Tuesday 9 August 2022

তুত্তুরীর দ্বাদশ জন্মদিন



 সময় বয়ে যায়, এক যুগেরও পার। এই তো মনে হয় সেদিনের কথা, প্রথম মোলাকাৎ তার সাথে। আর্কেডিয়ার উজ্জ্বল হলুদ রঙা ঘর, মাথার ওপর ঘুরন্ত ঘরঘরে পাখা, কপালে বয়স্ক ডাক্তারবাবুর স্নেহশীল হাত, কানে মৃদু রসিকতা, “হ্যাঁরে, তা শুনলাম তুই নাকি লেবার কমিশনার- আমাকে একটা চাকরী দিবি মা?” বলতে গেলাম কতকিছুই, বলার ছিলও অনেক কথা- পারলাম কই? জোড়া ফুসফুসের দখলদার তখন অচেনা কোন দৈত্য। এক ঝলক বাতাসের জন্য হাঁকপাঁক করতে করতে, ক্রমেই চোখের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল ঘোলাটে এক আস্তরণ- এমত ক্ষণে, সব পর্দা ফর্দাফাই করে ভেসে এল কার যেন হুঙ্কার-  প্রবীণ ডাক্তারবাবু সহর্ষে বলে উঠলেন, “বাপরেঃ না ভূমিষ্ঠ হতেই কি গলার জোর- শুনলি? শুনলি কি? তোর মেয়ে চিৎকার করছে, শোন।”  


 শৌভিকের সাথে বাইরে অপেক্ষা করছিল দিদিভাই-দাদাভাই- দাদারা- ছোট মাসি আরও যেন কারা কারা,  “প্রায় ফুটবল টিম ছিলাম আমরা” কৌতুকের সুরে গল্প শুনিয়েছিল শৌভিক। সবার শেষে এসেছিল আমার বাবা, পিতৃসুলভ আবেগে গদগদ হয়ে শৌভিক আজও বলে, “শ্বশুরটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল খুব”। মেয়ে নয় তো, শৌভিকের ইচ্ছাশক্তির জয় হয়েছিল সেদিন- বারবার বলত, “বুজু হবে। বুজু আসছে।”  কাঁচের ঘরের ভিতর থেকে নার্স দিদি দেখিয়েছিল ছোট্ট ঘুমন্ত বুজুটাকে, তারপরই পায়ের আঙুলে মেরে ছিল টকাস করে এক টোকা। কাঁচের দেওয়ালের ওপার থেকে ভেসে এসেছিল গগনভেদী হুঙ্কার। এপাশে অলক্ষ্যে দাঁত কিড়মিড় করেছিল বাবাও, খামোকা আমার মেয়েটাকে কাঁদায় কেন এরা, দুষ্টু লোক। দাদু অবশ্য হুঙ্কার শুনেই নাম রেখেছিল জগজ্জননী থুড়ি নজদগজনী।    


প্রথম দিকে বয়স মাপা হত দিনে, বাইশ দিনের মাথায়, এক কলসি পাউডার মাখিয়ে, তোয়ালে মুড়ে কি যেন একটা ইঞ্জেকশন দিতে নিয়ে গিয়েছিল মা আর দিদিভাই। ডাক্তারদিদির কড়া নিষেধ ছিল, তবুও ছোট্ট পায়ের পাতায় নিটোল কাজলের ফোঁটা এঁকেছিল জ্যাঠাইমা। সূঁচ ফোঁটাতেই নাকি ডাক্তার দিদিকে, “অ্যাও” বলে জব্বর ধমকেছিল তুত্তুরী। 


 দিনের হিসেব পাল্টে গেল সপ্তাহে। শিকারী বেড়ালের মত আসেপাশে ঘুরঘুর করত বুল্লু দাদা, ঘর ফাঁকা দেখলেই সনির্বন্ধ  অনুরোধ করত কচি গলায়, “একটু বোনিকে দাও না গো পিসি, একটি বার আমার কোলে দাও-”। একটু বড় হতেই, বোনির ডানা পাখনা গজাল, অনুমতির তোয়াক্কা না করেই দেড় পায়ে হামা টেনে টেনে দৌড়ত দাদার পিছু পিছু। একজনের দুধে দাঁত আর অন্যজনের ফোকলা হাসির ফাজলামিতে, উল্লাসে ফেটে পড়ত ব্যাঁটরার চাটুজ্জে বাড়ি। 


 সপ্তাহের হিসেব টপকে এল মাস, ঘুরল বছর। প্রথম জন্মদিনে মামমামের কোলে চেপে দাদুর হাতে পায়েস খাওয়া- রাতের বেলা হামলে পড়ে খাপলে খাওয়া জীবনের প্রথম চকলেট কেক। দ্বিতীয় জন্মদিনে বিশেষ কারণবশতঃ ছুটি পাইনি আমি। আমার অনুপস্থিতিতে আটকায়নি কিছু, পঞ্চব্যঞ্জন সাজিয়ে নাতনীর মুখের সামনে ধরেছিল মা। কোলে বসিয়ে পায়েস খাইয়েছিল  বাবা। ছুটি নিয়ে দৌড়ে এসেছিল শৌভিকও। সন্ধ্যে বেলা বাড়ি ফিরে ছবি দেখেছিলাম। মেয়ের জন্মদিন পালনের ছবি। তেচাকা সাইকেলে চড়ে দুধের বোতল হাতে ঝুমরো-ঝুমরো চুলে পোজ দেওয়া তুত্তুরী। 


