Tuesday 9 August 2022

অনির ডাইরি ৩০শে জুলাই, ২০২২

 


আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর, তাম্রলিপ্তের দায়িত্ব ভার গ্রহণের পর প্রথম মিটিং। আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম উৎকণ্ঠিত হওয়া নিষ্প্রয়োজন,  এটা একেবারেই পরিচয় আদানপ্রদানের মিটিং। সবার সাথে প্রাথমিক আলাপটা অবশ্যি আগেই হয়েছিল, আমার দুই পূর্বসূরীর বিদায় সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে। সেদিন দুই বিদায়ী আধিকারিকদের জন্য যে হারে কান্নাকাটি করছিল এরা, আমার সাথে আলাপটা একেবারেই জমেনি। তাই ডাকা আর কি। 


নভেম্বর মাস, ভাঁড়ে ভবাণী। তাই মিটিং শেষে নেহাৎ ছাপোষা চা-বিস্কুট। চা তো এল তার সাথে এল দারুণ সুন্দর একটা কাপ কেক। ঠিক যেমন রিলস্ গুলোয় দেখি। রঙ বেরঙের ক্রিমের মুকুট পরানো।হরেক রকম স্প্রিংকলস্  ছড়ানো। এত সুন্দর জিনিস এই মেদিনীপুরে কে বানাল? চা ওয়ালা? শুভাশিস হেসে বলল,‘না ম্যাডাম। শান্তনুর বউ বানিয়েছে। এটা শান্তনু খাওয়াচ্ছে সবাইকে।’ শুধু যে কেক গুলো দেখতে সুন্দর ছিল তা নয়,স্বাদেও ছিল জবরদস্ত। সবথেকে বড় কথা মিষ্টি একেবারে যথাযথ। আমাদের হাওড়া-কলকাতার তুলনায় এই জেলার লোক মিষ্টি একটু কম খায়। তরকারিপাতি ছাড়ুন, বার দুয়েক তো এমন কলাকাঁদ খেয়েছি যাতে চিনির সাথে সাথে মেশানো ছিল লবণও। 


তো সেই প্রথম কেক চাখার দিন থেকে আমি শান্তনুর গিন্নির অনুরক্ত।  ফরমাইশ মত বেশ কয়েকবার কেক বানিয়ে দিয়েছে শান্তনুর বউ। প্রতিবারই জিতে নিয়েছে সবার রসনা। শেষ নভেম্বরে বিবাহবার্ষিকী ছিল আমাদের এক পরম প্রিয় দম্পতির। শান্তনুকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম,‘তোমার বউ ছবিওয়ালা কেক বানাতে পারবে?’ জবাব পেলাম ঐ বাটার পেপারটা পাওয়া গেলেই পারবে। অতঃপর শান্তনু গেল ঐ বিশেষ কাগজ খুঁজতে আর আমি গেলাম মেয়েটির প্রোফাইল থেকে একখান সুন্দর ছবি খুঁজতে। যাতে কর্তাবাবু, গিন্নিমা আর তাদের চতুষ্পদী ছানা তিনজনেই থাকবে স্বমহিমায় বিদ্যমান। এমন ভাবে কাউকে কোনদিন ‘stalk’ করিনি মাইরি। মেয়েটির এবং ছেলেটির গোটা অ্যালবাম ঝাঁট দিয়ে ফেললাম, যতগুলো ভালো ছবি পেলাম সবকটাতে বাবুরা শুভেচ্ছা বার্তা লিখে রেখেছেন। অতি কষ্টে পৌনে একঘন্টার চেষ্টায় একখান ভালো বার্তা বিহীন ছবি পেয়েছিলাম সেবার। তবে কেকটা যা বানিয়েছিল শান্তনুর গিন্নী, একেবারে লাজবাব।


এবারেও তাই তুত্তুরীর জন্মদিনের আগে বলেছিলাম, শান্তনু একটা ভালো কেক বানিয়ে দিতে হবে। সেভাবে তুত্তুরীর জন্মদিন উপলক্ষে কোন অনুষ্ঠান কখনই করি না আমরা। যা হয়,যেটুকু হয় সেটা নিছকই পারবারিক। এবারে তো তারও উপায় নেই দাদু -দিদা বা ঠাম্মা-দাদুর যা শারিরীক অবস্থা, কেউ তমলুক আসতে পারবে না। কাকার কর্মসূত্রে ফুলঝুরি সমেত কাকিমাও আপাততঃ দুর্গাপুরে। সপ্তাহের মাঝে এষাদের ডাকার কথাও চিন্তা করা যায় না। তাই এমনিতেই তুত্তুরীর মন খারাপ। বারবার বলছিল, ‘মা কেকটাও কি কাটা হবে না?’ বাচ্ছাদের যে কি কেকের প্রতি টান ভগবান জানে।  


কথাটা তুলেছিল আমাদের উত্তমকুমার, ‘হায় ম্যাডাম, তুত্তুরীর জন্মদিন, আর আমাদের অফিসে কিছু হবে নি?’ হলেই হয়। শান্তনু কেক তো বানাচ্ছেই, তাহলে দুটো বানাও বরং। একটা একেবারে ক্রিম ছাড়া আর একটা তোমার যা খুশি। তুত্তুরীর বাপের ক্রিম কেকের ওপর জন্মবিরাগ। তাই ক্রিম ছাড়াটা আমি বাড়ি নিয়ে যাব আর ক্রিমওয়ালাটা অফিসে কাটা হবে। শুধু কি কেক খাওয়াব লোকজনকে? মিষ্টির সাথে নোনতা কিছু থাকবে নে কো? আমাদের ক্যাথলিন বা মিও আমোরের মত তমলুক নগরীর বিখ্যাত বেকারী হল বিদ্যুৎ বেকারী। তাই বললাম কেকের সাথে বিদ্যুৎবেকারী থেকে কিছু আনলে হয় না?


 জহরবাবু বললেন, ‘ম্যাডাম ঠাণ্ডা?’ ঠাণ্ডা অর্থাৎ কোল্ড ড্রিঙ্ক। এই আপিসে ১২মাসই ঠাণ্ডা সেবন চলে। ওটাকে আমি বলি চুঙ্গি কর। কেউ ভালো জামা পরে এলে থামস্ আপ খাওয়াতে হয়। কেউ নতুন জুতো পরে এলে স্প্রাইট। এ ছাড়াও কেউ ঘড়ি পাল্টালে, কেউ চুল কাটলে, অফিস টাইমে কারোর বন্ধু দেখা করতে এলে  ইত্যাদি প্রভৃতি চুঙ্গি আদায় চলতেই থাকে। চুঙ্গি দিতে আমারও আপত্তি নেই। তবে আর থামস্ আপ বা স্প্রাইট নয় রে বাবা। একটু অন্য স্বাদের ঠাণ্ডা হোক না। উত্তমকুমার বলল জিরু হোক। আরও অনেকে অনেক রকম মত দিল বটে, শেষ পর্যন্ত হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়ে জিতল লিমকা আর ফ্যান্টা।


 সাথে একটা করে গরম গরম চিকেন স্প্রিং রোল আর কাঠি কাবাব। বিদ্যুৎ বেকারীর কাঠি কাবাব যাকে বলে, ‘ওয়ার্ল্ড ফেমাস ইন তমলুক।’ একখান লম্বা কাঠির ডগায় গোটা দুয়েক চিকেন,বেশ কয়েকটি পেঁয়াজ টুকরো গেঁথে কোন মোটা ব্যাটারে চুবিয়ে ভাজা। ভাবতেই জিভে জল। সবকিছু আগের দিন ঠিক করে বাড়ি ফিরলাম, ঐদিনটি যদিও আনুষ্ঠানিক ভাবে ছুটি নিয়েছিলাম, তবুও অফিস যাব। একটু বেলা হবে। জন্মদিনেও ইস্কুল যাবেন শ্রীমতী তুত্তুরী, তাঁকে স্কুল থেকে ফেরৎ নিয়ে তবে যাব। 


সাড়ে চারটে নাগাদ সকন্যা আপিসে পৌঁছে হকচকিয়ে গেলাম একেবারে। আমার চেম্বারটাকে চেনাই যাচ্ছে না। একবেলার অনুপস্থিতিতেই ভোল পাল্টে গেছে তার।হরেক রঙের বেলুনের আভরণে, ‘হ্যাপ্পি বাড্ডে’লেখা ব্যানারে তিনি হয়ে উঠেছেন অপরূপা। এসব কখন করলে রে? জিজ্ঞাসা করলে মুখ টিপে হাসে সবাই। একে একে সবার আগমনে ভরে ওঠে ঘর, কাপ কেক হাতে ডোনাল্ড ডাক ওয়ালা কেক দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় সবাই। অতঃপর কেক কাটার পালা। সযতনে ডোনাল্ড ডাকে বাদ দিয়ে কেক কাটতে উদ্যোগী হন শ্রীমতী তুত্তুরী, ঘিরে ধরে টিম তাম্রলিপ্ত নামক পরিবারের সদস্যবৃন্দ , এমন সময় সমবেত লোকজনকে সরিয়ে মুখ বাড়ান শ্রীমতী কচি। যাঁর ভালো নাম কুমারী সমাদৃতা জানা। আমাদের শুভদীপ্তর অসীম গুণবতী তথা নৃত্য পটিয়সী কন্যা। বিকাল চারটেয় স্কুল থেকে ফিরে, মুখহাত ধুয়ে সামান্য জলযোগ সেরেই তিনি হাজির হয়েছেন তুত্তুরী দিদির জন্মদিন পালন করতে।


