Saturday 4 May 2019

চন্দ্রকান্তমণি

চন্দ্রকান্তমণি- (c) Anindita Bhattacharya

“দুধ ম্যাডাম”।
“  থ্যাঙ্কস্ এডওয়ার্ড। ” আশি বছরের মিস মার্থার দুচোখে ফুটে উঠল পরম বিশ্বাস। ফুটবে নাই বা কেন? বিগত ছাপ্পান্ন বছর ধরে এই একই রুটিন চলে আসছে। প্রতিরাতে আমি একগ্লাস উষৎ উষ্ণ দুধ এনে দি ম্যাডামকে।  দুধ ছাড়া ওণার ঘুম আসেনা। এই গডউইন কাসলের বিশ্বস্ত বাটলার আমি এডোয়ার্ড অস্টিন। ম্যাডামের সব অভ্যাস, পছন্দ, অপছন্দ আমার নখদর্পনে। ম্যাডাম আমায় চোখ বন্ধ করে ভরসা করেন। কেনই বা করবেন না,বিগত ছাপান্ন বছরে একটাও অবিশ্বাসের কাজ করেছি আমি? আজ ছাড়া।
মাপ করে দেবেন ম্যাডাম। মাপ করে দেবেন মৃত শ্রী এবং শ্রীমতী গডউইন। ওণাদের পবিত্র আত্মা শান্তি পাক। ওণাদেরও পরম স্নেহভাজন ছিলাম যে আমি। গডউইনদের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে গিয়ে কবে যে ঝড়ে গেল যৌবন,তার হিসেব রাখিনি। আমি নির্লোভ বিশ্বস্ত বাটলার এডোয়ার্ড অস্টিন, আজ করে বসেছি এক চরম অন্যায়।কিন্তু আমি নিরুপায়।
যেদিন থেকে নতুন অথিতির প্রবেশ ঘটেছে এই গডউইন কাসলে, আমি বোধহয় পাগল হয়ে গেছি।

মিঃ মার্কাস এসে যখন একান্তে কথা  বলছিলেন, ম্যাডামের উচিৎ হয়নি আমাকে ডাকা। কেন যে ডাকতে গেলেন। মিঃ মার্কাস মোটেই স্বচ্ছন্দ বোধ করছিলেন না। আমিও না। ম্যাডামের অনুরোধে ঢেঁকি গিললাম দুজনে। মিঃ মার্কাসের পরিচয়টা দিতে ভুলে গেছি বোধহয়, বয়স হলে এমনি হয়। মিঃ মার্কাস হলেন জেনকিন্স পরিবারের উকিল। জেনকিন্স আর গডউইনরা সম্পর্কে আত্মীয়। আত্মীয়তা যদিও বহুদূরের। তা জেনকিন্স পরিবারের শেষ উত্তরাধিকারী তথা ম্যাডামের কাজিন মিঃ উইলিয়াম জেনকিন্স সম্প্রতি মারা গেছেন। উইলের বয়স বেশী নয় কিন্তু। বছর ২৩-২৪। কি যে হয়েছিল, বোধহয় মানসিক বিষাদে ভুগছিলেন। ঠাকুরদার বিশাল দোনলা বন্দুকের নলটা গলার নলিতে ঠেকিয়ে টিপে দেন ট্রিগার। দুম্।
উইল একা নয়। জেনকিন্সদের বিষাদের ইতিহাস আছে বাবু। উইলের ঠাকুরদা মিঃ জেমস্ জেনকিন্স, উনি আর্মির বড় অফিসার ছিলেন। কর্মসূত্রে ওণাকে পাড়ি দিতে হয় সুদূর ভারতবর্ষ।  অনেক নেটিভ ভারতীয় রাজ্যের বিরুদ্ধে বৃটিশ আর্মিকে উনি নেতৃত্ব দেন। শত্রুপক্ষকে নির্দয় ভাবে কচুকাটা করার বদনাম বা সুনাম ছিল ওণার। ইন্ডিয়ান পুরুষ বা নারী ছিল ওণার দুচক্ষের বিষ।শিশু থেকে বৃদ্ধ,  পুরুষগুলোকে কচুকাটা করতেন, আর নারীদের-। এই বিরাশি বছর বয়সে এটুকু বলতে পারি, ভারতীয় নারীদের ওণার ছিটেফোঁটাও পছন্দ ছিলনা। তবে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নির্দয় ভাবে তাদের উপভোগ করার মধ্যে একধরণের পৈশাচিক আনন্দ পেতেন মিঃ জেমস্। বলতে পারেন জাতিশ্রেষ্ঠত্বের অহংকার তৃপ্ত হত ওণার।তবে অভিজাত বিজিত রমণী ছাড়া কাউকে স্পর্শ করতেন না তিনি। রাণী/বেগম বা রাজপরিবারের রমণীদের ধর্ষণ করে তীব্র জাতিশ্রেষ্ঠত্বের শ্লাঘা অনুভব করতেন তিনি। ওণার অত্যাচার আর নিষ্ঠুরতার গল্প ছিল কিংবদন্তী। পৌঁছেছিল খোদ ইংলণ্ডেশ্বরীর কানেও। কোম্পানী ওণাকে বাঁচাতে কম অর্থব্যয় করেনি। কিন্তু লাভ হয়নি। কথিত আছে একজাহাজ সোনা-দানা-হিরে জহরৎ নিয়ে ফিরে আসেন মিঃ জেমস্ জেনকিন্স। তারপরই কি যে হয়,বছর পাঁচেকের মধ্যেই ঐ একই দোনলা বন্দুক দিয়ে নিজেকে শেষ করে দেন তিনি। ঠিক ঐ একই ভাবে। যেভাবে ওণার নাতি উইল শেষ করেছিল নিজেকে।
উইলের অবশ্য আত্মহত্যা করাটা অস্বাভাবিক না। চোখের সামনে রাতারাতি টাকার কুমির থেকে পথের ভিখিরি হয়ে গেল জেনকিন্স পরিবার।মিঃ জেমসের লুট করে আনা অত ভারতীয় ধনরত্ন যে কিভাবে নিঃশেষিত  হয়ে গেল তা আজও লণ্ডনের অভিজাতদের বিস্ময়।  কিভাবে যে এরা টাকা ওড়ায়,  তা আমার মত সাধারণ ইংরেজ বাটলার কল্পনাও করতে পারবে না। শুধু কি তাই? কতগুলো মৃত্যু ঘটল জেনকিন্স পরিবারে,গুণে শেষ করা যাবে না। বলতে গেলে সব অপঘাতে মৃত্যু।
এমনিতে যে জেনকিন্স আর গডউইন পরিবারের সম্পর্ক মধুর,তা বলা যায় না। বিগত শত বছরে কেউ কারো মুখ দেখেনি। কিন্তু জেনকিন্সদের আপন বলতে তিনকুলে আর কেউ নেই,তাই উইলের মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি ম্যাডামের ভাগ্যে জুটেছে।

