Wednesday 22 November 2023

অনির ডায়েরি ২১শে নভেম্বর, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি 

(জহরবাবুর দাদুভাই আর গোবর্ধনধারী)



সংকুচিত ভাবে শুভাশিস মনে করাল," ম্যাডাম আজ জহরবাবুর নাতির অন্নপ্রাশন।"  জহরবাবুর দৌহিত্র থুড়ি দাদুভাই আজ প্রথম অন্নগ্রহণ করবে। প্রায় তিন সপ্তাহ আগে থেকে বলে রেখেছেন জহর বাবু,  ঐদিন সকলের উপস্থিতি এবং আশির্বাদ প্রদান বাধ্যতামূলক। 


জহরবাবু এককালে এই অফিসের দারোয়ান এবং নৈশপ্রহরী ছিলেন। বছর দুয়েক আগে আমি এসে তাম্রলিপ্তের কার্যভার গ্রহণ করলাম আর উনিও অবসর নিলেন। আমরা সাধ্যমত ওনাকে বিদায় সম্বর্ধনা তো জানিয়ে দিলাম, কিন্তু জহর বাবু গেলেন না অফিস ছেড়ে। একখান দরখাস্ত করলেন, যতদিন না পাকাপাকি দারোয়ান পাচ্ছে এই অফিস,উনি ওই দায়িত্বভার গ্রহণে ইচ্ছুক। বেতনপত্র সরকার বাহাদুর যা দেবে, তাই মাথা পেতে নেবেন। ব্যাপারটা মহানগরের জানালামও আমি। তারপর যা হয় আর কি, Dঅনুমোদন বা মজদুরি কিছুই আসে না, তাতেও জহরবাবু অদমনীয়।


 প্রত্যহ সকাল ন'টায় ভটভটি চালিয়ে আপিসে এসে ঢোকেন, সব জানলা দরজা খোলেন,  আলো জ্বালেন, সুইপার মাসিকে দিয়ে ঘরদোর সাফ করান, জল ভরান, চা করে ধরেন সবার মুখে মুখে, বেল বাজালেই ছুটে আসেন এবং প্রতি এক ঘন্টায়  একবার করে জানতে চান," ম্যাডাম, টিপিন হয়েছে?" অথবা " ম্যাডাম আজ অফিসে কিছু খাওয়া-দাওয়া হবে নি?" আরো অনেক কিছু করেন, যাতে মাঝেমাঝেই আমার অন্য স্টাফদের কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোয়। বিগত বছর তাও এদিক-ওদিক করে Rসামান্য কিছু সাম্মানিক দিতে পেরেছিলাম বুড়োকে, এ বছর তো আমার নিজেরই ভাঁড়ে মা ভবাণী। বুড়াকে তাই যত বলি, আর কেন আমার পাপ বাড়াচ্ছেন, এবার আসুন। বিদেয় হন। বুড়া ততো জোরে জোরে চিৎকার করে, "জয় গুরু নিতাই। প্রেমানন্দে হরি হরি বলো মন, হরি হরি বলো।"


এহেন বৃদ্ধের দাদুভাইয়ের k অন্নপ্রাশনে হাজিরা না দিয়ে কি পারা যায়! লম্বা ছুটির মাঝে একদিন আপিস, ঠিক সেইদিনই অন্নগ্রহণ করবেন দাদুভাই। আগে থেকে যারা ক্যাজুয়াল লিভের আবেদন করেছিল, সব নাকচ করে দিয়েছি আমি। আরে ভাই এই খেয়ালী বৃদ্ধের জন্য এইটুকু তো করতেই হবে। কিন্তু এখন তো বাজে সবে বেলা দেড়টা, এত তাড়াতাড়ি খেতে যাব কেন? টিফিন তো তিনটের আগে করি না কেউই। শুভাশিস কান চুলকে বলে, ' সকাল থেকে ফোন করেই যাচ্ছেন জহর বাবু। 'কখন আসতেছ? ম্যাডাম কখন আসতেছেন?'"

মুড়ির টিনের মত ঠেসেঠেসে ঢুকিয়েও ধরল না সবাই গাড়িতে। যোশুয়া আর আশিসকে সওয়ার হতে হল বাইকে। সবমিলিয়ে মোরা, এক কম এক ডজন। জনা দুয়েক রয়ে গেল অফিস সামলাতে।  বেশি দূরের রাস্তা তো নয়। পনেরো কুড়ি মিনিট মাত্র। গ্রাম জানুবসান, পোস্ট নোনাকুড়ি। সেখানে কি যেন এক বন্ধ সিনেমা হলের পাশে জহরবাবুর বেয়াই গৃহেই  দাদুভাইয়ের মুখে ভাত। 


দাদুভাইয়ের ভালো নাম জয়। তিনি ফিরিঙ্গি ভাষায় সত্যিই "a bundle of joy"। ভাগ্যে কার্ডে তার ছবি ছিল, তাই না আমরা নিমন্ত্রণ বাড়িটা খুজে পেলাম। হাইরোড থেকে ঢালু রাস্তা দিয়ে অনেক নীচে জয়ের পিতামহের ভিটে। যখন গাড়ি থেকে নামছি আমরা, শান্তনু বলল, "এত বছরে এই প্রথম আমরা জহর বাবুর বাড়ি আসতেছি। এর আগে ওনার দুই মেয়ের বিয়ে আর কার যেন শ্রাদ্ধে নিমন্ত্রণ করছিলেন, আসতে পারিনি আমরা। খুব রেগে গিয়েছিলেন জহর বাবু।" 

Dআজ অবশ্য জহরবাবুর মুখে চোখে রাগের কোন চিহ্নই নেই। একগাল হেসে স্বাগত জানিয়ে নিয়ে গেলেন আমাদের। বাড়ির বাইরে জুতো খুলে ঢুকছে সকলে। আমাদের জন্য একটু বেশি খাতির। সামনের এক ফালি মাজা বারান্দায় রাখা আছে কতগুলি প্লাস্টিকের চেয়ার, সেখানে জুতো খুলে ভিতরে ঢুকলাম আমরা। 


অগণিত কুচোকাঁচা পরিবৃত হয়ে মায়ের কোলে শুয়ে খেলা করছিলেন জয় বাবু, আমাদের দর্শন করানোর জন্য R সাময়িক ভাবে কুচো ব্রিগেডকে বাইরে পাঠানো হল। ইত্যবসরে দাদুভাইকে সটান মায়ের কোল থেকে তুলে আমায় গছিয়ে দিলেন জহরবাবু। ছিমছাম ভদ্রলোক কিঞ্চিৎ টেকো, ধপধপে গাত্র বর্ণ, কপালে ধ্যাবড়া Kকাজলের টিপ,  পরণে ন্যাপি, তার ওপর নীলচে হাফ প্যান্ট এবং জামা থাকলেও মধ্যপ্রদেশ পুরো ফাঁকা। যেমন তুলতুলে তেমনি মসৃণ। গায়ে দুধ আর ট্যালকম পাউডার মেশানো মোহক সৌরভ। অচীরেই অনুধাবন করতে পারলাম, আমি ওনাকে আলিঙ্গন করে যতটা মন্ত্রমুগ্ধ, উনি মোটেই ততোটা পুলকিত নন। বরং উটকো লোকের আদরে বেশ বিরক্ত। 


Dজহরবাবুর গিন্নি বললেন, " আজ সকাল থেকেই বলছিলাম, দেখো এবারেও কেউ আসবে নি। আর লোকটা সমানে বলে চলেছে, 'না ম্যাডাম বলেছেন উনি আসবেন।' আপনারা আসাতে লোকটা যে কি খুশি আর গর্বিত হয়েছে কি বলব।" না বলতে পারলেও, বেশ বুঝতে পারছিলাম, 'লোকটা' হেব্বি খুশি। আমরা থাকতে অন্য কাউকে আর দাদুভাইয়ের কাছে ঘেঁষতেই R দিচ্ছিল না। দৌড়ে দৌড়ে গিয়ে কখনও কফি আনছিল, তো কখনও সবার জন্য জলের বোতলK। ওই যজ্ঞিবাড়িতে কোথা থেকে খুঁজে পেতে একরাশ মিষ্টি, নিমকি দিয়ে তিনটি প্লেট সাজিয়েও এনেছিল লোকটা। এসব খেলে আর নিমন্ত্রণ রক্ষা করব কি করে, বলে কোন মতে নিরস্ত করা হল তাকে।


ভোজনের ব্যবস্থা দোতলায়। সদ্য নির্মিত রেলিং- পলেস্তারা বিহীন খাড়া সিড়ি দিয়ে উঠতে হয় দোতলার ছাতে। ছাদের প্রথম অংশে মাটিতে আসন পেতে খেতে বসেছেন অভ্যাগত বর্গ।  আমাদের আরো তিন ধাপ সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হল, পাশের ছাতে। আমাদের জন্য প্লাস্টিকের চেয়ার টেবিল। 

শুভাশিস- শান্তনু-নন্দন আগে থেকেই বলে রেখেছিল, নিরামিষ ভোজ হবে। কারণ গোবর্ধনধারী এসেছেন। গোবর্ধনধারী হলেন বালক শ্রীকৃষ্ণ, নাড়ুগোপাল আর রাধাস্বামীর মাঝামাঝি।  কষ্টি পাথরে নির্মিত, রুপার চোখ, মাথায় প্রকাণ্ড মুকুট, সর্বাঙ্গ গহনায় মোড়া। গোবর্ধনধারীর প্রবল ডিমান্ড এই চত্বরে। কোলাঘাট ব্লকের দেরিয়াচকে ওনার মন্দির। কিন্তু সেই মন্দিরে মোটেই থাকেন না গোবর্ধনধারী, তিনি ঘুরে বেড়ান ভক্তদের বাড়ি বাড়ি। কারো বাড়িতে শুভ কাজ হলে আগেভাগে ডেট নিতে হয় গোবর্ধনধারীর। পাঁচ ছয় মাসের আগে কোন ডেট মেলা ভার। একেক দিনে চার পাঁচ বাড়িতে দর্শন দেন গোবর্ধনধারী। আর এই পথ উনি অতিক্রম করেন পালকিতে। সেই পালকি বহনের ও নির্দিষ্ট লোক থাকে। তবে শর্ত একটাই, গোবর্ধনধারী নদী পার করবেন না।


গোবর্ধনধারীর প্রিয় খাদ্য নাকি,' বিছে কলা', অর্থাৎ বীজ সমেত কাঁচা কলা। রাস্তায় কোথাও যদি বিছে কলার কাঁদি দেখতে পান উনি, তাহলে নাকি এমন লোভ দেন যে পালকি প্রবল ভারী হয়ে যায়, আর তাঁকে নড়ানোই যায় না।


গোবর্ধনধারী যখন আসেন সঙ্গে পাঁচক ঠাকুরও নিয়ে আসেন। প্রয়োজনে যারা হাজার বারোশো নিমন্ত্রিত লোকেরও রান্না করে দেয়। উনি এলে বিনা নিমন্ত্রণেও সেখানে ভিড় জমায় ভক্তবৃন্দ, মাটিতে পাত পেড়ে সেবন করে প্রভুর প্রসাদ। ঠাকুরের মাহাত্ম্য এমনি, যে যতই লোক আসুক না কেন,ভোগ কোনদিন কম পড়ে না। আমার অবশ্য গোবর্ধনধারীর সঙ্গে সাক্ষাতের সৌভাগ্য হল না। আমরা যাবার আগেই উনি সপার্ষদ রওনা দিয়েছেন অন্য ভক্তের গৃহে। ওনার প্রসাদ টুকু সেবন করতে পারলাম এটাই যথেষ্ট।


প্রসাদ বলতে তপ্ত ভাত, পরিবেশকের ভাষায় অন্ন, ঘরের খাঁটি গাওয়া ঘি, চার রকমের তরকারি। যার মধ্যে যেমন ছিল শুক্ত, তেমনি ছিল বিখ্যাত বিছে কলার তরকারি। এছাড়া ধোঁয়া ওঠা ডাল, প্রচুর পোস্ত ছড়ানো আলু ভাজা, চাটনি থুড়ি অম্বল, পরমান্ন, মিষ্টি এবং এলাচ গন্ধী চাপ চাপ লাল দই। সাথে জহর বাবুর হরি নাম।  খেয়েদেয়ে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠছি, বৃদ্ধ এক গাল হেসে বললেন, " ম্যাডাম চলি যাচ্ছেন?চিন্তা করবেন নি, আমি পাঁচটার মধ্যে পৌঁছে যাব।" বলতে গেলাম, কে চিন্তা করছে, বলতে গেলাম, আজ আর নাই বা গেলেন, আজ তো আপনার দাদুভাইয়ের অন্নপ্রাশন। বললাম না, বললেই বা শুনছে কে? লোকটা তো আজ সকালে ও নটার মধ্যে এসে অফিস খুলে দিয়ে গেছে। সবই গোবর্ধনধারীর মহিমা।

No comments:

Post a Comment