Tuesday, 21 September 2021

ইতি অনিন্দিতা

 তাম্রলিপ্ত,         সোমবার, ৫ই আশ্বিন, ১৪২৮ বঙ্গাব্দ


প্রিয় এষা,

তুমি কি জানো, যে গতকাল রাতে শ্রীমতী তুত্তুরী, তোমার আদরের কুট্টুসকে মখমলি চিকেন চাখিয়েছে? ‘মখমলি চিকেন’ বলতে বুঝলে না তো?  ঐ যে তোমার দাদা, লাল টমেটো না হলদে খরগোশ, কোথা থেকে যেন যেটা আনিয়েছিল।  যাদের সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ডেলিভারি করতে বলা হয়েছিল আর রাত পৌনে নটার সময় তাদের ডেলিভারি কাকু তার মান্ধাতার আমলের সাইকেলটা ঠেলতে ঠেলতে এক প্যাকেট ভর্তি কি সব নিয়ে এসেছিল। কি প্রচণ্ড ক্ষেপেছিল শৌভিক। রেগে গিয়ে গোঁ ধরেই বসেছিল, লোকটা এলে, খাবারের প্যাকেটটা কেড়ে নিয়ে ভাগিয়ে দেবে। মূল্য দূরস্থান, এমনকি ডেলিভারি চার্জটাও দেবে না। নেহাৎ আমি নিজেই পেশায় গায়েগতরে খেটে খাওয়া শ্রমিক,তাই অনেক বলে কয়ে মাথাটা ঠাণ্ডা করেছিলাম।


তবে তীব্র কেওড়া গন্ধী মাংসটা চাখার পর, মনে হয়েছিল শৌভিককে না আটকালেই ভালো করতাম। তুত্তুরী বলল,এমনকি শ্রীমান কুট্টুসও নাকি বার তিনেক ঘুরে, ঘুরে এসে শুধুই শুঁকেছিল,হয়তো শুঁকে বোঝার চেষ্টা চালাচ্ছিল, এই মালটা আসলে কি! তুত্তুরীর বয়ান অনুসারে শেষমেশ অবশ্যি পেটে চালান করে। বিগত তিন বেলায়, তুত্তুরী দিদি তার কুট্টুস ভাইয়ের আরও যে এমনি কত রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা আমার ধারণা ধীরে ধীরে জানতে পারব আমরা। ক্রমশঃ প্রকাশ্য ব্যাপারস্যাপার আর কি- 


রবিবার ভোর ভোর তোমরা যখন বেরোলে দেবী বর্গভীমা সন্দর্শনে, শ্রীমতী তুত্তুরী স্বেচ্ছায় ঘাড় পেতে নিল, তোমাদের অনুপস্থিতিতে কুট্টু বাবুর রক্ষণাবেক্ষণের ভার। সেই মোতাবেক ঢাকঢোল পিটিয়ে শ্রীমান কুট্টুসকে নিয়ে গেল ছাতে পায়চারি করতে, যাতে সেই মওকায় গাড়িতে সওয়ার হয়ে কেটে পড়তে পারো তোমরা দোঁহে। কুট্টু বাবু চতুষ্পদী হলেও এতই কি বোকা রে ভাই? যেই অর্জুন গাড়ির দরজা খুলেছে, তিনতলার ছাত থেকে তুত্তুরীর হাত ছাড়িয়ে হুড়মুড় করে দৌড়ে এল কুট্টুস বাবু। অবোলা জীব হলেও তোমাদের এক ঝলক দেখার জন্য ওর আর্তি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম আমরা। তুত্তুরীর প্রবল চিৎকারে সচকিত হয়ে আপ্রাণ শক্তিতে বাইরের দরজাটা চেপে ধরেছিলাম যে আমি-। যেই তোমাদের তুলে পলাশের গাড়ির চাকা গড়াল, দরজার হাতল ছাড়লাম আমি, ওমনি বুলেটের মত ছুট্টে বেরিয়ে এল কুট্টুস। তারপর খানিক গোল গোল করে ঘুরল গাড়ি বারন্দার নীচে, বোধহয় তোমাদের গায়ের গন্ধ শুঁকল আর দৌড়ল গাড়ির পিছন পিছন।প্রহরারত সিভিক ভলান্টিয়ার ছেলেটির এমনিতেই সারমেয় ভীতি আছে, কুট্টুসের ঐ দৌড় দেখে সে তো একলাফে পগার পার। ভাগ্যে শ্রীমতী তুত্তুরী ছিল, রীতিমত জাপটে ধরে, পরম স্নেহে  ‘ঘরে চল না। আসবে, আসবে এখুনি এষা পিসিরা ফিরে আসবে’ বলতে বলতে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল কুট্টু বাবুকে।  দুজনের সম্পর্কের বাঁধুনিটা কখন যে আমাদের অসাক্ষাতে এত জবরদস্ত হয়ে উঠেছে, তাই বোধহয়, তুত্তুরীদিদির সাথে শোবে বলে গতরাতে কেঁদে ভাসিয়েছিলেন শ্রীমান কুট্টুস। 


কি ভালো নামে চেনে ও তোমাদের। চেনে তুত্তুরীকেও। এমনিতে শ্রীমান কুট্টুস বাস্তবিকই শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে,তবে সাময়িক ভাবে ওকে ত্যাগ করার ক্ষোভেই বোধহয় সেদিন পাগলের মত বাগানে ছোটাছুটি করছিল আর ঘাস চিবাচ্চিল।তুত্তুরী তো বেশ কয়েকবার বলেই ফেলল, 'ওরে, তুই ছাগল নস। তুই হলি কুতুয়া। কুতুয়ারা ঘাস খায় না।' 


শেষমেশ শৌভিক ঘাড় ধরে এনে বারন্দার গ্রীলে বেঁধে রাখল কিয়ৎক্ষণ। তখন অবশ্যি দিব্যি ভাজা মাছ উল্টে না খেতে পারার মত মুখ করে বসেছিল। দিব্যি পোজও দিল ভালো মানুষের মত মুখ করে। তারপর আমায় দেখে সটান উঠতে চাইল আমার কোলে। জানে আমি ভয় পাই। কোলে নিতে না পারার অপরাধবোধেই খানিক প্রজাপতি বিস্কুট দিয়েছিলাম খেতে। বেশী না একটা ছোট্ট টুকরো, সেটা কুট্টুস খায়ও নি। অথচ যখন বমি করল, তখন সটান দাদা আর তুত্তুরী আমার ওপর চড়াও হল, আমার দেওয়া বিস্কুটের জন্যই নাকি কুট্টুস বমি করেছে। ঘাস খাওয়া বা তোমাদের ওপর আক্রোশ বশতঃ নয়। তোমাদের ওপর এত আক্রোশ, অথচ যেই তোমরা ফিরে এলে, ওমনি কেমন ভালো ছেলের মত,তোমার পায়ের কাছে শুয়ে তোমার পদযুগল আঁকড়ে ধরল, যাতে আর না ছেড়ে যেতে পারো ওকে। মায়া কিছু কাড়াতে পারে বটে তোমাদের কুট্টুস বাবু। 


যাই হোক, যে কথা বলার জন্য এত্ত বড় প্রস্তাবনা,  তা হল, আশা করি তোমার মনে আছে, গতকাল রাতে শ্রীমান কুট্টুসের নৈশভোজ দেখে আমি হুমকি দিচ্ছিলাম, এবার থেকে যাদের প্রতি আমার প্রেম উছলিয়া উঠবে তাদের ডেকে কুট্টু ভোজ খাওয়াব- আহাঃ কি অনুপমই হবে সে ভোজ।তৈলহীন, লবণ বিহীন মাংসের খিচুড়ির সাথে সীতা ভোগ আর রসোগোল্লার চটকানি। সমগ্র ব্যাপারখানা পর্যবেক্ষণ করে, আমাদেরই ক্ষুধামান্দ্য দেখা দিয়েছিল,আর ও তো বেচারী নেহাৎ পুঁচকে ছানা। 


আজ এদিকে উপুর্যান্তে বৃষ্টি পড়ছে, নৈশভোজ বলতে রুটি গতকাল রাতে তোমাদের জন্য রান্না করা সতীদেবীর মাংস থুড়ি সতীদেবীর রান্না করা মুর্গির মাংস। অথচ ঝুপঝুপে বৃষ্টি আর ঝোড়ো শীতল হাওয়ার এমন রাত কি জমে খিচুড়ি ছাড়া। যথারীতি রান্না করতে গিয়ে দেখি সবকিছুই বাড়ন্ত। তখন মনে পড়ল কুট্টুস ভোজের কথা। শুকনো খোলায় হাল্কা করে ভাজা মুগ ডাল(সোনা নয়, ইমিটেশন মুগ) আর সুফল বাংলার সিদ্ধ চাল, পরিমাণ মত লবণ আর হলুদ দিয়ে সিদ্ধ করে, তার সাথে মিশিয়েছি সতীদেবীর মাংস থুড়ি রান্না করা মুর্গির মাংস। মেশানোর আগে আলাদা কড়ায় ফুটিয়ে ফুটিয়ে বেশ ঘন তথা থকথকে বানিয়ে নিয়েছিলাম দুচার টুকরো আলু সমেত মাংটাকে। চুপি চুপি বলি, শনিবার রাতে রান্না করা পনীরের কয়েকটা টুকরো লুকিয়েছিল ফ্রীজের কোন গহীন কোণায়, তাদেরও মিশিয়ে দিয়েছি কুট্টু ভোজে। সব  মিলেমিশে, সিদ্ধ হবার মিলিয়ে নিয়েছি শুধু নুন আর মিষ্টির ভারসাম্যটুকু। আর ছড়িয়েছি পর্যাপ্ত ঘি-গরম মশলা। আমাদের তো আর কুট্টু বাবুর মত লোম ঝরে যাওয়ার ভয় নেই। বিশ্বাস করো খেতে জব্বর হয়েছিল। গতকাল রাতে এই নিয়ে তোমার আর অর্জুনের খিল্লী করার জন্য যৎপরনাস্তি দুঃখিত মাইরি। কুট্টুসের খাবারটা মোটেই খুব খারাপ নয়। 


