Sunday, 14 January 2024

অনির ডাইরি ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৩

 


#অনিরডাইরি 


যবে থেকে শুনেছি অরূপ বিয়ে করছে, তবে থেকে ঠিক করেছি এই শাড়িটাই পরব। বড় সাধ করে, গুচ্ছ-গুচ্ছ রিলস দেখে, রিভিউ পড়ে, কিনেছিলাম শাড়িটা। আজ থেকে বছর ১৫ বছর আগে আমার বিয়ের বেনারসিটার যা দাম ছিল, প্রায় সমমূল্যে কিনেছি শাড়িটা। যার জন্য কেনা এবং পরা তিনি তো ফিরেও তাকালেন না। নিকষ আঁধারের চাদরে মোড়া বঙ্গোপসাগরের অদূরে, এক রেস্তোরাঁয় নৈশ ভোজে গিয়েছিলাম দোঁহে, দুটো প্রেমের বুলি ছাড়ুন, তাঁর নীরস শুঁটকো তত্ত্ব কথার দাপটে মনে হচ্ছিল জানালা গলে পালিয়েই যাই। নেহাৎ আটকে গিয়ে কেলেঙ্কারি হবে- 


যাই হোক, তারপর থেকে আর পরাই হয়নি শাড়িটা। সুযোগ আসে কোথায়? জেলার ভূত আমি, মহানাগরিকদের যাবতীয় জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান থেকে সদা ব্রাত্য। আর এই মেদিনীপুরে কে আর রোজ রোজ বিয়ে করছে বা পার্টি দিচ্ছে। এইসব ভেবেচিন্তে পরে তো এসেছি শাড়িটা, কিন্তু স্বস্তি পাচ্ছি না মোটে। শাড়ি তো নয় যেন ছাতার কাপড়। কেবল হড়হড়িয়ে খুলে যেতে চায়। চাকা লাগানো চেয়ারে বসতে গেলে প্রতি মুহূর্তে মনে হয় হড়কে পড়ে গেলাম বুঝি। আঁটোসাঁটো করে গাছ কোমর বেঁধে পরতে গেলে জারদৌসি কাজের খোঁচায় পেট কুটকুট করে।


যাই হোক, কটা তো ঘন্টা, সন্ধ্যে নামলেই সদল বলে গিয়ে হাজির হব অরূপের ভাড়া করা লজে। যেদিন লাজুক মুখে নিমন্ত্রণ করতে এসেছিল ছেলেটা, সেদিন নির্লজ্জের মত বলেই দিয়েছিলাম, "তাড়াতাড়ি খেতে দিবে তো?" এদিকে রাত সামান্য গভীর হলেই বন্ধ হয়ে যায় অটো,টোটো,ট্রেকার।  যোশুয়া আর মণীশ সেই হাওড়া ফিরবে, রবি আর সন্দীপ বাগনান। আমি আর বেদজ্যোতি কাঁথি। ফলে বেশি দেরী করা যাবে না। বধূ সেজে আসতে দেরি করতেই পারে, আমরা পৌঁছেই সটান হাত ধুয়ে খেতে বসব।


অরূপ কথা দিয়েছে, সাড়ে ছটার মধ্যেই সব রেডি হয়ে যাবে। নিমতৌড়ির এই নব্য প্রশাসনিক ভবন চত্বর থেকে যেতে সময় লাগবে মিনিট পঁচিশ। সবমিলিয়ে সাড়ে পাঁচটার ঘন্টাটা পড়ার অপেক্ষা, বিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেব আমরা। পৌঁছে আগে ফুচকা, কফি, পকোড়া তারপর মেন কোর্স। মেনুও জেনে নিয়েছি আগেভাগে। সব মিলিয়ে জনা পনেরো আমরা। মুড়ির টিনের মত ঠেসেঠুসেও কোন গাড়িতে ধরবে না, তাই বাইক নিয়ে যাবে কয়েকজন। কে কার বাইকে চাপবে, সেই নিয়ে খুনসুটি চলছে সকাল থেকে। আমাদের রবিবাবু এমন মাঞ্জা দিয়েছেন যে আমি পর্যন্ত হীনমন্যতায় ভুগছি, গোটা অফিস সেই নিয়ে চর্চায় উত্তাল। বিয়ে বাড়িতে বরকে আদৌ চেনা যাবে তো!


আজ বড়ই খুশি খুশি আবহাওয়া আকাশে-বাতাসে। এমন সময় যা হয় আর কি, ঢং করে মেসেজ ঢুকল জনৈকা বড় ম্যাডামের, সঙ্গে ঢুকল মুখ্যসচীবের এক খান পত্র। মুখ্যসচীব জেলাশাসকদিগকে কিছু নির্দেশ দিয়েছেন, যা আমাদের দপ্তর সংক্রান্ত। সেই নিয়েই আলোচনা করতে আমায় যেতে বলা হয়েছে, সন্ধ্যেবেলা। কি সর্বনাশ সন্ধ্যেবেলা কেন! তাহলে বে বাড়ি যাব কেমনে? আর তাছাড়া এই নিয়ে আলোচনা করার আমি কে রে বাবা? মানছি জেলা শাসকের করণে আমাদের অফিস, তাই বলে এই জেলার সব থেকে বড় অফিসার তো আমি নই। তিনি আমার বড় সাহেব, যিনি হলদিয়ায় বসেন। বাক্যালাপ, আলোকপাত, চায়ের চর্চা ইত্যাদি যা খুশি করার জন্য তিনিই যোগ্য ব্যক্তি।


তাঁকেই ফোন করলাম, যে দাদা তোমার জেলা তুমি সামলাও, আমি চললাম বিয়ে বাড়ি। কপালের এমন ফের, বড় সাহেবের সেই দিনই মহানগরের গুরুত্বপূর্ণ মিটিং। অগত্যা গরীবকেই যেতে হবে জবাই হতে। কি বলব সেটা তো অন্তত বলে দাও। বড় সাহেব হেসে বললেন,"বলো আমাদের দপ্তর থেকে এই সংক্রান্ত কোন নির্দেশ আমরা এখনও পাইনি। টাকা-পয়সাও কিচ্ছু নাই। তবুও জেলাধীশ যা নির্দেশ দিবেন, তাই শিরোধার্য।"


একটা একটা করে ফাইনাল পেমেন্ট ছাড়ি, আর জানলার বাইরে দেদীপ্যমান তপনের দিকে চাই, এবার তো ঢলে পড় রে বাবা। আজ না হয় বিকেল চারটেতেই সন্ধে করে দাও রে বাবা। সূর্যদেব একটা কথাও শুনলেন না বটে, তবুও সাহস করে চারটে নাগাদ ফোন করলাম ম্যাডামের আপ্তসহায়ককে। ম্যাডাম যদি চেম্বারে থাকেন তো সটান গিয়ে হাজির হই। সাজ দেখে বুঝতেই পারবেন আশা করি, যে বিয়ে বাড়ি যাব সন্ধ্যে হলে।


অভাগা যেদিকে চায়-  পিএ বাবু কইলেন," ম্যাডাম তো ডিএম সাহেবের সাথে মিটিং করছেন।" আচ্ছা ঠিক আছে, সাড়ে চারটে নাগাদ আবার করলাম, আবার একই জবাব। পৌনে পাঁচটা, পাঁচটা, সোয়া পাঁচটা- বারবার একই কথা শুধাই আমি, একই জবাব দেন তিনি। শান্তনু শুকনো মুখে এসে জানতে চায়," তাহলে কি হবে ম্যাডাম? আপনি যেতে পারবেননি?"


তাই আবার হয়, আমাদের অরূপের শুভবিবাহ আর তাতে গরহাজির থাকব আমি! পৃথিবী উল্টে গেলেও যাব। বললাম, তোমরা রেডি থাকো। আমি চললাম ম্যাডামকে পাকড়াও করতে। পৌনে ছটা নাগাদ যখন প্রশাসনিক ভবনের বি ব্লকের তিন তলা থেকে নেমে, প্রশস্ত আঙিনা পেরিয়ে এ ব্লকের তিন তলায় উঠছি, অবাক হয়ে তাকাচ্ছে ঘরফেরতা সরকারি লোকজন, "এই ম্যাডামটা আজ এত সেজেগুজে আসতেছে কেন?" আমি নিরূপায়, আমি ভ্রূক্ষেপহীন।


ম্যাডামের চেম্বারে ঢুকে দেখি শূন্য আসনের সামনে ফাইলের ছোটখাটো শিবালিক-হিমাচল এবং হিমাদ্রি। ম্যাডামের মুখ্য আর্দালি, যাঁকে আমি ঠাকুরমশাই বলে সম্বোধন করি, দৌড়ে এসে বললেন," ম্যাডাম আপনার আগে অনেকে লাইন দিয়েছে। ওই যে দেখেন ফাইল দিয়ে লাইন রাখা।"

থাক লাইন, আমি বেলাইনেই ঢুকব আজ। আমায় বিয়ে বাড়ি যেতে হবে রে বাবা। ইঁট পাতার মত সবথেকে উপরের ফাইলটার উপর হাতের দু কপি রিপোর্ট রেখে, পেপার ওয়েট চাপা দিলাম। গ্যাঁট হয়ে বসলাম সবথেকে সামনের চেয়ারটায়, কোনমতে যাতে আমাকে টপকে কেউ ম্যাডামের কাছে না ঘেঁষতে পারে। 

ঘড়ির কাঁটা ছুটছে আপন লয়ে, আমার হৃদপিণ্ড ছুটছে তার থেকে আড়াইগুণ দ্রুত গতিতে। ছটা- সোয়া ছটা- সাড়ে ছটা বেজে গেল প্রায়। স্বর্গের ৩৩ কোটির মধ্যে যতজনকে চিনি ডেকে ফেলেছি, কারো দেখা নেই, ম্যাডামেরও না। বসে বসে লম্বা মেসেজ লিখলাম ম্যাডামকে, বড় সাহেব যা বলতে বলেছেন তাই সুচারু ইংরেজিতে লিখলাম, সাথে রিপোর্টটাও দিলাম টাইপ করে। সবশেষে বিনীত অনুরোধ করলাম, প্লিজ ম্যাডাম যদি অনুমতি দেন তো বিদায় নিই। একটা বিয়ে বাড়ি যাবার আছে, আমার অন্যান্য সহকর্মীবৃন্দ আমার জন্য প্রতীক্ষারত।


