আমার আর তুত্তুরীর কাছে, হাওড়া হল উৎসবনগরী। পাঁচশ বছরের বুড়ি শহরটায় পা দিলেই কেবল হইচই আর আড্ডা। চাটুজ্জে বাড়ির বৈঠকখানাটা যেন গমগম করে আমাদের উপস্থিতিতে। রাত যত গভীর হয়, ততোই চড়া হয় আড্ডার মেজাজ। তিন প্রজন্ম মিলে আড্ডাবাজদের সংখ্যা নেহাৎ কম না, পিসি আর বাবা দুভাইবোন, অয়ন- অনিন্দ্য- অনিন্দিতা আমরা তিন খুড়তুতো- জেঠতুতো ভাইবোন, শ্রীমান বুল্লু কুমার আর শ্রীমতী তুত্তুরী দুই মামাতো-পিসতুতো ভাইবোন, মা আর চৈতি, চাটুজ্জে বাড়ির দুই প্রজন্মের দুই কুলবধূ সব মিলিয়ে বাবার ভাষায়, ‘এক কম কুরু বংশের ১/১০ অংশ।’
খানা পিনা ছাড়া কি আর আড্ডা জমে, খানা বলতে জমিয়ে মাখা মুড়ি, কাপের পর কাপ চা ছাড়াও কখনও আসর মাতায় কদমতলা়র ফ্রেন্ডস কেবিনের জিভে জল আনা মোগলাই পরোটা, কখনও বা বেদুইনের রোল, কিছুক্ষণ রেস্তোরাঁর চাউমিন আর চিলিচিকেন, কখনও বা সর্দারজির ধাবা থেকে আনা ডিম তড়কা আর রুমালি রুটি। আর পিনা বলতে জিরের গন্ধওয়ালা নিরামিষ পানীয় বিশেষ। অন্য পানভোজনের আলোচনা চলে বটে পুরোদমে, আজগুবি পরিকল্পনাও হয় বিস্তর, যেমন ধরুন আমি যোগাড় করব গাঁজা, অয়ন যোগাড় করবে কল্কে আর গাঁজা সাজার দায়িত্ব নেবে বাবা। বেশি না সবার জন্য এক ছিলিম ব্যাস্। মাইরি বলছি এ পরিকল্পনা আমরা বোধহয় তুত্তুরীর বছর পাঁচেক বয়স থেকে করে আসছি। আগে নেশার গল্পগাছা হলে প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হত মা, আজকাল আমাদের দৌড় বুঝে আর কিছু বলে না। প্রসঙ্গতঃ ইদানিং আমরা সবাই মিলে শ্রীমান অনিন্দ্যর পিছনে পড়ি মহুয়া খাবার জন্য। ব্যাটা কোথায় যেন দেখে এসেছে সিলড্ মহুয়া মাত্র কুড়ি টাকা লিটার। প্রাপ্তবয়স্ক গুলোকে ওটা খেতে এবং খাওয়াতেই হবে মাইরি।
আকাশকুসুম নেশার পরিকল্পনা চলে, বাবা-পিসি এবং আমাদের শৈশবের স্মৃতিচারণ চলে, চাটুজ্জে বাড়ি আর মুখুজ্জে বাড়ি অর্থাৎ বাবাদের মামার বাড়িতে ঘটে যাওয়া নানা গা ছমছমে ভৌতিক গল্পের চর্বিতচর্বন চলে, অতীতের না না রসাল গল্প হয় আর হয় গানবাজনা। কয়েক হাজার বার বলা ও শোনা গল্প গুলো যখন সাময়িক ভাবে পুরাণ হয়ে যায়, হঠাৎই খালি গলায় গান ধরে অয়ন।
অনেক তৈলমর্দন করলে টুকটাক গান গায় বুল্লু বাবু, মামির সঙ্গে ডুয়েট গায় তুত্তুরী। মায়ের দর বরাবরই বেশি, মধ্যরাত্রি সমাগত হলে তবে তাঁর গান গাইতে ইচ্ছে টিচ্ছে করে। ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’ হয়ে তুত্তুরীর হাত ধরে নাচে চৈতি। এমনকি আসুরিক গলায় গান গাই আমিও, বাড়ির মধ্যেই তো।