পুনশ্চঃ- ডেজার্টে ছিল অর্জুনের আনা সীতাভোগ। যা দোকান চেঁচে মাত্র চারশগ্রাম আনতে পেরেছে বলে দুঃখে অর্জুনের হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছিল, অথচ তোমরা কেউ চারচামচও খেয়ে আমায় উদ্ধার করোনি। আজ ফ্রিজ সাফ করতে গিয়ে সন্ধ্যা বেলায় তিনি এবং গোটা দুই পুঁটকে রসোগোল্লা উদ্ধার হয়।ঠান্ডা আলমারিতে রাত্রিবাসের দরুন সীতাভোগটা কেমন যেন ফাটা পায়ের মত দেখতে লাগছিল মাইরি।   কুট্টু ভোজের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, মাইক্রোওয়েভ সেফ বোওলে পর্যায়ক্রমে ছানার পোলাও আর রস সমেত রসোগোল্লাদ্বয় মিশিয়ে ভালো করে ঘেঁটে দেড় থেকে দু মিনিট মাইক্রোওয়ভে ফুটিয়ে নিয়েছি। মন্দ হয়নি কিন্তু ব্যাপারটা। পরের বার এলে অবশ্যই খাওয়াব, শুধু তোমাদের। গতরাতে যাদের খাওয়াব মনস্থ করে লিস্টি বানিয়েছিলাম, তাদের আপ্যায়নের জন্য দেখছি অন্য রেসিপি খুঁজতে হবে। ইতিমধ্যে যদি তেমন কিছু তোমরা আবিষ্কার করো, তো অবশ্যই জানিও। যা দেখা তো দূর শুনলেই ক্ষুধামান্দ্য অবধারিত। 

 অনেক ভালোবাসা রইল,পারলে আবার এসো। জলদি জলদি। 


ইতি 

অনিন্দিতা(দি)

Thursday, 9 September 2021

ইতি অনিন্দিতা।

 তাং- ২৪শে ভাদ্র, ১৪২৮


ইয়ে বলছি কি না,


কালকের কথা গুলো আজ কেমন যেন বাসি হয়ে যায়, না বলা কথা গুলো কিছুতেই আর বলা হয়ে ওঠে না নৈমিত্তিক ব্যস্ততার চাপে। কখনই তাল মিলিয়ে আসে না অবকাশ উভয়ের দ্বারে। কখনও পরিবৃত থাকো তুমি, তো পর মুহূর্তে একই গল্প শোনাই আমি। এত কাজ বাপের জন্মে করেছি? কান্না পায় মাঝেমাঝে। অথচ কিছুই যেন গুছিয়ে করে উঠতে পারি না, অগোছালোই থেকে যায় সবকিছু। কিছুই কেন যে তোমার মত পারি না আমি।


সকালে ঘুম ভেঙেই যখন ফোন করেছিলে তুমি, তখন দম ফেলার ফুরসৎ ছিল না আমার। বিছানা তোলা, স্নান করতে যাওয়া, বাজার করার সাথে মিলেমিশে ঘন্ট পাকাচ্ছিলো শ্রীমতী তুত্তুরীর সিলেবাসের পাওয়ার পয়েন্ট-আবহাওয়া ও জলবায়ু আর গড়ের অঙ্ক। সামান্য যোগে ভুল করার  ক্ষমার অযোগ্য অপরাধে মাথা গরম করে, তোমাকে বলা হল না, ঠিক সেই মুহূর্তেই কি দারুণ সোনালী রোদ এসে পড়ছিল তোমার পূবের বারান্দায়। তোমায় জানানো হল না, আমার শুকিয়ে যাওয়া অপরাজিতা গাছে নতুন করে ডানা মেলেছে কিছু কচি সবুজ পাতা। তোমার কাছে অনুযোগ করা হল না, তোমাদের আবাসনের দুষ্টু কাঠবিড়ালি কি ভাবে সব পাতা ছিঁড়ে উলঙ্গ করে দিয়েছে আমার সাধের সিক্স মর্নিং গাছটাকে। কি সুন্দর ফুল ফোটাচ্ছিল কচি গাছটা। আক্ষেপ করা হল না তোমার কাছে, যে দৈনন্দিন ব্যস্ততায় কতদিন হয়ে গেল গাছে সার দেবার সময় হচ্ছে না আমার। তোমাকে দেখানো হল না, যখন ফোনটা রেখে দিলে তুমি, ঠিক তখনই আমাদের দাম্পত্য আলাপ শুনবে বলে ছাত থেকে টেলিফোনের তার বেয়ে সুড়সুড় করে নেমে আসছিল একটা ধেড়ে ইঁদুর। 


অফিস যাবার পথে যখন দুদণ্ড সময় পেয়ে ফোন করলাম তোমায়, আপাদমস্তক কাজে ডুবে তুমি। কতজন অপেক্ষা করছে তোমার একটু খানি সময়ের জন্য। চটজলদি ফোন রাখার চক্করে তোমায় শোনানোই হল না, আমার প্রিয়তমা বান্ধবীর সরকারি আবাসের দোতলার বাথরুমে হঠাৎ ঢুকে পড়া গোখরো সাপের কথা। বর্ষাকালে ব্যাঙ উঠত বটে, জলের পাইপ বেয়ে, পিছু-পিছু যে তিনিও আসবেন এটা কে জানত? তোমাকে শোনানোই হল না, আতঙ্কিত গিন্নিকে ছেড়ে অনুপ্রবেশকারী সাপের কুশল সংবাদ জানতে চাওয়ার অপরাধে বরটাকে ত্যাগই করবে বলে মনস্থ করেছে ও, ঐ যেমন মনস্থ আমরা দিনে অন্তত আড়াই বার নিয়ম মেনে করি আর কি-।


 এই তো সেদিনও প্রতিটি ঘটনার পুঙ্খনাপুঙ্খ বিবরণ শোনাতাম তোমায়, তীব্র অনাসক্তিতে বেঁকে যেত তোমার ভ্রু, ফুলে উঠত দুই গাল। করুণ চোখে অপেক্ষা করতে, কখন শেষ হবে আমার দৈনিক বৃত্তান্ত। আজ এই মধ্যরাতে, সুপ্ত কন্যার পাশে শুয়ে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে চিঠি লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে, কে জানে সেটা কোন যুগ ছিল সত্য, দ্বাপর না ত্রেতা! 


তোমায় জানানোই হল না, কাজের দরকারে করা ফোন না তোলায়, কাকে যেন কোন গ্রূপে 'পাক্কা হারামজাদা' বলেছি আমি। যাকে লিখলাম, সে দেখার আগেই প্রত্যক্ষ করলাম, সর্বপ্রথম মেসেজটার পাঠিকাও আমি স্বয়ং। কন্যা বিদ্যা গজগজ হবে বলে, সরকারী ফোনটা বাড়িতে রেখে আসি যে। ক্লাস করার নামে তিনি সারাদিন কি করেন,হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি মাইরি। অবিলম্বে যাবতীয় বন্ধুদের গ্রূপ থেকে নিজেকে থুড়ি নিজের ওই নম্বরটাকে হঠাতে হবে। মা হয়েছি বলে কি, প্রাণ খুলে দুটো বাজে কথাও বলা যাবে না মাইরি। কাল থেকে যদি বিশুদ্ধ তথা সংস্কৃত ভাষায় সংস্কৃতিমনস্ক আঁতেলদের মত বার্তালাপ করা শুরু করি, আমার প্রিয় বন্ধুরা যে তৎক্ষণাৎ আমায় ত্যাগ করবে গো- 


তোমার আদরের দুলালী,তুমি বদলী হয়ে যাবার পর থেকে যিনি ক্রমাগত ছাগলের মত, 'ব্যা-ব্যা' করেই চলেছেন, পড়তে বসতে বললেই, ছলছল আঁখি নিয়ে যিনি আপন মনে গুনগুন করেন, ' বাবার জন্য আমার আজ খুব মনটা খারাপ', সেই তিনি শুধু যে আমার একার ফোনটারই বারোটা বাজাচ্ছেন, তাই নয়, দায়িত্ব সহকারে আমার বাবা এবং মায়ের ফোনেরও যাবতীয় দৈনিক ডেটা খতম করছেন। দিনভর ফোন গুলি যে তাঁরই কুক্ষিগত থাকে, তা আমি বেশ বুঝতে পারি, যখনই, যে নম্বরেই ফোন করি, এ বাড়িতে ফোন তোলেন কেবল একজনই। 


 তোমাকে শোনানো হল না,  অফিস ফেরৎ মাকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে যাওয়ার গল্প। মাকে কেমন ধমকাল মায়ের ডাক্তার। যাকে ধমকালেন তিনি তো দিব্যি হাসাহাসি মুখে বসে রইলেন, মাঝখান থেকে আমি কেমন ব্যোমকে গিয়ে বেমালুম ফিজ না দিয়েই, আচ্ছা আসি বলে বেরিয়ে আসছিলাম। বকাবকি করে ক্লান্ত উনিও বলেই ফেলেছিলেন, 'হ্যাঁ আসুন।ভালো থাকবেন'।  ভাগ্যে মা বলল, ফিজটা দিতে। পথে শুনতে হল, 'মাথাটা কার খারাপ? আমার না তোর? পাগলের ডাক্তার কাকে দেখানো দরকার বলতো?'  