  আমাদের হক বাবু সামান্য লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলেন, ‘আপনাকে না জিজ্ঞাসা করেই ওকে আসতে বলেছি ম্যাডাম। শান্তনুর মেয়েকেও বলেছিলাম। সেটা এখনও ঘুমাচ্ছে। আপনি রাগ করলেন-’। হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না। হক বাবু আপনি কি খেপেছেন, এতদিনে আমায় এই চিনলেন? অথবা ঘুরিয়ে বললে বলতে হয়, আপনারা আমায় এই কদিনে কি ভীষণ ভালো চিনেছেন হকবাবু। কচিকাঁচা গুলো আসলে যে আমার আনন্দ বহুগুণ বেড়ে যাবে এটা আপনারা না বুঝলে বুঝবে কে।

তুত্তুরীর দ্বাদশ জন্মদিন



 সময় বয়ে যায়, এক যুগেরও পার। এই তো মনে হয় সেদিনের কথা, প্রথম মোলাকাৎ তার সাথে। আর্কেডিয়ার উজ্জ্বল হলুদ রঙা ঘর, মাথার ওপর ঘুরন্ত ঘরঘরে পাখা, কপালে বয়স্ক ডাক্তারবাবুর স্নেহশীল হাত, কানে মৃদু রসিকতা, “হ্যাঁরে, তা শুনলাম তুই নাকি লেবার কমিশনার- আমাকে একটা চাকরী দিবি মা?” বলতে গেলাম কতকিছুই, বলার ছিলও অনেক কথা- পারলাম কই? জোড়া ফুসফুসের দখলদার তখন অচেনা কোন দৈত্য। এক ঝলক বাতাসের জন্য হাঁকপাঁক করতে করতে, ক্রমেই চোখের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল ঘোলাটে এক আস্তরণ- এমত ক্ষণে, সব পর্দা ফর্দাফাই করে ভেসে এল কার যেন হুঙ্কার-  প্রবীণ ডাক্তারবাবু সহর্ষে বলে উঠলেন, “বাপরেঃ না ভূমিষ্ঠ হতেই কি গলার জোর- শুনলি? শুনলি কি? তোর মেয়ে চিৎকার করছে, শোন।”  


 শৌভিকের সাথে বাইরে অপেক্ষা করছিল দিদিভাই-দাদাভাই- দাদারা- ছোট মাসি আরও যেন কারা কারা,  “প্রায় ফুটবল টিম ছিলাম আমরা” কৌতুকের সুরে গল্প শুনিয়েছিল শৌভিক। সবার শেষে এসেছিল আমার বাবা, পিতৃসুলভ আবেগে গদগদ হয়ে শৌভিক আজও বলে, “শ্বশুরটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল খুব”। মেয়ে নয় তো, শৌভিকের ইচ্ছাশক্তির জয় হয়েছিল সেদিন- বারবার বলত, “বুজু হবে। বুজু আসছে।”  কাঁচের ঘরের ভিতর থেকে নার্স দিদি দেখিয়েছিল ছোট্ট ঘুমন্ত বুজুটাকে, তারপরই পায়ের আঙুলে মেরে ছিল টকাস করে এক টোকা। কাঁচের দেওয়ালের ওপার থেকে ভেসে এসেছিল গগনভেদী হুঙ্কার। এপাশে অলক্ষ্যে দাঁত কিড়মিড় করেছিল বাবাও, খামোকা আমার মেয়েটাকে কাঁদায় কেন এরা, দুষ্টু লোক। দাদু অবশ্য হুঙ্কার শুনেই নাম রেখেছিল জগজ্জননী থুড়ি নজদগজনী।    


প্রথম দিকে বয়স মাপা হত দিনে, বাইশ দিনের মাথায়, এক কলসি পাউডার মাখিয়ে, তোয়ালে মুড়ে কি যেন একটা ইঞ্জেকশন দিতে নিয়ে গিয়েছিল মা আর দিদিভাই। ডাক্তারদিদির কড়া নিষেধ ছিল, তবুও ছোট্ট পায়ের পাতায় নিটোল কাজলের ফোঁটা এঁকেছিল জ্যাঠাইমা। সূঁচ ফোঁটাতেই নাকি ডাক্তার দিদিকে, “অ্যাও” বলে জব্বর ধমকেছিল তুত্তুরী। 


 দিনের হিসেব পাল্টে গেল সপ্তাহে। শিকারী বেড়ালের মত আসেপাশে ঘুরঘুর করত বুল্লু দাদা, ঘর ফাঁকা দেখলেই সনির্বন্ধ  অনুরোধ করত কচি গলায়, “একটু বোনিকে দাও না গো পিসি, একটি বার আমার কোলে দাও-”। একটু বড় হতেই, বোনির ডানা পাখনা গজাল, অনুমতির তোয়াক্কা না করেই দেড় পায়ে হামা টেনে টেনে দৌড়ত দাদার পিছু পিছু। একজনের দুধে দাঁত আর অন্যজনের ফোকলা হাসির ফাজলামিতে, উল্লাসে ফেটে পড়ত ব্যাঁটরার চাটুজ্জে বাড়ি। 


 সপ্তাহের হিসেব টপকে এল মাস, ঘুরল বছর। প্রথম জন্মদিনে মামমামের কোলে চেপে দাদুর হাতে পায়েস খাওয়া- রাতের বেলা হামলে পড়ে খাপলে খাওয়া জীবনের প্রথম চকলেট কেক। দ্বিতীয় জন্মদিনে বিশেষ কারণবশতঃ ছুটি পাইনি আমি। আমার অনুপস্থিতিতে আটকায়নি কিছু, পঞ্চব্যঞ্জন সাজিয়ে নাতনীর মুখের সামনে ধরেছিল মা। কোলে বসিয়ে পায়েস খাইয়েছিল  বাবা। ছুটি নিয়ে দৌড়ে এসেছিল শৌভিকও। সন্ধ্যে বেলা বাড়ি ফিরে ছবি দেখেছিলাম। মেয়ের জন্মদিন পালনের ছবি। তেচাকা সাইকেলে চড়ে দুধের বোতল হাতে ঝুমরো-ঝুমরো চুলে পোজ দেওয়া তুত্তুরী। 


 তৃতীয় জন্মদিনের কেকটার ওপর দুটো সাদা ক্রীমের হাঁস ছিল। কেক না কেটে, পরম হরষে হাঁসগুলোকে জবাই করেছিল তুত্তুরী। চতুর্থ জন্মদিনটা ছিল আমাদের ফ্ল্যাটে পালন করা প্রথম জন্মদিন। নাতনীর জন্য বেলুন ফুলিয়ে ফুলিয়ে বুকে ব্যথা হয়ে গিয়েছিল আমার বাবার। তখনও লিফট বসেনি,হাঁপানি রুগী হওয়া সত্ত্বেও নাতনীর জন্য হেঁটে চারতলায় উঠেছিলেন শ্বশুরমশাই। শুধু কি তাই, তুত্তুরীর জন্য টুপিও পরেছিল সবাই, ঝকমকে রাংতার টুপি। 


 পঞ্চম জন্মদিনে মেঘ ভাঙা বৃষ্টিতে ভেসে গিয়েছিল মহানগর। কোথায় যেন বেড়াতে গিয়েছিলাম আমরা- ষষ্ঠ জন্মদিনের আগে ডিপথেরিয়া বাঁধিয়েছিল তুত্তুরী। ষষ্ঠ জন্মদিনের আগে আরও একটা ঘটনা ঘটেছিল। তুত্তুরীর জীবনের অংশ হয়েছিল এষা আর অর্জুন। আজও মনে আছে যেচে পড়েই ফোন করেছিল এষা,‘এই দিদি, সামনেই তো তুত্তুরীর জন্মদিন-’।  ব্যাস ঐটুকুই, আর বলতে হয়নি। আর বলেও না এষা। প্রতি জন্মদিনের আগে একবার করে তাজ্জব হয়ে যায় শৌভিক, ‘এষাটাকে কে বলল?’ প্রতিবার একই জবাব দিই আমি,‘ এষাটাকে কি বলতে লাগে?’। এষা আর তুত্তুরীর মধ্যে অনুপ্রবেশের অধিকার কি আদৌ আমার আছে? না শৌভিকের আছে? একে এষায় রক্ষে নেই,তার ওপর আবার অর্জুন আর কুট্টুস দোসর। 


  সপ্তম জন্মদিনে প্রথম বার হাজিরা দিয়েছিল কাকিমা। নবম জন্মদিনে কেঁদেকেটে রেসিডেন্সিয়াল ট্রেনিং ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলাম আমি। দশম জন্মদিনে কোভিড আক্রান্ত  হয়েছিলাম তুত্তুরী আমি। সম্পূর্ণ গৃহবন্দী অবস্থায় পালিত হয়েছিল তুত্তুরীর জন্মদিন। একাদশতম জন্মদিনের আগে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল মা। প্রায় একপক্ষ ধরে চলেছিল যমে মানুষে টানাটানি। তারই মধ্যে মহকুমা শাসক হয়ে মহানগর ছাড়তে হয়েছিল শৌভিককে।  


আজ তাঁর দ্বাদশ জন্মদিন। বিগত এক বছরে বদলে গেছে অনেক কিছুই। নিজের বাড়ি, নিজের পাড়া, নিজের শহর ছাড়তে হয়েছে তুত্তুরীকে। ছাড়তে হয়েছে ছোট্টবেলার স্কুল। ছাড়তে হয়েছে প্রিয়তমা বান্ধবীকে। তাও থমকায়নি তুত্তুরী। হতোদ্যম হয়নি তুত্তুরী।  দাদু তাকে শিখিয়েছে যে, ‘সারভাইভাল অব দা ফিটেস্ট’। পরিবর্ত পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে না পারলে যে পিছিয়ে পড়তে হয়, আর যার নামই পুরোযা, সে তো পিছিয়ে পড়তে পারে না। পুরোযা মানেই যে অগ্রবর্তিনী বা পথপ্রদর্শিকা। 

