রাত একটা। চাটুজ্জে বাড়ির বুড়ো দেওয়াল ঘড়িটা যদিও চিৎকার করছে, ‘হুঁশিয়ার! পৌনে দুটো বেজে গেছে কিন্তু।’ ওটা অমনিই করে। সবসময় এক ঘন্টা এগিয়ে দৌড়য়। তাতেই নাকি সবার সুবিধা।
সামান্য উসখুস করতে শুরু করেছে আমার বাবা। আমাদের আড্ডা শুরু হওয়া ইস্তক গোটা দুই সিগারেট ইতিমধ্যেই ফুঁকে ফেলেছে। আরেকটা ফোঁকার সময় সমাগত। আশি পেরিয়েছে কয়েক বছর হল, সিগারেট ছাড়ার কথা বলে বলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে পারিবারিক ডাক্তার বাবু। দুদিন বন্ধ রাখে বাবা। তৃতীয় দিন থেকে আবার পুনঃমুষিক ভব। মৃদু তাড়া দেয় মা, রাত অনেক হল এবার ঘুমাতে হবে তো নাকি? যাদের উদ্দেশ্য করে তাড়া দিল মা, তাদের একদল, ‘সাইকেলের দুদিক চাকা,মধ্যে ফাঁকা’ গানে উদ্দাম হাত পা ছুঁড়ছে। অপর দল তাদের দেখে হেসে উল্টে যাচ্ছে। আজ দুপুরে হাওড়া থুড়ি বাপের বাড়ি এসেছি আমি আর আমার দ্বাদশী কন্যা তুত্তুরী, কর্মসূত্রে বর্তমানে আমরা তাম্রলিপ্ত নগরীর বাসিন্দা। কাল বিকেলে আবার ফিরে যাব নিজ নিকেতন। আবার শুরু হবে ইঁদুর দৌড়। হাতে অবকাশ বলতে এই রাতটকুই। আমি আর তুত্তুরী হাওড়া এলেই জম্পেশ আড্ডা বসে ব্যাঁটরার চাটুজ্জে বাড়িতে, বাবা আর পিসি দুই ভাইবোন, আমরা তিন খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন, তুত্তুরী আর বুল্লুবাবু দুই মামাতো- পিসতুতো ভাইবোন, আমার মা আর আমাদের আদরের ভাতৃবধূ চৈতি সব মিলিয়ে আড্ডাবাজদের সংখ্যা কি কম? আর এটা তো শ্রীমতী তুত্তুরীর জন্মদিন স্পেশাল আড্ডা। শুধু আজকের জন্য শ্রীমতী তুত্তুরীকে নিজে হাতে সাজিয়ে দিয়েছে তার প্রাণাধিক প্রিয় বড় মামী। জন্মদিন উপলক্ষে জম্পেশ দেখে একটা গল্পের বই উপহার দিয়েছে বড়মামা।
জমে উঠেছে আমাদের আড্ডা থুড়ি পার্টি। নাচ গানের ফাঁকে ফাঁকে চলছে যে যার স্কুলের গল্প। তুত্তুরী আর বুল্লুবাবু অর্থাৎ আমার কন্যা আর ভাইপোর গল্পগুলো আধুনিক যুগের, আমাদের তিন খুড়তুতো-জেঠতুতো ভাইবোন অর্থাৎ অয়ন, অনিন্দ্য আর অনিন্দিতার গুলো মধ্য যুগের, বাবা আর পিসির গুলো সেই আদি প্রস্তর যুগের। তা হোক, স্বাদে-গন্ধে-সৌরভে- দুষ্টুমি আর দুরভিসন্ধিতে সব সমান। উফ কি নচ্ছারই না ছিলাম আমরা। এমন অনেক গল্পই আজকাল আমরা খোলাখুলি বলতে পারি, যা এক দশক আগেও মা বা পিসির সামনে বললে পিঠের চামড়া তুলে ডুগডুগি বাজানো হত। বাবা অবশ্যি চিরকালীন বেস্ট ফ্রেণ্ড।
স্বর্গীয় ছোটকাকুও তাই ছিলেন। তাঁর গল্পও ওঠে কোন না কোন প্রসঙ্গে। উঁচু টেবিলের ওপর দাঁড় করানো,নকল মুক্তোর মালা পরানো ছবিটায় কি কোন আলোড়ন ওঠে? খেয়াল করি না কেউ। হয়তো পাশের ছবিটা থেকে খেয়াল করেন ছোট কাকিমা। আজ যেমন অনিন্দ্য, ছোটকাকুর হাতে বিভিন্ন কারণে ঠ্যাঙানি খাবার গল্প বলছিল। রঞ্জিত মল্লিকের মত বেল্ট খোলার বদভ্যাস থাকলেও ছোটকাকুর হাতই ছিল যথেষ্ট।
