পর্ব - ১
#অনির_পুজোর_ডাইরি #অনিরডাইরি
পুজো আসতে বাকি, আর মাত্রই কয়েক সপ্তাহ। তারপরই জনৈক বঙ্গ সন্তানের জলদ গম্ভীর কণ্ঠে ঘোষিত হবে, " আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির-।" আর তার ঠিক আট দিনের মাথায় আমাদের ট্রেন। ফি বছর ওমনিই তো বেরোই আমরা, অষ্টমী বা নবমীর দিন।
এবারের গন্তব্য দক্ষিণ ভারতের এমন এক প্রত্যন্ত অঞ্চল, যার আশেপাশে দূরদূরান্তেও নেই কোন বিমানবন্দর। ট্রেন-ই একমাত্র ভরসা। তাও কেবল একটিই ট্রেন। সেই ট্রেনে যেতে সময় লাগে পাক্কা দুই রাত। টিকিটের জন্য বিগত বৎসর থেকে যুদ্ধ করে চলেছি আমরা, এ বছর যাবারটা জুটলেও, ফেরারটা ঝুলে আছে অপেক্ষমাণ তালিকায়। যাবার টিকিটেরই বা কি ছিরি, দুটো সাইড আপার একটা সাইড লোয়ার বার্থ জুটেছে, তাও কামরার তিন কোনায়।
বিগত তিন চার মাস ধরে প্রতি ভোরে ঘুম থেকে উঠেই, PNR স্ট্যাটাস চেক করি আমি। প্রতি রাতে শুতে যাবার আগে, চেক করে শৌভিক। অপেক্ষমাণ তালিকার তাতে কিস্যু যায় আসে না। আপদ ভারতীয় রেল, ওই পথে আরও গুটিকয় ট্রেন দিলেই তো পারে বাপু, তা নয়।
রবিবারের রাত, ঘড়ির কাঁটা সদ্য স্পর্শ করেছে মধ্যরাত, আর ঘন্টা ছয়েক পর থেকেই শুরু হয়ে যাবে সাপ্তাহিক যুদ্ধ। নিদ্রা দেবীকে মন প্রাণ দিয়ে ডাকছি, তার আসার কোন লক্ষণই নেই। বছর ঘুরে মা আসছেন, কিন্তু সেই আনন্দানুভূতি কেন যেন কিছুতেই আসছে না। বিগত এক মাস ধরে যা চলছে, প্রথমে শাশুড়ি মাকে নিয়ে যমেমানুষে টানাটানি, তারই মধ্যে শ্রীমতী তুত্তুরীর ষাণ্মাসিক পরীক্ষা,তার মধ্যেই দুয়ারে সরকারের পাগল করা চাপ, শৌভিকের নৈমিত্তিক পেশাদারী ঝঞ্ঝাট, সবার উপর এই টিকিট কনফার্মেশন এর জটিলতা। কেনাকাটাও হয়নি কিস্যু। কাঁথি ছেড়ে নড়লে তবে না কেনাকাটি, ওই অনলাইনের ভরসায় যতটুকু হয়। রোজ রাতেই টেনশন করি আমি, যাঃ সব্বাই, সব কিনে নিলো গো। মোদের বুঝি আর জুটবে নি কিছুই। রোজ সকালে উঠে ভুলে যাই।
কেমন যেন ঘেঁটে যাচ্ছে সব। সামলানো যাচ্ছে না কিছুই। টিকিট যাও বা কাটা হয়েছে, হোটেল গাড়ি বুকিং কিছুই করা হয়নি। মধ্যরাতের নিভৃতিতে সেই কথাই কইছিলাম দোঁহে, এবার কিন্তু করেই ফেলতে হবে সব। হাতে সময় আর নেই। একটা প্রকাণ্ড দীর্ঘশ্বাস হঠাৎ শৌভিক বলল, " দূর ওখানে আর যাবই না।পচা জায়গা।" সত্যি বলতে কি কথাটা অমনঃপূত হল না আমারও, এত ঝঞ্ঝাট করে যেতে মন চাইছে না মোটে। তবু নীরব থাকি। মোটা লোকদের আবার সব ব্যাপারে মতামত দিতে নেই। দিলেই কিভাবে যেন সব দায় এসে চাপে তাদের ঘাড়ে। মাথার ওপর ঘট ঘট করে ঘুরতে থাকে বুড়ো শিলিং ফ্যানটা। জবাব না পেয়ে ঠেলে শৌভিক, "এই মধ্যপ্রদেশ যাবি?"
এবার সিরিয়াসলি ধড়মড় করে উঠে বসি আমি, আবার মধ্যপ্রদেশ? বিগত চারটে পুজোর মধ্যে তিনবারই গেছি ওই রাজ্যে। ওঙ্কারেশ্বর, মহেশ্বর, মান্ডু, উজ্জয়িনী, গোয়ালিয়ার, চান্দেরী, ওর্চা, শিবপুরী, ভীমবেটকা, ভোপাল, সাঁচি,বিদিশা সবই আমাদের ঘোরা। তাহলে?
উৎসাহ পেয়ে, উঠে বসে শৌভিক, মৃদু রাত আলোকের আলোয়, খাটের ওপর মুখোমুখি হাঁটু মুড়ে বসে চলে আমাদের গোল টেবিল বৈঠক। বৈঠকে শ্রীমতী তুত্তুরী অনুপস্থিত থাকলেও, এই আলোচনার মধ্যমণি তিনিই। মেয়ের ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট গুলোর ওপর দুর্দম আকর্ষণ, ভারতের কোন প্রান্তে কটা সাইট এই তালিকায় ঢুকেছে, কটা ঢুকতে চলেছে, দিবারাত্র এই নিয়েই চর্চা করেন তিনি। সেই সূত্র ধরেই ঠিক হয়, খাজুরাহ আর মার্বেল রক দেখতে গেলে কেমন হয়।
এতবার গেছি বলেই হয়তো পশ্চিমবঙ্গের বাইরে ভারতের এই অঙ্গরাজ্যটিকে এত আপন লাগে আমাদের। মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের দক্ষতা আর পেশাদারিত্ব অতুলনীয়। ভাষা বা খাদ্য সংক্রান্ত কোন জটিলতা কখনও হয় না। স্থানীয় মানুষজন অত্যন্ত বিনয়ী, আন্তরিক এবং ভদ্র। সেসব তো ঠিকই আছে, কিন্তু যাব কেমনে? এত বিলম্বে কি আর কিছুতে সিট বা বুকিং মিলবে আদৌ?