"উত্তর আসবে না, তুমি আসবেই আমি জানি" করে ম্যাডাম এসে উপস্থিত হলেন আরো মিনিট ১৫ দেরীতে। পিছন পিছন ঢুকলেন জনা তিনেক গণ্যমান্য আধিকারিক। কেউ কিছু বলার আগে করজোড়ে মার্জনা চাইলাম আমি, একটু যদি আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়, যা বলার সব মেসেজে লিখে পাঠিয়েছি আমি। ম্যাডাম জিভ কেটে বললেন," আপনি মেসেজ করেছিলেন, আমি এতক্ষণ দেখিইনি। আসলে একটা ভিসি ছিল, তারপর বেশ কয়েকটা মিটিং, মোবাইলের দিকে তাকানোর সুযোগই হয়নি।কিন্তু আপনি এতক্ষণ অপেক্ষা করলেন কেন, চলে গেলেই পারতেন।


 উঁচু গোড়ালির জুতো আর হলহলে শাড়ি সামলে, বাতাসের থেকেও দ্রুত গতিতে দৌড়ই আমি, লিফট আসতে বড্ড দেরী করছে, সিঁড়ি ধরি আমি।  আমার প্রতীক্ষায় রয়েছে ১৪ জন, " সৌরভ-রঞ্জিত- শান্তনু -শুভাশিস - শুভদীপ্ত----- চলো চলো আর এক মুহূর্ত দেরি নয়। ফুচকাওয়ালা বসে আছে আমাদেরই প্রতীক্ষায়, ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে কফি আর পকোড়া গুলো, খেতে হবে তো। ছবি তুলতে হবে তো। জলদি জলদি গাড়ি বাইক স্টার্ট করো সবাই। এহে বড্ড রাত হয়ে গেল গো। যারা যাবার সময় সোহাগ করে বন্ধুর বাইকে যাচ্ছে, ফেরার সময় নিজের ব্যবস্থা নিজেরা করবে, একটাকেও বাড়ি পৌঁছিয়ে দেব না আমি।হক বাবু, উপহারটা নিলেন? খালি হাতে গেলে যদি খেতে না দেয় -

অনির ডাইরি ৭ই ডিসেম্বর, ২০২৩

 


#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 


হঠাৎ একদিন শুনলাম সুন্দর স্যার আসবেন। জে সুন্দরশেখর, প্রাক্তন আইএএস, অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত মুখ্য সচীব। কোন এক কালে কাঁথির মহকুমা শাসকের দায়িত্বভার সামলে ছিলেন। বর্তমানে হায়দ্রাবাদের পাকাপাকি বাসিন্দা। কি যেন কাজে সস্ত্রীক দীঘা আসছেন, এখন যদি বর্তমান মহকুমা শাসক অনুমতি দেন, তো ওনার প্রাক্তন নিবাসটি এক ঝলক দেখতে চান।  


বর্তমান মহকুমা শাসক, এহেন আব্দারে কিঞ্চিৎ হতভম্ব হয়ে সটান দৌড়ে এলেন তাঁর সহধর্মিনীর কাছে। অধম তখন সদ্য অফিস থেকে ফিরে মেয়ে পেটাতে, থুড়ি পড়াতে বসেছে। এমন সময় ঢংয়ের ছদ্ম অনুমতি ভিক্ষায় যৎপরনাস্তি ক্রুদ্ধ হলাম। এ বাড়ির কোন কাজে, কবে, কে আমার অনুমতির তোয়াক্কা করে? তাছাড়া বাড়িতে যে অতিথি স্বয়ং আসতে চান, তাকে না বলার কুশিক্ষা আমার আছে নাকি? 


গৃহকর্তা কান এঁটো করে হেসে বললেন, ' জানি তো। সেই ভরসাতেই বলেছি, অবশ্যই আসবেন।' জবাবে সুন্দর স্যার বলেছেন, "তোমার গিন্নি যদি ওই দিন থাকেন তো খুব ভালো হয়। আমার স্ত্রী ওর জন্য সামান্য কিছু উপহার নিয়ে যাবে।" কি সর্বনাশ! আবার উপহার কেন? অনাগত মান্যগণ্য অতিথিদের জন্য কি প্রতি-উপহার কেনা যায়, সেই নিয়ে বেশ খানিক মস্তিষ্ক প্রক্ষালন-পূর্বক আমরাও কিছু কিনলাম টুকটাক। শৌভিককে বললাম," বল, এলে কিন্তু অবশ্যই খেয়ে যেতে হবে।" বিজ্ঞের মতন মাথা নেড়ে শৌভিক বলল, "ঠিক ঠিক, খাবারে  ইডলি ঢোসা, দই বড়া রাখব।" 


এই না হলে আমার বর। দক্ষিণ ভারতীয়কে উনি দক্ষিণী খাদ্য দিয়ে আপ্যায়ন করবেন, কেন রে ভাই? বলি আমাদের কালিয়া, কোর্মা, পোলাও, শুক্তো, ছেঁচকি, চচ্চড়ি, ছ্যাচড়া, ডালনা, অম্বল, দই, মিষ্টি কি দোষ করল? শুধু একবার জেনে বল ওনারা নিরামিষাশী কিনা, বাকি বন্দোবস্ত আমার।

জানতে গিয়েই বাঁধল বিপত্তি। সুন্দর স্যার বললেন, কলকাতা থেকে কাঁথি পর্যন্ত উনি না খেয়ে আসতে পারবেন না।  কারণ ওনার ভাষায়, "When I'm hungry, I get very angry."  তাই কোলাঘাটে থেমে, লাঞ্চ করেই আসবেন, আমরা যেন অযথা ব্যস্ত না হই। 


বাপরে কি রাগী লোক রে ভাই! যতই বলুক কিছু খাব না, তবুও সামান্য জলযোগের ব্যবস্থা করাই হল। তখন গরম কাল, তাই- দইয়ের ঘোল, তরমুজ, আঙুর, পাকা পেঁপে, বাগানের কাজু, রসগোল্লা আর মিষ্টি দই। ভালো চা আনানো হল খুঁজে পেতে। কাঁথিতে যে চা আমরা খাই, তাতে না থাকে গন্ধ না স্বাদ। সবকিছু সেরে, সাজিয়ে গুছিয়ে, আদর্শ বঙ্গ বধূর মত সুতির শাড়ি পড়ে, অপেক্ষা করতে লাগলাম মাননীয় অতিথিদের জন্য।


অফিস ছেড়ে তিনটে নাগাদ চলে এল শৌভিক। কাঁটায় কাঁটায় সোয়া তিনটে, বাংলোর মস্ত সবুজ গেটটা খুলে, ঢুকে এল দুধ সাদা ইনোভা গাড়িটা। শৌভিক আর আমি ত্রস্ত হয়ে এগিয়ে যাবার আগেই গাড়ির দরজা খুলে লাফিয়ে বেরিয়ে এলেন, এক দশাসই চেহারার প্রৌঢ়। এক গাল হেঁসে, আমাকে করজোড়ে নমস্কার জানিয়ে বললেন, " বৌদি কেমন আছে?"  দক্ষিণ ভারতীয়দের মত ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, মাথা ভর্তি একরাশ কালো চুল, ততোধিক কালো ঝোড়া গোঁফ এবং এক গাল হাসি। কে বলবে, এই লোকটা প্রায় সত্তর? 


গাড়ির অন্য দিকের দরজা খুলে ওনার স্ত্রী নেমে এলেন, আকৃতি এবং প্রকৃতিতে একেবারেই সুন্দর স্যারের বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। নাতিদীর্ঘ উচ্চতা, গৌরবর্ণ, ধীর, স্থির, লক্ষীমন্ত মহিলা। আমরা যথোচিত আপ্যায়ন পূর্বক ভিতরে যাবার অনুরোধ করলাম যুগলে। কিন্তু ওনাদের চোখ বাংলো থেকে আর সরেই না। দুজোড়া চোখে উপচে পড়ছে একরাশ স্মৃতি আর অপার মুগ্ধতা। দেশী ভাষায় পরস্পরকে কিছু বলতে শুরু করে বোধহয় হুঁশ ফিরে পেলেন দুজনে। আমাদের উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে ভাষাটা বদলে গেল  ইংরেজি, হিন্দি আর বাংলার সংমিশ্রণে। স্ত্রীর সাথে কয়েক মুহূর্ত সোহাগী দাম্পত্যালাপ করে, সুন্দর স্যার বললেন, "জানো, এইখান থেকে প্রথম সংসার জীবন শুরু করি আমরা-"। 


বৈশাখের প্রচণ্ড দাবদাহে পুড়ছে কাঁথি। কোন মতে প্রৌঢ় দম্পতিকে বসার ঘরে এনে, বাতানুকূল যন্ত্র চালিয়ে দেওয়া হল। মুখের সামনে ধরা হল দইয়ের ঘোল। টাটকা ফল, মিষ্টি আর কাজু। কাজু গুলো বাংলোর গাছের শুনে আর প্রতিবাদ করলেন না দোঁহে। ঘোলে চুমুক দিতেই সুন্দর স্যারের জাঁদরেল কালো গোঁফ, পলকে সাদা। 


মাতৃসুলভ ভঙ্গিতে ম্যাডাম বললেন, " জানো আমরা ক্লাসমেট। বিয়ের পর ও হঠাৎ করেই সিভিল সার্ভিস পরীক্ষাটা দিয়েছিল, বেঙ্গল ক্যাডার হওয়াতে কি খুশি যে হয়েছিলাম আমরা। কাঁথিতে পোস্টিং হল যখন, আমিও চলে এলাম বাচ্ছাদের নিয়ে। তখন বাংলোটা এমন ছিল না। চারিদিকে শুধু মাটি আর মাটি। সেবার শীতে ফুলকপি আর পালং শাক লাগিয়েছিলাম আমরা, এত হয়েছিল খেয়ে বিলিয়েও শেষ করতে পারিনি।"


