#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা
হঠাৎ একদিন শুনলাম সুন্দর স্যার আসবেন। জে সুন্দরশেখর, প্রাক্তন আইএএস, অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত মুখ্য সচীব। কোন এক কালে কাঁথির মহকুমা শাসকের দায়িত্বভার সামলে ছিলেন। বর্তমানে হায়দ্রাবাদের পাকাপাকি বাসিন্দা। কি যেন কাজে সস্ত্রীক দীঘা আসছেন, এখন যদি বর্তমান মহকুমা শাসক অনুমতি দেন, তো ওনার প্রাক্তন নিবাসটি এক ঝলক দেখতে চান।
বর্তমান মহকুমা শাসক, এহেন আব্দারে কিঞ্চিৎ হতভম্ব হয়ে সটান দৌড়ে এলেন তাঁর সহধর্মিনীর কাছে। অধম তখন সদ্য অফিস থেকে ফিরে মেয়ে পেটাতে, থুড়ি পড়াতে বসেছে। এমন সময় ঢংয়ের ছদ্ম অনুমতি ভিক্ষায় যৎপরনাস্তি ক্রুদ্ধ হলাম। এ বাড়ির কোন কাজে, কবে, কে আমার অনুমতির তোয়াক্কা করে? তাছাড়া বাড়িতে যে অতিথি স্বয়ং আসতে চান, তাকে না বলার কুশিক্ষা আমার আছে নাকি?
গৃহকর্তা কান এঁটো করে হেসে বললেন, ' জানি তো। সেই ভরসাতেই বলেছি, অবশ্যই আসবেন।' জবাবে সুন্দর স্যার বলেছেন, "তোমার গিন্নি যদি ওই দিন থাকেন তো খুব ভালো হয়। আমার স্ত্রী ওর জন্য সামান্য কিছু উপহার নিয়ে যাবে।" কি সর্বনাশ! আবার উপহার কেন? অনাগত মান্যগণ্য অতিথিদের জন্য কি প্রতি-উপহার কেনা যায়, সেই নিয়ে বেশ খানিক মস্তিষ্ক প্রক্ষালন-পূর্বক আমরাও কিছু কিনলাম টুকটাক। শৌভিককে বললাম," বল, এলে কিন্তু অবশ্যই খেয়ে যেতে হবে।" বিজ্ঞের মতন মাথা নেড়ে শৌভিক বলল, "ঠিক ঠিক, খাবারে ইডলি ঢোসা, দই বড়া রাখব।"
এই না হলে আমার বর। দক্ষিণ ভারতীয়কে উনি দক্ষিণী খাদ্য দিয়ে আপ্যায়ন করবেন, কেন রে ভাই? বলি আমাদের কালিয়া, কোর্মা, পোলাও, শুক্তো, ছেঁচকি, চচ্চড়ি, ছ্যাচড়া, ডালনা, অম্বল, দই, মিষ্টি কি দোষ করল? শুধু একবার জেনে বল ওনারা নিরামিষাশী কিনা, বাকি বন্দোবস্ত আমার।
জানতে গিয়েই বাঁধল বিপত্তি। সুন্দর স্যার বললেন, কলকাতা থেকে কাঁথি পর্যন্ত উনি না খেয়ে আসতে পারবেন না। কারণ ওনার ভাষায়, "When I'm hungry, I get very angry." তাই কোলাঘাটে থেমে, লাঞ্চ করেই আসবেন, আমরা যেন অযথা ব্যস্ত না হই।
বাপরে কি রাগী লোক রে ভাই! যতই বলুক কিছু খাব না, তবুও সামান্য জলযোগের ব্যবস্থা করাই হল। তখন গরম কাল, তাই- দইয়ের ঘোল, তরমুজ, আঙুর, পাকা পেঁপে, বাগানের কাজু, রসগোল্লা আর মিষ্টি দই। ভালো চা আনানো হল খুঁজে পেতে। কাঁথিতে যে চা আমরা খাই, তাতে না থাকে গন্ধ না স্বাদ। সবকিছু সেরে, সাজিয়ে গুছিয়ে, আদর্শ বঙ্গ বধূর মত সুতির শাড়ি পড়ে, অপেক্ষা করতে লাগলাম মাননীয় অতিথিদের জন্য।
অফিস ছেড়ে তিনটে নাগাদ চলে এল শৌভিক। কাঁটায় কাঁটায় সোয়া তিনটে, বাংলোর মস্ত সবুজ গেটটা খুলে, ঢুকে এল দুধ সাদা ইনোভা গাড়িটা। শৌভিক আর আমি ত্রস্ত হয়ে এগিয়ে যাবার আগেই গাড়ির দরজা খুলে লাফিয়ে বেরিয়ে এলেন, এক দশাসই চেহারার প্রৌঢ়। এক গাল হেঁসে, আমাকে করজোড়ে নমস্কার জানিয়ে বললেন, " বৌদি কেমন আছে?" দক্ষিণ ভারতীয়দের মত ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, মাথা ভর্তি একরাশ কালো চুল, ততোধিক কালো ঝোড়া গোঁফ এবং এক গাল হাসি। কে বলবে, এই লোকটা প্রায় সত্তর?