রাত সাড়ে বারোটায় খাজুরাহের নিকটবর্তী বিমানবন্দর দেখতে বসে শৌভিক। দেখা যায়,খাজুরাহতেই একখান এয়ারপোর্ট আছে বটে, তাও আন্তর্জাতিক মানের, কিন্তু কলকাতা থেকে কোন উড়োজাহাজ সেখানে অবতরণ করে না। বিমানবন্দর আছে জব্বলপুরেও, কলকাতা থেকে ডাইরেক্ট ফ্লাইট ও আছে,তবে ওয়ানস্টপ নয়। যেতে লাগবে ঘন্টা আটেক, আর টিকিটের দাম যা,বেচতে হবে কিডনি।
অগত্যা পুনরায় শরণাপন্ন হতে হয় ভারতীয় রেলের। রাত একটায় জ্বলে ওঠে ঘরের আলো, দৌড়ে গিয়ে মধ্যপ্রদেশের চার ভাঁজ করা ম্যাপটা নিয়ে আসে শৌভিক। নিয়ে আসা হয় ল্যাপটপ। রাত দুটো-সোয়া দুটো অবধি, গুগল ম্যাপে ফেলে দুজনে দেখতে থাকি, কিভাবে যাওয়া যায়, কি কি দেখা যায় ইত্যাদি প্রভৃতি।
দেখা যায়, ট্রেন তো আছে, কিন্তু যে দিন আমাদের ট্রেন ধরার কথা অর্থাৎ নবমীর দিন কলকাতা থেকে জব্বলপুর যাবার সমস্ত টিকিট ওয়েটিং লিস্টে চলে গেছে। "দূর ঘুমিয়ে পড়ি চল" হতাশ হয়ে বলি আমি। ঘড়িতে রাত দুটো কাল ভোরে শ্রীমতি তুত্তুরী স্কুল, আমাদের অফিস। এতক্ষণের উত্তেজিত নার্ভগুলির উপর দ্রুত নামছে হতাশার ক্লান্তি। দুই চোখে ঝপ করে নেমে আসছে গভীর নিদ্রার যবনিকা।
শৌভিক ঘুমাতে দিলে তো, "একদম শুবি না। একটু ভাবতে দে-।" অন্ধকার ঘরে পায়চারি করতে করতে বলে শৌভিক। নিষেধ সত্ত্বেও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বোধহয়, শৌভিকের ঠেলার চোটে, আঁতকে উঠে বসলাম, " কি হয়েছে?" চোখের ওপর জোর পাওয়ারের আলো জ্বলছে, ল্যাপটপ, ম্যাপ, সরকারি ক্যালেন্ডার ছড়িয়ে আছে বিছানা জুড়ে। আমার মাথায় দুঘা তবলা বাজিয়ে তিনি বললেন, " এই দেখ, সব প্ল্যান করে ফেলেছি। মহালয়ার দুদিন আগে বেরোব আমরা। মাত্র চার দিন ছুটি নিলেই কেল্লা ফতে। সব ফাঁকা,যাতে চাইবি, তাতেই কনফার্ম বুকিং মিলবে।
বন্ধ জানালা গলে পালায় ঘুম, ধড়মড় করে উঠে আয়েস করে বসি, এক কাপ চা হলে মন্দ হত নি, বলে দাঁত খিচুনি খাই। উল্টোদিকে একের পর এক হিসেব আর পরিকল্পনা বলতে থাকে শৌভিক, ভেবেচিন্তে সহমত বা দ্বিমত পোষণ করতে থাকি আমি। নাকচ ও হয় কিছু , ঘড়ির কাঁটা ছুটতে থাকে আপন গতিতে, তার থেকেও দ্রুত গতিতে ছোটে আমাদের মন আর মাথা। কানের পাশে কে যেন গুণগুণ করে ওঠে, " কাশ আর শিউলি পারফেক্ট পেয়ার, পুজো পুজো গন্ধ ইজ ফ্লোটিং ইন এয়ার।" এতদিনে মনে হচ্ছে তিনি আসছেন, আসছেন আনন্দকলস উপুড় করতে, সেই আনন্দের অংশীদার হতে হবে যে। এখনও কত কিছু বাকি, কে জানে কি হয় -
(চলবে)
পুনশ্চ - ছবিটি অজয়গড় দুর্গের। যাতে উঠতে নামতে সব মিলিয়ে ভাঙতে হয়েছিল প্রায় দেড় হাজার পাথুরে সিঁড়ি।
অনির পুজোর ডাইরি, ২০২৩
#অনিরডাইরি #অনির_পুজোর_ডাইরি
পর্ব -২
সেদিন রবিবার, আসছে রবিবার থেকেই শুরু হয়ে যাবে নবরাত্রি। নগর কলকাতা ভেসে যাবে হুজুগে উৎসবমুখর জনপ্লাবনে। সন্ধ্যা নামছে মহানগরের বুক জুড়ে। কি যেন একটা টিভি প্রোগ্রাম দেখছিলেন শ্বশুরমশাই একাকী। বৃদ্ধ-বৃদ্ধার নিভৃত সংসারে অসময়ের দরজা ঘন্টির শব্দে বেশ বিরক্ত হয়েই দরজা খুললেন।
একজোড়া সার্চ লাইট এর মত খর দৃষ্টি ঝপাং করে এসে পড়ল শৌভিক আর আমার মুখের উপর। কয়েক মুহূর্ত বুঝি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াল সময়। তারপর বৃদ্ধের দুই চোখে উপচে উঠল খুশির মহাপ্লাবন। "তোরা! এই অসময়ে-"। অসময়েই বটে, সেই কোন সকালে বেরিয়েছি কাঁথি থেকে, প্রথমে হাওড়া, তারপর দোঁহে কলকাতা। পাঁচ প্রিয়তম বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে পুজোর আগে এক ঝলক দেখার আশা নিয়ে।
হাওড়া আমায় আসতেই হতো, মাসিক টাকা-পয়সা তুলে দেবার জন্য, কলকাতাও যে সেই তালিকায় ঢুকবে গতরাতেও তা ঠিক ছিল না। বিগত দিন দিনেক ধরে কি যেন ইন্টারভিউ নিয়েছে শৌভিক । সপ্তাহান্ত হওয়া সত্ত্বেও জোটেনি বিশ্রাম, দুই চোখে গভীর ক্লান্তির কাজল। তাও লাফিয়ে লাফিয়ে আমার সঙ্গী হয়েছে। এক ঝলক বাপ মাকে দেখার জন্য।
