অনির ডাইরি ১লা ফেব্রুয়ারি ২০২২
কেউ জমিয়ে রাখেন স্ট্যাম্প তো কেউ সংগ্রহ করেন কয়েন। কেউ বা জমান ’ভারি ভারি সিল্কের শাড়ি আর মোটা মোটা সোনার গয়না’। আর আমি জমাই অভিজ্ঞতা আর স্মৃতি। হরেক রঙের, হরেক স্বাদের অভিজ্ঞতা আর তার স্মৃতি।
সরস্বতী পুজো এলেই মনে পড়ে যায়, এই তো সেদিন কোলে করে বাড়ি নিয়ে এসেছিলাম তুত্তুরীর বুজু সরস্বতীকে। চুঁচুড়ার রবীন্দ্রনগর মার্কেট জুড়ে তখন খুদে থেকে প্রমান সাইজের সরস্বতীদের মেলা। তাদের মধ্যে লুকিয়ে বসেছিল আমাদের বুজুটা। কিন্তু তানিয়াদির চোখ এড়ানো কি অতই সহজ রে বাবা! ঠিক খুঁজে বার করে দরদস্তুর করে, রমেশকে দিয়ে গাড়িতে তুলিয়ে দিল তাকে। পুঁচকে ছাঁচের ঠাকুর, বড় মিষ্টি মুখটা আর গা ভর্তি অভ্রর চিকিমিকি।
কোলে করে বুুজু সরস্বতীকে গাড়িতে তোলার সময় পইপই করে সচেতন করল রমেশ, ‘একে সাবধানে কোলে নিয়ে বসবেন ম্যাডাম। পড়ে না যায়।’ বুজু সরস্বতী কিনা, বড় ছটফটে ও। গাড়ি যায়, গাড়ি যায়, আচমকা কোথা থেকে যে এক লক্কড় মার্কা বাইকওলা গাড়ির সামনে এসে উদয় হল, ঘচাং করে ব্রেক কষল আমাদের সুশান্ত। যাকে আমি বিগত কয়েক মাস ধরে প্রশান্ত বলে ডেকে আসছি, এবং সেও বিনা আপত্তিতে “হ্যাঁ ম্যাডাম” বলে সাড়া দিয়ে আসছে। কৃতঘ্ন বাইকওলা প্রাণ বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ দূরে থাকুক, চারটি গালাগাল দিয়ে পগার পার। সুশান্ত সম্প্রদায়গত ভাবে ছিল সাঁওতাল,এবং জাতবৈশিষ্ট্য বজায় রেখে নিখাদ সরল এবং সাদাসিধে। এই যদি আমাদের পুরানো ড্রাইভার রাজীব বা বিপ্লব হত, বাইকওলার কপালে সেদিন দুঃখ ছিল।
যাক বাইকওলা তো পগারপার, সুশান্ত এবং আমি হতভম্ব আর বুজু সরস্বতীর সুউচ্চ চালচিত্র, ঠিক চায়ে ডোবাতে যাওয়া মারি বিস্কুটের মত দুখণ্ড। কি হবে এবার? ভাঙা ঠাকুরে কি পুজো হয়?
গাড়ি তখন নিবেদিতা সেতুতে। একবার ভাবলাম দিই গঙ্গায় ভাসিয়ে। বাড়ির পাশের বাজার থেকে কিনে নেব খন একটা। শ আড়াই টাকা জলে গেল, এই যা দুঃখের। ভাবলাম বটে, কিন্তু ফেলতে পারলাম না। কেমন কোল ঘেঁষে বসে আছে দেখ, যেন একটা ছোট্ট মানুষ। মায়ের ওমে খুঁজছে নিরাপত্তার আশ্বাস। কি করি?
