তুত্তুরী আর ফুলঝুরির গল্প -১
শ্রীমতী ফুলঝুরির আগমনের খবর শুনে মোটেই তেমন পুলকিত হয়নি তুত্তুরী। কাকিমার উদরের মধ্যে হঠাৎ কেউ মাথা চাড়া দিয়েছে, ব্যাপারটা প্রথম চোটে অবশ্য তেমন বোধগম্য হয়নি তুত্তুরীর। খুশির খবর পেয়ে বাড়ির সকলের সঙ্গে আনন্দে মত্ত হয়েছিলেন তিনিও। ধীরে ধীরে তিনি অনুধাবন করলেন, ও বাবা, আসন্ন অতিথি তো ভূমিষ্ঠ হয়েই দখল করে বসবে কাকিমাকে। তুত্তুরী এবং তার কাকিমার মধ্যে অন্য কেউ, ব্যপারটা মোটেই পছন্দ হল না তার। ঠারেঠোরে এমনকি শেষ পর্যন্ত সোচ্চারে সেটা জানিয়েও দিলেন তিনি। শুনে মা আর কাকিমা তো হেসেই খুন।
বেচারী কাকিমা প্রায় রোজই বলতে লাগল,‘ওরে না রে। তুই তো আমার প্রথম বাচ্ছা। তুই তো আমার প্রিয়তম বন্ধু। তোর জায়গা কি কেউ নিতে পারে?’ সাময়িক ভাবে গলে যায়, ভুলে যায় তুত্তুরী। আবার কেউ ঢুকিয়ে দেয় সন্দেহের বিষ, ‘তুমি বড় দিদি হয়ে যাবে। বেবি হলে তো কাকিমা তাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকবে।’ কিঃ আমার জন্য আর সময় থাকবে না কাকিমার হাতে? হে ঠাকুর এ কি হল-
দেখতে দেখতে, বোঝাতে বোঝাতে,হাসতে হাসতে এসে যায় নির্দিষ্ট দিনটা। ধরা ধামে অবতীর্ণ হন জুনিয়র তুত্তুরী। হুঁশ ফিরতেই ছবি পাঠায় কাকিমা, ‘তুই তো বোনই চেয়েছিলি-’। সে বোধহয় কোন দুর্বল মুহূর্তে কাকিমার আদরে দ্রবীভূত হয়ে বলে ফেলেছিলেন শ্রীমতী তুত্তুরী, বোন হলে বেশি খুশী হবেন। কিন্তু ফুলঝুরি আগমনের খবরে তিনি ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে গেলেন মাইরি। ‘আমি কক্ষনো বোন চাইনি। আমি ভাই চেয়েছিলাম। দেখছ ও আসতেই কাকিমা আমার কথা ভুলে গেছে-’।
বেচারী কাকিমা, সেলাই না শুকানোর যাতনায়, ছোট্টটার রাত জাগায়, ধেড়েটার অভিমানে হাবুডুবু খেয়ে মরে। কাকিমা আর তুত্তুরীর আভ্যন্তরীণ সম্পর্কে সাধারণতঃ জড়াই না আমি। কারণ কয়েকবার নাক গলানোর চেষ্টা করে দেখেছি, ব্যাটারা নিজেরা যতই মারামারি হাতাহাতি করুক, মাঝখানে আমার বা আমার নাকের উপস্থিতি উভয়েরই ঘোরতর নাপসন্দ। তবে এক্ষেত্রে তো আর হাত গুটিয়ে বসে থাকা যায় না।
তুত্তুরীকে শোনাই এমনি দুই জেঠতুতো-খুড়তুতো বোনের কথা। যাদের মধ্যে বয়সের ফারাক প্রায় তুত্তুরী আর ফলঝুরির মতই। রুনু-ঝুনুর গল্প। দিদিভাই আর আমার গল্প। দিদিভাইয়ের অন্ধ অনুগামিনী ছিলাম আমি। আমার চোখে সেরা রূপসী ছিল আমার দিদিভাই। তেরো বছরের বড় জেঠতুতো দিদির চলন,বলন, হাসি, সাজগোজ, নিপাট সাদাসিধে বোকা-বোকা প্রশ্ন সবকিছু অন্ধের মত নকল করতাম আমি। যত্ন না করা সত্ত্বেও মাছি পিছলে যাওয়া দিদিভাইয়ের পেলব ত্বকের দিকে কি হ্যাংলার মতই না তাকিয়ে থাকতাম আমি। কি প্রসঙ্গে যেন, কাকে একবার খুব সুন্দর দেখতে বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল দিদিভাই, তাজ্জব হয়ে গেছিলাম আমি। বলো কি? তোমার থেকেও সুন্দর? কেউ হতে পারে? অসম্ভব। তখন কলেজে পড়ি, বড় মাসি একবার বলেছিল, 'তোকে দিনদিন রুণার মত দেখতে হয়ে যাচ্ছে।' রুণা অর্থাৎ আমার দিদিভাই। কি যে পুলকিত হয়েছিলাম সেদিন। রীতিমত উড়তে উড়তে বাড়ি ফিরেছিলাম মাটির আড়াই ইঞ্চি ওপর দিয়ে।