ঘন্টা তিনেক লেগেছে হাওড়া আসতে। হাওড়ায় এসেই বরকে বাবা-মায়ের কাছে গচ্ছিত রেখে হাওড়া ময়দান দৌড়েছি আমি। মাস দুয়েক আগে একখান সাধের ব্লাউজ কিনেছিলাম। পুজোর ব্যাগ গোছাতে গিয়ে দেখি দুই সাইজ ছোট। কি যে অসম্ভব মন খারাপ নিয়ে ছটফট করেছি গত দুই রাত। কোন ছোট্টবেলা থেকে মায়ের সাথে ওই দোকানে যাচ্ছি, একবার বলেই দেখি না, যদি পাল্টে দেয়। যা দাম এই ডিজাইনার ব্লাউজ গুলোর।
গোটা রাস্তা এই নিয়ে খিল্লি করতে করতে এসেছে আমার বর। হাওড়ায় এসে দোসর হয়েছে বাবাও। আলোচ্য একটাই, এমন বেখাপ্পা আব্দার শুনে কেমন আমায় পাগল ঠাউরাবে দোকানদার। খিল্লি করাই স্বাভাবিক। বিল-প্যাকেট কিস্যুই নাই আমার। কাঁথির এক অনামা মিষ্টির দোকানের খোলে ভরে এনেছি ব্লাউজটা। কার্যক্ষেত্রে যদিও ভিড়ের জন্য ঘন্টাখানেক দাঁড়িয়ে থাকতে হলেও, জোটেনি কোন দুর্ব্যবহার। বুড়ো কর্মচারী, যাকে সবাই মামা বলে সম্বোধন করে, মেপে দেখিয়ে দিলেন যে মাপে কোন ভুল নেই। একটু সেলাই খুলতে হবে কেবল। সেটা ওঁরাই করে দেবেন, সময় লাগবে দিন চারেক।
চারদিন মাত্র? আমি তো পাক্কা বারো দিনের আগে ফিরছিই না এই শহরে। খুশির চোটে কুস্তি করে মায়ের আরও তিনটে ব্লাউজ কিনে যখন বাড়ি ফিরলাম, ঘড়িতে বেলা তিনটে। তখনও অভুক্ত বসে আছেন আমার জনক জননী। জামাই সামলাচ্ছেন যত্ন করে। এ এমন জামাই যে, চা, মিষ্টি, জাঙ্ক ফুড কিচ্ছু খায় না, ঘড়ি ধরে খায়, অসময়ে কিছু দাঁতে কাটে না। সে যাই হোক, অভুক্ত জামাইয়ের সামনে ওমন হাউহাউ করে খাওয়া যায় নাকি, অতএব -।
আসল কথা হল, আমরা কেউই বাবামায়েদের বিব্রত করতে চাই না। যাদের এই বয়সে সামান্য নড়তে দম বেরিয়ে যায়, পাঁচ মিনিট দাঁড়াতে হাঁটু কাঁপে, এক ধাপ সিঁড়ি ওঠানামা করতে লাঠি হলে ভালো হয়, তাদের কাছে আবার আপ্যায়ন কি? একই কথা প্রযোজ্য শ্বশুর-শাশুড়ির ক্ষেত্রেও। তাই হাওড়া থেকে বেরিয়ে, মলে খেয়ে ঢুকেছি আমরা। ভ্যাটভ্যাটে সাদা, জলের মত পাতলা চিজ সসওয়ালা পাস্তা আর গার্লিক ব্রেড। তাতে পকেটে যত বড় ফুটো হল, পাকস্থলী তেমন ভরল কই? উল্টে শ্রীমতি তুত্তুরী রেগে প্রবল হাত-পা ছুঁড়ছেন কাঁথিতে, "মাকে আলাদা পেলেই যত ভালো-মন্দ খাওয়াও।"
সেই গল্পই করলাম আমরা। দীর্ঘদিন বাদে মহানগরের পা রেখে কেমন বেমানান, বেকুব লাগে নিজেদের, তিলোত্তমার রূপে প্রানোচ্ছলতায় কেমন জুড়িয়ে যায় চোখ, পুড়িয়ে যায় চোখ, জিনিসপত্রের দাম দেখে কেমন কপালে ওঠে চোখ ইত্যাদি প্রভৃতি। তুত্তুরীকে আনিনি বলে সামান্য অনুযোগ করলেন শ্বশুরমশাই। আজই ফিরে যাব আমরা। এতটা যাতায়াত করতে ওর বড় কষ্ট হত, কাল ভোরে আবার স্কুল- বলতে বলতে থমকে গেলাম দোঁহে, রান্নাঘর থেকে গটগট করে বেরিয়ে আসছেন শাশুড়ি মাতা, একহাতে বৃদ্ধর জন্য চা অন্য হাতে, বগলে একাধিক বিস্কুটের ডাব্বা।
সত্যি দেখছি, না স্বপ্ন! এই তো মাস খানেক আগের কথা, জবরদস্তি যখন কলকাতা থেকে কাঁথি নিয়ে গিয়েছিল শৌভিক, গাড়ি থেকে ধরাধরি করে নামাতে হয়েছিল বৃদ্ধাকে। ওনার অবস্থা দেখে, আঁতকে উঠেছিলাম আমি আর তুত্তুরী। পূর্ণিমার চাঁদের মত গাত্রবর্ণে, পড়েছিল পুরো কালির পরত। দশাসই চেহারার অস্থিগুলোকে কোনমতে আঁকড়ে ঝুলছিল লোলচর্ম। জড়িয়ে যাচ্ছিল কথা, পায়ের পর পা ফেলতেও থমকাচ্ছিলেন,টলছিলেন, হুমড়ি খেয়ে পড়ছিলেন।
অবস্থা যে এতটা সঙ্গীন আমরা বুঝতেই পারিনি। শ্বশুরমশাই প্রায়ই বলতেন," জ্বর আসছে।" আর পাঁচটা বাঙালি বাড়ির মতই, জ্বর এলে প্রতিরক্ষার প্রথম লাইন হিসেবে দেওয়া হত প্যারাসিটামল। দিলেই পালাত জ্বর, আবার দিন তিনেক বাদে ফিরে আসত দল বল নিয়ে। সাথে যোগ হল যখন তখন মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া, আর সাংঘাতিক রকমের ডুমোডুমো রাশ।
অতঃপর পাড়ার ডাক্তার, টেস্ট, ওষুধ এবং পথ্য। ধরা পড়ে না কিছুই। উদ্বেগ বাড়ায় কেবলই হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ। ২০২২ এ ভয়ানক কমে গিয়েছিল হিমোগ্লোবিন, নেমে গিয়েছিল সাড়ে তিন।পাক্কা ছয় বোতল রক্ত দিতে হয়েছিল, যার মধ্যে দু বোতল দিয়েছিল তমলুক মহকুমা শাসকের বাহনচালক পলাশ আর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট অঞ্জন চৌধুরী সাহেব। তারপর থেকে আয়রন রিচ খাবারদাবার, ওষুধ দেওয়া হয় ওনাকে, থাকেন পেশাদার আয়ার তত্ত্বাবধানে। তারপরেও সাড়ে পাঁচ হিমোগ্লোবিন নামে কি করে?