দাঁড়ান। দাঁড়ান। সম্পত্তি বলতে আপনারা কি ভাবছেন? বলেছি না জেনকিন্সরা কপর্দকশূন্য।সদ্য আত্মঘাতী উইলের বাড়িটাও বন্দক। আর ছাড়াবার সামর্থ্য গডউইনদের নেই। ম্যাডামও উকিল বাবুকে তাই বোঝাচ্ছিলেন। আমায় ডাকলেন সাক্ষ্য দিতে। শুঁড়ির সাক্ষী মদ্যপ আরকি।
উকিল বাবু বিরক্ত হয়ে উঠে গেলেন। যাবার আগে ম্যাডামকে একটা টিনের কৌটো আর একটা চিঠি দিয়ে গেলেন। পাতি গোল টিনের কৌটো। গায়ের রঙটাও উঠে গেছে। ম্যাডামের নির্দেশে আমিই খুললাম। খালি।
খালি তো হবারই কথা ম্যাডাম। উইল আপনার তুতো কাজিন হতেই পারে। তাই বলে সে যে পথের ভিখারি তা নিয়ে তো কোন দ্বিমত নেই?ফেলে দিতে চাইলাম কৌটোটা। নোংরা টিনের কৌটো। ইন্ডিয়ায় তৈরি।গায়ের লাল সোনালী হাতি ঘোড়া বিবর্ণ। রঙ চটা।  ম্যাডাম দিলেন না। পরের দিন আটেক শুধু ঐ কৌটো আঁকড়ে পড়ে রইলেন ম্যাডাম। না না ধারালো যন্ত্র দিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করছিলেন কৌটোটাকে। করতে করতেই একদিন টপ করে খসে পড়ল ম্যাডামের কোলে। পায়রার ডিম?না না দরজার নবের মত প্রকাণ্ড একটুকরো পাথর। পূর্ণিমার চন্দ্রের মত সৌম্য তার কান্তি। মুহূর্তে ফায়ার প্লেসের আগুনে চকমক করে উঠল। ছিটকে বেরোল তার দ্যুতি। এক টুকরো দ্যুত্যি প্রতিফলিত হল মোর মুখমণ্ডলে। পলকে যেন প্রগাড় শান্তি নেমে এল মোর শিরা ধমনীতে। এই তো সে। আমার মোক্ষ।
ম্যাডাম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিলেন। দেখছিলাম আমিও। ম্যাডাম যেই তাকে ড্রয়ারে রাখতে যাবেন,খপ করে চেপে ধরলাম ম্যাডামের হাত। না। না। না। এ পাথর,এই মণি শুধু এডোয়ার্ড অস্টিনের। জীবনে আমার এইরূপ দেখেননি ম্যাডাম।আমিওকি ম্যাডামের এইরূপ দেখেছি? দুই নরপিশিচের মত ঝাপটাঝাপটি করছিলাম আমরা। দুজনের মুখদিয়েই বেরোচ্ছিল রক্তজল করা আওয়াজ,“দেঁ-দেঁ-দেঁ। এই মঁণি আঁমার”। ডেইজি, ম্যাডামের সেক্রেটারি দৌড়ে এসেছিল আমাদের অতিপ্রাকৃত চিৎকারে। “এ কি?” চিৎকার করে উঠেছিল ডেইজি। পলকে যেই তাকালাম ডেইজিরর দিকে, আলগা হল মুঠি, খপ্ করে মণিটা কেড়ে নিলেন ম্যাডাম। আর তারপর পাশে রাখা ওয়াকিং স্টিকটা তুলে নিয়ে বসিয়ে দিলেন সপাৎ করে এক বাড়ি। মাথা কেটে ঝরঝর করে ঝরতে লাগল রক্ত। সম্বিত ফিরে পেলাম ম্যাডাম আর আমি। সামলে নিলাম দুজনেই। ছুটে বেরিয়ে গেলাম ম্যাডামের ঘর থেকে। পিছন পিছন দৌড়ে এল ডেইজিও।
এরপর কেটে গেছে একপক্ষ। নিজের ছন্দে ফিরেছে গডউইন কাসল। ম্যাডাম ক্ষমা করে দিয়েছেন আমাকে। ক্ষমা চেয়েওছেন। আমি শুধু জানতে চেয়েছি,“ওটা কি ছিল ম্যাডাম?ওটা কোথায়?” জবাবে ম্যাডাম বলেছেন,“ওটা নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না এডওয়ার্ড। খুব যত্নে রেখেছি ওকে। ও মণি আমার শেষ বয়সের পরম প্রাপ্য। জানো ভারতীয়রা কি বলে ওকে? চন্দ্রকান্তমণি। ”
চন্দ্রকান্তমণি! হ্যাঁ ঐ চন্দ্রকান্তমণি,  শুধুই এডওয়ার্ড অস্টিনের। বিগত একপক্ষ ধরে ফিসফিস করে কত কথা বলেছে সে আমার সাথে। ম্যাডাম ভাবছেন এডোয়ার্ড জানে না,চন্দ্রকান্তমণি কোথায় লুকানো আছে,কিন্তু ম্যাডাম জানেন না, চন্দ্রকান্তমণি স্বয়ং অহর্নিশ ঘোষণা করে চলেছে কোথায় আছে সে। আজ অমাবস্যা। ইন্ডিয়ান ফেরিওয়ালাটা বলছিল, এই অসুধের গুণ অমাবস্যায় ভালো খোলে। ম্যাডাম এখনও জানেন না, ৫৬বছরের বিশ্বস্ত এডওয়ার্ড ম্যাডামের দুধে মিশিয়েছে গুণে গুণে ছটা গুলি-। এডওয়ার্ড তো একটাই দিতে চেয়েছিল,চন্দ্রকান্তমণিই বলল,“আরো দে। আরো। আরো। আরো। ”
(চলবে?)
চন্দ্রকান্তমণি পর্ব-২

দুধের গ্লাস শেষ হতে না হতেই,ম্যাডামের মাথাটা হেলে পড়ল বালিশের ওপর। মুখমণ্ডল  থেকে ধীরে ধীরে মুছে গেল সজীবতার উষ্ণ লালিমা। ধিকিধিকি ফায়ার প্লেসের আগুন ছাড়া কেউ জানল না। বাইরে তখন ঝিরিঝিরি তুষারপাত হচ্ছে। আজ ঠাণ্ডাটা বড় জব্বর। পশমী কম্বল টেনে দিলাম,ম্যাডামের গলা অবধি। ফায়ারপ্লেসের আগুনের প্রশয়ে লুকোচুরি খেলছে আলোআঁধার। দেরাজের চাবি ম্যাডামের বালিশের নীচে থাকে। দেরাজের ভেতরে তন্নতন্ন করে খুঁজছি, কোথায় সে? জামাকাপড়ের  আবডালে লুকানো ফোকরে। নেই। বুকশেল্ফে মূল্যবান চামড়া দিয়ে বাঁধানো সোনার জলে নাম লেখা শতশত বই,টান মেরে মেরে ফেলে দিলাম মাটিতে। নেই। ম্যাডামের ডেস্ক তোলপাড় করে ফেললাম।  নেই।  সব টানা ড্রয়ার খুলে তছনছ করে ফেললাম। নেই । নেই নেই কোথাও নেই। আবেগে থরথর করে কাঁপছি আমি। হঠাৎ ম্যাডামের কাঁপা কাঁপা গলা ভেসে এল-“এডওয়ার্ড মণি খুঁজছ?ঐ মণি অভিশপ্ত।” চমকে তাকিয়ে দেখি, ম্যাডাম আবার পূর্ববৎ নির্জীব হয়ে পড়েছেন। ঝাঁপিয়ে পড়লাম। না। না। না। এভাবে আমাকে ফাঁকি দিতে দেবো না। বলো কোথায় আমার মণি? ম্যাডাম একই রকম নির্জীব হয়ে পড়ে রইলেন। নিষ্প্রাণবৎ। কিন্তু আমি জানি, সব ম্যাডামের অভিনয়। পাশ থেকে বালিশ তুলে চেপে ধরলাম ম্যাডামের মুখে,এতটুকু প্রতিবাদ করলেন না ম্যাডাম।শরীর ইতিমধ্যেই বরফের মত ঠান্ডা।  মৃতের আবার শ্বাস নেবার কি প্রয়োজন। কিন্তু এই মাত্র যে কথা বললেন ম্যাডাম?