 তৃতীয় জন্মদিনের কেকটার ওপর দুটো সাদা ক্রীমের হাঁস ছিল। কেক না কেটে, পরম হরষে হাঁসগুলোকে জবাই করেছিল তুত্তুরী। চতুর্থ জন্মদিনটা ছিল আমাদের ফ্ল্যাটে পালন করা প্রথম জন্মদিন। নাতনীর জন্য বেলুন ফুলিয়ে ফুলিয়ে বুকে ব্যথা হয়ে গিয়েছিল আমার বাবার। তখনও লিফট বসেনি,হাঁপানি রুগী হওয়া সত্ত্বেও নাতনীর জন্য হেঁটে চারতলায় উঠেছিলেন শ্বশুরমশাই। শুধু কি তাই, তুত্তুরীর জন্য টুপিও পরেছিল সবাই, ঝকমকে রাংতার টুপি। 


 পঞ্চম জন্মদিনে মেঘ ভাঙা বৃষ্টিতে ভেসে গিয়েছিল মহানগর। কোথায় যেন বেড়াতে গিয়েছিলাম আমরা- ষষ্ঠ জন্মদিনের আগে ডিপথেরিয়া বাঁধিয়েছিল তুত্তুরী। ষষ্ঠ জন্মদিনের আগে আরও একটা ঘটনা ঘটেছিল। তুত্তুরীর জীবনের অংশ হয়েছিল এষা আর অর্জুন। আজও মনে আছে যেচে পড়েই ফোন করেছিল এষা,‘এই দিদি, সামনেই তো তুত্তুরীর জন্মদিন-’।  ব্যাস ঐটুকুই, আর বলতে হয়নি। আর বলেও না এষা। প্রতি জন্মদিনের আগে একবার করে তাজ্জব হয়ে যায় শৌভিক, ‘এষাটাকে কে বলল?’ প্রতিবার একই জবাব দিই আমি,‘ এষাটাকে কি বলতে লাগে?’। এষা আর তুত্তুরীর মধ্যে অনুপ্রবেশের অধিকার কি আদৌ আমার আছে? না শৌভিকের আছে? একে এষায় রক্ষে নেই,তার ওপর আবার অর্জুন আর কুট্টুস দোসর। 


  সপ্তম জন্মদিনে প্রথম বার হাজিরা দিয়েছিল কাকিমা। নবম জন্মদিনে কেঁদেকেটে রেসিডেন্সিয়াল ট্রেনিং ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলাম আমি। দশম জন্মদিনে কোভিড আক্রান্ত  হয়েছিলাম তুত্তুরী আমি। সম্পূর্ণ গৃহবন্দী অবস্থায় পালিত হয়েছিল তুত্তুরীর জন্মদিন। একাদশতম জন্মদিনের আগে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল মা। প্রায় একপক্ষ ধরে চলেছিল যমে মানুষে টানাটানি। তারই মধ্যে মহকুমা শাসক হয়ে মহানগর ছাড়তে হয়েছিল শৌভিককে।  


আজ তাঁর দ্বাদশ জন্মদিন। বিগত এক বছরে বদলে গেছে অনেক কিছুই। নিজের বাড়ি, নিজের পাড়া, নিজের শহর ছাড়তে হয়েছে তুত্তুরীকে। ছাড়তে হয়েছে ছোট্টবেলার স্কুল। ছাড়তে হয়েছে প্রিয়তমা বান্ধবীকে। তাও থমকায়নি তুত্তুরী। হতোদ্যম হয়নি তুত্তুরী।  দাদু তাকে শিখিয়েছে যে, ‘সারভাইভাল অব দা ফিটেস্ট’। পরিবর্ত পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে না পারলে যে পিছিয়ে পড়তে হয়, আর যার নামই পুরোযা, সে তো পিছিয়ে পড়তে পারে না। পুরোযা মানেই যে অগ্রবর্তিনী বা পথপ্রদর্শিকা। 

 

 ভালো থেকো পুরোযা। লক্ষ্মী মেয়ে নয়, বরং লক্ষ্মী বাঈ হয়ে জমিয়ে মোকাবিলা করো জীবনের, তোমার জন্য ভালোমত একটা পৃথিবী রেখে যেতে পারব না হয়তো,তবে পৃথিবীর জন্য একজন জবরদস্ত জগজ্জননী রেখে যাব, এটাই থাকুক অঙ্গীকার।

No comments:

Post a Comment