Tuesday 4 December 2018

অনির ডাইরি ৪/১২/১৯৮৪-২০১৮


স্পষ্ট অস্পষ্টের মায়াজালাক্রান্ত স্মৃতি।এটুকু মনে আছে, বড় মামার বিয়ে ছিল সেই সময়। মায়ের খুড়তুতো ভাই, বংশের বড় ছেলে, তার বিয়েতে না গেলে হয়?তখন নভেম্বরের শেষ বা ডিসেম্বরের শুরু। মহানগরে ততোটা না হলেও সুদূর মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত গ্রাম রামনগরে জাঁকিয়ে বসেছে শীত। বিয়ে বাড়ির হুল্লোড়ের পাশাপাশি মাচা থেকে লেপ কম্বল পাড়া,রোদে দেওয়ার কাজ চলছে পূর্ণোদ্যমে। ভোর বেলা হুহু করতে করতে কাঁচা ঘুমে উষ্ণ মিষ্টি খেজুরের রস খাওয়াতো দিদা। বড় মামা আর্মিতে ছিলেন। শুধু বড়মামা কেন, রামনগর-কাদখালি-বাছড়া গ্রামের সব সমর্থ পুরুষই বেলডাঙা ক্যাম্প দিয়ে মিলিটারিতে ঢুকত। গ্রামে ঘুরতো আড়কাঠি, এক্স আর্মি ম্যান। ট্যাকা দাও চাকরী নাও। জমি বেচে চাকরীতে ঢোকো, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবার টাকা জমিয়ে জমি কেনো,গরু কেনো, মাটির বাড়ি সারাও,পাকা বাড়ি তোলো। বিয়ের সম্বন্ধ এল বলে, বর্তমান ধ্যানধারণা অনুসারে রূপসী না হলেও ঐ সময় চলনশীল মোটামুটি ডাগরডোগর মেয়েদের বাবারা রেডিও,সাইকেল, হাতঘড়ি এবং সে যুগে চমকে ওঠার মত নগদ নিয়ে পাত্রের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ত।
বড় মামার সাথে তার দুই আর্মি ম্যান বন্ধুও এসেছিলেন বিয়েতে। অজ গ্রাম। ইলেকট্রিসিটি দূর অস্ত। শৌচাগার স্নানাগারের কথা বলে আর সফিস্টিকেটেড ফেবু জনতাকে লজ্জা দিতে চাই না। কিন্তু ঐ দুই মিলিটারি মামার তাতে কোন সমস্যা ছিল বলে মনে পড়ে না। দিব্যি বাড়ির ছেলে হয়ে মিশে গিয়েছিলেন।
বিয়ের দিন, বর যাবে পাল্কি করে। ছোটদা নীতবড়, বরের সাথে তার পাল্কি চাপার কথা। আমি এমন কান্না জুড়লাম, ছোটদা আমাকে পাল্কি চাপার সুযোগ করে দিয়ে সরে গেল। পলাশী থেকে দুটো স্টেশন পর সেই নবগ্রামের ভিতর দিকে মেয়ের বাড়ি। বিশাল জোড়া নৌকায় বরযাত্রীরা গঙ্গা পেরিয়ে এপাশ থেকে বাসে উঠল। লাক্সারী বাস না। বড় বাস, যেগুলি দূর পাল্লায় চলত তখন নদীয়া মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। বাসের নামটা কি ভাবে যেন আজও মনে আছে। বাস থেকে নেমে বর যাত্রীরা হেঁটে যাবে, আর আমি আর বর পাল্কিতে। আমরা আগে পৌঁছলাম। বড় মামিমার মা,বরকে বরণ করে নীতবরকে বরণ করতে গিয়ে থতমত খেয়ে একসা কাণ্ড। ছোটদা আজোও মাঝেমাঝেই মাথায় গাঁট্টা মারে, ওর ভাগের লাইমলাইট খেয়ে নেওয়ার জন্য।
যাইহোক, বিয়ে হল, আলো জ্বালিয়ে, কিসের আলো মনে নেই হ্যাজাক সম্ভবত। বাবা বা দাদারা ভালো বলতে পারবে। আমি এতই ছোট ছিলাম যে ঘুমিয়েই পড়েছিলাম ছোট মাসির কোলে। সেই ঘুম ভাঙে পরদিন সকালে। বর আসবে- নতুন বউ আসবে এই উন্মাদনায়।
রামনগরে খবরের কাগজ গিয়ে পৌঁছত প্রায় সূর্য ডোবার সময়। ইলেকট্রিসিটি নেই ফলে টিভির কোন গল্পই নেই। জনগণমাধ্যম বলতে রেডিও। যাতে খুব সহজে রেডিও বাংলাদেশ এবং রেডিও সিলোন আসত,কিন্তু বিবিধ ভারতী কখনই ধরা যেত না। কলকাতা ক এবং খ মাঝে মাঝে ঝাঁকি দর্শন দিত বটে তবে তার জন্য রেডিওটিকে নিয়ে রীতিমত কসরত করতে হত। কি নিস্তরঙ্গ জীবন ছিল ভাবুন।দেশ যদি রাতারাতি শত্রুপক্ষের করায়ত হয়ে যেত তাহলেও বোধহয় দিন দুয়েকের আগে রামনগরবাসীরা কিছুই জানতে পারত না। কারো খুব একটা জানার উৎসাহও ছিল বলে মনে হয় না। দেশ বা জাতীয় সংবাদের তুলনায় স্থানীয় গ্রাম্য পরনিন্দা পরচর্চাতেই অধিবাসীরা অধিক বরং বলা চলে অত্যধিক উৎসাহী ছিল।