বলতে বলতে কি যেন মনে পড়ে যায়, ভদ্রমহিলা আড় চোখে সুন্দর স্যারের দিকে তাকিয়ে বলেন, " একবার কি হয়েছিল জানো? সেদিন রবিবার, সুন্দরজী বাগানে দাঁড়িয়ে গাছে জল দিচ্ছেন, আর একটা লোক এসে বলে, 'এই মালি, এসডিও সাহেব আছেন?' সুন্দরজীও এত বদমাইশ ছিলেন, বললেন, ' একটু দাঁড়ান দেখে আসছি।'"


সম্মিলিত হাসির প্লাবনে ধুয়ে যায় মোদের সরকারি আবাসের বসার ঘরটা। শৌভিকের সাথে সুন্দরজীর গল্প জমে, তখন আর এখনকার কাজের ধারা, গণ্ডি, পরিসর, জটিলতা ইত্যাদি নিয়ে। আমার কাছে ম্যাডাম খুলে বসেন স্মৃতির ঝাঁপি।" খুব ভালো লাগতো কাঁথি, জান তো। আমার ছেলেমেয়েদেরও খুব প্রিয় এখানকার স্মৃতি। আমরা এখানে আসছি বলে ওদের কি আনন্দ। রাত্রি হলেই ফোন করবে সবাই আর খুঁটিয়ে জানতে চাইবে, কি দেখলাম। কেমন দেখলাম। চেনা কার সাথে দেখা হল এইসব। 


কাঁথি ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না আমাদের, কিন্তু সমস্যা দেখা দিল যখন বাচ্ছারা একটু বড় হল। একটাও ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল ছিল না তখন আশেপাশে। বাড়িতে রেখে পড়াব যে, ইংরেজি জানা কোন ভালো টিউটর পর্যন্ত পাইনি তখন। কাঁথি আমার জন্য একদিক দিয়ে খুব লাকি।

এখান থেকেই চাকরির পরীক্ষা দিলাম, পেয়েও গেলাম। ছেলেমেয়েকে এখানে রেখেই গিয়ে জয়েন করতে হল হায়দ্রাবাদে। ২-৩ মাস বাংলো স্টাফেদের কাছেই রয়ে গেল ছেলে মেয়ে আমার। ওরা এত ভালোবাসতো আমার বাচ্ছাদের, যেদিন নিয়ে গেলাম সবার কি কান্না।"


 সুন্দর স্যারদের চমকে দেবে বলে,সেই সময়কার বাংলো স্টাফদের খুঁজে বার করার চেষ্টা করেছিল শৌভিক। পায়নি। সবাই বর্তমানে অবসৃত, কেউ কেউ মৃত। ম্যাডাম জানতে চান," পাশের ঘরটা কি করো তোমরা?" বুঝতে পারি উনি আর একবার ছেড়ে যাওয়া জীবন আর সংসারকে অনুভব করতে চান। সাদরে ভিতরে নিয়ে যাই, খাবার ঘর থেকে রান্না ঘর, অতিথি ঘর থেকে তুত্তুরীর ঘর, আমার অগোছাল শোবার ঘর -এক পা এক পা করে হাঁটেন উনি, পরম মমতায় হাত বোলান সরকারী ভাড়া বাড়ির উজ্জ্বল হলুদ রঙা দেওয়ালে। " এর আগেও একবার এসেছিলাম জানো তো। একদম ভালো লাগেনি। কি নোংরা, ধুলো পড়া, কুৎসিৎ ছিল সবকিছু। এবার খুব ভালো লাগছে। কি পরিষ্কার করে গুছিয়ে রয়েছ তোমরা।" স্মৃতি মেদুরতায় ভারী হয়ে আসে কণ্ঠ, "এই খানে খেতে বসতাম আমরা, এই ঘরটায় বান্টি পড়ত স্যারের কাছে, এই ঘরে মেয়ে নিয়ে ঘুমাতাম আমি, ওই ঘরের দরজা খুলে এক বর্ষায় এত বড় একটা সাপ দেখেছিলাম আমি -"। বলতে - শুনতে খেই হারিয়ে ফেলি আমরা। আমার মধ্যে উনি ওনার অতীতকে দেখেন আর আমি ওনার মধ্যে দেখি আমার ভবিষ্যৎ।


রোদ পড়ে আসে, সমুদ্র বায়ুর দাপটে মাথা ঝাঁকায় বাংলোর বুড়ো আম-জাম-তেঁতুল-কাজুবাদাম গাছ গুলো।শৌভিক আমন্ত্রণ জানায় অফিস দেখতে যাবার জন্য। উৎসাহিত হয়ে পদব্রজেই রওনা দেয়, প্রাক্তন আর বর্তমান মহকুমা শাসকদ্বয়। আমার হাত ছাড়েন না ম্যাডাম। "তুমি আমার সাথে গাড়িতে চলো।"  ইনোভা গাড়ি ভর্তি তন্তুজের শাড়ি, শ্রীলেদার্সের জুতো ইত্যাদি, এক টুকরো কলকাতা। 


ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সুন্দর স্যারকে প্রতিটা সেকশন দেখায় শৌভিক। সুন্দর স্যারের সমসাময়িক লোকজন কেউই আর নেই, ওনার বিদায় সম্বর্ধনায় গান গেয়েছিল যে ছেলেটি, তিনি বর্তমান মহকুমা শাসকের গুরুগম্ভীর আপ্ত সহায়ক। মহকুমা শাসকের চেম্বারে বসে অন্ধ্রপ্রদেশ আর তেলেঙ্গানার বিবাদের কারণ বিশদে বোঝান ম্যাডাম। নিমন্ত্রণ করেন ওনার শহরে, " হায়দ্রাবাদ এসো।" সুন্দর স্যার বলেন, " চলো, চলো আমাদের সাথেই চলো। এত বছর আছি, আমরাও কিছু দেখিনি। তোমাদের সাথে আমরাও ঘুরব।" শৌভিক এর দিকে তাকিয়ে বলেন, " ডিএম কে বলব? দুদিন ছুটি দিতে -"। শৌভিক হাসে, ম্যাডাম মুখ ঝামটে বলে, " সুন্দরজীর রসিকতার রোগ আছে। কথায় কথায় ছড়া বানায় আর লোকজনের হাড় জ্বালায়। আজ সকালে তোমার বরকে কি বলেছে শুনেছ?" রাবণের মত হাহা করে হেসে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে সুন্দর জী বলেন, "হ্যাঁ বলেছি, when I'm hungry, I get very angry."


বেলা গড়িয়ে যায় সূর্য ঢলে পড়ে। বিদায় নেন ওনারা। যাবার আগে আলিঙ্গন আর আশীর্বাদ করে যান ম্যাডাম, আর সুন্দর স্যার আমার মাথায় হাত রেখে বলেন, " চলে যাচ্ছি আম্মা, তবে যাবার আগে অনেক আশীর্বাদ করে যাচ্ছি। খুব ভালো থেকো। তোমাদের থেকে যে আতিথেয়তা পেলাম, অন্নপূর্ণা আর আমি বিমোহিত। এই না হলে বাঙালি! এই আতিথেয়তা কেবল বাঙালিরাই দিতে পারে। তাই দেখো, অবসর নেবার পরও,নানা ছুঁতোনাতায় বারবার ফিরে আসি এই রাজ্যে।"

অনির ডাইরি ১লা ডিসেম্বর, ২০২৩

 


#সব_চরিত্র_কাল্পনিক #অনিরডাইরি 


সে অনেককাল আগের কথা। তারপর কত্ত কি হল, বারো বছরের বনবাস, আড়াই বছরের অজ্ঞাতবাস, আরো না জানে কত, কত্ত কি। সেদিনও এমনিই মিঠে রোদ উঠেছিল। বাতাসে ছিল হাল্কা হিমেল স্পর্শ। অল্প ধোঁয়াশা-কুয়াশা মাখা মহানগর জুড়ে কেমন যেন উৎসবের গন্ধ। রামধনু রঙা পশম আর পশমী পোশাকের পসরা সাজিয়ে ওয়েলিংটনে বসেছিল একেবারে পুতুলের মত দেখতে ভুটিয়া নরনারীর দল, ময়দানে বাঁশ বাঁধছিল যেন কারা, মেলা বসবে যে।  


সেজে গুজে,গেরুয়া সবুজ রঙা সবথেকে ভালো জামাটা পরে বেরোল যখন মেয়েটা, ঘড়ি বলছে বেলা এগারো। সাজতেও তেমন জানত নাকি মেয়েটা? সাজ বলতে তো সেই ল্যাকমের ক্লেনজিং মিল্ক, আয়ুরের গোলাপী টোনার আর ভ্যাজলিন বডি লোশন। তাই মুখে মাখত মেয়েটা। তার ওপরে ল্যাকমের সানস্ক্রিন, চোখে ল্যাকমেরই কালো আইলাইনার আর ঠোঁটে লিপস্টিক। লিপস্টিকও একটাই ছিল মেয়েটার, গোলাপী রঙের, এল এইটিন ব্র্যান্ডের। নাম ছিল ক্যাম্পা কোলা।  ভাগ্যে অমন সুন্দর সোনালী পশমী রোদ উঠেছিল, তাই না অমন অপরূপা লাগছিল মেয়েটাকে। অন্তত মেয়েটার তাই মনে হয়েছিল বটে সেদিন, ‘আমি অপরূপা। আমি অতুলনীয়া।’ সবই মরশুমের দোষ মশাই। 


হেঁটে হাওড়া ময়দান। সেখান থেকে বৈষ্ণবঘাটা মিনি। থিয়েটার রোডে নামবে মেয়েটা। প্রতীক্ষা করছে কেউ। এর আগে একবার দেখা হয়েছিল বটে, সে আরো অনেককাল আগের কথা। ভালো করে আলাপ পরিচয় কিছুই তেমন হয়নি। ছেলেটাকে হেব্বি নাক উঁচু মনে হয়েছিল মেয়েটার। বড় বেশী সবজান্তা। জানিস তো জানিস, তাই বলে দেখানোর কি আছে রে ভাই। না হয় তুই সোনারটুকরো, আমি ঢিপচালতি গোবরগণেশ। তাই বলে, সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর কি আছে? কানাকে কানা, খোঁড়াকে খোঁড়া, গোবরগণেশকে গোবরগণেশ বলতে নেই, এটাও জানিস না? 