আমার থেকেও বেশি মন খারাপ সুশান্তর,“কি হবে ম্যাডাম? আমার গাড়িতে ভেঙে গেল ঠাকুরটা?ইশ্। ” বেচারার কষ্ট দেখে ফোন করলাম আমার বুড়োকে, বৃদ্ধ যদিও নাস্তিক, তবে কন্যার জন্য, রামকৃষ্ণ দেবের ভাষায়, “ দুগ্ধ এবং তামাক” উভয়ই সেবনে সক্ষম। মায়ের হাতে বাননো এক কাপ গরম চায়ে, পরম তৃপ্তির চুমুক মেরে বাবা বলল, “ধুর!ধুর! ফেলে দিবি কেন? মনে নেই, রাণী রাসমনিকে কি বলেছিলেন রামকৃষ্ণদেব? পরিবারের কারো হাত-পা ভাঙলে তাকে ফেলে দিবি? ফেভিকুইক দিয়ে জুড়ে দে না। ”
সুশান্তর যেন ধড়ে প্রাণ এল,“গাড়িতে একটা ফেভিকুইক আছে ম্যাডাম। কিনেছিলুম। আপনি নিন।” তাই করলাম। কি গন্ধ বাপস্। চোখে জল এল। কিন্তু বুজু সরস্বতীর চালচিত্র তো জুড়ল না বাপু। সুশান্ত কাতর স্বরে বলল,“ম্যাডাম, ওকে কোলে নিয়ে বসুন। শুকনো মাটি তো তাই হুহু করে আঠা টেনে নিচ্ছে। আপনাদের বাড়িতে মাটি নেই ম্যাডাম? একটু এঁটেল মাটি ডেলা করে জুড়ে দিলেই আটকে যাবে। ” শহুরে আবাসনে বিশাল বাগান, প্রচুর গাছ, কিন্তু মাটি কোথায় পাই?
সুশান্তর বিশ্বাস হয় না। ম্যাডামের বাড়ি মাটি নেই? শেষে বলে “আপনি দুঃখ করবেন না ম্যাডাম, একটা দোকান দেখে দাঁড়াব, আর একটা ফেভি কুইক কিনে দেখা যাক না?” বেলঘড়িয়া এক্সপ্রেস ওয়েতে কোথায় ফেভি কুইক পাবি বাবা? খানিক গিয়ে ঘচাং করে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। সামনে একটা মার্বেলের মূর্তির দোকান,“একটু বলে দেখব ম্যাডাম? যদি ওরা জুড়ে দেয়?” কাল বাদে পরশু সরস্বতী পুজো, অনেকে তিথিগত ভাবে কালই করবে, এখন কার দায় পড়েছে, সুশান্তর ম্যাডামের মেয়ের বুজু সরস্বতীর চালচিত্র জুড়তে বসবে। ছেলেটা শুনলে তো?
কি বলল, কি শুনল কে জানে, ফিরে এসে বলল, “দিন ম্যাডাম, ওরা দেখতে চাইছে।” কোলে করে নবজাতকের মত বুজু সরস্বতীকে নিয়ে গেল হাইওয়ের পাশের ঢালে। কালো প্লাস্টিক টাঙানো দোকানে থরে থরে দাঁড়িয়ে আছেন নানা দেবদেবী- মহাপুরুষের দল। সময় আর কাটে না। বেলঘড়িয়ার নচ্ছার মশার দল বার কয়েক আক্রমণ করে হাফ লিটার রক্ত শুষে নিল। তারপর দেখি সুশান্ত আসছে, কোলে বুজু সরস্বতী।পিছন পিছন দোকানের মালিকও উঠে এসেছে। “মার্বেলের গুঁড়ো দিয়ে জুড়ে দিয়েছি দিদি। চিন্তা নেই। ” দেখলাম রঙও করে দিয়েছেন ওণারা। সুশান্ত বলল,“ম্যাডাম ওরা কিছু চায়নি, কিন্তু ২০-৩০টা টাকা দেবেন?” মাত্র ২০/৩০? ২০০/৩০০ হলেও দিতে রাজি ছিলাম। দিতে গেলাম-কিছুতেই নেবে না। কে বলে ভালো মানুষ নেই? শেষে সুশান্ত করজোড়ে বলল,“নিন না দাদা,ম্যাডাম ভালোবেসে দিচ্ছেন, চা খাবেন খন। নাহলে ম্যাডাম দুঃখু পাবে। ”