 

 ভালো থেকো পুরোযা। লক্ষ্মী মেয়ে নয়, বরং লক্ষ্মী বাঈ হয়ে জমিয়ে মোকাবিলা করো জীবনের, তোমার জন্য ভালোমত একটা পৃথিবী রেখে যেতে পারব না হয়তো,তবে পৃথিবীর জন্য একজন জবরদস্ত জগজ্জননী রেখে যাব, এটাই থাকুক অঙ্গীকার।

অনির ডাইরি ২৫শে জুলাই, ২০২২



‘আমি বোধহয় আর চাকরী পাব না, জানো-’। শুকনো মুখে বলেছিল মেয়েটা। একের পর পর চাকরির পরীক্ষা দিয়েই যাচ্ছিল মেয়েটা। আরও ভালো করে, আরও মনযোগ দিয়ে পড়ছিল মেয়েটা। বড় কষ্টে মানুষ মেয়েটা। প্রত্যন্ত গাঁয়ের মেয়ে, গ্রামের স্কুলের পাঠ চুকিয়ে, নিকটস্থ মফঃস্বল ঘুরে উচ্চ শিক্ষার জন্য মহানগরের বাসা গড়েছিল  মেয়েটা। ডিগ্রী পাবার পর আর সময় নষ্ট করেনি, টুকটাক কাজ করে, টিউশনির পাশাপাশি পুরোদমে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল একটা চাকরীর জন্য। অধ্যাপিকা হবার স্বপ্ন দেখত মেয়েটা। না হলে হাইস্কুলের শিক্ষিকা। এমনকি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা হতে পারলেও খুশি হয়ে যেত মেয়েটা। একা একা শহরতলীতে থেকে কাজ আর পড়াশোনা চালাত। গাঁয়ে অপবাদ দিত নিন্দুকের দল। নির্ঘাত কিছু খারাপ কাজ করে, নাহলে মহানগরের এত মধু কিসের। সেসব কথা ছিটকে কানেও আসত মেয়েটার। ভেঙে পড়ত কখনও কখনও। গোঁত্তা মারতাম আমি। “কুছ তো লোগ কহেঙ্গে।” পড়াশোনাটা ছাড়িস না বাপু। পড়লে, খাটলে, চাকরী ঠিক হবে। আমাকে দেখছিস না। আমার বন্ধুদের দেখছিস না। চাকরী একটা পেতেই হবে। উপার্জন না করলে, এত পরিশ্রম, এত অপবাদ সহ্য করা, সব বৃথা। এই যে এত কষ্ট করলি, আর একটু ধৈর্য ধর। 


সেদিন রবিবার। আকাশের মুখ ছিল ভার। কেমন যেন থমথমে ছিল পরিবেশ। কি যেন পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। তলার দিকের অনেকে পেয়ে গেছে। মেয়েটার নাম নেই। লিস্ট এনে দেখাচ্ছিল মেয়েটা। ‘এই দেখ। এ তো কোয়ালফাই করতেই পারেনি। ও আমার থেকে অনেক অনেক পিছনে ছিল। এদের কি করে হয়ে গেল গো?’ জবাব দিতে পারিনি। তবে ধমকেছিলাম খুব। শুধু দুর্নীতি খুঁজলে হবে? হেরে গিয়ে বসে পড়লে, রণক্ষেত্র ছেড়ে পালালে হবে?খুব বড় মুখ করে বলেছিলাম, কেন চাকরী পাবি না? আমি তো পেয়েছি। আমরা তো পেয়েছি। মন দিয়ে পড়। পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই,আমার বাবা শিখিয়েছিল। 


আরোও কিছুদিন লড়েছিল মেয়েটা। আরও অনেকদিন লড়েছিল মেয়েটা। দিয়েছিল আরও কিছু পরীক্ষা। সেই একই গল্প, ভীষণ ভালো হয় পরীক্ষা। ফলাফল হয় বেরোয় না। আর বেরোলেও কারা যেন ভরে দেয় সব আসন। মেয়েটার হাতে থেকে যায় পেন্সিল। সংসারে মন দেয় মেয়েটা। এখানে কোন দুর্নীতির গন্ধ পায় না। শ্বশুর-শাশুড়ির নয়নমণি হয় মেয়েটা। স্বামীর পরম সুহৃদ, প্রেমের আধার হয় মেয়েটা। নবজাতক সন্তানের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে মেয়েটা। কেউ আজকাল আর ওকে বলে না, চাকরী কিন্তু পেতেই হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে। সবাই আশা ছেড়ে দিয়েছে। সবাই মেনে নিয়েছে, সবাই মানিয়ে নিয়েছে। শুধু আমি বলি। দেখা হলেই বলি। এভাবে ছেড়ে দিস না। এভাবে হেরে যাস না। নিজেকে ভুলে যাস না।নিজের পায়ে দাঁড়া, নিজের পরিচয় বানা। ক্লান্তি মাখা একটা হাসি ফুটে ওঠে মেয়েটার ঠোঁটে। হেরে যাওয়া হাসি। 


মেয়েটা তো তবু সাংসারিক আচ্ছাদনের আড়ালে ঢেকে নিয়েছে নিজেকে। কিন্তু ছেলেগুলো? তাদের কি হল? তারা কোথায় লুকালো? এ সমাজ যে বড় নির্মম, উপার্জনহীন পুরুষকে যে মানুষ গণ্য করে না। কেউ বোঝে না তাদের অপারগতা। কেউ শোনে না তাদের ব্যর্থতার গল্প। কেউ মানতে চায় না, সব দোষ তাদের নয়।


 জনগণের স্মৃতি শক্তি বড় দুর্বল, আজকের উত্তেজনা অচীরেই দখল করে নেবে আগামী কালের ভিন্নতর কোন উত্তেজনা। আসবে নতুন নটনটি আর কুশীলবের দল। সময়ের মেকআপে আজকের খলনায়ক আবার অবতীর্ণ হবেন নায়কের নাম ভূমিকায়। মক্ষিরানিদেরও অভাব হবে না। টিস্যু পেপারে কালিমা মুছে নির্ঘাত ফিরে আসবেন মাননীয় আপ্ত সহায়ক মহোদয়। ফেঁসে যাওয়া আর ফাঁসিয়ে দেওয়ার কত যে গল্প ঘুরবে সোশ্যাল মিডিয়ায়, গলা ফাটাবেন, সওয়াল- জবাব করবেন অভিযুক্তদের শুভানুধ্যায়ীদের দল। দুনিয়া চলবে নিজের গতিতে, দীর্ঘশ্বাস গিলে, দগদগে ক্ষতে সময়ের মলম লাগিয়ে, আবার কোমর বাঁধবে হারিয়ে দেওয়া ছেলেমেয়েগুলো। কোমর বাঁধবে নতুন কোন লড়াইয়ের জন্য। ভিন্নতর কোন যুদ্ধের জন্য। এবার যেন ওরা জেতে, সর্বান্তকরণে এই প্রার্থনাই করি। মাথা উঁচু করে বাঁচা এবং যোগ্যতা অনুযায়ী উপার্জনের অধিকার সকলেরই আছে। 

অনির ডাইরি ২৩শে জুলাই, ২০২২

 তুত্তুরী আর ফুলঝুরির গল্প -১



শ্রীমতী ফুলঝুরির আগমনের খবর শুনে মোটেই তেমন পুলকিত হয়নি তুত্তুরী। কাকিমার উদরের মধ্যে হঠাৎ কেউ মাথা চাড়া দিয়েছে, ব্যাপারটা প্রথম চোটে অবশ্য তেমন বোধগম্য হয়নি তুত্তুরীর। খুশির খবর পেয়ে বাড়ির সকলের সঙ্গে আনন্দে মত্ত হয়েছিলেন তিনিও। ধীরে ধীরে তিনি অনুধাবন করলেন, ও বাবা, আসন্ন অতিথি তো ভূমিষ্ঠ  হয়েই দখল করে বসবে কাকিমাকে। তুত্তুরী এবং তার কাকিমার মধ্যে অন্য কেউ, ব্যপারটা মোটেই পছন্দ হল না তার। ঠারেঠোরে এমনকি শেষ পর্যন্ত সোচ্চারে সেটা জানিয়েও দিলেন তিনি। শুনে মা আর কাকিমা তো হেসেই খুন। 


বেচারী কাকিমা প্রায় রোজই বলতে লাগল,‘ওরে না রে। তুই তো আমার প্রথম বাচ্ছা। তুই তো আমার প্রিয়তম বন্ধু। তোর জায়গা কি কেউ নিতে পারে?’ সাময়িক ভাবে গলে যায়, ভুলে যায় তুত্তুরী। আবার কেউ ঢুকিয়ে দেয় সন্দেহের বিষ, ‘তুমি বড় দিদি হয়ে যাবে। বেবি হলে তো কাকিমা তাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকবে।’ কিঃ আমার জন্য আর সময় থাকবে না কাকিমার হাতে? হে ঠাকুর এ কি হল- 