তবে সে সব অবশ্যি, এখন অতীত। বিগত কয়েকমাসে দূরভাষের মাধ্যমে বন্ধুত্ব বেশ ভালোই হয়েছে উভয়ের। প্রাথমিক খোলস, সঙ্কোচের বাঁধন খোলার পর দুজনেই তাজ্জব হয়ে গেছে। বড় বেশী রকম মিল উভয়ের মধ্যে। কোথাও যেন মিলে যায়, অনুরণন সৃষ্টি করে উভয়ের হৃদয়ের তরঙ্গ। যেমন যেমন ঘুঁচেছে হৃদয়ের দূরত্ব, তেমনি তিল তিল করে ফুলে উঠেছে মেয়েটা। বাড়িয়ে ফেলেছে বেশ কয়েক কেজি ওজন।আসলে বেশ অনেক কেজি ওজন। কে জানে ছেলেটা ওকে চিনতে পারবে কি না। কথাটা তুলেওছিল আগের রাতের আলাপে, উল্টোদিক থেকে জবাব এসেছে, ‘মানুষ মোটা হয় কি করে? এক জোড়া জুতো কিনে, দৌড়তে শুরু করো, সব ঠিক হয়ে যাবে। ’ বলেছিলাম না, বেশ আঁতেল আর অনেকটা কাঠখোট্টা ছেলেটা। 


থিয়েটার রোডের বেশ খানিক আগেই নামিয়ে দেয় বাসটা। সাহারা সদনের সামনে দাঁড়াবে ছেলেটা, দুরুদুরু বুকে হাঁটতে থাকে মেয়েটা। রাস্তা পেরিয়ে মুখোমুখি হয় তার সাথে, একটা সাদা ঢলঢলে গেঞ্জি থুড়ি টি শার্ট আর সবজে প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে সে। হাতে রোল পাকানো কাগজের বাণ্ডিল। ইতিউতি তাকিয়ে বোধহয় মেয়েটাকেই খুঁজছিল ছেলেটা। সামনে গিয়ে হাত নাড়তে সম্বিত ফিরে পেল ছেলেটা। অদূরে আরেক স্থূলাঙ্গিনীকে দেখিয়ে নার্ভাস ভাবে বলল,‘ আমি তো ভাবছিলাম ঐটা তুমি।’ 


বাকি গল্পটার সাক্ষী মহানগর, সাক্ষী মোহর কুঞ্জ- রবীন্দ্রসদন-নন্দনচত্বর। সাক্ষী ঋতুপর্ণা-সাহেব চ্যাটার্জি আর জয় সেনগুপ্তর ‘চতুরঙ্গ’। সাক্ষী একাডেমির পিছনের ছোট্ট ক্যান্টিন। আর সাক্ষী ধর্মতলা। নন্দন থেকে হাঁটিয়ে ধর্মতলা নিয়ে এসেছিল ছেলেটি। ততোক্ষণে অস্ত গেছেন সূয্যি মামা। জ্বলে উঠেছে মহানগরীর বুকের ওপর শতেক আলোকমালা। বেশ কয়েকবার ফোন করে ফেলেছে গুটি কয়েক ফাজিল বন্ধুবান্ধবের দল। ছেলেটি শুধু একবার জানতে চেয়েছিল, ‘আমার সাথে দেখা করতে এসেছো, এটা জানে না, তোমার পরিচিত এমন কেউ আছে?’ বাসে তুলে দিয়ে নীচে দাঁড়িয়ে ছিল ছেলেটা। ক্লান্ত মেয়েটার মুখে তখন কয়েক হাজার ওয়াটের দ্যুতি। বাসে স্টার্ট দিল ড্রাইভার,কন্ডাকটর হাঁক পাড়ল ,‘হাওড়া-হাওড়া। বেবোন রোড- হাওড়া স্টিশন-ময়দান-কদমতলা। ’ হাত নাড়ল মেয়েটা। ঘুরিয়ে হাত নাড়ল না ছেলেটা, সামান্য মাথা নাড়ল শুধু। তারপর আলগোছে থুতনি চুলকে বলল,‘আরেকটু জোরে হাঁটা প্রাকটিশ করো। বড্ড আস্তে হাঁটো,’ এবং ‘মানুষ যে কি করে, মোটা হয়?’


আবারও বলছি কিন্তু, সব চরিত্র নিছক কাল্পনিক। এক বর্ণ ও বিশ্বাস করবেন না কিন্তু।

Friday, 24 November 2023

অনির ডাইরি, ২২ শে নভেম্বর, ২০২৩

 


#অনিরডাইরি 

একরাশ বিরক্তি চেপে অফিস বেরিয়েছি। সেই কোন কাক ডাকা ভোরে উঠেও, এমন দেরী হয়ে গেল অফিস বেরোতে। আর তার জন্য, আমি ছাড়া আর কেউ দায়ী নয়। কি যে করলাম সকাল থেকে-।  ঘড়ির কাঁটা যেন 'তুড়ুক সওয়ার', যত জোরে ছুটছে, গাড়ির চাকা ততো জোরে ছুটতে পারছে কই! চাকার প্রতিটি পাকের সাথে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ আর লজ্জার বহর। এই সপ্তাহে এর আগেও একদিন লেট করেছিলাম, সৌজন্য আমার অ-সময়ানুবর্তিতা, আর দোষ চাপিয়েছিলাম জগদ্ধাত্রী পুজোর ভাসানের ওপর। যদিও পুরো মিথ্যা ছিল না, হেড়িয়া মোড় সত্যিই অচল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তা নেহাৎ স্বল্প সময়ের জন্য। আজ যদি আবার বড় সাহেবকে দেরীর জন্য মার্জনা চেয়ে মেসেজ পাঠাতে হয় হেব্বি লজ্জা লাগবে।


যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই-।  মগরাজপুরে বিশাল জ্যামে গিয়ে গোঁত্তা খেল গাড়ি। ড্রাইভারদের অসহিষ্ণু হর্ন, বাইক আরোহীদের হল্লা, চোখ রাঙানি কিছুতেই কিছু হল না। হবে কি করে? রাস্তা এখানে ভয়ানক সরু যে। একদিকে নির্মীয়মান উড়াল পুল, অন্যদিকে দিগন্ত প্রসারী ধান ক্ষেত। তবে তার জন্য জ্যাম হয় না। এখন নির্ঘাত রেলগেট পড়েছে। একটা টিংটিংয়ে লাইন, দিনে মেরে কেটে দু-এক জোড়া ট্রেন, পড়বি তো পর তার একটাই আমার ভাগ্যে পড়েছে। উড়াল পুলটা যে কবে চালু হবে ভগবান জানে। 


উত্তেজনায় বাঁ হাতের অনামিকার নখটা মট করে ভেঙেই ফেলতাম,এমন সময় তার দিকে চোখ পড়ল। শ্যামলা বরণ, দোহারা চেহারা, মাঝারি উচ্চতা, কাঁধ পর্যন্ত এক রাশ জট পড়া রুক্ষ লালচে চুল, পরণে বিবর্ণ লাল রঙের নাইটি, যার বাঁ কাঁধের দিকটা ছিঁড়ে ঝুলছে। ফলে পিঠটা পুরো অনাবৃত। ধুলিমলিন অথচ তেলতেলে টানটান পিঠের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, বয়স বেশি না মেয়েটার। অপ্রাপ্তবয়স্কই হবে নির্ঘাত। উঠতি বয়সের একটা ডাগর মেয়ে এই ভাবে স্খলিত বসনা হয়ে রাস্তায় ঘুরছে মানে নিশ্চয়ই মানসিক ভারসাম্যহীন! 


ভাবতে না ভাবতেই মেয়েটা রাস্তার ধার থেকে এক খাবলা মাটি তুলে ছুঁড়ে মারল সামনের বাইক আরোহীর দিকে। কি সর্বনাশ, এই মেয়েটিকে এই অবস্থায় ফেলে চলে যাবার কথা ভাবতেও আতঙ্ক লাগছে যে। আহারে, কার বাছা গো। কি জানি, কি হয়েছে মেয়েটার সাথে। যাই ঘটে থাকুক না কেন, এখনি কোন ব্যবস্থা না নেওয়া হলে আর কি কি ঘটতে পারে ভেবেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।

কি করি? কাকে বলি? ভাবতে ভাবতে গোপীবল্লভ বাবুর কথা মনে পড়ে গেল। গোপীবাবু হুগলীর চাইল্ড লাইনের মুখ্য কর্ণধার। চুঁচুড়ায় থাকতে অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় যদিও চাইল্ড লাইন কাজ করে না, তবুও মেয়েটার একটা নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা যদি কোন ভাবে করে দিতে পারেন। বেজে গেল ওনার ফোন। এদিকে মেয়েটা মাথা চুলকাচ্ছে আর গাড়ির লাইনের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করছে।


দ্বিতীয় ফোনটা করলাম নিজের বরকে। যদিও মগরাজপুর কাঁথি মহকুমার মধ্যে পড়ে না, তবুও যদি কিছু করতে পারে। ব্যস্ত অফিস টাইমে বউয়ের আদিখ্যেতা মনে করেই বোধহয় আজকেই ফোনটা কেটে দিল শৌভিক। অন্য দিন অকারণে ফোন করে বিরক্তি করি বলেই বোধহয় আজ 'পালে বাঘ পড়ল '। চোখে দেখতে না পেলেও, শুনতে পেলাম হুইসল বাজিয়ে চলে যাচ্ছে ট্রেন। বহুদূরের সারিবদ্ধ গাড়িগুলির মধ্যে সঞ্চারিত হল সামান্য স্পন্দন। অচিরেই এই জায়গা ছেড়ে চলে যাব আমরা। এতক্ষণ যার জন্য উন্মুখ হয়ে প্রতীক্ষা করছিলাম, এখন সেটাই জাগাচ্ছে চূড়ান্ত আতঙ্ক। 

কি করি? মেয়েটাকে গাড়িতে তুলে নেব কি? 


