#তাম্রলিপ্তকড়চা #অনিরডাইরি
এই তো সেদিনের কথা,পুজোর ছুটির পর সদ্য খুলেছে অফিস। বাতাসে হেমন্তের শিরশিরে আগমনী বার্তা, রোদে লেগেছে পশমী উষ্ণতা। সর্বত্র আলসেমি আর গা ছাড়া ভাব। আর তো মেরেকেটে দু সপ্তাহ, গয়ংগচ্ছ করে কাটিয়ে দিলেই হল। তারপরই এসে হাজির হবেন উলঙ্গিনী। আসমুদ্র হিমাচল আবার ভেসে যাবে উৎসবের আবহে।
সোমবারের বারবেলায় অলক্ষে কে যে হেসেছিল। ঢং করে মেসেজ ঢুকল, সেদিনই সন্ধ্যায় ভিসি করবেন মহামহিম, যাতে হাজিরা বাধত্যামূলক। ভিসি গড়াল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা অবধি। মহামহিম বললেন," লেবার ডিপার্টমেন্ট পারবে না,তোমরা একটু দেখ।" ইয়েস স্যার বলতে ব্যস্ত রথীমহারথীদের পিছনের সারির ভিড়ে মিশে থাকা কালো মাথা, বলতে পারলাম না, কি পারব না স্যার? রাজ্য জুড়ে অসংগঠিত ক্ষেত্রে পৌনে দুই কোটি মানুষকে পরিষেবা দিই আমরা। সংগঠিত ক্ষেত্রকে জুড়লে সংখ্যাটা আরো অনেক অনেক বেশি। এই তো দুয়ারে সরকারে এত গুলো সার্ভিস ডোলিভারি করলাম আমরা আর এই তুচ্ছ কাজটা পারব নি?
তবে জেলা প্রশাসনকে বড় মুখ করে বলে এলাম, আমাদের কাজ, আমরাই করে নিব। আপনাদের এমনিতেই এত্ত চাপ, সংসদীয় নির্বাচন আসতেছে, খামোখা এর মধ্যে আর আমাদের জন্য বিব্রত হতে হবেনি। যদি কোন প্রয়োজন বা সমস্যা হয় অবশ্যই জানাব।
বলে এলাম, নিজের টিমের প্রতি অখণ্ড ভরসা থেকে। সময় যে এমন চাল চালবে, কে জানত। দিন রাত ছোটে, দৌড়য় আমাদের কালেক্টিং এজেন্ট/ এসএলও থেকে সিকেসিও, ইন্সপেক্টরেরা। ফোন করে গালাগাল খায় সাধারণ মানুষের। জেলা থেকে জেলায় ঘোরে সেই সব রেকর্ডেড মেসেজ। শেষ অক্টোবরেও জলমগ্ন ছিল পূব মেদিনীপুরের বিভিন্ন গ্রাম, হাঁটু ভাঙা জল ঠেলেও ঘোরে আমার লোকজন, ঘোরে বাড়ি বাড়ি। খুঁজে বেড়ায় হারানিধি। তদারকি করে, চাপ দেয়, রিপোর্ট বানায়, ডিজিটাইজ করে ওরা। অথচ কোন ভোজবাজিতে যেন কেবল পিছিয়েই পড়তে থাকি আমরা।
রোজ ঝাড় খায় বড় সাহেব আর আমি। সবার এক বুলি, ‘নম্বর বাড়াও ইয়ার, নম্বর বাড়াও।’ নম্বর কি মুড়িমুড়কি, চাইলেই বাড়ানো যায় নাকি। বড় সাহেবের কড়া হুকুম, নম্বরের ইঁদুর দৌড়ে আমরা সামিল হব না। খিস্তি খেলে খাব, রিপোর্ট জল মেশাব না কিছুতে। শ্যাম রাখি, না কুল রাখি- এই দ্বন্দ্বে নাকানিচোবানি খাই শান্তনু আর আমি। যেখানে যত ডেটা বেস আছে নামিয়ে চলে আমাদের সমীক্ষা, ব্যাটারা ভোজবাজি টো করছে কুথায়? কিভাবে এত্ত পিছিয়ে পড়ছি আমরা। পুরাণ জং ধরা দপ্তরী কম্পিউটারের সাধ্য কি, অলীক ব্যাপারস্যাপার ধরার। তিনি বাবু দিব্য ঝুলন্ত, ঘুমন্ত হয়ে পড়ে থাকেন। রক্তচাপ বাড়ে আমাদের।
এত্ত এত্ত চাপে যখন আকন্ঠ নিমগ্ন, স্ট্রেস পেইনে জর্জরিত সকলে, তখন এক মিটিং এ এমনিই বললাম আমি, " হ্যাঁ গো, এবার আমাদের অফিসে দীপাবলি হবে নি?" সামনে বসে থাকা ক্লান্ত, কোটরগত দেড় ডজন চোখ পলকে ভ্যাবলা হয়ে যায়। তারপর সকলের মুখচোখের ওপর খেলে যায় অবিশ্বাসের রৌদ্রছায়া, কি বলছেন কি ম্যাডাম, মাথা টাথা খারাপ হল নাকি। একে নির্বাচনী কাজ তার ওপর দপ্তরের হাজারো " ডু ইট নাও" মার্কা চাপ, সবার ওপর এই সমীক্ষা আর পিছিয়ে পড়ার খেউড় গান, এর মধ্যে দীপাবলি!