মারকুটে অবশ্য আমার মাও কম ছিল না। শৌভিক বিশ্বাস করে না, কিন্তু কাঠের লম্বা স্কেল থেকে, হাত পাখার হাতল, প্লাস্টিকের চিরুনি, সাঁই করে ছুটে আসা হাওয়াই চপ্পল কিসের দ্বারাই না আহত হয়েছি আমি। হাওয়াই চটির মহিমা আপামর রাজ্যবাসীর ঢেড় আগে থেকে টের পেয়েছি আমরা। অয়ন, অনিন্দ্যও কি ও রসে থুড়ি অভিজ্ঞতায় বঞ্চিত ভেবেছেন।
মা আবার মৃদু তাড়া দেয়। বুড়ো ঘড়িতে সোয়া দুটো। মানে রাত দেড়টা। চুনোপুঁটি দুটো তখনও হাত পা ছুঁড়ছে কি যেন ভয়ানক গানে। এইসব অনিন্দ্যর অপকীর্তি। কোথা থেকে বানায় এমন প্লে লিস্ট ভগবান জানে। ব্যাটারা একটা ভদ্রসভ্য গান চালা না। অয়ন বিরক্ত স্বরে বলে, ‘ওসব মুর্গি ডান্স বন্ধ কর। রাতে ঘুম আসবে না তোদের। দাঁড়া আমি একটা চালাই।’ ঘর ভেসে যায়, ‘পহেলা নেশা’র মূর্ছনায়।
আবার তাড়া দেয় মা। সিগারেট ধরিয়ে উঠে পড়ে বাবা। সম্প্রতি ভাইরাল ফিভার থেকে উঠে বড্ড দুর্বল হয়ে গেছে বাবা। কানেও যে কি বাঁধিয়েছে। পিছন থেকে গাড়ির হর্ন শুনতে পাবে না এই ভয়ে বেশ কদিন আর রাস্তায় বেরোচ্ছে না বাবা। বিরাম নেই শুধু সিগারেট টানার। রাত দশটা থেকে এইটি তিন নম্বর সিগারেট। তাহলেই বুঝুন।
মায়ের তাড়া খেয়ে মনে পড়ে যায়, কেকটাই তো কাটা হয়নি এখনও। আজ আমাদের পার্টি শুরুই হয়েছে একটু বিলম্বে। প্রায় রাত দশটায় আপিসের কাজ মিটিয়ে বাড়ি ফিরেছে অনিন্দ্য। আসার সময় ভাগ্নির জন্য বয়ে এনেছে জব্বর একখান কেক। কেক কম, ক্রিম বেশি। ঠিক যেমনটি ভালোবাসেন শ্রীমতী তুত্তুরী। হাক্লান্ত অনিন্দ্যকে একটু ধাতস্থ হবার সময় দিতে গিয়ে আর কাটাই হয়নি কেকটা। ঠিক হয়েছিল, নৈশ ভোজন মিটলে, ওটা আমরা ডেজার্ট হিসেবে খাব সবাই মিলে।
মায়ের গুঁতো খেয়ে অবশেষে চটজলদি সাজানো হয় কেকটা। গ্লাসে গ্লাসে ঢালা হয় জিরু। আমাদের আড্ডা বসবে আর জিরু বাবু থাকবে না, তাও কি হয়। কেককে ঘিরে সুন্দর করে সাজানো হয় জিরুর নটি গ্লাস। ছুরি নিয়ে প্রস্তুত হয়ে যান শ্রীমতী তুত্তুরী। মামা-ভাগ্নি অর্থাৎ অনিন্দ্য এবং তুত্তুরীর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও কেকের ওপর থেকে রং মশালটা সরিয়ে দিই আমি। ওটা মহা আপদ। বড্ড বারুদ ছেটায়। আর এর আগেও তো দুবার রং মশাল জ্বালিয়ে কেক কেটে ফেলেছে তুত্তুরী। পরিবেশের আর কত ক্ষতি করবি বাপু তোরা। যুক্তিতে হেরে গিয়ে পিছিয়ে যায় মামা ভাগ্নির টিম। স্পিকারে বেজে ওঠে, "হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ" এর ধুন। কেকের একটা পুঁচকে টুকরো কেটে সবার মুখে মুখে ধরে তুত্তুরী। কেক কামড়াতে গিয়ে তুত্তুরীর আঙ্গুল মৃদু কামড়ে ফেলে পিসি, হাসির হুল্লো়ড় ওঠে একচোট। কে যেন বলে আসছে বছর আবার হবে, হোক হোক বলে উল্লাস জাহির করে জিরুর গ্লাসে ঠোঁট ডোবাই আমরা। কে জানে কি হবে আসছে বছর, বাবা মা পিসির স্বাস্থ্য প্রতিদিন ভেঙে পড়ছে একটু একটু করে। ওরাই তো আমাদের শিকড়, যতদিন ওরা থাকবে ততোদিনই মূলের সঙ্গে যুক্ত থাকব আমরা, আর তারপর কি হবে- সে চিন্তা এই মুহূর্তে করে লাভ কি? আপাতত এই সুখের মুহূর্তটাকে তো পান করেনি এক নিঃশেষে। কাল যা হবে,দেখা যাবে।
No comments:
Post a Comment