যতই আবেগপ্রবণ ট্যালা হই না কেন, সেটা যে চূড়ান্ত বোকামি হবে এতটুকু বুদ্ধি আমার ঘটেও আছে।ভেবে চিন্তে ফোন করলাম তমলুকের মহকুমা শাসককে। ইনি নিশ্চয় সহায়তা করতে পারবেন। ফোন ব্যস্ত। ধৈর্য হারিয়ে শেষে ফোন করলাম ১০৯৮ এ। চাইল্ডলাইনের হেল্পলাইন নম্বর। এর আগেও বেশ কয়েকবার এই নম্বরে ফোন করে খবর দিয়েছি আমি। বিশেষত যখনই কোন বাচ্ছাকে সন্দেহজনক পরিস্থিতিতে ভিক্ষে করতে বা বাচ্ছা রাস্তায় ফেলে কাউকে ভিক্ষে করতে দেখেছি। কোন বার বিফল করেনি ওই নম্বরটা। আজ এমনি কপাল তিনবারের চেষ্টাতেও ফোন তুলল না কেউ। উল্টে ৩০ সেকেন্ড পরে পরে কেটে যেতে লাগলো লাইনটা। আমি বোধহয় আজ সেই অভাগা, যেদিকে তাকাচ্ছি, সাগর শুকিয়ে যাচ্ছে।

 

তূণীরের সব অস্ত্র শেষ, আর বোধহয় কিছুই করতে পারলাম না। এদিকে ক্রমশই চঞ্চল হয়ে উঠছে আটকে থাকা যানবাহনের সারি, আর স্বল্প কয়েকটা মুহূর্ত ব্যাস, তারপরই মেয়েটাকে পিছনে ফেলে চলে যেতে হবে আমাদের। হতোদ্যম হয়ে আবার একবার ১০৯৮ এ ফোন করতে যাচ্ছি, বেজে উঠল মুঠো ফোনটা। ফোনের ওপারে গোপী বাবু। গম্ভীর গলায় জানতে চাইলেন," কে বলছেন?" 

মাত্র দু বছর হল চুঁচুড়া ছেড়ে এসেছি, তারপরেও বেশ কয়েকবার ফোন করেছেন উনি নানা কারণে, আর আজকেই কি না আমায় চিনতে পারছেন না। ওসব মান অভিমানের পালা পরে হবে, আগে তো মেয়েটার হিল্লে করি। স্বাভাবিক স্বরে বললাম, "আমি অনিন্দিতা ম্যাডাম।" পলকে নরম হয়ে গেল গলা, দরদী কন্ঠ বলে উঠল," ম্যাডাম! হ্যাঁ ম্যাডাম! বলুন।" খুলে বললাম সব, উনি শুনে বললেন," ওই জেলায় তো আমরা কাজ করি না, তাও আপনি ১০৯৮ এ জানান, ওরা এসে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে মেয়েটিকে।" বললাম তিনবারেও নিশানায় তীর লাগাতে পারিনি আমি। জবাব এল," আচ্ছা ম্যাডাম, আমি এক্ষুনি দেখছি।" মিনিট দুই একের মধ্যেই ফোন, "ম্যাডাম আপনাকে একজনের নাম আর নম্বর পাঠিয়েছি। ওনাকে একটু বললেই হবে।" 


 হোয়াটসঅ্যাপ খুলে দেখি, যার নম্বর দিয়েছেন, তা ইতিমধ্যেই সংরক্ষিত আছে আমার মুঠোফোনে।DCPO পূর্ব মেদিনীপুর বলে। ফোন করলাম, খুলে বললাম ব্যাপারটা। বুঝতে পারছি, উনিও আমার  মতই আটকে আছেন কোথাও। ভালো শুনতে পাচ্ছেন না, কিন্তু আমি যে নিরূপায়। মেয়েটাকে পিছনে ফেলে ইতিমধ্যেই অনেকটা এগিয়ে এসেছি, আমি চিন্তা হচ্ছে আর যদি না খুঁজে পাওয়া যায় মেয়েটাকে। DCPO প্রথমেই জানতে চাইলেন, "আপনার কাছে কি ওর কোন ছবি আছে?" ছবি তোলার কথা সত্যিই মাথাতেও আসেনি। এখন হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে। ছবি থাকলে অন্তত মেয়েটাকে চিনতে পারত ওরা। তাসত্ত্বেও উনি আশ্বস্ত করলেন," কোথায় দেখেছেন আর কেমন দেখতে একটু লিখে পাঠান দেখছি,আমার সাধ্যমত চেষ্টা করছি।" 

 তড়িঘড়ি করে লিখলাম," চণ্ডীপুর ব্লকের মগরাজপুর ফ্লাইওভারের নীচে একটি ১৬-১৭ বছর বয়সী মেয়ে, অর্ধনগ্ন অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝারি উচ্চতা, দোহারা চেহারা, শ্যামলা রং। পরণে ছেঁড়া নাল নাইটি। সম্ভবত মানসিক ভারসাম্যহীন। প্লিজ ওকে রেসকিউ করুন ।" 


পাঠানোর সময় কি মনে হল সমাজ কল্যাণ দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অতিরিক্ত জেলাশাসক, সাধারণ মহোদয়কেও পাঠিয়ে রাখলাম মেসেজটা। যদি কিছু সুবিধা হয়। নন্দকুমার মোড় ঘুরে, গাড়ি কোলাঘাট-হলদিয়া রোডে উঠেছে মেসেজ ঢুকল, "আচ্ছা দেখছি।" মাননীয় অতিরিক্ত জেলাশাসক যখন দেখছেন বলেছেন আর আমার উদ্বেগের কারণ নেই। নিশ্চিন্ত মনে, সামান্য লজ্জিত চিত্তে অফিসে ঢুকলাম। তারপর যা হয় আর কি, কাজের চাপ, মিটিং এর যাতনায় ভুলেই গেছি সব। বেলা দুটো কুড়িতে মেসেজ ঢুকলো ADM সাহেবের তরফ থেকে, শুধু একটাই কথা লেখা ছিল তাতে, "রেস্কিউড"। আকাশের রং কি হঠাৎ করে একটু বেশি নীল হয়ে গেল, রোদে কি লাগল সোনার ছোঁয়া! এত নির্ভার সকাল থেকে তো লাগেনি।


মনের কোন গহীন কোণে কেবল মাথা চাড়া দিচ্ছিল একটা লোভ। যদি জানতে পারতেম, কি হল মেয়েটার। ওর নাম ধাম জানা গেল কি? ওর মাকে/ বাড়ির লোককে খবর দেওয়া গেল কি? সাড়ে তিনটে নাগাদ ফোন করলেন DCPO, বললেন, " বাপরে কি কষ্ট করে যে মেয়েটাকে উদ্ধার করেছি ম্যাডাম! সে তো কেবল পালিয়েই বেড়ায়। আপনি অর্ধনগ্ন বলেছিলেন, আমি তো পুরো নগ্ন অবস্থায় পেলাম। পুলিশ যদি সক্রিয় সহযোগিতা না করত, আপনাকে খবর দেবার মুখ থাকত না। যাই হোক জানিয়ে রাখি, মেয়েটিকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে, অতি কষ্টে। নতুন পোশাক ও পরানো হয়েছে। ডাক্তারবাবুর রিপোর্ট পেলে পাভলভ বা কোথাও স্থানান্তর করা হবে।  মেয়েটি তো কিছুই বলতে পারছে না। এই মুহূর্তে কথা বলার মত অবস্থাতেই নেই। তবে জানেন তো, মেয়েটির বয়স কিন্তু ১৭/১৮ র মধ্যে নয়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে, ভালো জামা পরাতে অন্তত ২৪/২৫ বলে মনে হল। সঠিক বয়স অবশ্য ডাক্তার বাবুরাই বলতে পারবেন।"


DCPO অর্থাৎ District Child Protection Officer, ১৮র নীচের মানুষজনকে নিয়েই ওনার কাজ। ২৪/২৫ বছরের মেয়েকে উদ্ধার করা সত্যিই ওনার দায়িত্ব নয়। তবু যে উনি করেছেন,পিছিয়ে আসেননি তার জন্য প্রভূত ধন্যবাদ জানালাম। সাথে সাথে বয়স গুলিয়ে ফেলার জন্য মার্জনা চাইলাম। আমার জন্যই সারাদিন ছুটেছেন উনি, তাও এমন কাজে, যেটা আদতে ওনার নয়। মাঝপথে থামিয়ে দিলেন ভদ্রমহিলা, বললেন, " মেয়েটার  বয়স ১৮র নীচে বা উপরে যাই হোক, এই পরিণতি যেন কারো না হয়। আমি না হলে অন্য কাউকে তো কিছু করতেই হত। দাঁড়ান ম্যাডাম আগে মেয়েটার কিছু ব্যবস্থা করতে পারি, তারপর না হয় ধন্যবাদ জানাবেন।' ফোনটা রাখতে রাখতে মনে হল, নাহ্ সমাজটা এখনও রসাতলে যায়নি। এখনও আশা আছে -

Wednesday, 22 November 2023

অনির ডায়েরি ২১শে নভেম্বর, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি 

(জহরবাবুর দাদুভাই আর গোবর্ধনধারী)



সংকুচিত ভাবে শুভাশিস মনে করাল," ম্যাডাম আজ জহরবাবুর নাতির অন্নপ্রাশন।"  জহরবাবুর দৌহিত্র থুড়ি দাদুভাই আজ প্রথম অন্নগ্রহণ করবে। প্রায় তিন সপ্তাহ আগে থেকে বলে রেখেছেন জহর বাবু,  ঐদিন সকলের উপস্থিতি এবং আশির্বাদ প্রদান বাধ্যতামূলক। 


জহরবাবু এককালে এই অফিসের দারোয়ান এবং নৈশপ্রহরী ছিলেন। বছর দুয়েক আগে আমি এসে তাম্রলিপ্তের কার্যভার গ্রহণ করলাম আর উনিও অবসর নিলেন। আমরা সাধ্যমত ওনাকে বিদায় সম্বর্ধনা তো জানিয়ে দিলাম, কিন্তু জহর বাবু গেলেন না অফিস ছেড়ে। একখান দরখাস্ত করলেন, যতদিন না পাকাপাকি দারোয়ান পাচ্ছে এই অফিস,উনি ওই দায়িত্বভার গ্রহণে ইচ্ছুক। বেতনপত্র সরকার বাহাদুর যা দেবে, তাই মাথা পেতে নেবেন। ব্যাপারটা মহানগরের জানালামও আমি। তারপর যা হয় আর কি, Dঅনুমোদন বা মজদুরি কিছুই আসে না, তাতেও জহরবাবু অদমনীয়।