গাড়ির অন্য দিকের দরজা খুলে ওনার স্ত্রী নেমে এলেন, আকৃতি এবং প্রকৃতিতে একেবারেই সুন্দর স্যারের বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। নাতিদীর্ঘ উচ্চতা, গৌরবর্ণ, ধীর, স্থির, লক্ষীমন্ত মহিলা। আমরা যথোচিত আপ্যায়ন পূর্বক ভিতরে যাবার অনুরোধ করলাম যুগলে। কিন্তু ওনাদের চোখ বাংলো থেকে আর সরেই না। দুজোড়া চোখে উপচে পড়ছে একরাশ স্মৃতি আর অপার মুগ্ধতা। দেশী ভাষায় পরস্পরকে কিছু বলতে শুরু করে বোধহয় হুঁশ ফিরে পেলেন দুজনে। আমাদের উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে ভাষাটা বদলে গেল ইংরেজি, হিন্দি আর বাংলার সংমিশ্রণে। স্ত্রীর সাথে কয়েক মুহূর্ত সোহাগী দাম্পত্যালাপ করে, সুন্দর স্যার বললেন, "জানো, এইখান থেকে প্রথম সংসার জীবন শুরু করি আমরা-"।
বৈশাখের প্রচণ্ড দাবদাহে পুড়ছে কাঁথি। কোন মতে প্রৌঢ় দম্পতিকে বসার ঘরে এনে, বাতানুকূল যন্ত্র চালিয়ে দেওয়া হল। মুখের সামনে ধরা হল দইয়ের ঘোল। টাটকা ফল, মিষ্টি আর কাজু। কাজু গুলো বাংলোর গাছের শুনে আর প্রতিবাদ করলেন না দোঁহে। ঘোলে চুমুক দিতেই সুন্দর স্যারের জাঁদরেল কালো গোঁফ, পলকে সাদা।
মাতৃসুলভ ভঙ্গিতে ম্যাডাম বললেন, " জানো আমরা ক্লাসমেট। বিয়ের পর ও হঠাৎ করেই সিভিল সার্ভিস পরীক্ষাটা দিয়েছিল, বেঙ্গল ক্যাডার হওয়াতে কি খুশি যে হয়েছিলাম আমরা। কাঁথিতে পোস্টিং হল যখন, আমিও চলে এলাম বাচ্ছাদের নিয়ে। তখন বাংলোটা এমন ছিল না। চারিদিকে শুধু মাটি আর মাটি। সেবার শীতে ফুলকপি আর পালং শাক লাগিয়েছিলাম আমরা, এত হয়েছিল খেয়ে বিলিয়েও শেষ করতে পারিনি।"
বলতে বলতে কি যেন মনে পড়ে যায়, ভদ্রমহিলা আড় চোখে সুন্দর স্যারের দিকে তাকিয়ে বলেন, " একবার কি হয়েছিল জানো? সেদিন রবিবার, সুন্দরজী বাগানে দাঁড়িয়ে গাছে জল দিচ্ছেন, আর একটা লোক এসে বলে, 'এই মালি, এসডিও সাহেব আছেন?' সুন্দরজীও এত বদমাইশ ছিলেন, বললেন, ' একটু দাঁড়ান দেখে আসছি।'"
সম্মিলিত হাসির প্লাবনে ধুয়ে যায় মোদের সরকারি আবাসের বসার ঘরটা। শৌভিকের সাথে সুন্দরজীর গল্প জমে, তখন আর এখনকার কাজের ধারা, গণ্ডি, পরিসর, জটিলতা ইত্যাদি নিয়ে। আমার কাছে ম্যাডাম খুলে বসেন স্মৃতির ঝাঁপি।" খুব ভালো লাগতো কাঁথি, জান তো। আমার ছেলেমেয়েদেরও খুব প্রিয় এখানকার স্মৃতি। আমরা এখানে আসছি বলে ওদের কি আনন্দ। রাত্রি হলেই ফোন করবে সবাই আর খুঁটিয়ে জানতে চাইবে, কি দেখলাম। কেমন দেখলাম। চেনা কার সাথে দেখা হল এইসব।
কাঁথি ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না আমাদের, কিন্তু সমস্যা দেখা দিল যখন বাচ্ছারা একটু বড় হল। একটাও ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল ছিল না তখন আশেপাশে। বাড়িতে রেখে পড়াব যে, ইংরেজি জানা কোন ভালো টিউটর পর্যন্ত পাইনি তখন। কাঁথি আমার জন্য একদিক দিয়ে খুব লাকি।
এখান থেকেই চাকরির পরীক্ষা দিলাম, পেয়েও গেলাম। ছেলেমেয়েকে এখানে রেখেই গিয়ে জয়েন করতে হল হায়দ্রাবাদে। ২-৩ মাস বাংলো স্টাফেদের কাছেই রয়ে গেল ছেলে মেয়ে আমার। ওরা এত ভালোবাসতো আমার বাচ্ছাদের, যেদিন নিয়ে গেলাম সবার কি কান্না।"
