Sunday 30 December 2018

সব চরিত্র কাল্পনিক


তো যা বলছিলাম আর কি, আমাদের স্কুলের নাম ছিল তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবন।অবশ্যই বাংলা মিডিয়াম, আশি-নব্বইয়ের দশকে মধ্য হাওড়ার সেরা গার্লস স্কুল ছিল আমাদের বিদ্যালয়। আজও আমাদের মত প্রাক্তনীরা নিজেদের তারা বলে পরিচয় দিতে অত্যন্ত শ্লাঘা বোধ করি।
তো এইরকম জনাকয়েক তারাদের একটা গ্রুপ আছে। হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপ। সদস্য সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। চট করে সেখানে কোন নতুন সদস্যকে আমরা সংযোজিতও করতে চাই না।কারণ আর কিছুই নয়, আসলে এই গ্রুপে আমরা সকলে বড় বেশী অকপট। গালাগালির কোন রাখঢাক নেই,বরং শালীন ভাষায় সুচারু ভাবে নিজের বক্তব্য পেশ করতে গেলে অনেক সময়ই উদোম খিস্তি খেতে হয়। পাতি কলতলার ঝগড়া মার্কা ঝগড়াও হয় মাঝেসাঝে, কলহরতারা ছাড়া বাকিরা তখন নারদ নারদ জপি। “নারদ নারদ খ্যাংড়া কাঠি,লেগে যা নারদ ঝটাপটি।” অনেকেই তাদের বরকে নিয়ে,ইয়ে মানে বরের শারীরিক সমস্যা,শীতলতা ইত্যাদি নিয়ে খোলাখুলি ঘ্যানঘ্যান করে, সহকর্মী বিশেষ করে ওপরওয়ালাদের গুষ্টি উদ্ধার করে। এ ব্যাপারে অবশ্য সবথেকে সোচ্চার আমাদের চয়ন। চয়নের পূর্বের বস ছিলেন এক ভয়ানক সুদর্শন হরিয়ানভি জাট, কিন্তু চয়নের কেন যে তাকে অপছন্দ  ছিল কে জানে?দিনের শুরুটাই চয়ন করত, “সাতসকালে শালা আমার হারামি বস্ মেসেজ করল,দিনটাই খারাপ যাবে বা-। ” চয়ন যখন চাকরী ছেড়ে অন্য ফার্মে গেল, আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম,যাক “হারামি বস্” এর হাত থেকে রেহাই পেল গ্রুপটা। ও বাবা,কিছুদিন বাদেই বস্ ফেরৎ এলেন গ্রুপে,ইনি অবশ্য বাঙালী এবং মহিলা, তাতে কি? চয়নের মতে ইনি নাকি  “রক্তচোষা হারামি বস্। ”বস্ নাকি যাকে পায় তার সঙ্গেই সটান শুয়ে পড়ে। দুপুরে টিফিন বক্স খোলার সাথে সাথে হোয়াটস্অ্যাপ খুললেই হুড়মুড় করে ঢোকে চয়নের মেসেজ,“মালটা এই ঢুকল। কার সাথে ইয়ে করতে গিয়েছিল কে জানে?দুটো জুনিয়রকে দুবগলে নিয়ে ঢুকলেন তিনি। পঞ্চাশ বছুরে বুড়ি জামাকাপড় পরেছে দেখো না! কালো স্প্যাগেটি টপের ওপর স্বচ্ছ সাদা শার্ট। সব দেখা যাচ্ছে মাইরি। মালটাকে এই চোদ্দ তলা থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেব?” হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে যায়।

তো যাই হোক এই খোলাখুলি আলোচনা গুলিকে জিইয়ে রাখার স্বার্থে আমরা গ্রুপে নতুন সদস্য সংযোজনে ভয়ানক নারাজ। এর আগে তুলিকা আর হৈমন্তীর পেড়াপিড়িতে দুই তারাকে সংযোজন করা হয়েছিল। তাদের একজন বিশ্বসংসারে বলে বেরিয়েছিল, “চয়ন,সঞ্চিতা,মৌটুসি আর অনির কি মুখ খারাপ। উঃ মাগো কি অশ্লীল কথাবার্তা বলে।” মাইরি বলছি আমাদের আঙুল খারাপ হলেও মুখটাকে আমরা যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে রাখি। আরেক তারাতো বেছে বেছে শুধু তাদের সাথেই কথা বলত, যাদের বা তাদের বরেদের বাড়ি-গাড়ি এবং ব্যাঙ্কে লক্ষাধিক টাকাপয়সা আছে। সে কি কেলো বাপরে! বাকিদের সাথে মামুলী কুশল বিনিময়েও তার ঘোর আপত্তি।  বারবার ভদ্রভাষায় বলেও তাদের সংশোধন করা গেল না,তখন চয়ন পার্সোনাল মেসেজে আমার গুষ্টি উদ্ধার করে বলল,“হঠা শালা শাঁখচুন্নি দুটোকে। ”

সেই শেষ। বিগত দু বছরে তুলিকা অন্তত বাহান্ন বার সাড়ে পঞ্চাশ জনকে সংযোজন করতে বলেছে, আমরা করিনি। পাছে তুলিকা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে করে বসে,এই আশঙ্কায় আমরা তুলিকাকে অ্যাডমিন পব থেকেই সরিয়ে দিয়েছি।

