#অনিরডাইরি
রোজ অফিসে বেরিয়ে, সর্বাগ্রে যেটা করি, তা হল বাড়িতে ফোন। সাধারণতঃ সারাদিনে এই একবারই বার্তালাপ হয় জনকজননীর সাথে। হয় নৈমিত্তিক কুশল সমাচার আদানপ্রদান, " ঠিক আছ তো? শরীর- টরীর সব…" ইত্যাদি। দিন বদলালেও জিজ্ঞাস্য একই থাকে, জবাবও একই আসে। "আমরা তো ভালোই আছি, তোরা কেমন আছিস? তুত্তুরীকে স্কুলে দিয়ে এলি".… ইত্যাদি প্রভৃতি। এর বেশি বলার মত কথা, তেমন কিছু খুঁজেও পাই না আমরা।
সেদিন, এইসব কথার মাঝে মা জিজ্ঞাসা করল,"কবে আসছিস?" আসা মানে কালীপুজোয় পিত্রালয় গমন। এই তো একাদশীর দিন ফিরলাম, আবার বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে যেতে হবে ভাবলেই, "কুন কুন জায়গায়" যে ব্যথা জেগে ওঠে কি বলব। সেটাই বললাম মাকে, বোঝালাম, এবার নাও যেতে পারি। মাসিক টাকাপয়সা গুলো তুলে একদিন দিয়ে আসব খন।
" তোমরা তাহলে এবার কালীপুজোয় আসছ না?" পরের দিন আবার একই প্রশ্ন করে বাবা। বোঝাই, পেটের ধান্ধায় দৈনন্দিন এই দেড়শ কিলোমিটার যাতায়াতে ভিতর থেকে ক্ষয়ে যাচ্ছি আমি। এর উপর সরকারি চাকরগিরি করার হাজার অত্যাচার, অফিস সামলে বাড়ি ফিরে মেয়েকে পড়ানো, সব মিলিয়ে জর্জরিত আমি। চুপ করে শোনে বাবা। অপরাধবোধ হয়, নিজের অপারগতায়। বলি, এবার না হয় তোমরা দুজনেই খুব আনন্দ করে দীপাবলী কাটালে, আমাজন থেকে স্পেশাল মোমবাতি অর্ডার দিয়ে দিচ্ছি, বাড়ি পৌঁছে যাবে।
"কেন?" ওপার থেকে ভেসে আসে বাবার মন কেমন করা কণ্ঠস্বর, "কে জ্বালাবে? তোমরা আসলে, তবেই খণ্ডহরে দেওয়ালি। বাতি জ্বালাবার সামর্থ্য আমাদের আর নেই। কালীপুজোর দিন বড়জোর বারান্দা আর বাইরের আলো গুলো জ্বেলে দেব আমরা। ব্যাস।" সেদিনের মতো দূরাভাষে কথাবার্তা ওই পর্যন্ত হলেও, বুকের ভিতর কুরেকুরে কেউ যেন লিখতে থাকে, কানের কাছে বলতে থাকে, বার বার, "তোমরা এলে, তবেই খণ্ডহরে দেওয়ালি।"
কালীপুজোর ছুটিতে কবে কি করব সেই পরিকল্পনা হয়ে গিয়েছিল আমাদের। শেষ মুহূর্তে ঝাড়াই-বাছাইয়ের সময় খুলে বললাম শৌভিককে। জানতে চাইলাম, কি করি বল তো। ক্ষণিক ভেবে আমার বর বলল," ক্রিকেটে, বেনিফিট অফ ডাউট সবসময় ব্যাটসম্যানের পক্ষেই যায়। যখন মনে দ্বিধা দেখা দিয়েছে, চলেই যা।" এই না হলে আমার বর। জীবনেও কোন কিছুতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি, নিজের মত জোর করে চাপিয়ে দেয় নি।
এরপর আর কি, বাক্স খাটের ভিতর থেকে বেরোয় চাকা লাগানো ব্যাগ। কালী পুজোর আগের রাতে গোছগাছ মিটতে মিটতে বেজে যায় রাত একটা। পুজোর দিন অ্যালার্ম দিয়ে কাক ভরে উঠে পড়ি আমি। যাবই যখন, সময় নষ্ট করে লাভ কি। মেয়েকে ঠেলে তুলি, হেমন্তী প্রভাতে কাঁপতে কাঁপতে স্নান, পুজো সেরে, এক কাপ কেলে কফি খেয়ে বেরিয়ে পড়ি হাওড়ার উদ্দেশ্যে। যাচ্ছি মাত্র দিন চারেকের জন্য অথচ জামা কাপড় নিয়েছি ব্যাগ ভর্তি করে। নিয়েছি রং বেরংয়ের প্রদীপ, মোমবাতি, রংলী বানানোর উপকরণ, দীপাবলী উপলক্ষে উপহার পাওয়া শুকনো ফল, মিষ্টি, এমনকি মায়ের ফরমাইশি তুলসী গাছও।