এত ঘটা করে যিনি সুদূর চুঁচুড়া থেকে দমদম বিমানবন্দরে অবতরণ করেছিলেন এবং বাসস্ট্যাণ্ড থেকে যাকে নবজাতকের মত কোলে করে সিঁড়ি ভেঙে চার তলায় তুলেছিল শৌভিক, সেই বুজু সরস্বতীকে আর সাহস করে তাম্রলিপ্তে আনতে পারিনি আমি। যা দস্যি মেয়ে, কে জানে আবার যদি ভেঙে বসে চালচিত্র বা আঙুল। সেই কথাই বলছিলাম গাড়িতে বসে, এবারে বোধহয় আর পুজো পাবে না বুজুটা।
সেদিন রবিবার। মাসে একবার বাড়ি ফেরে আমার বর। শুক্রবার রাতে ফিরে মহানগরে প্রবেশ করে, রাতে হাটারির চাইনিজ, দিনে আর্সেলানের বিরিয়ানি আশ মিটিয়ে খেয়ে আবার রবিবার সন্ধ্যায় তাম্রলিপ্তের পথ ধরি আমরা। সেদিনটাও রবিবারই ছিল। রাত তখন আটটা। সদ্য এক পশলা বৃষ্টিতে ভিজে বোম্বে রোড দিয়ে হুহু করে দৌড়চ্ছে শৌভিকের সাদা গাড়ি। গাড়ি চালাতে চালাতে আমাদের কথা শুনছিল মহকুমা শাসকের বাহনচালক পলাশ। হঠাৎ বলে উঠল, ‘এখেনেই পুজো করুন না ম্যাডাম। সব হয়ে যাবে। ঠাকুরটা আমি বলে দেব-।’
দিন তিনেক বাদে, ঘোরতর আপিস টাইমে পলাশের ফোন, ‘ম্যাডাম পুজো করবেন তো?তাহলে বামুন ঠাকুরকে বলে দিই। কারণ এর পর দেরী কললে আর বামুন পাবেননি।’ ঠাকুর মশাই দিয়ে আবার কবে পূজিত হয় আমাদের বুজু সরস্বতী? ও তো আমিই বসি পাঁচালি খুলে, পিছনে করজোড়ে বসে তুত্তুরী আর আমাদের উমারাণী। অং-বং-চং মন্ত্র পড়ি আমি। তারপর বলি পুষ্পাঞ্জলি দেবে তো। দুটোতেই মাথা নাড়ে একসাথে। অতঃপর ‘সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমলো লোচনে-’। এই তো হয়। আমার পাঁচালিটা অবশ্যি বাড়িতেই রয়ে গেছে। সাতপাঁচ ভাবতে ব্যস্ত ছিলাম, ফোনের ওপারে অধৈর্য হয়ে ওঠে পলাশ,‘ ম্যাডাম তাহলে ঠাকুর মশাইকে বলে দিই? আমাদেরই স্টাফ, খুব বেশী দক্ষিণা লাগবেনি। আর ঢাকিকেও বলে দিই ম্যাডাম? আমাদের অফিসেরই ঢাকী, স্যারের বাড়ির পুজোয় ও বাজাবে বুলছে-।’ সরস্বতী পুজোয় ঢাক! হাসব না কাঁদব বুঝে উঠতে না উঠতেই কেটে গেল ফোন-
অনির ডাইরি ২রা ফেব্রুয়ারি, ২০২২
‘হ্যাঁ গো দিদি তোমাদের বাড়িতে সরস্বতী পুজো হয়?’ যাঁদের উদ্দেশ্যে বলা, তাঁদের একজন ছোট হাত কোদাল দিয়ে বাগানের মাটি কোপাচ্ছিলেন, অপরজন ব্যস্ত ছিলেন চুপড়ি করে ঘাস তুলতে। দুজনেই খুব কথা বলতে ভালোবাসেন, ভালোবাসি তুত্তরী আর আমিও। তাই সক্কাল সক্কাল দিদিরা কাজে এলেই আমরা মা মেয়ে গুটিগুটি এসে দাঁড়াই, দু চারটে কুশল সংবাদ বিনিময় হয়। দিদি বা মাসিরা গল্প শোনান আর কোন কোন বড় সাহেবের বাংলোর বাগান ওনাদের হাতে তৈরি। কেমন সুন্দর ফুল ফোটে সেথা, কত কত সব্জি ফলে সেথা।
