Saturday 22 December 2018

অনির ডাইরি 22.12.18

২২/১২/১৮

সে সব দিন ছিল সাদাকালো। চোখে ছিল কি সব অসম্ভব স্বপ্ন। আবিষ্কার করেই ছাড়ব টাইম মেশিন। তারপর পাড়ি দেব সুদূর অতীতে অথবা অনাগত ভবিষ্যতে। কে সেই ব্যক্তি, যার সাথে বাঁধা আমার গাঁটছড়া? এদিকে ফুটো ছাতে বছর বছর সোডা-সিমেন্টের প্রলেপ পড়ে চলে, যদি বাধ মানে অবাধ্য বরষা। গরম কালে বিকাল হলেই পশ্চিম আকাশের মুখ ভার, বাবার মুখে বুড়ো নরওয়েস্টারের গল্প-খুনখুনে সেই যে বুড়ো, যার বিশাল দাড়ির আনাচে-কাঁনাচে লুকিয়ে থাকে পশ্চিমী হাওয়া, বুড়ো দাড়ি ছেড়ে দিলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে “কালবোশেখী”। সাবেকী বার্মাটিকের কাঠের পাল্লা রোদে জলে ভিজে প্রায় পাঁপড় ভাজা-কালবোশেখীর তাণ্ডব যেমন বাড়ে পাল্লা দিয়ে বাড়ে তার থরহরি কম্প। আর তারপর? উঠোন আর পশ্চিমের বাগান জুড়ে তিন ভাইবোনের হুড়োহুড়ি দিয়ে আম কুড়ানো। বিদ্যুতবাতি ততোক্ষণে ভোঁ কাট্টা। ডিসি কিনা,তাই জোরে হাওয়া দিলেই কেটে পড়ত তার। চিত্রহার-চিত্রমালা-ফরমান-দেখ ভাই দেখ-টুকুস করে লোডশেডিং। পাশের বাড়ির এসি কানেকশন-দিব্যি জ্বলজ্বলে, বিরক্ত চেপে জ্যাঠাইমা বলত,“এসিতো বড়লোকের কারেন্ট, তাই থাকে। আমাদের গরীব লোকের ডিসি কারেন্ট কি না-”। বড়দা পড়াতে বসলেই অবশ্য, মনেপ্রাণে প্রার্থনা জুড়তাম,“ হে ঠাকুর,দাও আলো নিভিয়ে। দাদা তো নয় যেন সাক্ষাৎ  থানার বড়বাবু। ” না মারত না কোনদিন,তবে জিভে যা ধার ছিল, তার থেকে দাদা দুঘা মেরেই দাও বরং। নিভত আলো, ছুটি থোড়াই দিত দাদা। বগলে করে মাদুর আর হাতে হ্যারিকেন নিয়ে ছাতে পড়তে বসা-।
লোডশেডিং এর রাতে ছাতে শোওয়া-ওঃ সে কি উত্তেজনা। সাথে সাথে জেঠুর ভূতের গল্প। হাড়ে হাড়ে ঠকাঠকি লেগে যেত।
অগ্রাণ মাসে নবান্ন। কাঁচা দুধে নলেন গুড় আর নতুন চাল,সাথে হরেক রকম ফলের টুকরো। জ্যাঠাইমার নবান্ন অতুলনীয়। বড়মাসি নবান্নে কাঁচা আদা দিত। কেন এত ভালো নবান্নকে মার্ডার করতে বড়মাসি?
শীত পড়লেই মাসিদের হাতে বোনা সোয়েটার। সুদূর মুর্শিদাবাদ থেকে দিদার পাঠানো খেজুরে গুড়ের চাকতি। শীত পড়লেই বড় মাসির পিঠেপুলি বানানোর ধুম লেগে যেত। রাঙালুর পান্তুয়া, লাউয়ের পায়েস নিদেনপক্ষে ইলিশ মাছ বা খাসির মাংস, ভালো কিছু রান্না হলেই আমার তলব পড়ত। বড়দা বা সেজদা নাহলে ছোটদা আসত সাইকেল নিয়ে- বড়জেঠুর সাইকেলের স্পোকে একবার গোড়ালি ঢুকিয়ে ফেলেছিলাম-বাপরে সেই থেকে খুব ভয় সাইকেলে চড়ায়। তবে বড়মাসির তলব-ভয় পালাত জানলা গলে। আতঙ্ক ছিল সেজমাসি,বাপস্ ধরতে পারলে হয়, ঘষে ঘষে পিতলের ঘটি মাজার মত করে চান করাত আর মাথা ঘষে দিত। শ্যাম্পু নয়,মাথা ঘষা বলতাম আমরা। চুল কাটার ওপর ছিল কড়া নিষেধাজ্ঞা। আহাঃ একমাথা কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, পাশের বাড়ির বৌদি বলত,“সাক্ষাৎ নজরুল”। বিকেল হলেই দড়ি নিয়ে চুল বাঁধতে বসত মেজো পিসি। বড় সযতনে চুল আঁচড়ে দিত, তাও এমন হল্লা জুড়তাম যেন ডাকাত পড়েছে। পশ্চিম আকাশ লাল করে ডুবত সূর্য, কুলায় ফেরা কাকদের চিৎকারে কানে তালা ধরে যেত, আসেপাশের বাড়িতে বেজে উঠত সন্ধ্যার মঙ্গলশঙ্খ।  ঠাকুমা আনমনে বলে উঠত,“বেলা কত ছোট হয়ে গেছে-”। কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেল গুলো সেই-

ছোটো। পুরোনো  দিনগুলোকে মনে করিয়ে দেবার জন্য।

No comments:

Post a Comment