#অনিরডাইরি
যবে থেকে শুনেছি অরূপ বিয়ে করছে, তবে থেকে ঠিক করেছি এই শাড়িটাই পরব। বড় সাধ করে, গুচ্ছ-গুচ্ছ রিলস দেখে, রিভিউ পড়ে, কিনেছিলাম শাড়িটা। আজ থেকে বছর ১৫ বছর আগে আমার বিয়ের বেনারসিটার যা দাম ছিল, প্রায় সমমূল্যে কিনেছি শাড়িটা। যার জন্য কেনা এবং পরা তিনি তো ফিরেও তাকালেন না। নিকষ আঁধারের চাদরে মোড়া বঙ্গোপসাগরের অদূরে, এক রেস্তোরাঁয় নৈশ ভোজে গিয়েছিলাম দোঁহে, দুটো প্রেমের বুলি ছাড়ুন, তাঁর নীরস শুঁটকো তত্ত্ব কথার দাপটে মনে হচ্ছিল জানালা গলে পালিয়েই যাই। নেহাৎ আটকে গিয়ে কেলেঙ্কারি হবে-
যাই হোক, তারপর থেকে আর পরাই হয়নি শাড়িটা। সুযোগ আসে কোথায়? জেলার ভূত আমি, মহানাগরিকদের যাবতীয় জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান থেকে সদা ব্রাত্য। আর এই মেদিনীপুরে কে আর রোজ রোজ বিয়ে করছে বা পার্টি দিচ্ছে। এইসব ভেবেচিন্তে পরে তো এসেছি শাড়িটা, কিন্তু স্বস্তি পাচ্ছি না মোটে। শাড়ি তো নয় যেন ছাতার কাপড়। কেবল হড়হড়িয়ে খুলে যেতে চায়। চাকা লাগানো চেয়ারে বসতে গেলে প্রতি মুহূর্তে মনে হয় হড়কে পড়ে গেলাম বুঝি। আঁটোসাঁটো করে গাছ কোমর বেঁধে পরতে গেলে জারদৌসি কাজের খোঁচায় পেট কুটকুট করে।
যাই হোক, কটা তো ঘন্টা, সন্ধ্যে নামলেই সদল বলে গিয়ে হাজির হব অরূপের ভাড়া করা লজে। যেদিন লাজুক মুখে নিমন্ত্রণ করতে এসেছিল ছেলেটা, সেদিন নির্লজ্জের মত বলেই দিয়েছিলাম, "তাড়াতাড়ি খেতে দিবে তো?" এদিকে রাত সামান্য গভীর হলেই বন্ধ হয়ে যায় অটো,টোটো,ট্রেকার। যোশুয়া আর মণীশ সেই হাওড়া ফিরবে, রবি আর সন্দীপ বাগনান। আমি আর বেদজ্যোতি কাঁথি। ফলে বেশি দেরী করা যাবে না। বধূ সেজে আসতে দেরি করতেই পারে, আমরা পৌঁছেই সটান হাত ধুয়ে খেতে বসব।
অরূপ কথা দিয়েছে, সাড়ে ছটার মধ্যেই সব রেডি হয়ে যাবে। নিমতৌড়ির এই নব্য প্রশাসনিক ভবন চত্বর থেকে যেতে সময় লাগবে মিনিট পঁচিশ। সবমিলিয়ে সাড়ে পাঁচটার ঘন্টাটা পড়ার অপেক্ষা, বিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেব আমরা। পৌঁছে আগে ফুচকা, কফি, পকোড়া তারপর মেন কোর্স। মেনুও জেনে নিয়েছি আগেভাগে। সব মিলিয়ে জনা পনেরো আমরা। মুড়ির টিনের মত ঠেসেঠুসেও কোন গাড়িতে ধরবে না, তাই বাইক নিয়ে যাবে কয়েকজন। কে কার বাইকে চাপবে, সেই নিয়ে খুনসুটি চলছে সকাল থেকে। আমাদের রবিবাবু এমন মাঞ্জা দিয়েছেন যে আমি পর্যন্ত হীনমন্যতায় ভুগছি, গোটা অফিস সেই নিয়ে চর্চায় উত্তাল। বিয়ে বাড়িতে বরকে আদৌ চেনা যাবে তো!