নাচার পালা হলে, মা আর পিসির হাত ধরে টানি। হাত তুলে মারের ভঙ্গি করে মা। পিসি কিন্তু কোমরে আঁচল জড়িয়ে রেডি, ‘ইনি-বিনি-টাপা-টিনি’। খানিক নেচে হাঁপিয়ে যায় পিসি, রিমোটে গান পজ করে অনিন্দ্য। ৮৭ বছর বয়সে ভাইপো ভাইঝি নাতি নাতনীদের সাথে নাচার ক্ষমতা কজন বাঙালি মহিলার থাকে মশাই। আমার পিসি সত্যিই অসামান্যা।
চাগিয়ে বড় স্পিকারটাকে দোতলা থেকে নামিয়ে আনে অনিন্দ্য। ভাগের গান বাজে, একেক জনের মর্জি মত এক একটা গান। কেউ যেন বঞ্চিত না হয়। এমনিই করে থাকি আমরা। এটাই আমাদের পার্টি।
মায়ের প্রিয় মাধুরী চট্টোপাধ্যায়ের মধু ঢালা কণ্ঠ গেয়ে ওঠে, ‘ ঐ যে সবুজ বন বিথীকায়, দূর দিগন্তেরও সীমানায়-’। বাবার শাম্মি কাপুরের ওষ্ঠ হেলনের আড়াল থেকে সঙ্গত করেন মহঃ রফি সাহেব, ‘ও দিল লেনে ওয়ালোঁ দিল দেনা শিখখো জী।’
আমার জন্য মুকেশ জী গান ধরেন, ‘ওঃ মেহবুবা, তেরে দিল কে পাশ হি হ্যায় মেরি মঞ্জিল এ মকসুব-’। রেশ মেলায় না, দুই খুদের দাপটে মঞ্চে নেমে পড়ে শ্রেয়া ঘোষাল, জুবিন নাটিয়াল আর অরিজিৎ সিং।
পিসির পালা আসে, অনিন্দ্য ফাজালামি মারা উদাত্ত কণ্ঠে জানতে চায়, ‘দিদি, ও দিদি, কি গান শুনবে গো তুমি?’ বাবার দিদিকে যে আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম দিদি বলে ডাকি, তা আশা করি জানেন সকলেই। লাজুক হেসে অনেক ভেবে চিন্তে জবাব দেয় দিদি,‘তুই সেই যে গানটা শোনাতিস না-’। লক্ষ্য আমি। কোন গানটা? ‘ঐ যে রে, যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভোলেনা মোরে-’। নতুন চাকরি পেয়ে কেনা প্রথম ল্যাপটপে কবে যেন শুনিয়েছিলাম গানটা, কোন বাংলাদেশী শিল্পীর কণ্ঠে। শৈশবের গান শুনতে শুনতে ভিজে উঠেছিল পিসির চোখ, সে অনেক অনেক কাল আগের কথা। তখনও আমি অনুঢ়া, শ্রীমতী তুত্তুরী জন্মাতে আরো বছর আড়াই তিন। আর বু্ল্লু বাবু তো সদ্যোজাত।
‘ কি গান বাছলে গো দিদি-’ বলতে বলতে ইউটিউব স্ক্রল করতে থাকে অনিন্দ্য। রাত বাড়ে, বাকিরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে খুচরো খুনসুটিতে, সিগারেট ফুঁকতে যায় বাবা, দাম্পত্য কলহে লিপ্ত হয় মা, সবার জন্য খাবার গরম করতে যায় চৈতি, ঢাকের সাথে টেমটেমির মত বড় মামীকে অনুসরণ করে তুত্তুরী।