ভাবছ বোধহয় আজকের গল্প এইটুকুই, আজ্ঞে না স্যার, এখনো তো তোমায় শোনানোই হয়নি, জনৈক পুলিশের সাথে আমার আদরিণী ইন্সপেক্টরের ঝাড়পীঠের গল্প।' কিভাবে তিনটি জেলা দূর থেকে ফোনেই তার নিষ্পত্তি করলাম,তাও শোনাতে পারলাম না তোমায়। বাড়ি ফেরার পথে ঠাণ্ডা মাথায় পুলিশকে সামলে আমার লোকজনকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করলাম,তারপরও মা বলে কি না, 'পাগলের ডাক্তার কাকে দেখানো দরকার বল তো?' এত অপমান ধর্মে সইবে মাইরি? 


ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাতি ছাড়ালো। কাল আবার সাড়ে ছটায় দরজা পিটবে, আমাদের সোফিয়া মাসি। বাবা যার নাম দিয়েছে সোফিয়া লরেন। দরজা না খুলতে পারলে, ঝাড়পোঁছ এর দায়িত্বটাও চাপবে আমার ঘাড়ে। তোমার মেয়ের আর কি,ধুলো মেঝেতেই গড়াগড়ি যাবে। সারাদিন হয় নাচ্ছেন নয়তো মাটিতে গড়াচ্ছেন। আপাততঃ ঘুমাতে যাই। তুমি বোধহয় গভীর ঘুমে। চলো শুভরাত্রি। 


ইয়ে জানো তো, সায়নী বলেছে আমাকে বিনি পয়সায় একখান খরগোশ দেবে। এক জোড়া কিনেছিল, দেড় দু  মাস অন্তর পাঁচটা করে বাচ্ছা দিয়ে এখন সাকুল্যে পঁচিশ খান হয়েছে। তার থেকে একটা আমাকে ভালোবেসে দিতে চাইছে। তুত্তুরীও সেই শুনে ধেইধেই করে নাচ্ছে, তোমার অনুমতি নেওয়া হল না, হ্যাঁ গো, আনব নাকি একখান? 


ইতি 

অনিন্দিতা।

Sunday, 5 September 2021

অনির ডাইরি ১লা আগস্ট, ২০২১

 

মক্সো করেছিলাম বন্ধুদিবসে লিখব বলে, তারপর যা হয় আর কি, বিশ্বাসঘাতক সময় - । কোনদিনই খুব বেশী বন্ধুবান্ধব আমার ছিল না,আজও বন্ধু বলতে যাদের বদন মুদিত নয়নের সম্মুখে ভেসে ওঠে, তাদের সংখ্যা বেশ সীমিত। অন্তত জুকুদার ফেসবুক যে এগারোশ কত বন্ধু দেখাচ্ছে তার এক দশমাংশের থেকেও বেশ অনেকটাই কম। মোটামুটি সারাদিন যারা অনুপস্থিত থেকেও ঘিরে থাকে আমার দিনটাকে, তাদেরই বন্ধু বলে ধরি আর কি-। 


যাদের সকলকেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে হাড়ে হাড়ে চিনি, কারো কপালে সহকর্মীর ছাপ্পা তো কারো গায়ে সহপাঠী বা ক্ষেত্রবিশেষে সহযাত্রীর  উল্কি। ভালোমত চেনা পরিচয় না হলে আবার মৈত্রী হয় নাকি? 


মুস্কিল হল,এই চেনাবৃত্ত-চেনাছকের বাইরেও বেশ কিছু মানুষ ধূমকেতুর মত আচমকা প্রবেশ করেই বেরিয়েগেছেন আমার জীবনের কক্ষপথ থেকে, আর রেখে গেছেন একরাশ সৌহার্দ্যের সুখস্মৃতি। 


তা প্রায় বছর দশেক হল, তুত্তুরী তখন সদ্য পূর্ণ করেছে এক বৎসর। শিশুকন্যার দোহাই দিয়ে মহানগর পোস্টিং পেয়েছি।  চার্চ লেনের পাঁচ তলায় আপিস। বড়সাহেব মহঃ আমানুল হক। আপিস তো নয়, হাওদাখানা, দুবার ফোন চুরি হয়েছে খাস বড়সাহেবেরই, সবাই প্রায় বগলদাবা করে ঘোরে নিজের মুঠোফোন আর আলমারির চাবি। আর আমি এমনি ট্যালা, যে টেবিলে মোবাইল ফেলে ফাইল বগলে ঢুকেছিলাম বড় সাহেবের ঘরে। শুভাকাঙ্ক্ষী বড় সাহেবের পিতৃসুলভ ধমক খেয়ে ছুটতে ছুটতে নিজের চেম্বারে ঢুকে দেখি দিব্যি ফাইলের ওপর শুয়ে আড়ামোড়া ভাঙছেন তিনি। বেশী না মাত্র দুটো মিস কল এসেছে আমার অনুপস্থিতিতে।কোন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি দুবার ফোন করেছেন। 


সাধারণতঃ অচেনা নম্বরে ঘুরিয়ে ফোন করি না। কিন্তু কেন জানি না, সেদিন করলাম। ওপার থেকে এক প্রৌঢ় কণ্ঠ বলে উঠল, ‘হ্যালো অনিন্দিতা? আমি প্রসেনিজিৎ দা বলছি-’। তৎকালে প্রসেনজিৎ নামক দুজন ব্যক্তিকে কেবল চিনতাম, প্রথমতঃ দি প্রসেনজিৎ, সুপারস্টার। তিনি থোড়াই অধমের মত তুচ্ছ ব্যক্তিকে ফোন করবেন?


আর দ্বিতীয়জন সার্ভিসতুতো সিনিয়র দাদা শ্রী প্রসেনজিৎ কুণ্ডু ওরফে পিকে দা। তিনি মাঝেমধ্যেই ফোন করেন থুড়ি করতেন নানা কাজে। নম্বরটা অচেনা যদিও, সে তো হতেই পারে।ব্যস্ত কেজো সুরে জানতে চাইলাম, ‘ হ্যাঁ প্রসেনজিৎ দা বলো? তোমার ক্লেমের ফাইল স্যারের ঘরে। ’ ওপারের গলাটা কিঞ্চিৎ  থতমত খেয়ে বলল, ‘আরেঃ আমি প্রসেনজিৎ দা বলছি ব্যাঙ্ক থেকে। ’ ও হরি। ভুলেই গিয়েছিলাম। আমি আরেক প্রসেনজিৎকেও চিনি। তবে তাঁকে কোনদিন দাদা বলে ডাকা বা ভাবার ধৃষ্টতা  দেখাইনি। 


প্রৌঢ় ভদ্রলোকের সাথে ব্যাঙ্কেই আলাপ।কিছুদিন আগেই আমি গিয়েছিলাম অ্যাকাউন্টে ঠিকানা বদল করতে, যাঁর টেবিলে পাঠানো হয়েছিল, সেই সৌম্য দর্শন অতি গৌর বর্ণ প্রৌঢ়, আদতে ছিলেন অত্যন্ত সদাশয় তথা অমায়িক  ব্যক্তি। পাশে বসিয়ে, চা খাইয়ে স্নেহশীল ভঙ্গিমায় অনেক খোশগল্প করেছিলেন। না বলতেই কে ওয়াই সি ঠিক করে দিয়েছিলেন, আর সব কি কি করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘ আমার নম্বরটা নিয়ে যাও, কোন দরকার হলে ফোন করে দিও, কাজ হয়ে যাবে। কষ্ট করে আর আসতে হবে না। তবে যদি আসো, অবশ্যই এই বুড়োটার সাথে দেখা করে যেও।’


