Thursday 14 July 2022

অনির ডাইরি ১০ই জুলাই, ২০২২

 

#তাম্রলিপ্তকড়চা 



শুধু একবার ধুয়োটা তুলতে হত। যে কোন উৎসব, তা সে যে কোন ধর্ম বা সম্প্রদায়েরই হোক না কেন, পালন করতে সদা প্রস্তুত থাকত টিম চুঁচুড়া। আমার টিম চুঁচুড়া। এই ধরণের যাবতীয় বিদঘুটে পরিকল্পনার সুপ্ত বীজ, উপ্ত হত অবশ্যি এই অধমের উর্বর মস্তিষ্কে। আমি ধুয়ো তোলার পর, সেইসব ভুলে ভরা অবাস্তব পরিকল্পনাকে কেটে ছেঁটে বাস্তব রূপ দেবার দায়িত্ব নিত কৌশিক আর সঞ্চিতা। দুটোই ছিল ভয়ানক বাস্তববাদী। ওদের শিলমোহর পড়লে তারপর আসত ফাণ্ডের প্রশ্ন। এই নিয়ে মস্তিষ্ক প্রক্ষালনের দায়িত্ব ছিল সিকেসিও শুভজিতের। সবশেষে জানানো হত এসএলওদের। 'অমুক দিবসে, বৈকাল অমুক ঘটিকায় অনুগ্রহ করিয়া সমবেত হইয়া ধন্য করিবেন আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর চুঁচুড়াকে।' 


সবাই কখনই আসতে পারত না, গুটি কয়েক লোকজনই আসত, বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। পুরসভার বিদ্যুত, রেশমা আর চন্দ্রা, মগরার সংগ্রাম, মাম্পি,প্রিয়াঙ্কা আর পুজা, পোলবার রমেশ, প্রদীপ,সমীর, দেবী দি, মিঠুদি, কুমকুমদি, বাঁশবেড়িয়ার মহুয়াদি,নূপুর দি, ধনিয়াখালি থেকে অমৃতা, কৌশিক, পাণ্ডুয়া থেকে শান্তনু, আশিষ আর অভিষেক এবং বলাগড়ের শ্যামল। 


পুঁচকে আপিস, এত লোককে বসতে দেবার মত জায়গাও থাকত না, তাতেও দমত না লোকজন। নিজেদের আপিস মনে করে চলেই আসত। শ্যামল বলত,‘মন্দির’। কোর্ট বন্ধ হবার পর, 'সূর্য যখন অস্তে পড়ে ঢুলি- ', বুড়ো কালেক্টরেট জুড়ে ছড়িয়ে পড়া ছুটির মেজাজ, ব্যাগ গোছাত অন্যান্য দপ্তরের কর্মচারীবৃন্দ, পিছনের বারন্দাটা তখন গমগম করত, শুধুই আমাদের জন্য। 


SLOদের একটু দেরী করে জানানোর কারণ হল, রমেশ, মাম্পি এবং প্রিয়াঙ্কার কানে খবরটা একবার ঢুকলে, আর পরিকল্পনা বাতিলের সুযোগ থাকত না। রমেশের আনাগোণা বেশী ছিল বলে, আভাস পেয়েই যেত। আমরা চুপচাপ থাকলেও নানা অছিলায় ঐ প্রসঙ্গটাই তুলত, আশানুরূপ জবাব না পেলে শুকনো মুখে এসে বসত আমার উল্টো দিকের চেয়ারে, ‘ম্যাডাম, এবারে কি রথে জিলিপি পাঁপড় হবে না?’ 