 প্রত্যহ সকাল ন'টায় ভটভটি চালিয়ে আপিসে এসে ঢোকেন, সব জানলা দরজা খোলেন,  আলো জ্বালেন, সুইপার মাসিকে দিয়ে ঘরদোর সাফ করান, জল ভরান, চা করে ধরেন সবার মুখে মুখে, বেল বাজালেই ছুটে আসেন এবং প্রতি এক ঘন্টায়  একবার করে জানতে চান," ম্যাডাম, টিপিন হয়েছে?" অথবা " ম্যাডাম আজ অফিসে কিছু খাওয়া-দাওয়া হবে নি?" আরো অনেক কিছু করেন, যাতে মাঝেমাঝেই আমার অন্য স্টাফদের কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোয়। বিগত বছর তাও এদিক-ওদিক করে Rসামান্য কিছু সাম্মানিক দিতে পেরেছিলাম বুড়োকে, এ বছর তো আমার নিজেরই ভাঁড়ে মা ভবাণী। বুড়াকে তাই যত বলি, আর কেন আমার পাপ বাড়াচ্ছেন, এবার আসুন। বিদেয় হন। বুড়া ততো জোরে জোরে চিৎকার করে, "জয় গুরু নিতাই। প্রেমানন্দে হরি হরি বলো মন, হরি হরি বলো।"


এহেন বৃদ্ধের দাদুভাইয়ের k অন্নপ্রাশনে হাজিরা না দিয়ে কি পারা যায়! লম্বা ছুটির মাঝে একদিন আপিস, ঠিক সেইদিনই অন্নগ্রহণ করবেন দাদুভাই। আগে থেকে যারা ক্যাজুয়াল লিভের আবেদন করেছিল, সব নাকচ করে দিয়েছি আমি। আরে ভাই এই খেয়ালী বৃদ্ধের জন্য এইটুকু তো করতেই হবে। কিন্তু এখন তো বাজে সবে বেলা দেড়টা, এত তাড়াতাড়ি খেতে যাব কেন? টিফিন তো তিনটের আগে করি না কেউই। শুভাশিস কান চুলকে বলে, ' সকাল থেকে ফোন করেই যাচ্ছেন জহর বাবু। 'কখন আসতেছ? ম্যাডাম কখন আসতেছেন?'"

মুড়ির টিনের মত ঠেসেঠেসে ঢুকিয়েও ধরল না সবাই গাড়িতে। যোশুয়া আর আশিসকে সওয়ার হতে হল বাইকে। সবমিলিয়ে মোরা, এক কম এক ডজন। জনা দুয়েক রয়ে গেল অফিস সামলাতে।  বেশি দূরের রাস্তা তো নয়। পনেরো কুড়ি মিনিট মাত্র। গ্রাম জানুবসান, পোস্ট নোনাকুড়ি। সেখানে কি যেন এক বন্ধ সিনেমা হলের পাশে জহরবাবুর বেয়াই গৃহেই  দাদুভাইয়ের মুখে ভাত। 


দাদুভাইয়ের ভালো নাম জয়। তিনি ফিরিঙ্গি ভাষায় সত্যিই "a bundle of joy"। ভাগ্যে কার্ডে তার ছবি ছিল, তাই না আমরা নিমন্ত্রণ বাড়িটা খুজে পেলাম। হাইরোড থেকে ঢালু রাস্তা দিয়ে অনেক নীচে জয়ের পিতামহের ভিটে। যখন গাড়ি থেকে নামছি আমরা, শান্তনু বলল, "এত বছরে এই প্রথম আমরা জহর বাবুর বাড়ি আসতেছি। এর আগে ওনার দুই মেয়ের বিয়ে আর কার যেন শ্রাদ্ধে নিমন্ত্রণ করছিলেন, আসতে পারিনি আমরা। খুব রেগে গিয়েছিলেন জহর বাবু।" 

Dআজ অবশ্য জহরবাবুর মুখে চোখে রাগের কোন চিহ্নই নেই। একগাল হেসে স্বাগত জানিয়ে নিয়ে গেলেন আমাদের। বাড়ির বাইরে জুতো খুলে ঢুকছে সকলে। আমাদের জন্য একটু বেশি খাতির। সামনের এক ফালি মাজা বারান্দায় রাখা আছে কতগুলি প্লাস্টিকের চেয়ার, সেখানে জুতো খুলে ভিতরে ঢুকলাম আমরা। 


অগণিত কুচোকাঁচা পরিবৃত হয়ে মায়ের কোলে শুয়ে খেলা করছিলেন জয় বাবু, আমাদের দর্শন করানোর জন্য R সাময়িক ভাবে কুচো ব্রিগেডকে বাইরে পাঠানো হল। ইত্যবসরে দাদুভাইকে সটান মায়ের কোল থেকে তুলে আমায় গছিয়ে দিলেন জহরবাবু। ছিমছাম ভদ্রলোক কিঞ্চিৎ টেকো, ধপধপে গাত্র বর্ণ, কপালে ধ্যাবড়া Kকাজলের টিপ,  পরণে ন্যাপি, তার ওপর নীলচে হাফ প্যান্ট এবং জামা থাকলেও মধ্যপ্রদেশ পুরো ফাঁকা। যেমন তুলতুলে তেমনি মসৃণ। গায়ে দুধ আর ট্যালকম পাউডার মেশানো মোহক সৌরভ। অচীরেই অনুধাবন করতে পারলাম, আমি ওনাকে আলিঙ্গন করে যতটা মন্ত্রমুগ্ধ, উনি মোটেই ততোটা পুলকিত নন। বরং উটকো লোকের আদরে বেশ বিরক্ত। 


Dজহরবাবুর গিন্নি বললেন, " আজ সকাল থেকেই বলছিলাম, দেখো এবারেও কেউ আসবে নি। আর লোকটা সমানে বলে চলেছে, 'না ম্যাডাম বলেছেন উনি আসবেন।' আপনারা আসাতে লোকটা যে কি খুশি আর গর্বিত হয়েছে কি বলব।" না বলতে পারলেও, বেশ বুঝতে পারছিলাম, 'লোকটা' হেব্বি খুশি। আমরা থাকতে অন্য কাউকে আর দাদুভাইয়ের কাছে ঘেঁষতেই R দিচ্ছিল না। দৌড়ে দৌড়ে গিয়ে কখনও কফি আনছিল, তো কখনও সবার জন্য জলের বোতলK। ওই যজ্ঞিবাড়িতে কোথা থেকে খুঁজে পেতে একরাশ মিষ্টি, নিমকি দিয়ে তিনটি প্লেট সাজিয়েও এনেছিল লোকটা। এসব খেলে আর নিমন্ত্রণ রক্ষা করব কি করে, বলে কোন মতে নিরস্ত করা হল তাকে।


ভোজনের ব্যবস্থা দোতলায়। সদ্য নির্মিত রেলিং- পলেস্তারা বিহীন খাড়া সিড়ি দিয়ে উঠতে হয় দোতলার ছাতে। ছাদের প্রথম অংশে মাটিতে আসন পেতে খেতে বসেছেন অভ্যাগত বর্গ।  আমাদের আরো তিন ধাপ সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হল, পাশের ছাতে। আমাদের জন্য প্লাস্টিকের চেয়ার টেবিল। 

শুভাশিস- শান্তনু-নন্দন আগে থেকেই বলে রেখেছিল, নিরামিষ ভোজ হবে। কারণ গোবর্ধনধারী এসেছেন। গোবর্ধনধারী হলেন বালক শ্রীকৃষ্ণ, নাড়ুগোপাল আর রাধাস্বামীর মাঝামাঝি।  কষ্টি পাথরে নির্মিত, রুপার চোখ, মাথায় প্রকাণ্ড মুকুট, সর্বাঙ্গ গহনায় মোড়া। গোবর্ধনধারীর প্রবল ডিমান্ড এই চত্বরে। কোলাঘাট ব্লকের দেরিয়াচকে ওনার মন্দির। কিন্তু সেই মন্দিরে মোটেই থাকেন না গোবর্ধনধারী, তিনি ঘুরে বেড়ান ভক্তদের বাড়ি বাড়ি। কারো বাড়িতে শুভ কাজ হলে আগেভাগে ডেট নিতে হয় গোবর্ধনধারীর। পাঁচ ছয় মাসের আগে কোন ডেট মেলা ভার। একেক দিনে চার পাঁচ বাড়িতে দর্শন দেন গোবর্ধনধারী। আর এই পথ উনি অতিক্রম করেন পালকিতে। সেই পালকি বহনের ও নির্দিষ্ট লোক থাকে। তবে শর্ত একটাই, গোবর্ধনধারী নদী পার করবেন না।


গোবর্ধনধারীর প্রিয় খাদ্য নাকি,' বিছে কলা', অর্থাৎ বীজ সমেত কাঁচা কলা। রাস্তায় কোথাও যদি বিছে কলার কাঁদি দেখতে পান উনি, তাহলে নাকি এমন লোভ দেন যে পালকি প্রবল ভারী হয়ে যায়, আর তাঁকে নড়ানোই যায় না।


গোবর্ধনধারী যখন আসেন সঙ্গে পাঁচক ঠাকুরও নিয়ে আসেন। প্রয়োজনে যারা হাজার বারোশো নিমন্ত্রিত লোকেরও রান্না করে দেয়। উনি এলে বিনা নিমন্ত্রণেও সেখানে ভিড় জমায় ভক্তবৃন্দ, মাটিতে পাত পেড়ে সেবন করে প্রভুর প্রসাদ। ঠাকুরের মাহাত্ম্য এমনি, যে যতই লোক আসুক না কেন,ভোগ কোনদিন কম পড়ে না। আমার অবশ্য গোবর্ধনধারীর সঙ্গে সাক্ষাতের সৌভাগ্য হল না। আমরা যাবার আগেই উনি সপার্ষদ রওনা দিয়েছেন অন্য ভক্তের গৃহে। ওনার প্রসাদ টুকু সেবন করতে পারলাম এটাই যথেষ্ট।