তাই করতামও। ফোন কখনও করিনি, তবে গেলে দেখা করতাম। বেশ কিছুদিন আর ব্যাঙ্কে যেতে হয়নি, তাই দেখাসাক্ষাৎও হয়নি। ভাবলাম তাই বোধহয় কুশল বিনিময় করতে ফোন করেছেন ভদ্রলোক। উৎফুল্ল স্বরে জানতে চাইলাম, ‘ও প্রসেনজিৎ বাবু আপনি? কেমন আছেন?’ ওপার থেকে ভেসে এল মৃদু ধমক, ‘কেমন আছি, পরে জানলেও চলবে। আগে বলো তোমার এটিএম কার্ডটা কোথায়?’ থতমত খেয়ে জানালাম, কার্ডটা যেখানে থাকার সেখানেই আছে, হাতব্যাগের ভিতর পয়সার থলের মধ্যে, ওণারই উপহার দেওয়া ব্যাঙ্কের নাম লেখা ‘ফ’ লেদারের পাউচের ভিতর। ওদিকের গলায় ফুটে উঠল, চাপা উত্তেজনা,‘ তাই নাকি? আমি ফোনটা ধরছি, তুমি খুঁজে দেখো তো। ’ 


হাতব্যাগ উপুড় করে টেবিলের ওপর ঢেলেও পেলাম না, এটিএম কার্ড। সবেধন নীলমণি একটিই অ্যাকাউন্ট,তার একমাত্র কার্ড। আমার সিন্দুকের চাবি। কি করি? রীতিমত আতঙ্কিত সুরে জানতে চাইলাম ফোন করে ব্লক করাব কি? করাতে হলেও বোধহয় কার্ড নম্বরটা লাগবে,যা আমার মুখস্থও নেই, কোথাও টোকাও নেই। 


ওদিক থেকে স্নেহময় বড়দার ধমক ভেসে এল, ‘কাল হাওড়া ময়দান থেকে টাকা তুলেছিলে?’ আলবাৎ তুলেছিলাম। বেশ মনে আছে টাকা তুললাম, টাকা গুণলাম,পয়সার থলে তে ঢোকালাম। থলেটা হাত ব্যাগে ঢোকালাম, তারপর মায়ের ভাষায় ধেইধেই করতে করতে বাড়ি গেলাম। উনি জানালেন, ওখানেই হয়েছে গড়বড়, টাকা গোণার সময়, ফ লেদারের পাউচে ভরা কার্ডটা রেখেছিলাম এটিএম কাউন্টারে। তারপর তাঁকে সেখানে রেখেই ধেইধেই- ।  


জনৈক ব্যক্তি পরে রাতে ঐ এটিএমে টাকা তুলতে গিয়ে কার্ড সমেত পাউচটা পান। উনি তৎক্ষণাৎ এটিএমের রক্ষীর কাছে সেটি জমা করতে উদ্যত হন, এই আশঙ্কায় যে,যার কার্ড সে হয়তো নিজের ভুল বুঝতে পেরে ছুটে আসবে। রক্ষী হাই তুলে দায়সারা ভাবে জানান,তিনি নিতে পারবেন না। হয় থানায় জমা করুন, নাহলে ওখানেই পড়ে থাকুক। যার কার্ড সে বুঝে নেবে। 


এত সহজে দায় ঝেড়ে ফেলতে পারেননি ভদ্রলোক, উনি তখন ফ লেদার পাউচটি ঘেঁটে দেখেন ভিতরে কোন ঠিকানা বা ফোন নম্বর আছে কি না। ছোট্ট চিরকৃটে প্রসেনজিৎ বাবুর স্বহস্তে লেখা ফোন নম্বরটি আমি ভাগ্যে ঐ পাউচটাতেই রেখেছিলাম, গতকাল রাত নটা নাগাদ ভদ্রলোক প্রসেনজিৎ বাবুকে ফোন করে সব জানান। কার্ডের নামটা শুনেই উনি চিনতে পারেন, কিন্তু আমার নম্বর না থাকায় আর ফোন করতে পারেননি। আজ আপিসে এসে, ডেটাবেস ঘেঁটে আমার নম্বর খুঁজে সকাল থেকে চেষ্টা করছেন যোগাযোগ করার। 


শুনে স্বস্তি পেলাম। সাথে সাথে ভদ্রলোকের নাম আর নম্বরটাও। প্রসেনজিৎ বাবু জানালেন, ভদ্রলোক কাল রাতেই ওণাকে জানিয়ে রেখেছেন আজ সারাদিন উনি কাজের জন্য হাওড়ার কোন প্রত্যন্ত গ্রামে থাকবেন, যেখানে টাওয়ার থাকবে না। ফলে রাত আটটা নটার আগে ওণাকে পাওয়া যাবে না। তখন ফোন করলে উনি জানাবেন কখন উনি কার্ডটা ফেরৎ  দিতে পারবেন। 


সত্যিই ওণাকে পাওয়া গেল না রাত নটা অবধি। টেনশনে কত সহস্রবার যে ডায়াল করলাম ওণার নম্বর। রাত নটার পর বাজল ফোনের রিং, ওপাশ থেকে ভেসে এল এক ক্লান্ত পুরুষকণ্ঠ। পরিচয় দিতেই , চিনতে পারলেন। মার্জনা চাইলেন এতক্ষণ ফোনে না পাওয়ার জন্য। জানালেন পেশায় ছোটখাট কন্ট্রাক্টর। কাজের ধান্ধায় প্রায়ই এমন দূরদূরান্তে যেতে হয়। আগামী কালও যেতে হবে। যদি আমি সকাল সকাল একটু হাওড়া ময়দানের ঐ এটিএমে আসি, তো উনি কার্ডটা আমায় দিয়ে যেতে পারেন। 


কৃতজ্ঞতায় বুঝে আসছিল গলা। কে বলে আমরা কলি যুগে বাস করি? এখনও কত যে সৎ মানুষ ছড়িয়ে আছেন, এই সমাজে। তাই না এতকিছুর পরও জিতে যায় মানুষ। নিশ্বাস চেপে কোন মতে কাটল রাত, ভোর ভোর পৌঁছালাম এটিএমে। ফোন করতেই এক সৌম্য দর্শন বছর ত্রিশের ব্যক্তি এগিয়ে এলেন, নমস্কার বিনিময়ের পর আমার কার্ডটা আমার হাতে দিয়ে ওণার শান্তি হল। তাড়া ছিল ওণার, তবুও দুদণ্ড কথা বললেন আমার সাথে। ভুল বললাম, আমিই বলে গেলাম একতরফা। জানালাম অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতা। জানালাম কি চাকরী করি আমি এবং শৌভিক, জানালাম এছাড়াও আছে বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব, যে কোন প্রয়োজনে উনি যেন নিঃসঙ্কোচে জানান আমাদের। এই উপকারের কোন প্রতিদান তো হয় না, তবুও চেষ্টা করব পাশে থাকার। উনিও কথা দিলেন, অবশ্যই জানাবেন। পরে বাড়ি ফিরে একই কথা জানিয়েছিলাম প্রসেনজিৎ বাবুকেও। মজার কথা হল না উনি কখনও কোন সাহায্য চেয়েছিলেন না প্রসেনজিৎ বাবু। দ্বিতীয় ব্যক্তির সাথে এরপরও বেশ কিছুদিন যোগাযোগ ছিল, প্রথমজনের সাথে আর কখনও যোগাযোগই হয়নি। 


নাই হোক দেখাসাক্ষাৎ, নাই থাকুক যোগাযোগ, ওই যে স্বর্গীয় চাণক্য বলে গেছেন না, বন্ধুত্বের প্রথম শর্তই হল বিপদে পাশে থাকা, এনারা যদি বন্ধু না হন, তাহলে আর বন্ধু কে? প্রতিটি বন্ধুদিবসে তাই একটি বার অন্তত স্মরণ করি এইসব মানুষকে, আর ইথার তরঙ্গে পাঠিয়ে দিই, একরাশ শুভকামনা। যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন। আপনাদের মত ভালো মানুষদের বড় দরকার এই পোড়া সমাজে।

Saturday, 21 August 2021

তুত্তুরী উবাচ ২১শে আগস্ট, ২০২১

 


👧🏻-মা, এই যে তুমি বললে না, পার হেড দুটো করে চিকেন বল, এখানে যদি রাবণ থাকত, তাহলে কি হত? দশটা হেডের জন্য দুটো করে, একাই কুড়িটা বল খেয়ে নিত।  

👨🏻- রাবণ খেতো তো একটাই মাথা দিয়ে। 

👩🏻-(পাশ থেকে কৌতুকের সুরে) আর বাকি মাথা গুলো কি করত? তারা খেতে চাইত না বুঝি?

👧🏻-(উভয় পক্ষকে শান্ত করার ভঙ্গিতে) আরেঃ রাবণ এক-একটা গাল এক-একটা মাথায় খেত। 

👨🏻-(নিজের খাবারে মনঃনিবেশ পূর্বক, বিড়বিড় করে) ঐ জন্যই রাবণ এখানে নেই। থাকলে সবারটা একাই সাবড়ে দিত। 

👧🏻-(কিছুক্ষণ নীরবে খেয়ে) জানো তো বাবা, ঠাম্মাদাদু(পিতামহ) সেদিন বলছিল,‘ তুমি একদম তোমার বাবার মত কাঁটা-চামচ দিয়ে খাও। ’ তো আমি বললাম, ‘সে তো হবেই, আমি তো বাবার থেকেই শিখেছি। ’ তখন ঠাম্মাদাদু বলল, ‘তোমার বাবাকে কিন্তু কেউ শেখায়নি। তোমার বাবা সিনেমা দেখে শিখেছিল। ’ তখন আমি বললাম, ‘কিন্তু দাদু আমি তো অত সিনেমা দেখি না। ’ 

👩🏻-(পাশ থেকে ব্যঙ্গের সুরে) তারপর ঠাম্মাদাদু কি বলল, আর পড়াশোনা করতে হবে না, দিনরাত টিভি আর মোবাইল নিয়ে বসে থাকো। তাই তো?