দেখতে দেখতে, বোঝাতে বোঝাতে,হাসতে হাসতে এসে যায় নির্দিষ্ট দিনটা। ধরা ধামে অবতীর্ণ হন জুনিয়র তুত্তুরী। হুঁশ ফিরতেই ছবি পাঠায় কাকিমা, ‘তুই তো বোনই চেয়েছিলি-’। সে বোধহয় কোন দুর্বল মুহূর্তে কাকিমার আদরে দ্রবীভূত হয়ে বলে ফেলেছিলেন শ্রীমতী তুত্তুরী, বোন হলে বেশি খুশী হবেন। কিন্তু ফুলঝুরি আগমনের খবরে তিনি ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে গেলেন মাইরি। ‘আমি কক্ষনো বোন চাইনি। আমি ভাই চেয়েছিলাম। দেখছ ও আসতেই কাকিমা আমার কথা ভুলে গেছে-’।  


বেচারী কাকিমা, সেলাই না শুকানোর যাতনায়, ছোট্টটার রাত জাগায়, ধেড়েটার অভিমানে হাবুডুবু খেয়ে মরে। কাকিমা আর তুত্তুরীর আভ্যন্তরীণ সম্পর্কে সাধারণতঃ জড়াই না আমি। কারণ কয়েকবার নাক গলানোর চেষ্টা করে দেখেছি, ব্যাটারা নিজেরা যতই মারামারি হাতাহাতি করুক, মাঝখানে আমার বা আমার নাকের উপস্থিতি উভয়েরই ঘোরতর নাপসন্দ।  তবে এক্ষেত্রে তো আর হাত গুটিয়ে বসে থাকা যায় না। 


তুত্তুরীকে শোনাই এমনি দুই জেঠতুতো-খুড়তুতো বোনের কথা। যাদের মধ্যে বয়সের ফারাক প্রায় তুত্তুরী আর ফলঝুরির মতই। রুনু-ঝুনুর গল্প।  দিদিভাই আর আমার গল্প। দিদিভাইয়ের অন্ধ অনুগামিনী ছিলাম আমি।  আমার চোখে সেরা রূপসী ছিল আমার দিদিভাই। তেরো বছরের বড় জেঠতুতো দিদির চলন,বলন, হাসি, সাজগোজ, নিপাট সাদাসিধে বোকা-বোকা প্রশ্ন সবকিছু অন্ধের মত নকল করতাম আমি। যত্ন না করা সত্ত্বেও মাছি পিছলে যাওয়া দিদিভাইয়ের পেলব ত্বকের দিকে কি হ্যাংলার মতই না তাকিয়ে থাকতাম আমি। কি প্রসঙ্গে যেন, কাকে একবার খুব সুন্দর দেখতে বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল দিদিভাই, তাজ্জব হয়ে গেছিলাম আমি। বলো কি? তোমার থেকেও সুন্দর? কেউ হতে পারে? অসম্ভব।  তখন কলেজে পড়ি, বড় মাসি একবার বলেছিল, 'তোকে দিনদিন রুণার মত দেখতে হয়ে যাচ্ছে।' রুণা অর্থাৎ আমার দিদিভাই। কি যে পুলকিত হয়েছিলাম সেদিন। রীতিমত উড়তে উড়তে বাড়ি ফিরেছিলাম মাটির আড়াই ইঞ্চি ওপর দিয়ে।


অন্ধের মত নকল করতাম, দিদিভাইয়ের চালচলন,বাচনভঙ্গী। আজও করি, চেতন এবং  অবচেতনে। গভীর চিন্তামগ্ন হলে যেভাবে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বাঁদরের মত মুখ করে থাকি, সেটাও তো আমার দিদিভাইয়ের নকলেই। ও যখন করত, ওকে সদ্য ফোটা কুসুমের মত লাগত। আমাকে যে কেন অমন লাগে না, বলে দাঁতমুখ খেঁচাই আমি। হেসে কুটোপুটি হয় তুত্তুরী। 


দ্রব হওয়া কচি হৃদয়ে ভালোলাগা আর ভালোবাসার বীজ ছড়াই আমি। ফুলঝুরিও তো আমার মতই হবে। তুত্তুরী দিদিই তো হবে তার আদর্শ। তুত্তুরীকে যে এবার একটু বেশীখাটতে হবে। নিজেকে তুলে ধরতে হবে ভালো উদাহরণ হিসেবে।  কারণ সব ব্যাপারে ফুলঝুরি তো নকল করবে তার তুত্তুরীদিদিকেই। ভাগ করে নেবে তার ভালো মন্দ, চেনা-অচেনা অভিজ্ঞতা যত। আর বয়ঃসন্ধিক্ষণে? কে হবে শ্রীমতী ফুলঝুরির মেন্টর? কে বোঝাবে, ছেলেদেরও ভালো লাগতে পারে, মেয়েদেরও। অথবা ভালো লাগতেই পারে উভয়পক্ষকে,কোনটাই দোষের না। কোনটাই পাপ বা অন্যায় নয়। কার সঙ্গে চিলেকোঠার ছাতে গিয়ে লুকিয়ে প্রথম সিগারেটে টান দেবে ফুলঝুরি? আর সেই যে, ‘শেলি বায়রন, শেক্ষপিয়র,টেনে গেছে শুধু ব্রাণ্ডি বিয়র’, তা কার কাছে প্রথমবার ব্রান্ডি/বিয়র খাওয়ানোর আব্দার করবে ফুলঝুরি? তুত্তুরীর কাছেই তো। ছোট বোন অন্য কারো পাল্লায় পড়লে কি আদৌ খুশি হবে তুত্তুরী। আর যেদিন আমরা কেউ থাকব না, কে থাকবে সেদিন তুত্তুরী আর ফুলঝুরির? একে অপরের ভরসাতেই তো পাড়ি দিতে হবে আরোও অনেক অনেক বছর। চোট আঘাত লাগলে, সামলাতে হবে একে অপরকে, বলতে হবে আহা রে তোর লাগল? 


শুধু কি তাই, একটু বড় হলে ফুলঝুরিকে পড়াতেও হবে তুত্তুরীকে, পাশ থেকে ফোড়ন কাটে কাকিমা। নর্মালি পড়াশোনার কথা তুললেই বিরক্ত হয় তুত্তুরী। কিন্তু এক্ষেত্রে যেহেতু ছাত্রী ফুলঝুরি এবং দিদিমণি গিরি করবে তুত্তুরী তাই ব্যাপারটা তাঁর হেব্বি পছন্দ হয়। পছন্দ হয় শ্রীমতী ফুলঝুরিকেও। ‘ও মা কি মসৃণ স্কিন দেখো, গায়ে কি মিষ্টি গন্ধ দেখো, কি রকম পুটুস পুটুস করে তাকায় দেখো।’ দুই বোনের পিরিত দেখে গলে যায় মা আর কাকিমা। ব্যাপারটা বেশ ভালোই চলছিল, আচমকা, শ্রীমতী তুত্তুরীর কোলে এবং হাতে একটু অপকর্ম করে ফেললেন শ্রীমতী ফুলঝুরি। যিনি করলেন, তিনি তো প্রকৃতির আহ্বানে সাড়া দিয়ে অত্যন্ত মুক্ত বোধ করলেন এবং খিলখিলিয়ে উঠলেন, যাঁরা দর্শক, মোহক উল্লাসে ফেটে পড়লেন তাঁরাও, কেবল যার অপকম্মটা হল তিনি রেগে আগুন এবং তেলে বেগুন। 


সে যাই হোক, শ্রীমতী তুত্তুরী এবং ফুলঝুরির অঙ্ক থুড়ি গপ্প তো সবে শুরু। আমরা মা এবং কাকিমা ঠিক করেছি, আমরা কোন দলে থাকব না। আমরা কেবল রগড় দেখব। কারণ মুখে যাই বলুক, আদতে দুটোই মহা ধড়িবাজ। দুটোর মধ্যে মিলও প্রচুর। তিনিও নিশাচর ছিলেন, ইনিও। ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করা হলে তিনিও অমনি করতেন, যেমন রাত দেড়টায় এখন ইনি করছেন।

Thursday 14 July 2022

অনির ডাইরি ১০ই জুলাই, ২০২২

 

#তাম্রলিপ্তকড়চা 



শুধু একবার ধুয়োটা তুলতে হত। যে কোন উৎসব, তা সে যে কোন ধর্ম বা সম্প্রদায়েরই হোক না কেন, পালন করতে সদা প্রস্তুত থাকত টিম চুঁচুড়া। আমার টিম চুঁচুড়া। এই ধরণের যাবতীয় বিদঘুটে পরিকল্পনার সুপ্ত বীজ, উপ্ত হত অবশ্যি এই অধমের উর্বর মস্তিষ্কে। আমি ধুয়ো তোলার পর, সেইসব ভুলে ভরা অবাস্তব পরিকল্পনাকে কেটে ছেঁটে বাস্তব রূপ দেবার দায়িত্ব নিত কৌশিক আর সঞ্চিতা। দুটোই ছিল ভয়ানক বাস্তববাদী। ওদের শিলমোহর পড়লে তারপর আসত ফাণ্ডের প্রশ্ন। এই নিয়ে মস্তিষ্ক প্রক্ষালনের দায়িত্ব ছিল সিকেসিও শুভজিতের। সবশেষে জানানো হত এসএলওদের। 'অমুক দিবসে, বৈকাল অমুক ঘটিকায় অনুগ্রহ করিয়া সমবেত হইয়া ধন্য করিবেন আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর চুঁচুড়াকে।' 


