অনির ডাইরি ২১শে জুন, ২০২১
#Happy_Fathers_day
#কোন_দিনটা_বাবা_দিবস_নয়
আমার এই নাতিদীর্ঘ জীবনে, মাত্র দুই বার কাঁদতে দেখেছি বাবাকে। প্রথম বার, ২৩শে জানুয়ারী, ২০০৫। রাত বোধহয় দশটা। ছোট ক্যাম্প খাটে শুয়ে আছে ঠাকুমা, অক্সিজেন চলছে। ক্যাথিটার লাগানো। নড়তে চড়তে, কথা বলতে কিছুই পারে না তখন ঠাকুমা। শুধু তাকিয়ে থাকে। খাওয়ার সময় হলে, নাকে লাগানো নলে, একটা মস্ত বড় সিরিঞ্জ লাগাই আমি, আর আস্তে আস্তে তাতে ঢেলে দি, সিদ্ধ সব্জির স্যুপ বা ফলের রস। এক্কেবারে তরল। থাকে না কোন দানা বা পাল্প। তারপর ইঞ্জেকশন দেবার মত করে ঢুকিয়ে দি ঠাকুমার শরীরে। ডাক্তার জবাব দিয়েই দিয়েছেন, এইভাবে যে কটা দিন চলে। নাঃ কোন আয়া রাখা হয়নি ঠাকুমার জন্য। বাবা- ছোটকাকু- পিসি আমার দুই খুড়তুতো ভাই হামেহাল পড়ে আছে ঠাকুমাকে নিয়ে। দুবেলা ছুটে আসছে দিদিভাই। বিছানাতেই বড় কাজ করে ফেলছে ঠাকুমা, ছোট্ট শিশুর মত, আদর করে তা সাফ করে দিচ্ছে দিদিভাই বা পিসি। আমার কাজ বলতে শুধু টাইমে টাইমে নাক দিয়ে ওষুধ আর লিকুইড খাবার খাওয়ানো।
এরই মাঝে আমার জন্মদিন। বাড়িতে মুমূর্ষু রোগী থাকতে আবার জন্মদিন কিসের, তুবও ওরই মধ্যে সামান্য মিষ্টি, জ্যাঠাইমার এনে দেওয়া পেস্ট্রি। রাত দশটা নাগাদ, ঠাকুমাকে ঘিরে জমে উঠেছে গল্প। ক্যাম্প খাটে ঠাকুমার পায়ের কাছে বসে আছে ছোটকাকু, তার পাশে দাঁড়িয়ে বাবা। অদূরে ঠাকুমার সাবেকী কাঠের পালঙ্কে বসে আছে মা, আমি আর পিসি। আচমকা খেয়াল করল মা, কখন যেন থেমে গেছে ঠাকুমার হৃদস্পন্দন। একটু আগেও সামান্য অক্সিজেনের জন্য হাপরের মত ওঠানামা করছিল যে শরীরটা, হঠাৎ যেন চরম প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। আশঙ্কার কথা জানাতে জাস্ট উড়িয়েই দিল ছোটকাকু। ‘কি যা তা বলছ। মা ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয়। ’ বাবা কিন্তু এত সহজে ফেলল না মায়ের কথা গুলো, পাগলের মত একবার ঠাকুমার বুকের ওপর হাত রাখল,তারপর অক্সিজেন সিলিণ্ডারটার দিকে। তারপর কি যে হল, হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল বাবা,সমস্ত মুখ পলকে হয়ে গেল টকটকে লাল। হেঁচকি তুলে গুমরে গুমরে কাঁদতে লাগল বাবা। কনিষ্ঠ তথা ঠাকুমার সবথেকে আদরের সন্তান ছিল আমার ছোটকাকু। বোধহয় বাবার ঐ আকস্মিক শোক দেখেই কাঁদতে পারেনি ছোটকাকু। বাবাকে জড়িয়ে ধরে, বারবার বলেই যাচ্ছিল, ‘আমি তো আছি। তুই কাঁদছিস কেন?’
