Sunday, 9 April 2023

অনির ডাইরি ৩০শে মার্চ, ২০২৩

 


#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 

অর্থ বর্ষ প্রায় শেষ। "সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে"র ধারাকে অব্যাহত রেখে, শেষ মুহূর্তে হুড়মুড়িয়ে ডুকছে অ্যালটমেন্ট। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এই অর্থবর্ষটা আমরা বুঝি ধারহীন ভাবেই শেষ করতে পারব।

নূতন করে ধার করার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছি। কম্পিউটার সারায় যে ছেলেটি, তাকে বলেই দিয়েছি, এপ্রিল পড়লেই আর একবার চেক করে নেবে আমাদের সব কম্পিউটার গুলো। অ্যান্টিভাইরাস গুলো, সময় শেষের রক্তচক্ষু দেখাচ্ছে। ওগুলোকেও একটু বদলে দাও। ইলেকট্রিকের কাজ করে যে ছেলেটি, তাকে বলা হয়েছে, একটু ফ্যানগুলো ছেড়ে দিয়ে যা বাবা।


এরই মধ্যে ঘোষিত হয়েছে দুয়ারে সরকার। বাতাসে ফিসফিসে খবর, উচ্চ মাধ্যমিক মিটলেই জেলা শহরে আসতে চলেছেন মাননীয়া। সদর দপ্তর থেকে নামানো হয়েছে বেশ কিছু নালিশের ডালি। জনে জনে ফোন করে শুধাতে হচ্ছে, " দাদা/দিদি বলুন কি আপনার অভিযোগ/অনুযোগ…"


অধিকাংশই  শ্রম দপ্তর সংক্রান্ত নয়। তাদেরকেও দিশাহীন ভাবে ছাড়া যাচ্ছে না। বলে দিতে হচ্ছে, একটু অমুক দপ্তরে কথা বলে দেখুন, কেমন। মাঝে মাঝে ঘটছে মজার মজার ঘটনা, যেমন জনৈক নালিশকারী ঘুরিয়ে আমাদের শান্তনুকে বলেছে, " আপনি কে? কোথা থেকে বলছেন আগে বলুন। অফিসের ঠিকানা দিন। আমি গিয়ে কথা বলব।" আজ্ঞে তাই সই, বলে পথনির্দেশ দেওয়া হল। ভদ্রলোক এসে পৌঁছালেন যখন, সূর্য ডুবু ডুবু। ধোপদুরস্ত পোষাক-পরিচ্ছদ, পেশায় জানালেন শিক্ষক। শ্রম দপ্তর কি, কি কাজ করে ইত্যাদি আলোচনা অন্তে, অফিস পর্যবেক্ষণ পূর্বক, জহর বাবুর হাতের এক কাপ অমৃত চা সেবন করিয়া, মহাশয় জানাইলেন, "আসলে আমার কোন নালিশ নাই বুঝলেন। দেখছিলাম সত্যি নালিশ করলে কেউ শোনে কিনা।"


এ তো তাও ভালো, শুভদীপ্তকে তো একজন বেদম বকুনি দিল, " আবাস যোজনায় বাড়ি দিলেনি, এখন আবার ফোন করে আদিখ্যেতা করতে এয়েছো?' আবাস যোজনার কয়েক সহস্র যোজনের মধ্যেও পড়ে না শ্রম দপ্তর। তবুও নালিশের উপর জ্বলজ্বল করছে আমাদের দপ্তরের নাম। শুভদীপ্ত খানিক দম নিয়ে আবার প্রশ্ন করল, "BMSSY এর বই আছে আপনার? ওই যে ২৫ টাকার বই গুলো-।" ঘুরিয়ে জবাব এল, ' আমার কি আছে, না আছে, তা তোমাকে বলতে যাব কেন? জানো আমার খুড়শ্বশুরের পিসতুতো ভাইপো কে, জানো আমার মামাদাদু কোথায় চাকরি করেন?' আর কথা বাড়ানো সমীচীন বোধ করেনি, শুভদীপ্ত। 


একই কথা নন্দন শুনল বটে, তবে এক্ষেত্রে বাড়ি নয় হাগুখানা। হক বাবুকে একজন তো রীতিমত চমকালো, " নির্বাচনটা আসতে দিন।" সুরজিৎকে আবার উল্টো কথা শোনালো আর একজন, " না না, সরকারের বিরুদ্ধে আমার কোন নালিশ নেই। খুব ভালো কাজ করছে আমাদের সরকার।"  বেদজ্যোতিকে একজন বলল, "প্যানকার্ড পাইনি"। যোশুয়াকে একজন বলল," বউ পালিয়ে গেছে মূল্যবান ডকুমেন্ট নিয়ে। কি করা যায় বলুন দিকি?" কোলাঘাটের শান্তনু আর তমলুকের বিল্বমঙ্গল কে কারা যেন দুপুরের ঘুম ভাঙ্গিয়েছে বলে উদোম খিস্তি মারল। মনীষকে কে যেন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব শোনালো, "আমি করিনি সার। মা কালীর দিব্যি। বুইলেন কিনা, আমার অনেক শত্তুর আছে, তারাই কেউ করছে নির্ঘাত। আপনি একবার বলুন সার, আমি নিজে গিয়ে সই করে দুব যে আমার কোন নালিশ নেই।


এছাড়াও নালিশ পাওয়া গেল, "রাস্তা চাই", ডিজিটাল রেশন কার্ড, জমি বিবাদ সংক্রান্ত, চাকরি চাইলেন কেউ কেউ, পাড়ায় কেউ বিরক্ত করছে বলে নালিশ করেছেন কয়েকজন, এমনকি পঞ্চায়েত ভোটের টিকিট ও চাইলো জনা কয়েক। কথা বলতে গিয়ে বোঝাই যায়, অধিকাংশই সাদাসিদা গাঁয়ের মানুষ।


একদল ফোন করছে, একদল এন্ট্রি করছে, এক নজরে মনে হবে এটা যেন সরকারি অফিস নয়, কোন কল সেন্টার বুঝি। আর এই সমস্ত নালিশ সংক্রান্ত কাজের তদারকি করছে, আমাদের পাঁশকুড়া পুরসভার ইন্সপেক্টর শ্রী সঞ্জয় কুমার টুডু। এখন কথা হল, এতগুলো ছেলে যে বিভিন্ন ব্লক পুরসভা থেকে এসে এই কাজ করছে তাদের চাট্টি মুড়ি জলের ব্যবস্থা তো করা উচিত। মানছি ধারেনগদে চলে আমাদের,  কিন্তু মার্চ মাস বলে কথা, সেই বিলগুলি তো মেটাতে হবে এবার। জল মুড়ির টাকা দিবে কি মহানগর? 


যাকে প্রশ্নটা করলাম, তিনি এমন হাসলেন, হাসতে হাসতে গড়িয়েই পড়লেন। শেষে অতি কষ্টে হাসি থামিয়ে, চোখ মুছে, নাক ঝেড়ে, গলা খাঁকরে বললেন, " চাও না, চাও। নজির সৃষ্টি করো।" ধারের জ্বালা এবং নজির সৃষ্টি করার সুপ্ত বাসনা নিয়ে ফোন করলাম মহানগর তুতো এক দাদাকে। যাকে ফোনালাম, তিনি ছদ্ম মাতব্ব্বরীর ঢঙ্গে বললেন, " টাকা চাই? বেশ তো। একদিনের উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট প্রোগ্রাম নামিয়ে ফেল, কিছু টাকা পাবি।"


ও হরি! ওই প্রোগ্রাম তো আমি  স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নারী দিবসের পরের দিনই করে ফেলেছি। সেই যে তানিয়া দি এসে ক্লাস নিয়ে গেল, আবার কি করব? আর এই কর্মযজ্ঞে এই মুহূর্তে একটিও মেয়েকে জুড়িনি আমরা। এমনকি আমি নিজেও ফোন করিনি। একটাও না। চুঁচুড়ায় থাকতে একবার এই রকম ফোন করতে বাধ্য হয়েছিলাম, যা শিক্ষা হয়েছে, বাপরে! ফোনে অচেনা মেয়ের গলা শুনলেই, লোকজনের সব সমস্যা দূরীভূত হয়ে প্রবল প্রেমের উদ্রেক হয়। 


দাদা বললেন, "প্রোগ্রাম করেছিস, তাতে কি হয়েছে? আবার কর। তবে একটা কথা বলতো, তোকে এত দেরিতে টাকা দিলে তুই খরচা করতে পারবি তো? নাহলে কিন্তু মুখ পুড়বে।"  মুখে তো বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ তিরিশে দিলেও, একত্রিশে প্রোগ্রাম নামিয়ে দেব। কার্যক্ষেত্রে ব্যাপারটা অত সহজও ছিল না।


 প্রথমতঃ ডাকবো কাদের? আমাদের মেয়ে এসএলও এবং কালেক্টিং এজেন্টদের সাথে তো ইতিমধ্যেই করে নিয়েছি এই কর্মশালা। এমতবস্থায় চল্লিশ জন মহিলা পাই কোথায়? শুভাশিসই বুদ্ধি দিল, "ম্যাডাম বাথরুম সাফ করে যে দিদিগুলা, ওদের ডাকলে হয় না?" দারুণ প্রস্তাব, লুফে নিলাম এক কথায়। নেভি নীল পাড়ওয়ালা,সাদা সিনথেটিক শাড়ি পরিহিতা একদল অল্পবয়সী মেয়ে, ইদানিং কাজ করে এই কমপ্লেক্সে। ওরা ঝাঁট দেয়, বাথরুম সাফ করে। ওদের দয়াতেই নিশ্চিন্তে শৌচাগারে যেতে পারি আমরা। ওদের নিয়োগের পূর্বে শৌচাগার গুলির যে হাল ছিল, তা অকহতব্য। একবার গেলে দুঃস্বপ্ন আসতো অন্তত তিন দিন।


শুধু সুইপার দিদিদের দিয়ে হল ভরল না। পি ডব্লিউ ডির যে অধিকর্তা এই দিদিদের দেখভাল করেন, উনিই জোগাড় করে দিলেন অন্য একটি সেল্ফ হেল্প গ্রুপের মেয়েদের। এরাও পাশেই কাজ করে। ইতিপূর্বে এমন কর্মশালায় অংশ গ্রহণ করেনি কেউই। তাই সকলের উৎসাহ ছিল দেখার মত।অংশগ্রহণকারী তো পেলাম, এবার এদের শেখাবে পড়াবে কে? সময় বড় স্বল্প। সাম্মানিক বড়ই কম। আবার তানি দিকে ডাকলে, নির্ঘাত কান মূলে দেবে। আমার মতোই ব্যস্ত সেও এই মুহূর্তে, হয়তো আমার থেকেও বেশি।


জেলা আইনি পরিষেবা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হল। অতিমারি পূর্ববর্তী সময়ে, হুগলীতে, এনাদের সাথে বেশ সুসম্পর্ক ছিল আমাদের। সমস্ত অনুষ্ঠানে আমরা ডাকতাম ওনাদের আর ওঁরা ডাকতেন আমাদের। আইন নিয়ে কাজ করার অবসর এবং পরিসর এই মুহূর্তে আমাদের ক্রম সংকুচিত হলেও, ওনারা পূর্ণ বিক্রমে বিদ্যমান। মাননীয় সচীব মহাশয় রাজি হয়ে গেলেন এক কথাতেই। জানালেন চারটি আইন নিয়ে কথা বলবেন। খুব সহজ সরল ভাষায়। আইন গুলি হল-  কন্যা ভ্রুণ হত্যা আইন ১৯৯৪, যৌন অপরাধ থেকে শিশুদের সুরক্ষা আইন ২০১২, কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা প্রতিরোধ আইন ২০১৩ এবং গার্হস্থ হিংসা প্রতিরোধ আইন ২০০৫।