সবাই কখনই আসতে পারত না, গুটি কয়েক লোকজনই আসত, বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। পুরসভার বিদ্যুত, রেশমা আর চন্দ্রা, মগরার সংগ্রাম, মাম্পি,প্রিয়াঙ্কা আর পুজা, পোলবার রমেশ, প্রদীপ,সমীর, দেবী দি, মিঠুদি, কুমকুমদি, বাঁশবেড়িয়ার মহুয়াদি,নূপুর দি, ধনিয়াখালি থেকে অমৃতা, কৌশিক, পাণ্ডুয়া থেকে শান্তনু, আশিষ আর অভিষেক এবং বলাগড়ের শ্যামল। 


পুঁচকে আপিস, এত লোককে বসতে দেবার মত জায়গাও থাকত না, তাতেও দমত না লোকজন। নিজেদের আপিস মনে করে চলেই আসত। শ্যামল বলত,‘মন্দির’। কোর্ট বন্ধ হবার পর, 'সূর্য যখন অস্তে পড়ে ঢুলি- ', বুড়ো কালেক্টরেট জুড়ে ছড়িয়ে পড়া ছুটির মেজাজ, ব্যাগ গোছাত অন্যান্য দপ্তরের কর্মচারীবৃন্দ, পিছনের বারন্দাটা তখন গমগম করত, শুধুই আমাদের জন্য। 


SLOদের একটু দেরী করে জানানোর কারণ হল, রমেশ, মাম্পি এবং প্রিয়াঙ্কার কানে খবরটা একবার ঢুকলে, আর পরিকল্পনা বাতিলের সুযোগ থাকত না। রমেশের আনাগোণা বেশী ছিল বলে, আভাস পেয়েই যেত। আমরা চুপচাপ থাকলেও নানা অছিলায় ঐ প্রসঙ্গটাই তুলত, আশানুরূপ জবাব না পেলে শুকনো মুখে এসে বসত আমার উল্টো দিকের চেয়ারে, ‘ম্যাডাম, এবারে কি রথে জিলিপি পাঁপড় হবে না?’ 


রথের জিলিপি পাঁপড়, সে তো সবাই বাড়িতে খাই, কিন্তু আপিসে গোল হয়ে বসে ভাগ করে খাবার কি যে আনন্দ, তা কেবল বুঝত আমার টিম চুঁচুড়া। আপিসটাও তো একটা পরিবারই ছিল আমাদের, ভালোবাসা, রাগ অভিমান, ঝগড়া, চোখের জলে মাখামাখি একটা বৃহত্তর পরিবার।


যাই হোক, দিনক্ষণ ঠিক হয়ে যাবার পরই গঠিত হত অনেকগুলি কমিটি। যেমন আপিস সাফাই এবং সাজানো কমিটি। এতে থাকত প্রীতি, প্রিয়াঙ্কা, প্রদীপ আর আমাদের সুইপার তথা মালি তথা ষাটোর্ধ্ব এ্যাংগ্রি ইয়ং ম্যান অজিত দা। এক দফা সাফাই অভিযানের পর আসত রমেশ এবং কেঁচে গণ্ডুষ করত এতক্ষণের সাফাই অভিযান। বারন্দার গাছগুলোকে কাটছাঁট করে মেকাপ করাত মাম্পি। পড়ন্ত বিকেলের কনে দেখা আলোয়,  অন্য সময়ের অগোছাল সরকারী অফিসটাকে সেইদিন গুলোতে যেন চেনাই যেত না।


 খাবার কমিটিতে থাকত সোমনাথ,রমেশ আর ধীমান। মেনু সোমনাথ আর ধীমানের। প্রথমেই বলে দেওয়া হত, ‘বাপু হে এই অনুষ্ঠানে কিন্তু খাসি হবে না।’ 'অঃ খাসি হবে না', শুনেই ঝুলে যেত ধীমানের মুখ। আর সোমনাথ ডুব দিত গভীর চিন্তাসমুদ্রে। শেষ পর্যন্ত যা মেনু হত,সেটা ফেলতে হত কৌশিক সঞ্চিতা আর অরুণ বাবুর সামনে। খেয়ে পেটখারাপ করবে কি না বা অসুখবিসুখ বাঁধবে কি না এই নিয়ে চর্চার পর, অবশেষে পড়ত শিলমোহর। 


এরপর ধীমান আর রমেশ একচোট হাতাহাতি করত কোথা থেকে আনা হবে। ধারে নগদে যারা দেয়, তাদের খাবার তেমন পছন্দ হয় না এদের। রথের জিলিপিপাঁপড় অবশ্যি ধারে কেনার দরকার হত না, ওটা আমি খাওয়াতাম। পাঁপড়টা কিনে এনে প্রদীপ চা ওয়ালাকে দেওয়া হত,  ভালো তেলে মুচমুচে করে ভেজে দেবার জন্য। অতঃপর নির্দিষ্ট সময়ে একই সঙ্গে এসে হাজির হত জিলিপি আর পাঁপড়। আমার ঘরের পাখা, বাতানুকূল যন্ত্র সবকিছু বন্ধ করে কাগজের থালায় ঢালা হত স্তুপীকৃত জিলিপি আর পাঁপড়। হাতে হাতে চলে আসত আপিসের সব চেয়ার। বসে পড়ত যে যার বাঁধা জায়গায়। আমার ডানপাশের তোয়ালে ঢাকা চেয়ারটা নির্দিষ্ট থাকত চন্দননগরের বড়সাহেব তথা বড়দির জন্য। সবার মাথা হওয়া সত্ত্বেও শত অনুরোধেও ওণারা বসতেন না আমার চেয়ারে। টেবিলের সামনের চেয়ারগুলোয় বাঁ দিক থেকে বসত চঞ্চল, অরুণ বাবু, দর্প, সঞ্চিতা, কৌশিক আর নির্মল। পিছনের চেয়ারের একদম বাঁহাত থেকে বসত ধীমান,সোমনাথ,শুভজিৎ,প্রীতি ইত্যাদিরা। বিদ্যুতের জীবনেও বসার জায়গা হত না, ও বেচারী হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকত দরজার কাছে। সবার আগে ছবি তুলত রমেশ, অতঃপর,‘টুট পড়ো’। 


এক বছরের মধ্যেই বদলে গেছে চিত্রটা। পুরাণ মুখগুলোর জায়গা দখল করেছে নতুন মুখের দল। কুশীলব বদলে গেছে বটে চরিত্রগুলো বদলায়নি। বদলায়নি চিত্রনাট্য ও। এখানেও ধুয়ো তুলি আমি। সেটা নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করে আরএলও ইন্সপেক্টর সৌরভ আর পুরসভার ইন্সপেক্টর বেদজ্যোতি। অফিসে জিলিপি, পাঁপড় ব্যাপারটা কতটা বাস্তবসম্মত। অতঃপর ফাণ্ডের জন্য ফাইল যায় সিকেসিও শুভাশিষের কাছে। এবার ব্যাগড়া দিই আমি, আর ফাইল চালাচালির দরকার নেই বাপিরা। তুচ্ছ জিলিপি পাঁপড় স্পনসর্ করাটা আমার দায়িত্ব। আপিস সাজানো গোছানোর দায়িত্ব নেয় চঞ্চল,শুভাশিস আর উত্তম। বস্তাবন্দী হয়ে আবর্জনারা গুদামজাত হয়, সদ্য কেনা কন্টিনজেন্সি মালপত্র ভাগ করে পৌঁছে দেওয়া হয় ব্লকের শ্রমিক কল্যাণ সহায়তা কেন্দ্রগুলিতে। 


খাবার কমিটি হয় হক বাবু, শান্তনু আর অরূপকে নিয়ে। সরু জিলিপি না মোটা জিলিপি এই নিয়ে চলে দ্বন্দ্ব। ব্যক্তিগত ভাবে আমি রসে টইটুম্বুর মোটা বাঙালি জিলিপি ভালোবাসি। এদের অধিকাংশই সরু মুচমুচে জিলিপির পক্ষপাতী। পাঁপড় নিয়েও চলে বিস্তর অঙ্ক কষা। পাঁপড় কিনে এনে কাকে দিয়ে ভাজানো হবে? কারোর তেলের ওপরেই ভরসা করতে পারেন না হক বাবু। আমাদের চঞ্চল আবার দীক্ষা নিয়েছে, আঁশ খায় না। আপিসে যাবতীয় খাওয়াদাওয়ার সময় চঞ্চল শুকনো মুখে মুড়ি চিবোয়। কাজেই ভালো দোকান থেকে কিনতে হবে। 


অবশেষে অনেক গবেষণা করে, ডিমারীর রথের মেলা থেকে অর্ধ সুপ্ত জিলিপিওয়িলির ঘুম ভাঙিয়ে জিলিপি পাঁপড় ভাজিয়ে, চেখে কিনে আনে অরূপ, আশিষ আর উত্তম। চুঁচুড়ার মতই গাদাগাদি করে আমার চেম্বারে জড় হয় সবাই। আপিসের শেষ চেয়ারটাকে ঢুকিয়েও সবার জায়গা হয় না, জহর বাবু শেষে একটা টুল টেনে এনে বসেন। পাখা বাতানুকূল যন্ত্র বন্ধ করে দরদর করে ঘামি আমরা। জিলিপি আর আসে না। কই রে ভাই? ঠোঙাগুলো দেখিয়ে কোথায় গেল আশিষ আর অরূপ। বলতে না বলতেই কাঁসার থালায় সুন্দর করে সাজানো গুটি কয়েক বাটিতে করে চলে আসে জিলিপির দল।বুঝতে পারি,এদের সুন্দর করে পরিবেশনের তাগিদেই দেরী হচ্ছে। দূর দূর,অত সাজাতে হবে নি, দুটো থালায় উপুড় করে ঢেলে ফেল সবকিছু। ভাগ করে খাই সবাই। 