আজ বড়ই খুশি খুশি আবহাওয়া আকাশে-বাতাসে। এমন সময় যা হয় আর কি, ঢং করে মেসেজ ঢুকল জনৈকা বড় ম্যাডামের, সঙ্গে ঢুকল মুখ্যসচীবের এক খান পত্র। মুখ্যসচীব জেলাশাসকদিগকে কিছু নির্দেশ দিয়েছেন, যা আমাদের দপ্তর সংক্রান্ত। সেই নিয়েই আলোচনা করতে আমায় যেতে বলা হয়েছে, সন্ধ্যেবেলা। কি সর্বনাশ সন্ধ্যেবেলা কেন! তাহলে বে বাড়ি যাব কেমনে? আর তাছাড়া এই নিয়ে আলোচনা করার আমি কে রে বাবা? মানছি জেলা শাসকের করণে আমাদের অফিস, তাই বলে এই জেলার সব থেকে বড় অফিসার তো আমি নই। তিনি আমার বড় সাহেব, যিনি হলদিয়ায় বসেন। বাক্যালাপ, আলোকপাত, চায়ের চর্চা ইত্যাদি যা খুশি করার জন্য তিনিই যোগ্য ব্যক্তি।
তাঁকেই ফোন করলাম, যে দাদা তোমার জেলা তুমি সামলাও, আমি চললাম বিয়ে বাড়ি। কপালের এমন ফের, বড় সাহেবের সেই দিনই মহানগরের গুরুত্বপূর্ণ মিটিং। অগত্যা গরীবকেই যেতে হবে জবাই হতে। কি বলব সেটা তো অন্তত বলে দাও। বড় সাহেব হেসে বললেন,"বলো আমাদের দপ্তর থেকে এই সংক্রান্ত কোন নির্দেশ আমরা এখনও পাইনি। টাকা-পয়সাও কিচ্ছু নাই। তবুও জেলাধীশ যা নির্দেশ দিবেন, তাই শিরোধার্য।"
একটা একটা করে ফাইনাল পেমেন্ট ছাড়ি, আর জানলার বাইরে দেদীপ্যমান তপনের দিকে চাই, এবার তো ঢলে পড় রে বাবা। আজ না হয় বিকেল চারটেতেই সন্ধে করে দাও রে বাবা। সূর্যদেব একটা কথাও শুনলেন না বটে, তবুও সাহস করে চারটে নাগাদ ফোন করলাম ম্যাডামের আপ্তসহায়ককে। ম্যাডাম যদি চেম্বারে থাকেন তো সটান গিয়ে হাজির হই। সাজ দেখে বুঝতেই পারবেন আশা করি, যে বিয়ে বাড়ি যাব সন্ধ্যে হলে।
অভাগা যেদিকে চায়- পিএ বাবু কইলেন," ম্যাডাম তো ডিএম সাহেবের সাথে মিটিং করছেন।" আচ্ছা ঠিক আছে, সাড়ে চারটে নাগাদ আবার করলাম, আবার একই জবাব। পৌনে পাঁচটা, পাঁচটা, সোয়া পাঁচটা- বারবার একই কথা শুধাই আমি, একই জবাব দেন তিনি। শান্তনু শুকনো মুখে এসে জানতে চায়," তাহলে কি হবে ম্যাডাম? আপনি যেতে পারবেননি?"