প্রসাদ বলতে তপ্ত ভাত, পরিবেশকের ভাষায় অন্ন, ঘরের খাঁটি গাওয়া ঘি, চার রকমের তরকারি। যার মধ্যে যেমন ছিল শুক্ত, তেমনি ছিল বিখ্যাত বিছে কলার তরকারি। এছাড়া ধোঁয়া ওঠা ডাল, প্রচুর পোস্ত ছড়ানো আলু ভাজা, চাটনি থুড়ি অম্বল, পরমান্ন, মিষ্টি এবং এলাচ গন্ধী চাপ চাপ লাল দই। সাথে জহর বাবুর হরি নাম।  খেয়েদেয়ে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠছি, বৃদ্ধ এক গাল হেসে বললেন, " ম্যাডাম চলি যাচ্ছেন?চিন্তা করবেন নি, আমি পাঁচটার মধ্যে পৌঁছে যাব।" বলতে গেলাম, কে চিন্তা করছে, বলতে গেলাম, আজ আর নাই বা গেলেন, আজ তো আপনার দাদুভাইয়ের অন্নপ্রাশন। বললাম না, বললেই বা শুনছে কে? লোকটা তো আজ সকালে ও নটার মধ্যে এসে অফিস খুলে দিয়ে গেছে। সবই গোবর্ধনধারীর মহিমা।

অনির ডাইরি ১২ই অক্টোবর, ২০২৩

 


#অনিরডাইরি 

রোজ অফিসে বেরিয়ে, সর্বাগ্রে যেটা করি, তা হল  বাড়িতে ফোন। সাধারণতঃ সারাদিনে এই একবারই বার্তালাপ হয় জনকজননীর সাথে। হয় নৈমিত্তিক কুশল সমাচার আদানপ্রদান, " ঠিক আছ তো? শরীর- টরীর সব…" ইত্যাদি। দিন বদলালেও জিজ্ঞাস্য একই থাকে,  জবাবও একই আসে। "আমরা তো ভালোই আছি, তোরা কেমন আছিস? তুত্তুরীকে স্কুলে দিয়ে এলি".… ইত্যাদি প্রভৃতি। এর বেশি বলার মত কথা, তেমন কিছু খুঁজেও পাই না  আমরা। 


সেদিন, এইসব কথার মাঝে মা জিজ্ঞাসা করল,"কবে আসছিস?" আসা মানে কালীপুজোয় পিত্রালয় গমন। এই তো একাদশীর দিন ফিরলাম, আবার বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে যেতে হবে ভাবলেই, "কুন কুন জায়গায়" যে ব্যথা জেগে ওঠে কি বলব। সেটাই বললাম মাকে, বোঝালাম, এবার নাও যেতে পারি। মাসিক টাকাপয়সা গুলো তুলে একদিন দিয়ে আসব খন।

" তোমরা তাহলে এবার কালীপুজোয় আসছ না?" পরের দিন আবার একই প্রশ্ন করে বাবা। বোঝাই, পেটের ধান্ধায় দৈনন্দিন এই দেড়শ কিলোমিটার যাতায়াতে ভিতর থেকে ক্ষয়ে যাচ্ছি আমি। এর উপর সরকারি চাকরগিরি করার হাজার অত্যাচার, অফিস সামলে বাড়ি ফিরে মেয়েকে পড়ানো, সব মিলিয়ে জর্জরিত আমি। চুপ করে শোনে বাবা। অপরাধবোধ হয়, নিজের অপারগতায়। বলি, এবার না হয় তোমরা দুজনেই খুব আনন্দ করে দীপাবলী কাটালে, আমাজন থেকে স্পেশাল মোমবাতি অর্ডার দিয়ে দিচ্ছি, বাড়ি পৌঁছে যাবে।


"কেন?" ওপার থেকে ভেসে আসে বাবার মন কেমন করা কণ্ঠস্বর, "কে জ্বালাবে? তোমরা আসলে, তবেই খণ্ডহরে দেওয়ালি। বাতি জ্বালাবার সামর্থ্য আমাদের আর নেই। কালীপুজোর দিন বড়জোর বারান্দা আর বাইরের আলো গুলো জ্বেলে দেব আমরা। ব্যাস।" সেদিনের মতো দূরাভাষে কথাবার্তা ওই পর্যন্ত হলেও, বুকের ভিতর কুরেকুরে কেউ যেন লিখতে থাকে, কানের কাছে বলতে থাকে, বার বার, "তোমরা এলে, তবেই খণ্ডহরে দেওয়ালি।"


কালীপুজোর ছুটিতে কবে কি করব সেই পরিকল্পনা হয়ে গিয়েছিল আমাদের। শেষ মুহূর্তে ঝাড়াই-বাছাইয়ের সময় খুলে বললাম শৌভিককে। জানতে চাইলাম, কি করি বল তো। ক্ষণিক ভেবে আমার বর বলল," ক্রিকেটে, বেনিফিট অফ ডাউট সবসময় ব্যাটসম্যানের পক্ষেই যায়। যখন মনে  দ্বিধা দেখা দিয়েছে, চলেই যা।" এই না হলে আমার বর। জীবনেও কোন কিছুতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি, নিজের মত জোর করে চাপিয়ে দেয় নি।


এরপর আর কি, বাক্স খাটের ভিতর থেকে বেরোয় চাকা লাগানো ব্যাগ। কালী পুজোর আগের রাতে গোছগাছ মিটতে মিটতে বেজে যায় রাত একটা। পুজোর দিন অ্যালার্ম দিয়ে কাক ভরে উঠে পড়ি আমি। যাবই যখন, সময় নষ্ট করে লাভ কি। মেয়েকে ঠেলে তুলি, হেমন্তী প্রভাতে কাঁপতে কাঁপতে স্নান, পুজো সেরে, এক কাপ কেলে কফি খেয়ে বেরিয়ে পড়ি হাওড়ার উদ্দেশ্যে। যাচ্ছি মাত্র দিন চারেকের জন্য অথচ জামা কাপড় নিয়েছি ব্যাগ ভর্তি করে। নিয়েছি রং বেরংয়ের প্রদীপ, মোমবাতি, রংলী বানানোর উপকরণ, দীপাবলী উপলক্ষে উপহার পাওয়া শুকনো ফল, মিষ্টি, এমনকি মায়ের ফরমাইশি তুলসী গাছও।


বাড়ির গলিতে যখন বামাল সমেত ঢুকছি আমরা মা-মেয়ে, জনৈক প্রতিবেশী ছুটে এসে টব সমেত তুলসী গাছটা নিতে চায় তুত্তুরীর হাত থেকে। "আহারে, মেয়েটার কত কষ্ট হচ্ছে এত বড় টব বইতে।" টবটাকে আরো নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরে তুত্তুরী, হাসি মুখে প্রত্যাখ্যান করে সহৃদয় সহায়তার প্রস্তাব। অতঃপর তিনি হাত বাড়ান আমার ভারী ব্যাগগুলির দিকে। " তুই তো দে, বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।" আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে নিরস্ত করি আমিও। আমরা হলাম যাকে বলে শক্তপোক্ত স্বাধীনচেতা নারী, নিজেদের মোট নিজেরাই বইতে পারি।

আজ আমাদের চাটুজ্জে বাড়িতে দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজো। সবার ব্যস্ততা চরমে। একদিকে ভোগ রান্না হচ্ছে তো অন্য দিকে চাল গুড়ি দিয়ে কলার পেটোর ওপর বানানো হচ্ছে ১৪ প্রদীপ। চতুর্মুখী সুখ প্রদীপ। এরপর বানানো হবে বাক্সপ্যাঁটরা  সমেত লক্ষ্মী নারায়ণ কুবের। তারপর গড়া হবে গোবরের লক্ষ্মী। সায়াহ্নে কুলো পিটিয়ে তাকে বিদেয় জানানো হবে চৌ রাস্তার মুখে। এসব মিটলে বানানো হবে রঙলী।

দিন ঢলে, সন্ধ্যা নামে, বৈঠক খানার সাদা মার্বেলের ওপর ফুটে ওঠে অয়নের হাতে বানানো দশ রঙা রঙলী। সাজানো হয় প্রদীপ দিয়ে। উৎসাহের আতিশয্যে, কাতরাতে কাতরাতেও মাটিতে বসে পড়ে পঁচাত্তরের মা আমার। বাবার 'খণ্ডহরে দিওয়ালির' প্রথম প্রদীপ জ্বলে ওঠে মায়ের হাতে। বাকি গুলো জ্বালানো নিয়ে আক্ষরিক অর্থে হাতাহাতি চলে বাবার দুই নাতিনাতনীর মধ্যে। সাময়িক ভাবে হলেও আলোক মালায় সেজে ওঠে প্রপিতামহের বানানো দেড়শ বছরের বুড়ো বাড়িটা। 

দক্ষিণের ছাত থেকে ভেসে আসে কোলাহল, হাজিরা দিতে হবে বাজি পোড়ানোর যজ্ঞে। নাহলে ব্যাপারটা নাকি তেমন জমছে না। ঘাসে ঢেকে যাওয়া পরিত্যক্ত পূবের উঠোন পেরোতে পেরোতে ফিরে তাকাই একবার বাড়িটার দিকে, কানে বেজে ওঠে জনৈক মাতৃসমার গর্বিত উক্তি, আজ সকালেই বলছিলেন উনি, "তোর কথা আমি প্রায়ই বলি জানিস। সবাইকে বলি। তুই কেমন সব দিক সামলাস।  আমাদের বাড়ির মেয়েটা জানিস, বিয়ে হয়ে ইস্তক আর আসতেই চায় না। ওর বর নাকি পছন্দ করে না, ঘনঘন বাপের বাড়ি যাওয়া। এটা কেমন কথা বল তো? মেয়ের বাড়ির লোক বলে আমাদের কি মন নেই?" 