অ্যাসিড, গ্যাস,বদহজম নিপাত যাক, এমনি সৌহার্দ্যপূর্ণ মিষ্টিমধুর থাকুক আমাদের তাম্রলিপ্ত আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর। সকলকে রথ এবং উল্টোরথের বিলম্বিত শুভেচ্ছা। জিলিপির রসের মত মধুর আর পাঁপড়ের মত মুচমুচে কাটুক আপনাদেরও দিনগুলি।

অনির ডাইরি ৮ই জুলাই, ২০২২

 

আমার আর তুত্তুরীর কাছে, হাওড়া হল উৎসবনগরী। পাঁচশ বছরের বুড়ি শহরটায় পা দিলেই কেবল হইচই আর আড্ডা। চাটুজ্জে বাড়ির বৈঠকখানাটা যেন গমগম করে আমাদের উপস্থিতিতে।  রাত যত গভীর হয়, ততোই চড়া হয় আড্ডার মেজাজ। তিন প্রজন্ম মিলে আড্ডাবাজদের সংখ্যা নেহাৎ কম না,  পিসি আর বাবা দুভাইবোন, অয়ন- অনিন্দ্য- অনিন্দিতা আমরা তিন খুড়তুতো- জেঠতুতো ভাইবোন, শ্রীমান বুল্লু কুমার আর শ্রীমতী তুত্তুরী দুই মামাতো-পিসতুতো ভাইবোন, মা আর চৈতি, চাটুজ্জে বাড়ির দুই প্রজন্মের দুই কুলবধূ সব মিলিয়ে বাবার ভাষায়, ‘এক কম কুরু বংশের ১/১০ অংশ।’  


খানা পিনা ছাড়া কি আর আড্ডা জমে, খানা বলতে জমিয়ে মাখা মুড়ি, কাপের পর কাপ চা ছাড়াও কখনও আসর মাতায় কদমতলা়র ফ্রেন্ডস কেবিনের জিভে জল আনা মোগলাই পরোটা, কখনও বা বেদুইনের রোল, কিছুক্ষণ রেস্তোরাঁর চাউমিন আর চিলিচিকেন, কখনও বা সর্দারজির ধাবা থেকে আনা ডিম তড়কা আর রুমালি রুটি। আর পিনা বলতে জিরের গন্ধওয়ালা নিরামিষ পানীয় বিশেষ। অন্য পানভোজনের আলোচনা চলে বটে পুরোদমে, আজগুবি পরিকল্পনাও হয় বিস্তর, যেমন ধরুন আমি যোগাড় করব গাঁজা, অয়ন যোগাড় করবে কল্কে আর গাঁজা সাজার দায়িত্ব নেবে বাবা। বেশি না সবার জন্য এক ছিলিম ব্যাস্।  মাইরি বলছি এ পরিকল্পনা আমরা বোধহয় তুত্তুরীর বছর পাঁচেক বয়স থেকে করে আসছি। আগে নেশার গল্পগাছা হলে প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হত মা, আজকাল আমাদের দৌড় বুঝে আর কিছু বলে না। প্রসঙ্গতঃ ইদানিং আমরা সবাই মিলে শ্রীমান অনিন্দ্যর পিছনে পড়ি মহুয়া খাবার জন্য। ব্যাটা কোথায় যেন দেখে এসেছে সিলড্ মহুয়া মাত্র কুড়ি টাকা লিটার। প্রাপ্তবয়স্ক গুলোকে ওটা খেতে এবং খাওয়াতেই হবে মাইরি। 


আকাশকুসুম নেশার পরিকল্পনা চলে, বাবা-পিসি এবং আমাদের শৈশবের স্মৃতিচারণ চলে, চাটুজ্জে বাড়ি আর মুখুজ্জে বাড়ি অর্থাৎ বাবাদের মামার বাড়িতে ঘটে যাওয়া নানা গা ছমছমে ভৌতিক গল্পের চর্বিতচর্বন চলে, অতীতের না না রসাল গল্প হয় আর হয় গানবাজনা। কয়েক হাজার বার বলা ও শোনা গল্প গুলো যখন সাময়িক ভাবে পুরাণ হয়ে যায়, হঠাৎই খালি গলায় গান ধরে অয়ন। 


অনেক তৈলমর্দন করলে টুকটাক গান গায় বুল্লু বাবু, মামির সঙ্গে ডুয়েট গায় তুত্তুরী। মায়ের দর বরাবরই বেশি, মধ্যরাত্রি সমাগত হলে তবে তাঁর গান গাইতে ইচ্ছে টিচ্ছে করে। ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’ হয়ে তুত্তুরীর হাত ধরে নাচে চৈতি। এমনকি আসুরিক গলায় গান গাই আমিও, বাড়ির মধ্যেই তো। 


নাচার পালা হলে, মা আর পিসির হাত ধরে টানি। হাত তুলে মারের ভঙ্গি করে মা।  পিসি কিন্তু কোমরে আঁচল জড়িয়ে রেডি, ‘ইনি-বিনি-টাপা-টিনি’। খানিক নেচে হাঁপিয়ে যায় পিসি, রিমোটে গান পজ করে অনিন্দ্য। ৮৭ বছর বয়সে ভাইপো ভাইঝি নাতি নাতনীদের সাথে নাচার ক্ষমতা কজন বাঙালি মহিলার থাকে মশাই। আমার পিসি সত্যিই অসামান্যা। 


চাগিয়ে বড় স্পিকারটাকে দোতলা থেকে নামিয়ে আনে অনিন্দ্য। ভাগের গান বাজে, একেক জনের মর্জি মত এক একটা গান। কেউ যেন বঞ্চিত না হয়।  এমনিই করে থাকি আমরা। এটাই আমাদের পার্টি।


 মায়ের প্রিয় মাধুরী চট্টোপাধ্যায়ের মধু ঢালা কণ্ঠ গেয়ে ওঠে, ‘ ঐ যে সবুজ বন বিথীকায়, দূর দিগন্তেরও সীমানায়-’। বাবার শাম্মি কাপুরের ওষ্ঠ হেলনের আড়াল থেকে সঙ্গত করেন মহঃ রফি সাহেব, ‘ও দিল লেনে ওয়ালোঁ দিল দেনা শিখখো জী।’ 


আমার জন্য মুকেশ জী গান ধরেন, ‘ওঃ মেহবুবা, তেরে দিল কে পাশ হি হ্যায় মেরি মঞ্জিল এ মকসুব-’। রেশ মেলায় না, দুই খুদের দাপটে মঞ্চে নেমে পড়ে শ্রেয়া ঘোষাল, জুবিন নাটিয়াল আর অরিজিৎ সিং।


 পিসির পালা আসে, অনিন্দ্য ফাজালামি মারা উদাত্ত কণ্ঠে জানতে চায়, ‘দিদি, ও দিদি, কি গান শুনবে গো তুমি?’ বাবার দিদিকে যে আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম দিদি বলে ডাকি, তা আশা করি জানেন সকলেই।  লাজুক হেসে অনেক ভেবে চিন্তে জবাব দেয় দিদি,‘তুই সেই যে গানটা শোনাতিস না-’। লক্ষ্য আমি।  কোন গানটা? ‘ঐ যে রে, যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভোলেনা মোরে-’। নতুন চাকরি পেয়ে কেনা প্রথম ল্যাপটপে কবে যেন শুনিয়েছিলাম গানটা, কোন বাংলাদেশী শিল্পীর কণ্ঠে। শৈশবের গান শুনতে শুনতে ভিজে উঠেছিল পিসির চোখ, সে অনেক অনেক কাল আগের কথা। তখনও আমি অনুঢ়া, শ্রীমতী তুত্তুরী জন্মাতে আরো বছর আড়াই তিন। আর বু্ল্লু বাবু তো সদ্যোজাত। 


‘ কি গান বাছলে গো দিদি-’ বলতে বলতে ইউটিউব স্ক্রল করতে থাকে অনিন্দ্য। রাত বাড়ে, বাকিরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে খুচরো খুনসুটিতে, সিগারেট ফুঁকতে যায় বাবা, দাম্পত্য কলহে লিপ্ত হয় মা, সবার জন্য খাবার গরম করতে যায় চৈতি, ঢাকের সাথে টেমটেমির মত বড় মামীকে অনুসরণ করে তুত্তুরী।  


সবকিছু থেকে নির্লিপ্ত, ঘোলাটে চোখে ছাতের কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে থাকে পিসি। পাশে গিয়ে বসতেই এক গাল হাসে। মা আর ছোট কাকিমা দুজনেই কর্মরতা ছিলেন বলে আমরা তিন ভাইবোনই ঠাকুমা আর পিসির কাছে মানুষ। ওদের চোখে আমরা তিনজনই সমান হলেও  আমার সঙ্গে পিসির সম্পর্কটা বরাবরই একটু অন্য মাত্রা পায়। পাবে নাই বা কেন, সেই নার্সারি থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পিসির হাত ধরেই তো স্কুলে গেছি আমি। ছুটির সময় পিসির ছাতার তলায় সেঁদিয়ে বাড়ি ফিরেছি। ব্যাঁটরা পাবলিক লাইব্রেরিই বলুন বা তারাসন্দরী বালিকা বিদ্যাভবন, স্কুল পাল্টেছে, পাল্টায়নি পিসির আর আমার সমীকরণ। শুনলে হয়তো হাসবেন, প্রথম কলেজের দিনেও বাজার যাবার অছিলায় গেট পর্যন্ত ছেড়ে এসেছিল পিসি। আমার আইনানুগ বিবাহের সাক্ষী হয়েছিল পিসি আর অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ের বেলায় দিনভর অভুক্ত থেকে সম্প্রদান করেছিল পিসি। সম্প্রদান করতে করতে সে কি কান্না পিসির। পাশে একটা চেয়ারে লাঠি হাতে রাজার মত বসেছিলেন আমার জেঠামশাই, কান্না যে কি ছোঁয়াছে হয় সেদিন দেখেছিলাম। পিসিকে দেখে প্রয় শিশুর মত ফুলে ফুলে কাঁদতে লেগেছিল জেঠুও। সে কি বিড়ম্বনা। 


পিসির পাশে বসে, শিরা ওঠা খসখসে হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বললাম, ‘আমার সাথে তমলুক যাবে দিদি?’ নিভন্ত দুই চোখ পলকে জ্বলে ওঠে দপ্ করে। ‘তমলুক? সে তো অনেএএক দূর।’ বলি, আমাদের উত্তমকুমারের তুফান মেল আছে তো। দেড়শো বছরের বুড়ো বাড়ি আর বাড়ির সদস্যদের জন্য চিন্তিত হয়ে পড়ে পিসি। ‘ আমি না থাকলে কি হবে?’


