আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর, তাম্রলিপ্তের দায়িত্ব ভার গ্রহণের পর প্রথম মিটিং। আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম উৎকণ্ঠিত হওয়া নিষ্প্রয়োজন, এটা একেবারেই পরিচয় আদানপ্রদানের মিটিং। সবার সাথে প্রাথমিক আলাপটা অবশ্যি আগেই হয়েছিল, আমার দুই পূর্বসূরীর বিদায় সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে। সেদিন দুই বিদায়ী আধিকারিকদের জন্য যে হারে কান্নাকাটি করছিল এরা, আমার সাথে আলাপটা একেবারেই জমেনি। তাই ডাকা আর কি।
নভেম্বর মাস, ভাঁড়ে ভবাণী। তাই মিটিং শেষে নেহাৎ ছাপোষা চা-বিস্কুট। চা তো এল তার সাথে এল দারুণ সুন্দর একটা কাপ কেক। ঠিক যেমন রিলস্ গুলোয় দেখি। রঙ বেরঙের ক্রিমের মুকুট পরানো।হরেক রকম স্প্রিংকলস্ ছড়ানো। এত সুন্দর জিনিস এই মেদিনীপুরে কে বানাল? চা ওয়ালা? শুভাশিস হেসে বলল,‘না ম্যাডাম। শান্তনুর বউ বানিয়েছে। এটা শান্তনু খাওয়াচ্ছে সবাইকে।’ শুধু যে কেক গুলো দেখতে সুন্দর ছিল তা নয়,স্বাদেও ছিল জবরদস্ত। সবথেকে বড় কথা মিষ্টি একেবারে যথাযথ। আমাদের হাওড়া-কলকাতার তুলনায় এই জেলার লোক মিষ্টি একটু কম খায়। তরকারিপাতি ছাড়ুন, বার দুয়েক তো এমন কলাকাঁদ খেয়েছি যাতে চিনির সাথে সাথে মেশানো ছিল লবণও।
তো সেই প্রথম কেক চাখার দিন থেকে আমি শান্তনুর গিন্নির অনুরক্ত। ফরমাইশ মত বেশ কয়েকবার কেক বানিয়ে দিয়েছে শান্তনুর বউ। প্রতিবারই জিতে নিয়েছে সবার রসনা। শেষ নভেম্বরে বিবাহবার্ষিকী ছিল আমাদের এক পরম প্রিয় দম্পতির। শান্তনুকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম,‘তোমার বউ ছবিওয়ালা কেক বানাতে পারবে?’ জবাব পেলাম ঐ বাটার পেপারটা পাওয়া গেলেই পারবে। অতঃপর শান্তনু গেল ঐ বিশেষ কাগজ খুঁজতে আর আমি গেলাম মেয়েটির প্রোফাইল থেকে একখান সুন্দর ছবি খুঁজতে। যাতে কর্তাবাবু, গিন্নিমা আর তাদের চতুষ্পদী ছানা তিনজনেই থাকবে স্বমহিমায় বিদ্যমান। এমন ভাবে কাউকে কোনদিন ‘stalk’ করিনি মাইরি। মেয়েটির এবং ছেলেটির গোটা অ্যালবাম ঝাঁট দিয়ে ফেললাম, যতগুলো ভালো ছবি পেলাম সবকটাতে বাবুরা শুভেচ্ছা বার্তা লিখে রেখেছেন। অতি কষ্টে পৌনে একঘন্টার চেষ্টায় একখান ভালো বার্তা বিহীন ছবি পেয়েছিলাম সেবার। তবে কেকটা যা বানিয়েছিল শান্তনুর গিন্নী, একেবারে লাজবাব।
এবারেও তাই তুত্তুরীর জন্মদিনের আগে বলেছিলাম, শান্তনু একটা ভালো কেক বানিয়ে দিতে হবে। সেভাবে তুত্তুরীর জন্মদিন উপলক্ষে কোন অনুষ্ঠান কখনই করি না আমরা। যা হয়,যেটুকু হয় সেটা নিছকই পারবারিক। এবারে তো তারও উপায় নেই দাদু -দিদা বা ঠাম্মা-দাদুর যা শারিরীক অবস্থা, কেউ তমলুক আসতে পারবে না। কাকার কর্মসূত্রে ফুলঝুরি সমেত কাকিমাও আপাততঃ দুর্গাপুরে। সপ্তাহের মাঝে এষাদের ডাকার কথাও চিন্তা করা যায় না। তাই এমনিতেই তুত্তুরীর মন খারাপ। বারবার বলছিল, ‘মা কেকটাও কি কাটা হবে না?’ বাচ্ছাদের যে কি কেকের প্রতি টান ভগবান জানে।
কথাটা তুলেছিল আমাদের উত্তমকুমার, ‘হায় ম্যাডাম, তুত্তুরীর জন্মদিন, আর আমাদের অফিসে কিছু হবে নি?’ হলেই হয়। শান্তনু কেক তো বানাচ্ছেই, তাহলে দুটো বানাও বরং। একটা একেবারে ক্রিম ছাড়া আর একটা তোমার যা খুশি। তুত্তুরীর বাপের ক্রিম কেকের ওপর জন্মবিরাগ। তাই ক্রিম ছাড়াটা আমি বাড়ি নিয়ে যাব আর ক্রিমওয়ালাটা অফিসে কাটা হবে। শুধু কি কেক খাওয়াব লোকজনকে? মিষ্টির সাথে নোনতা কিছু থাকবে নে কো? আমাদের ক্যাথলিন বা মিও আমোরের মত তমলুক নগরীর বিখ্যাত বেকারী হল বিদ্যুৎ বেকারী। তাই বললাম কেকের সাথে বিদ্যুৎবেকারী থেকে কিছু আনলে হয় না?