পিছন থেকে চিৎকার করে উঠল এক মহিলাকণ্ঠ। চমকে তাকিয়ে দেখি ডেইজি। ম্যাডামের সেক্রেটারি। ডেইজি নীচের ঘরে শোয়। হয়তো আমিই মালপত্র টানাহেঁচড়া  করতে গিয়ে বেকার শব্দ করে বসেছি। ডেইজি চিৎকার করেই চলেছে, ঝাঁপিয়ে পড়তে গেলাম ডেইজির দিকে। ঝলঝলে রাতপোশাক গুটিয়ে দৌড়ল ডেইজি, সমানে চিৎকার করছে বাঁচাও। বাঁচাও।
ইদানিং ম্যাডামের সব চিঠিপত্র,কাগজ,দস্তাবেজ সামলায় ডেইজি। নির্ঘাত মণিটা ওর হেফাজতেই আছে। মণি আমার চাই। মণি আমায় ডাকছে। সিঁড়ির বাঁকে ধরে ফেললাম ডেইজিকে, সপাটে এক চড়। ছিটকে নীচে পড়ল ডেইজি। সিঁড়ির রেলিংএ ঠকাস করে ঢুকল মাথাটা। ঘাড়টা কেমন যেন খড়ভরা পুতুলের মত বেঁকে গেল। চোখ খুলেই পড়ে রইল ডেইজিই লাশ। দুচোখে সীমাহীন আতঙ্ক। আমার বিরাশি বছরের বুড়ো শরীর এবার জবাব দিচ্ছে। হাপরের মত হাঁপাচ্ছি। হাঁটুগুলো এবার ভেঙে পড়বে মনে হচ্ছে। টলতে টলতে কোনমতে নামলাম,ডেইজির মৃত শরীরটাকে ডিঙিয়ে ঢুকলাম ওর ঘরে। এইঘরটা বেশ ঠাণ্ডা। ফায়ারপ্লেসের আগুন নিভু নিভু। হাঁপাতে হাঁপাতে তোলপাড় করছি ডেইজির  ডেস্ক। ডেইজির দেরাজ। তোরঙ্গ-।
এ বাড়ির বড় ঘড়িতে ঢং ঢং করে চারটে বাজল। আর কত খুঁজব তোকে মণি। পড়ে আছে দোতলা একতলায় দুদুটো লাশ। রীতিমত ভয় করছে এবার। আর তিন চার ঘন্টা পরেই ফর্সা হবে আকাশ। হয়তো রোদ উঠবে না। তাই বলে এবাড়ির দাসদাসীরা কাজে আসবে না? হঠাৎ মনে হল, ডেইজির শৌচালয়টা একবার দেখি-
একহাতে দেওয়াল গিরি নিয়ে ঢুকলাম ডেইজির শৌচালয়ে। সাবান রাখার জায়গায় একগাদা নুড়ি পাথর। কেন?
ধুচ্ছি প্রতিটি পাথর। ডেইজির শৌচাগার কি অসম্ভব ঠাণ্ডা। বাইরে বোধহয় ঝড় উঠল, মেথর আসার দরজাটা ঠকঠকিয়ে চমকে দিল আমায়। মিথ্যা। মিথ্যা। সব মিথ্যা। এগুলো নিছক পাথর। আমার মণি কই? আমার চন্দ্রকান্তমণি? সে যে আমায় ডাকছে- আমার বুড়ো ধমনীতে তীব্র হচ্ছে রক্তের বেগ। টলতে টলতে রান্নাঘর থেকে বিশাল ছুরি নিয়ে ফিরে এলাম। ফেড়ে ফেলছি ডেইজির বালিশ- তোশক। নেই। নেই। তবে কি ম্যাডামের কাছেই? বেরোতে যাব, চোখ পড়ল মেজেতে পড়ে থাকা ডেইজির তোরঙ্গের ওপর। ভিতরের জিনিসপত্র লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ে আছে মাটিতে। তোরঙ্গটা বেশ পুরোনো, বিবর্ণ, চামড়া ফেটে গেছে কয়েক জায়গায়।  কিন্তু বেশ দামী চামড়া। এ জিনিস ডেইজির হতেই পারে না। অনাথ আশ্রমে বেড়ে ওঠা সেক্রেটারিকে ম্যাডামই দিয়েছিলেন দয়াপরবশ হয়ে। ভিতরে দামী শাটিনের আস্তরণ, দেওয়াল গিরির মরা আলোতেও ঝিলিক দিচ্ছে গোলাপী শাটিন। যদিও তাও ছেঁড়া। তাপ্পি মারা। কাঁপা কাঁপা হাত বোলাচ্ছি তোরঙ্গের শাটিনের আস্তরন বরাবর। কি যেন একটা আছে ভিতরে, গোল মত,দরজার নবের মত।
আমার মণি। বরফের মত শীতল। তবু তাকে ওষ্ঠে ছোঁয়ানো মাত্র উষ্ণতার স্রোত বয়ে গেল বুড়ো শরীরে। কি তীব্র মায়া। ম্যাডাম,ডেইজিকে মারতে এতটুকু হাত কাঁপেনি আমার। প্রয়োজনে আবার মারতে পারি। মরতেও পারি। দেওয়ালগিরির আলোতে কেমন যেন ম্রিয়মান লাগল মণিকে। কি হয়েছে রে মণি তোর? সেদিন তো রূপে ঝলমল করছিলি,আজ এমন শীতল কেন?
“কারণ সেদিন ছিল পূর্ণিমা। আর আজ অমাবস্যা। চন্দ্রের ক্ষয় এবং বৃদ্ধির সাথেই বাড়তে বা কমতে থাকে মণির দীপ্তি। তাই তো এর নাম চন্দ্রকান্তমণি-”।  কে যেন বলে উঠল পিছন থেকে। চমকে ফিরে তাকালাম, পিছনে দাঁড়িয়ে আব্দুল। এ বাড়ির মেথর বলতে পারেন। আব্দুল শৌচাগার সাফ করে, মাথায় করে বয়ে নিয়ে যায় বর্জ্য পদার্থ। পিছনের লোহার সিঁড়ি দিয়ে উঠে, চেম্বারপট সাফ করে, নীরবে নেমে যায়। মূল কাসলে কখনও প্রবেশ করে না। আজ এই ভোর রাতে আব্দুল,ডেইজির ঘরে কি করছে?নিশ্চয় শৌচাগারের মেথর দরজা দিয়ে ঢুকে এসেছে। বাগিয়ে ধরলাম ছুরি,দুটোকে নিকেশ করেছি। আর এটাতো কালো ইন্ডিয়ান। পুলিশ জানবে,অর্থের লোভে আব্দুলই মেরেছে, ম্যাডাম আর ডেইজিকে। আর বুড়ো এডওয়ার্ড মেরেছে আব্দুলকে- ।
(চলবে?)