 সত্যিই তো, ঠাকুমা চলে যাওয়া ইস্তক এই বুড়ো বাড়িটার প্রতিটি কোণে যে নজরদারি চলায়, সে আমার পিসিই তো। কে কখন বেরোচ্ছে, কে কখন ঢুকছে, কোন দরজায় ছিটকিনি লাগানো হয়নি,।  কোন জানলার পাল্লা ভালোমত লাগছে না, কোথায় কাপড় শুকাতে দিয়ে বেমালুম ভুলেছে মা বা চৈতি,  সব খেয়াল রাখে পিসি। ঈশ্বরের কৃপায় কোন ব্যধি নেই আমার পিসি থুড়ি দিদির। ইদানিং কানে একটু কম শুনছে, আর হাঁটুর ব্যথাটাও অল্প বেড়েছে। তাই নিয়েই দিনরাত কাজ করে চলে পিসি। অপ্রয়োজনে চার বার ঝাঁট দেয় গোটা বাড়ি। এঁটো বাসন পড়ে থাকতে দেখলেই দৌড়ে গিয়ে মেজে দেয়। অয়ন সেদিন বিরক্ত হয়ে বলছিল,‘বয়স্ক লোকজনকে কোথায় বলতে হয়, অত বসে থেকো না। একটু নড়াচড়া করো। আর আমাদের দিদিকে দেখ, একে হাত জোড় করে বলি তুমি একটু সুস্থির হয়ে বসো, অত কাজ করতে হবে না। তাও শোনে না।’ 


তমলুক ভ্রমণের কথা শুনে পিসির চোখে হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে উঠেও নিভে গেল। ‘আমি কি পারব?’ 


সবাই মিলে,সমস্বরে বললাম, পারবে না মানে? অয়ন বলল,‘ তবে দিদি, দোহাই যে শাড়ি গুলো বাড়িতে পরো,সেগুলো নিয়ে যেও না। আর প্রেশারের ওষুধটা অবশ্যই নিও। আর চশমাটাও। নাঃ থাক, দাঁড়াও আমিই গুছিয়ে দেব তোমার ব্যাগটা।’  


বাচ্ছা আর বয়স্কদের খাইয়ে আমাদের খেতে বসতে বসতে রাত সাড়ে বারোটা। পিসি তখনও দোদুল্যমান। হয়তো মানসিক সমর্থন পেতেই বলল, ‘অনেকদিন তো এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাইও নি বল-’। ঠিক কাকে উদ্দেশ্য করা বলা কেউ বুঝল না, অয়ন বলল, ‘ আরে দিদি মন খারাপ করছ কেন? আজ রাতে ফুরফুরে মন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো, কাল উত্তম কুমার আসবে তোমায় নিয়ে যেতে।’ ‘অ্যাঁ উত্তম কুমার? সে আবার কি?’ ভেবলে গিয়ে প্রশ্ন করে পিসি। হেসে কুটোপুটি খেতে খেতে অয়ন বলে, ‘কেন ওর ড্রাইভারের নাম যে উত্তমকুমার তুমি জানো না।’ অতঃপর ‘ তিন ভাইপো ভাইঝি আর দুই নাতি নাতনীর সম্মিলিত চিৎকার, ‘ভদ্দর ঘর কি লড়কি ভাগি ডেরাইভার কে সাথ-’। রাত একটা অবধি 'ছোঃ ছোঃ ছোঃ কেয়া শরম কি বাত' চলল আমাদের। প্রায় জোর করেই মজলিস ভঙ্গ করল মা। পরদিন সকাল আটটায় রওনা  দিতে হবে যে আমাদের। 


স্কুল ছুটি থাকার সৌজন্যে দাদু-মাম্মাম(দিদা) আর দাদা (বুল্লুবাবু)কে ছেড়ে নড়ল না তুত্তুরী। মাত্র দুটো দিনের তো ব্যাপার। কাল বাদ পরশুই ফিরে আসতে হবে আমাদের, পিসিকে যত্নপূর্বক পৌঁছে দিতে হবে তাঁর ভাইপোদের জিম্মায়। ব্যাগ সমেত পিসিকে গাড়ি অবধি ছাড়তে এল তুত্তুরী আর তার বড় মামা। যত্ন করে চামড়ার নরম ব্যাগে পিসির জামাকাপড় গুছিয়ে দিয়েছে অয়ন। চেনের খাপে রেখেছে টাকার ব্যাগ, প্রেশারের ওষুধ। সুন্দর করে চুল বেঁধে এমনকি নেল পলিশও পরিয়ে দিয়েছে দিদিকে। উত্তমকুমারের গাড়ির জানলা দিয়ে ছুটে আসা উদ্দাম হাওয়া অবশ্য পিসির যতনে বাঁধা চুলগুলিকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। অবাক দৃষ্টিতে দুপাশে ছুটে চলা মানুষ, গাড়ি আর বাড়ি দেখছে পিসি। বাগনানের কাছে অসময়ের রুগ্ন দামোদর দেখে হতবাক হয়ে যায় পিসি। এই নাকি বাংলার দুঃখ? কোলাঘাটে রূপনরায়ণের বিস্তৃত রূপ দেখে অধিকতর হতবাক হয়ে পড়ে পিসি। দূরে রেল ব্রিজের ওপর দিয়ে উল্টোদিকে ছুটে চলা ট্রেন দেখে নিজের শৈশবে ফিরে যায় পিসি। উত্তমকুমার ওদিকে বলেই যায়,‘ আপনাকে আজ বিকালে বর্গভীমা মন্দির দেখতে নিয়ে যাব পিসিমা। কাল দীঘা যাবেন নাকি?’ বয়সজনিত শ্রবণশক্তি হ্রাস আর হাওয়ার দাপটে ভালো বুঝতেও পারে না পিসি। হাসে শুধু কান এঁটো করে।কানের গোড়ায় মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে  শুধাই আমি,‘দিদি তোমার ভালো লাগছে তো?’ শীর্ণ হাতে আমার হাতটা চেপে ধরে বলে পিসি,‘ভীষণ ভালো লাগছে। ভাগ্যে তুই বললি আর ওরা জোর করে পাঠাল। এবার দেখ না, মাঝে মাঝেই জ্বালাব তোকে। বলব,তমলুক নিয়ে চ-’। জীবন বড় অনিশ্চিত,কে জানে কি লুকিয়ে আছে কালের গর্ভে, সম্বল বলতে শুধু এই অমৃত মুহূর্তটুকুই তো। 



অনির ডাইরি ১লা জুলাই, ২০২২

 


এক বছর! মাত্র একটা বছরের মধ্যে আমূল বদলে গেল সবকিছু। বেশ তো গতানুগতিক ছন্দে চলছিল জীবন। বদলির অর্ডার তো বেরিয়েছিল আমার, চুঁচুড়া থেকে বিধাননগর। কারা যেন পরিহাসের ছলে মৃদু অনুযোগও করছিল তাই নিয়ে, ‘তোমায় তো পাড়ায় পোস্টিং দিল গো-।’ 


সেই মত, ক্যাশবুক গুলো শেষ করে, এক তাড়া গ্রাচুইটির কেসের অর্ডার লিখে, মহানগরে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত ছিলাম আমি। এবার মুভমেন্ট অর্ডারটা বেরিয়ে গেলেই হয়। আমরা যারা বাইরে থেকে মহানগরে ঢুকতাম,রোজই কথাবার্তা - মেসেজ চালাচালি হত, বেরোল? মুভমেন্ট অর্ডার কি বেরোল? করোণা ভীতি ঝেড়ে ফেলে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছিল জীবন। গত বছর ১লা জুলাই ছিল বৃহস্পতিবার। শুক্রবার দিনটা ছুটি নিলে, টানা চারদিন ছুটি। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ব্যাগপত্তর গুছিয়ে তুত্তুরী সহ রওণা দিয়েছিলাম হাওড়া। 


দোসরা জুলাই, সন্ধ্যে বেলা, উদ্দাম আড্ডা বসেছে বাবার একতলার বৈঠকখানায়। এমন শোরগোল করছি আমরা, যে  ঠাকুমা থাকলে নির্ঘাত বলত, আমাদের চিৎকারের  ঠেলায়, ‘বাড়িতে কাক উড়ছে, চিল পড়ছে।’ হবে নাই বা কেন? আড্ডাবাজদের সংখ্যা কি কম? বাবারা দুই ভাইবোন, আমরা তিন খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন, তুত্তুরীরা তুই মামাতো পিসতুতো ভাইবোন, সর্বোপরি দুই কুলবধূ, মা আর চৈতি। 