রথের জিলিপি পাঁপড়, সে তো সবাই বাড়িতে খাই, কিন্তু আপিসে গোল হয়ে বসে ভাগ করে খাবার কি যে আনন্দ, তা কেবল বুঝত আমার টিম চুঁচুড়া। আপিসটাও তো একটা পরিবারই ছিল আমাদের, ভালোবাসা, রাগ অভিমান, ঝগড়া, চোখের জলে মাখামাখি একটা বৃহত্তর পরিবার।


যাই হোক, দিনক্ষণ ঠিক হয়ে যাবার পরই গঠিত হত অনেকগুলি কমিটি। যেমন আপিস সাফাই এবং সাজানো কমিটি। এতে থাকত প্রীতি, প্রিয়াঙ্কা, প্রদীপ আর আমাদের সুইপার তথা মালি তথা ষাটোর্ধ্ব এ্যাংগ্রি ইয়ং ম্যান অজিত দা। এক দফা সাফাই অভিযানের পর আসত রমেশ এবং কেঁচে গণ্ডুষ করত এতক্ষণের সাফাই অভিযান। বারন্দার গাছগুলোকে কাটছাঁট করে মেকাপ করাত মাম্পি। পড়ন্ত বিকেলের কনে দেখা আলোয়,  অন্য সময়ের অগোছাল সরকারী অফিসটাকে সেইদিন গুলোতে যেন চেনাই যেত না।


 খাবার কমিটিতে থাকত সোমনাথ,রমেশ আর ধীমান। মেনু সোমনাথ আর ধীমানের। প্রথমেই বলে দেওয়া হত, ‘বাপু হে এই অনুষ্ঠানে কিন্তু খাসি হবে না।’ 'অঃ খাসি হবে না', শুনেই ঝুলে যেত ধীমানের মুখ। আর সোমনাথ ডুব দিত গভীর চিন্তাসমুদ্রে। শেষ পর্যন্ত যা মেনু হত,সেটা ফেলতে হত কৌশিক সঞ্চিতা আর অরুণ বাবুর সামনে। খেয়ে পেটখারাপ করবে কি না বা অসুখবিসুখ বাঁধবে কি না এই নিয়ে চর্চার পর, অবশেষে পড়ত শিলমোহর। 


এরপর ধীমান আর রমেশ একচোট হাতাহাতি করত কোথা থেকে আনা হবে। ধারে নগদে যারা দেয়, তাদের খাবার তেমন পছন্দ হয় না এদের। রথের জিলিপিপাঁপড় অবশ্যি ধারে কেনার দরকার হত না, ওটা আমি খাওয়াতাম। পাঁপড়টা কিনে এনে প্রদীপ চা ওয়ালাকে দেওয়া হত,  ভালো তেলে মুচমুচে করে ভেজে দেবার জন্য। অতঃপর নির্দিষ্ট সময়ে একই সঙ্গে এসে হাজির হত জিলিপি আর পাঁপড়। আমার ঘরের পাখা, বাতানুকূল যন্ত্র সবকিছু বন্ধ করে কাগজের থালায় ঢালা হত স্তুপীকৃত জিলিপি আর পাঁপড়। হাতে হাতে চলে আসত আপিসের সব চেয়ার। বসে পড়ত যে যার বাঁধা জায়গায়। আমার ডানপাশের তোয়ালে ঢাকা চেয়ারটা নির্দিষ্ট থাকত চন্দননগরের বড়সাহেব তথা বড়দির জন্য। সবার মাথা হওয়া সত্ত্বেও শত অনুরোধেও ওণারা বসতেন না আমার চেয়ারে। টেবিলের সামনের চেয়ারগুলোয় বাঁ দিক থেকে বসত চঞ্চল, অরুণ বাবু, দর্প, সঞ্চিতা, কৌশিক আর নির্মল। পিছনের চেয়ারের একদম বাঁহাত থেকে বসত ধীমান,সোমনাথ,শুভজিৎ,প্রীতি ইত্যাদিরা। বিদ্যুতের জীবনেও বসার জায়গা হত না, ও বেচারী হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকত দরজার কাছে। সবার আগে ছবি তুলত রমেশ, অতঃপর,‘টুট পড়ো’। 