ভদ্রমহিলা মোটেই আবেগপ্রবণ নন, বরং বেশ ঠোঁটকাটা। এই প্রথম নিজের প্রশংসা শুনলাম ওনার মুখে, জীবনের চারটে দশক পেরিয়ে। দ্রবীভূত হয়ে পড়েছিলাম আবেগে, সামলে নিয়ে চরণ স্পর্শ করে বলেছিলাম, কতটা পারি জানি না, আশির্বাদ করো যেন সত্যিই সবদিক সমান তালে সামলাতে পারি। না পারলে আমার যে কোন উপায় নেই। আমি এলে, আমি পারলে তবেই না "খণ্ডহরে দিওয়ালি"।আমাকে যে পারতেই হবে।

অনির ডাইরি ১০ই নভেম্বর, ২০২৩

 

#তাম্রলিপ্তকড়চা #অনিরডাইরি 

এই তো সেদিনের কথা,পুজোর ছুটির পর সদ্য খুলেছে অফিস। বাতাসে হেমন্তের শিরশিরে আগমনী বার্তা, রোদে লেগেছে পশমী উষ্ণতা। সর্বত্র আলসেমি আর গা ছাড়া ভাব। আর তো মেরেকেটে দু সপ্তাহ, গয়ংগচ্ছ করে কাটিয়ে দিলেই হল। তারপরই এসে হাজির হবেন উলঙ্গিনী। আসমুদ্র হিমাচল আবার ভেসে যাবে উৎসবের আবহে। 

 

সোমবারের বারবেলায় অলক্ষে কে যে হেসেছিল। ঢং করে মেসেজ ঢুকল, সেদিনই সন্ধ্যায় ভিসি করবেন মহামহিম, যাতে হাজিরা বাধত্যামূলক। ভিসি গড়াল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা অবধি। মহামহিম বললেন," লেবার ডিপার্টমেন্ট পারবে না,তোমরা একটু দেখ।" ইয়েস স্যার বলতে ব্যস্ত রথীমহারথীদের পিছনের সারির ভিড়ে মিশে থাকা কালো মাথা, বলতে পারলাম না, কি পারব না স্যার? রাজ্য জুড়ে অসংগঠিত ক্ষেত্রে পৌনে দুই কোটি মানুষকে পরিষেবা দিই আমরা। সংগঠিত ক্ষেত্রকে জুড়লে সংখ্যাটা আরো অনেক অনেক বেশি। এই তো দুয়ারে সরকারে এত গুলো সার্ভিস ডোলিভারি করলাম আমরা আর এই তুচ্ছ কাজটা পারব নি?


তবে জেলা প্রশাসনকে বড় মুখ করে বলে এলাম, আমাদের কাজ, আমরাই করে নিব। আপনাদের এমনিতেই এত্ত চাপ, সংসদীয় নির্বাচন আসতেছে, খামোখা এর মধ্যে আর আমাদের জন্য বিব্রত হতে হবেনি। যদি কোন প্রয়োজন বা সমস্যা হয় অবশ্যই জানাব। 


বলে এলাম, নিজের টিমের প্রতি অখণ্ড ভরসা থেকে।  সময় যে এমন চাল চালবে, কে জানত। দিন রাত ছোটে, দৌড়য় আমাদের কালেক্টিং এজেন্ট/ এসএলও থেকে সিকেসিও, ইন্সপেক্টরেরা। ফোন করে গালাগাল খায় সাধারণ মানুষের। জেলা থেকে জেলায় ঘোরে সেই সব রেকর্ডেড মেসেজ। শেষ অক্টোবরেও জলমগ্ন ছিল পূব মেদিনীপুরের বিভিন্ন গ্রাম, হাঁটু ভাঙা জল ঠেলেও ঘোরে আমার লোকজন, ঘোরে বাড়ি বাড়ি। খুঁজে বেড়ায় হারানিধি। তদারকি করে, চাপ দেয়, রিপোর্ট বানায়, ডিজিটাইজ করে ওরা। অথচ কোন ভোজবাজিতে যেন কেবল পিছিয়েই পড়তে থাকি আমরা।


 রোজ ঝাড় খায় বড় সাহেব আর আমি। সবার এক বুলি, ‘নম্বর বাড়াও ইয়ার, নম্বর বাড়াও।’  নম্বর কি মুড়িমুড়কি, চাইলেই বাড়ানো যায় নাকি। বড় সাহেবের কড়া হুকুম, নম্বরের ইঁদুর দৌড়ে আমরা সামিল হব না। খিস্তি খেলে খাব, রিপোর্ট জল মেশাব না কিছুতে। শ্যাম রাখি, না কুল রাখি- এই দ্বন্দ্বে নাকানিচোবানি খাই শান্তনু আর আমি। যেখানে যত ডেটা বেস আছে নামিয়ে চলে আমাদের সমীক্ষা, ব্যাটারা ভোজবাজি টো করছে কুথায়? কিভাবে এত্ত পিছিয়ে পড়ছি আমরা। পুরাণ জং ধরা দপ্তরী কম্পিউটারের সাধ্য কি, অলীক ব্যাপারস্যাপার ধরার। তিনি বাবু দিব্য ঝুলন্ত, ঘুমন্ত হয়ে পড়ে থাকেন। রক্তচাপ বাড়ে আমাদের।


এত্ত এত্ত চাপে যখন আকন্ঠ নিমগ্ন, স্ট্রেস পেইনে জর্জরিত সকলে, তখন এক মিটিং এ এমনিই বললাম আমি, " হ্যাঁ গো, এবার আমাদের অফিসে দীপাবলি হবে নি?" সামনে বসে থাকা ক্লান্ত, কোটরগত দেড় ডজন চোখ পলকে ভ্যাবলা হয়ে যায়। তারপর সকলের মুখচোখের ওপর খেলে যায় অবিশ্বাসের রৌদ্রছায়া, কি বলছেন কি ম্যাডাম, মাথা টাথা খারাপ হল নাকি। একে নির্বাচনী কাজ তার ওপর দপ্তরের হাজারো " ডু ইট নাও" মার্কা চাপ, সবার ওপর এই সমীক্ষা আর পিছিয়ে পড়ার খেউড় গান, এর মধ্যে দীপাবলি! 


বললাম, হোক না, আমার মা আর জ্যাঠাইমা ছোট থেকে শিখিয়েছে, যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে। কাজের চাপ তো সারা বছরই চলবে। DA মামলা যেমন গড়াবে জন্ম থেকে জন্মান্তরে, ন্যায্য প্রাপ্য - পদ - সম্মান- পরিকাঠামো কোনদিনই জনগণ চাকর গিরিতে জুটবে না, এগুলো তো নিত্য সত্য।  তাই বলে কি বাঁচতে ভুলে যাব আমরা? এই উৎসব গুলোই তো সামান্য নিঃশ্বাস নেবার সময়।


তারপর আর কি, বাক্সপ্যাঁটরা হাঁটকে বেরোয়, গেল দীপাবলির আলোক মালা, যার কিছুতে আবার দাঁতে শান দিয়েছে কালেক্টরেটের মহা পরাক্রমী ইঁদুর গুষ্টি। বাদ দিয়ে কেটে, ছেঁটে, দুয়েকটা কিনে এনে হলুদ-সবুজ-লাল-গোলাপী আলোর মালায় সেজে ওঠে আমাদের আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর। নিমন্ত্রণ জানানো হয় সমস্ত কর্মচারী থেকে SLO - CA দের। কাজ মিটিয়ে, সবাই আসুন। সামিল হোন আমাদের রং আর আলোর উৎসবে। আসুন দুদণ্ড স্বস্তির বাতাস ভরে নিই ফুসফুসে।  তবে এমনি এলে হবে নি, এসে বানাতে হবে রঙলী। জ্বালাতে হবে প্রদীপ। প্রদীপ, মোমবাতি আর সামান্য রং যোগান দিব আমরাই। যদি পারেন তো নিয়ে আসুন রং, চুড়ি, ছাঁকনি, চামচ, কাঁটা চামচ ইত্যাদি, রঙলী বানাতে যা যা অবশ্য প্রয়োজনীয়। 


অধিকাংশই আল্পনার সাথে পরিচিত থাকলেও কখনও বানায়নি রঙলী। বেশির ভাগই প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা, সন্ধ্যা প্রগাঢ় হলে বা রাত নামলে চলে না বাস বা টোটো, তাতে কি। তাতেও উৎসাহে পড়েনি ভাঁটা। বিকাল নামার সাথে সাথেই জমিয়ে বসে পড়েছে লোকজন, জীবনের প্রথম রঙলী করতে। মফঃস্বল শহর আমাদের, আশেপাশের দোকান ঘুরে ও চার প্যাকেটের বেশি মেলেনি রঙলীর রং। নভোনীল বাবু হায় হায় করেছেন," ইশ যদি একবার যাওয়া যেত মহানগর, সত্যনারায়ণ পার্কের সামনে ঢেলে বিকোয় ম্যাডাম।" সে অবকাশ মিললে তবে তো।আর আমাদের সাধ্যও যা সীমিত। 

সকলের উৎসাহ আর উদ্দীপনার দাপটে জাস্ট উড়ে গেছে আমাদের রং, নিয়ে আসা হয়েছে আবির। ফুরিয়েছে আবির, তো নিয়ে আসা হয়েছে আটা, কিন্তু হাল ছাড়েনি কেউ। নব্য প্রশাসনিক ভবনের তিন তলার করিডোর জুড়ে ফুটে উঠেছে একের পর এক কল্পনার ছায়া-মায়াচিত্র।


দীপাবলির আগের সন্ধ্যার শেষ অফিস, একে একে নিভে যাচ্ছে অন্যান্য দপ্তর গুলির আলো, আর আমাদের ক্ষুদ্র অকিঞ্চিৎ দপ্তর, আর তার সামনের দালান তখন ভেসে যাচ্ছে আলো আর রঙের প্লাবনে। মন খারাপ করে বসেছিল সৌম্য, শুভদীপ্ত আর যশুয়া টেনে নামিয়েছে মাটিতে। "চল হাত লাগাই"। রিপোর্ট বানানো ছাড়িয়ে শান্তনুকে টেনে করিডোরে নামিয়েছে অরূপ, হয়ে যাবে, হয়ে যাবে। সব হয়ে যাবে। দৌড়ে দৌড়ে তদারকি করেছেন হক বাবু, ঘুরে ঘুরে দেখেছেন উৎসাহ দিয়েছেন নভোনীল বাবু। আর আমি কি করেছি, সত্যি বলছি আমি কিছু করিনি। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছি, প্রতিটা রোমকূপে ভরে নিয়েছি আজকের দিনটার প্রতিটা মুহূর্ত। বদলির চাকরি আমাদের, পরিযায়ী পাখির মত আজ এখানে আছি, কে জানে কাল কে কোথায় থাকব। সঙ্গে করে নিয়ে যাব, কেবল এই ভালোলাগা আর সুখ স্মৃতি গুলো। এই তো জীবন কালি দা -