Tuesday, 9 August 2022

অনির ডাইরি ২৫শে জুলাই, ২০২২



‘আমি বোধহয় আর চাকরী পাব না, জানো-’। শুকনো মুখে বলেছিল মেয়েটা। একের পর পর চাকরির পরীক্ষা দিয়েই যাচ্ছিল মেয়েটা। আরও ভালো করে, আরও মনযোগ দিয়ে পড়ছিল মেয়েটা। বড় কষ্টে মানুষ মেয়েটা। প্রত্যন্ত গাঁয়ের মেয়ে, গ্রামের স্কুলের পাঠ চুকিয়ে, নিকটস্থ মফঃস্বল ঘুরে উচ্চ শিক্ষার জন্য মহানগরের বাসা গড়েছিল  মেয়েটা। ডিগ্রী পাবার পর আর সময় নষ্ট করেনি, টুকটাক কাজ করে, টিউশনির পাশাপাশি পুরোদমে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল একটা চাকরীর জন্য। অধ্যাপিকা হবার স্বপ্ন দেখত মেয়েটা। না হলে হাইস্কুলের শিক্ষিকা। এমনকি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা হতে পারলেও খুশি হয়ে যেত মেয়েটা। একা একা শহরতলীতে থেকে কাজ আর পড়াশোনা চালাত। গাঁয়ে অপবাদ দিত নিন্দুকের দল। নির্ঘাত কিছু খারাপ কাজ করে, নাহলে মহানগরের এত মধু কিসের। সেসব কথা ছিটকে কানেও আসত মেয়েটার। ভেঙে পড়ত কখনও কখনও। গোঁত্তা মারতাম আমি। “কুছ তো লোগ কহেঙ্গে।” পড়াশোনাটা ছাড়িস না বাপু। পড়লে, খাটলে, চাকরী ঠিক হবে। আমাকে দেখছিস না। আমার বন্ধুদের দেখছিস না। চাকরী একটা পেতেই হবে। উপার্জন না করলে, এত পরিশ্রম, এত অপবাদ সহ্য করা, সব বৃথা। এই যে এত কষ্ট করলি, আর একটু ধৈর্য ধর। 


সেদিন রবিবার। আকাশের মুখ ছিল ভার। কেমন যেন থমথমে ছিল পরিবেশ। কি যেন পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। তলার দিকের অনেকে পেয়ে গেছে। মেয়েটার নাম নেই। লিস্ট এনে দেখাচ্ছিল মেয়েটা। ‘এই দেখ। এ তো কোয়ালফাই করতেই পারেনি। ও আমার থেকে অনেক অনেক পিছনে ছিল। এদের কি করে হয়ে গেল গো?’ জবাব দিতে পারিনি। তবে ধমকেছিলাম খুব। শুধু দুর্নীতি খুঁজলে হবে? হেরে গিয়ে বসে পড়লে, রণক্ষেত্র ছেড়ে পালালে হবে?খুব বড় মুখ করে বলেছিলাম, কেন চাকরী পাবি না? আমি তো পেয়েছি। আমরা তো পেয়েছি। মন দিয়ে পড়। পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই,আমার বাবা শিখিয়েছিল। 


আরোও কিছুদিন লড়েছিল মেয়েটা। আরও অনেকদিন লড়েছিল মেয়েটা। দিয়েছিল আরও কিছু পরীক্ষা। সেই একই গল্প, ভীষণ ভালো হয় পরীক্ষা। ফলাফল হয় বেরোয় না। আর বেরোলেও কারা যেন ভরে দেয় সব আসন। মেয়েটার হাতে থেকে যায় পেন্সিল। সংসারে মন দেয় মেয়েটা। এখানে কোন দুর্নীতির গন্ধ পায় না। শ্বশুর-শাশুড়ির নয়নমণি হয় মেয়েটা। স্বামীর পরম সুহৃদ, প্রেমের আধার হয় মেয়েটা। নবজাতক সন্তানের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে মেয়েটা। কেউ আজকাল আর ওকে বলে না, চাকরী কিন্তু পেতেই হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে। সবাই আশা ছেড়ে দিয়েছে। সবাই মেনে নিয়েছে, সবাই মানিয়ে নিয়েছে। শুধু আমি বলি। দেখা হলেই বলি। এভাবে ছেড়ে দিস না। এভাবে হেরে যাস না। নিজেকে ভুলে যাস না।নিজের পায়ে দাঁড়া, নিজের পরিচয় বানা। ক্লান্তি মাখা একটা হাসি ফুটে ওঠে মেয়েটার ঠোঁটে। হেরে যাওয়া হাসি। 


মেয়েটা তো তবু সাংসারিক আচ্ছাদনের আড়ালে ঢেকে নিয়েছে নিজেকে। কিন্তু ছেলেগুলো? তাদের কি হল? তারা কোথায় লুকালো? এ সমাজ যে বড় নির্মম, উপার্জনহীন পুরুষকে যে মানুষ গণ্য করে না। কেউ বোঝে না তাদের অপারগতা। কেউ শোনে না তাদের ব্যর্থতার গল্প। কেউ মানতে চায় না, সব দোষ তাদের নয়।


 জনগণের স্মৃতি শক্তি বড় দুর্বল, আজকের উত্তেজনা অচীরেই দখল করে নেবে আগামী কালের ভিন্নতর কোন উত্তেজনা। আসবে নতুন নটনটি আর কুশীলবের দল। সময়ের মেকআপে আজকের খলনায়ক আবার অবতীর্ণ হবেন নায়কের নাম ভূমিকায়। মক্ষিরানিদেরও অভাব হবে না। টিস্যু পেপারে কালিমা মুছে নির্ঘাত ফিরে আসবেন মাননীয় আপ্ত সহায়ক মহোদয়। ফেঁসে যাওয়া আর ফাঁসিয়ে দেওয়ার কত যে গল্প ঘুরবে সোশ্যাল মিডিয়ায়, গলা ফাটাবেন, সওয়াল- জবাব করবেন অভিযুক্তদের শুভানুধ্যায়ীদের দল। দুনিয়া চলবে নিজের গতিতে, দীর্ঘশ্বাস গিলে, দগদগে ক্ষতে সময়ের মলম লাগিয়ে, আবার কোমর বাঁধবে হারিয়ে দেওয়া ছেলেমেয়েগুলো। কোমর বাঁধবে নতুন কোন লড়াইয়ের জন্য। ভিন্নতর কোন যুদ্ধের জন্য। এবার যেন ওরা জেতে, সর্বান্তকরণে এই প্রার্থনাই করি। মাথা উঁচু করে বাঁচা এবং যোগ্যতা অনুযায়ী উপার্জনের অধিকার সকলেরই আছে। 

No comments:

Post a Comment