👧🏻-না মানে, ঠাম্মা দাদু বলল, ‘তুমিও দেখো। যত দেখবে ততো শিখবে। ’ (কিঞ্চিৎ  প্রগলভ হয়ে) জানো তো বাবা,আমি ঠাম্মাদাদুকে বলেছি,‘আমি বাবার থেকে আর একটা জিনিসও শিখেছি, কি করে ওয়াইন গ্লাস ধরতে হয়। ’

👩🏻-(মা হতাশ গলায়) হয়ে গেল। তোর থেকে ও মোদো মাতাল হতে শিখেছে। 

👧🏻-(বিরক্ত হয়ে) আঃ উজ্জ্বয়িনীর হোটেলে ঐ গ্লাসে জল খেয়েছিলাম। মদ আমি খাই না। আর ঠাম্মাদাদুও বলল,‘ধরতে শিখেছ, কিন্তু খেতে শিখো না। ’

Friday, 20 August 2021

অনির ডাইরি ১৩ই আগস্ট, ২০২১

 


নামটা শুনেছিলাম বিয়ের আগেই। সে অনেককাল আগের কথা। এক যুগ তো বটেই, তারও বেশী। আইনানুগ বিবাহ হয়ে যাবার পর থেকেই শ্বশুরমশাইয়ের নির্দেশ ছিল, সপ্তাহান্তে একটি বেলা যেন আমি হবু শ্বশুরবাড়িতে কাটাই। গোঁড়া রক্ষণশীল পরিবার আমাদের, এসব সাহেবীয়ানায় ঘোর আপত্তি মায়ের। কিন্তু সদ্য কর্কটরোগাক্রান্ত শ্বশুরমশাইকে না বলার সাধ্য কার? 


অগত্যা প্রতি শনিবার, সামান্য বেলায় ঘুম ভেঙে মায়ের হাতের এককাপ চা খেয়েই উঠে বসতাম তেঘরিয়া মিনিতে। প্রাতঃরাশ না করে বসে থাকত বৃদ্ধ আর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র। তারপর হবু বরের হাতে সেঁকা কড়কড়ে টোস্টে জবজবে করে মাখানো মাখন দিয়ে প্রাতঃরাশ সারতাম তিনজনে। শাশুড়ী মা যথারীতি কিছুই খেতেন না। তবে আমাদের সাথে বসে গল্প করতেন অনেক। তেমনি একদিন শুনেছিলাম তাঁর কথা।  ‘কাল তোমার কাকিমারা সব এসেছিলেন- কেকা, স্বপ্না, সন্ধ্যা। ’ শুনলাম বটে, চিনলাম না কাউকে। পাশ থেকে হবু বর জানালো, 'এনাদের মধ্যে কেকা অর্থাৎ মণি কাকিমা হল তোমার বড় সাহেবের বউ।'


 বড় সাহেব অর্থাৎ মণিকাকা অর্থাৎ তৎকালীন অ্যাডিশনাল কমিশনার শ্রী অরুণকান্তি ভট্টাচার্য মহাশয়। বসের,বসেরও  বস।আমাদের সার্ভিসের সিনিয়রতম সদস্য। দূর থেকেই দেখেছি কেবল মিটিংএ। ডায়াসের ওপর রাখা মস্তচেয়ারে গম্ভীর মুখে বসে থাকতে। যিনি মুখ খুললে তো বটেই, গলা খাকরি দিলেও স্তব্ধ হয়ে যেত যাবতীয় গুঞ্জন। এহেন বড় সাহেবের ভ্রাতুষ্পুত্রের আমি ঘরণী হতে চলেছি- 


যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয়, কয়েক সপ্তাহ পরের এক শনিবার। দ্বিপ্রাহরিক মধ্যাহ্নভোজের মধ্যেই মণিকাকার ফোন, কোথায় যেন বেরিয়েছিলেন সস্ত্রীক, পথে একবার ঢুঁ মেরে যাবেন তাঁর আদরের ছোটদার বাড়ি। শুনে তো এঁটো হাতেই বাড়ির বাস ধরি আমি, কান ধরে বসালেন শ্বশুরমশাই, ‘আরেঃ এত ভয়ের কি আছে? অফিসের চৌহদ্দির মধ্যে উনি তোমার বস্। বাড়িতে তো নয়। এখানে শুধুই মণিকাকা। ’ 


দরজার বেল বাজল। স্টাডিরুমে সিঁটিয়ে  আছি আমি, কিছুতেই যাব না, এত বড়,মস্ত বড় সাহেবের সামনে। বসার ঘর থেকে ভেসে এল কার যেন রিনিরিনি কণ্ঠস্বর, ‘ওমা ভয় পাচ্ছিস কেন? আয় আয় দেখি।’  চৌকাঠের অপর পারে এক অপরূপা মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা। মাথায় অবশ্য আমারই মত ছোট্টখাট্ট, ধপধপে গায়ের রঙ। চোখে সরু ফ্রেমের চশমা। পরণে গুজরাতি কাজ করা সুতির শাড়ি আর ঠোঁটে মোহন হাসি। সেই দণ্ড থেকে মণিকাকা স্যার রয়ে গেলেন বটে, ম্যাডাম হয়ে গেলেন মণি কাকিমা। 


অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ের পরদিন আয়লা মাথায় নিয়ে প্রবেশ করলাম শ্বশুরবাড়ি। সর্বত্র এক হাঁটু জল। ঝড়ের দাপটে ছিঁড়েছে ইলেক্ট্রিকের তার, আছড়ে পড়ছে গাছের পর গাছ। পথে আটকে পড়েছে বাকি আত্মীয়স্বজনেরা। বধূবরণ করবে কে? পূর্ববঙ্গীয় নিয়মনীতি কিছুই তেমন জানেন না শাশুড়ী মা, ভয়েই অস্থির। উপস্থিত শুধু মণিকাকা আর কাকিমা। আজ মধ্যরাতে, নিকষ আঁধারে ঘেরা এই বাংলোর বারন্দায় বসে বারবার মনে পড়ছে সেইদিনটার কথা, আমায় বরণ করে ঘরে তুলেছিল মণিকাকিমা। 


ঝড়ে কাঁপছে কলকাতা, সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মনখারাপের বোঝা। ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে, ডুগরে-ডুগরে কাঁদছি শুধু আমার মায়ের জন্য। চিরকালই বাবার মেয়ে আমি। মা যেন বড় বেশী নিঃসঙ্গ, হয়তো অবহেলিতও।  প্রতিটা পলে মনে পড়ছে, কবে কি দুর্ব্যবহার করেছি মায়ের সাথে,শুনিয়েছি কি কটু কথা আর সরু ব্লেড দিয়ে যেন কেউ চিরে দিচ্ছে হৃদপিণ্ডটাকে। বড় আদরের পুত্রবধূ আমি, আমার কান্না সহ্য হয় নাকি বৃদ্ধ শ্বশুরের। অসহায় শ্বশুরমশাই গিয়ে ধরলেন মনিকাকিমাকে,‘কেকা মেয়েটাকে থামাও। ’ হাত ধরে ঘরের বাইরে টেনে আনল মনিকাকিমা,‘ তুই খামোকা কাঁদছিস কেন আমায় বল? আমরা কি এতই খারাপ লোক?’ 


না মণি কাকিমা, মোটেই খারাপ নও, বরং ভীষণ ভীষণ ভালো তোমরা। আমরা অর্থাৎ আমি এবং উমা অনেক ভাগ্য করে পেয়েছিলাম তোমাদের সবাইকে। বিয়ের জন্মলগ্ন থেকে শ্বশুরবাড়ি সুলভ কোন অনুভূতি কখনও জাগতে দাওনি তোমরা। কখনও ভিন্ন চোখে দেখোনি এবাড়ির মেয়েদের আর বউদের। পুঁচি, বুজান, দুষ্টু,সোনাইয়ের থেকে যে আলাদা অনিন্দিতা আর উমা, তা কখনও মনে হয়নি আমাদের। আজও হয় না। ভুলেই যাই আমরা ভট্টাচার্য বাড়ির মেয়ে নই, বধূ।  


এইভাবে, এত জলদি তোমার চলে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না মণিকাকিমা। কল্পনাও করতে পারছি না মণিকাকার মানসিক অবস্থা। বাইরে থেকে বড় রুঠা মণিকাকা, একদম তোমার উল্টো। স্থিতধী।  কিন্তু ভিতরটা যে বড় নরম, নইলে ঠিক চারদিন আগে, লিখত না মণিকাকা যে, ‘সামান্য বেপরোয়া হলেই যিনি আমাকে শাসন করতেন, তিনি এখন অর্দ্ধ-চেতন। অসহ্য এ-স্বাধীনতা।’ সেদিন সর্বান্তঃকরণে প্রার্থনা করেছিলাম, সুস্থ হয়ে ওঠো তুমি। সেজেগুজে মিষ্টি হেসে আবার এসে দাঁড়াও সবার মাঝে, আমার মতই বরণ করে নাও আমার উত্তরসূরীদের। সব প্রার্থনা কেন যে সত্যি হয় না।