Monday 25 February 2019


তুত্তুরীর বুজু সরস্বতী পুজো হবে, তানিয়া মাসি আর রমেশ মামা মিলে অনেক ঝাড়াই বাছাই করে প্রকাণ্ড দর দস্তুর করে কিনে তো দিল।গাড়িতে তোলার সময় রমেশ বলেও দিল পইপই করে,“ম্যাডাম ওকে ভালো করে কোলের কাছে নিয়ে বসুন। পড়ে না যায়। ” বুজু সরস্বতী বলে কথা, বাবা! বড় ছটপটে।
গাড়ি যায়, গাড়ি যায়, আচমকা কোথা থেকে যে এক লক্কড় মার্কা বাইকওলা গাড়ির সামনে এসে উদয় হল, ঘচাং করে ব্রেক কষল আমাদের সুশান্ত। যাকে আমি বিগত কয়েক মাস ধরে প্রশান্ত বলে ডেকে আসছি, এবং সেও বিনা আপত্তিতে “হ্যাঁ ম্যাডাম” বলে সাড়া দিয়ে আসছে।
কৃতঘ্ন বাইকওলা প্রাণ বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ দূরে থাকুক, চারটি গালাগাল দিয়ে পগার পার। সুশান্ত সম্প্রদায়গত ভাবে  সাঁওতাল,এবং জাতবৈশিষ্ট্য বজায় রেখে নিখাদ সরল এবং সাদাসিধে। এই যদি আমাদের পুরানো ড্রাইভার রাজীব বা বিপ্লব হত, বাইকওলার কপালে দুঃখ ছিল।
যাক বাইকওলা তো পগারপার, সুশান্ত এবং আমি হতভম্ব আর বুজু সরস্বতীর সুউচ্চ চালচিত্র, ঠিক চায়ে ডোবাতে যাওয়া মারি বিস্কুটের মত দুখণ্ড। কি হবে এবার? ভাঙা ঠাকুরে কি পুজো হয়?
 গাড়ি তখন নিবেদিতা সেতুতে। একবার ভাবলাম দিই গঙ্গায় ভাসিয়ে। বাড়ির পাশের বাজার থেকে কিনে নেব খন একটা। শ আড়াই টাকা জলে গেল, এই যা দুঃখের। ভাবলাম বটে, কিন্তু ফেলতে পারলাম না। কেমন কোল ঘেঁষে বসে আছে দেখ, যেন একটা ছোট্ট মানুষ। মায়ের ওমে খুঁজছে নিরাপত্তার আশ্বাস। কি করি?
আমার থেকে মন খারাপ সুশান্তর,“কি হবে ম্যাডাম? আমার গাড়িতে ভেঙে গেল ঠাকুরটা?ইশ্। ” বেচারার কষ্ট দেখে ফোন করলাম আমার বুড়োকে, বৃদ্ধ যদিও নাস্তিক, তবে কন্যার জন্য, রামকৃষ্ণ দেবের ভাষায়, “ দুগ্ধ এবং তামাক” উভয়ই সেবনে সক্ষম। মায়ের হাতে বাননো এক কাপ গরম চায়ে, পরম তৃপ্তির চুমুক মেরে বলল, “ধুর!ধুর! ফেলে দিবি কেন? মনে নেই, রাণী রাসমনিকে কি বলেছিলেন রামকৃষ্ণদেব? পরিবারের কারো হাত-পা ভাঙলে তাকে ফেলে দিবি? ফেভিকুইক দিয়ে জুড়ে দে না। ”
সুশান্তর যেন ধড়ে প্রাণ এল,“গাড়িতে একটা ফেভিকুইক আছে ম্যাডাম। কিনেছিলুম। আপনি নিন।” তাই করলাম। কি গন্ধ বাপস্। চোখে জল এল। কিন্তু বুজু সরস্বতীর চালচিত্র তো জুড়ল না বাপু। সুশান্ত কাতর স্বরে বলল,“ম্যাডাম, ওকে কোলে নিয়ে বসুন। শুকনো মাটি তো তাই হুহু করে আঠা টেনে নিচ্ছে। আপনাদের বাড়িতে মাটি নেই ম্যাডাম? একটু এঁটেল মাটি ডেলা করে জুড়ে দিলেই আটকে যাবে। ” শহুরে আবাসনে বিশাল বাগান, প্রচুর গাছ, কিন্তু মাটি কোথায় পাই?
সুশান্তর বিশ্বাস হয় না। ম্যাডামের বাড়ি মাটি নেই? শেষে বলে “আপনি দুঃখ করবেন না ম্যাডাম, একটা দোকান দেখে দাঁড়াব, আর একটা ফেভি কুইক কিনে দেখা যাক না?” বেলঘড়িয়া এক্সপ্রেস ওয়েতে কোথায় ফেভি কুইক পাবি বাবা? খানিক গিয়ে ঘচাং করে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। সামনে একটা মার্বেলের মূর্তির দোকান,“একটু বলে দেখব ম্যাডাম? যদি ওরা জুড়ে দেয়?” কাল বাদে পরশু সরস্বতী পুজো, অনেকে তিথিগত ভাবে কালই করবে, এখন কার দায় পড়েছে, সুশান্তর ম্যাডামের মেয়ের বুজু সরস্বতীর চালচিত্র জুড়তে বসবে। ছেলেটা শুনলে তো?
কি বলল, কি শুনল কে জানে, ফিরে এসে বলল, “দিন ম্যাডাম, ওরা দেখতে চাইছে।” কোলে করে নবজাতকের মত বুজু সরস্বতীকে নিয়ে গেল হাইওয়ের পাশের ঢালে। কালো প্লাস্টিক টাঙানো দোকানে থরে থরে দাঁড়িয়ে আছেন নানা দেবদেবী- মহাপুরুষের দল। সময় আর কাটে না। বেলঘড়িয়ার নচ্ছার মশার দল বার কয়েক আক্রমণ করে হাফ লিটার রক্ত শুষে নিল। তারপর দেখি সুশান্ত আসছে, কোলে বুজু সরস্বতী।পিছন পিছন দোকানের মালিকও উঠে এসেছে। “মার্বেলের গুঁড়ো দিয়ে জুড়ে দিয়েছি দিদি। চিন্তা নেই। ” সুশান্ত বলল,“ম্যাডাম ওরা কিছু চায়নি, কিন্তু ২০-৩০টা টাকা দেবেন?” দিতে গেলাম-কিছুতেই নেবে না। কে বলে ভালো মানুষ নেই? শেষে সুশান্ত করজোড়ে বলল,“নিন না দাদা,ম্যাডাম ভালোবেসে দিচ্ছেন, চা খাবেন খন। নাহলে ম্যাডাম দুঃখু পাবে। ”
গাড়ি গড়াল। খুব লজ্জা লাগছিল, দিন কয়েক আগেই সুশান্তকে বলা হয়েছে মার্চ মাস থেকে অন্য গাড়ি নেব আমরা। ঝাঁ চকচকে নতুন গাড়ি। বাতাসে সাথে কথা বলে- তার আগে জিজ্ঞাসা করেছিলাম বটে,“সুশান্ত তোমার আপত্তি নেই তো?” সরকারি রেটে ভালো গাড়ি পাওয়া যায় না। এত ভালো গাড়ি কি ছাড়া যায়? অরিন্দম বাবু বললেন,“সুশান্ত ম্যাডামকে বলো, না ম্যাডাম আমিই থাকব। ” সাঁওতালরা কবে আবার মনের কথা খুলে বলতে পারে? মাথা নত করে সুশান্ত বলেছিল,“ম্যাডামের যাতে সুবিধা হয়। ” আর আজ ছেলেটা আমার মেয়ের শখের ঠাকুরের জন্য এতখানি দৌড়দৌড়ি করল। আমার বাড়ি ঢুকতে রাত নটা বাজবে। ও কটায় পৌঁছবে কে জানে?
 মনস্থির করে নিলাম, জন্মগত ভাবে আমি চাটুজ্জে, আর চাটুজ্জেরা স্বভাবতঃ  আবেগপ্রবণ। এতখানি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিততে পারে এমন দামী গাড়ি কেউ বানাতে পারে নাকি? বললাম,“সুশান্ত,খুব দুঃখ হয়েছে বাবা?ম্যাডাম ছেড়ে দেবে বলেছে বলে?” খোলা জানলা দিয়ে হুহু করে ঢুকছে হাওয়া, সুশান্ত বেশ খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল,“হ্যাঁ ম্যাডাম। বড় বাজে সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আপনার ঐ গাড়িটা পছন্দ ম্যাডাম? একটু সময় দিন। দরকার হলে এটা বেচে ঐ গাড়িটা কিনব। আপনি লোনের ব্যবস্থাটা একটু করে দেবেন শুধু। ” প্রসঙ্গতঃ লোন মানে গতিধারা।
কবে গাছে কাঁঠাল পাকবে সেই আশায় আমরা এএলসি আর ড্রাইভার গোঁফে তেল মাখতে মাখতে বাড়ি ফিরলাম। শৌভিককে বলা ছিল, নীচে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল বুজু সরস্বতীকে কোলে করে ওপরে নিয়ে যাবে বলে। সুশান্তর কিছুতেই ভরসা হয় না। “ম্যাডাম আমি বরং দিয়ে আসি। ” বললাম তুই বাড়ি যা বাবা। যাবার আগে, কান চুলকে বলল,“ম্যাডাম আমাদের গ্রাম পঞ্চায়েতে একটা ক্যাম্প করবেন? আমাদের লোকগুলো ভালো জানে না,সামাজিক সুরক্ষা যোজনা সম্পর্কে। আমাদের বাড়ির মেয়ে-ছেলে গুলোও একবার আপনাকে আর স্যারকে(সুখেন বর্মন) দেখতে চায়।যাবেন ম্যাডাম?” এ আর এমন কি? গিয়েছিলাম আজ পাণ্ডুয়ার শিখিরা-চাঁম্পতা গ্রাম পঞ্চায়েতে। অজ গ্রাম যাকে বলে। সবুজ ধান ক্ষেত, পেকে ওঠা আলু ক্ষেত, বকুলের ভারে নুয়ে পড়া আমগাছ, তেঁতুল গাছ, ডোবায় চরে বেড়ানো হাঁস, অযতনে বেড়ে ওঠা, পুকুর পাড়ের রক্তজবা  দেখে মোহিত হয়ে গেলাম। ৩৫০ফর্ম পড়ল পটাপট। আরো জমা পড়ছে,আমরা বেরিয়ে এলাম।অনেকটা চলে আসার পর সুশান্ত বেজায় ঢোঁক গিলে বলল,“বাড়ির মেয়েছেলে গুলো সেজে গুজে বসেছিল ম্যাডাম।আপনি যাবেন বলে। এখন হল্লা করছে। ” তো আগে বলবি তো বাবা। জবাব পেলাম,“আপনি ব্যস্ত ছিলেন না ম্যাডাম-”। এই না হলে আমাদের সুশান্ত!

Sunday 30 December 2018

সব চরিত্র কাল্পনিক


তো যা বলছিলাম আর কি, আমাদের স্কুলের নাম ছিল তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবন।অবশ্যই বাংলা মিডিয়াম, আশি-নব্বইয়ের দশকে মধ্য হাওড়ার সেরা গার্লস স্কুল ছিল আমাদের বিদ্যালয়। আজও আমাদের মত প্রাক্তনীরা নিজেদের তারা বলে পরিচয় দিতে অত্যন্ত শ্লাঘা বোধ করি।
তো এইরকম জনাকয়েক তারাদের একটা গ্রুপ আছে। হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপ। সদস্য সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। চট করে সেখানে কোন নতুন সদস্যকে আমরা সংযোজিতও করতে চাই না।কারণ আর কিছুই নয়, আসলে এই গ্রুপে আমরা সকলে বড় বেশী অকপট। গালাগালির কোন রাখঢাক নেই,বরং শালীন ভাষায় সুচারু ভাবে নিজের বক্তব্য পেশ করতে গেলে অনেক সময়ই উদোম খিস্তি খেতে হয়। পাতি কলতলার ঝগড়া মার্কা ঝগড়াও হয় মাঝেসাঝে, কলহরতারা ছাড়া বাকিরা তখন নারদ নারদ জপি। “নারদ নারদ খ্যাংড়া কাঠি,লেগে যা নারদ ঝটাপটি।” অনেকেই তাদের বরকে নিয়ে,ইয়ে মানে বরের শারীরিক সমস্যা,শীতলতা ইত্যাদি নিয়ে খোলাখুলি ঘ্যানঘ্যান করে, সহকর্মী বিশেষ করে ওপরওয়ালাদের গুষ্টি উদ্ধার করে। এ ব্যাপারে অবশ্য সবথেকে সোচ্চার আমাদের চয়ন। চয়নের পূর্বের বস ছিলেন এক ভয়ানক সুদর্শন হরিয়ানভি জাট, কিন্তু চয়নের কেন যে তাকে অপছন্দ  ছিল কে জানে?দিনের শুরুটাই চয়ন করত, “সাতসকালে শালা আমার হারামি বস্ মেসেজ করল,দিনটাই খারাপ যাবে বা-। ” চয়ন যখন চাকরী ছেড়ে অন্য ফার্মে গেল, আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম,যাক “হারামি বস্” এর হাত থেকে রেহাই পেল গ্রুপটা। ও বাবা,কিছুদিন বাদেই বস্ ফেরৎ এলেন গ্রুপে,ইনি অবশ্য বাঙালী এবং মহিলা, তাতে কি? চয়নের মতে ইনি নাকি  “রক্তচোষা হারামি বস্। ”বস্ নাকি যাকে পায় তার সঙ্গেই সটান শুয়ে পড়ে। দুপুরে টিফিন বক্স খোলার সাথে সাথে হোয়াটস্অ্যাপ খুললেই হুড়মুড় করে ঢোকে চয়নের মেসেজ,“মালটা এই ঢুকল। কার সাথে ইয়ে করতে গিয়েছিল কে জানে?দুটো জুনিয়রকে দুবগলে নিয়ে ঢুকলেন তিনি। পঞ্চাশ বছুরে বুড়ি জামাকাপড় পরেছে দেখো না! কালো স্প্যাগেটি টপের ওপর স্বচ্ছ সাদা শার্ট। সব দেখা যাচ্ছে মাইরি। মালটাকে এই চোদ্দ তলা থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেব?” হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে যায়।