বাড়ির গলিতে যখন বামাল সমেত ঢুকছি আমরা মা-মেয়ে, জনৈক প্রতিবেশী ছুটে এসে টব সমেত তুলসী গাছটা নিতে চায় তুত্তুরীর হাত থেকে। "আহারে, মেয়েটার কত কষ্ট হচ্ছে এত বড় টব বইতে।" টবটাকে আরো নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরে তুত্তুরী, হাসি মুখে প্রত্যাখ্যান করে সহৃদয় সহায়তার প্রস্তাব। অতঃপর তিনি হাত বাড়ান আমার ভারী ব্যাগগুলির দিকে। " তুই তো দে, বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।" আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে নিরস্ত করি আমিও। আমরা হলাম যাকে বলে শক্তপোক্ত স্বাধীনচেতা নারী, নিজেদের মোট নিজেরাই বইতে পারি।
আজ আমাদের চাটুজ্জে বাড়িতে দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজো। সবার ব্যস্ততা চরমে। একদিকে ভোগ রান্না হচ্ছে তো অন্য দিকে চাল গুড়ি দিয়ে কলার পেটোর ওপর বানানো হচ্ছে ১৪ প্রদীপ। চতুর্মুখী সুখ প্রদীপ। এরপর বানানো হবে বাক্সপ্যাঁটরা সমেত লক্ষ্মী নারায়ণ কুবের। তারপর গড়া হবে গোবরের লক্ষ্মী। সায়াহ্নে কুলো পিটিয়ে তাকে বিদেয় জানানো হবে চৌ রাস্তার মুখে। এসব মিটলে বানানো হবে রঙলী।
দিন ঢলে, সন্ধ্যা নামে, বৈঠক খানার সাদা মার্বেলের ওপর ফুটে ওঠে অয়নের হাতে বানানো দশ রঙা রঙলী। সাজানো হয় প্রদীপ দিয়ে। উৎসাহের আতিশয্যে, কাতরাতে কাতরাতেও মাটিতে বসে পড়ে পঁচাত্তরের মা আমার। বাবার 'খণ্ডহরে দিওয়ালির' প্রথম প্রদীপ জ্বলে ওঠে মায়ের হাতে। বাকি গুলো জ্বালানো নিয়ে আক্ষরিক অর্থে হাতাহাতি চলে বাবার দুই নাতিনাতনীর মধ্যে। সাময়িক ভাবে হলেও আলোক মালায় সেজে ওঠে প্রপিতামহের বানানো দেড়শ বছরের বুড়ো বাড়িটা।
দক্ষিণের ছাত থেকে ভেসে আসে কোলাহল, হাজিরা দিতে হবে বাজি পোড়ানোর যজ্ঞে। নাহলে ব্যাপারটা নাকি তেমন জমছে না। ঘাসে ঢেকে যাওয়া পরিত্যক্ত পূবের উঠোন পেরোতে পেরোতে ফিরে তাকাই একবার বাড়িটার দিকে, কানে বেজে ওঠে জনৈক মাতৃসমার গর্বিত উক্তি, আজ সকালেই বলছিলেন উনি, "তোর কথা আমি প্রায়ই বলি জানিস। সবাইকে বলি। তুই কেমন সব দিক সামলাস। আমাদের বাড়ির মেয়েটা জানিস, বিয়ে হয়ে ইস্তক আর আসতেই চায় না। ওর বর নাকি পছন্দ করে না, ঘনঘন বাপের বাড়ি যাওয়া। এটা কেমন কথা বল তো? মেয়ের বাড়ির লোক বলে আমাদের কি মন নেই?"
ভদ্রমহিলা মোটেই আবেগপ্রবণ নন, বরং বেশ ঠোঁটকাটা। এই প্রথম নিজের প্রশংসা শুনলাম ওনার মুখে, জীবনের চারটে দশক পেরিয়ে। দ্রবীভূত হয়ে পড়েছিলাম আবেগে, সামলে নিয়ে চরণ স্পর্শ করে বলেছিলাম, কতটা পারি জানি না, আশির্বাদ করো যেন সত্যিই সবদিক সমান তালে সামলাতে পারি। না পারলে আমার যে কোন উপায় নেই। আমি এলে, আমি পারলে তবেই না "খণ্ডহরে দিওয়ালি"।আমাকে যে পারতেই হবে।
No comments:
Post a Comment