'এই এত্ত বড় বড় গেঁদা, দেখেন মেডাম। সব আমাদের হাতে তৈরি। ও বাড়ির মেডাম তো সকাল বিকেল ছবি ছারতেছেন। তারপর কত্ত কমলি(কলমি) হইছে, মেথি হইছে। ফুল কপি, বাঁধা কপি, গাজর, পালং শাক,নঙ্কা, টমেটো-’। হতভাগ্য আমরা। আমাদের বাগানে মহকুমা শাসকের আদরের বাহনচালক কেবল ওলকপি লাগিয়েছিলেন। যেদিকে তাকাই ওল কপি মাইরি। ফুল ও কিছু লাগানো হয়েছে বটে, তবে পাশাপাশি বাংলো গুলোর তুলনায় তাদের শোভা নেহাৎই দীন। অন্য সাহেব,মেমসাহেবদের বাংলোয় গেলে তুত্তুরী আর আমি হ্যাংলার মত ফুল দেখে বেড়াই।
মাসিরা সদ্য কাজে আসছে কয়েকদিন। এসেই অমুক সাহেবের বাগান আর তমুক মেমসাহেবের গল্প জোড়াতে প্রথম দিকে খুব রেগে যেত তুত্তুরী। এখন আর রাগে না। বরং মাসিদের সঙ্গে গপ্প করবে বলে বসে থাকে। গাঁ ঘরের হরেক রকম খবর দেয় মাসিরা, যার অনেকটাই তুত্তুরীর কাছে রূপকথা। সেদিন যেমন বাড়ি থেকে এক ঝুড়ি কুমড়ো ফুল দিয়ে গেছে মাসিরা,তুত্তুরী ভাজা খাবে বলে।
আরেকদিন যেমন ভীম পুজোর গল্প শোনাচ্ছিল মাসিরা। এই জেলায় ভীম অত্যন্ত জাগ্রত দেবতা।ভীম একাদশীর দিন বিশাল আড়ম্বর সহ পূজিত হন মধ্যম পাণ্ডব। ‘ম্যালা লোকে মানত করে মেডাম। আমার ব্যাটাকে তো মানসিক করেই পেয়েছি।’ বলছিলেন প্রৌড়া। এদের পুত্রাকাঙ্খা বড় প্রবল। শ্রীমতী তুত্তুরী যে একলা একেশ্বরী, এটা কিছুতেই এদের গলা দিয়ে নামে না।
অপেক্ষাকৃতা নবীনা যিনি, তিনি বলছিলেন,‘আমার দুই মেয়ের পর ব্যাটা হয় মেডাম। আমরা তো গরীব মানুষ, আমার বর,শাশুড়ী সবাই না করে দেছিল ব্যাটা নিতে। ডাক্তারবাবুর থেকে ওষুধ ও এনে দেছিল। কেবল আমার এক বুড়ি দিদি শাশুড়ী কইলেন, তোর এত ব্যাটার শখ, তুই লে। এখনই লিস না। বাড়িতে অশান্তি হবে। দুয়েক বছর বাদ, ওষুধ খাবা বন্ধ করে দিবি নি। সে আমার কি দুঃখ মেডাম। পরের ব্যাটা দেখি, আর চোখের জল ফেলি। তারপর খুড়িমাই( উপস্থিত প্রৌঢ়া) কইল, তুই ভীমের কাছে মানত কর কেনে। তাই কল্লাম। মোর কাছে তো ট্যাকাপয়সা কিছু ছেল না। তখন তো এ সব কাম করতুমনি। তাই ঠাকুরকে কয়েছিলাম, ব্যাটা হলে,তোমায় মাখা দিয়ে পুজো দুব। তাই দিয়ে এলুম।’
