Wednesday, 16 June 2021

অনির ডাইরি ১৬ই জুন, ২০২১

 


ঠাকুমা প্রায়ই বলতো,‘জন-জামাই-ভাগনা তিন নয় আপনা।’ কিন্তু নাতজামাইয়ের ক্ষেত্রে বোধহয় এ নিয়ম প্রযোজ্য ছিল না। চাটুজ্জে বাড়ির বড় জামাই শ্রী সিদ্ধার্থ ব্যানার্জী ওরফে আমাদের টুলটুল দাদা ছিল আক্ষরিক অর্থেই সবার নয়নমণি।  


দিদিভাইয়ের যখন বিয়ে হয়েছিল, তখন আমার বয়স বছর চারেক, বুল্লু বাবুর বাবা শ্রীমান অয়ন তখন সদ্য তিন আর কাকা শ্রীমান অনিন্দ্য সবে দাঁড়াতে শিখেছে। বাকি তুতো ভাইবোনদের অবস্থাও তথৈবচ। ফলে দিদির বিয়ের স্মৃতি বেশ অস্পষ্ট, সাদাকালো,ধোঁয়া-ধোঁয়া।


 শুধু মনে পড়ে, সদর দরজার বাঁ হাতে খোলা বাগানে ম্যারাপ বেঁধে পংক্তিভোজের আয়োজন হয়েছিল। টেবিলে পাতার জন্য যে পাতলা মোম কাগজ কেনা হয়েছিল, তার বেশ কিছু রোল বেঁচে যায়। যা দিয়ে পরবর্তী কালে বাড়ির খাতা বানিয়ে দিত বাবা। বিশাল উঠোনে ম্যারাপ বেঁধে সম্পন্ন হয়েছিল বিবাহের আচারবিধি। স্বহস্তে বড় নাতনীকে সম্প্রদান করেছিলেন ঠাকুমা। 


পশ্চিমের বাগানে বড় বড় মাটির উনুন বানিয়ে হয়েছিল রান্নাবান্না। তবে সবার আগে বসেছিল ‘ভিয়েন’। শুভ কাজ উপলক্ষে বাড়িতেই মিষ্টান্ন প্রস্তুত করাকে আমাদের মধ্য হাওড়ার ভাষায় বলে ভিয়েন। চাটুজ্জে বাড়ির যাবতীয় শুভকাজের বিশেষত্বই ছিল ঘরে তৈরি দরবেশ। লাড্ডু পাকানোর আগে ভেজে তোলা লাল-হলুদ বোঁদের পাহাড়,জীবনে সেই প্রথম দেখা। 


সাবেকী বিশাল রান্নাঘরে মাটির উনুনে গড়ে হয়েছিল নিরামিষ রান্নাবান্না। জগন্নাথ ঠাকুর আদতে ছিলেন উড়িষ্যার বাসিন্দা। এ দেশীয়া রমণীকে বিবাহ করে, গলির মুখে একখানি ‘উড়ের হিন্দু হোটেল’ খুলে বসেছিলেন। যাবতীয় শুভকর্মে নিরামিষ রান্নার দায়িত্ব বরাবরই জগন্নাথ ঠাকুরকেই সমর্পিত হত। মনে আছে নিরামিষ হেঁশেলকে ঘিরে বয়স্কাদের আড্ডা। কে ছিল না তাতে? ঠাকুমা, বড় পিসিমা, মুন্সিরহাটের পিসি, বাবার পিসিরা,বাবার মাইমারা। কে জানে অন্য কোনও জ্যোতিষ্কে হয়তো আজও একই রকম ভাবে আড্ডা বসিয়েছেন তাঁরা। 