সবকিছু থেকে নির্লিপ্ত, ঘোলাটে চোখে ছাতের কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে থাকে পিসি। পাশে গিয়ে বসতেই এক গাল হাসে। মা আর ছোট কাকিমা দুজনেই কর্মরতা ছিলেন বলে আমরা তিন ভাইবোনই ঠাকুমা আর পিসির কাছে মানুষ। ওদের চোখে আমরা তিনজনই সমান হলেও আমার সঙ্গে পিসির সম্পর্কটা বরাবরই একটু অন্য মাত্রা পায়। পাবে নাই বা কেন, সেই নার্সারি থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পিসির হাত ধরেই তো স্কুলে গেছি আমি। ছুটির সময় পিসির ছাতার তলায় সেঁদিয়ে বাড়ি ফিরেছি। ব্যাঁটরা পাবলিক লাইব্রেরিই বলুন বা তারাসন্দরী বালিকা বিদ্যাভবন, স্কুল পাল্টেছে, পাল্টায়নি পিসির আর আমার সমীকরণ। শুনলে হয়তো হাসবেন, প্রথম কলেজের দিনেও বাজার যাবার অছিলায় গেট পর্যন্ত ছেড়ে এসেছিল পিসি। আমার আইনানুগ বিবাহের সাক্ষী হয়েছিল পিসি আর অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ের বেলায় দিনভর অভুক্ত থেকে সম্প্রদান করেছিল পিসি। সম্প্রদান করতে করতে সে কি কান্না পিসির। পাশে একটা চেয়ারে লাঠি হাতে রাজার মত বসেছিলেন আমার জেঠামশাই, কান্না যে কি ছোঁয়াছে হয় সেদিন দেখেছিলাম। পিসিকে দেখে প্রয় শিশুর মত ফুলে ফুলে কাঁদতে লেগেছিল জেঠুও। সে কি বিড়ম্বনা।
পিসির পাশে বসে, শিরা ওঠা খসখসে হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বললাম, ‘আমার সাথে তমলুক যাবে দিদি?’ নিভন্ত দুই চোখ পলকে জ্বলে ওঠে দপ্ করে। ‘তমলুক? সে তো অনেএএক দূর।’ বলি, আমাদের উত্তমকুমারের তুফান মেল আছে তো। দেড়শো বছরের বুড়ো বাড়ি আর বাড়ির সদস্যদের জন্য চিন্তিত হয়ে পড়ে পিসি। ‘ আমি না থাকলে কি হবে?’
সত্যিই তো, ঠাকুমা চলে যাওয়া ইস্তক এই বুড়ো বাড়িটার প্রতিটি কোণে যে নজরদারি চলায়, সে আমার পিসিই তো। কে কখন বেরোচ্ছে, কে কখন ঢুকছে, কোন দরজায় ছিটকিনি লাগানো হয়নি,। কোন জানলার পাল্লা ভালোমত লাগছে না, কোথায় কাপড় শুকাতে দিয়ে বেমালুম ভুলেছে মা বা চৈতি, সব খেয়াল রাখে পিসি। ঈশ্বরের কৃপায় কোন ব্যধি নেই আমার পিসি থুড়ি দিদির। ইদানিং কানে একটু কম শুনছে, আর হাঁটুর ব্যথাটাও অল্প বেড়েছে। তাই নিয়েই দিনরাত কাজ করে চলে পিসি। অপ্রয়োজনে চার বার ঝাঁট দেয় গোটা বাড়ি। এঁটো বাসন পড়ে থাকতে দেখলেই দৌড়ে গিয়ে মেজে দেয়। অয়ন সেদিন বিরক্ত হয়ে বলছিল,‘বয়স্ক লোকজনকে কোথায় বলতে হয়, অত বসে থেকো না। একটু নড়াচড়া করো। আর আমাদের দিদিকে দেখ, একে হাত জোড় করে বলি তুমি একটু সুস্থির হয়ে বসো, অত কাজ করতে হবে না। তাও শোনে না।’
তমলুক ভ্রমণের কথা শুনে পিসির চোখে হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে উঠেও নিভে গেল। ‘আমি কি পারব?’