উদ্বেগের মধ্যেই একের পর এক ডাক্তার বদলান শ্বশুরমশাই, নিয়ে যান মহানগরের বড় থেকে বড়তর হসপিটালে। কিন্তু ব্যর্থ হয় সবাই। জ্বর সেই আসতেই থাকে, উনি বারবার উল্টে পড়ে যেতেই থাকেন। অবস্থা শেষ পর্যন্ত এমন দাঁড়ায় যে উচ্চ তাপমাত্রায় সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন শাশুড়ি মা। তড়িঘড়ি শ্বশুরমশাই আর প্রতিবেশী পট্টনায়ক কাকু মিলে নিয়ে যান এক সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে। খবর পেয়ে সব কাজ ফেলে কলকাতা ছুটে যায় শৌভিক, পৌঁছাতে লাগে ঘন্টা চারেক, গিয়ে দেখে ওই জ্বর কমানোর ইনজেকশন দিয়ে ফেরৎ পাঠিয়ে দিয়েছে হাসপাতাল। সামান্য কিছু ওষুধ দিয়েছে, যা এমনিই সবার ঘরে থাকে।
মহানগর ডাহা ফেল করার পর নিছক কথা প্রসঙ্গেই কাঁথির সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার বাবুকে ব্যাপারটা জানানো হয় । সাম্প্রতিক টেস্ট রিপোর্টগুলি বুড়ো শ্বশুরমশাই হোয়াটসঅ্যাপ করতে পারেন না বলে, ফোনে জেনে-টুকে দেখানো হয় ওনাকে।
এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারবাবুর প্রথম বক্তব্যই ছিল, বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করানো, এসব মূল্যবান টেস্ট দেখে বোঝা যাচ্ছে, যে ওনার কি হয়নি। কিন্তু কি হয়েছে, সেই টেস্ট বা তার রিপোর্ট কোথায়? একটা সাদামাটা রক্তের পরীক্ষা করতে দেন উনি। রিপোর্ট কি এলে চিকিৎসা করা সহজ তাও জানিয়ে দেন আগে ভাগে। আর যদি তা না আসে, তাহলে খারাপতম ব্যাপারটার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত হতে বলেন।
রিপোর্ট হুবহু মিলে যায় ওনার ভবিষৎ বাণীর সাথে। এরপর আর সময় নষ্ট না করে বুড়োবুড়িকে সোজা নিয়ে আসা হয় কাঁথি। স্বচক্ষে বৃদ্ধাকে প্রত্যক্ষ করে ডাক্তারবাবু জানান এটা সেপসিস। কোন সাংঘাতিক ইনফেকশন হয়েছে ভদ্রমহিলার। যার মূল জীবাণু,এতদিন ধরে এতজন ডাক্তারের দেওয়া অ্যান্টি বায়োটিকে মরে গেলেও ছেড়ে গেছে তার বিষ। সেই বিষের দহনেই বিগত বছরে হিমোগ্লবিন নেমেছিল সাড়ে তিন।
জানান, পরীক্ষা নিরীক্ষা চলতেই থাকবে, সর্বাগ্রে শিরায় দিতে হবে চড়াতম ডোজের অ্যান্টিবায়োটিক।দিতে হবে গোটা পনেরো। তবে ইতিমধ্যেই অনেক দেরী হয়ে গেছে, এমতবস্থায় গোটা ছয়েক অ্যান্টিবায়োটিক যদি উনি নিতে পারেন,তবেই আশা আছে, অন্যথা খারাপতম ঘটনার জন্য যেন আমরা মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকি।
এরপরের দুই সপ্তাহ যে কি অসম লড়াই করেছিলেন ভদ্রমহিলা আর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র, তার সাক্ষী বৃদ্ধ শ্বশুরমশাই, তুত্তুরী আর আমি। একদিকে চড়া অ্যান্টিবায়োটিক, অন্য দিকে রক্তরস দিতে হচ্ছিল বৃদ্ধাকে। প্রতি দেড় দিনের মাথায় বদল করতে হচ্ছিল হাতের চ্যানেল। সে যাতনা চোখে দেখা যায় না। যেদিন ডাক্তার বাবু ছাড়পত্র দিলেন, যে এবার উনি সুস্থ, সেটা ছিল শৌভিক এর জন্মদিনের আগের রাত। জন্মদিনের সেরা উপহার।
তবে সেদিনও ভাবিনি আর কখনও ভদ্রমহিলাকে এই রূপে দেখতে পাব। তখনও হাঁটতে গিয়ে থরথর করে কাঁপছিলেন উনি। তখনও জড়িয়ে যাচ্ছিল কথা। আজ, সেই মহিলা নিষেধ করা সত্ত্বেও নিজে হাতে চা করে খাওয়ালেন আমাদের,মুখের সামনে সুন্দর করে সাজিয়ে ধরলেন কেক আর বিস্কুট। এঁটো কাপ গুলো মাজতে গেলাম তো হাত থেকে কেড়ে নিলেন জোর করে, এও কি সত্যি!
রাত বাড়ছে, উঠে পড়লাম আমরা। কাল আবার অফিস। মহালয়ার দুদিন আগে থেকে ছুটি চেয়েছি দোঁহে, পঞ্চমী থেকে সারা পুজো ঘাঁটি আঁকড়ে মহকুমা সামলাবে শৌভিক । তার আগে কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে যাব আমরা। ফলে পুজোর মধ্যে আর সাক্ষাৎ হবে না আমাদের সাথে। এর পর যখন আসব, ততদিনে বিদেয় নেবেন দশ ভূজা। তবে এখনই সে কথা ভেবে কি লাভ। আনন্দ কলস পূর্ণ হতে যে এখনও ঢের দেরী।
(চলবে)
পুনশ্চ - ছবিতে সকাল সাতটার পান্না
অনির পুজোর ডাইরি, ২০২৩
পর্ব ৩
#অনির_পুজোর_ডাইরি #অনিরডাইরি
আর মাত্র ঘন্টা আধেক, তারপরেই বেজে উঠবে সেই বহুকাঙ্খিত বাঁশি খানা। হেলতে দুলতে গড়াতে শুরু করবে ট্রেনের চাকা। বিগত কয়েকদিনে যেই প্রশ্ন করেছে, " পুজোয় কোথাও যাচ্ছ নাকি?" একই জবাব দিয়েছি আমি, টিকিট তো কাটা আছে মধ্যপ্রদেশের, তবে ট্রেনের চাকা না গড়ানো পর্যন্ত বলতে পারি না, যে যাচ্ছি।
আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই হয়ে যাবে ফয়সালা, যাচ্ছি, নাকি যাচ্ছি না। কি যে অসীম উদ্বেগে কে
টেছে বিগত কয়েকটা দিন। উদ্বেগ দুই বাড়ির বাবা মায়েদের শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে, উদ্বেগ তুত্তুরীর স্কুলের ছুটি না পড়া নিয়ে, উদ্বেগ আমাদের ছুটি অনুমোদিত হওয়া/ না হওয়া নিয়ে। আজ যখন হাওড়া স্টেশন থেকে মাত্র পাঁচশ মিটার দূরে আছি, এবার তো কেটে যাবার কথা সব বাদল। মুখোশের মত টুপটাপ ঝরে যাওয়া উচিৎ যাবতীয় উদ্বেগের অবগুণ্ঠন।
