Thursday 6 December 2018

মধ্যমেধার মধ্যবিত্তের রোজনামচা ৬ই ডিসেম্বর ২০১৮

মধ্যমেধার মধ্যবিত্তের রোজনামচা ৬ই ডিসেম্বর ২০১৮

সে একটা যুগ ছিল। ভোর হত আকাশবাণীর প্যাঁপো প্যাঁপো শুনে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে আসর জমাত বিবিধভারতী। খেলা থাকলে, বিশাল সাবেকী রেডিওতে কলকাতা ক এ বাঙলা ধারাবিবরণী। অনুরোধের আসরে,প্রেম নিবেদন করত পাড়ার ঘন্টারা বেপাড়ার বুঁচিকে। লতাজীর মধুক্ষরা কণ্ঠ গেয়ে উঠত,“শায়েদ মেরে শাদিকা খ্যায়াল দিল মে আয়া হ্যায়”। শ্রাবন্তী মজুমদারকে গোপনে প্রেমপত্র পাঠাত পাড়ার দাদারা,“আয় খুকু আয়। ”
যখন তখন ঝুপ্ করে লোডশেডিং। গরম কালে ছাতে উঠে হাওয়া খাওয়া। মাথার ওপর সুবিশাল মহাকাশ, আর কালো আকাশে শত শত হীরের কুচির মত ঝকঝকে তারা। শীত হেমন্তে দেওয়ালগিরির ঝকঝকে কাঁচে ঠিকরে আসা আলো অন্ধকার কড়িবরগায় রচনা করত আজব নক্সা। গল্প করতে করতে মুছতে গিয়ে,গৃহপরিচারিকা দেবীদির হাতে প্রায়ই মটাং করে ভেঙে যেত হ্যারিকেনের চিমনি। মাসের প্রথমদিকে রবিবার মানেই খাসির মাংস। মাসের শেষে অবশ্য পোনা মাছ। রবিবার মানেই রবিবাসরীয় আর ঝপাং ঝপাং জামাকাপড় কাচার ধুম।শীত পড়তে না পড়তেই গরম জামা-লেপ কম্বল ছাতে রোদ খাওয়ানোর মরশুম।  রোদে তেতে থাকা লেপের ওপর গড়াগড়ি খাবার আনন্দে মাখামাখি দিন কাটছিল বেশ।

দেশজুড়ে যদিও উত্তেজনার পারদ চড়ছিল বেশ কিছুদিন ধরেই, চলছিল চাপানউতোর, ঘনিয়ে উঠছিল পারস্পরিক অবিশ্বাস আর অমূলক ঘৃণার কালো মেঘ। তখন আমরা বেশ ছোট,স্কুলের গণ্ডী পেরোতে আরো অনেক বছর বাকি, রোজ সকালের আনন্দবাজার জুড়ে থাকত বিশাল বিশাল শিরোনাম। তার তলায় সাদাকালো ছবি। কি হচ্ছে বা হতে চলেছে তা বোঝার মত বুদ্ধি আমাদের ছিল না। আমাদের মহল্লা বা আসেপাশের মহল্লায়ও এই নিয়ে যে তেমন তাপোত্তাপ ছিল তা মনে পড়ে না। ইন্টারনেট, সোশাল মিডিয়া তখন কষ্টকল্পনা মাত্র। সংবাদ মাধ্যম বলতে রেডিও যা প্রায় কেউই তখন শুনত না,আর দূরদর্শনে সাড়ে সাতটায় বাংলা আর রাত নটায় হিন্দি/ইংরেজি খবর। পুরোপুরি সরকার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম।