আর দ্বিতীয় বার কাঁদতে দেখেছিলাম, ২৫ শে মে, ২০০৯। আকাশ- বাতাস জুড়ে শুধুই আয়লার আগমন বার্তা। ঝমঝমে বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে মহানগর। বৃষ্টির দাপটে ঠকঠক করে কাঁপছে জানলার কাঁচ। তারই মধ্যে শ্বশুরবাড়ি চলেছি আমি। বাসর জাগার প্রভাবে, রীতিমত ঢুলছে শৌভিক। ঐ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ছুটে এসেছে দাদারা,বৌদিরা, সুজাতা বৌদি আর আমার দুই প্রাণাধিকা সহেলী সঞ্চিতা আর পম্পা। বাসরে ঘেঁটে যাওয়া মেকাপ, ধেবড়ে যাওয়া সিঁদুরকে গুছিয়ে-গাছিয়ে নতুন করে বেনারসী আর গয়না পরে বউ সাজছি আমি। যত সময় যাচ্ছে, ততো পারদ চড়ছে বাবার। যত শীঘ্র আমায় বিদায় দিতে পারে ততোই যেন শান্তি।
আমাকে ঠেলে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর মূল দায়িত্বে আমার ছোটমাসি। আমি তো জানিই না ছাই, শ্বশুরবাড়ি যেতে হলে এত জিনিস বগলদাবা করে নিয়ে যেতে হয়। ছোট বলে বলে দিচ্ছে, গায়ে হলুদে আসা জিনিসপত্র, তার সাথে সাথে বাড়িতে পরার পোশাক পরিচ্ছদ সব গুছিয়ে তত্ত্বে আসা মস্ত ভিআইপিতে ঢোকানো হচ্ছে সবাই মিলে। কি যে ঢোকাচ্ছে দেখতেও দিচ্ছে না ছাই, তাকালেই গাঁট্টা মারছে সঞ্চিতা, চন্দন ঘেঁটে যাচ্ছে নাকি। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ফিসফিস করে জানতে চাইছি আমি, ‘হ্যাঁ রে, টাকা দিয়েছে শৌভিক?’ টাকা অর্থাৎ জুতো চুরির টাকা। বোনপো রণি আর পম্পা-সঞ্চিতাতে মিলে জুতো লুকিয়েছিল বিয়ের পর। শৌভিকও টাকা দেবে না, ওরাও ছাড়বে না।এদিকে দেরী হয়ে যাচ্ছে নৈশ ভোজের, নব দম্পতির সাথে ভোজন করবে বলে বসে আছে বাড়ির লোক, মায় আমার আশি বছরের জেঠুও। শেষে খালি পায়েই খেতে নামছিল শৌভিক, হাঁ হাঁ করতে করতে নিজের জুতোটাই খুলে দিয়েছিল বাবা। ‘বাবা জামাই,আমার জুতোটাই পরো।’ কেলেঙ্কারির একশেষ। সুড়সুড় করে জুতো ফিরিয়ে দিয়েছিল রণি। তারপর থেকে নতুন বরকে জপিয়েই যাচ্ছি। কিছু টাকা দে না বাপ। কত আশা করে জুতো চুরি করেছে ছেলেমেয়েগুলো।
বড় উত্যক্ত করছিল বাবা, শুনতেও দিল না, কত টাকা দিয়েছে। গিয়ে বসলাম আশির্বাদের আসনে। সবার আগে আশির্বাদ করবে বড়জেঠু আর জেঠিমা। কেঁদে কেঁদে হেঁচকি উঠছে জেঠিমার। ঝরঝর করে কাঁদছে বুড়ো জেঠুও। তারপর বড়মাসি। পিসি। আরোও কারা কারা যেন। বাবাকে ডেকেই যাচ্ছে সবাই, ‘ও মেসো। ও কাকু এসো না। ’ নীচে থেকে দোতলায় আর আসেই না বাবা। মা আমার পাশে বসে, বাচ্ছা মেয়ের মত কেঁদেই যাচ্ছে। অবস্থা খারাপ আমার ছোট মাসির। কাকে ছেড়ে কাকে সামলায়। এরই মধ্যে লৌকিকতা। সবাইকে চা দেওয়া। ক্রমেই খারাপ হচ্ছে আবহাওয়া। অথচ বাবা আশির্বাদ না করলে কি যেতে পারি আমি।
কে যেন ধরে আনল বাবাকে। নীচে কোন তদারকিতে ব্যস্ত ছিল কে জানে। লজ্জিত হয়ে উঠে এল। বেতো হাঁটু মুড়ে বসল কোন মতে, দুটো ধান দুর্বো নিল, তারপরই, সমস্ত মুখ পলকে হয়ে গেল টকটকে লাল। হেঁচকি তুলে গুমরে গুমরে কাঁদতে লাগল বাবা। মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য। তারপর ছুটে পালাতে গেল বাবা, এবার খপ করে চেপে ধরলাম আমি, সেই দশ বছর বয়স থেকে বিয়ে করার শখ, ঠিক এমনি করে, লাল চেলী পরে, কপালে চন্দন, এমনি প্রিয়জন পরিবৃত হয়ে, বন্ধুদের শুভাশিস আর শুভেচ্ছা মেখে, আলোর রোশনাই আর আতরের সুবাসে সুবাসিত হয়ে, স্বপ্নের পুরুষের হাত ধরে তার রাজ্যে পাড়ি দেব আমি। সব স্বপ্নই তো সত্যি হল, কিন্তু তার সাথে সাথে যে বাবা এবং মাকে ছেড়ে যেতে হবে এই সামান্য হিসেবটুকু কেন যে মাথায় আসেনি। ‘ও বাবা, বাবা গো। তুমিও চলো না আমার সঙ্গে। কি ভাবে বাঁচব বাবা, তোমাকে আর মাকে ছেড়ে? কিভাবে টিকব এই চেনা পরিমণ্ডল আর চেনা গন্ধগুলোকে ছেড়ে-।
আজও প্রতি মুহূর্তে এই একই কথা বলে যাই আমি, প্লিজ বাবা, আর কয়েকটা দিন, আর কয়েকটা বছর প্লিজ থেকে যাও বাবা। আমি সেদিন তোমায় ছেড়ে এসেছিলাম, বলে তুমি যেন আমায় ছেড়ে যেও না বাবা। কি ভাবে বাঁচব বাবা, তোমায়/ তোমাদের ছেড়ে---
No comments:
Post a Comment