তো যাই হোক এই খোলাখুলি আলোচনা গুলিকে জিইয়ে রাখার স্বার্থে আমরা গ্রুপে নতুন সদস্য সংযোজনে ভয়ানক নারাজ। এর আগে তুলিকা আর হৈমন্তীর পেড়াপিড়িতে দুই তারাকে সংযোজন করা হয়েছিল। তাদের একজন বিশ্বসংসারে বলে বেরিয়েছিল, “চয়ন,সঞ্চিতা,মৌটুসি আর অনির কি মুখ খারাপ। উঃ মাগো কি অশ্লীল কথাবার্তা বলে।” মাইরি বলছি আমাদের আঙুল খারাপ হলেও মুখটাকে আমরা যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে রাখি। আরেক তারাতো বেছে বেছে শুধু তাদের সাথেই কথা বলত, যাদের বা তাদের বরেদের বাড়ি-গাড়ি এবং ব্যাঙ্কে লক্ষাধিক টাকাপয়সা আছে। সে কি কেলো বাপরে! বাকিদের সাথে মামুলী কুশল বিনিময়েও তার ঘোর আপত্তি।  বারবার ভদ্রভাষায় বলেও তাদের সংশোধন করা গেল না,তখন চয়ন পার্সোনাল মেসেজে আমার গুষ্টি উদ্ধার করে বলল,“হঠা শালা শাঁখচুন্নি দুটোকে। ”

সেই শেষ। বিগত দু বছরে তুলিকা অন্তত বাহান্ন বার সাড়ে পঞ্চাশ জনকে সংযোজন করতে বলেছে, আমরা করিনি। পাছে তুলিকা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে করে বসে,এই আশঙ্কায় আমরা তুলিকাকে অ্যাডমিন পব থেকেই সরিয়ে দিয়েছি।

নতুন সদস্য সংযোজনে আমার আর চয়নের এই আপত্তি অবশ্য ধোপে টিকল না, লাবু অর্থাৎ লাবণীর ক্ষেত্রে। তুলিকা কোন কথাই শুনল না। রীতিমত আল্টিমেটাম দিল,“লাবুকে অ্যাড না করলে আমিও থাকব না। মেয়েটা খুব বাজে সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, এই সময় যদি আমরা বন্ধুরা ওকে একটু সঙ্গ না দি, কে দেবে?” চয়ন তাও মিনমিন করে বলল,“তো যা না,বা-টা গিয়ে সঙ্গ দে। গ্রুপে অ্যাড করার কি আছে?” ঝাঁপিয়ে পড়ল হৈমন্তী আর নীলাঞ্জনা,“তুলির সাথে একমত। মেয়েটার খুব বাজে সময় যাচ্ছে। এই সেদিন বরটা মারা গেল,ঐ শোক না সামলাতে পেরে ওর মাও চলে গেলেন। একাহাতে মেয়ে সামলাতে নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে বেচারা। ওকে অ্যাড কর। দুটো প্রাণের কথা বলার কেউ নেইরে ওর। আমরা সবাই এত দূরে দূরে থাকি-। ”
সত্যি বলছি লাবুকে আমি,সঞ্চিতা বা চয়ন তেমন চিনতাম না। ও অন্য সেকশনে পড়ত। যতদূর মনে পড়ে,বেশ শ্যামলা লাজুক একটা মেয়ে,পড়াশোনায়ও অতি সাধারণ ছিল। এগারো ক্লাসে আমাদের স্কুলে আর সুযোগও পায়নি। হাওড়া গার্লস্ এ পড়ত। তারপর আর কোন খবর জানি না। আসলে লাবু,তুলিকা, হৈমন্তী আর নীলাঞ্জনা একই পাড়ার মেয়ে,ফলে ওদের মধ্যে বন্ধুত্বও একটু বেশী প্রবল। তো এ হেন লাজুক লাবুর জীবনের ওপর দিয়ে যে ইতিমধ্যে এত ঝড় বয়ে গেছে,সত্যি বলছি জানতাম না। বেশ সলজ্জ ভাবেই লাবুকে গ্রুপে অ্যাড করা হল।বেশ সেন্সরড্ ভাবে আলাপ-আলোচনা হল সেদিন গ্রুপে। কেউ তেমন মুখ খুলল না। কিন্তু যার জন্য এত সাবধানতা, সারাদিন সেই বাবুর পাত্তা নেই, অথচ যে যা লিখছে পড়ছে, এতো হেবি জ্বালা। পড়ে, খবর রাখে অথচ কিছু বলে না। তবে কি এও বাইরে খবর পাচার করবে?
গভীর রাতে লাবুর মেসেজ ঢুকল,“ভাই আমার এই বিপদের দিনে তোরা আমার পাশে দাঁড়ালি, অনেক ধন্যবাদ। সারাদিন তোদের সব মেসেজ আমি পড়েছি, বিশ্বাস কর। এত ভালো লাগছিল পড়তে। মনে হচ্ছিল বহুদিন পর প্রাণভরে নিশ্বাস নিচ্ছি। জবাব দেবার সময় পাইনিরে। আজ নাইট ডিউটি, সব পেশেন্ট আপাততঃ ঘুমোচ্ছে, তাই ভাবলাম এই ফাঁকে তোদের সাথে একটু কথা বলি। ভাই  তোরা সবাই বড় বড় চাকরী বাকরি করিস, যারা করিস না তাদের বরেরা করে, আমি ভাই ছাপোষা নার্স। তাও প্রাইভেট নার্সিং হোমে।নার্সিং পড়তে পড়তে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, ভাবিনি কোনদিন চাকরী করতে হবে। বেশ ছিলাম বর-মেয়ে সংসার নিয়ে। হঠাৎ কি যে হল। ব্যবসায় ধাক্কা খেয়ে বরটা- একবার আমার আর মেয়ের কথা ভাবলও না জানিস।”দীর্ঘক্ষণ নীরবতা। লাবু বোধহয় ব্যস্ত। কেউ কোন জবাব দিচ্ছে না। হয় ঘুমিয়ে কাদা,অথবা কি বা বলবে? এই তীব্র মনখারাপের বাতাস যেন বাতানুকূল যন্ত্র থেকে বেরিয়ে এসে পাক খাচ্ছে ঘরের মেঝেতে। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। ভোরবেলায় উঠে দেখি, লাবু লিখেছে,“সব কথা তোদের জানালাম। আমি খুব সাধারণ রে,বাড়ি-গাড়ি, টাকাপয়সা,গয়নাগাটি,রূপযৌবন,শিক্ষাদীক্ষা গর্ব করার মত আমার কিছুই নেই ভাই, আমায় তোদের দলে নিবি তো?” জবাবটা নিজস্ব কায়দায় দেখলাম চয়ন দিয়েছে সকলের হয়ে,“নিয়ে তো নিয়েইছিরে বা-টা।”
(চলবে)