আড্ডার ফাঁকে শৌভিকের ফোন। দুই ভাই কি সব ফাজিল মন্তব্যও করল তার জন্য। হট্টোগোল থেকে দূরে সরে গিয়ে, ফোনটা কানে ধরতেই, ওপাশ থেকে শৌভিকের চূড়ান্ত আবেগবিহীন কেজো কণ্ঠস্বর। ‘কপাল পুড়েছে-’। মানে? মানেটা শৌভিক বলার আগেই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল,‘ এসডিও অর্ডার বেরিয়েছে?’ এটাকেই বোধহয় মহিলাদের ইনট্যুশন বলে। আমি বলি ভাইবস্। বেশ কিছুদিন ধরেই টের পাচ্ছিলাম, বলছিলামও শৌভিককে, ‘তুই বাপু বাঁচবি না। এসডিও তোকে হতেই হবে-।’ 


এরপরের প্রশ্ন অবধারিত ভাবেই, কোথায় হল? জবাব এল তমলুক। এরপরের প্রশ্ন, জানলি কি করে? জবাব এল ‘এষা।’ প্রশ্নটা না করলেও পারতাম, কারণ ততোক্ষণে আমার ফোনে এষার কল ওয়েটিং আসা শুরু হয়ে গেছে। কি প্রবল উৎসাহ নিয়ে খবরটা শুনিয়েছিল এষা, সেই উত্তাপের সিকি ভাগও ফেরৎ দিতে পারিনি আমরা। সেটা নিয়ে মৃদু অনুযোগও করল পাগলি মেয়েটা। ‘দেখ না দিদি, দাদা বলছে,দাদা নাকি জানত না। তা তোমরা আমাদের পার্টি দিচ্ছ কবে-’। জানতাম না তো কেউই, কবে যে ফাইল উঠল, কবে যে সই হল, ধুৎ জীবন কেন যে এত অঘটনঘটনপটিয়ী। 


অতঃপর খবর দেওয়া আর অভিনন্দন গ্রহণ করার পালা। গভীর রাতে,নিদ্রিত তুত্তুরী আর তন্দ্রাচ্ছন্নভাব মায়ের পাশে শুয়ে ফিসফিসে বার্তালাপ। ‘ কত লোক আমাদের অর্ডার বেরোনোর খবর রাখে রে-’, দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বলে শৌভিক। এমন দিনে একসাথে না থাকতে পারার অস্বস্তিতে ভুগছি দুজনেই। শৌভিক জানায়, কে যেন ওকে অভিনন্দন জানিয়ে ফোন করে বলেছে, অমুক মন্ত্রী সম্পর্কে তার মামা আর তমুক অফিসার পিসেমশাই হয়। খামোখা চমকে যে লোকজনের কি লাভ হয়। তবে উভয়ের বন্ধুবান্ধবরাই খুব উচ্ছ্বসিত। অর্জুন তো শ্রীমান কুট্টুসের ছবি সম্বলিত একটা কার্ডই বানিয়ে পাঠিয়েছে, ‘কি আনন্দ, মামা এসডিও হয়েছে, ভৌ উউউ’। খুশি আমার চুঁচুড়ার সহকর্মীরাও। খুশির লহর কেবল অনুপস্থিত উভয়ের পরিবারে। কারোরই বাবা-মা যেন খুশি নয়। তমলুক চলে যাবে শৌভিক। প্রতি সপ্তাহে ফিরতেও পারবে না, এটা যেন কিছুতেই হজম হচ্ছে না কারো। শ্বশুরমশাই তো যেন কাকে বলেই ফেলেছেন,‘জ্যেষ্ঠ পুত্রের বাইরে চলে যাওয়ায়, আমি বেশ বিপন্ন বোধ করছি।’ 


অন্যায় তো কিছু বলেননি, শৌভিকের চলে যাওয়ার সম্ভবনাতেই বিপন্ন বোধ করছি আমি। বড় পরিশ্রমী আমার বর। সকালে বিছানা ঝাড়া থেকে দোকানবাজার, জামাকাপড় কাচা (অবশ্যই মেসিনে), বাথরুম(মেঝেটা, ইয়েটা অবশ্য আমার জিম্মেদারি ) পরিষ্কার কতকাজ যে দায়িত্ব নিয়ে করে সংসারে, সেটা ভাবতে বসে পাগল পাগল লাগে। গোটা বাড়ির চালিকা শক্তি তো ওই। সবথেকে বড় কথা, কলকাতা উত্তরের নির্বাচনী দপ্তরে পোস্টিং হওয়ার দরুন আমার পরে বেরোয় এবং আমার আগে বাড়িতে ঢোকে শৌভিক। মেয়েটাও যে বড্ড বাপ সোহাগী।  


বললাম, আমিও তমলুকে বদলি হয়ে যাই বরং। প্রায় মারমূর্তি ধরল শৌভিক। কি দরকার? কোন পাগলে নিরাপদ নির্ঝঞ্ঝাট বিধাননগর ছেড়ে স্বেচ্ছায় ঝঞ্ঝাট চূড়ামণি পূব মেদিনীপুরে যায়? দেখতে দেখতে এসে গেল দিনটা।  ৯ই জুলাই, শুক্রবার একসাথেই বাড়ি থেকে বেরোলাম দুজনে। গ্রীলের গেট ধরে দাঁড়িয়ে থাকা তুত্তুরীর মুখে চোখে একটাই অনুনয়,‘ আজই ফিরে এসো কিন্তু বাবা।’ কিভাবে যেন আগেপিছেই রাখা ছিল দুজনের গাড়ি। শৌভিকের ক্রিম কালারের জাইলো। সিকিউরিটি মনোরঞ্জন বাবু নেমে স্যালুট করলেন, হাত থেকে ব্যাগটা নিতে গেলেন। ছেড়ে দিল দুজনের গাড়ি। নিবেদিতা সেতু পর্যন্ত বার বার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিলাম একে অপরকে। তারপর দিল্লী রোড ধরলাম আমরা আর শৌভিকের গাড়ি রওনা দিল বোম্বে রোড বরাবর। 


সেদিন রাতে অবশ্যি ফিরে এসেছিল শৌভিক। শনি-রবি আর রথ নিয়ে পরপর তিনদিন ছুটি। সেই সপ্তাহান্তটা শুধু গল্প করেই কাটিয়ে দিলাম আমরা। মুগ্ধ হয়ে গল্প শোনাচ্ছিল শৌভিক, ‘এত সুন্দর কালেক্টরেট কোথাও দেখিনি। সবকিছু নতুন আর ঝকঝকে। আর ডিএম সাহেবের চেম্বারটা যা বানিয়েছে, উফঃ-’।  জানতে চাইলাম, এসডিওর বাংলো নেই? নিজের প্রসঙ্গে হাই তোলে শৌভিক, কেজো সুরে জানায়, ‘একটা হয়েছে শুনছি, নিমতৌড়ির ওখানে। কে যাবে? ওটা তো ভুষুণ্ডির মাঠ।’ জানায় ওর আপিসের পিছনের আবাসনে একটা ফ্ল্যাটেই আপাততঃ মহকুমা শাসকের নিবাস। শৌভিকও ওখানেই থাকতে চায়। ঘোরতর রকম শহরের মধ্যে, দোকান বাজার, তমলুক স্টেশন সবকিছু পা বাড়ালেই। মহকুমা শাসকের গৃহস্থালির ভারপ্রাপ্ত  লোকজনও খুব একটা ঐ ধাপধাড়া গোবিন্দপুরে যেতে উৎসুক নয়।


দেখতে দেখতে এসে গেল ১২ই জুলাই। কাল পাকাপাকি ভাবে তমলুক রওণা দেবে শৌভিক। তবে সে তো কালকের কথা, আজ যে রথ। ওপরের লফট থেকে নামানো হয় ভাইবোন সমেত জগু বাবুকে। নামানো হয়, খবরের কাগজের মোড়া তাঁর তিনতলা রথ।

বেলা বাড়ে, তুত্তুরীকে ছুটি দেয় না গোঁড়া ক্যাথলিক স্কুল। পড়ার ঘরে ল্যাপটপ চালিয়ে ঘাড় গোঁজ করে পড়তে বসে তুত্তুরী। ব্যাগ গোছাতে বসে শৌভিক। ব্যাগ গোছাতে গিয়ে আবিষ্কৃত হয়, টুকটাক কত কিছু কেনা বাকি। পোশাক পরিচ্ছদেরও যা হাল। পাকাপাকি ভাবে থাকতে হলে গোটা কয়েক জামাকাপড় কেনা বাধ্যতামূলক।  চটজলদি বেরোনোর তোড়জোর করি আমরা। তুত্তুরীর ক্লাশ শেষ হবার আগেই ফিরে আসব, মাত্র ঘন্টা খানেকের ব্যাপার। স্নানাহার ফিরে এসেই না হয়- 


ঠিক এগারোটা পয়ত্রিশে বাবার ফোন, আজও ভাসছে কথা গুলো ইথার তরঙ্গে, ‘তুমি কি ব্যস্ত আছ, আসতে পারবে? মা যেন কেমন-’।  ঠিক এই ভয়টাই পাই আমি সবসময়। ঠিক এই কথাগুলোই দুঃস্বপ্নে শুনি আমি, অসময়ে বাড়ি থেকে ফোন এলেই ধড়াস করে ওঠে বুক। যদিও প্রতিবারই প্রমাণ হয়, অকারণ আশঙ্কা করি আমি, আর যেদিন সত্যিই হয়, সেদিন কেন যে বাজে না কোন বিপদঘন্টি।