Wednesday 9 June 2021

অনির ডাইরি ৯ই জুন, ২০২১

 


মা হবার সবথেকে বড় সমস্যা হল, যে কোন সুখাদ্য আস্বাদন করতে গেলেই,  চোখের সামনে ভেসে ওঠে, একজোড়া কচি কচি কুৎকুতে চোখ। খেতে বড় ভালোবাসে মেয়েটা আমার। চুঁচুড়ার স্পাইসির স্পেশাল মটন বিরিয়ানির কাছে ওসব আপনাদের আরসালান, আমিনিয়া বা রহমানিয়া নেহাৎ শিশু। এক কৌটো সুবাসী ভাতের মধ্যে একখণ্ড তুলতুলে তোবলা আলু, তার নীচে লুকিয়ে থাকা একটি সিদ্ধ ডিম আর থুলথুলে একখান মাটন। 


কাল আমাদের মহারণ, তার আগে চাঁদা তুলে বিরিয়ানি খাওয়া। বলির আগে ইয়েকে কচি কাঁঠাল পাতা খাওয়ানোর সমতুল হলেও, খেতে আর পারলাম কই, কয়েক চামচ সুবাসী ভাত আর আলুটা খেলাম বটে, বাকিটা প্যাক করে ব্যাগে ঢোকালাম। বিরিয়ানির আলুটা মোটেই পছন্দ করে না তুত্তুরী, তবে আতরে জবজবে ভাত,মাটন আর ডিমটা বড় ভালোবাসে।


গাড়িতে বসে মোবাইল দেখলে, যেমন মাথা ঘোরে তেমনি গা গুলায়। পাপী পেটের ব্যাপার, ফোন করতে,ফোন ঘাঁটতে,রিপোর্ট মেলাতে, ফোন তুলে লোককে ধমকাতে, চমকাতে, মতামত চাইতে, মতামত দিতে, জনসংযোগ করতে ঘাঁটতেই হয় মোবাইল। অসম্ভব গা গুলোতে থাকায় নেমেই পড়লাম হাই রোডের ধারে। নীল দিগন্তে তখন ম্যাজিক। বজ্র বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টিপাত হতে পারে নাকি কাল, যুগপৎ বাড়িতে শৌভিক আর আপিসে রমেশ ভয় দেখিয়েছে - হলেই চিত্তির। যাবতীয় কৃতকর্মের ওপর আইস টি।


ছোট্ট দোকান, দোকানের সামনের রোয়াকে পা দুলিয়ে বসে গল্প করছে তিন জোড়া কপোতকপোতী। বাকি অংশে  রাখা কয়েকটা হেলমেট। ভিতরে সৌম্য দর্শনা প্রৌঢ়া ছ্যাঁকছোঁক করে কি সব রান্নাবান্না করছেন। গরম অমলেটের সুবাসে মথিত রাজপথ। প্রশ্নের জবাবে ঘাড় নেড়ে জানালেন চা হবে। বড় ভাঁড় না ছোট ভাঁড়। প্রাক্তন বড়সাহেব থাকলে নির্ঘাত বলতেন, ‘সবথেকে বড় ভাঁড়। ’ স্যার অমনি ছিলেন। চা-তাল। তবে আমি বা সুবীর বাবু কেউই অত চা একসাথে খেতে পারি না। তাই একদম এক চুমুকে নিঃশেষ এমন ভাঁড় না হলেই চলে। চায়ের দোকানে কাঁচের বয়ামে রাখা বিস্কুটের প্রতি অসম্ভব শিশুসুলভ লোভ ছিল স্যারের। নিজেও খেতেন,  ড্রাইভার আর আমাকেও জোর করে খাওয়াতেন। কাঁচের বয়ামে রাখলে বিস্কুটগুলো কি একটু বেশী সুস্বাদু হয়ে যায়? রাজপথের ধারে এই চায়ের দোকানগুলোতে কত রকম যে বেকারী বিস্কুট পাওয়া যায়! আর পাওয়া যায় টিফিন কেক। নামী ব্রাণ্ডের দামী কেক নয়। ছোট্ট বেলার পাখির ছবিওয়ালা পার্পল রঙের প্যাকেটে মোড়া ফিলিপস্ বা হলুদ-সবুজ ওরাং-ওটাং রঙা বাপুজী। একটু বেশী মিষ্টি বটে,তবে ওগুলো চায়ে ডুবিয়ে খেলে মনে হয় সাক্ষাৎ অমৃত। সুবীর বাবুকে প্রশ্ন করলাম, ‘বিস্কুট খাবেন? আমি কিন্তু খাব। ’ দোকানের সামনে রাখা জলের বোতল থেকে ঢকঢক করে জল খাচ্ছিলেন উনি, মাথা নেড়ে জানালেন কিচ্ছু চাই না। তারপর ইশারায় সামনের রোয়াকটা দেখিয়ে বললেন, ‘বসুন না ম্যাডাম। ’ যেখানে বসতে বললেন,  সেখানে বিরাজমান দুটি জাব্দা হেলমেট। পাশের ছেলেটি, সঙ্কোচে হেলমেট সরিয়ে বলল ,‘বসুন না। ’ বসেই তো ছিলাম সারাদিন।  বসে বসেই ধরে গেল মাথা। বসব না বলার পর, ছেলেটি ইতঃস্তত করে প্রশ্নটা করেই ফেলল, ‘ট্রেন কবে চলবে?’ সরকারী বাহন দেখেই বোধহয় প্রশ্নটা করেছে ছেলেটা, কিন্তু এই প্রশ্ন তো আমারও। ট্রেন কবে চলবে? কবে চলবে ট্রেন? 


 স্টিলের থালায় দুটি ধুমায়িত ভাঁড় নিয়ে হাজির হলেন ভদ্রমহিলা। গরম চায়ে একচুমুক দিতেই জুড়িয়ে গেল মনপ্রাণ। হেসে বললাম, ‘কি করে জানব বাবা? তুই যেখানে আমিও সেখানে।’ সামনের কাঁচের বয়ামের ভিতরে রাখা বই গজাগুলো বড়ই সুন্দর দেখতে। গজা দিয়ে চা খেলে কি অ্যাসিড হবে? লোকে বলে বটে, তবে হাওড়ার ছেলেমেয়েদের ওসব হয়টয় না বোধহয়। দিদি একটা গজা দিন তো,আর কয়েকটা প্যাকও করে দিন। একটু কিটকিটে মিষ্টি বটে, তবে ভালো লাগবে নির্ঘাত মেয়েটার। নাঃ মা হওয়ার সত্যিই জ্বালা মাইরি!

No comments:

Post a Comment