Saturday 22 December 2018

অনির ডাইরি 22.12.18

২২/১২/১৮

সে সব দিন ছিল সাদাকালো। চোখে ছিল কি সব অসম্ভব স্বপ্ন। আবিষ্কার করেই ছাড়ব টাইম মেশিন। তারপর পাড়ি দেব সুদূর অতীতে অথবা অনাগত ভবিষ্যতে। কে সেই ব্যক্তি, যার সাথে বাঁধা আমার গাঁটছড়া? এদিকে ফুটো ছাতে বছর বছর সোডা-সিমেন্টের প্রলেপ পড়ে চলে, যদি বাধ মানে অবাধ্য বরষা। গরম কালে বিকাল হলেই পশ্চিম আকাশের মুখ ভার, বাবার মুখে বুড়ো নরওয়েস্টারের গল্প-খুনখুনে সেই যে বুড়ো, যার বিশাল দাড়ির আনাচে-কাঁনাচে লুকিয়ে থাকে পশ্চিমী হাওয়া, বুড়ো দাড়ি ছেড়ে দিলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে “কালবোশেখী”। সাবেকী বার্মাটিকের কাঠের পাল্লা রোদে জলে ভিজে প্রায় পাঁপড় ভাজা-কালবোশেখীর তাণ্ডব যেমন বাড়ে পাল্লা দিয়ে বাড়ে তার থরহরি কম্প। আর তারপর? উঠোন আর পশ্চিমের বাগান জুড়ে তিন ভাইবোনের হুড়োহুড়ি দিয়ে আম কুড়ানো। বিদ্যুতবাতি ততোক্ষণে ভোঁ কাট্টা। ডিসি কিনা,তাই জোরে হাওয়া দিলেই কেটে পড়ত তার। চিত্রহার-চিত্রমালা-ফরমান-দেখ ভাই দেখ-টুকুস করে লোডশেডিং। পাশের বাড়ির এসি কানেকশন-দিব্যি জ্বলজ্বলে, বিরক্ত চেপে জ্যাঠাইমা বলত,“এসিতো বড়লোকের কারেন্ট, তাই থাকে। আমাদের গরীব লোকের ডিসি কারেন্ট কি না-”। বড়দা পড়াতে বসলেই অবশ্য, মনেপ্রাণে প্রার্থনা জুড়তাম,“ হে ঠাকুর,দাও আলো নিভিয়ে। দাদা তো নয় যেন সাক্ষাৎ  থানার বড়বাবু। ” না মারত না কোনদিন,তবে জিভে যা ধার ছিল, তার থেকে দাদা দুঘা মেরেই দাও বরং। নিভত আলো, ছুটি থোড়াই দিত দাদা। বগলে করে মাদুর আর হাতে হ্যারিকেন নিয়ে ছাতে পড়তে বসা-।
লোডশেডিং এর রাতে ছাতে শোওয়া-ওঃ সে কি উত্তেজনা। সাথে সাথে জেঠুর ভূতের গল্প। হাড়ে হাড়ে ঠকাঠকি লেগে যেত।
অগ্রাণ মাসে নবান্ন। কাঁচা দুধে নলেন গুড় আর নতুন চাল,সাথে হরেক রকম ফলের টুকরো। জ্যাঠাইমার নবান্ন অতুলনীয়। বড়মাসি নবান্নে কাঁচা আদা দিত। কেন এত ভালো নবান্নকে মার্ডার করতে বড়মাসি?
শীত পড়লেই মাসিদের হাতে বোনা সোয়েটার। সুদূর মুর্শিদাবাদ থেকে দিদার পাঠানো খেজুরে গুড়ের চাকতি। শীত পড়লেই বড় মাসির পিঠেপুলি বানানোর ধুম লেগে যেত। রাঙালুর পান্তুয়া, লাউয়ের পায়েস নিদেনপক্ষে ইলিশ মাছ বা খাসির মাংস, ভালো কিছু রান্না হলেই আমার তলব পড়ত। বড়দা বা সেজদা নাহলে ছোটদা আসত সাইকেল নিয়ে- বড়জেঠুর সাইকেলের স্পোকে একবার গোড়ালি ঢুকিয়ে ফেলেছিলাম-বাপরে সেই থেকে খুব ভয় সাইকেলে চড়ায়। তবে বড়মাসির তলব-ভয় পালাত জানলা গলে। আতঙ্ক ছিল সেজমাসি,বাপস্ ধরতে পারলে হয়, ঘষে ঘষে পিতলের ঘটি মাজার মত করে চান করাত আর মাথা ঘষে দিত। শ্যাম্পু নয়,মাথা ঘষা বলতাম আমরা। চুল কাটার ওপর ছিল কড়া নিষেধাজ্ঞা। আহাঃ একমাথা কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, পাশের বাড়ির বৌদি বলত,“সাক্ষাৎ নজরুল”। বিকেল হলেই দড়ি নিয়ে চুল বাঁধতে বসত মেজো পিসি। বড় সযতনে চুল আঁচড়ে দিত, তাও এমন হল্লা জুড়তাম যেন ডাকাত পড়েছে। পশ্চিম আকাশ লাল করে ডুবত সূর্য, কুলায় ফেরা কাকদের চিৎকারে কানে তালা ধরে যেত, আসেপাশের বাড়িতে বেজে উঠত সন্ধ্যার মঙ্গলশঙ্খ।  ঠাকুমা আনমনে বলে উঠত,“বেলা কত ছোট হয়ে গেছে-”। কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেল গুলো সেই-

ছোটো। পুরোনো  দিনগুলোকে মনে করিয়ে দেবার জন্য।

Thursday 6 December 2018

মধ্যমেধার মধ্যবিত্তের রোজনামচা ৬ই ডিসেম্বর ২০১৮

মধ্যমেধার মধ্যবিত্তের রোজনামচা ৬ই ডিসেম্বর ২০১৮

সে একটা যুগ ছিল। ভোর হত আকাশবাণীর প্যাঁপো প্যাঁপো শুনে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে আসর জমাত বিবিধভারতী। খেলা থাকলে, বিশাল সাবেকী রেডিওতে কলকাতা ক এ বাঙলা ধারাবিবরণী। অনুরোধের আসরে,প্রেম নিবেদন করত পাড়ার ঘন্টারা বেপাড়ার বুঁচিকে। লতাজীর মধুক্ষরা কণ্ঠ গেয়ে উঠত,“শায়েদ মেরে শাদিকা খ্যায়াল দিল মে আয়া হ্যায়”। শ্রাবন্তী মজুমদারকে গোপনে প্রেমপত্র পাঠাত পাড়ার দাদারা,“আয় খুকু আয়। ”
যখন তখন ঝুপ্ করে লোডশেডিং। গরম কালে ছাতে উঠে হাওয়া খাওয়া। মাথার ওপর সুবিশাল মহাকাশ, আর কালো আকাশে শত শত হীরের কুচির মত ঝকঝকে তারা। শীত হেমন্তে দেওয়ালগিরির ঝকঝকে কাঁচে ঠিকরে আসা আলো অন্ধকার কড়িবরগায় রচনা করত আজব নক্সা। গল্প করতে করতে মুছতে গিয়ে,গৃহপরিচারিকা দেবীদির হাতে প্রায়ই মটাং করে ভেঙে যেত হ্যারিকেনের চিমনি। মাসের প্রথমদিকে রবিবার মানেই খাসির মাংস। মাসের শেষে অবশ্য পোনা মাছ। রবিবার মানেই রবিবাসরীয় আর ঝপাং ঝপাং জামাকাপড় কাচার ধুম।শীত পড়তে না পড়তেই গরম জামা-লেপ কম্বল ছাতে রোদ খাওয়ানোর মরশুম।  রোদে তেতে থাকা লেপের ওপর গড়াগড়ি খাবার আনন্দে মাখামাখি দিন কাটছিল বেশ।

দেশজুড়ে যদিও উত্তেজনার পারদ চড়ছিল বেশ কিছুদিন ধরেই, চলছিল চাপানউতোর, ঘনিয়ে উঠছিল পারস্পরিক অবিশ্বাস আর অমূলক ঘৃণার কালো মেঘ। তখন আমরা বেশ ছোট,স্কুলের গণ্ডী পেরোতে আরো অনেক বছর বাকি, রোজ সকালের আনন্দবাজার জুড়ে থাকত বিশাল বিশাল শিরোনাম। তার তলায় সাদাকালো ছবি। কি হচ্ছে বা হতে চলেছে তা বোঝার মত বুদ্ধি আমাদের ছিল না। আমাদের মহল্লা বা আসেপাশের মহল্লায়ও এই নিয়ে যে তেমন তাপোত্তাপ ছিল তা মনে পড়ে না। ইন্টারনেট, সোশাল মিডিয়া তখন কষ্টকল্পনা মাত্র। সংবাদ মাধ্যম বলতে রেডিও যা প্রায় কেউই তখন শুনত না,আর দূরদর্শনে সাড়ে সাতটায় বাংলা আর রাত নটায় হিন্দি/ইংরেজি খবর। পুরোপুরি সরকার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম।

সেদিনটা ছিল রবিবার। বাবা মায়ের হাত ধরে গেছি বড় মাসীর বাড়ি। জমাটি আড্ডার ফাঁকে, রাত নটার খবর চালানো হল। তখন তাই নিয়ম ছিল। বাড়িতে যত বড় অথিতিই আসুক না কেন,খবর বন্ধ হবে না। খবর শুরু হতেই মুহূর্তে নেমে এল শ্মশানের স্তব্ধতা। হাল্কা মনে পড়ে, কাটারী, শাবল,লাঠি হাতে বিশাল জনতার উন্মত্ত চিৎকার,“জয় শ্রীরাম। ” জনৈক সাধুবাবা হিন্দিতে বললেন,“করসেবা রুখ নেহি সাকতি। চাহে কোই সন্ত মহাত্মা রোকে,চাহে কোই নেতা রোখে। আজ ইস ধাঁচে কো গিরানা হ্যায়?কোর্ট অর্ডার কোনদিন মানিনি। মানব না। ” সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন,“আজ পাক্কা গিরালোগে?” জবাব পাওয়া গেল,“গিরনা তো চাইয়ে। পুরি তৈয়ারি কে সাথ আয়ে হ্যায়। ” “আগর নেহি গিরা তো?” “অ্যায়সা তো হো নেহি সাকতা,কিঁউকে-” আর বলতে দিল না পাশের সাধু। জোর করে চুপ করিয়ে দেওয়া হল।