প্রথমার্ধ মিটলো, এবার দ্বিতীয়ার্ধের পালা।  দ্বিতীয়ার্ধে কাদের ডাকব, সেই নিয়ে ছিটেফোঁটাও সংশয় ছিল না আমার। শ্রীমতী অঞ্চিতা ঘটকের এনজিও পরিচিতির সাথে আমার আলাপ চন্দননগরের বড় সাহেবের সৌজন্যে। স্যারের উৎসাহে, গৃহ শ্রমিকদের নিয়ে একটা কর্মশালা করেছিলাম আমরা। সেখানেই অঞ্চিতা দি এবং পারমিতার সঙ্গে আলাপ। কথায় কথায় জানতে পারি, ওনারা জেন্ডার ইস্যু এবং জেন্ডার ভায়োলেন্স নিয়ে সিরিয়াস কাজকর্ম করেন। গার্হস্থ্য হিংসার শিকার মহিলাদের পাশে দাঁড়ান। অঞ্চিতাদির ভাষায়,“ যতক্ষণ মেয়েটি লড়বে, আমরা লড়ব। ”


কথাটা যে কতখানি সত্যি, প্রমাণ পেয়েছিলাম, যখন আমার প্রাক্তণ ড্রাইভারের গর্ভবতী স্ত্রীকে আড়ং ধোলাই দিয়েছিল তার মা-মাসি আর মাসতুতো ভাই। মেরেধরে, মাথার চুল খানিক খামচে ছিঁড়ে দিয়েছিল। তখন লকডাউন। সারা রাত শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে অশ্রুপাত করেছিল যুগলে। সকালে আমায় নিতে এসে খুলে বলে ছেলেটি। থানায় পাঠাই। সে অভিজ্ঞতা আর লিখছি না। কাজ তো হয় অষ্টরম্ভা। উল্টে মেয়েটিকে দুপুর বেলা একলা কোয়ার্টারে ডেকে পাঠায় মেজবাবু। আবার ছুটে আসে স্বামী স্ত্রী আমার কাছে। অসহায় হয়ে পরিচিতির শরণাপন্ন হই আমি। 


লক ডাউনের মধ্যেই ছুটে আসে কাকলী আর শুভ্রা। আগে কথা বলে যুগলের সাথে। কাউন্সেলিং করা হয় দুজনের। তারপর নিয়ে যাওয়া হয় থানায়। চাপ দেওয়া হয় এদিক,ওদিক,সেদিক দিয়ে। শেষ পর্যন্ত কেস নিতে বাধ্য হয় পুলিশ। ধাতানি দেওয়া হয় শাশুড়ী মাতা ইত্যাদিকে। পরিচিতির সহায়তায় পরিস্থিতির উন্নতি হবার পর যেটা হয়, তা হল বিস্তর কুম্ভীরাশ্রু সহ একরাশ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে, ছেলেটি আমার গাড়ি ছেড়ে অন্য অফিসারের গাড়ি ধরে নেয়। যেখানে গাড়ির টাকা আমাদের মত গোনাগুনতি নয়। মালিকের ভাষায়, তেল চুরির সুযোগ ও অঢেল। যাই হোক, সে অন্য গল্প। মেয়েটি যে সমস্যা মুক্ত হয়, সেটাই আসল। 


দ্বিতীয়ার্ধের জন্য তাই পারমিতার মাধ্যমে পরিচিতিকেই ধরলাম। সুদূর দক্ষিণ কলকাতা থেকে তমলুক এসে দুর্ধর্ষ সেশন নিয়ে গেল কাকলী আর শুভ্রা। দারুণ উপভোগ করল আমাদের মেয়েগুলো। অনুষ্ঠান শেষে সবাইকে দেওয়া হল একখান করে শংসা পত্র। আমার আর সৌম্যজিতের সই করা, পাতি কালার প্রিন্টারে প্রিন্ট করা, এক টুকরো মোটা কাগজ, যাতে লেখা শ্রীমতি অমুক, এই তারিখে, এই স্থানে, এই কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার ভবিষ্যতের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের জন্য আমাদের তরফ থেকে রইল এক চুপড়ি শুভেচ্ছা। 


 শংসাপত্র দেবার সময় জানতাম না যে, এমন গোল বাঁধবে। আজ বিকালে হঠাৎ ধরলেন জহর বাবু, "ম্যাডাম, আমাকেও ওরকম একটা শংসাপত্র দ্যান"। ইতিমধ্যে কেটে গেছে দিন দুয়েক, আর পাঁচটা কাজে, মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে কিসের শংসাপত্র। অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, 'কি চাইছেন? বুঝলাম না।' উনি বললেন, " ওই যে, পুতুল মনিকে যেরম দিইছেন।"  জহর বাবুর পুতুল মনি হল আমাদের সুইপার মাসি। পাকেচক্রে তিনিও ওই কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন বটে এবং আর অন্যান্যদের সাথে সাথে তার ভাগ্যেও একটি শংসাপত্র জুটেছে। সেটা নিয়ে মাসি চুপচাপ কেটে পড়লে কোন সমস্যা হত না। কিন্তু তিনি সেইটি জহর বাবুকে দেখিয়েই বিপদ ডেকে এনেছেন। অন্যের দেখে ছোট্ট বাচ্চারা যেমন বল বা খেলনার বায়না করে, ঠিক তেমনি একখানি শংসাপত্রের বায়না জুড়েছেন জহর বাবু। যত বোঝাই ওটা একটা পাতি কাগজ বই কিছু না। কিন্তু জহর বাবুর বক্তব্য হল যেহেতু আমার সই করা কাগজ নিশ্চয়ই ওইটা দিয়ে বিরাট কিছু আদায় করতে পারবে মাসি। তাই ওনারও ঐটি চাই। কি জ্বালায় যে পড়েছি। ভাবছি একখানা শংসাপত্র লিখেই ফেলব বুড়ার জন্য। কি লিখবো সেটা অবশ্য ভাবার বিষয়। এত খেয়াল রাখে বৃদ্ধ আমার, অফিসে ঢোকার সাথে সাথেই গুড মর্নিং সম্ভাষণপূর্বক দরজা খুলে দেয়, দরজা ভেজিয়ে দেয়, জানলা খুলে/ বন্ধ করে দেয়, পর্দা সরিয়ে/টেনে দেয়, আলো জ্বালিয়ে দেয়, পাখা চালিয়ে দেয়, আবার না বলতেই এসে পাখার স্পিড বাড়িয়ে বা কমিয়ে দিয়ে যায়, বাতানুকূল যন্ত্রের সুইচ অন করে, রিমোট খানা হাতের কাছে দিয়ে যায়, না বলতেই চায়ের কাপ এনে ধরে মুখের কাছে, দশবার খোঁজ নেয় টিফিন খেয়েছি কিনা। এহেন বৃদ্ধের শংসাপত্র কি অমন হুট কথায় লেখা যায়? সময় লাগবে নি? সে কথাই বললাম জহর বাবুকে, একটু ভাবতে তো দিবেন। দাঁড়ান ভাবি, তারপরে জম্পেশ করে লিখব খন আপনার প্রশংসা পত্র। যাই বলুন না কেন, মেয়েদের যেমন empowerment লাগে পুরুষদেরও তেমনি pampering লাগে মশাই। ওরা স্বীকার করে না বা মুখ ফুটে বলতে পারে না, তাই বলে কি আমরা বুঝি না?

Sunday, 26 March 2023

অনির ডায়েরি ২৫শে মার্চ, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 


শনিবারের সন্ধ্যা, জোর করে পড়তে বসেছি তুত্তুরী আর আমি। কে যে কাকে পড়াচ্ছে, বোঝা দায় যদিও। শৌভিক এখনও বাড়ি ফেরেনি। তমলুকে মিটিং ছিল। মিটিং এর মাঝে, ঘন্টায় ঘন্টায় তো আর ফোন করে জ্বালাতে পারি না, তাই মহকুমা শাসকের ড্রাইভার নূপুর বাবুকে ফোন করেছিলাম, "স্যার বেরিয়েছেন" কি না জানতে। তিনিও ধরেননি, পরে জানতে পারলাম, ধরবেন কি করে, তিনি তো ফোনটা বাংলোতেই ফেলে গেছেন।


ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষী ছেলেটির নম্বর নেব নেব করেও আর নেওয়া হয়নি। ফলে whatsapp ই ভরসা। অফিশিয়াল নম্বরে আবার, ' বেরিয়েছ ' বা ' ওগো ফেরার সময় এক কিলো চিনি আর আড়াইশো পেঁয়াজ এনো তো' মার্কা বার্তা পাঠালে,  খেপে ব্যোম হয়ে যায় শৌভিক। ব্যক্তিগত নম্বরে যে পাঠাব, সেটা আবার দিনে বার চারেকের বেশি দেখেন না তিনি। "বেরোলি? তুই এলে কফি খাবো " মেসেজটা বিগত দুই ঘন্টায় বার দুয়েক করে ফেলেছি। জবাব আসেনি। ভাবছি কি করব, ফোন করব কি না, এমন সময় বাংলোর নিরাপত্তা রক্ষী ভদ্রলোক এসে এক গাল হেসে, বার পাঁচেক মাথা চুলকে আর হাত কচলে বললেন, " ম্যাডাম এক ভদ্রলোক এসেছেন। বলছেন, উনি আগে এখানে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। স্যারের সাথে কি দরকার-"। 


কেজো সুরে জানালাম, স্যার তো নেই। কখন ফিরবে জানিনা। উনি হাত কচলে বললেন, ' আজ্ঞে ম্যাডাম, বলছিলাম- উনি বললেন, উনি আপনার সঙ্গে দুই মিনিট কথা বলতে চান।' কি সাংঘাতিক!  এই শনিবার ভর সন্ধ্যায়, কোথাকার কে অজানা লোক, আমার সাথে কথা বলতে বাংলোয় চলে এসেছে? তমলুকে থাকতে এই এক জ্বালা ছিল, রাজ্যের লোক প্রথম প্রথম আমায় এসে ধরত, "আপনি একবার বললেই এসডিও সাহেব করে দিবেন/ ছেড়ে দিবেন।" কিছুতেই বোঝাতে পারতাম না যে, ওভাবে হয় না। সহবাস করলেও, পেশাগত ভাবে দুজন দুটো আলাদা জগতের বাসিন্দা।


আমার অফিসের ব্যাপারে যেমন আমি শৌভিককে নাক গলাতে দিই না। তেমনি ওর অফিসেরও কোন কিছু আমি জানতে চাই না। অফিসটাকে আমরা বাংলোর বাইরেই রাখতে সচ্ছন্দ বোধ করি। তাই বলে কি দপ্তরী কেচ্ছা করি না আমরা? কোন সমস্যা হলে, একে অপরের মতামত চাইনা আমরা?  অবশ্যই চাই। কিন্তু ওইটুকুই। বরের কাজে মাতব্বরি করা আমার দুচক্ষের বিষ। ফেসবুকে ডায়েরি লেখা ছাড়া, এমনকি অপরিচিত বা অর্ধপরিচিত লোকজনের কাছে নিজেদের পেশাগত পরিচয় দিতেও স্বচ্ছন্দ বোধ করি না আমি। আমি অনিন্দিতা আর ও শৌভিক এই পরিচয়টুকুই তো যথেষ্ট।


সন্দিগ্ধ স্বরে জানতে চাইলাম, 'আপনি ওনাকে চেনেন?' উনি দুদিকে ঘাড় নাড়লেন। সন্ধ্যেবেলা পাকশালা সামলায় যে ছেলেটি, সেও জানালো, চেনা তো দূর, নামই শোনেনি কোনদিন। তাহলে?  বললাম, বলুন স্যার এলে আসতে। না হলে সোমবার অফিস টাইমে স্যারের সাথে যোগাযোগ করতে।