নতুন সদস্য সংযোজনে আমার আর চয়নের এই আপত্তি অবশ্য ধোপে টিকল না, লাবু অর্থাৎ লাবণীর ক্ষেত্রে। তুলিকা কোন কথাই শুনল না। রীতিমত আল্টিমেটাম দিল,“লাবুকে অ্যাড না করলে আমিও থাকব না। মেয়েটা খুব বাজে সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, এই সময় যদি আমরা বন্ধুরা ওকে একটু সঙ্গ না দি, কে দেবে?” চয়ন তাও মিনমিন করে বলল,“তো যা না,বা-টা গিয়ে সঙ্গ দে। গ্রুপে অ্যাড করার কি আছে?” ঝাঁপিয়ে পড়ল হৈমন্তী আর নীলাঞ্জনা,“তুলির সাথে একমত। মেয়েটার খুব বাজে সময় যাচ্ছে। এই সেদিন বরটা মারা গেল,ঐ শোক না সামলাতে পেরে ওর মাও চলে গেলেন। একাহাতে মেয়ে সামলাতে নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে বেচারা। ওকে অ্যাড কর। দুটো প্রাণের কথা বলার কেউ নেইরে ওর। আমরা সবাই এত দূরে দূরে থাকি-। ”
সত্যি বলছি লাবুকে আমি,সঞ্চিতা বা চয়ন তেমন চিনতাম না। ও অন্য সেকশনে পড়ত। যতদূর মনে পড়ে,বেশ শ্যামলা লাজুক একটা মেয়ে,পড়াশোনায়ও অতি সাধারণ ছিল। এগারো ক্লাসে আমাদের স্কুলে আর সুযোগও পায়নি। হাওড়া গার্লস্ এ পড়ত। তারপর আর কোন খবর জানি না। আসলে লাবু,তুলিকা, হৈমন্তী আর নীলাঞ্জনা একই পাড়ার মেয়ে,ফলে ওদের মধ্যে বন্ধুত্বও একটু বেশী প্রবল। তো এ হেন লাজুক লাবুর জীবনের ওপর দিয়ে যে ইতিমধ্যে এত ঝড় বয়ে গেছে,সত্যি বলছি জানতাম না। বেশ সলজ্জ ভাবেই লাবুকে গ্রুপে অ্যাড করা হল।বেশ সেন্সরড্ ভাবে আলাপ-আলোচনা হল সেদিন গ্রুপে। কেউ তেমন মুখ খুলল না। কিন্তু যার জন্য এত সাবধানতা, সারাদিন সেই বাবুর পাত্তা নেই, অথচ যে যা লিখছে পড়ছে, এতো হেবি জ্বালা। পড়ে, খবর রাখে অথচ কিছু বলে না। তবে কি এও বাইরে খবর পাচার করবে?
গভীর রাতে লাবুর মেসেজ ঢুকল,“ভাই আমার এই বিপদের দিনে তোরা আমার পাশে দাঁড়ালি, অনেক ধন্যবাদ। সারাদিন তোদের সব মেসেজ আমি পড়েছি, বিশ্বাস কর। এত ভালো লাগছিল পড়তে। মনে হচ্ছিল বহুদিন পর প্রাণভরে নিশ্বাস নিচ্ছি। জবাব দেবার সময় পাইনিরে। আজ নাইট ডিউটি, সব পেশেন্ট আপাততঃ ঘুমোচ্ছে, তাই ভাবলাম এই ফাঁকে তোদের সাথে একটু কথা বলি। ভাই  তোরা সবাই বড় বড় চাকরী বাকরি করিস, যারা করিস না তাদের বরেরা করে, আমি ভাই ছাপোষা নার্স। তাও প্রাইভেট নার্সিং হোমে।নার্সিং পড়তে পড়তে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, ভাবিনি কোনদিন চাকরী করতে হবে। বেশ ছিলাম বর-মেয়ে সংসার নিয়ে। হঠাৎ কি যে হল। ব্যবসায় ধাক্কা খেয়ে বরটা- একবার আমার আর মেয়ের কথা ভাবলও না জানিস।”দীর্ঘক্ষণ নীরবতা। লাবু বোধহয় ব্যস্ত। কেউ কোন জবাব দিচ্ছে না। হয় ঘুমিয়ে কাদা,অথবা কি বা বলবে? এই তীব্র মনখারাপের বাতাস যেন বাতানুকূল যন্ত্র থেকে বেরিয়ে এসে পাক খাচ্ছে ঘরের মেঝেতে। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। ভোরবেলায় উঠে দেখি, লাবু লিখেছে,“সব কথা তোদের জানালাম। আমি খুব সাধারণ রে,বাড়ি-গাড়ি, টাকাপয়সা,গয়নাগাটি,রূপযৌবন,শিক্ষাদীক্ষা গর্ব করার মত আমার কিছুই নেই ভাই, আমায় তোদের দলে নিবি তো?” জবাবটা নিজস্ব কায়দায় দেখলাম চয়ন দিয়েছে সকলের হয়ে,“নিয়ে তো নিয়েইছিরে বা-টা।”
(চলবে)

No comments:

Post a Comment