সেদিনটা ছিল রবিবার। বাবা মায়ের হাত ধরে গেছি বড় মাসীর বাড়ি। জমাটি আড্ডার ফাঁকে, রাত নটার খবর চালানো হল। তখন তাই নিয়ম ছিল। বাড়িতে যত বড় অথিতিই আসুক না কেন,খবর বন্ধ হবে না। খবর শুরু হতেই মুহূর্তে নেমে এল শ্মশানের স্তব্ধতা। হাল্কা মনে পড়ে, কাটারী, শাবল,লাঠি হাতে বিশাল জনতার উন্মত্ত চিৎকার,“জয় শ্রীরাম। ” জনৈক সাধুবাবা হিন্দিতে বললেন,“করসেবা রুখ নেহি সাকতি। চাহে কোই সন্ত মহাত্মা রোকে,চাহে কোই নেতা রোখে। আজ ইস ধাঁচে কো গিরানা হ্যায়?কোর্ট অর্ডার কোনদিন মানিনি। মানব না। ” সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন,“আজ পাক্কা গিরালোগে?” জবাব পাওয়া গেল,“গিরনা তো চাইয়ে। পুরি তৈয়ারি কে সাথ আয়ে হ্যায়। ” “আগর নেহি গিরা তো?” “অ্যায়সা তো হো নেহি সাকতা,কিঁউকে-” আর বলতে দিল না পাশের সাধু। জোর করে চুপ করিয়ে দেওয়া হল।