ছুটি অনুমোদনের পূর্ব শর্ত মেনে পঞ্চমীর ভোর রাতে কাঁথি ফিরে আসবে শৌভিক। বাকি পুজোটা "একা কুম্ভ" হয়ে ঘাঁটি গেড়ে পড়ে থাকবে কাঁথিতে।আমি আর তুত্তুরী অবশ্যই থাকব না। আমাদের কাছে পুজো মানেই প্রাণের শহর, হাওড়া। পঞ্চমীর মধ্যরাত্রে ট্রেন থেকে নেমে সবাহন শৌভিক, সবৎসা আমায় ছেড়ে আসবে পিত্রালয়।
ব্যাপারখানা লেখা যতটা সহজ, আদতে গোজগাছ করাটা ছিল ততটাই জটিল। কাঁথির নিবাস খালি করে, তিন ব্যাগ প্যাকিং করতে হয়েছে আমায়। বামাল সমেত দুটো ঢাউস ব্যাগ আগেভাগে গিয়ে রেখে আসতে হয়েছে হাওড়ায়। কারণ বেড়াতে গিয়ে যে পোশাক পরব তা পুজোর দিনে পরা যায় না, আবার পুজোর সাজে ভ্রমণ অসম্ভব, ইত্যাদি প্রভৃতি। প্রায় অরভিন রোমেলের মতো ছক কষে সামলাতে হয়েছে সব রণাঙ্গন।
প্যাকিংয়ে বিন্দুমাত্র সহায়তা করতে পারেনি আমার বর। পুজোর ছুটি পড়ার আগেই ছুটি নেওয়ায়, জমা কাজ শেষ করতেই নাভিশ্বাস উঠেছে লোকটার। গতকাল বাড়ি ফিরেছে রাত পৌনে দশটায়, তার পাক্কা সাড়ে এগারো ঘণ্টার মধ্যে পোঁটলাপুঁটলি সমেত রওনা দিয়েছি আমরা। ট্রেন বেলা একটা দশের শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস। একটায় ট্রেন ধরতে, নটায় বেরোনো নিয়ে প্রবল আপত্তি ছিল শৌভিকের। নূপুর বাবু ছাড়তে যাবেন সঙ্গে সিকিউরিটিও থাকবে, তিন ঘন্টায় আরামসে পৌঁছে যাব হাওড়া। দশটা না হলেও সাড়ে নটায় তো বেরোলেই হয়।
উভয়ের মধ্যস্থতায় সোয়া নটায় বেরিয়েছি আমরা। নিয়মানুবর্তিতার কোন অপবাদ এই ট্রেনের নাই, ফলে আগামী অন্তত ২৬ টি ঘণ্টা আমাদের কাটতে চলেছে ট্রেনেই।তাই সবথেকে আরামদায়ক আর ঘরোয়া পোশাকে রওনা দিয়েছি আমরা, পেট ভরে খেয়ে রওনা দিয়েছি আমরা। ট্রেনে কোন প্যান্ট্রি কার নাই, ফলে স্যান্ডউইচ আর মিষ্টি সুখ নিয়েছি বাক্স ভর্তি করে।
পাক্কা অফিস টাইমে বেরোলেও, ফাঁকায় ফাঁকায় পেরিয়ে গেলাম রূপশ্রী মোড়, হেঁড়িয়া, উলুবেড়িয়া, পাঁচলা এমনকি অঙ্কুরহাটির ভিড়ে ভরা পুজোর হাটও। শৌভিক আড়ামোড়া ভেঙে বলল, "বারোটার আগেই পৌঁছে যাব। তেমন হলে কিছু খেয়েও নেব।"
একরাশ অগ্রিম শারদ শুভেচ্ছা জানিয়ে ইছাপুর জলট্যাঙ্কে নেমে গেল তুত্তুরীর মাসি, এখান থেকে হাওড়া স্টেশন আর মিনিট পনেরোর গল্প। ডান হাতে কদমতলা বাজার হয়ে হাওড়া ময়দান,সেখান থেকে একটুখানি। কি মনে হল, এই সময় ওই পথে জ্যাম হতে পারে, তার থেকে সোজা বাইপাস ধরে আরও তাড়াতাড়ি হবে। বলে না, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়, ময়দানের মুখে পড়ার ৫০০ মিটার দূর থেকেই শুরু হল ট্রাফিক জ্যাম। এই ঘোর মধ্যাহ্নে এত ট্রাক, বাস, টেম্পো, গাড়ি, বাইক কিভাবে একই সাথে এসে হাজির হল জানিনা, সব মিলিয়ে শুদ্ধ বাংলায় যাকে বলে, যানবাহন চলাচল স্তব্ধ।
ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছাড়িয়ে সাড়ে ১২ টপকে গেল কুল কুল করে ঘামছি আমি, মনে আকুল প্রার্থনা ট্রেন যেন মিস না হয়। খোদ ট্রাফিক পুলিশ ফাঁড়ির সামনে এত জ্যাম, কেন ঠাকুর? হয়তো ঈশ্বর প্রেরিত দূত হয়েই আচমকা এসে উদয় হলো এক মহিলা সিভিক ভলান্টিয়ার। জানতে চাইল, গন্তব্য কোথায়, কটার ট্রেন। ট্রেনের টাইম জেনে আঁতকে উঠে বলল, " সামনে রাস্তা সারাই চলছে। ঘুরিয়ে নিন স্যার, এই বেলা ঘুরিয়ে অন্য পথ ধরুন। না হলে দুটোর আগে কোন মতে পৌঁছাতে পারবেন না।"
কপাল গুণে ঠিক সেই মুহূর্তে এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা যে গাড়ি ঘুরতেই পারে, কিন্তু ঘড়ি যে বলছে, পৌনে একটা বেজে গেছে। গাড়ি ঘুরিয়ে সেই ইছাপুর জল ট্যাংক- কদমতলা বাজার - পঞ্চাননতলা হয়ে ময়দান পৌঁছতে অন্তত আরো আধঘন্টা তো লেগেই যাবে। তাছাড়া ওই পথে হাওড়া ময়দান পৌঁছেও যদি দেখা যায় এমনই জ্যাম, কি হবে?
আনন্দময়ীর আশির্বাদ আর নূপুর বাবুর হাত যশে, বাকি পথটা বোধহয় উড়েই গিয়েছিলাম, আর একটু দেরী হলেই হুইসেল বাজিয়ে রওনা দিত মোদের সাধের ছুটির ট্রেন। এক হাতে টানা ব্যাগ অন্য হাতে শ্রীমতী তুত্তুরীকে নিয়ে কি ছুটই না লাগলাম দোঁহে। আর এই মুহূর্তে, সকল উদ্বেগের অবসান ঘটিয়ে যখন গড়াতে শুরু করেছে ট্রেনের চাকা, ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়ছে হাওড়া স্টেশনের নয় নম্বর প্লাটফর্ম, নিজেকে দেখতে পাচ্ছি না বটে, তবে দেখতে পাচ্ছি, অনুভব করতে পারছি কি চলছে সামনের দুজনের মনের মধ্যে। শৌভিকের চোখে মুখে এখনও লেগে আছে সন্দেহের ছাপ, তুতুরি দুচোখে অগাধ বিস্ময়। সত্যিই যাচ্ছি তাহলে-
(চলবে)
পুনশ্চ: - ছবিতে খাজুরাহের বিশ্বনাথ মন্দিরের উল্টোদিকে অবস্থিত মনোলিথিক নন্দী মহারাজ