বললাম, হোক না, আমার মা আর জ্যাঠাইমা ছোট থেকে শিখিয়েছে, যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে। কাজের চাপ তো সারা বছরই চলবে। DA মামলা যেমন গড়াবে জন্ম থেকে জন্মান্তরে, ন্যায্য প্রাপ্য - পদ - সম্মান- পরিকাঠামো কোনদিনই জনগণ চাকর গিরিতে জুটবে না, এগুলো তো নিত্য সত্য। তাই বলে কি বাঁচতে ভুলে যাব আমরা? এই উৎসব গুলোই তো সামান্য নিঃশ্বাস নেবার সময়।
তারপর আর কি, বাক্সপ্যাঁটরা হাঁটকে বেরোয়, গেল দীপাবলির আলোক মালা, যার কিছুতে আবার দাঁতে শান দিয়েছে কালেক্টরেটের মহা পরাক্রমী ইঁদুর গুষ্টি। বাদ দিয়ে কেটে, ছেঁটে, দুয়েকটা কিনে এনে হলুদ-সবুজ-লাল-গোলাপী আলোর মালায় সেজে ওঠে আমাদের আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর। নিমন্ত্রণ জানানো হয় সমস্ত কর্মচারী থেকে SLO - CA দের। কাজ মিটিয়ে, সবাই আসুন। সামিল হোন আমাদের রং আর আলোর উৎসবে। আসুন দুদণ্ড স্বস্তির বাতাস ভরে নিই ফুসফুসে। তবে এমনি এলে হবে নি, এসে বানাতে হবে রঙলী। জ্বালাতে হবে প্রদীপ। প্রদীপ, মোমবাতি আর সামান্য রং যোগান দিব আমরাই। যদি পারেন তো নিয়ে আসুন রং, চুড়ি, ছাঁকনি, চামচ, কাঁটা চামচ ইত্যাদি, রঙলী বানাতে যা যা অবশ্য প্রয়োজনীয়।
অধিকাংশই আল্পনার সাথে পরিচিত থাকলেও কখনও বানায়নি রঙলী। বেশির ভাগই প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা, সন্ধ্যা প্রগাঢ় হলে বা রাত নামলে চলে না বাস বা টোটো, তাতে কি। তাতেও উৎসাহে পড়েনি ভাঁটা। বিকাল নামার সাথে সাথেই জমিয়ে বসে পড়েছে লোকজন, জীবনের প্রথম রঙলী করতে। মফঃস্বল শহর আমাদের, আশেপাশের দোকান ঘুরে ও চার প্যাকেটের বেশি মেলেনি রঙলীর রং। নভোনীল বাবু হায় হায় করেছেন," ইশ যদি একবার যাওয়া যেত মহানগর, সত্যনারায়ণ পার্কের সামনে ঢেলে বিকোয় ম্যাডাম।" সে অবকাশ মিললে তবে তো।আর আমাদের সাধ্যও যা সীমিত।
সকলের উৎসাহ আর উদ্দীপনার দাপটে জাস্ট উড়ে গেছে আমাদের রং, নিয়ে আসা হয়েছে আবির। ফুরিয়েছে আবির, তো নিয়ে আসা হয়েছে আটা, কিন্তু হাল ছাড়েনি কেউ। নব্য প্রশাসনিক ভবনের তিন তলার করিডোর জুড়ে ফুটে উঠেছে একের পর এক কল্পনার ছায়া-মায়াচিত্র।
দীপাবলির আগের সন্ধ্যার শেষ অফিস, একে একে নিভে যাচ্ছে অন্যান্য দপ্তর গুলির আলো, আর আমাদের ক্ষুদ্র অকিঞ্চিৎ দপ্তর, আর তার সামনের দালান তখন ভেসে যাচ্ছে আলো আর রঙের প্লাবনে। মন খারাপ করে বসেছিল সৌম্য, শুভদীপ্ত আর যশুয়া টেনে নামিয়েছে মাটিতে। "চল হাত লাগাই"। রিপোর্ট বানানো ছাড়িয়ে শান্তনুকে টেনে করিডোরে নামিয়েছে অরূপ, হয়ে যাবে, হয়ে যাবে। সব হয়ে যাবে। দৌড়ে দৌড়ে তদারকি করেছেন হক বাবু, ঘুরে ঘুরে দেখেছেন উৎসাহ দিয়েছেন নভোনীল বাবু। আর আমি কি করেছি, সত্যি বলছি আমি কিছু করিনি। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছি, প্রতিটা রোমকূপে ভরে নিয়েছি আজকের দিনটার প্রতিটা মুহূর্ত। বদলির চাকরি আমাদের, পরিযায়ী পাখির মত আজ এখানে আছি, কে জানে কাল কে কোথায় থাকব। সঙ্গে করে নিয়ে যাব, কেবল এই ভালোলাগা আর সুখ স্মৃতি গুলো। এই তো জীবন কালি দা -
No comments:
Post a Comment