অনির ডাইরি ১৫ই আগস্ট, ২০২১

 


‘এই খানেই গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়েছিলেন না শহীদ মাতঙ্গিনী হাজরা?’ প্রশ্ন করল শৌভিক। শ্যাওলা ধরা এক বাঁধানো পুকুরের ধারে সবে দাঁড়িয়েছে শৌভিকের গাড়ি। পুকুরের একধারে সাদা রঙের দোল মঞ্চ বা নহবৎ খানার মত একখান ইমারত, যার বুক এফোঁড়-ওফোঁড়  করে চলে গেছে পিচের রাস্তা। ঐ রাস্তা ধরেই হেঁটে যেতে হবে আমাদের। এটাই আজ আমদের তিন নম্বর গন্তব্যস্থল।  সেই সকাল সোয়া আটটা থেকে শুরু হয়েছে পতাকা উত্তোলন পর্ব। 


সবার আগে শৌভিকের নিজের দপ্তরে। শুনেছি জেলা যখন যখন অবিভক্ত মেদিনীপুর ছিল তখনও এখানেই বসতেন তমলুকের মহকুমা শাসক। পিছনে লাগানো বোর্ড অনুসারে আমার বর তমলুকের ৮০তম মহকুমা শাসক। জেলা যখন ভাগ হল, তখন তড়িঘড়ি এই অফিসের ওপর তোলা হল নতুন মঞ্জিল। আর মহকুমা শাসকের দপ্তর রাতারাতি ভোল বদলে হয়ে গেল জেলা শাসকের করণ। এই তো সেদিন পর্যন্ত এই আপিসেই বসতেন জেলা শাসক। নিমতৌড়ির ঝাঁ চকচকে নতুন কালেক্টরেট তো জীবন পেয়েছে গত বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে। আর পুরাতন মহকুমা শাসকের দপ্তর হয়েছে পুনর্মুষিক ভবঃ।  


নিমতৌড়ির কালেক্টরেটে ঠিক নটার সময় পতাকা তুলবেন মাননীয় জেলা শাসক মহোদয়, সেখানে হাজিরা দিয়ে তমলুক জেল। গাল ভরা নাম, তমলুক সাব-কারেকশনাল হোম। দণ্ডাজ্ঞা  প্রাপ্ত আসামী নয়, কেবলমাত্র বিচারাধীন বন্দীরাই এই হোমের বাসিন্দা। পদাধিকার বলে তমলুকের মহকুমা শাসক আবার এই জেলের সুপারও বটে। জেলের প্রতি আমাদের বংশানুক্রমিক দুর্বলতা। রীতিমত দাগী পরিবার বলতে পারেন। স্বর্গীয় পিতামহ তো জেল খেটেছেন খাস মান্দালয়ে, তস্য ভ্রাতা জেল খেটেছেন, 'ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়' আন্দোলন করতে গিয়ে। জেঠু জেল এড়িয়ে যেতে পারলেও, পারেনি বাবা এবং ছোটকাকু। নকশাল পিরিয়ডে হাজতবাসের কথা বলতে বলতে আজও কেমন যেন স্মৃতিমেদুর হয়ে ওঠে বাবা। 


শৌভিক জেলে পতাকা তুলবে, শুনেই অনুরোধ করেছিলাম, যদি সঙ্গী হিসেবে গণ্য করে এ অধমে। জবাবে শুনেছি, জেলের নিয়ম ভীষণ কড়া। প্রবেশাধিকার অত্যন্ত দুর্লভ। এমনকি সুপার হওয়া সত্ত্বেও, সশস্ত্র দেহরক্ষীকে বাইরে রেখে ঢুকতে হয় আমার বরকেও। তবুও মেয়ে- বউয়ের আব্দার বলে কথা, সসঙ্কোচে জেলার সাহেবকে অনুরোধ করেছিল শৌভিক, যদি আর কি- 


জেলের বাইরেই সাজানো ছিল শহীদ বেদী। গেরুয়া- সাদা-সবজে আবিরে আঁকা এবং লেখা, '৭৫ তম স্বাধীনতা দিবস।' প্রতীক্ষায় ছিলেন জেল কর্মীরা। সুপার পৌঁছাতেই শুরু হল, অভিবাদন। তারপর পতাকা তোলা, জাতীয় সঙ্গীত গাওন। তারপর হাজিরা খাতায় সই করে, ভিতরে ঢোকা।


 তেরঙা বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে জেল। বানানো হয়েছে মস্ত শহীদ বেদী। তাকে সাজানো হয়েছে ফুল আর আবির দিয়ে। শহীদ বেদীকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পুরুষ কয়েদিরা। পুষ্পস্তবক, ব্যাজ নিয়ে আমাদের স্বাগত জানাতে এগিয়ে এলেন মহিলা বন্দিনীদের দল। সংখ্যায় বেশ কম। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে দেখে অবাঙালি মনে হয়, চপচপে করে তেল দিয়ে বাঁধা খোঁপা, সিঁথিতে ডগডগে লাল বা মেটে সিঁদুর। হিজাব পরা রমণীও আছেন। আর আছে কয়েকটি তরুণী কন্যা। যে মেয়েটি ফুলের তোড়া দিল বা ব্যাজ আটকাল,  জেলের প্রটোকলের ভয়ে তার নাম ছাড়া আর কিছুই জানতে পারলাম না। শুনলাম ২০১৮ সাল থেকে বিচারের প্রতীক্ষায় জেলে আছে মেয়েটি। কি অপরাধে কে জানে? আর এক মহিলা জানালেন ওনার হাজতবাসের মেয়াদ শুরু সেই ২০১৬ থেকে। কে জানে মুক্তি কবে, আর কি সংবাদ বয়ে আনবে সেই মুক্তির বাতাস। 


বক্তৃতা দিতে উঠে এটাই বলল শৌভিক, ' আজ স্বাধীনতা দিবস, আর স্বাধীনতার অর্থ সেই জানে, এক লহমার জন্য হলেও ক্ষুণ্ন হয়েছে যার স্বাধীনতা। আজকের দিনটির তাৎপর্য তাই আপনাদের থেকে বেশি কেউ বুঝবে না।' 


জেলের অধিবাসী এবং বাসিনীদের সঙ্গে সামান্য সময় কাটিয়ে, একরাশ শুভেচ্ছা আর শুভকামনা বিলিয়ে আমরা চলেছি তৃতীয় গন্তব্যের অভিমুখে। জনৈক স্থানীয় সমাজ সেবী খোদ নিমন্ত্রণ করেছেন শৌভিককে। 


 ধুতি আর খদ্দরের পাঞ্জাবি আর মুখে ডবল মাস্ক পরে ভদ্রলোক সটান হাজির হয়েছিলেন শৌভিকের চেম্বারে। দোতলায় উঠে হাঁফাতে হাঁফাতে বলেছিলেন, 'আমার বয়স ৮২ বছর, আমি অমুক শিশু নিকেতনের সাথে জড়িত। একটু যদি স্বাধীনতা দিবসের দিন দয়া করে আমাদের হোমে পদধূলি দেন।' ওনার বয়স শুনেই এককথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল আমার বর। 


শিশুনিকেতন থেকে বেশ খানিক দূরে শ্যাওলা ধরা পুকুর পাড়ে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে যেতে হয়। বগলে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ ঝুলিয়ে, খদ্দর পরা বৃদ্ধ নিজে অপেক্ষা করছিলেন আমাদের জন্য, সঙ্গে এক অপেক্ষাকৃত বৃদ্ধতর ব্যক্তি। শৌভিককে সপরিবারে পেয়ে কি যে অসীম খুশি দুই বুড়োতে। নিজেরাই কোথা থেকে বয়ে আনলেন প্লাস্টিকের চেয়ার, নিষেধ করার আগেই তাদের দিলেন স্যানিটাইজার দিয়ে স্নান করিয়ে। তারপর পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন, ' একটু বসুন আজ্ঞে।' বিশাল হোমটা আপাততঃ খাঁ খাঁ করছে। করোনার জন্য বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে শিশুদের। তবুও কি উৎসাহ দুই বৃদ্ধের। তিনতলা তুলবেন, পাশের ফাঁকা জমিতে তুলবেন নতুন বিল্ডিং। জেলাশাসককে ধরে পাশ করিয়েছেন প্ল্যান।পেয়েছেন স্যাংশনও। টাকাও ঢুকে যাবে কিছুদিনের মধ্যে। বেলা এগারোটার পিঠ পোড়ানো রোদে, ঘুঘু পাখির ডাক শুনতে শুনতে, কড়া মিষ্টি দেওয়া দুধ চায়ে চুমুক দিতে দিতে শোনালেন কত যে গল্প,শোনালেন এক দামাল ছেলের গল্প।  পাশেই হ্যামিল্টন স্কুলে পড়ত সে ছেলে। তখন এই অঞ্চল ঢাকা ঘন জঙ্গলে। পড়ত থোড়াই, কেবল দস্যিবৃত্তি করে বেড়াত। গাছের মগডাল থেকে পেড়ে আনত ফলের গোছা, ঝপাং করে ঝাঁপ দিত পুকুরে। মাছ ধরে, ঘুড়ি উড়িয়ে দিব্যি কাটছিল দিন,তারপর কি যে হল- হঠাৎ একদিন বদলে গেল ছেলেটা। ঘুড়িলাটাই ফেলে তুলে নিল পিস্তল। তারপর কি যে হল, আর বয়স বাড়ল না ছেলেটার। ইতিহাস তাকে আজও চেনে শহীদ ক্ষুদিরাম বলে। 