তাই আবার হয়, আমাদের অরূপের শুভবিবাহ আর তাতে গরহাজির থাকব আমি! পৃথিবী উল্টে গেলেও যাব। বললাম, তোমরা রেডি থাকো। আমি চললাম ম্যাডামকে পাকড়াও করতে। পৌনে ছটা নাগাদ যখন প্রশাসনিক ভবনের বি ব্লকের তিন তলা থেকে নেমে, প্রশস্ত আঙিনা পেরিয়ে এ ব্লকের তিন তলায় উঠছি, অবাক হয়ে তাকাচ্ছে ঘরফেরতা সরকারি লোকজন, "এই ম্যাডামটা আজ এত সেজেগুজে আসতেছে কেন?" আমি নিরূপায়, আমি ভ্রূক্ষেপহীন।
ম্যাডামের চেম্বারে ঢুকে দেখি শূন্য আসনের সামনে ফাইলের ছোটখাটো শিবালিক-হিমাচল এবং হিমাদ্রি। ম্যাডামের মুখ্য আর্দালি, যাঁকে আমি ঠাকুরমশাই বলে সম্বোধন করি, দৌড়ে এসে বললেন," ম্যাডাম আপনার আগে অনেকে লাইন দিয়েছে। ওই যে দেখেন ফাইল দিয়ে লাইন রাখা।"
থাক লাইন, আমি বেলাইনেই ঢুকব আজ। আমায় বিয়ে বাড়ি যেতে হবে রে বাবা। ইঁট পাতার মত সবথেকে উপরের ফাইলটার উপর হাতের দু কপি রিপোর্ট রেখে, পেপার ওয়েট চাপা দিলাম। গ্যাঁট হয়ে বসলাম সবথেকে সামনের চেয়ারটায়, কোনমতে যাতে আমাকে টপকে কেউ ম্যাডামের কাছে না ঘেঁষতে পারে।
ঘড়ির কাঁটা ছুটছে আপন লয়ে, আমার হৃদপিণ্ড ছুটছে তার থেকে আড়াইগুণ দ্রুত গতিতে। ছটা- সোয়া ছটা- সাড়ে ছটা বেজে গেল প্রায়। স্বর্গের ৩৩ কোটির মধ্যে যতজনকে চিনি ডেকে ফেলেছি, কারো দেখা নেই, ম্যাডামেরও না। বসে বসে লম্বা মেসেজ লিখলাম ম্যাডামকে, বড় সাহেব যা বলতে বলেছেন তাই সুচারু ইংরেজিতে লিখলাম, সাথে রিপোর্টটাও দিলাম টাইপ করে। সবশেষে বিনীত অনুরোধ করলাম, প্লিজ ম্যাডাম যদি অনুমতি দেন তো বিদায় নিই। একটা বিয়ে বাড়ি যাবার আছে, আমার অন্যান্য সহকর্মীবৃন্দ আমার জন্য প্রতীক্ষারত।
"উত্তর আসবে না, তুমি আসবেই আমি জানি" করে ম্যাডাম এসে উপস্থিত হলেন আরো মিনিট ১৫ দেরীতে। পিছন পিছন ঢুকলেন জনা তিনেক গণ্যমান্য আধিকারিক। কেউ কিছু বলার আগে করজোড়ে মার্জনা চাইলাম আমি, একটু যদি আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়, যা বলার সব মেসেজে লিখে পাঠিয়েছি আমি। ম্যাডাম জিভ কেটে বললেন," আপনি মেসেজ করেছিলেন, আমি এতক্ষণ দেখিইনি। আসলে একটা ভিসি ছিল, তারপর বেশ কয়েকটা মিটিং, মোবাইলের দিকে তাকানোর সুযোগই হয়নি।কিন্তু আপনি এতক্ষণ অপেক্ষা করলেন কেন, চলে গেলেই পারতেন।
উঁচু গোড়ালির জুতো আর হলহলে শাড়ি সামলে, বাতাসের থেকেও দ্রুত গতিতে দৌড়ই আমি, লিফট আসতে বড্ড দেরী করছে, সিঁড়ি ধরি আমি। আমার প্রতীক্ষায় রয়েছে ১৪ জন, " সৌরভ-রঞ্জিত- শান্তনু -শুভাশিস - শুভদীপ্ত----- চলো চলো আর এক মুহূর্ত দেরি নয়। ফুচকাওয়ালা বসে আছে আমাদেরই প্রতীক্ষায়, ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে কফি আর পকোড়া গুলো, খেতে হবে তো। ছবি তুলতে হবে তো। জলদি জলদি গাড়ি বাইক স্টার্ট করো সবাই। এহে বড্ড রাত হয়ে গেল গো। যারা যাবার সময় সোহাগ করে বন্ধুর বাইকে যাচ্ছে, ফেরার সময় নিজের ব্যবস্থা নিজেরা করবে, একটাকেও বাড়ি পৌঁছিয়ে দেব না আমি।হক বাবু, উপহারটা নিলেন? খালি হাতে গেলে যদি খেতে না দেয় -
No comments:
Post a Comment