অনির পুজোর ডাইরি, ২০২৩
পর্ব ৪
#অনির_পুজোর_ডাইরি #অনিরডাইরি
আজব ট্রেন মাইরি শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস। নামেই এক্সপ্রেস। বাংলা ছাড়ানোর সাথে সাথেই বনে গেছে লোকাল। বাংলা থেকে ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ হয়ে তবে মধ্যপ্রদেশে ঢোকেন মহাশয়। পথে থামেন প্রায় সব স্টেশনে। হাওড়া ছাড়ানোর পর বর্ধমানে যা হকার উঠেছিল, তারপর থেকে ওঠেনি আর একটাও হকার। এক কাপ চায়ের জন্য প্রাণটা হা হা করছে।
এত স্টেশনে থামছে, কিন্তু একটাও চা ওয়ালা উঠছে না। স্টেশন গুলোও কেমন যেন,জনশূন্য। নেই কোন স্টল বা ফেরিওয়ালা। আলোআঁধারি স্টেশনে লোকজন নামছে আর গায়েব হয়ে যাচ্ছে। অথবা জনহীন স্টেশনে দুম করে উদয় হচ্ছে এক দঙ্গল ক্লান্ত মানুষ।
সন্ধ্যা প্রগাঢ় হয়ে রাত নামে। ডিনারের অর্ডার নিতে আসে না কেউ। কেবল জলের বোতল বিক্রি হয় ট্রেনে। IRCTC থেকে মেসেজ পাঠায়, খেতে চাইলে অর্ডার করুন। রাত ন'টা নাগাদ ট্রেনটা বারকাকানা নামক এক ইস্টিশনে থামার কথা, সেখানেই খাবার অর্ডার দেয় শৌভিক। দুটো এগ থালি, মূল্য ৪৮০ টাকা। রাত পৌনে দশটা নাগাদ ট্রেনটা যখন পৌঁছায়, দুটি থালি আসে বটে, তাতে ডবল ডিম থাকলেও ঝোল মাত্র এক চামচ। মোটা আলো চালের ভাত, সামান্য ডাল, ছোলার তরকারি আর দুটো রুটি। কথা ছিল বাটার রুটি দেওয়া হবে, আদতে হাতে গড়া ঘরোয়া রুটি। আচারের প্যাকেট হন্যে হয়ে খুঁজেও পাই না। উল্টে ডিমের ঝোলে মেলে এক টুকরো কাঠ।
আগের দিনের ট্রেনটা ঘন্টা আড়াই লেটে পৌঁছেছিল, আজ কি হবে কে জানে। জব্বলপুর অবধি টিকিট থাকলেও, আমরা নামব দক্ষিণ কাটনি বলে একটা স্টেশনে। সেখানেই অপেক্ষা করবে গাড়ি। দক্ষিণ কাটনি থেকে গন্তব্য, সোজা মাডলা। সেখানেই অভয়ারণ্যের লাগোয়া পান্না জঙ্গল ক্যাম্প, আগামী দুদিন আমাদের আস্তানা।
দক্ষিণ কাটিনি থেকে পান্না জঙ্গল ক্যাম্পের দূরত্ব ১৪২ কিলোমিটার। গুগলে বলছে সময় লাগবে সাড়ে তিন ঘণ্টা, তাই আজ আর কোথাও ঘুরতে যাবার পরিকল্পনা রাখিনি আমরা।
ভাগ্যক্রমে মাত্র পনেরো মিনিট দেরিতে আমাদের নামিয়ে দিল শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস। আরো মিনিট ১৫/২০ অপেক্ষা করতে হল ড্রাইভারের জন্য, যিনি ভুল বুঝে আড়াই কিলোমিটার দূরে কাটনি মুড়ারওয়া স্টেশনে গিয়ে প্রতীক্ষা করছিলেন আমাদের। বাকি পথে অবশ্য আর কোনো সমস্যা হয়নি।
কাঁথি থেকে বয়ে আনা স্যান্ডউইচ আর মিষ্টি সুখ দিয়ে প্রাতরাশ সেরেছি আমরা। সকাল থেকে জোটেনি এক কাপ চাও। হোটেল পৌঁছাতে গড়িয়ে যাবে বিকেল। পথে দাঁড়িয়ে জম্পেশ করে মধ্যাহ্ন ভোজন করার মত কোন দোকানপাট পেলাম না আমরা। কাটনি খুব ছোট্ট শহর। শহর ছাড়ালেই হাইওয়ে, যার দুদিকে কেবল চাষের জমি। মাঝে মাঝে পড়ে ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম। রাস্তার ওপরেই শুকায় শস্য। চড়ে মোষ। রাস্তার অবস্থা ও খুব ভালো নয়।
পথে পাওয়া একমাত্র ভদ্র সভ্য দোকান থেকে মসলা চা আর পকোড়া দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সেরে যখন মাডলা পৌছালাম, ঘড়িতে বিকাল সাড়ে চারটে। পান্না জঙ্গল ক্যাম্প একদম ছবির মত সুন্দর। কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে জঙ্গল থেকে আলাদা করা। নিস্তব্ধতার চাদরে মোড়া, চারটি দোতলা কাঠের কটেজ। প্রতিটি কটেজে চারটি করে ঘর। ঘরের লাগোয়া বারন্দায় বসেই কাঁটাতারের বাইরে ঘন জঙ্গলের শোভা উপভোগ করা যায়।
সদ্য বর্ষা শেষ হয়েছে, জঙ্গল এখন সত্যিই পান্না সবুজ। মধ্যপ্রদেশের দুটি জেলা, পান্না আর ছত্রপুর জুড়ে অবস্থিত এই অভয়ারণ্যের আয়তন হল ৫৪২ বর্গ কিলোমিটার। এককালে মহারাজা ছত্রশালের রাজধানী ছিল পান্না। ভারতের ২২ তম আর মধ্যপ্রদেশের পঞ্চম অভয়ারণ্য পান্না। বয়সে নিতান্তই অর্বাচীন। ১৯৯৪ সালেই পান্নাকে বাঘেদের অভয়ারণ্য ঘোষিত করা হয়।
বাঘ ছাড়াও চিতা, স্লথ ভাল্লুক, চিতল হরিণ, সম্বার, নীল গাই, চৌখাম্বা ইত্যাদির নিবাস পান্না। ২০০৯ সালে রাতারাতি বাঘ শূন্য হয়ে পড়ে পান্না। কারণ হিসেবে বলা হয় যে, এখানকার পুরুষ বাঘেরা নাকি, বাচ্চা বাঘগুলোকে খেয়ে নেয়। এবং চোরা শিকার অবশ্যই। তখন বান্ধবগড় আর কানহা থেকে দুটি মহিলা বাঘ আর পেঞ্চ থেকে একটি পুরুষ বাঘকে নিয়ে আসা হয় পান্নায় বংশ বিস্তারের জন্য।
বর্তমানে পান্নায় সাকুল্যে ৮০টি বাঘ আছে। আয়তনে বিশাল হবার জন্য, এই জঙ্গলে তেনাদের দেখা মেলা অবশ্য লটারি পাবার সামিল। বিশেষত এই মুহূর্তে। আমরা অবশ্য এসেছি জঙ্গল দেখতে। জঙ্গলের রূপ রস গন্ধ ছন্দকে প্রতিটি রোমকূপে ভরে নিতে। তবে যদি তিনি দয়া করে দর্শন দেন, তাহলে খুশির সীমা থাকে না, এই আর কি। শৌভিক বলেই রেখেছে, ক্যামেরা এনেছে বটে, তবে সামনে যদি তিনি এসে দাঁড়ান, তাহলে প্রথম চোটে মোটেই ছবি তুলবে না। বরং দেখবে প্রাণ ভরে। সামনে যেই আসুক, মোরা আগে দেখব। তারপর হুঁশ ফিরলে, তিনি যদি পোজ দেন তো ভাবা যাবে ছবির কথা।