তুত্তুরী আর আমার শহুরে কান বোঝে না মাখাটা কি বস্তু। খুড়িমা বুঝিয়ে দেয়, ‘সন্দেশ গো মেডাম। তুমরা সন্দেশ বলো, আমরা বলি মাখা।’ তা তুমি কি মানত করেছিলে তো দিদি, জানতে চাই আমি। উত্তর পাই খুড়িমা ভীমকে, ভীম মানত করেছিল। মানে? একসাথে বলে উঠি আমরা মা আর মেয়ে। খুড়িমা বুঝিয়ে দেয়, বড় ভীমকে, ছোটা ভীম মানত করেছিলেন তিনি। খুড়িমা বলেন, ‘আমরা গরীব মানুষ মেডাম, তাই ছোট ভীমকে শুধু জবা ফুল চেনোনি, ঐ ফুলের মালা পরিয়ে দিয়ে গেছলাম। কত লোকে কত টাকার মালা পরায় তুমি জানোনি।’ নাঃ আমি সত্যিই জানি না বটে।
মাসিদের ব্যাটা প্রেমে, প্রথমদিকে খুব আহত হত তুত্তুরী। কিন্তু রাতারাতি যে মাসিদের লিঙ্গ বৈষম্য বা নারী পুরুষের সমানাধিকার সম্পর্কে সচেতন করা যাবে না, সেটা এখন বুঝে গেছে। মাসিরা মাসিদের ভাবে থাকে, আমরা আমাদের। তাতে আমাদের সখ্য হতে কোন সমস্যা হয়নি।
আর তিনরাত পোহালেই সরস্বতী পুজো। এখনও কিছুই হয়নি আমাদের। শৌভিকের আদরের বাহনচালক পলাশ অবশ্য আমাদের সকাল বিকেল আশ্বস্ত করছে, ‘কুন চিন্তা নেই ম্যাডাম। ঠাকুর আমি বলে গেইছি। তুত্তুরীকে লিয়ে আনতে যাব। বড় ঠাকুর লিব ম্যাডাম। অরুণের ঠাকুর। খুব নাম। ও ছাঁচে ঠাকুর বানায় না ম্যাডাম। হাতে গড়ে। আপনি শুধু দেখবেন-। ’ আমি অরুণকে চিনি না, সেটা হয়তো আমারই অজ্ঞতা বটে। আমি এখনো এই শহরের কিছুই চিনে উঠতে পারিনি।
পলাশ চায়ও না, আমি চিনি। আমি দোকান যাব বললেই, পলাশ দৌড়ে আসে,‘ দাঁড়ান না ম্যাডাম, স্যারকে একবার আপিসে ছেড়ে দিয়ে, আমি নিজে যাব। একটুও সময় পাচ্ছি নে।’ সময় আমার বরই পাচ্ছে না,তো পলাশ। সেটা নিয়ে আমার কোন নালিশ নেই। মুস্কিল হচ্ছে ফুল থেকে ফল, মিষ্টি, দশকর্মা কোনকিছুই পলাশ আগে ভাগে আনতে ইচ্ছুক নয়। সবকিছুই সে টাটকা লিয়ে পালিয়ে আসবে। অর্ধেক জিনিস কিনবেও না। যেমন-‘কলাগাছ আমি বাড়ি থেকে কেটে লিয়ে আসব। পান-সুপুরি তো আমার বাড়িতেই আছে ম্যাডাম। ওটা পুজোর দিন সকালে আনব। গোমূত্র-গোময়? ও তো আমার বাড়িতেই গরু আছে ম্যাডাম। সক্কাল সক্কাল লিয়ে পালিয়ে আসব।' ইত্যাদি এবং প্রভৃতি।
এই আন্তরিকতা, স্যারের প্রতি এত ভালোবাসা প্রশংসার ঊর্ধ্বে, কিন্তু মুস্কিল হল আমাদের বাড়ির পুজো, অথচ আমার এই মুহূর্তে করার কিছুই নেই। উত্তেজনার পারদকে নামাতেই গল্প করতে এসেছিলাম মাসিদের সঙ্গে। কথায় কথায় জানতে চাইলাম, ওদের বাড়িতেও পুজো হবে কি না। জবাবে লাজুক ভাবে হেসে, মাথায় ঘোমটাটা ভালো করে টেনে, উবু হয়ে বসে দোঁহে বললেন, ‘না মেডাম। আমরা তো গরীব মানুষ। আমাদের বাড়ি পুজো হয় না।’ আমাদের বাড়ি হবে, তোমরা এসো, কেমন। বড়জন বলল, আচ্ছা। আর ছোটজন বলল,‘ম্যাডাম আমার ব্যাটাকে লিয়ে আসব? ব্যাটাটা রোজ বলে, ও মা তুমি কুথা কাজে যাও? আমায় লিয়ে যাও নি কেন?’ এত কষ্ট করে পাওয়া ব্যাটা, তাকে না আনলে হয়? তাই বললাম, এসো। সাথে বেটি গুলোকেও নিয়ে এসো বটে, ওরা মোটেই ফেলনা নয়।