অন্ধের মত নকল করতাম, দিদিভাইয়ের চালচলন,বাচনভঙ্গী। আজও করি, চেতন এবং অবচেতনে। গভীর চিন্তামগ্ন হলে যেভাবে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বাঁদরের মত মুখ করে থাকি, সেটাও তো আমার দিদিভাইয়ের নকলেই। ও যখন করত, ওকে সদ্য ফোটা কুসুমের মত লাগত। আমাকে যে কেন অমন লাগে না, বলে দাঁতমুখ খেঁচাই আমি। হেসে কুটোপুটি হয় তুত্তুরী।
দ্রব হওয়া কচি হৃদয়ে ভালোলাগা আর ভালোবাসার বীজ ছড়াই আমি। ফুলঝুরিও তো আমার মতই হবে। তুত্তুরী দিদিই তো হবে তার আদর্শ। তুত্তুরীকে যে এবার একটু বেশীখাটতে হবে। নিজেকে তুলে ধরতে হবে ভালো উদাহরণ হিসেবে। কারণ সব ব্যাপারে ফুলঝুরি তো নকল করবে তার তুত্তুরীদিদিকেই। ভাগ করে নেবে তার ভালো মন্দ, চেনা-অচেনা অভিজ্ঞতা যত। আর বয়ঃসন্ধিক্ষণে? কে হবে শ্রীমতী ফুলঝুরির মেন্টর? কে বোঝাবে, ছেলেদেরও ভালো লাগতে পারে, মেয়েদেরও। অথবা ভালো লাগতেই পারে উভয়পক্ষকে,কোনটাই দোষের না। কোনটাই পাপ বা অন্যায় নয়। কার সঙ্গে চিলেকোঠার ছাতে গিয়ে লুকিয়ে প্রথম সিগারেটে টান দেবে ফুলঝুরি? আর সেই যে, ‘শেলি বায়রন, শেক্ষপিয়র,টেনে গেছে শুধু ব্রাণ্ডি বিয়র’, তা কার কাছে প্রথমবার ব্রান্ডি/বিয়র খাওয়ানোর আব্দার করবে ফুলঝুরি? তুত্তুরীর কাছেই তো। ছোট বোন অন্য কারো পাল্লায় পড়লে কি আদৌ খুশি হবে তুত্তুরী। আর যেদিন আমরা কেউ থাকব না, কে থাকবে সেদিন তুত্তুরী আর ফুলঝুরির? একে অপরের ভরসাতেই তো পাড়ি দিতে হবে আরোও অনেক অনেক বছর। চোট আঘাত লাগলে, সামলাতে হবে একে অপরকে, বলতে হবে আহা রে তোর লাগল?
শুধু কি তাই, একটু বড় হলে ফুলঝুরিকে পড়াতেও হবে তুত্তুরীকে, পাশ থেকে ফোড়ন কাটে কাকিমা। নর্মালি পড়াশোনার কথা তুললেই বিরক্ত হয় তুত্তুরী। কিন্তু এক্ষেত্রে যেহেতু ছাত্রী ফুলঝুরি এবং দিদিমণি গিরি করবে তুত্তুরী তাই ব্যাপারটা তাঁর হেব্বি পছন্দ হয়। পছন্দ হয় শ্রীমতী ফুলঝুরিকেও। ‘ও মা কি মসৃণ স্কিন দেখো, গায়ে কি মিষ্টি গন্ধ দেখো, কি রকম পুটুস পুটুস করে তাকায় দেখো।’ দুই বোনের পিরিত দেখে গলে যায় মা আর কাকিমা। ব্যাপারটা বেশ ভালোই চলছিল, আচমকা, শ্রীমতী তুত্তুরীর কোলে এবং হাতে একটু অপকর্ম করে ফেললেন শ্রীমতী ফুলঝুরি। যিনি করলেন, তিনি তো প্রকৃতির আহ্বানে সাড়া দিয়ে অত্যন্ত মুক্ত বোধ করলেন এবং খিলখিলিয়ে উঠলেন, যাঁরা দর্শক, মোহক উল্লাসে ফেটে পড়লেন তাঁরাও, কেবল যার অপকম্মটা হল তিনি রেগে আগুন এবং তেলে বেগুন।
সে যাই হোক, শ্রীমতী তুত্তুরী এবং ফুলঝুরির অঙ্ক থুড়ি গপ্প তো সবে শুরু। আমরা মা এবং কাকিমা ঠিক করেছি, আমরা কোন দলে থাকব না। আমরা কেবল রগড় দেখব। কারণ মুখে যাই বলুক, আদতে দুটোই মহা ধড়িবাজ। দুটোর মধ্যে মিলও প্রচুর। তিনিও নিশাচর ছিলেন, ইনিও। ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করা হলে তিনিও অমনি করতেন, যেমন রাত দেড়টায় এখন ইনি করছেন।
No comments:
Post a Comment