জহরবাবু বললেন, ‘ম্যাডাম ঠাণ্ডা?’ ঠাণ্ডা অর্থাৎ কোল্ড ড্রিঙ্ক। এই আপিসে ১২মাসই ঠাণ্ডা সেবন চলে। ওটাকে আমি বলি চুঙ্গি কর। কেউ ভালো জামা পরে এলে থামস্ আপ খাওয়াতে হয়। কেউ নতুন জুতো পরে এলে স্প্রাইট। এ ছাড়াও কেউ ঘড়ি পাল্টালে, কেউ চুল কাটলে, অফিস টাইমে কারোর বন্ধু দেখা করতে এলে ইত্যাদি প্রভৃতি চুঙ্গি আদায় চলতেই থাকে। চুঙ্গি দিতে আমারও আপত্তি নেই। তবে আর থামস্ আপ বা স্প্রাইট নয় রে বাবা। একটু অন্য স্বাদের ঠাণ্ডা হোক না। উত্তমকুমার বলল জিরু হোক। আরও অনেকে অনেক রকম মত দিল বটে, শেষ পর্যন্ত হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়ে জিতল লিমকা আর ফ্যান্টা।
সাথে একটা করে গরম গরম চিকেন স্প্রিং রোল আর কাঠি কাবাব। বিদ্যুৎ বেকারীর কাঠি কাবাব যাকে বলে, ‘ওয়ার্ল্ড ফেমাস ইন তমলুক।’ একখান লম্বা কাঠির ডগায় গোটা দুয়েক চিকেন,বেশ কয়েকটি পেঁয়াজ টুকরো গেঁথে কোন মোটা ব্যাটারে চুবিয়ে ভাজা। ভাবতেই জিভে জল। সবকিছু আগের দিন ঠিক করে বাড়ি ফিরলাম, ঐদিনটি যদিও আনুষ্ঠানিক ভাবে ছুটি নিয়েছিলাম, তবুও অফিস যাব। একটু বেলা হবে। জন্মদিনেও ইস্কুল যাবেন শ্রীমতী তুত্তুরী, তাঁকে স্কুল থেকে ফেরৎ নিয়ে তবে যাব।
সাড়ে চারটে নাগাদ সকন্যা আপিসে পৌঁছে হকচকিয়ে গেলাম একেবারে। আমার চেম্বারটাকে চেনাই যাচ্ছে না। একবেলার অনুপস্থিতিতেই ভোল পাল্টে গেছে তার।হরেক রঙের বেলুনের আভরণে, ‘হ্যাপ্পি বাড্ডে’লেখা ব্যানারে তিনি হয়ে উঠেছেন অপরূপা। এসব কখন করলে রে? জিজ্ঞাসা করলে মুখ টিপে হাসে সবাই। একে একে সবার আগমনে ভরে ওঠে ঘর, কাপ কেক হাতে ডোনাল্ড ডাক ওয়ালা কেক দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় সবাই। অতঃপর কেক কাটার পালা। সযতনে ডোনাল্ড ডাকে বাদ দিয়ে কেক কাটতে উদ্যোগী হন শ্রীমতী তুত্তুরী, ঘিরে ধরে টিম তাম্রলিপ্ত নামক পরিবারের সদস্যবৃন্দ , এমন সময় সমবেত লোকজনকে সরিয়ে মুখ বাড়ান শ্রীমতী কচি। যাঁর ভালো নাম কুমারী সমাদৃতা জানা। আমাদের শুভদীপ্তর অসীম গুণবতী তথা নৃত্য পটিয়সী কন্যা। বিকাল চারটেয় স্কুল থেকে ফিরে, মুখহাত ধুয়ে সামান্য জলযোগ সেরেই তিনি হাজির হয়েছেন তুত্তুরী দিদির জন্মদিন পালন করতে।
আমাদের হক বাবু সামান্য লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলেন, ‘আপনাকে না জিজ্ঞাসা করেই ওকে আসতে বলেছি ম্যাডাম। শান্তনুর মেয়েকেও বলেছিলাম। সেটা এখনও ঘুমাচ্ছে। আপনি রাগ করলেন-’। হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না। হক বাবু আপনি কি খেপেছেন, এতদিনে আমায় এই চিনলেন? অথবা ঘুরিয়ে বললে বলতে হয়, আপনারা আমায় এই কদিনে কি ভীষণ ভালো চিনেছেন হকবাবু। কচিকাঁচা গুলো আসলে যে আমার আনন্দ বহুগুণ বেড়ে যাবে এটা আপনারা না বুঝলে বুঝবে কে।