এখন অবশ্য ওসব কিছুই ভাবার মত অবস্থায় নেই আমরা। আপাতত ভালো করে স্নান, গরম চা, চটজলদি নৈশ ভোজ আর ঘুম। কাল ভোর চারটেয় উঠতে হবে। ছটা থেকে আমাদের সাফারি শুরু, তবে শুধু সেই জন্য নয়, কাল মহালয়া যে। কালই তো বেজে উঠবে তাঁর আলোর বেণু। রেডিও নেই বটে, গুগল তো আছে। আর আছে কলকাতা ক এর ওয়েবসাইট। বছর ভর অনেক অপেক্ষা করিয়েছেন তিনি, এবার তো জলদি এসো মা।
(চলবে)
অনির পুজোর ডাইরি, ২০২৩
পর্ব ৫
#অনির_পুজোর_ডাইরি #অনিরডাইরি
চারটে বাজতে দশে অ্যালার্ম দেওয়া ছিল আজ, অবশ্য অ্যালার্ম বাজার আগেই ঘুম ভেঙে গেছে দুজনের। আজ মহালয়া যে। কলকাতা 'ক' এর ওয়েবসাইট খুলে দিলাম, ঘর ভেসে গেল বীরেন ভদ্রের উদাত্ত কণ্ঠস্বরে। পাশের ঘরেই এক অবাঙালি পরিবার আছে, গতকাল অনেক রাত অবধি ভেসে আসছিল গ্লাসের টুংটাং শব্দ, চাপা হাসি, অট্টহাস্য, উত্তেজিত মৃদু কথাবার্তা। নগর কলকাতায় থাকলে হয়তো শোনাই যেত না, কিন্তু পান্নার জঙ্গলে অসীম নৈঃশব্দের মাঝে, বড় বেমানান লাগছিল ওই উল্লাস। বেশ বিরক্ত হচ্ছিল তুত্তুরী। এখন অবশ্য তাঁরা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। তাঁদের ব্যালকনিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে মূল্যবান বোতল, খালি- আধ খালি গ্লাস। এবার এই ব্রাহ্ম মুহূর্তে, এই বাঙালি পরিবারের জ্বালাতন করার পালা।
ঘরেই দেওয়া কেটলি আর দুধ, চিনি দিয়ে কফি বানিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসলাম দুজনে। জঙ্গলের গায়ে এখনও আঁধারের চাদর। জঙ্গলের মাথার ওপর ঝিকমিক করছে হীরের কুচির মত সহস্র তারা। তাদের মধ্যে শুকতারার দীপ্তিই আলাদা। পৌনে ছটায় গাড়ি আসবে আমাদের, ছটা থেকে সাফারি শুরু। চলবে বেলা এগারোটা অব্দি। দুক্ষেপে জঙ্গল দেখব আমরা। এগারোটায় ফিরে স্নানাহার সেরে, আবার বেরোব বিকেল পৌনে চারটেয়। পরের সাফারি বিকেল চারটে থেকে যতক্ষণ না সন্ধ্যা নামে।
আজকের প্রাতঃরাশ জঙ্গলেই সারব আমরা। গতকাল রাতে হোটেল থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল, কি প্রাতঃরাশ নিয়ে যেতে ইচ্ছুক আমরা- পরোটা-জিরা আলু, আলু পরোটা -দই, ব্রেড-বাটার, স্যান্ডউইচ নাকি অন্য কিছু। যা বলা হবে, ওনারা তাই প্যাক করে গাড়িতে তুলে দেবেন। সাথে দেবেন মাথাপিছু দুটো করে সিদ্ধ ডিম, দুটি করে কলা আর প্যাকেজড জুস। চা কফিও বানিয়ে রাখবে, যাতে খেয়ে গাড়িতে উঠতে পারি।
হুড খোলা জিপসি তে আমাদের প্রথম জঙ্গল সাফারি, উত্তেজনায় ফেটে পড়তে চাইছে হৃদয়। জিপসিতে ড্রাইভার এর পাশের আসনে বসবে গাইড। পিছনের উঁচু সিটগুলো আমাদের জন্য। জিপসির গায়ে ২/৩ টি আঁকাবাঁকা পাদানি করা আছে তাতে পা দিয়ে উঠে, গাড়ির দেওয়াল টপকে ঢুকতে হয়। অন্য কোন রাস্তা নেই। যাদের হাঁটুর সমস্যা থাকে, তাঁরা কি করে ওঠেন ভগবান জানে। মাঝের সিটে বসব আমি আর শৌভিকের ক্যামেরার পিট্টু ব্যাগ, পিছনে ক্যামেরা বাগিয়ে ওরা বাপ আর মেয়ে।
শুরু হল যাত্রা। মাডলা গেট দিয়ে ঢুকতে হলে আগে থেকে করিয়ে রাখতে হয় পারমিট। বনদপ্তরের ওয়েবসাইট থেকে পারমিট করা থাকলে জিপসি আর গাইড পাবেনই। না হলে এসেও করাতে পারেন, সে ক্ষেত্রে গাড়ি ফাঁকা থাকলে তবেই পাবেন। আমাদের সব আগে থেকেই বুক করা ছিল। হোটেলে বললে, ওরাই সব ব্যবস্থা করে দেয়। তার জন্য নেয় কিছু অতিরিক্ত মূল্য। সেটা আমাদের সরকারি হোটেলের ক্ষেত্রে দেড় হাজার টাকা। আশেপাশের বিলাসবহুল রিসর্ট গুলিতে তার মূল্য পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা। বিদেশি হলে অবশ্য সবই দ্বিগুণ হয়ে যায়। খাজুরাহর সৌজন্যে পান্নায় বিদেশি ভ্রমণ পিপাসুর সংখ্যাও অনেক বেশি। তুলনায় বাঙালি নগন্য।
পরপর লাইন দিয়ে দাঁড়ালো জিপসি গুলো। সাকুল্যে দশ-বারোটা গাড়ি আজ। বাঘ দেখার সম্ভাবনা কম বলে পান্নায় পর্যটকও বান্ধবগড় ইত্যাদির তুলনায় অনেক কম। ঠিক ছটায় গেট খুলে গেল, ছুটতে শুরু করল গাড়িগুলো। জঙ্গলে প্রবেশ করেই ছিটকে গেল যে যার মত। এখনও ভালো করে আলো ফোটেনি, বাতাসে বেশ ভালো ঠান্ডা।
পান্নার জঙ্গলের চরিত্র প্রতি কিলোমিটারে বদলে যায়। মাডলা গেট দিয়ে ঢুকলে প্রথমেই পড়ে বেল আর কয়েতবেল গাছের জঙ্গল। পাবেন খয়ের গাছ আর কি যেন একটা ভূতিয়া গাছ। গাছের কাণ্ড রূপালী রঙের আর পাতাগুলো এই মরশুমে লাল। দূর থেকে চাঁদের আলোয় নাকি এই গাছগুলোকে মানুষ বলে ভ্রম হয়, তাই স্থানীয় বাসিন্দারা ওদের 'ভূতিয়া পেড়' বলে। তারপর শুধুই সেগুন গাছের জঙ্গল। জঙ্গলে প্রথমে সাক্ষাৎ হল এক দঙ্গল চিতল হরিণের সাথে। বেপরোয়া হরিণ যত, পাত্তাই দিল না আমাদের বা জীপটাকে। অন্তত ২৫-৩০ জন তো হবেই। পুরুষ মাত্র হাতে গোনা, তাদের মধ্যে জনা দুয়েকের মাথায় বিশাল শিং,যেমন আমরা ছবিতে দেখি। বাকিদের মাথার শিং ছোট এবং মেরুন রঙ মোজার মতন পাতলা আস্তরণ দিয়ে ঢাকা।