সুন্দর স্যারদের চমকে দেবে বলে,সেই সময়কার বাংলো স্টাফদের খুঁজে বার করার চেষ্টা করেছিল শৌভিক। পায়নি। সবাই বর্তমানে অবসৃত, কেউ কেউ মৃত। ম্যাডাম জানতে চান," পাশের ঘরটা কি করো তোমরা?" বুঝতে পারি উনি আর একবার ছেড়ে যাওয়া জীবন আর সংসারকে অনুভব করতে চান। সাদরে ভিতরে নিয়ে যাই, খাবার ঘর থেকে রান্না ঘর, অতিথি ঘর থেকে তুত্তুরীর ঘর, আমার অগোছাল শোবার ঘর -এক পা এক পা করে হাঁটেন উনি, পরম মমতায় হাত বোলান সরকারী ভাড়া বাড়ির উজ্জ্বল হলুদ রঙা দেওয়ালে। " এর আগেও একবার এসেছিলাম জানো তো। একদম ভালো লাগেনি। কি নোংরা, ধুলো পড়া, কুৎসিৎ ছিল সবকিছু। এবার খুব ভালো লাগছে। কি পরিষ্কার করে গুছিয়ে রয়েছ তোমরা।" স্মৃতি মেদুরতায় ভারী হয়ে আসে কণ্ঠ, "এই খানে খেতে বসতাম আমরা, এই ঘরটায় বান্টি পড়ত স্যারের কাছে, এই ঘরে মেয়ে নিয়ে ঘুমাতাম আমি, ওই ঘরের দরজা খুলে এক বর্ষায় এত বড় একটা সাপ দেখেছিলাম আমি -"। বলতে - শুনতে খেই হারিয়ে ফেলি আমরা। আমার মধ্যে উনি ওনার অতীতকে দেখেন আর আমি ওনার মধ্যে দেখি আমার ভবিষ্যৎ।
রোদ পড়ে আসে, সমুদ্র বায়ুর দাপটে মাথা ঝাঁকায় বাংলোর বুড়ো আম-জাম-তেঁতুল-কাজুবাদাম গাছ গুলো।শৌভিক আমন্ত্রণ জানায় অফিস দেখতে যাবার জন্য। উৎসাহিত হয়ে পদব্রজেই রওনা দেয়, প্রাক্তন আর বর্তমান মহকুমা শাসকদ্বয়। আমার হাত ছাড়েন না ম্যাডাম। "তুমি আমার সাথে গাড়িতে চলো।" ইনোভা গাড়ি ভর্তি তন্তুজের শাড়ি, শ্রীলেদার্সের জুতো ইত্যাদি, এক টুকরো কলকাতা।
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সুন্দর স্যারকে প্রতিটা সেকশন দেখায় শৌভিক। সুন্দর স্যারের সমসাময়িক লোকজন কেউই আর নেই, ওনার বিদায় সম্বর্ধনায় গান গেয়েছিল যে ছেলেটি, তিনি বর্তমান মহকুমা শাসকের গুরুগম্ভীর আপ্ত সহায়ক। মহকুমা শাসকের চেম্বারে বসে অন্ধ্রপ্রদেশ আর তেলেঙ্গানার বিবাদের কারণ বিশদে বোঝান ম্যাডাম। নিমন্ত্রণ করেন ওনার শহরে, " হায়দ্রাবাদ এসো।" সুন্দর স্যার বলেন, " চলো, চলো আমাদের সাথেই চলো। এত বছর আছি, আমরাও কিছু দেখিনি। তোমাদের সাথে আমরাও ঘুরব।" শৌভিক এর দিকে তাকিয়ে বলেন, " ডিএম কে বলব? দুদিন ছুটি দিতে -"। শৌভিক হাসে, ম্যাডাম মুখ ঝামটে বলে, " সুন্দরজীর রসিকতার রোগ আছে। কথায় কথায় ছড়া বানায় আর লোকজনের হাড় জ্বালায়। আজ সকালে তোমার বরকে কি বলেছে শুনেছ?" রাবণের মত হাহা করে হেসে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে সুন্দর জী বলেন, "হ্যাঁ বলেছি, when I'm hungry, I get very angry."
বেলা গড়িয়ে যায় সূর্য ঢলে পড়ে। বিদায় নেন ওনারা। যাবার আগে আলিঙ্গন আর আশীর্বাদ করে যান ম্যাডাম, আর সুন্দর স্যার আমার মাথায় হাত রেখে বলেন, " চলে যাচ্ছি আম্মা, তবে যাবার আগে অনেক আশীর্বাদ করে যাচ্ছি। খুব ভালো থেকো। তোমাদের থেকে যে আতিথেয়তা পেলাম, অন্নপূর্ণা আর আমি বিমোহিত। এই না হলে বাঙালি! এই আতিথেয়তা কেবল বাঙালিরাই দিতে পারে। তাই দেখো, অবসর নেবার পরও,নানা ছুঁতোনাতায় বারবার ফিরে আসি এই রাজ্যে।"
No comments:
Post a Comment