কোন ধাঁচা?সেটাও দেখালো, ১৬শ শতকে তৈরি বিশাল এক মসজিদ। যার বিশাল গম্বুজগুলিও কেমন যেন ফুটন্ত টেনশনের  আঁচে কিঞ্চিৎ  বিবর্ণ। চতুর্দিকে বাঁশ আর দড়ি দিয়ে কর্ডন করা। মধ্য বয়সী জেলাশাসক এবং এসপি ঢুকলেন, সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলেন,“সব ঠিক আছে তো?পিলপিল করে করসেবকরা ঢুকছে। কোন বড় দুর্ঘটনা বাঁধাবার পরিকল্পনা নিয়ে। ”সহাস্য জেলাধীশ এবং এসপি বলে গেলেন,“না। না। শান্তি বজায় থাকবে। কিচ্ছু হবে না। পুলিশ আছে তো।”
মূল হোতাতে কিছুতেই শহরে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না বলে দাবী করেছিল প্রশাসন। কিন্তু পুলিশ এবং প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করে,ধুতি ছেড়ে প্যান্ট পরে বাইকে চেপে অকুস্থলে এসে হাজির হলেন সিংঘল। করসেবকদের মধ্যেও প্রবল ধস্তাধস্তি  লেগে গেল। মাথায় হলুদ ব্যাণ্ড পরা একদল তরুণ এতক্ষণ ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসা করসেবকদের পিছনে ঠেলে ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগল। পূর্বপরিকল্পিত কি?কে করল এতবড় পরিকল্পনা?দেশ এবং রাজ্যের এতগুলি গোয়েন্দা সংস্থা ঘুনাক্ষরেও কিছু জানতে পারল না?
প্রথম আক্রান্ত  হল মূল শ্রাইনের প্রবেশ দ্বার। মুষ্টিমেয় আক্রমণকারী করসেবকদের ছোঁড়া ইঁট কিছুক্ষণ আটকালো পুলিশ। কিন্তু কতক্ষণ ?লাঠিচার্জ,টিয়ারগ্যাস, শূণ্যে গুলি ছোঁড়া হল কি হল না, কিছুই বোঝা গেল না। হু হু করে ঠুকতে লাগল প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত করসেবক বাহিনী। নাম মাত্র ধস্তাধস্তি,ফাঁক গলে হুহু করে ঢুকতে লাগল জনস্রোত। পুলিশ শূণ্য শ্রাইনের গেট খুলে দিল কেউ। ততোক্ষণে পাঁচিল টপকে,ফাঁকা ব্যারিকেড ভেঙে ছুটে আসছে উন্মত্ত জনতা। গম্বুজের মাথায় উড়ল গেরুয়া পতাকা। এটাই ছিল সঙ্কেত। হাতে থাকা অস্ত্র নিয়ে  শতাব্দী প্রাচীন এক স্থাপত্যের ওপর ধর্ষকাম উল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়ল ধর্মান্ধ একপাল ভারতীয়। মাটিতে মিশে গেল একটা মসজিদ। ৬ই ডিসেম্বর ১৯৯২এর সূর্য ডুবল এক চূড়ান্ত অশনি সঙ্কেত নিয়ে।
মন্দির না মসজিদ?বিংশ শতকের শেষ দশকে বিশ্বের অন্যতম উন্নয়নশীল তথা প্রগতীশীল দেশের মানুষ মত্ত হয়ে উঠল পরষ্পরের রক্ত পিপাসায়। দাঙ্গা শব্দটার সাথে নতুন করে পরিচিত হলাম। সারা ভারতব্যাপী দাঙ্গা। কার্ফু। দিনের পর দিন কার্ফু। সাঁজোয়া গাড়ি টহল দিতে লাগল হাওড়ার রাস্তায় রাস্তায়। দেখা মাত্র গুলি করার নির্দেশ সংক্রান্ত সতর্ক বাণী জারি করা হল।
থামে। আবার শুরু হয়। ধিকধিক করে জ্বলতে থাকে অবিশ্বাস আর ঘৃণার আগুন। প্রতিবাদ করলেই শুনতে হত,“ কাশ্মীরে যখন হিন্দু মন্দির ভাঙা হচ্ছিল, তখন চুপ করে ছিলেন কেন?” ইণ্ডিয়া টুডের মতে এই দাঙ্গার পিছনে প্রত্যক্ষ ভাবে কোন রাজনৈতিক দল সম্ভবত ছিল না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানীয় কোন ঘটনা বা রেষারেষিই দায়ী ছিল। গোটা দেশে সংঘর্ষের বলি সরকারী মতে ১০০০। নির্বিচারে চলে লুটপাট। দেশের যে কোন প্রান্তে সম্মিলিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ লাঠি তুললেই, শুনতে হয়,“ অত বড় মসজিদ ভাঙার সময় লাঠি তুলতে পারো নি, আর সামান্য প্রতিবাদে লাঠিচার্জ?” দোষারোপ পাল্টা দোষারোপের আড়ালে হুহু করে ঝরতে লাগল রক্ত।  সুরাট, আহমেদাবাদ,ভোপাল, বম্বে,আসাম, উত্তর প্রদেশ,বিহার,রাজস্থান, কেরালা এমনকি পশ্চিমবঙ্গ। বম্বেতে তীব্রতা ছিল ভয়াবহ। গাড়ির টায়ারকে দুইদিকে  ল্যাম্পপোস্টের সাথে টানটান করে করে, অ্যাসিড ভর্তি কাঁচের বোতল গুলতির মত ছোঁড়া হত বিপক্ষের ওপর। নিন্দুকে বলে,এই সময় যতলোক সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে মারা গেছে তার থেকে অনেক বেশী মানুষ মারা যায় পুলিশের গুলিতে।৫ই ডিসেম্বর ২০১১সালে ইন্ডিয়া টুডে ঐ সময় মৃত বহু মানুষের পরিবার পরিজনদের সাক্ষাৎকার নেয়। তাতে উঠে আসে নানা চমকপ্রদ তথ্য। ১৭-১৮বছরের তরুণ, গণ্ডগোল শুনে দেখতে গিয়েছিল স্টেশনের কাছে কি হচ্ছে,পুলিশ অন্ধের মত গুলি চালায়। গোড়ালীতে গুলি খেয়ে কোন রকমে বুকে হেঁটে বাড়িও ফিরেছিল ছেলেটা,শেষ রক্ষা হয়নি। বাড়ি ঢুকে বুকে গুলি করে মারে দুই কনস্টেবল।তারপর কেটে গেছে ছাব্বিশটা বছর। নাকি কাটেনি। আজকাল প্রায়ই মনে হয়,শুধু যেন আমাদেরই বয়স বাড়ছে,দেশের বয়স বুঝি আটকে আছে সেই যুগেই, অথবা পিছিয়ে গেছে আরো আরো আরো বহুযুগ পিছনে। কে জানে?
#ফিরেদেখা  ©Anindita Bhattacharya