গাইড বললেন,এগুলোকে Antler বলে, horn নয়। হর্ন হলে তা পাকাপাকি হয়, যেমন পুরুষ চৌখাম্বা, নীলগাই বা সম্বর হরিণের মাথায় দেখতে পাওয়া যায়। চিতলের শিং বছরে একবার ঝরে যায়। মোজার মত পাতলা আস্তরণটা রক্তজাল বহন করে। শিং বেশ বড় হয়ে গেলে, ওই ভেলভেটের মতো স্তরটা শুকিয়ে আসে। ফলে রক্ত সংবহন বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যাওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই শিং গুলো আমাদের osteoporosis হওয়া হাড়ের মত মুচমুচে আর ফোঁপড়া হয়ে পড়ে। তখন হরিণ গিয়ে গাছে মাথা ঘষে। ঘষতে ঘষতে শিং গুলোকে ভেঙে ফেলে। ভেঙ্গে ফেলা শিংগুলো মিনারেল এ ভর্তি থাকে বলে, সজারুর মত কিছু বন্যজন্তু আবার ওই গুলো খেয়ে তাদের মিনারেলের অভাব পূরণ করে।
গাইড শোনাতে থাকেন পান্নার ইতিহাস। সমগ্র জঙ্গলটাই নাকি পান্নার রাজা সম্পত্তি ছিল। জঙ্গলের মধ্যে রাজার ব্যক্তিগত ফার্ম হাউস আজও আছে। সম্প্রতি রাজার উত্তরসুরিরা ওইখানে একটি বিলাসবহুল রিসর্ট করার পরিকল্পনা করছে। গাড়ি গড়ায়, গড়ায় গাইড দাদার গল্পও। পথে দেখা হয় সপরিবার সম্বর হরিণ আর নীলগাইদের সাথে। চিতল, সম্বর, নীলগাই পাশাপাশি থাকে, একই সাথে ঘাস খায়। বাচ্ছা গুলোও মনে হয় যেন একই সাথে খেলা করে। গাছের উপর থেকে বাঁদর আর লেঙ্গুরদের সাথে বার্তালাপ করে। অ্যান্টিলোপ হওয়া সত্ত্বেও দূরত্ব বজায় রাখে চৌখম্বা। তিনি নাকি সাংঘাতিক লাজুক। গাইড বলেন, " শের মিল জায়গা, পর উসকা দর্শন মিল না মুস্কিল হ্যায়।" সর্বত্র চূড়ান্ত অলসতার ছাপ। আমরা ছবি, ভিডিও তুলি, ফুসফুসে ভরে নিই টাটকা জংলি সুবাস।
আবার গাড়ি গড়ায় মন্থর গতিতে, মুঠোফোনে কি যেন দেখতে থাকে গাইড, স্থানীয় ভাষায় কি যেন বলে ড্রাইভারকে, তারপর আমাদের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, " চেপে ধরে বসুন। গাড়ি ছুটবে এবার, কল এসেছে।" 'কল' অর্থাৎ সাবধান বাণী, বাঘ বা লেপার্ড আসছে। মূলত বাঁদর, লেঙ্গুর এরা গাছের উপর থেকে যদি বাঘকে আসতে দেখে, তাহলে এক বিশেষ ধরনের আওয়াজ করে। যাতে সচকিত হয়ে যায় চিতল- সম্বর-নীলগাইয়ের দল। কল শুনতে পেলেই, একে অপরকে মেসেজ পাঠায় ড্রাইভার আর গাইডরা। যেখানে কল আসে সেখানেই এসে জমায়েত হয় সব গাড়ি। নির্দিষ্ট দূরত্ব অনুযায়ী দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে জিপসি গুলো, আর সওয়ারিদের বলা হয়, মোবাইল সাইলেন্ট রাখুন আর একদম কথা বলবেন না। বললেই পালাবে মহারাজ।
ঝড়ের বেগে পৌছে গেলাম আমরা। তখনও শোনা যাচ্ছে, 'কুপ - কুপ' করে কল, থেমে-থেমে, আস্তে-আস্তে। এবার পালা অপেক্ষার। অপেক্ষা করলেই যে তিনি আসবেন এমন নয়। ওই কল তাঁরও পরিচিত। ফলে কল শুনে তিনি রাস্তা বদলে ফেলতেও পারেন। তবুও, এই অপেক্ষা করার মধ্যেই লুকিয়ে আছে যাবতীয় উত্তেজনা। জঙ্গলের এই অংশটি জুড়ে কেবল তৃণভূমি। আফ্রিকার তৃণভূমির মত, সোনালী হলুদ রঙের বড় বড় ঘাস চতুর্দিকে। মাঝে মাঝে নড়ে উঠছে ঘাস, আর বয়ে যাচ্ছে শিহরণ।এলেন কি! তিনি এলেন কি! আচমকা দুলে উঠল পিছনের ঘাস, একসাথে পিছন ফিরল সব কটা গাড়ির সমস্ত আরোহী। ছুটে মাটির রাস্তা পেরিয়ে চলে গেল যে, আয়তনে পাড়ার নেড়িদের সাইজ হবে। গায়ের রং চুনে হলুদ, তার ওপর কালো প্যাস্টেল রং দিয়ে যেন ডোরা কেটে দিয়েছে কেউ। একা নন, সঙ্গে দোসর আছে। আরেকটি একই সাইজের মহাশয়। আকারে ক্ষুদ্র হলেও, দুটোই ব্যাপক নাদুসনুদুস চেহারা। ছবি তোলা ভুলে চোখ দিয়ে গিলছি আমরা। দুই পুঁচকেও রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত দেখল আমাদের। চোখগুলো বোধ হয় কালো পুঁতি দিয়ে তৈরি । ভোরের সূর্যালোকে ঝকমক করছে। এতদিন সার্কাসে দেখেছি, চিড়িয়াখানায় দেখেছি আর দেখেছি স্টাফড টয় হিসেবে, এই প্রথম তাঁর রাজত্বে তাঁর দর্শন পেলাম। সত্যি বলছি পুতুল, চিড়িয়াখানা বা সার্কাসের বাঘের থেকে হাজার হাজার গুণ সুন্দর এবং অভিজাত। স্বর্গীয় সঞ্জীব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কি সাধে বলে গেছেন, "বন্যরা বনে সুন্দর-"।প্রাথমিক মুগ্ধতা কেটে গিয়ে সবে ক্যামেরা অন করেছি, আচমকা যেন কানের কাছে গর্জে উঠল কেউ। রক্ত জল করা সে চিৎকার। মা ডাকছে,"পালিয়ে আয় বাবু।" দুই খুদে ওমনি দে ছুট। বেশ খানিকক্ষণ ধরে শুধু কাঁপতে থাকল ঝোপঝাড়।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment