Friday, 24 November 2023

অনির ডাইরি, ২২ শে নভেম্বর, ২০২৩

 


#অনিরডাইরি 

একরাশ বিরক্তি চেপে অফিস বেরিয়েছি। সেই কোন কাক ডাকা ভোরে উঠেও, এমন দেরী হয়ে গেল অফিস বেরোতে। আর তার জন্য, আমি ছাড়া আর কেউ দায়ী নয়। কি যে করলাম সকাল থেকে-।  ঘড়ির কাঁটা যেন 'তুড়ুক সওয়ার', যত জোরে ছুটছে, গাড়ির চাকা ততো জোরে ছুটতে পারছে কই! চাকার প্রতিটি পাকের সাথে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ আর লজ্জার বহর। এই সপ্তাহে এর আগেও একদিন লেট করেছিলাম, সৌজন্য আমার অ-সময়ানুবর্তিতা, আর দোষ চাপিয়েছিলাম জগদ্ধাত্রী পুজোর ভাসানের ওপর। যদিও পুরো মিথ্যা ছিল না, হেড়িয়া মোড় সত্যিই অচল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তা নেহাৎ স্বল্প সময়ের জন্য। আজ যদি আবার বড় সাহেবকে দেরীর জন্য মার্জনা চেয়ে মেসেজ পাঠাতে হয় হেব্বি লজ্জা লাগবে।


যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই-।  মগরাজপুরে বিশাল জ্যামে গিয়ে গোঁত্তা খেল গাড়ি। ড্রাইভারদের অসহিষ্ণু হর্ন, বাইক আরোহীদের হল্লা, চোখ রাঙানি কিছুতেই কিছু হল না। হবে কি করে? রাস্তা এখানে ভয়ানক সরু যে। একদিকে নির্মীয়মান উড়াল পুল, অন্যদিকে দিগন্ত প্রসারী ধান ক্ষেত। তবে তার জন্য জ্যাম হয় না। এখন নির্ঘাত রেলগেট পড়েছে। একটা টিংটিংয়ে লাইন, দিনে মেরে কেটে দু-এক জোড়া ট্রেন, পড়বি তো পর তার একটাই আমার ভাগ্যে পড়েছে। উড়াল পুলটা যে কবে চালু হবে ভগবান জানে। 


উত্তেজনায় বাঁ হাতের অনামিকার নখটা মট করে ভেঙেই ফেলতাম,এমন সময় তার দিকে চোখ পড়ল। শ্যামলা বরণ, দোহারা চেহারা, মাঝারি উচ্চতা, কাঁধ পর্যন্ত এক রাশ জট পড়া রুক্ষ লালচে চুল, পরণে বিবর্ণ লাল রঙের নাইটি, যার বাঁ কাঁধের দিকটা ছিঁড়ে ঝুলছে। ফলে পিঠটা পুরো অনাবৃত। ধুলিমলিন অথচ তেলতেলে টানটান পিঠের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, বয়স বেশি না মেয়েটার। অপ্রাপ্তবয়স্কই হবে নির্ঘাত। উঠতি বয়সের একটা ডাগর মেয়ে এই ভাবে স্খলিত বসনা হয়ে রাস্তায় ঘুরছে মানে নিশ্চয়ই মানসিক ভারসাম্যহীন! 


ভাবতে না ভাবতেই মেয়েটা রাস্তার ধার থেকে এক খাবলা মাটি তুলে ছুঁড়ে মারল সামনের বাইক আরোহীর দিকে। কি সর্বনাশ, এই মেয়েটিকে এই অবস্থায় ফেলে চলে যাবার কথা ভাবতেও আতঙ্ক লাগছে যে। আহারে, কার বাছা গো। কি জানি, কি হয়েছে মেয়েটার সাথে। যাই ঘটে থাকুক না কেন, এখনি কোন ব্যবস্থা না নেওয়া হলে আর কি কি ঘটতে পারে ভেবেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।

কি করি? কাকে বলি? ভাবতে ভাবতে গোপীবল্লভ বাবুর কথা মনে পড়ে গেল। গোপীবাবু হুগলীর চাইল্ড লাইনের মুখ্য কর্ণধার। চুঁচুড়ায় থাকতে অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় যদিও চাইল্ড লাইন কাজ করে না, তবুও মেয়েটার একটা নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা যদি কোন ভাবে করে দিতে পারেন। বেজে গেল ওনার ফোন। এদিকে মেয়েটা মাথা চুলকাচ্ছে আর গাড়ির লাইনের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করছে।


দ্বিতীয় ফোনটা করলাম নিজের বরকে। যদিও মগরাজপুর কাঁথি মহকুমার মধ্যে পড়ে না, তবুও যদি কিছু করতে পারে। ব্যস্ত অফিস টাইমে বউয়ের আদিখ্যেতা মনে করেই বোধহয় আজকেই ফোনটা কেটে দিল শৌভিক। অন্য দিন অকারণে ফোন করে বিরক্তি করি বলেই বোধহয় আজ 'পালে বাঘ পড়ল '। চোখে দেখতে না পেলেও, শুনতে পেলাম হুইসল বাজিয়ে চলে যাচ্ছে ট্রেন। বহুদূরের সারিবদ্ধ গাড়িগুলির মধ্যে সঞ্চারিত হল সামান্য স্পন্দন। অচিরেই এই জায়গা ছেড়ে চলে যাব আমরা। এতক্ষণ যার জন্য উন্মুখ হয়ে প্রতীক্ষা করছিলাম, এখন সেটাই জাগাচ্ছে চূড়ান্ত আতঙ্ক। 

কি করি? মেয়েটাকে গাড়িতে তুলে নেব কি? 


যতই আবেগপ্রবণ ট্যালা হই না কেন, সেটা যে চূড়ান্ত বোকামি হবে এতটুকু বুদ্ধি আমার ঘটেও আছে।ভেবে চিন্তে ফোন করলাম তমলুকের মহকুমা শাসককে। ইনি নিশ্চয় সহায়তা করতে পারবেন। ফোন ব্যস্ত। ধৈর্য হারিয়ে শেষে ফোন করলাম ১০৯৮ এ। চাইল্ডলাইনের হেল্পলাইন নম্বর। এর আগেও বেশ কয়েকবার এই নম্বরে ফোন করে খবর দিয়েছি আমি। বিশেষত যখনই কোন বাচ্ছাকে সন্দেহজনক পরিস্থিতিতে ভিক্ষে করতে বা বাচ্ছা রাস্তায় ফেলে কাউকে ভিক্ষে করতে দেখেছি। কোন বার বিফল করেনি ওই নম্বরটা। আজ এমনি কপাল তিনবারের চেষ্টাতেও ফোন তুলল না কেউ। উল্টে ৩০ সেকেন্ড পরে পরে কেটে যেতে লাগলো লাইনটা। আমি বোধহয় আজ সেই অভাগা, যেদিকে তাকাচ্ছি, সাগর শুকিয়ে যাচ্ছে।

 

তূণীরের সব অস্ত্র শেষ, আর বোধহয় কিছুই করতে পারলাম না। এদিকে ক্রমশই চঞ্চল হয়ে উঠছে আটকে থাকা যানবাহনের সারি, আর স্বল্প কয়েকটা মুহূর্ত ব্যাস, তারপরই মেয়েটাকে পিছনে ফেলে চলে যেতে হবে আমাদের। হতোদ্যম হয়ে আবার একবার ১০৯৮ এ ফোন করতে যাচ্ছি, বেজে উঠল মুঠো ফোনটা। ফোনের ওপারে গোপী বাবু। গম্ভীর গলায় জানতে চাইলেন," কে বলছেন?" 

মাত্র দু বছর হল চুঁচুড়া ছেড়ে এসেছি, তারপরেও বেশ কয়েকবার ফোন করেছেন উনি নানা কারণে, আর আজকেই কি না আমায় চিনতে পারছেন না। ওসব মান অভিমানের পালা পরে হবে, আগে তো মেয়েটার হিল্লে করি। স্বাভাবিক স্বরে বললাম, "আমি অনিন্দিতা ম্যাডাম।" পলকে নরম হয়ে গেল গলা, দরদী কন্ঠ বলে উঠল," ম্যাডাম! হ্যাঁ ম্যাডাম! বলুন।" খুলে বললাম সব, উনি শুনে বললেন," ওই জেলায় তো আমরা কাজ করি না, তাও আপনি ১০৯৮ এ জানান, ওরা এসে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে মেয়েটিকে।" বললাম তিনবারেও নিশানায় তীর লাগাতে পারিনি আমি। জবাব এল," আচ্ছা ম্যাডাম, আমি এক্ষুনি দেখছি।" মিনিট দুই একের মধ্যেই ফোন, "ম্যাডাম আপনাকে একজনের নাম আর নম্বর পাঠিয়েছি। ওনাকে একটু বললেই হবে।" 


 হোয়াটসঅ্যাপ খুলে দেখি, যার নম্বর দিয়েছেন, তা ইতিমধ্যেই সংরক্ষিত আছে আমার মুঠোফোনে।DCPO পূর্ব মেদিনীপুর বলে। ফোন করলাম, খুলে বললাম ব্যাপারটা। বুঝতে পারছি, উনিও আমার  মতই আটকে আছেন কোথাও। ভালো শুনতে পাচ্ছেন না, কিন্তু আমি যে নিরূপায়। মেয়েটাকে পিছনে ফেলে ইতিমধ্যেই অনেকটা এগিয়ে এসেছি, আমি চিন্তা হচ্ছে আর যদি না খুঁজে পাওয়া যায় মেয়েটাকে। DCPO প্রথমেই জানতে চাইলেন, "আপনার কাছে কি ওর কোন ছবি আছে?" ছবি তোলার কথা সত্যিই মাথাতেও আসেনি। এখন হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে। ছবি থাকলে অন্তত মেয়েটাকে চিনতে পারত ওরা। তাসত্ত্বেও উনি আশ্বস্ত করলেন," কোথায় দেখেছেন আর কেমন দেখতে একটু লিখে পাঠান দেখছি,আমার সাধ্যমত চেষ্টা করছি।" 

 তড়িঘড়ি করে লিখলাম," চণ্ডীপুর ব্লকের মগরাজপুর ফ্লাইওভারের নীচে একটি ১৬-১৭ বছর বয়সী মেয়ে, অর্ধনগ্ন অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝারি উচ্চতা, দোহারা চেহারা, শ্যামলা রং। পরণে ছেঁড়া নাল নাইটি। সম্ভবত মানসিক ভারসাম্যহীন। প্লিজ ওকে রেসকিউ করুন ।" 


পাঠানোর সময় কি মনে হল সমাজ কল্যাণ দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অতিরিক্ত জেলাশাসক, সাধারণ মহোদয়কেও পাঠিয়ে রাখলাম মেসেজটা। যদি কিছু সুবিধা হয়। নন্দকুমার মোড় ঘুরে, গাড়ি কোলাঘাট-হলদিয়া রোডে উঠেছে মেসেজ ঢুকল, "আচ্ছা দেখছি।" মাননীয় অতিরিক্ত জেলাশাসক যখন দেখছেন বলেছেন আর আমার উদ্বেগের কারণ নেই। নিশ্চিন্ত মনে, সামান্য লজ্জিত চিত্তে অফিসে ঢুকলাম। তারপর যা হয় আর কি, কাজের চাপ, মিটিং এর যাতনায় ভুলেই গেছি সব। বেলা দুটো কুড়িতে মেসেজ ঢুকলো ADM সাহেবের তরফ থেকে, শুধু একটাই কথা লেখা ছিল তাতে, "রেস্কিউড"। আকাশের রং কি হঠাৎ করে একটু বেশি নীল হয়ে গেল, রোদে কি লাগল সোনার ছোঁয়া! এত নির্ভার সকাল থেকে তো লাগেনি।


মনের কোন গহীন কোণে কেবল মাথা চাড়া দিচ্ছিল একটা লোভ। যদি জানতে পারতেম, কি হল মেয়েটার। ওর নাম ধাম জানা গেল কি? ওর মাকে/ বাড়ির লোককে খবর দেওয়া গেল কি? সাড়ে তিনটে নাগাদ ফোন করলেন DCPO, বললেন, " বাপরে কি কষ্ট করে যে মেয়েটাকে উদ্ধার করেছি ম্যাডাম! সে তো কেবল পালিয়েই বেড়ায়। আপনি অর্ধনগ্ন বলেছিলেন, আমি তো পুরো নগ্ন অবস্থায় পেলাম। পুলিশ যদি সক্রিয় সহযোগিতা না করত, আপনাকে খবর দেবার মুখ থাকত না। যাই হোক জানিয়ে রাখি, মেয়েটিকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে, অতি কষ্টে। নতুন পোশাক ও পরানো হয়েছে। ডাক্তারবাবুর রিপোর্ট পেলে পাভলভ বা কোথাও স্থানান্তর করা হবে।  মেয়েটি তো কিছুই বলতে পারছে না। এই মুহূর্তে কথা বলার মত অবস্থাতেই নেই। তবে জানেন তো, মেয়েটির বয়স কিন্তু ১৭/১৮ র মধ্যে নয়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে, ভালো জামা পরাতে অন্তত ২৪/২৫ বলে মনে হল। সঠিক বয়স অবশ্য ডাক্তার বাবুরাই বলতে পারবেন।"


DCPO অর্থাৎ District Child Protection Officer, ১৮র নীচের মানুষজনকে নিয়েই ওনার কাজ। ২৪/২৫ বছরের মেয়েকে উদ্ধার করা সত্যিই ওনার দায়িত্ব নয়। তবু যে উনি করেছেন,পিছিয়ে আসেননি তার জন্য প্রভূত ধন্যবাদ জানালাম। সাথে সাথে বয়স গুলিয়ে ফেলার জন্য মার্জনা চাইলাম। আমার জন্যই সারাদিন ছুটেছেন উনি, তাও এমন কাজে, যেটা আদতে ওনার নয়। মাঝপথে থামিয়ে দিলেন ভদ্রমহিলা, বললেন, " মেয়েটার  বয়স ১৮র নীচে বা উপরে যাই হোক, এই পরিণতি যেন কারো না হয়। আমি না হলে অন্য কাউকে তো কিছু করতেই হত। দাঁড়ান ম্যাডাম আগে মেয়েটার কিছু ব্যবস্থা করতে পারি, তারপর না হয় ধন্যবাদ জানাবেন।' ফোনটা রাখতে রাখতে মনে হল, নাহ্ সমাজটা এখনও রসাতলে যায়নি। এখনও আশা আছে -

No comments:

Post a Comment