ওরা দুজনে তাই বলতে গেল, আমি ফোন করলাম শৌভিককে। ঘড়িতে রাত পৌনে আটটা, এতক্ষণে যদি মিটিং নাও ভেঙ্গে থাকে একটা ফোনতো করা/ধরাই যায়। ফোন করতেই শৌভিক বললো, " এই বেরোলাম। ফোন করতেই যাচ্ছিলাম।"  জানালাম নূতন অতিথির কথা। ব্যাপারটা বেশ ভয়ের যাই বলেন, আমার বরটা তো বিশেষ সুবিধের নয়। বরং বেশ ট্যাড়া। এদিক ওদিক তাকায় না, সোজা ব্যাটে খেলে। শত্রুও বেশ কিছু বানিয়েছে। কারা যেন হুমকি-টুমকি ও দিয়েছে, কত বড় এসডিও হয়েছে দেখে নেবে। সে সব গল্প শৌভিক ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেও, আমার অত দুঃসাহস নেই। 


ভেবেছিলাম উপহাস করবে বুঝি, শৌভিক হাসল না। ক্লান্ত স্বরে বলল, ' ভদ্রলোক বোধ হয় রিটায়ার্ড আইএএস অফিসার। হলদিয়ার এসডিও ছিলেন বোধহয়। আমার কাছেও এসেছিলেন। খুব গুছিয়ে কিছু বলতে পারছিলেন না, কথাবার্তা বেশ অসংলগ্ন মনে হয়েছিল স্বল্প পরিসরে। ভয় করলে দেখা করতে হবে না।' 


অবসরপ্রাপ্ত আমলা মানে তো, আমার শ্বশুরমশাইয়ের বর্তমান আর আমাদের ভবিষ্যৎ। কেমন লাগবে যদি ওনাকে এমনি করে বাংলোর বাইরে থেকে ভাগিয়ে দেয় বর্তমান কোন আমলার গৃহিনী। ফোনটা রেখে বাগানে বেরিয়ে দেখি গেটের কাছে কার সাথে যেন কথা বলছেন সিকিউরিটি। জিজ্ঞাসা করলাম ভদ্রলোক চলে গেছেন নাকি? জবাব দিলেন," না ম্যাডাম। স্যারের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটা চাইছেন।" দৌড়ে গেলাম গেটের কাছে,  এক বয়স্ক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে ইস্ত্রি বিহীন ফুলহাতা শার্ট আর প্যান্ট। এক মাথা অবিন্যস্ত কাঁচা পাকা চুল। থতমত খাওয়া হাবভাব।


করজোড়ে নমস্কার জানিয়ে বললাম, " মার্জনা করবেন স্যার। আসলে আমি ঠিক আপনাকে চিনতে পারিনি। এসডিও সাহেব বললেন আপনি আগেও এসেছিলেন। ভিতরে আসুন প্লিজ।"


 উনি বললেন, ' আপনি আমার মেয়ের মতন। আমার মেয়েও আপনার বয়সীই হবে বুঝলেন। একটু নম্বরটা যদি-।' বললাম, নম্বর বলছি সেভ করে নিন। উনি নার্ভাস হয়ে সব পকেট হাতড়ে, মোবাইল ফোন খুঁজে না পেয়ে, বললেন, " আমি চোখে তেমন দেখতে পাই না বুঝলেন তো। একটু যদি কাগজে -'। 


ভিতরে এনে বসালাম, পাকশালার ছেলেটিকে বললাম, এক কাপ ভালো করে চা করে আনুন তো। সে উল্টে একটা মিষ্টির প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললে, " স্যার এনেছেন।" কি দরকার ছিল বলতে গিয়েও গিলে ফেললাম। ওই প্রজন্মকে বোঝা আমাদের সাধ্যাতীত। ভদ্রলোক নার্ভাস ভাবে হেসে, হালকা জড়ানো স্বরে বললেন, " আমার সুগার আছে তো, তাই সুগার ফ্রী মিষ্টি এনেছি।"


ডায়েরির পাতা ছিড়ে বড় বড় করে মহকুমা শাসকের নম্বরটা লিখে দিলাম। উনি গুরুত্বহীন ভাবে, ভাঁজ করে, পকেটে পুরে গল্প করতে লাগলেন। বললেন ওনার বয়স ৭৯ বছর। উনি কাঁথির ভূমিপুত্র। সংস্কৃতের ছাত্র। সংস্কৃতে কাব্যতীর্থ। ওনার স্ত্রীও সংস্কৃতে এমএ এবং তিনিও কাব্যতীর্থ। স্ত্রী বিগত সাত বছর ধরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত। বিছানাটাই তার ঘরবাড়ি। শোনালেন, " রান্নার লোক আছে। সে মাসে ১০ হাজার টাকা বেতন নেয়। স্ত্রীর দেখাশোনা করার জন্য, আয়া আছে। সে নেয় মাসে ১৫ হাজার। যে জামাকাপড় কাচে, সে নেয় ২০০০ টাকা। এছাড়াও  বাজার- মাছ যা লাগে, ফোন করে বললেই দিয়ে যায়।" বললেন, "চোখে তেমন দেখতে পাই না তো, তাই একটা টোটো রেখেছি। তাকে ফোন করে বললে, সেই এদিক ওদিক নিয়ে যায়।"


পক্ষাঘাতের অংশটুকু বাদ দিলে বাকি ওই বয়সী সব দম্পতিদের একই গল্প। জানতে চাইলাম সন্তানাদির কথা। বললেন একটি কন্যা সন্তান। তিনি কোন নামী স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। জামাতাও পেশায় শিক্ষক। বললেন মেয়ে আগে ওঁদের সাথেই থাকত। বর্তমানে কর্মসূত্রে এই জেলারই অন্য শহরের বাসিন্দা।


এই জেলার জনৈক নামী নেতার নাম করে বললেন, ও আমার সম্বন্ধী। বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলাম, উনি আপনার শ্যালিকাকে বিবাহ করেছেন? ভদ্রলোক হেসে কইলেন, " নানা আমি ওর বোনকে বিয়ে করিছি।"বললেন, " জানেন ও  আমার সম্বন্ধী বলে, আমাকে হলদিয়া থেকে সরিয়ে দেয় তৎকালীন সরকার। অফিসে ভাঙচুরও করে অমুক-"। ভাঙচুর যিনি করেছিলেন, তিনি এককালে দুই মেদিনীপুরের ত্রাস ছিলেন। বর্তমানে অবশ্য সবটুকুই অতীত বা ভূত।


ভদ্রলোকের কথাবার্তা বেশ অসংলগ্ন। হুট করে কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছেন বোঝা দায়। এই আসানসোলে বিডিওগিরি করছেন, তো এই গেলেন ডায়মন্ড হারবারে। অনেক বড় বড় অফিসারের নাম করলেন, যাদের সঙ্গে উনি এককালে কাজ করেছেন। কাউকেই তেমন চিনতে পারলাম না, একজন ছাড়া। ভদ্রলোক এককালে লেবার কমিশনার ছিলেন। আমরা যখন চাকরিতে ঢুকি, উনি তখন আমাদের দপ্তরের মুখ্য সচীব। একজনকে অন্তত চিনতে পারার সাথে সাথেই, এনার মুখে জ্বলে উঠল হাজার ওয়াটের আলো।


বললেন আসানসোলে থাকতে থাকতেই দুষ্কৃতিদের ছোঁড়া বোমার স্প্লিন্টার লেগে ক্ষতিগ্রস্ত হয় চোখ।  "এখন তো আরোই কম দেখি, তোমাকে সরি আপনাকে যেমন একদম ঝাপসা দেখছি। শুধু অবয়বটাই যা, বুঝতে পারছি। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি জানো/জানেন, ঠিক হয়নি। উত্তরোত্তর বিগড়েছে।" 


কথা ঘোরাতে প্রশ্ন করলাম হলদিয়ার এসডিও থেকে কোথায় গেলেন? উত্তর দিলেন, " আর বলবেন না। সেই কুচবিহার এডিএম অর্ডার হল। আমি যাইনি। পরিবারকে ফেলে অতদূর যাবার মতন অবস্থা তখন ছিল না। তখন দিল কলকাতায়, কম্পালসারি ওয়েটিং এ। রাইটার্স বিল্ডিংয়ে এমন একটা ঘর দিল, যেখানে একটা পাখা পর্যন্ত ছিল না। এদিকে হাজিরা নিয়ে কি কড়াকড়ি। একটা মেস বাড়িতে থাকতাম আরো বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। সে এক অভিজ্ঞতা- " 


মেস বাড়ির অভিজ্ঞতার মাঝখানে, ফোন করলো শৌভিক, জানতে চাইলো কি অবস্থা?  বললাম চায়ে পে চর্চা করছি আমরা। শৌভিক ভুল বুঝেছিল, উনি আইএএস ছিলেন না বটে, তবে উনি রাজ্য সিভিল সার্ভিসে আমার শ্বশুরমশাইয়ের ব্যাচমেট। ১৯৭৮ এর স্পেশাল ব্যাচ এতটাই বড় ছিল, যে আমার শ্বশুরমশাইয়ের নাম করতে গিয়েও আর করলাম না।  এই মুহূর্তে এনার স্মৃতিশক্তি বা মনোযোগ কোনটাই তেমন প্রবল নয়। দু একটি কথা বলতে গিয়ে দেখলাম, ইনি শোনার থেকে শোনানোতে বেশি উৎসাহী। এটাই হয়তো বয়স বাড়ার লক্ষণ। নিজের মধ্যেও এই লক্ষণের পূর্বাভাস পাই আজকাল। সাগ্রহে শুনতে লাগলাম ওনার গল্প।


রাইটার্স থেকে অবশ্য আবার এডিএম হয়ে ফেরত আসেন তমলুক। তখনও অবিভক্ত মেদিনীপুর। ২০০৪ সালে ভদ্রলোক অবসর নিতে নিতে, এসে পৌঁছায় শৌভিক। দেখলাম ভদ্রলোক যাকে না পেয়ে, তার সহধর্মিনীর সাথে দেখা করতে উদগ্রীব ছিলেন, গল্পের ঝোঁকে বিস্মিত হয়েছেন তার সাথে সাক্ষাতের কারণ। এমন কি শৌভিকের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করার পরেও, মনে পড়ল না। ভদ্রলোক এমন ভাবে মাথা চুলকাচ্ছিলেন, মায়া লাগছিল রীতিমত। শৌভিক বলল, " বাড়ি ফিরবেন তো? আমার গাড়িটা তো ফিরছেই, আপনাকে নামিয়ে দিয়ে যাবে।" 


ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন, একটা নোংরা রুমাল বার করে মুখটা মুছলেন, তারপর লাজুকভাবে এক গাল হেসে বললেন, " বাড়ি না ক্লাবে যাব। বাড়িতে বিড়ি সিগারেট ফুঁকতে দেয় না বউ। অশান্তি করে শুয়ে শুয়েই। তাই ক্লাবে যাই, বিড়ি না ফুঁকলে আবার পেট সাফ হয় না কিনা।" আসি, তাহলে,  বলে অনুমতি দিলেন ভদ্রলোক। আমরাও বললাম সাবধানে যাবেন। ভালো থাকবেন।  দুটো সিঁড়ি ভেঙে নামতেই যে হারে থরথর করে কাঁপছিলেন ভদ্রলোক, এ বুড়া কিভাবে যে রাতের বেলা একা বাড়ি ফিরবে কে জানে? ফোনটাও তো সঙ্গে করে আনেন নি। ওই ব্যাচের সিভিল সার্ভেন্টদের পেনশন কত, আমাদের থেকে ভালো কেউ জানে না। ভদ্রলোক আবার শ্বশুরমশাইয়ের বছর পাঁচেক আগেই অবসর নিয়েছিলেন। ফলে কি পান সহজেই অনুমেয়। পেনশনারদের তো আর ইনক্রিমেন্ট হয় না, DA টুকুই ভরসা। সে প্রসঙ্গে আর মুখ না খোলাই ভালো। ওষুধ,পথ্য, ডাক্তার, আয়া, বাজারদর কেউ তো আর বয়স দেখে রেয়াত করে না। ফলে কমাতেই হয় জীবনধারণের মান। 


সময় কাউকেই রেয়াত করে না, আজ আপনি যতই দোর্দণ্ডপ্রতাপ হোন না কেন, হাতে মুণ্ড কাটুন না কেন, কালকে আপনার গল্পটাও আর পাঁচজনের মতোই হবে। তাও যে কেন ভুলে যাই আমরা, মত্ত হয়ে পড়ি অর্থ, পদ আর শক্তির আস্ফালনে। ভুলে যাই, কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না শেষ কালে। শেষ অঙ্কে সবাই সমান।

অনির ডায়েরী ২৪ শে মার্চ ,২০২৩

 

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 

"আমার নতুন PT ড্রেস লাগবে, বাবা," কোন একদিন বলেছিল তুত্তুরী। তখন সদ্য শেষ হয়েছে বার্ষিক পরীক্ষা, স্কুল বন্ধ। শৌভিক উড়িয়েই দিল দাবিটা, "আগে পাশ কর, নতুন ক্লাসে ওঠ, তবে না পিটি ড্রেস।"


মেনে নিল, বেশ কিছুদিন নির্বাক রইল তুত্তুরী। কাউকে আর কিছু বলল না, তারপর এল সেই দিন, পরীক্ষার ফলাফল ঘোষিত হলো এবং আমাদের যাবতীয় আশঙ্কা সমূলে বিনষ্ট করে দেখা গেল, সসম্মানেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন শ্রীমতী তুত্তুরী।  অতঃপর তিনি পুনরায় দাবি তুললেন, " মা, এবার আমায় পিটি ড্রেস কিনে দাও।"


এবার আমার জবাব দেবার পালা। বললাম, " আগে স্কুল খুলুক গিয়ে দেখ কি বলে, তবে না-। গিয়ে হয়তো দেখলি, যে পিটি ড্রেস আবার বদলে গেছে। অথবা একদমই বদলায়নি, গত ক্লাসেরটাই আবার পরতে বলছে। তাই না, হতে পারে তো-"।


স্কুল খুলল কোন এক বৃহস্পতিবার এবং যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই ঘনিয়ে এলো সন্ধ্যা। নতুন রুটিন অনুযায়ী দেখা গেল, শুক্রবারই PT ক্লাশ পড়েছে। অফিস থেকে ফিরে দেখি মেয়ের মুখে জমেছে বাদল। ড্রেস ওই একই আছে এবং সবাই তা পরেছিল। "সবাই আমাকে দেখে হাসছিল। বলল তোর ড্রেস কই?  সবাই সালোয়ার পরে কি সুন্দর দৌড়াদৌড়ি করল, আর আমায় স্কার্ট পরে ওদের পিছন পিছন ছুটতে হলো"- স্ফুরিত অধরে, জানালেন শ্রীমতী তুত্তুরী।


তাজ্জব হয়ে জানতে চাইলাম, তা তুই খামোকা স্কার্ট পরলি কেন? আগের বছরের পিটি ড্রেস দুটো তো নতুনই আছে। যাঁরা জানেন না তাঁদের অবগতির জন্য বলি, বিগত বৎসরে দুবার স্কুল বদল হয়েছে শ্রীমতী তুত্তুরীর। একবার এপ্রিল মাসে মহানগর থেকে তাম্রলিপ্ত‌। আর একবার মধ্য নভেম্বরে তাম্রলিপ্ত থেকে কাঁথি। তাম্রলিপ্ত স্কুলেরটা পরতে বলছি না, কিন্তু এই স্কুলেরটা তো পরতেই পারতিস।


বাবাও সম্মতি দিল পাশ থেকে,'এক্কেবারে ভোম্বল।' শ্রীমতী তুত্তুরী চোখ বড় বড় করে বললেন, "এই না না। একদম নয়, হয় নতুন পিটি ড্রেস নয়তো নরমাল স্কুল ইউনিফর্ম, না হলে ঢুকতেই দেবে না-'।  অতঃপর বাবার কানে সুড়সুড়ি দিতে দিতে, গদগদ কণ্ঠে কইলেন, " বা-আ-বা-আ, PT ড্রেস কিনে দাও না, বাবা।" সুড়সুড়ির আমেজে চোখ বন্ধ করে, ইশারায় মাথাটা দেখিয়ে, ওখানে বিলি কাটতে বলে, বাবা বললেন, " হ্যাঁ, দেবো তো। মা কিনে দেবে।"


ছাই ফেলতে ভাঙ্গা কুলো আমি, সোমবার কাক ভোরে মেয়েকে স্কুলে ছাড়তে গিয়ে, স্কুলের উল্টোদিকের সদা হাস্যময়ী সেলাই মাসিকে বলে এলাম, " ও দিদি, মেয়ের পিটি ড্রেস লাগবে যে। আসছে শুক্রবারের মধ্যে দিতে পারবেন? না হলে আবার স্কুল কামাই করতে হবে মেয়েকে।"  মাসি এক গাল হেসে বাড়ি পাঠালেন।


প্রতিশ্রুতি মোতাবেক বুধবারের মধ্যেই নূপুর বাবু (মহকুমা শাসকের ড্রাইভার) গিয়ে নিয়ে এলেন নতুন জামা। বিলটা দেখেই বুঝলাম, যে কেন বাবা বলেছিল, ওটা মা দেবে। যাই হোক, ভাবলাম পকেটে আগুন লাগলো বটে, ঝামেলাটা অন্তত মিটলো। হরি হরি! বাড়ি ঢুকতেই লাফাতে লাফাতে এগিয়ে এলেন শ্রীমতী তুত্তুরী, " মা তোমার হলুদ ওড়না আছে?"


ঋণাত্মক জবাব পেয়ে ঘাবড়ে গেলেন তিনি। ভীত সন্ত্রস্ত স্বরে জানতে চাইলেন, "তাহলে  কি হবে মা? ওড়না ছাড়া তো ঢুকতে দেবে না। তুমি আমায় একটা হলুদ ওড়না কিনে দাও-"। ভাবলাম বলি, ওটা বাবা দেবে। বললাম না কারণ জানি, বিস্তর ফাইল চালাচালির পরেও ওটা আমারই ঘাড়ে চাপাবে শৌভিক। অতি কষ্টে ও ব্যাটাকে ওড়না এবং হলুদ রং যদিও বা বোঝাতে পারি, দোকানের  হাল হকিকৎ বোঝাতে আমার জান বেরিয়ে যাবে। 


সত্যি কথা বলতে কি, কোন দোকানে পাওয়া যায়, এই শহরে, তা তো আমি নিজেই জানিনা। ভাগ্যে বন্ধুদের থেকে দোকানের নামটা জেনে এসেছিল তুত্তুরী।  কাঁথি শহরের জমজমাট বাজারের মধ্যে,বেশ নামী এবং বড় দোকান। আসন্ন চৈত্র সেলের বিস্তর ভিড় আর টোটোওয়ালাদের সাথে রীতিমতো মল্লযুদ্ধ করে, বিগত বছরের PT ইউনিফর্ম (হাউস) রং মিলিয়ে যখন কিনে নিয়ে এলাম হলুদ ওড়না, আক্ষরিক অর্থেই শ্রীমতী তুত্তুরীর তখন খুশির সীমা নাই। কেবল বাবাকে বা মাসিকে দেখিয়ে স্বাদ মিটলো না, উল্লাসের চোটে হাওড়ায় ফোন করে দাদু দিদাকেও সবিস্তারে শোনালো সব গল্প।


আজ সকালেও প্রত্যক্ষ করলাম তার অপরিসীম আনন্দ। সময়ের বেশ খানিক আগে উঠে পড়ে,  তৈরি হয়ে নিয়েছেন একা একাই। সুপ্ত বাপকে ঠেলে তুলে আহ্লাদী হয়ে দেখালেন, "  বাবা, বাবা। দেখো বাবা আমায় নতুন PT ড্রেস।" বাপ মেয়েতে যখন এই নিয়ে খুনসুটি আর আহ্লাদ করছে, আমার মনে পড়ছিল প্রায় এক যুগ আগে, এক বৃদ্ধের উপদেশ-। 


তখন তুত্তুরী আড়াই বা তিন মাসের ছোট্ট বেবি। কন্যা সমেত আমি তখনও পিত্রালয়ে বসবাস করি। সপ্তাহান্তে শ্বশুরমশাই স্বয়ং এসেছেন পুত্রবধূ আর নাতনিকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। শৌভিক তখন খড়গপুর ২ নম্বর ব্লকের বিডি ও। বাড়ি ফিরছে সেও। দীর্ঘদিন বাদে একত্রিত হতে চলেছে গোটা ভট্টাচার্য পরিবার। গিরিশ পার্ক ফ্লাইওভার তখনও কিছু গর্ত আর লোহার ছড়ের সমষ্টি। তাও প্রবল ট্রাফিক জ্যামে অচল গণেশ টকিজের মোড়। জানলা দিয়ে বাইরের বড় বড় বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং দেখছিলাম আমি, দাদুর কোলে অকাতরে ঘুমাচ্ছে সেদিনের ছোট্ট তুত্তুরী ।বেবি পাউডারে প্রায় সাদা, কপালে কাজলের ধ্যাবড়া টিপ।


নিদ্রিত নাতনির পায়ের আঙুল টেনেটেনে খেলা করছিলেন শ্বশুরমশাই।আচমকা বললেন, " তোমায় একটা কথা বলব, দুঃখ পেয়ো না। এ যা চাইবে সঙ্গে সঙ্গে দেবে না।" অতঃপর একটু থেমে, একটু হেসে বললেন, "সামান্য হলেও অভাব বোধ থাকাটা বড্ড দরকার। না হলে ভালো মানুষ হওয়া যায় না।"


বৃদ্ধের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মানি আমরা।  মুখ খুলতেই কক্ষনো কিছু পেয়ে যায় না শ্রীমতী তুত্তুরী। মাসকাবার কাকে বলে তাও জানে এবং বোঝে তুত্তুরী। কোন জিনিস চেয়ে ফেলেও, দাম দেখে পিছিয়ে যায় তুত্তুরী। আশার বাইরে সামান্য কিছু পেয়ে গেলে এত্ত, এত্ত খুশি হয় তুত্তুরী। সময় বড় নির্দয়। বাবার শেখানো নেতির নেতিকরণ তত্ত্ব অনুসারে, আজ যা স্বাভাবিক, কাল তাই অস্বাভাবিক। আজ যা সাদা, কাল তাই ঘোর মসীবর্ণ। সময়ের অমোঘ নিয়মে বদলে যাবেন হয়তো ইনিও, না বদলে যাওয়াটাই অস্বাভাবিক। আজকের সবটুকুই থেকে যাবে স্মৃতিতে। তবুও এই সান্তনা টুকু তো থেকে যাবে, যে আমরা চেষ্টা করেছিলাম।

অনির ডাইরি ২৩ শে মার্চ, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি 


জীবনে দুঃখের কি আর শেষ আছে বাপু। শুনতে আপনার দুঃখ বিলাস মনে হবে হয়তো, কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার সবথেকে বড় এবং চিরকালীন দুঃখ হল ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠা। রাতের বেলা যত তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়ি না কেন, হতভাগা ঘুম কিছুতে আসতে চায় না। মাথার মধ্যে গজগজ করে, না জানি কত কিছুই। মস্তিষ্ককে বেশ দু চার ঘা বেত্রাঘাত পূর্বক, মাত্রাতিরিক্ত সাধ্য সাধনা করে ডেকে আনতে হয় নিদ্রাদেবীকে। রাত্রিবাস করার পর, তাঁরই এমন সোহাগ উথলে ওঠে অধমের প্রতি, যে তিনি আর আমার ঘাড় থেকে নামতেই চান না।


দুঃখ হয়, খুব দুঃখ হয়, জাস্ট কান্না পায় অফিস টাইমে অফিস বেরোতে। বিশেষতঃ যখন ভোরের রোদ ঝলমলে আকাশটা আচমকাই ভার করে ফেলে মুখ। কে জানে কার ওপর অভিমানে ছলছলিয়ে ওঠে তার আঁখি। চৈতালি বৃষ্টিতে যখন কাকস্নান করে, জানলার বাইরের ইউক্যালিপটাস আর আকাশমনি গাছ গুলো, ভিজে চুপচুপে হয়ে যায় ঝগড়ুটে ছাতারে আর মেহনতী কাঠঠোকরার পাল, তখন কেবলই মনে হয়, "এমন দিনে তারে বলা যায়"।  চন্দ্রবিন্দুর জুজু গানের সুরে বলতেই তো পারি,  "মার্জনা করবেন স্যার, আজ আর আসছি না।" 


বেইমান আকাশ, অভিমান ভুলে খিলখিলিয়ে ওঠে একটু পরেই, ঝলমলিয়ে ওঠেন সূর্যি দেব। পরমেশ্বরের কাছে ঝুড়ি ঝুড়ি অভিযোগ আর হ্যাংলার মত প্রার্থনা করতে করতে আপিস বেরোই আমি। হে ভগবান, আজ একটা ভালো বাস পাইয়ে দিও কিন্তু। বাসে উঠেই যেন একখান সিট পাই। দীর্ঘ দুই, পৌনে দুই ঘন্টার বাস যাত্রা দাঁড়িয়ে করতে আমি অসমর্থ। ‘সিট হয়ে যাবে, উঠে আসুন না’ মার্কা গুলগল্পে বিশ্বাস করতে আমি নারাজ। দূরপাল্লার বাসে, পরের স্টপে সিট হয়ে যাবে মানে খুব কম করেও পনেরো-বিশ মিনিটের গল্প। 


শুধু কি তাই, হে ভগবান ভাড়া যেন ঠিকঠাক নেয় প্রভু। দীঘা অভিমুখী বা ফিরতি পর্যটকদের ওপর নির্ভর করে প্রাত্যহিক ভাড়া। কলকাতার লোক নাই, তো ভাড়া পঞ্চাশ/ষাট। তিনটে সিট বুক করে, জড়াজড়ি করে অর্ধ শায়িত হয়ে মহানগর ফিরতি কপোতকপোতী দর্শনের মতলব হল আমাদের সিটও নেই আর আমাদের ভাড়াও বেড়ে একশ। দাঁড়ান আরো আছে, হে ভগবান তোমার পায়ে পড়ি আমাকে বাদশা, টনি কক্কর এণ্ড পার্টির হাত থেকে বাঁচিও। 


দূর পাল্লার এসি বাস হলে যেমন সিনেমা চলে, নন এসি বাস হলে তেমনি বাজে গান। যেমন তাদের সুর, তেমনি কথা। গতকালের গান গুলো এখনও আমার কানে ভাসছে- ‘শি ডোন্ট নো, শি ডোন্ট নো-’, ‘ইউ ডার্টি, ডার্টি গাল, তু প্যার করে ইয়া ধোঁকা’, ‘থ্রি সিক্সটি পে কমর ঘুমা-’ ইত্যাদি। শুধু গানে রক্ষে নেই, একদম সামনের ছোট টিভিতে কারা আবার নাচেও। চোখ জুড়ানো লোকেশনে, মূল্যবান ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক, হাতে বিদেশী ইয়ের বোতল নিয়ে একদল নারীপুরুষের সে কি উদ্দাম নাচ। ভয়ে চশমা খুলে বসে থাকি আমি। হতে পারে ঐ নাচগানের সৌজন্যেই, ঘুম আসে না রাতে। 


কি ভাবলেন, দুঃখ বা প্রার্থনা শেষ? দাঁড়ান মশাই, আরো আছে। হে ভগবান, বাসটা যেন ঠিকঠাক যায় প্রভু। আপদ বাস একই সময় ছেড়ে কোনদিন পুচ্ছ তুলে দৌড়ে চলে আসে তো কোনদিন তার গেঁটে বাত হয়। হয় এসে দেখি, সবে জহর বাবুর সঙ্গে ঝগড়া লাগিয়েছে সুইপার মাসি। এক প্রস্থ ঝগড়ার পর, ডাস্টবিন খালি করবে মাসি, তারপর ঝাঁট পড়বে, তারপর মোছা। 'তুমি আজ এত সকালে কেন' বলে হুংকার ছাড়ে মাসি। নয় তো দেখি, সব কাজ সেরে, জহর বাবুর এন্ড পার্টির সঙ্গে বেশ খানিকক্ষণ খোশ গল্প করে, বস্তা বগলে বাড়ি ফিরছে মাসি। ফেরার পথে আমাকে আওয়াজ দিয়ে যায় " এই যে, তোমার আজ এত দেরি কেন?"


এর পরেও থাকে নানা খুচখাচ দুঃখ এবং আব্দার, যেমন হে ভগবান যাওয়া এবং আসাটা যেন নির্বিঘ্নে হয়। এ পথে, পথ দুর্ঘটনা আকছার ঘটে। পথ অবরোধও নৈমিত্তিক ঘটনা। অবরোধ হল তো হল, অন্যান্য সহযাত্রীদের তেমন  তাপোত্তাপ থাকে না দেখি। অনেকেই নেমে পড়েন বাস থেকে, ঘুরে বেড়ান এদিক ওদিক। তত্ত্বতালাশ করেন, অবরোধ কেন হল, অবরোধ করা কতটা ন্যায়সঙ্গত ইত্যাদি প্রভৃতি। এসি বাস হলে, বন্ধ করে দেয় বাতানুকূল যন্ত্র। ফাঁকা হয়ে যায় সমগ্র বাস। এক আমিই বসে থাকি বোকার মতন, আর ভাবতে থাকি, হে ভগবান আজ সকালে কার মুখ দেখেছিলাম প্রথমে। নির্ঘাত আমার নিজেরই হবে। 


খোঁজ নিতে থাকি, অবরোধ কেউ তুলছে কি? পুলিশ এল কি? মহকুমা শাসককে ফোনটা করেই ফেলব নাকি? পুলিশ অবশ্য আসে, অবরোধ উঠেও যায়, বাস ছেড়েও দেয়, তখনও ওঠে না কয়েকজন যাত্রী। ‘হ্যাঁগো, কই গো’ বলে ফোন করে তাদের পরিবার পরিজন। কণ্ডাক্টর আর ড্রাইভার মিলে চর্চা জোড়ে, নির্ঘাত চরতে গেছে, ব্যাটাকে ফেলেই চলে চল। হাউমাউ জোড়েন মহিলারা, ‘ বাস ছেড়ে দিবে? ছেড়ে দিবে মানে কি?বলতেছি তো, লোকটা পাইখানা গেছে। তা লোকের পাইখানা পাবেনি-’। যিনি অপকর্ম করতে গিয়েছিলেন, এমন ভাবে বেল্ট আটকাতে আটকাতে বাসে ওঠেন, যেন বাসটা ওণার শ্বশুরমশাই যৌতুক দিয়েছিলেন। বউ প্রশ্ন করে, ‘ঠিকঠাক ধুইছ?’ মাথা চুলকানোর অছিলায় কানে আঙুল দিই আমি, মনে মনে বলি,হে ভগবান, সকাল সকাল এত দুঃখ কেন দিচ্ছ প্রভু, তুলে নাও প্রভু। 


কেউ কাউকে তোলে না, বরং আরো জোরে, আরো রসালো সুরে জমে ওঠে দাম্পত্যালাপ, ‘তোমায় কখন থেকে বলতেছি, বাস দাঁড়াইছে,এই তালে হেগে আসো। তা নয়, বসে বসে পা💨ছ।' বাতানুকূল যন্ত্র বন্ধ করে দেবার সাথে সাথেই, এসি বাসগুলো কেন যে এমন পূতিগন্ধময় এবং জনশূণ্য হয়ে ওঠে বেশ অনুধাবন করতে পারি। অন্যান্য সহযাত্রীদের মত কেন যে বাস থেকে নেমে গেলাম না ভেবে মুচড়ে ওঠে হৃদয়। রাগ হয়, সাথে সাথে আসে দুঃখ, এখন আপনি এটাকে দুঃখু বিলাস ভাববেন না কি ভাববেন সেটা আপনার ব্যাপার। তবে বুঝলেন কি না,  বিগ বি ঠিকই বলে গেছেন," ইয়ে জিনা ভি কোই জিনা হ্যায় লাল্লু "।

অনির ডাইরি ১৮ই মার্চ, ২০২৩

 


#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 

"পাঁউসির কাছে একটা অনাথ আশ্রমে বসন্ত উৎসবের নিমন্ত্রণ আছে, যাবি?"কোন এক রবিবারে সকালে সাগ্রহে জানতে চাইল শৌভিক। দোল কেটেছে বেশ কয়েকদিন হল, জানলার বাইরে উদ্দাম উল্লাসে গান ধরেছে কোকিলের গুষ্টি। গরম কফির কাপটাকে দুই হাতে সোহাগী আলিঙ্গন পূর্বক, সেই কলতানই শুনছিলাম মন দিয়ে‌।

জবাব দিতে কিঞ্চিৎ বিলম্ব হওয়ায় আবার বলল শৌভিক,"যাবি? পাশেই একটা রিজর্ট আছে 'মনচাষা' বলে, ওটাও ঘুরে নেব আর ফেরার পথে তোদের মন্দারমনি থেকেও ঘুরিয়ে আনব। লাল কাঁকড়া বিচ, যাবি?" 


কয়েক বছর আগে হলেও, সপ্তাহান্তের ছুটির দিনে কোথাও যেতে বললে বিকট মুখব্যাদান করতাম আমি। ছুটির দুপুরে ফুল স্পিডে পাখা চালিয়ে, আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমানো ছিল আমার কাছে স্বর্গসুখ। সাধের দিবানিদ্রা ফেলে কোথাও নড়তে রাজি হতাম না তেমন। ইদানিং বয়স বেড়েছে, প্রতিটা মুহূর্তে অনুভব করি, হাতে কমে আসছে সময়। ব্যস্ততাটাকেও ততো খারাপ  লাগেনা আজকাল আর। 


জলখাবার খেয়ে, আমরা যখন রওনা দিলাম মধ্য গগনে উঠবার তোরজোড় সম্পন্ন করে ফেলেছেন সূর্যদেব। কাঁথি থেকে খুব একটা দূরে নয়, কুড়ি-একুশ কিলোমিটারের মতো হবে। মহকুমা শাসকের ড্রাইভার নূপুর বাবু স্টিয়ারিং ধরলে তো, মিনিট কুড়ি -পঁচিশেই পৌঁছে যাব আমরা। গল্প শোনাতে শোনাতে নিয়ে গেলেন নূপুর বাবু, আগেকার স্যার ম্যাডামরা নাকি প্রায়ই যেতেন, এই আশ্রমে। দূর দূর থেকে বহু লোক আজও আসেন এই আশ্রমটি দেখতে। বেশ অনেকবার বললেন, "খুব ভালো লাগবে ম্যাডাম।"


বাংলায় "অন্ত্যোদয় অনাথ আশ্রম" লেখা বোর্ড টাঙ্গানো গেটের ভেতর দিয়ে যখন ঢুকলাম, একনজরে বুঝতে পারলাম না, এটা অনাথ আশ্রম না কোন রিজর্ট! সর্বত্র পরিচ্ছন্নতা আর যত্নের ছাপ, থোকায় থোকায় ফুটে আছে কেয়ারি করা মরশুমি ফুলের দল। একটা শেডের তলায় দাঁড় করানো আছে, অনেকগুলি ছোট বড় গাড়ি। নূপুর বাবু বললেন, "ওই দেখুন কত মানুষ এসেছে। এনারা প্রচুর অনুদান পান স্যার।"


হলুদ গোল গলা গেঞ্জি আর সাদা সুতির পাজামা পরিহিত এক ভদ্রলোক দৌড়ে এলেন। এক মাথা অবিন্যস্ত কাঁচা পাকা চুল, খালি পা, মুখে এক গাল হাসি। করজোড়ে শৌভিককে অভ্যর্থনা জানিয়ে, সাদরে নিয়ে গেলেন আশ্রমের ভিতরে। বিশাল এলাকা জুড়ে আশ্রম। বেশ অনেকটা রাস্তা হাঁটলাম আমরা। একদিকে মস্তপুকুর আর অন্যদিকে বড় বড় বিল্ডিং আর বাগান।


খোলা মাঠে ত্রিপল টাঙিয়ে বানানো হয়েছে ছাউনি। ছাউনির নিচে সারি সারি চেয়ারপাতা। সামনে সিমেন্টের তৈরি পাকা মঞ্চ। সেখানে নাচছে অধিবাসী মেয়েরা। এগোতে এগোতে দাঁড়িয়ে পড়ে শৌভিক দেখালো, আকাশে ড্রোন উড়িয়ে ছবি এবং ভিডিও তোলা হচ্ছে। মঞ্চের পিছনে লাগানো আছে মস্ত এলইডি স্ক্রিন। পর্দায় ফুটে উঠছে ছবি এবং ভিডিও। সবকিছুই বেশ হাইটেক এখানে। কোথাও তাচ্ছিল্য বা অবহেলা বা দীনতার কোন ছাপ নেই। 

একদম সামনের তিনটি চেয়ার বরাদ্দ হল আমাদের জন্য। অধিবাসী এক শিশু কোথা থেকে এক চুবড়ি পাঁপড় ভাজা নিয়ে এসে হাজির হল। উপস্থিত অভ্যাগতদের চা আর পাঁপড় ভাজা দিয়েই খাতির করা হচ্ছে এখানে। কুলোয় করে তিন রঙা আবির নিয়ে এসে হাজির হলো তিন সুসজ্জিতা আশ্রম বালিকা। মোদের তিনজনের গালে লাগল নতুন করে আবিরের ছোঁয়া। বাঁদিকের লম্বা মাটির দাওয়ায় পেতে রাখা কাঠের টেবিল এবং বেঞ্চে বসে বসে পা দোলাচ্ছে কয়েকটি বালিকা। প্রত্যেকেই বেশ সুন্দর সাজুগুজু করেছে, বুঝতে পারলাম এদের অনুষ্ঠান এখনও বাকি।


যে প্রৌঢ় ভদ্রলোক আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে এসেছেন, দেখলাম তিনি মঞ্চে উঠে গিয়ে সঞ্চালিকার কানে কানে কিছু বলে এলেন। অতঃপর সঞ্চালিকার সুললিত আহ্বানে মঞ্চে উঠতে হলো তিনজনাকে। সদ্য বাবার পুরাণ ক্যামেরাটার দখল পেয়েছে তুত্তুরী, গলা থেকে ক্যামেরা নামাচ্ছে না মোটে। গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে এসেছে এখানেও, তুলছিলও কিছু ছবি, আচমকা মঞ্চে ডাক পেয়ে, অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে, ভোম্বলের মতোই স্টেজে উঠল। গৌরবার্থে বহুবচনের মতই মহকুমা শাসকের সাথে সাথে বরণ করে নেওয়া হলো আমাদেরও। মনোজ্ঞ অথচ সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখতে হলো শৌভিককে। তারপর আমরা আবার নেমে গিয়ে দর্শকের আসন গ্রহণ করলাম।


খালি গলায় অসম্ভব সুন্দর গান শোনালো এক আশ্রম বালিকা। তারপর আবার নাচের পালা, নাচ সাঙ্গ হলে আবার গান। দাড়ি বুড়ো যে কতগুলো বসন্তের গান লিখে গেছেন তার ইয়ত্তা নেই। আজও যেকোনো বসন্ত উৎসবের প্রাণপুরুষ কেবল তিনিই। সঞ্চালিকা ঘোষণা করলেন এবার দশ মিনিটের নৃত্যনাট্যের পালা।  ফিসফিস করে বলল শৌভিক, "বোর লাগলে উঠে পড়তে পারি। দীঘাও যাওয়া যায়।"  যায় তো বটে, কিন্তু একটুও বোর হচ্ছি না যে। কি ভালো গান গাইছে, কি সুন্দর নাচছে ছেলেমেয়েগুলো। কি উৎসাহ সবকটার। কি মিষ্টি লাগছে বাচ্ছাগুলোকে। ফিসফিস করে জানতে চাইলাম, " এত সুন্দর বাচ্ছাগুলোকে, কে অনাথ আশ্রমে রেখে গেল গো।"


নৃত্যনাট্য শেষে, অনুষ্ঠানে সাময়িক বিরতি ঘোষণা করে, সঞ্চালিকা যিনি আবার কর্মসূত্রে পাঁশকুড়া পুরসভার কর্মীও, মঞ্চে ডেকে নিলেন এই অনাথ আশ্রমের প্রধান কর্ণধার তথা প্রাণপুরুষ শ্রী বলরাম করণকে। হলুদ গোল গলা গেঞ্জি আর সাদা পাজামা পরিহিত যে প্রৌঢ় ভদ্রলোক আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে এনেছিলেন, বুঝলাম উনিই হলেন বলরাম বাবু।


করজোড়ে সকলকে নমস্কার জানিয়ে তিনি শুরু করলেন অন্ত্যোদয় অনাথ আশ্রমের গল্প। স্ত্রী আর তিন মেয়ে ময়না-চায়না আর মণিকে সঙ্গী করে একার চেষ্টায় এই আশ্রমটি গড়ে তোলেন নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। তখন আবাসিকের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। সামর্থ ছিল নগন্য। একটি মাত্র ঘর সম্বল। মেদিনীপুরের ভূমিপুত্র কিনা, তাই জেদ অদম্য। পিছু হটেননি বলরাম বাবু। গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে, দিয়ে এসেছেন একটি করে মাটির হাঁড়ি। ওণার ভাষায়, মা লক্ষীরভান্ডার। আর অনুরোধ করেছেন বাড়ির মা বউদের, " মাগো, তোমরা যখন তোমাদের ছেলেমেয়ের জন্য ভাত বসাবে, তখন আমার অনাথ শিশু গুলোর কথাও একটু ভেবো। একমুঠো চাল ওদের জন্য ফেলে দিও এই হাঁড়িতে। মাসের শেষে এসে, সেই হাঁড়ির চাল নিয়ে যাব আমি। তাই দিয়েই ভরবে আমার বাচ্ছাগুলোর পেট।" 


এই ভাবেই লড়েছেন কিন্তু পিছু হটেননি। বন্ধ হয়নি আশ্রম। আনন্দবাজার পত্রিকার স্থানীয় প্রতিবেদক শ্রী সুব্রত গুহ, যখন জানতে পারেন বলরামবাবু আর ওনার এই লক্ষ্মীর ভান্ডারের গল্প, তখন উনি এই নিয়ে একটি লম্বা প্রতিবেদন লেখেন। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায়, ২০০৪ সালে আট কলম জুড়ে ছাপা হয় সেই প্রতিবেদন। তারপরে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি বলরাম বাবুকে। বর্তমানে এই আশ্রমে ৫০ জন বালক এবং ৫০ জন বালিকা থাকে। পাশেই আর একটি আশ্রম গড়ে তুলেছেন বলরাম বাবু। যেখানেই থাকেন আরো ৬৫ জন মেয়ে ও শিশু।


বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত, সাংবাদিক সুব্রত বাবু স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন এই অনুষ্ঠানে। তাঁকে মঞ্চে ডেকে নিলেন বলরাম বাবু। ডেকে নিলেন উপস্থিত অন্যান্য মান্যগণ্য ব্যক্তিদের। দীর্ঘদিন এই আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত এঁরা সকলেই। শুধু যে নগদ অর্থে সাহায্য করেছেন বা করে চলেছেন তাই নয়, এমনও মানুষ আছেন যিনি ছেড়ে দিয়েছেন কলকাতায় তাঁর ব্যক্তিগত দোতলা বাড়ি। সেখানে খোলা হয়েছে আশ্রমের একটি টেম্পোরারি অফিস। আশ্রমের কোন শিশু অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ওখানে রেখে ডাক্তার দেখানো হয়। যে সমস্ত আবাসিক বালক বা  বালিকা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেছে, তারা ওখানে থেকেই পড়াশোনা করে। যেমন বর্তমানে নার্সিং পড়ছে বেশ কয়েকজন মেয়ে।


গল্প শোনাচ্ছিলেন জনৈক দম্পতি, এই আশ্রমের সঙ্গে ওনাদের ১৯ বছরের সম্পর্ক। ভদ্রমহিলা বলছিলেন," প্রথম যখন আসি সেটা ২০০৪ সাল। খবরের কাগজ পড়ে বলরামের সাথে ফোনে যোগাযোগ করি। সেটা মোবাইলের যুগ নয়। আমি শুধু বলেছিলাম, আমরা পাঁশকুড়া স্টেশনে দাঁড়াবো, আর আমি লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে থাকবো।" আজও তাই পরে আছেন ভদ্রমহিলা। ওণার স্বামী একটু আগে বলছিলেন, তাঁর বয়স ৮০। বর্তমানে বিদেশে বসবাস করেন। কখনও সিঙ্গাপুর, তো কখনো আমেরিকা। দুই পুত্রই বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত। জ্যেষ্ঠ পুত্র গুগলে মস্ত অফিসার। অনুষ্ঠান শেষে শৌভিককে গল্প শোনাচ্ছিলেন, Google Pay তে যত ট্রানজাকশন হয়, তার জন্য উনি রয়ালটি পান। কারণ ওটা ওনার জ্যেষ্ঠ পুত্রেরই ডিজাইন। 


বলছিলেন ১৯ বছর ধরে এই আশ্রমের সঙ্গে জড়িত, মায়া পড়ে গেছে এই আশ্রম আর এর প্রতিটি আবাসিকের ওপর। যেখানেই থাকুন প্রতিবছর এই অনুষ্ঠানে ছুটে আসেন। দুঃখ করছিলেন, "আর কতদিন আসতে পারব জানিনা। বয়স ৮০ হল, তবে এটুকু আশ্বাস নিয়ে যেতে পারব পরপারে, যে আমার পরেও আমার ছেলেরা পাশে থাকবে, এই বাচ্ছা গুলোর।"


বেশ অনেকক্ষণ বসলাম আমরা, আরো কিছুক্ষণ বসতে পারলে ভালো হতো কিন্তু বলরাম বাবু ধরে নিয়ে গেলেন আশ্রম দেখতে, বিশাল এলাকা জুড়ে আশ্রম। অনাথ আশ্রম চালানো ছাড়াও আরো অনেক কিছু করেন ওনারা। গণবিবাহ দেন, বিনামূল্যে ছানি অপারেশন শিবির করেন ইত্যাদি প্রভৃতি। সবশেষে ধরে নিয়ে গেলেন পাশের আশ্রমে, এটি একটি বিশেষ আশ্রম এখানে থাকে বিশেষ ধরনের শিশু যারা যৌন নির্যাতনের শিকার বা যারা ১৮ বছরের কম বয়সে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে। বিনা অনুমতিতে এই আশ্রমে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ চতুর্দিকে নিরাপত্তার কড়াকড়ি, সিসিটিভি ক্যামেরার ছড়াছড়ি।  শৌভিক সাবধান করে দিল তুত্তুরীকে, "গলা থেকে ক্যামেরা খুলে,গাড়িতে রেখে যা। এখানে কোনরকম ছবি তোলা যাবে না।"


তালা লাগানো মস্ত লোহার গেটের ভিতরে চকচকে নিকানো উঠোন, উঠোনে তুলসী মঞ্চ। উঠোনকে ঘিরে দুদিকে দুটো দোতলা বাড়ি। যার একতলায় রয়েছে অফিস। অফিসে টাঙানো রয়েছে আশ্রমিকদের খাদ্য তালিকা, কখন কি ক্লাস আছে, কে পড়াতে আসবেন ইত্যাদি। দেখলাম লেখাপড়া ছাড়াও নাচ,গান,সেলাই, পাটের কাজ এবং অন্যান্য হাতের কাজ শেখানো হয়। কে, কখন এইসব স্পেশাল ক্লাস নিতে আসবেন, ঝোলানো আছে তারও তালিকা। 


বেরিয়ে আসছি, দোনা মোনা করে একটা প্রশ্ন করেই ফেললাম, বাচ্ছাগুলো এই ট্রমা কাটায় কি করে? বিশেষ আশ্রমের দেখাশোনা করেন যে ম্যাডাম, উনি বললেন কাউন্সিলর আসেন। কাউন্সেলিং হয় নিয়মিত। জানতে চাইলাম, ভোলা যায়? কেউ ভোলে? উনি হাসলেন কেবল। প্রশ্নটাই বড় বোকাবোকা যে। কিছু প্রশ্নের উত্তর না জানাই বোধহয় ভালো। মিশুক না বাস্তবে কিছুটা কল্পনার রং। যেখানে ভালো থাকবে প্রতিটা শিশু, যেখানে মুছে যাবে সমস্ত কুৎসিত দাগ।


ছবি সৌজন্য - শ্রীমতী তুত্তুরী

অনির ডায়েরি ১৫ ই মার্চ, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 


মোবাইলের ঘড়ি বলছে সোয়া আটটা বাজতে এখনো বাকি কয়েকটা মিনিট, গাড়িতে উঠে বসলাম। আমি না বেরোলে কেউ যে আসর ছেড়ে নড়বেনা, বেশ বুঝতে পারছি। আজ আমাদের চণ্ডীপুরের ইন্সপেক্টর সাহেবের বৌভাত। শান্তনু, সন্দীপ আর মনীষ আমার তিন নবীন ইন্সপেক্টর। ব্যাটাদের চাকরি জীবনের বছর ঘুরে গেছে,অথচ এখনও ঘোঁছেনি "বেবি ইন্সপেক্টরের" তকমা। 

এহেন আমার তিন "বেবি"র মধ্যে শান্তনুরই প্রথম আইবুড়ো নাম ঘুঁচলো। বিয়ের কথাবার্তা শুরু হওয়া ইস্তক, যেভাবে সকলে শান্তনুর পিছনে লেগেছিল, আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিল এমন উৎতপেতে লোকজনকে জীবনের শুভতম দিবসে মোটেই নিমন্ত্রণ জানাবে না শান্তনু। সকল দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে, শেষ পর্যন্ত অবশ্য নিমন্ত্রণ জানিয়েছিল শান্তনু এবং তাও চূড়ান্ত সরলতা, এক রাশ উষ্ণতা এবং আন্তরিকতার সঙ্গে।


নিমন্ত্রিত হলে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে হবে এটাই আমার বাবার শিক্ষা। অতিমারি এসে সব চেনা ছক উল্টেপাল্টে দিল তাই, নতুবা কেউ আমার বাবাকে নিমন্ত্রণ করবে আর বাবা যাবে না, এমন ঘটনা আক্ষরিক অর্থেই কোটিকে গুটিক। উপরোধে ঢেঁকি গিলে, এমন কত যে নিমন্ত্রণ বাবা রক্ষা করেছে, যেখানে না গেলেই বোধহয় ভালো হতো। যেখানে কেউ বলেনি,'আসুন', কেউ বলেনি,'খেতে চলুন' বা 'ভালো করে খাবেন।' নীরব অবজ্ঞা উপলব্ধি করে, নীরবেই উপহার প্রদান পূর্বক অভুক্ত অবস্থায় গৃহে প্রত্যাবর্তন করেছে বাবা, কিন্তু গেছে।


শুধু যে নিজে গেছে তাই নয় যেতে বাধ্য করেছে মাকে এবং আমাকে। তাচ্ছিল্যে, অবজ্ঞায়, অভদ্রতায় জ্বলে গেছে গা, ভরে উঠেছে চোখ, তাও হাসির মুখোশ পরে দাঁড়াতে হয়েছে সর্বজন সমক্ষে। বৃদ্ধের আমি এতটাই অনুরাগিনী, যে কখনই বৃদ্ধের বিরুদ্ধাচরণ করার ইচ্ছা বা সাহস হয়নি। আজও হয় না। অবশ্য আমার স্ট্রাইক রেট বাবার মত অত নিখুঁত ও নয়। স্বভাবতঃ কুঁড়ে হওয়ায়, না যেতে পারা নিমন্ত্রণ বাড়ির সংখ্যাও আমার খুব কম কিছু নয়।


আজও কোন বিয়ে বাড়ির ছবি লাগালে, ঠোঁট ফোলায় রমেশ, দুঃখ পায় প্রিয়াঙ্কা। চুঁচুড়া ছেড়ে আসার সময় কথা দিয়ে এসেছিলাম যে, পৃথিবী উল্টে গেলেও ওদের বিয়েতে আমি আসবোই। কথা দিয়েছিলাম তমলুক ব্লকের এসএলও জয়ন্ত বাবুকেও, অবশ্যই হাজির হব ওনার কন্যার শুভবিবাহে। দুখানা কার্ড দিয়ে নিমন্ত্রণ করেছিলেন জয়ন্ত বাবু, একটা শুধু আমাকে সপরিবারে আর একটা দিয়ে পুরো অফিসকে। 


দিনটা সম্ভবত ছিল রবিবার। প্রস্তুত ছিলাম আমি আর তুত্তুরী। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল কেবল আমরা ছাড়া, অন্য সকলেরই সেদিন অন্য কোন না কোন নিমন্ত্রণ বা ব্যস্ততা আছে। সদ্য বদলি হয়ে এসেছি তাম্রলিপ্ত নগরী, এমতবস্থায় একাকী, অচেনা পরিবেশে, নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাবার মতন সৎ সাহস সেদিন জোটাতে পারিনি। বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিলাম পরিকল্পনা। সবথেকে খারাপ লেগেছিল, যখন কন্যার বিবাহের শত ব্যস্ততার মধ্যেও ফোন করেছিলেন জয়ন্ত বাবু, "ম্যাডাম আসছেন তো? ম্যাডাম কত দূরে আছেন?"  ঠিক যেমন ফোন করেছিল চুঁচুড়া থেকে রমেশ।


পরের দিন আপিসে এসে খুব বকেছিলাম সবকটাকে। কিসের এত গেঁতোমি তোমাদের বাপু? মানছি দূরের লোকেরা ছুটির দিন পরিবার ফেলে আসতে বিপন্ন বোধ করে, কাছাকাছি যারা থাকো তারা গেলে না কেন? সবাই চুপ, শেষে চঞ্চল বলল,' আসলে ম্যাডাম‌ কুন্তল স্যার সবাইকে গাড়ি করে নিয়ে যেত তো-'। কুন্তল আমার পূর্বসূরী এবং ব্যাচমেট এবং সুহৃদ। আজও এদের নয়নমণি। কুন্তলের সাথে নিমন্ত্রণ বাড়ি না যাবার কি সম্পর্ক বুঝলাম না। চঞ্চল বলল,' তার আগে তো, সাহেব ম্যাডামরা সবাই গাড়ি করে চলে যেতেন। স্টাফেরা যে যার মত বাসে করে যেত। একবারই গাড়ি দিয়েছিলেন অমুক আধিকারিক, সবাই খুব আনন্দ করে গিয়েছিল সেবার খেতে, ওমা হঠাৎ তাঁর মনে হল, যে তিনি হলদিয়া যাবেন। ভয়ের চোটে উত্তম তো না খেয়েই উঠে পড়ল।'


কবেকার কথা, তাও উত্তমকে বললাম, 'খেয়ে উঠবে তো? না খেয়ে হলদিয়া নিয়ে যেতে বলেনি তো কেউ।' উত্তম কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, ' আপনি জানেননি, উনি পাঁচবার খাবার জায়গায় চলে গেছেন আমায় ডাকতে, শেষে পাতে জল ঢেলে উঠে পড়লুম। যা ভয় পেতুম ম্যাডাম ওনাকে, ওনার ভয়ে বাথরুম পর্যন্ত যেতুমনি, চেপে বসে থাকতুম গাড়িতে। একবার বাথরুম গেছি চাবিটা গাড়িতে লাগানো ছিল, মোবাইলটাও গাড়িতেই রাখা ছিল। দু মিনিট পর ফিরে এসে দেখি, গাড়ি নাই। আমার তো মাথায় হাত, আশেপাশের অন্য সরকারি গাড়ির ড্রাইভাররা বলল, 'তোর বস্, তোর গাড়ি লিয়ে চলে গেছে।' ফোনটাও গাড়িতে রয়ে গেছে, ফোন করতেও পারতেছি নে। পকেটে যা পয়সা ছিল তাই দিয়ে বাসে করে অফিসে এসে দেখি, তিনি তুলকালাম বাঁধিয়েছেন। অমিয় দাকে (গাড়ির মালিক) বলতেছেন, 'হয় উত্তম থাকবে, নয় তোমার গাড়ি থাকবে।' উত্তমকুমারকে অবশ্য, দূর করে দেবার হুমকি, আমিও দিই। প্রতি তিন দিনে একবার তো বটেই। ভাগ্যে গাড়ি চালাতে পারি না- 


 যাইহোক প্রসঙ্গ থেকে সরে আসছি বুঝতে পেরে আবার জিজ্ঞাসা করলাম, তোমরা গেলে না কেন? ইতস্তত করে চঞ্চল বলল,' সেবার যা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তখন এত অটো টোটো ছিল না, ওই রোদে দুপুর বেলা সবাইকে হেঁটে অফিস ফিরতে হয়েছিল।' বুঝতে পারলাম আগেকার তিক্ত অভিজ্ঞতার জন্যই, ওরা সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাচ্ছে। আশ্বস্ত করে বললাম, কুন্তল স্যার জিন্দাবাদ। আর আমার ফেলে আসা অফিসের লোকজনকে একবার জিজ্ঞাসা করে দেখো,  চুঁচুড়ায় কেমন মুড়ি টিনের মত ঠেসে ঠেসে সবাইকে গাড়িতে তোলা হত। এখানেও তাই হবে। আধিকারিক বা অফিস বদলে গেলেও বদলাবে না নিয়ম।


নিমন্ত্রণ এলে তারপর থেকে মোটামুটি হাজিরা দেয় অধিকাংশই। আজই যেমন সব মিলিয়ে আমরা ১৬ জন এসেছি। কোলাঘাটের ইন্সপেক্টর সৌম্যর উপর ভার ছিল, কারা কারা যাবে তাদের নামের লিস্ট বানানো। তালিকা শেষ পর্যন্ত যা লম্বা হলো, বেদজ্যোতি-শুভাশিস-নন্দনের মত গুটিকয়েক যদি নানা কারণে যেতে অপারগ না হতো, তাহলে বোধহয় একটা মিনিবাস ভাড়া করতে হত, চাঁদা তুলে।


ঠিক ছিল, ঠিক চারটের সময় কাঁথি থেকে রওনা দেব আমি। পাঁচটা নাগাদ হক বাবুকে তোলা হবে নন্দকুমার থেকে। নিমতৌড়ি থেকে উঠবে সৌরভ আর CKCO শান্তনু। উপহার সমেত উঠবে শুভদীপ্ত। মেছেদা থেকে উঠবে সুরজিৎ, কোলাঘাট থেকে রঞ্জিৎ, দেউলটি থেকে সৌম্য, বাগনান থেকে রবিবাবু এবং সন্দীপ। সঞ্জয় আর মনীশ আসবে ট্রেনে। উলুবেরিয়া স্টেশন থেকে ওদের তুলে নেব আমরা। কাটায় কাটায় ছটায় পৌছবো আমরা নব দম্পতিকে আশিস এবং শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রথম ব্যাচে খেয়ে ঠিক রাত আটটায় বেরিয়ে পড়ব আমরা।

সেই মতো শনিবার দুপুরে এক ফোঁটাও না ঘুমিয়ে পৌনে চারটের মধ্যে সেজেগুজে তৈরি হয়ে গেলাম আমি। সপরিবারে নিমন্ত্রণ ছিল, শৌভিক আর তুত্তুরী রাজি হলো না এই অবেলায় উলুবেরিয়া যেতে, তাঁরা নাকি যুগলে পাখির ছবি তুলতে যাবেন। সব হলো স্টার্ট নিল না কেবল গাড়িটা। টেনশনে আধ কিলো ঘেমে গেল উত্তম কুমার। বাংলোর সিকিউরিটি ছেলেটি এবং উত্তমে মিলে বিস্তর ঠেলাঠেলিও করল তাও নড়লো না গাড়ি। বিরস বদনে মেসেজ করলাম অফিস গ্রুপে, ভাই সব তোমরা যে যেমন পারো, যেভাবে পারো চলে যাও। মনে হয় না আমি যেতে পারবো।


ভেবেছিলাম এই নিমন্ত্রণ বাড়িটাও বুঝি সংযুক্ত হতে চলেছে অপারগতার তালিকায়। পাঁচটা বেজে গেলে হয়তো সত্যি সত্যি আর যেতামও না। বাঁচিয়ে দিল কাঁথি বাজারের বুড়ো মেকানিক, আসতে একটু দেরি করেছিলেন বটে তবে মাত্র তিন মিনিটে কি যে মৃতসঞ্জীবনী সুধা পান করালেন গাড়িটাকে। গাড়ি একদম রকেট হয়ে দৌড়লো। নির্ধারিত সময়ের মিনিট পঁয়তাল্লিশেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম আমরা।


মেনু কি হতে চলেছে আগেই জেনে নিয়েছিলাম আমরা, যদিও কিছুই আর মনে ছিল না সেদিন। তবে জানতাম এবং মনেও ছিল যে টকটকে লাল লেহেঙ্গা পড়বে নববধূ। লেহেঙ্গার ছবিও দেখিয়েছিল শান্তনু। ছেলেটা এতই ভালোমানুষ গোবলু, যে কে সাজাতে আসবে, কখন সাজাতে আসবে এবং সাজানোর খরচ কত সেসব গল্পও শুনিয়ে ছিল আমাদের। ফলে সুসজ্জিতা নববধূর মঞ্চে অবতীর্ণ হতে, যে বেশ খানিকটা সময় লাগবে, এ ব্যাপারে আমরা ইতিমধ্যেই অবহিত ছিলাম। 


নববধূর আসতে বিলম্ব হলেও ফুচকাওয়ালার যে আসতে বিলম্ব হবে না, এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত ছিলাম। অবিলম্বে লাইন পড়ে গেল ফুচকাওয়ালার সামনে। একদল কটকটে ঝাল ফুচকা চায়, তো একদল ঝাল বিহীন শুকনো ফুচকা। ফুচকার পাশেই ঢেলে রাখা গরম গরম পনির কাঠি কাবাব। তার পাশে জ্বলন্ত চিকেন মোমো। তার পাশেই কফি। ফুচকার টক জলে পেট টইটুম্বুর, এমতবস্থায় কিছুতেই কফি খাব না আমরা, শান্তনুর মামা বাবুও ছাড়বেন না।  বড় ভালো বানিয়েও ছিল বটে কফিটা। পেট পুরে স্টার্টার সাঁটিয়ে, নববধূর ফাঁকা সিংহাসনে বসে ছবি তুলে, সেলফি কর্নারে গ্রুপি তুলতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেও আমার চোখ ঠিক ঘড়ির ওপর। এতগুলোকে তাড়িয়ে এনেছি যেমন, সালামত ভাবে বাড়ি পৌঁছানোর দায়িত্বও তেমনি আমারই। লজ্জার মাথা খেয়ে শান্তনুর মামাকে শেষ পর্যন্ত আমিই গিয়ে বললাম, রান্না কি সম্পন্ন? তাহলে আমাদের যদি একটু বসিয়ে দেন।


প্রথম ব্যাচে খেতে বসার সবথেকে বড় সুবিধা হল কোন কিছুই ঠান্ডা পাবেন না আপনি। জিভ জ্বালানো ফিস পাঞ্জাবি, আঙুল পোড়ানো মুগমোহন, কিমা মোটর, পোলাও, ভেটকি মাছের পাতুরি, খাসির মাংস, কষা চিকেন, মাছ, পনির ইত্যাদি যখন আসতে শুরু করল পরপর তখন বড় দুঃখ হচ্ছিল জানেন, কেন যে অতগুলো ফুচকা খেলাম। তেঁতুল জল আর এক্সপ্রেসো কফির আভ্যন্তরীণ বিবাদে, বাদ দিতে হলো অনেক কিছুই। তবে সন্দেশটা আর শেষ পর্যন্ত প্রাণে ধরে ছাড়তে পারলাম না। আমাদের হাওড়া জেলার বাগনান-উলুবেরিয়া অঞ্চল এমনিতেই মিষ্টির জন্য সুপ্রসিদ্ধ। এই অসময়েও সন্দেশটা থেকে ভুরভুর করে নলেন গুড়ের সুবাস ছাড়ছিল। প্রতি কামড়ে জিহবা আর তালুতে মিশছিল খাটি ছানার সোহাগ।


শান্তনুদের বাড়ির আতিথেয়তা অসম্ভব উষ্ণ। কতবার, কতজন, কতরকম ভাবে যে বলে গেল, ভালো করে খাবেন, যা ইচ্ছে খাবেন, যতবার ইচ্ছে চেয়ে খাবেন। আমার ছোট কাকুর ভাষায় নির্লজ্জের মত খাবেন অর্থাৎ লজ্জা করে খাবেন না, ইত্যাদি প্রভৃতি । বর বেশে এক ঘর অভ্যাগত দের সামনে অন্তত গোটা পাঁচেক বার তো আমায় প্রণাম করার চেষ্টাই করে ফেলল শান্তনু। পদাধিকার বলে উপরওয়ালা বটে, তাই বলে গুরু ঠাকুর তো নই, আরেকবার প্রণাম করতে এলেই ঠ্যাঙাবো, এই ভয় দেখিয়ে নিরস্ত করলাম শেষ পর্যন্ত। পাশ থেকে সন্দীপ ফুট কাটল, "ম্যাডাম সাথে সাথে শোকজ টাও করে দিন।" যেন অনাবশ্যক শোকজ করাটাই আমার কাজ। ওটাকেও দু চার ঘা দিলে মন্দ হত না, যা বুঝলাম।


আটটায় বের হব ভেবেছিলাম মাত্র পনেরো মিনিটের মধ্যে গুটিয়ে ফেলতে পেরেছি ব্যাপারটা। তার জন্য তারিফও করলো হক বাবু আর উত্তম। 'এই আপনি তাড়া দিলেন, তাই সব কটা নড়ল।' সেটা দূর থেকেও বুঝতে পারছিলাম বেশ, নতুবা যে হারে নতুন বরকে গোল করে ঘিরে ধরে মন্ত্রণা দিচ্ছিল সব কটা, এত বুদ্ধি আমাদের শান্তনু মাথায় রাখতে পারলে বাঁচি। কিছু রাখবে, কিছু হয়তো মিশে যাবে অপ্রয়োজনীয় স্মৃতির ভিড়ে। সব মিলিয়ে খুব খুব ভালো থাকবে আমাদের শান্তনু আর তার মৌলি, এটাই আপাতত টিম তাম্রলিপ্তর প্রতিটি উপস্থিত এবং অনুপস্থিত সদস্যর একমাত্র কামনা। ভালো থেকো নব দম্পতি। অনেক অনেক ভালোবাসা আর আশীর্বাদ রইল তোমাদের জন্য।

অনির ডাইরি ১০ই মার্চ, ২০২৩

 


#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 

মাসি দীর্ঘদিন ধরে আমাদের অফিস ঝাড়পোচ করে আসছে। অফিস স্থানান্তরিত হয়েছে, বদলে গেছে ইন্সপেক্টর থেকে আধিকারিক সকলে। জগদীশ গুপ্ত সাহেব তো মারাও গেছেন। চাকরি ছেড়ে দিয়েছে কত সিকেসিও। নতুন জয়েন করেছে আবার। মাসি শুধু রয়ে গেছে  ধ্রুবক হয়ে। মাসির আসল নাম পুতুল দাস। এককালে চা বিক্রি করতেন, তখন আপিস সাফাই করত অন্য মাসী। সে মাসি গত হলে, ঐ কাজটাও চাপে এই মাসির ঘাড়ে। 


আমি আসার পর মাসির সামান্য চাপ বেড়েছে। মেঝে কতটা সাফ হল, কোথায় ঝুল জমল,ডাস্টবিন কতদিন পর খালি করা হল - পুরুষ আধিকারিকরা এসব দেখে থোড়াই। দুচারদিন ডুব মারলেও কেউ কিছু বলত না। মাসির ভাষায় সবকটা “সাক্ষাৎ ভগবান ছেল”। আমি একাই অসুর। আমি আসার পর হাজিরা খাতা বানানো হয়েছে মাসিরও। অফিসে ঢুকে ঝ্যাঁটা ন্যাতায় হাত দেবার আগেই,সামনে খাতা খুলে ধরেন হক বাবু। নিত্য আমার আর হক বাবুর মুণ্ডপাত করতে করতে সই করতে হয় মাসিকে। লম্বা ছুটি নিলে দিতে হয় একজন প্রতিস্থাপক। ঝাড়পোঁচ করতে হয় একটু ধৈর্য্য ধরে।টেবিলে আঙ্গুল দিয়ে যাতে নাম না লেখা যায়। ঘর মোছার আগে পাল্টাতে হয় জল। কাদাগোলা মেঝে আমার দুচক্ষের বিষ। খালি করতে হয় ডাস্টবিনও। অফিসে ঢুকতেই পচা গন্ধওয়ালা ডাস্টবিন আমার দুচক্ষের বিষ। ইত্যাদি প্রভৃতি। 


এতদসত্ত্বেও মাসি নীবর থাকে, কারণ আপাততঃ মাসির মজুরীটা মাসেমাসেই দিতে পারি আমরা। আগে ঐটি পেতে কালঘাম ছুটত মাসীর। এখন অ্যালটমেন্ট এলেই সর্বাগ্রে আলাদা করে রাখা হয় মাসীর সম্বৎসরের মজুরীর টাকা। পুজোর বোনাসের ব্যবস্থা করা গেছে সময়মত। মাঝেমাঝেই, "মজুরী বাড়াও নাহলে আর আসবুনি" বলে হুমকি দেয় বটে মাসি, ওগুলো নির্বিষ আস্ফালন আমরাও বুঝি। কিন্তু বসন্তোৎসবের পরের দিন মাসির যে রূপ দেখলাম, তা মোটেই ইয়ে মানে শান্ত নয়। হোলির পরের দিন আপিসে ঢুকে দেখি, হক বাবু, জহর বাবু এবং অরূপ সিঁটিয়ে আছে। আলমারি হাঁটকে ছেঁড়া ন্যাকড়া আর পুরাণ ডাস্টার বার করছেন জহর বাবু। মাসি একাই সব্যসাচী। নেহাৎ মজুরীর বিলে আমিই সই করি, তাই আমার ভাগ্যে অমৃত বচন তেমন না জুটলেও, চোখ গোলগোল করে, মনে মনে ব্যাপক ভর্ৎসনা করল মাসি। বেদম হেসে মাসির ধ্যান না ভাঙালে, ভম্মই হয়ে যেতাম নির্ঘাত। 


যত চটছিল মাসি,ততো বাড়ছিল আমার হাসির দমক। যত হাসছিলাম আমি, ততো চটছিল মাসি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য হার মেনে নিলাম আমিই। সরি মাসি বলে বেশ খাণিক আদরও করে দিলাম, তাও গলল না বৃদ্ধা। তাও নমনীয় হল না দৃষ্টি। শুধু বলল,‘ মা, মা গো। মা জননী। তোমায় প্রণাম।” 🤕


ছবি - অরূপ এবং বেদজ্যোতি। দুদিন ধরে একই রকম ক্ষেপে আছে মাসি।😔