Tuesday 4 December 2018

অনির ডাইরি ৪/১২/১৯৮৪-২০১৮


স্পষ্ট অস্পষ্টের মায়াজালাক্রান্ত স্মৃতি।এটুকু মনে আছে, বড় মামার বিয়ে ছিল সেই সময়। মায়ের খুড়তুতো ভাই, বংশের বড় ছেলে, তার বিয়েতে না গেলে হয়?তখন নভেম্বরের শেষ বা ডিসেম্বরের শুরু। মহানগরে ততোটা না হলেও সুদূর মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত গ্রাম রামনগরে জাঁকিয়ে বসেছে শীত। বিয়ে বাড়ির হুল্লোড়ের পাশাপাশি মাচা থেকে লেপ কম্বল পাড়া,রোদে দেওয়ার কাজ চলছে পূর্ণোদ্যমে। ভোর বেলা হুহু করতে করতে কাঁচা ঘুমে উষ্ণ মিষ্টি খেজুরের রস খাওয়াতো দিদা। বড় মামা আর্মিতে ছিলেন। শুধু বড়মামা কেন, রামনগর-কাদখালি-বাছড়া গ্রামের সব সমর্থ পুরুষই বেলডাঙা ক্যাম্প দিয়ে মিলিটারিতে ঢুকত। গ্রামে ঘুরতো আড়কাঠি, এক্স আর্মি ম্যান। ট্যাকা দাও চাকরী নাও। জমি বেচে চাকরীতে ঢোকো, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবার টাকা জমিয়ে জমি কেনো,গরু কেনো, মাটির বাড়ি সারাও,পাকা বাড়ি তোলো। বিয়ের সম্বন্ধ এল বলে, বর্তমান ধ্যানধারণা অনুসারে রূপসী না হলেও ঐ সময় চলনশীল মোটামুটি ডাগরডোগর মেয়েদের বাবারা রেডিও,সাইকেল, হাতঘড়ি এবং সে যুগে চমকে ওঠার মত নগদ নিয়ে পাত্রের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ত।
বড় মামার সাথে তার দুই আর্মি ম্যান বন্ধুও এসেছিলেন বিয়েতে। অজ গ্রাম। ইলেকট্রিসিটি দূর অস্ত। শৌচাগার স্নানাগারের কথা বলে আর সফিস্টিকেটেড ফেবু জনতাকে লজ্জা দিতে চাই না। কিন্তু ঐ দুই মিলিটারি মামার তাতে কোন সমস্যা ছিল বলে মনে পড়ে না। দিব্যি বাড়ির ছেলে হয়ে মিশে গিয়েছিলেন।
বিয়ের দিন, বর যাবে পাল্কি করে। ছোটদা নীতবড়, বরের সাথে তার পাল্কি চাপার কথা। আমি এমন কান্না জুড়লাম, ছোটদা আমাকে পাল্কি চাপার সুযোগ করে দিয়ে সরে গেল। পলাশী থেকে দুটো স্টেশন পর সেই নবগ্রামের ভিতর দিকে মেয়ের বাড়ি। বিশাল জোড়া নৌকায় বরযাত্রীরা গঙ্গা পেরিয়ে এপাশ থেকে বাসে উঠল। লাক্সারী বাস না। বড় বাস, যেগুলি দূর পাল্লায় চলত তখন নদীয়া মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। বাসের নামটা কি ভাবে যেন আজও মনে আছে। বাস থেকে নেমে বর যাত্রীরা হেঁটে যাবে, আর আমি আর বর পাল্কিতে। আমরা আগে পৌঁছলাম। বড় মামিমার মা,বরকে বরণ করে নীতবরকে বরণ করতে গিয়ে থতমত খেয়ে একসা কাণ্ড। ছোটদা আজোও মাঝেমাঝেই মাথায় গাঁট্টা মারে, ওর ভাগের লাইমলাইট খেয়ে নেওয়ার জন্য।
যাইহোক, বিয়ে হল, আলো জ্বালিয়ে, কিসের আলো মনে নেই হ্যাজাক সম্ভবত। বাবা বা দাদারা ভালো বলতে পারবে। আমি এতই ছোট ছিলাম যে ঘুমিয়েই পড়েছিলাম ছোট মাসির কোলে। সেই ঘুম ভাঙে পরদিন সকালে। বর আসবে- নতুন বউ আসবে এই উন্মাদনায়।
রামনগরে খবরের কাগজ গিয়ে পৌঁছত প্রায় সূর্য ডোবার সময়। ইলেকট্রিসিটি নেই ফলে টিভির কোন গল্পই নেই। জনগণমাধ্যম বলতে রেডিও। যাতে খুব সহজে রেডিও বাংলাদেশ এবং রেডিও সিলোন আসত,কিন্তু বিবিধ ভারতী কখনই ধরা যেত না। কলকাতা ক এবং খ মাঝে মাঝে ঝাঁকি দর্শন দিত বটে তবে তার জন্য রেডিওটিকে নিয়ে রীতিমত কসরত করতে হত। কি নিস্তরঙ্গ জীবন ছিল ভাবুন।দেশ যদি রাতারাতি শত্রুপক্ষের করায়ত হয়ে যেত তাহলেও বোধহয় দিন দুয়েকের আগে রামনগরবাসীরা কিছুই জানতে পারত না। কারো খুব একটা জানার উৎসাহও ছিল বলে মনে হয় না। দেশ বা জাতীয় সংবাদের তুলনায় স্থানীয় গ্রাম্য পরনিন্দা পরচর্চাতেই অধিবাসীরা অধিক বরং বলা চলে অত্যধিক উৎসাহী ছিল।
ব্যতিক্রম ছিলেন বড় মেসোমশাই এবং অবশ্যই কিছুটা আমায় ছোট মেসোও। ছোটোর উৎসাহে বড় সকাল থেকেই রেডিও নিয়ে কসরত করছিলেন,হঠাৎ কি যে হল,বড় মেসোমশাই চিৎকার করে উঠলেন চুপ চুপ চুপ। শর্ট ওয়েভে ইংলিশ খবরে এমন কিছু বলছে, যে ক্ষণিকের মধ্যেই চূড়ান্ত নীরবতা নেমে এল উৎসবমুখর বিয়ে বাড়িতে। যারা ইংরাজি বুঝল না,তাদের বাংলায় বুঝিয়ে দিল পাশের জন। কিছু একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেছে বুঝতে পারলাম। বহু লোক রাতারাতি মারা গেছে। বড় মামা বিয়েতে আসা এক ভদ্রলোকের পরিবার থাকেন ঐ শহরে। তিনি উদ্ভ্রান্তের মত খানিক দৌড়দৌড়ি করলেন। তারপর হাঁচোড়পাঁচোড় করে ব্যাগ পত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লেন কিচ্ছুটি দাঁতে না কেটে। তখন মোবাইল ছাড়ুন ল্যাণ্ডফোনই দুর্লভ। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে একটাও ল্যাণ্ডফোন থাকত না। যারা ফেবুতে আঁতেল মার্কা পোস্ট দেয় যে মুছে যাক সোশাল নেটওয়ার্ক, হারিয়ে যাক মোবাইল, পাড়ার মোড়ে শুধু একটা ডায়ালটোন ওলা ফোন থাকুক। লুপ্ত হোক ইমেল। ফিরে আসুক চিঠি ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদের আমার সিরিয়াসলি মাইরি,“ক্যালাতে” ইচ্ছা করে।বাপ তোরা জঙ্গলে গিয়ে থাক। তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব যে আমাদের কতদূর এগিয়ে দিয়েছে,তা সেদিনের কথা ভাবলেই বুঝতে পারি। কি সাংঘাতিক মানসিক অবস্থা হয়েছিল ওণার তা বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। তবে একজন ইস্পাত শীতল মিলিটারি ম্যান ও নিজের পরিবারের বিপদ সম্ভবনা দেখলে আলুভাতে মার্কা হয়ে যায় তা আমার স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করা।
শোকের আবহে বিয়ে বাড়ি শেষ হল। রেডিও ছেড়ে নড়লেনই না দুই মেসোমশাই। দাদা মামারা সেই খবরের তর্জমা করে জনে জনে পরিবেশন করতে লাগল।
দেখতে দেখতে রামনগর আর আমাদের আশু বিরহে মুষড়ে পড়া দিদাকে ছেড়ে বাড়ির পথে রওনা দিলাম আমরা। বাড়ি ফিরেও সেই একই আলোচনা। ইণ্ডিয়া টুডের প্রচ্ছদে হাড় হিম করা সেই ছবি, একটা শিশু, আমাদেরই বয়সী হবে,যার খোলা দুই ঘোলাটে চোখে মৃত্যুর শীতলতা। বোধহয় কবর দেওয়া হবে,কারণ মাথা এবং গলার অনেকটাই মাটিতে ঢাকা। কি মিষ্টি,কি নিষ্পাপ একটা শিশু। ঘুমের মাঝে বেঘোরে মৃত। যার জন্য একফোঁটা চোখের জল ফেলার কেউ নেই। কে ফেলবে?সবাই তো মারা গেছে। পাহাড়ের ওপর থেকে গভীর রাতে চুপি চুপি নেমে এসেছিল মৃত্যুদূত।যার পোশাকী নাম মিথাইল আইসোসায়ানেট। পথে যাকেই পেয়েছে গিলে নিয়েছে।বিশ্বের জঘণ্যতম ইণ্ডাসট্রিয়াল ট্রাজেডি। সরকারী মতে মৃতের সংখ্যা ছিল সাড়ে তিনহাজারের একটু বেশী (৩৭৮৭) আর বেসরকারী মতে? ১৬,০০০। সাড়ে পাঁচ লক্ষ মানুষ পঙ্গু হয়ে যায় রাতারাতি। প্রায় আট হাজার মানুষ সপ্তাহ দুইয়ের মধ্যেই মারা যান। অতঃপর চলতে থাকে দোষারোপ পাল্টা দোষারোপের পালা। বিচারের বাণী কেঁদে ককিয়ে গলা শুকিয়ে মরে । মূল কালপ্রিটকে সযতনে কারা যেন পগার পার করে দেয়। জ্যাঠাইমা যেমন আমাদের দেখলেই প্রচ্ছদটা উল্টে রাখত। তেমনি ছেলে ভুলানো ল্যাবেঞ্চুস ধরিয়ে চুপ করিয়ে রাখার চেষ্টা চলে কিছুদিন। তারপর?জনতার স্মৃতিশক্তি অস্বাভাবিক দুর্বল। রোজ নতুন নতুন উত্তেজক খবর চায়। ওসব পচাপাতকো খবরে আর কার মাথা ব্যথা।
৩৪বছর কেটে গেছে ভোপাল গ্যাস লিক কাণ্ডের। কেউ মনে রাখেনি। কেউ কথা রাখেনি।
#Bhopaltragedy #ফিরেদেখা