কোন ধাঁচা?সেটাও দেখালো, ১৬শ শতকে তৈরি বিশাল এক মসজিদ। যার বিশাল গম্বুজগুলিও কেমন যেন ফুটন্ত টেনশনের  আঁচে কিঞ্চিৎ  বিবর্ণ। চতুর্দিকে বাঁশ আর দড়ি দিয়ে কর্ডন করা। মধ্য বয়সী জেলাশাসক এবং এসপি ঢুকলেন, সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলেন,“সব ঠিক আছে তো?পিলপিল করে করসেবকরা ঢুকছে। কোন বড় দুর্ঘটনা বাঁধাবার পরিকল্পনা নিয়ে। ”সহাস্য জেলাধীশ এবং এসপি বলে গেলেন,“না। না। শান্তি বজায় থাকবে। কিচ্ছু হবে না। পুলিশ আছে তো।”
মূল হোতাতে কিছুতেই শহরে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না বলে দাবী করেছিল প্রশাসন। কিন্তু পুলিশ এবং প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করে,ধুতি ছেড়ে প্যান্ট পরে বাইকে চেপে অকুস্থলে এসে হাজির হলেন সিংঘল। করসেবকদের মধ্যেও প্রবল ধস্তাধস্তি  লেগে গেল। মাথায় হলুদ ব্যাণ্ড পরা একদল তরুণ এতক্ষণ ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসা করসেবকদের পিছনে ঠেলে ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগল। পূর্বপরিকল্পিত কি?কে করল এতবড় পরিকল্পনা?দেশ এবং রাজ্যের এতগুলি গোয়েন্দা সংস্থা ঘুনাক্ষরেও কিছু জানতে পারল না?
প্রথম আক্রান্ত  হল মূল শ্রাইনের প্রবেশ দ্বার। মুষ্টিমেয় আক্রমণকারী করসেবকদের ছোঁড়া ইঁট কিছুক্ষণ আটকালো পুলিশ। কিন্তু কতক্ষণ ?লাঠিচার্জ,টিয়ারগ্যাস, শূণ্যে গুলি ছোঁড়া হল কি হল না, কিছুই বোঝা গেল না। হু হু করে ঠুকতে লাগল প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত করসেবক বাহিনী। নাম মাত্র ধস্তাধস্তি,ফাঁক গলে হুহু করে ঢুকতে লাগল জনস্রোত। পুলিশ শূণ্য শ্রাইনের গেট খুলে দিল কেউ। ততোক্ষণে পাঁচিল টপকে,ফাঁকা ব্যারিকেড ভেঙে ছুটে আসছে উন্মত্ত জনতা। গম্বুজের মাথায় উড়ল গেরুয়া পতাকা। এটাই ছিল সঙ্কেত। হাতে থাকা অস্ত্র নিয়ে  শতাব্দী প্রাচীন এক স্থাপত্যের ওপর ধর্ষকাম উল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়ল ধর্মান্ধ একপাল ভারতীয়। মাটিতে মিশে গেল একটা মসজিদ। ৬ই ডিসেম্বর ১৯৯২এর সূর্য ডুবল এক চূড়ান্ত অশনি সঙ্কেত নিয়ে।
মন্দির না মসজিদ?বিংশ শতকের শেষ দশকে বিশ্বের অন্যতম উন্নয়নশীল তথা প্রগতীশীল দেশের মানুষ মত্ত হয়ে উঠল পরষ্পরের রক্ত পিপাসায়। দাঙ্গা শব্দটার সাথে নতুন করে পরিচিত হলাম। সারা ভারতব্যাপী দাঙ্গা। কার্ফু। দিনের পর দিন কার্ফু। সাঁজোয়া গাড়ি টহল দিতে লাগল হাওড়ার রাস্তায় রাস্তায়। দেখা মাত্র গুলি করার নির্দেশ সংক্রান্ত সতর্ক বাণী জারি করা হল।
থামে। আবার শুরু হয়। ধিকধিক করে জ্বলতে থাকে অবিশ্বাস আর ঘৃণার আগুন। প্রতিবাদ করলেই শুনতে হত,“ কাশ্মীরে যখন হিন্দু মন্দির ভাঙা হচ্ছিল, তখন চুপ করে ছিলেন কেন?” ইণ্ডিয়া টুডের মতে এই দাঙ্গার পিছনে প্রত্যক্ষ ভাবে কোন রাজনৈতিক দল সম্ভবত ছিল না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানীয় কোন ঘটনা বা রেষারেষিই দায়ী ছিল। গোটা দেশে সংঘর্ষের বলি সরকারী মতে ১০০০। নির্বিচারে চলে লুটপাট। দেশের যে কোন প্রান্তে সম্মিলিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ লাঠি তুললেই, শুনতে হয়,“ অত বড় মসজিদ ভাঙার সময় লাঠি তুলতে পারো নি, আর সামান্য প্রতিবাদে লাঠিচার্জ?” দোষারোপ পাল্টা দোষারোপের আড়ালে হুহু করে ঝরতে লাগল রক্ত।  সুরাট, আহমেদাবাদ,ভোপাল, বম্বে,আসাম, উত্তর প্রদেশ,বিহার,রাজস্থান, কেরালা এমনকি পশ্চিমবঙ্গ। বম্বেতে তীব্রতা ছিল ভয়াবহ। গাড়ির টায়ারকে দুইদিকে  ল্যাম্পপোস্টের সাথে টানটান করে করে, অ্যাসিড ভর্তি কাঁচের বোতল গুলতির মত ছোঁড়া হত বিপক্ষের ওপর। নিন্দুকে বলে,এই সময় যতলোক সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে মারা গেছে তার থেকে অনেক বেশী মানুষ মারা যায় পুলিশের গুলিতে।৫ই ডিসেম্বর ২০১১সালে ইন্ডিয়া টুডে ঐ সময় মৃত বহু মানুষের পরিবার পরিজনদের সাক্ষাৎকার নেয়। তাতে উঠে আসে নানা চমকপ্রদ তথ্য। ১৭-১৮বছরের তরুণ, গণ্ডগোল শুনে দেখতে গিয়েছিল স্টেশনের কাছে কি হচ্ছে,পুলিশ অন্ধের মত গুলি চালায়। গোড়ালীতে গুলি খেয়ে কোন রকমে বুকে হেঁটে বাড়িও ফিরেছিল ছেলেটা,শেষ রক্ষা হয়নি। বাড়ি ঢুকে বুকে গুলি করে মারে দুই কনস্টেবল।তারপর কেটে গেছে ছাব্বিশটা বছর। নাকি কাটেনি। আজকাল প্রায়ই মনে হয়,শুধু যেন আমাদেরই বয়স বাড়ছে,দেশের বয়স বুঝি আটকে আছে সেই যুগেই, অথবা পিছিয়ে গেছে আরো আরো আরো বহুযুগ পিছনে। কে জানে?
#ফিরেদেখা  ©Anindita Bhattacharya

No comments:

Post a Comment