অনির ডাইরি ৪ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০২২
কে বলবে রাত পোহালেই বসন্ত পঞ্চমী, জানলার বাইরে ভরা শ্রাবণের কালো আকাশ, অঝোর ধারাপাত আর মাতাল ঝোড়ো বাতাস। তুত্তুরীর মুখেও পাল্লা দিয়ে জমছে ঘন বাদল। আগামী কাল পুজো, অথচ এখনও আসেনি ঠাকুর। আসেনি পুজোর ফুল, ফল, মিষ্টি বা দশকর্মার সামগ্রী। আসেনি জলচৌকি বা পুজোর বাসনকোসন।
অথচ গতকালই আপিস টাইমে ঠাকুর আনতে যাবার কথা ছিল তুত্তরী আর তার মাসির। সেই মোতাবেক প্রস্তুতও হয়েছিল দোঁহে, মোক্ষম মুহূর্তে শৌভিকের বাহনচালক পলাশ এসে সংবাদ দিল, ঠাকুর নাকি তখনও কাপড়ই পরেননি। কি ঠাকুর রে তুই মা, পরশু তোর পুজো বলে কথা আর তুই এখনও রেডি হতে পারলিনি?
যাই হোক সে তো গতকালের কথা, আজ তো তাঁকে আসতেই হবে। পলাশ বলেই গেছে, ‘সকাল সকাল তৈরি থেকো বুকু বাবু, তোমায় লিয়ে ঠাকুর আনতে যাব।’ পলাশ জানেই না বুকু বাবুর আসল নাম শ্রীমতী তুত্তুরী এবং তাঁকে অন্য নামে ডাকলে তিনি ভয়ানক অখুশি হন। পলাশ অবশ্য নির্দোষ, যা শুনেছে তাই শিখেছে। তুত্তুরীর বাবা যে কিছু বলেই ডাকে না, আর মা যখন যা মুখে আসে সবার সামনে তাই বলেই ডাকে- বুকু, বুকাই, বকবক, বুকলু,বাকলা, বুল্টু, বাল্টু, বালটি এমনকি বক রাক্ষসএবং বকাসুর।
সাড়ে নটা নাগাদ, পলাশ কাকুর সঙ্গে তুত্তুরী আর তার মাসি বেরিয়েছে ঠাকুর আনতে, ঘড়ির কাঁটা মধ্যাহ্নের ঘর স্পর্শ করতে চলল, এখনও তাদের পাত্তা নেই। বাইরে ক্রমশঃ বাড়ছে বৃষ্টির বেগ, বৃষ্টি মাথায় নিয়েই আপিস বেরোল শৌভিক। আর কদিন বাদেই পৌরসভা নির্বাচন, গমগন করে চলছে নমিনেশন পক্রিয়া। যাবার আগে অবশ্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেল, জলদি ফেরার খুব চেষ্টা করবে আর আগামী কালকের দিনটা বরাদ্দ রাখবে শুধু আমাদের জন্য।
ভিজতে ভিজতেই গৃহে প্রবেশ করে আমাদের সরস্বতী। গাড়ি থেকে তাকে কোলে করে নামিয়ে সযতনে টুলের ওপর বসায় সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা অমিত। পুজো নিয়ে যতটা উৎসাহী তুত্তরী আর আমি, ততোটাই অমিত আর পলাশ। পলাশ সগর্ভে বলে, ‘দেখতেছেন ম্যাডাম, কেমন সোন্দর ঠাকুর। এ হল আমাদের অরুণের ঠাকুর। ছাঁচের কাজ ওর কাছে পাবেননি, সব হাতে গড়া।‘