মনে আছে দিনের বেলা রান্নাঘরের সামনের রোয়াকে কলাপাতা পেতে খেতে বসানো হয়েছিল যাবতীয় কুচোকাচা তুতো ভাইবোনেদের এবং রীতিমত রাবণের মত অট্টহাস্য করে কেমন আমার পাতে হিসি করে দিয়েছিল বছর দুই আড়াইয়ের পিসতুতো ভাই নয়ন। সেটাই প্রথম বা শেষ নির্যাতন নয়, কেন যে আমার প্রতি এমন প্রেম ছিল ব্যাটার। দিব্যি মনে আছে গায়ে হলুদের অব্যবহিত পূর্বে ছিছি মার্কা অপকর্ম করে ব্যাপক ধোলাই খেয়েছিলাম মায়ের হাতে। 


মনে পড়ে স্বর্গীয় ছোটকাকু আর তাঁর বয়স্য গোপাল কাকুর সাথে বর আনতে গিয়েছিলাম আমিও। মনে পড়ে  দক্ষিণ-পূব-পশ্চিম খোলা দোতলার দালানে এক রাশ ভেলমেটে মোড়া তাকিয়া আর প্রচুর কুচো ফুল ছড়িয়ে বাসর সাজানো হয়েছিল দিদিভাই আর টুলটুল দাদার জন্য। সারা সন্ধ্যা যাতে গড়াগড়ি দিয়ে খেলা করছিলাম আমরা কুচো চিংড়ির দল। বিবাহ কার্য সমাপনে যখন বাসরের দিকে হাঁটা লাগিয়েছে নবদম্পতি, সিঁড়ির দরজা আটকেছিল অন্য দিদিরা। টাকা না দিলে খুলবে না বাসর ঘরের দরজা। বর পক্ষও নাছোড়বান্দা, দরকার কি বাসরঘরের? এই তোরা সিঁড়িতেই বসে পড় তো। ধপ করে কারা যেন বসিয়ে দিল দিদিভাই আর টুলটুল দাদাকে। তারপর কি হল? কারা জিতল? তা অবশ্য জানি না। টুলটুল দাদা কোন টাকাপয়সা দিয়েছিল কি না, তাও জানি না। দিয়ে থাকলেও আমাদের ভাগ দেয়নি কেউ।  আর দিলেও যে সেই টাকা নিয়ে কি করতাম, তাও জানি না। 


পরদিন সবাইকে কাঁদিয়ে হাত নাড়তে নাড়তে দিদিভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি চলে যাবার কথাও খুব মনে পড়ে। যদিও আজ মনে হয়, ওটা আমার শৈশবের নিছক কল্পনা ছিল, দিদিভাই মোটেই সায়রা বানুর মত ‘ম্যায় চলি, ম্যায় চলি’ করতে করতে শ্বশুরবাড়ি যায়নি। 


বিয়ের পরও চলতে থাকে কত যে অাচার- অনুষ্ঠান। বছরে কতবার যে তত্ত্ব পাঠাত জ্যাঠাইমা আর জেঠু তার ইয়ত্তা নেই।  পুজোয় পোশাকপরিচ্ছদের তত্ত্ব, শীতে গুড়- পাটালি-মোয়ার তত্ত্ব, গরম কালে আম-কাঁঠাল-লীচুর তত্ত্ব। জেঠু-জ্যাঠাইমার সাথে থালা ভর্তি দ্রব্যাদি নিয়ে আমরাও যেতাম। আর যেত দেবীদি আর মনসা দা। দিদিভাইয়ের সমবয়সীই ছিল দেবীদি। এখনকার ভাষায় গৃহশ্রমিক, তবে আমি বা অয়ন- অনিন্দ্য দিদি বলেই জানতাম।  আর মনসা দা ছিল এক নিঃসহায় বৃদ্ধ। সন্ধ্যা বেলা কালিবাড়ির মন্দিরে কাঁসরঘন্টা বাজাত মনসা দা। আর টুকটাক ফাইফরমাশ খাটত।আশির দশকের হাওড়া প্রায়শই ডুবে যেত বিদ্যুৎহীনতার আঁধারে। অন্ধকার গলিঘুঁজি দিয়ে টর্চ হাতে এগোত জেঠু, পিছন পিছন লাইন দিয়ে চার আনা- আট আনার দল। সবার পিছনে অতন্দ্র প্রহরীর মত টর্চ জ্বেলে জেঠাইমা। আমাদের সে কি উৎসাহ দিদিভাইয়ের বাড়ি যাবার বাপস্।  গেলেই দিদিভাইয়ের শাশুড়ী মাতা গরম গরম দুর্লভ কেবিনের মোগলাই পরোটা আর মল্লিক সুইটসের রসগোল্লা খাওয়াবে যে-  