 ইতিহাসই তো, তমলুক শহরের অলিতে গলিতে ছড়ানো শুধুই ইতিহাস। নাঃ ওই পুকুর পাড়ে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়েননি বটে শহীদ মাতঙ্গিনী হাজরা। পড়েছিলেন আর একটু দূরে। সেদিন ওনার সাথে তমলুক শহরের বিভিন্ন রাস্তায়, মোড়ে গুলি বিদ্ধ হন আরো ১১জন মানুষ। আর পাশের মহিষাদলে আরো ১৩ জন। এই টুকু ছোট্ট শহরে সেদিন যথার্থই বয়েছিল রক্তগঙ্গা, সে গল্প শুধু জানে সময়, আর জানে চারণ কবিরা।তবে তারাই বা আজ কোথায়? 


 চলে আসার সময়, দুই বৃদ্ধ বারবার অনুরোধ করলেন, ‘আবার আসবেন, আর যদি পারেন দুটো কাজের লোক খুঁজে দেন আজ্ঞে। আমাদের যা বয়স হয়েছে, এই বুড়ো হাড়ে আর পারি না গো আমরা। কোন দিন সেরিব্রাল হয়ে মরে যাব দেখবেন আজ্ঞে।কত জনকে বললাম, একটু দায়িত্ব নে বাবারা, তা এরা তো কেউ ঘাড়ই পাততে চায় না স্যার।’

অনির ডাইরি ২০শে আগস্ট, ২০২১

 


বাড়ির বিয়ের আনন্দই আলাদা।  বিশেষ করে আমাদের মত অভাগাদের জন্য, যাদের জীবনের শেষ বিয়েবাড়িটা বোধহয় ২০১৯ এ পড়েছিল। নাকি ২০১৮? তা কি আর মনে আছে বাপু।  


প্রায় এক বচ্ছর আগে থেকে চলছে পরিকল্পনা, পাল্টা পরিকল্পনা। কি পরব, কবে পরব। কি আছে, কি কিনতে হবে ইত্যাদি। কেন জানি না, প্রতিটা বিয়ে বাড়ির আগেই আমার মনে হয়, না তো পরার মত ভালো শাড়ি আছে, না মানানসই গয়না। বললেই চশমার ওপারে গোলগোল হয়ে যায় শৌভিকের চোখ। আলমারি ভর্তি, ওগুলো কি তাহলে? বরের কথা বাদ দিন। বরেরা অমনি বলে। 


পাড়ার হাবিব এর অমিতের একটা মেকআপ চ্যানেল আছে, তাতে অমিত নিজেই মেকআপ করে আপলোড করে সুন্দর সুন্দর ছবি আর ভিডিও। দেখে মেয়েরা পাগল হয়ে যায়, আর অচেনা পুরুষ সিংহের দল গাল দেয় ‘ছক্কা’ বলে। আমি অবশ্য অমিতের গ্রাহক নই, আমার মাথায় অমিতকে হাতও দিতে দেয় না সুরজিৎ, তবুও গেলেই ফাঁকফোকর খুঁজে গল্প করে অমিত। দেখায় ওর করা মেকআপের ছবি। আর বলে, ‘তুমি এসো, তোমায় আমি ডিসকাউন্টে করে দেবো। তোমার রেফারেন্সে কেউ এলেও-’। 


পিসতুতো দেওরের বিয়ে ঠিক হতেই তাই অমিতকে বলে রাখি, আগামী আগস্টে আমার বিয়ে বাড়ি। দেওর-ননদদের আর মাত্র জনা কয়েকেরই আইবুড়ো নাম খণ্ডানো বাকি। তাই ভালো করে সাজতে গুজতে তো হবেই। সম্পর্কে পিসি শাশুড়ী হলেও,বিয়ের জন্মলগ্ন থেকেই মণিকে নিজের পিসির মতই পেয়েছি  আমরা দুই বউ অর্থাৎ উমা আর আমি। যেহেতু উমার থেকে বেশ কিছুটা বড় আমি, এসেছিও বেশ কিছু বছর আগে, তাই আমার সাথে পিসিমণির সম্পর্কটা কিছুটা বন্ধুত্বপূর্ণও বটে। আর পিসেমশাই থুড়ি ছোটে কাকা তো আমাদের ডার্লিং। শ্বশুরবাড়িতে এসে থেকে এত ভালোবাসা পেয়েছি এই ভদ্রলোকের কাছ থেকে লিখতে গেলে আদ্র হয়ে ওঠে হৃদয়। আমাদের দুই বউয়ের বিয়েই হোক বা শ্রীমতী তুত্তুরীর অন্নপ্রাশন বা ভট্টাচার্য বাড়ির কোন শুভকাজই হয় না এই দম্পতি বিনা। তাদের জীবনের সবথেকে বড় শুভকাজ, এতে অনুপস্থিত  থাকলে গর্দান থাকবে নাকি? 


রীতিমত প্যাড পেন্সিল নিয়ে বসে হিসেব করি উমা আর আমি, কবে কি রঙ পরব। দুজনের আলমারির শাড়ি মিলিয়ে চলে হিসেব নিকেশ, আমারটা তুই পরিস,তোরটা আমি- তাহলে কি হবে? আর গয়না? অমিত বুদ্ধি দেয়, ওসব সোনারূপা ছাড়ো, বাগড়ি মার্কেট থেকে গয়না কিনে আনো। যেমন ফিনিশ তেমনি সস্তা। প্লানও বানাই আমরা দুই অসমবয়সী বধূ, ৪৬ নম্বর বাসে করে গিয়ে, বকুলতলা বা রাইটার্সের কাছে নেমে, পায়ে হেঁটে বাগড়ি মার্কেট যাব আমরা। আর দর করব কোমর বেঁধে। 


তার পরপরই ঘটে যায় কত্ত কি-। বেরিয়ে যায় শৌভিকের মহকুমা শাসকের অর্ডার, হাসপাতালে ভর্তি হয় মা, আর কলেজে নতুন সেশনের অ্যাডমিশনের দায়িত্বটা পুরোই চাপে টুকলু অর্থাৎ আমার আদরের দেওরের কাঁধে। বরের সঙ্গে দুর্গাপুর রওণা দেয় উমা। ঘেঁটে যায় যাবতীয় পরিকল্পনা, মাথায় ওঠে বাগড়ি মার্কেট, তুমি আমায় ডোবালে আর তুই আমায় ডোবালির দ্বন্দ্বে কে যে কাকে মির্জাফর বলব ভেবে পাই না আমরা। 


এরই ফাঁকফোকর গলে, এক ফোঁটা সময় বার করে, এক বর্ষণ মুখর দুপুরে পিসিমণির বাড়ি হামলা করি দুই বউয়ে। যাবার পথে উমাকে নিয়ে যাই ছুঁচ ফুটিয়ে, মহা বদ ব্যাটা, ভ্যাকসিন না নিয়ে বসে থাকা! চেনে না তো আমায়। গাড়িতে গোটা রাস্তা ভয় দেখাতে দেখাতে নিয়ে যায় উমা, ‘দিদিভাই, আমার কিন্তু মাথা ঘুরছে। জ্বর আসছে, কাশি আসছে-’। সত্যি সত্যি ভয় পেলেই হেসে গড়িয়ে পড়ছে, কি জ্বালা।  


পিসিমণির দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রার তেরোটা বাজিয়ে ঘেঁটে দেখি আমরা নতুন বউয়ের নতুন নতুন শাড়ি,কুর্তি, গয়না, আশির্বাদী হার আর ফুলশয্যার আংটি। প্ল্যাটিনামের ওপর জ্বলজ্বলে এক কুচি হীরে দেখে মোহিত হয়ে বাড়ি ফিরি আমরা। কোভিড বিধি মেনে বিয়ে, বিয়ের রাতের প্রথম পঞ্চাশের মধ্যে নেই আমরা, থাকবই বা কেন, প্রথম পঞ্চাশের অর্ধেক তো কনের বাড়ির লোকজনই থাকবেন আর বাকি অর্ধেকে অগ্রগণ্য বয়োজ্যেষ্ঠরা। তাতে কি? বাড়ির বিয়ে বলে কথা- বিয়ের দিন সকালটা তো আমাদের, আছে বধূবরণের দিন সকালটাও আর বৌভাতের রাত। বৌভাতের সকালে বউয়ের হাতের ঘি ভাত বা পায়েসের ওপর অধিকার বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠদের। রাতটা অবশ্য আমাদের কুচোকাঁচাদের। আমাকে কুচোকাঁচাদের মধ্যে ধরার জন্য বিগলিত হয়ে যাই মাইরি। 