ব্যতিক্রম ছিলেন বড় মেসোমশাই এবং অবশ্যই কিছুটা আমায় ছোট মেসোও। ছোটোর উৎসাহে বড় সকাল থেকেই রেডিও নিয়ে কসরত করছিলেন,হঠাৎ কি যে হল,বড় মেসোমশাই চিৎকার করে উঠলেন চুপ চুপ চুপ। শর্ট ওয়েভে ইংলিশ খবরে এমন কিছু বলছে, যে ক্ষণিকের মধ্যেই চূড়ান্ত নীরবতা নেমে এল উৎসবমুখর বিয়ে বাড়িতে। যারা ইংরাজি বুঝল না,তাদের বাংলায় বুঝিয়ে দিল পাশের জন। কিছু একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেছে বুঝতে পারলাম। বহু লোক রাতারাতি মারা গেছে। বড় মামা বিয়েতে আসা এক ভদ্রলোকের পরিবার থাকেন ঐ শহরে। তিনি উদ্ভ্রান্তের মত খানিক দৌড়দৌড়ি করলেন। তারপর হাঁচোড়পাঁচোড় করে ব্যাগ পত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লেন কিচ্ছুটি দাঁতে না কেটে। তখন মোবাইল ছাড়ুন ল্যাণ্ডফোনই দুর্লভ। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে একটাও ল্যাণ্ডফোন থাকত না। যারা ফেবুতে আঁতেল মার্কা পোস্ট দেয় যে মুছে যাক সোশাল নেটওয়ার্ক, হারিয়ে যাক মোবাইল, পাড়ার মোড়ে শুধু একটা ডায়ালটোন ওলা ফোন থাকুক। লুপ্ত হোক ইমেল। ফিরে আসুক চিঠি ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদের আমার সিরিয়াসলি মাইরি,“ক্যালাতে” ইচ্ছা করে।বাপ তোরা জঙ্গলে গিয়ে থাক। তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব যে আমাদের কতদূর এগিয়ে দিয়েছে,তা সেদিনের কথা ভাবলেই বুঝতে পারি। কি সাংঘাতিক মানসিক অবস্থা হয়েছিল ওণার তা বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। তবে একজন ইস্পাত শীতল মিলিটারি ম্যান ও নিজের পরিবারের বিপদ সম্ভবনা দেখলে আলুভাতে মার্কা হয়ে যায় তা আমার স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করা।
শোকের আবহে বিয়ে বাড়ি শেষ হল। রেডিও ছেড়ে নড়লেনই না দুই মেসোমশাই। দাদা মামারা সেই খবরের তর্জমা করে জনে জনে পরিবেশন করতে লাগল।
দেখতে দেখতে রামনগর আর আমাদের আশু বিরহে মুষড়ে পড়া দিদাকে ছেড়ে বাড়ির পথে রওনা দিলাম আমরা। বাড়ি ফিরেও সেই একই আলোচনা। ইণ্ডিয়া টুডের প্রচ্ছদে হাড় হিম করা সেই ছবি, একটা শিশু, আমাদেরই বয়সী হবে,যার খোলা দুই ঘোলাটে চোখে মৃত্যুর শীতলতা। বোধহয় কবর দেওয়া হবে,কারণ মাথা এবং গলার অনেকটাই মাটিতে ঢাকা। কি মিষ্টি,কি নিষ্পাপ একটা শিশু। ঘুমের মাঝে বেঘোরে মৃত। যার জন্য একফোঁটা চোখের জল ফেলার কেউ নেই। কে ফেলবে?সবাই তো মারা গেছে। পাহাড়ের ওপর থেকে গভীর রাতে চুপি চুপি নেমে এসেছিল মৃত্যুদূত।যার পোশাকী নাম মিথাইল আইসোসায়ানেট। পথে যাকেই পেয়েছে গিলে নিয়েছে।বিশ্বের জঘণ্যতম ইণ্ডাসট্রিয়াল ট্রাজেডি। সরকারী মতে মৃতের সংখ্যা ছিল সাড়ে তিনহাজারের একটু বেশী (৩৭৮৭) আর বেসরকারী মতে? ১৬,০০০। সাড়ে পাঁচ লক্ষ মানুষ পঙ্গু হয়ে যায় রাতারাতি। প্রায় আট হাজার মানুষ সপ্তাহ দুইয়ের মধ্যেই মারা যান। অতঃপর চলতে থাকে দোষারোপ পাল্টা দোষারোপের পালা। বিচারের বাণী কেঁদে ককিয়ে গলা শুকিয়ে মরে । মূল কালপ্রিটকে সযতনে কারা যেন পগার পার করে দেয়। জ্যাঠাইমা যেমন আমাদের দেখলেই প্রচ্ছদটা উল্টে রাখত। তেমনি ছেলে ভুলানো ল্যাবেঞ্চুস ধরিয়ে চুপ করিয়ে রাখার চেষ্টা চলে কিছুদিন। তারপর?জনতার স্মৃতিশক্তি অস্বাভাবিক দুর্বল। রোজ নতুন নতুন উত্তেজক খবর চায়। ওসব পচাপাতকো খবরে আর কার মাথা ব্যথা।
৩৪বছর কেটে গেছে ভোপাল গ্যাস লিক কাণ্ডের। কেউ মনে রাখেনি। কেউ কথা রাখেনি।
#Bhopaltragedy #ফিরেদেখা

No comments:

Post a Comment