আর জামাই ষষ্ঠী এলে তো কথাই নেই। দেড়শো বছরের ফোকলা বাড়িটা যেন ঝলমলিয়ে উঠত। সক্কাল সক্কাল ফোঁটা নিতে আসত টুলটুল দাদা। ঠাকুমার কাঁপা কাঁপা হাতের ফোঁটার পর, মস্ত পিতলের রেকাবি ভর্তি ছয় রকম ফল সহ বাড়ির একমাত্র জামাইয়ের হাতে হরেকরকম মিষ্টি, নতুন পোশাক তুলে দিত জ্যাঠাইমা। জ্যাঠাইমার মত সাজিয়ে দিত না বটে, তবে শুধু টুলটুল দাদার জন্যই থলে ভরে বাজারের সেরা আম আর সবথেকে বড় মিষ্টি কিনে আনত বাবা। আপিস বেরোবার আগে জামাই ফোঁটা দেবে যে মা। 


আসল ভুরিভোজ জমত রাতে। সারাদিন ধরে টুকটুক করে কত কি যে রান্না করত জ্যাঠাইমা। পিতলের রেকাবি, পিতলের বাটি,কাঁসার গ্লাসে সাজিয়ে দেওয়া হত সুখাদ্য। টোপাটোপা সাদা ময়দার লুচি, খাসির টকটকে ঝাল, মাংসের পুর ভরা পটলের দোলমা আরো কত কি। বরবধূ ছাড়াও আমন্ত্রিত থাকত আরো বেশ কিছু মান্যগণ্য অতিথি। দাদাভাই-সোমাদি অর্থাৎ টুলটুল দাদার দাদা-বৌদি তো ছিল আমাদের ঘরের লোক।  আজও চাটুজ্জে বাড়ির যাবতীয় শুভ কর্মে স্বমহিমায় ভাস্বর থাকেন দোঁহে, ওণারা ছাড়াও আরো অনেকে। খাওয়া দাওয়ার ফাঁকে দিদিভাই আর সোমাদিকে জপাত জ্যাঠাইমা-‘হ্যাঁ রে, মাত্র একটাতেই তোদের হয়ে গেল? এখনও সময় আছে, আরো একটা নে-’। দুই তরুণী জননী শুনেই আঁতকে উঠত, রক্ষা করো মা/মাসি , একে রামে রক্ষে নেই-। 


তারপর কত জল বয়ে গেল গঙ্গা দিয়ে। বদলে গেল কত দশক। হারিয়ে গেলেন কত প্রিয়জন। মুচে গেল কত সম্পর্ক। সাদাকালো জীবনে লাগল রঙের ছোঁয়া। জামাই হয়ে এল শৌভিক। শ্বশুর হয়ে দাদু হয়ে গেল টুলটুল দাদা। সেদিনের 'ম্যায় চলি, ম্যায় চলি' করে হাত নেড়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়া দিদিভাই আজ জাঁদরেল শাশুড়ি মা। পঞ্চব্যঞ্জন রেঁধে ফোঁটা দেয় জামাইকে। মাঝে মাঝে তাই মনে হয়, কুশীলব বদলে গেলেও চিত্রনাট্য বোধহয় থেকে যায় অবিকৃতই।

No comments:

Post a Comment