প্রতি মুহূর্তে বদলায় কবে ‘কি পরব তালিকা“। গায়ে হলুদে হলুদ পরাই রীতি, কিন্তু মায়ের সাদা গোলিপী মুগা যে বড় নজর কাড়ে। শুনে একটা অফ হোয়াইট শাড়ি বার করে বসে উমাও। শুনেই আঁতকে ওঠে পিসিমণি,পাগল নাকি, কে কোথায় হলুদ লাগিয়ে দেবে শাড়িতে, ও দাগ আর জম্মে উঠবে। ধ্যাৎ তেরি।  শেষ পর্যন্ত কমলা একখান শাড়ি মনোমত হয় বটে, শেষ পরেছিলাম কোন একবছর মেলায় যেন। ঠিক কমলা না পেলেও একটা চুনেহলুদে রঙ খুঁজে বার করে উমা। 


সব হিসেব করে গুছিয়ে তমলুকের উদ্দেশ্যে রওণা দিই আমি। হতাশ পিসিমণি আর উমাকে আশ্বস্ত করি বারবার, বিয়ের দিন সকালে ঠিক হাজির হব নটার মধ্যে, সে আমি যেখানেই থাকি না কেন। মাঝপথে কোথায় যে হারিয়ে ফেলি নথটা, শুনে উল্লসিত হয়ে ওঠে উমারাণী, ‘বেশ হয়েছে দিদিভাই।  আমি সাতসকালে ন্যূনতম সেজে যাবারও সুযোগ পাব না, আর তুমি পরবে নথ-’। আরেঃ সে সাজিয়ে দেব খন আমি,যা যা লাগবে বুঝিয়ে বলে দিই আনতে। 


সময়মতো পেয়েই যাই নথটা খুঁজে,বিয়ের দিন পৌনে ছটায় উঠে, ঘুমন্ত মেয়েকে টেনে তুলে স্নানিয়ে সাজিয়ে সাড়ে সাতটায় বেরিয়ে পড়ি, শুধু এক কাপ চা খেয়েই। আঃ বাড়ির বিয়ে বলে কথা। নটা দশের মধ্যে পৌঁছে খুঁজি উমাকে। কোথায় গেল মেয়েটা? সময়মতো ঢুকতেও পারে না? আজব অপদার্থ মাইরি। আমি তমলুক থেকে বালি এলাম, আর মহারাণী কলকাতা থেকে আসতে পারে না। বেলা বাড়ে, গায়ে হলুদের তেলের পাত্র আর হলুদের বাটি ধরানো হয় আমায় আর তুত্তুরীকে। পইপই করে বুঝিয়ে দেন পিসিমণির ননদ, মুন্নি পিসি,‘অনিন্দিতা ঠিক সে সমঝো, পহলে গণেশ জী নামবেন। তারপর তেলের ঘটি, তারপর পানপাতা দিয়ে সাজানো, হলুদ আর মেহেন্দির পাত্র।’ তাকে ঘিরে রাখা সবুজ কাঁচের চুড়ি হাতে পরবে নববধূ। দীর্ঘদিন বঙ্গদেশের অধিবাসী, বাঙালী রমণীর পতি তবুও আদতে তো উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা পিসেমশাইয়ের পূর্বপুরুষ। কাশীর কাছে ওণাদের ‘পুস্তেইনি হাভেলী’ আজো বর্তমান আভিজাত্যের চিহ্ন কাঁধে। ছবি দেখিয়েছিল ছোটেকাকা থুড়ি পিসেমশাই। যদিও কাজের দরকারে গোবলয়ে গেলে লোকে ওণাকে বাঙালী বলেই মনে করে। বিয়ের পর থেকে ছোটেকাকা পিসিমণির হাতের উচ্ছে চচ্চড়ি আর কুমড়োর ঘ্যাঁটই খেয়ে আসছেন, ইস্টবেঙ্গলকে সাপোর্ট করেন এবং সুযোগ পেলেই আমাকে ঘটি বলে খ্যাপান। তুমুল রেগে গেলে বলেন, ‘আমি কি বাঙালী রে?আমার কাছে তোরাও যা, ওরাও তাই। ’ মহা সুবিধাবাদী ভদ্রলোক মাইরি।  


ঝমঝমে বৃষ্টি মাথায় গাড়িতে উঠি মা আর মেয়ে। ছোটে কাকা নালিশ করে যায়, ‘উমারা বেলুড় চলে গেছে-’। যেন উমার অভিভাবক আমি। গাড়ি আর ছাড়ে না, অন্যান্য গাড়িগুলিতে তত্ত্ব তোলা হতেই থাকে, সাড়ে নটা নাকি চল্লিশ, দরজা খুলে মুখ বাড়ায় ভীতু ভীতু এক জোড়া চোখ। ‘দিদিভাই!’ শুনেই রাগ ধরে যায়। ভাগো ইঁয়াসে। এই গাড়িতে জায়গা হবে না। 'আচ্ছা' বলে ভয়ে ভয়ে অন্য গাড়িতে জায়গা খুঁজতে যায় উমা। বাঃ দারুণ মেয়ে তো। একবার না বলে দিলেই চলে যায়? জানে না আমার রাগের স্থায়িত্ব আড়াই মিনিট। আবার হাঁক পাড়ি আমি,‘থাক। আর অন্য গাড়িতে উঠতে হবে না। এটাতেই চেপে আমায় ধন্য করো। ’ চোরের মত গাড়িতে ওঠে উমা। পৌনে দশটা বাজে, এখনও ছাড়ে না গাড়ি, পাশ থেকে করুণ স্বরে প্রশ্ন করে তুত্তুরী, ‘মা তোমায় বকেছে, তাই তুমি আর আমার সাথে কথা বলবে না, না কাকিমা?’ আমাকে টপকে আদরও করতে পারে না উমা তার সোনাইকে। কোন মতে বলে, ‘না না। বলব তো।  আগে দিদিভাইয়ের মাথাটা একটু ঠাণ্ডা হোক। ’ 


মাথা ঠাণ্ডা তো তখন হবে, যখন জানা যাবে দেরীটা হল কেন? নির্ঘাত টুকলুই কিছু করেছে। তৈরী হতে সময় লাগিয়েছে,অথবা দেরী করেছে ঘুম থেকে উঠতে। হাঁহাঁ করে ওঠে উমা,’না দিদিভাই,ওর কোন দোষ নেই। তুমি তো শুনলেই না কি হয়েছিল।’ উফঃ এত পতিগত প্রাণা এই ভদ্রমহিলা। অতঃপর শুনতেই হয় দেরী পুরাণ। সামাণ্য ভুলে নির্ধারিত গলি ছাড়িয়ে চলে যাওয়া এবং ঘুরে আসার পথে গাড়ি খারাপ হয়ে যাবার গল্প শুনে মন খারাপ হয়ে যায় আমার। ইশ! কিছু  না জেনেই বকেছি গো মেয়েটাকে। প্রশ্রয় পেয়ে গলার জোর বাড়ে উমার,‘হ্যাঁ গো দিদিভাই, সে কি ধোঁয়া। আমরা তো ভাবলাম গাড়িতে আগুনই লেগে গেল। ড্রাইভার খালি বলে, আভি হো জায়েগা। শেষে মিনিট দশ পনেরো পর, ঐ বৃষ্টিতেই নেমে পড়লাম আমরা। ওকে বলা হল, তুই বাবা গাড়ি নিয়ে গ্যারাজে যা। সারিয়ে নিয়ে আয়। আর আমরা কোন মতে রাস্তা পেরিয়ে একটা টোটো ধরে ছুটতে ছুটতে আসছি। ’


অতঃপর আমার সাড়ে ৫২বার ক্ষমা চাওয়া আর পুরষ্কার স্বরূপ তত্ত্বের দই এর হাঁড়িখানা উমার কোলে চাপিয়ে দেয় ছোটে কাকা। বাপরেঃ কি ভারী গো, বললে ছোটেকাকা বোধহয় শুনতেই পায় না, এক গাল হেসে বলে, ‘দেখছিস কি সুন্দর হাঁড়িটা দেখতে। খাস অর্ডার দিয়ে আনানো বুঝলি। ওপরে কেমন গোপাল আছে দেখ,দেখ। ননী চোরা বালগোপাল। ’ মাথা নাড়ে উমা। বালগোপাল গোটা রাস্তা লক্ষ্মী হয়ে হাঁড়ির মাথায় বসলে বাঁচি, লাফিয়ে পালিয়ে গেলেই চিত্তির। আর আমার শাড়িতে যদি দই লাগে, তো হাঁড়িওয়ালিকে রাস্তাতেই নামিয়ে দেব কিন্তু হাঁড়ি সমেত। সাথে তার সোনাইকেও- হাসিমস্করায় ছাড়ে গাড়ি। আরো বারো বার সরি বলি আমি,আর ওরা দুটোতে বলে, ‘এবার অন্য কথা বললে হয় না। সরি সরি করে মাথা ধরিয়ে দিল মাইরি। ’ আঃ বাড়ির বিয়ে বলে কথা-