সবাই মিলে,সমস্বরে বললাম, পারবে না মানে? অয়ন বলল,‘ তবে দিদি, দোহাই যে শাড়ি গুলো বাড়িতে পরো,সেগুলো নিয়ে যেও না। আর প্রেশারের ওষুধটা অবশ্যই নিও। আর চশমাটাও। নাঃ থাক, দাঁড়াও আমিই গুছিয়ে দেব তোমার ব্যাগটা।’
বাচ্ছা আর বয়স্কদের খাইয়ে আমাদের খেতে বসতে বসতে রাত সাড়ে বারোটা। পিসি তখনও দোদুল্যমান। হয়তো মানসিক সমর্থন পেতেই বলল, ‘অনেকদিন তো এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাইও নি বল-’। ঠিক কাকে উদ্দেশ্য করা বলা কেউ বুঝল না, অয়ন বলল, ‘ আরে দিদি মন খারাপ করছ কেন? আজ রাতে ফুরফুরে মন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো, কাল উত্তম কুমার আসবে তোমায় নিয়ে যেতে।’ ‘অ্যাঁ উত্তম কুমার? সে আবার কি?’ ভেবলে গিয়ে প্রশ্ন করে পিসি। হেসে কুটোপুটি খেতে খেতে অয়ন বলে, ‘কেন ওর ড্রাইভারের নাম যে উত্তমকুমার তুমি জানো না।’ অতঃপর ‘ তিন ভাইপো ভাইঝি আর দুই নাতি নাতনীর সম্মিলিত চিৎকার, ‘ভদ্দর ঘর কি লড়কি ভাগি ডেরাইভার কে সাথ-’। রাত একটা অবধি 'ছোঃ ছোঃ ছোঃ কেয়া শরম কি বাত' চলল আমাদের। প্রায় জোর করেই মজলিস ভঙ্গ করল মা। পরদিন সকাল আটটায় রওনা দিতে হবে যে আমাদের।
স্কুল ছুটি থাকার সৌজন্যে দাদু-মাম্মাম(দিদা) আর দাদা (বুল্লুবাবু)কে ছেড়ে নড়ল না তুত্তুরী। মাত্র দুটো দিনের তো ব্যাপার। কাল বাদ পরশুই ফিরে আসতে হবে আমাদের, পিসিকে যত্নপূর্বক পৌঁছে দিতে হবে তাঁর ভাইপোদের জিম্মায়। ব্যাগ সমেত পিসিকে গাড়ি অবধি ছাড়তে এল তুত্তুরী আর তার বড় মামা। যত্ন করে চামড়ার নরম ব্যাগে পিসির জামাকাপড় গুছিয়ে দিয়েছে অয়ন। চেনের খাপে রেখেছে টাকার ব্যাগ, প্রেশারের ওষুধ। সুন্দর করে চুল বেঁধে এমনকি নেল পলিশও পরিয়ে দিয়েছে দিদিকে। উত্তমকুমারের গাড়ির জানলা দিয়ে ছুটে আসা উদ্দাম হাওয়া অবশ্য পিসির যতনে বাঁধা চুলগুলিকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। অবাক দৃষ্টিতে দুপাশে ছুটে চলা মানুষ, গাড়ি আর বাড়ি দেখছে পিসি। বাগনানের কাছে অসময়ের রুগ্ন দামোদর দেখে হতবাক হয়ে যায় পিসি। এই নাকি বাংলার দুঃখ? কোলাঘাটে রূপনরায়ণের বিস্তৃত রূপ দেখে অধিকতর হতবাক হয়ে পড়ে পিসি। দূরে রেল ব্রিজের ওপর দিয়ে উল্টোদিকে ছুটে চলা ট্রেন দেখে নিজের শৈশবে ফিরে যায় পিসি। উত্তমকুমার ওদিকে বলেই যায়,‘ আপনাকে আজ বিকালে বর্গভীমা মন্দির দেখতে নিয়ে যাব পিসিমা। কাল দীঘা যাবেন নাকি?’ বয়সজনিত শ্রবণশক্তি হ্রাস আর হাওয়ার দাপটে ভালো বুঝতেও পারে না পিসি। হাসে শুধু কান এঁটো করে।কানের গোড়ায় মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে শুধাই আমি,‘দিদি তোমার ভালো লাগছে তো?’ শীর্ণ হাতে আমার হাতটা চেপে ধরে বলে পিসি,‘ভীষণ ভালো লাগছে। ভাগ্যে তুই বললি আর ওরা জোর করে পাঠাল। এবার দেখ না, মাঝে মাঝেই জ্বালাব তোকে। বলব,তমলুক নিয়ে চ-’। জীবন বড় অনিশ্চিত,কে জানে কি লুকিয়ে আছে কালের গর্ভে, সম্বল বলতে শুধু এই অমৃত মুহূর্তটুকুই তো।
No comments:
Post a Comment