এক বছরের মধ্যেই বদলে গেছে চিত্রটা। পুরাণ মুখগুলোর জায়গা দখল করেছে নতুন মুখের দল। কুশীলব বদলে গেছে বটে চরিত্রগুলো বদলায়নি। বদলায়নি চিত্রনাট্য ও। এখানেও ধুয়ো তুলি আমি। সেটা নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করে আরএলও ইন্সপেক্টর সৌরভ আর পুরসভার ইন্সপেক্টর বেদজ্যোতি। অফিসে জিলিপি, পাঁপড় ব্যাপারটা কতটা বাস্তবসম্মত। অতঃপর ফাণ্ডের জন্য ফাইল যায় সিকেসিও শুভাশিষের কাছে। এবার ব্যাগড়া দিই আমি, আর ফাইল চালাচালির দরকার নেই বাপিরা। তুচ্ছ জিলিপি পাঁপড় স্পনসর্ করাটা আমার দায়িত্ব। আপিস সাজানো গোছানোর দায়িত্ব নেয় চঞ্চল,শুভাশিস আর উত্তম। বস্তাবন্দী হয়ে আবর্জনারা গুদামজাত হয়, সদ্য কেনা কন্টিনজেন্সি মালপত্র ভাগ করে পৌঁছে দেওয়া হয় ব্লকের শ্রমিক কল্যাণ সহায়তা কেন্দ্রগুলিতে। 


খাবার কমিটি হয় হক বাবু, শান্তনু আর অরূপকে নিয়ে। সরু জিলিপি না মোটা জিলিপি এই নিয়ে চলে দ্বন্দ্ব। ব্যক্তিগত ভাবে আমি রসে টইটুম্বুর মোটা বাঙালি জিলিপি ভালোবাসি। এদের অধিকাংশই সরু মুচমুচে জিলিপির পক্ষপাতী। পাঁপড় নিয়েও চলে বিস্তর অঙ্ক কষা। পাঁপড় কিনে এনে কাকে দিয়ে ভাজানো হবে? কারোর তেলের ওপরেই ভরসা করতে পারেন না হক বাবু। আমাদের চঞ্চল আবার দীক্ষা নিয়েছে, আঁশ খায় না। আপিসে যাবতীয় খাওয়াদাওয়ার সময় চঞ্চল শুকনো মুখে মুড়ি চিবোয়। কাজেই ভালো দোকান থেকে কিনতে হবে। 


অবশেষে অনেক গবেষণা করে, ডিমারীর রথের মেলা থেকে অর্ধ সুপ্ত জিলিপিওয়িলির ঘুম ভাঙিয়ে জিলিপি পাঁপড় ভাজিয়ে, চেখে কিনে আনে অরূপ, আশিষ আর উত্তম। চুঁচুড়ার মতই গাদাগাদি করে আমার চেম্বারে জড় হয় সবাই। আপিসের শেষ চেয়ারটাকে ঢুকিয়েও সবার জায়গা হয় না, জহর বাবু শেষে একটা টুল টেনে এনে বসেন। পাখা বাতানুকূল যন্ত্র বন্ধ করে দরদর করে ঘামি আমরা। জিলিপি আর আসে না। কই রে ভাই? ঠোঙাগুলো দেখিয়ে কোথায় গেল আশিষ আর অরূপ। বলতে না বলতেই কাঁসার থালায় সুন্দর করে সাজানো গুটি কয়েক বাটিতে করে চলে আসে জিলিপির দল।বুঝতে পারি,এদের সুন্দর করে পরিবেশনের তাগিদেই দেরী হচ্ছে। দূর দূর,অত সাজাতে হবে নি, দুটো থালায় উপুড় করে ঢেলে ফেল সবকিছু। ভাগ করে খাই সবাই। 


অ্যাসিড, গ্যাস,বদহজম নিপাত যাক, এমনি সৌহার্দ্যপূর্ণ মিষ্টিমধুর থাকুক আমাদের তাম্রলিপ্ত আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর। সকলকে রথ এবং উল্টোরথের বিলম্বিত শুভেচ্ছা। জিলিপির রসের মত মধুর আর পাঁপড়ের মত মুচমুচে কাটুক আপনাদেরও দিনগুলি।

No comments:

Post a Comment