ঠাকুর তো হল, এবার সাজানোর পালা। বেলা তিনটে নাগাদ টিপটিপে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে এসে হাজির হয় পার্বতী আর তার ছানাপোনারা। পার্বতী মহকুমা শাসকের পাকশালা সামলায়। তার দুই পুত্রকন্যার সাথে তুত্তুরীর বড়ই সদ্ভাব। সদ্ভাব রেবতীর ছেলেমেয়েদের সঙ্গেও। রেবতী বাংলোর ঝাড়ন পোঁচন এবং বাসন মাজার কাজটা করে। সম্পর্কে পার্বতী আর রেবতী সহোদরা। ওরা নাকি পাঁচ বোন, রেবতী মেজো আর পার্বতী ‘সেনো’। প্রথমবার শুনে, আমিও বুঝিনি সেনো বা স্যানো মানে কি? পার্বতী দুহিতা মিষ্টি, খুব মিষ্টি মিষ্টি করে বুঝিয়েছিল আমায়, বড়,মেজ, সেজর পর যে জন্মায়, তাকে এই জিলায় বলে স্যানো। ঠিক যেমন হাওড়ায় বলে, ‘ন’।
পুজো শৌভিকের সরকারি নিবাসে হলেও পুজো আসলে পার্বতী, রেবতী এবং আমার পাঁচ ছানা অর্থাৎ লাবণী,মিষ্টি, সূর্য, জগদীশ এবং তুত্তুরীর। রীতিমত পুজো স্পেশাল মিটিং করে তা ওদের ভালো করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। কি কি লাগবে বলো, যোগাড়ের দায়িত্ব আমার। ওদের দাবী মোতাবেক আমাদের আপিসের শান্তনু কিনে এনে দিয়েছে রঙ বেরঙের মার্বেল পেপার, ডবল সাইড টেপ, আল্পনা দেবার রঙ, তুলি, রাংতার ঝাড় এবং অন্যান্য সাজানোর উপকরণ আর রঙবেরঙের পতাকা। গতকাল রাত জেগে শিকলির কাগজ কেটেই রেখেছে তুত্তুরীর মাসি। এবার শুধু ঝটপট করে শিকলি, এরা বলে শেকল বানাতে হবে। আর ঘর সাজাতে হবে।
মেয়েগুলো বসে যায় শিকলি আর ফুল বানাতে। সাথে সাথে জমে ওঠে কাল সকাল বিকেল কে কি পরবে তার গল্প। ছেলেগুলোর ওসব সাজুগুজুতে উৎসাহ নেই, তারা হাত লাগায় সোফা,সেন্টার টেবিল ইত্যাদি সরিয়ে ঠাকুর বসার জায়গা করাতে। শৌভিকের সদ্য কাচা চাদর দিয়ে ঠাকুরের পিছনের চালচিত্র বানানো হয়। আপিস ফেরৎ যা দেখে যুগপৎ ভ্রু কোঁচকায় এবং ঠোঁট ফোলায় আমার বর। সাহস করে বলতে পারি না, এটা দু নম্বর চাদর বটে, প্রথমটা জানলায় ঝোলানোর পর বাতিল করেছে বাচ্ছাদের দল।
ভালো কাঁচিটা কার দখলে থাকবে এই নিয়ে এক প্রস্থ হাতাহাতির উপক্রম হয়, দমকা হাওয়ায় খুলে যায়, উড়ে যায়, ছিঁড়ে যায় বাইরের দরজায় এবং বারন্দার টাঙানো কাগজের শিকলি। হাওয়ার দমকে খসে পড়ে ঘরের ভিতরে সাজানো কাগজ আর রাংতার ডেকরেশন। হতোদ্যম হয়ে রাত আটটা নাগাদ বাড়ি চলে যায় ছেলেমেয়েদের দল। কালও যদি এমন বৃষ্টি হয়, কি হবে কে জানে। অমিত কেবল আশাবাদী, 'না ম্যাডাম, দেখবেন কাল সকালে সব ঠিক হয়ে যাবে। যা খুলে যাচ্ছে যাক, আমি সক্কাল সক্কাল উঠে, সব লাগিয়ে দেব।'
সাড়ে আটটা নাগাদ ফল, দশকর্মা, হোমকুণ্ড, বাসনকোসন এবং ঠাকুর বসানোর জলচৌকি নিয়ে হাজির হয় পলাশ আর নবেন্দু। ফুল, পান-সুপারি, কলাগাছ, গোমূত্র, গোময় নাকি কাল সকালে আসবে। আর আসবে মিষ্টি, একদম টাটকা-টাটকা। রাত নটায় নতুন করে ঝাঁট দেওয়া মোছা হয় ঠাকুর বসার ঘর, আলপনা দিতে বসি আমি। প্রথমে জলচৌকিতে আল্পনা আঁকা হয়, তারপর মঙ্গলঘট বসানোর জায়গায়।
রাত দশটা নাগাদ খাওয়াদাওয়ার পাট চুকলে, চৌকাঠে আল্পনা দিতে বসি আমি। সবে রাত দশটা, মহানগরে কলির সন্ধ্যা, অথচ এখানে মনে হচ্ছে যেন নিঝুম রাত। ব্যাঙ আর ঝিঁঝির ডাকে কান পাতা দায়। কি সুন্দর আল্পনা দিত ঠাকুমা। ভিজে চালকে শিলে বেটে, এক চিলতে ছেঁড়া ন্যাকড়া দিয়ে ফুটিয়ে তুলত অনুপম নক্সা। কি না থাকত তাতে, ফুল, লতাপাতা, ধানের ছড়া আর সবার শেষে লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ। তখন তো ইউটিউব ছিল না, কোথা থেকে যে ভেবে ভেবে নক্সা বার করত ঠাকুমা কে জানে। বাইরের জোলো ঠাণ্ডা হাওয়ায় রীতিমত কাঁপন ধরে যাচ্ছে, তারই মধ্যে ইউটিউব খুলে আল্পনা দিচ্ছি আমি আর পিছন থেকে বিশেষজ্ঞ মতামত দিচ্ছেন শ্রীমতী তুত্তুরী। আমার অন্যমনস্কতার সুযোগে মাসির সাজের বাক্স ঘেঁটে বেরিয়েছে কবে কার জমে যাওয়া মেরুন নেলপালিশের শিশি। তাই নিয়ে বিস্তর কসরৎ করছে দোঁহে, তিনবার বললাম, আমারটা পরো, কান করে না কেউ। আমারই পরা হয়নি অবশ্য, আর কখন পরব কে জানে!
সিকিউরিটির ঘর পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে, রেলিং এ ভর দিয়ে দাঁড়ায় অমিত, তারপর মোবাইলে একটা ছবি আমায় দেখিয়ে, অত্যন্ত কুণ্ঠা ভরে বলে,‘ ম্যাডাম আমায় যদি সুযোগ দেন, হুবহু এইটা এঁকে দেব-।বেশীক্ষণ লাগবেও না। মানে আপনার তো আরও অনেক কাজ আছে।’ আমি অনুমতি দেবার কে, এটা তো ওদের সবার পুজো, যার যা ইচ্ছে হয়, যা প্রাণ চায় করুক। শুধু আনন্দে থাকুক সব্বাই, আমি তো শুধু এটাই চাই।
আরো কয়েকজনকে নিমন্ত্রণ করলাম বটে, সন্ধ্যে বেলা শৌভিক বাড়ি ফিরতেই ঘোষণা করলাম, পুজোর অন্য কোন কাজ আমায় করতে দেওয়া হচ্ছে না বটে, তবে একটা কাজ আমি করেছি। কটা লোককে নিমন্ত্রণ করেছি বটে। শৌভিক শুধাল কাদের? বললাম সিকিউরিটি ছেলে দুটোকে, ছানাপোনা সমেত ঘাস ছেঁড়া মাসিদের, রান্নার দিদি, বাসন মাজার দিদি আর তাদের ছানা এবং পোনাদের। অনুমতি করলে ওদের বরদেরও বলতে পারি। খামোখা বরের জন্য আর রান্না করবে কেন ওরা? এবার পলাশের পালা। পলাশ তুমিও এসো কেমন? তবে একা নয়, সপরিবারে কিন্তু।