বাকিরা এখুনো না পোস্টাইলেও, ইতিমধ্যে অনিন, রাখি, সঞ্চিতা, অনুশ্রী, অস্মিতা এবং আমার ফেবু ফেরেন্ডরা নিশ্চয় জেনেই গেছেন, যে আষঢ়স্য প্রথম দিবসে ছিমতী চৈতালীর ঝুলি থেকে বেরিয়েছে একঝাঁক বিলাই😺😺।
তাইলে খুলেই বলি শুনুন, এক্ষেত্রে ঝুলি হল গিয়ে ছিমতী চৈতালীর বিখ্যাত ক্যামেরা। যাকে আমাদের অনুশ্রী আদর করে নাম দিয়েছে ‘খেলনা’। সেই যে গলির ঋষি কাকুর দোকানে বিক্রি হত না, পাঁচ সিকে বা দেড় টাকার প্লাস্টিকের ক্যামেরা, যা চোখের সামনে ধরে, মুখে ব্যাপক খচাৎ খচাৎ আওয়াজ করতাম আমরা ছোট্টবেলায়। একটু দামী হলে, যার আয়তাকার বাক্স থেকে বেরিয়ে থাকত, হ্যারিকেনের পলতে তোলার মত একখানি তারের আঙটা, সেই আঙটা ঘোরালে ভিতরে পরপর উঠত-নামত জয়াপ্রদা, জিতেন্দ্র, শ্রীদেবীর রঙীন ছবি। তেমনি খেলনা।
প্রতিটা গেট্টুতেই যে খেলনা, চৈতালী সাধ করে তুলে দেয় টিনটিন বাবুর হাতে। টিনটিন হল আমাদের অন্তু ওরফে অন্তরার সুপুত্তুর। টিনটিন অতীব সুবোধ বালক, কিন্তু ক্যামেরা হাতে পাবার পর যা হয় আর কি। প্রতি গেট্টু শেষে যখন বাড়ি ফেরার জন্য আড়ামোড়া ভাঙি আমরা অথবা সারা রাত ঠাকুর দেখে যখন পূবের আকাশে ফোটে প্রথম আলো, টিনটিন কাঁচুমাচু হয়ে জানায়, চৈতালীর ক্যামেরার ঢাকাটি নিরুদ্দেশ। অতঃপর, আকাশ পাতাল জুড়ে ধ্বনিত হয় টিনটিনের জননীর বজ্রনির্ঘোষ, পিটিয়ে ছাতু করার হুঙ্কার, চামড়া দিয়ে ঢোল বানিয়ে ডুগডুগি বাজানোর প্রতিশ্রুতি এবং চৈতালীর প্রবল গজগজানি। যুগপৎ টিনিটিনের জননীর ক্রোধ এবং চৈতালীর বিরক্তির খোঁচায় আমরাও উথাল পাতাল করে খুঁজতে থাকি, কিছু একটা। খুঁজতে খুঁজতে সমুদ্র মন্থনের মত উদ্ধার হয় অনেক কিছুই- রুমাল, খুচরো পয়সা, মাথা ভাঙা পেন, চকলেটের লুকানো মোড়ক। সবশেষে অমৃতের মত কারো না কারো পকেট থেকে মুখ বাড়ান তিনি। ক্যামেরা ঢাকা-
তো যাই হোক, এ হেন ঝুলি বা খেলনা বা ক্যামেরা যে নামেই ডাকুন না কেন, তা নিয়ে প্রতিবার নানা কসরৎ করে ছবি তোলে চৈতালী। এখানে দাঁড়া- ওখানে বোস- ঘাসের ওপর শুয়ে পড় মার্কা নির্দেশ শুনে তটস্থ হয়ে উঠি আমরা। ঘাসে শুলে পাছে মাথায় ইয়ে, উকুন টুকুন হয়, তাই ওটা অবশ্যি আমরা করি না। বাকি যা বলে, চিত্রনাট্যে যতটুকু থাকে তার থেকে বেশীই করি আমরা।
রঙ-ঢং, লাস্যহাস্য মেখে ছবি তো তোলা হয়, কিন্তু সে ছবির মুখ আমরা চট করে দেখতে পাই না। দরের ফটোগ্রাফাররা বোধহয় এমনি হয়। বিরক্ত হয়ে অনুশ্রী ওটার নাম দেয় খেলনা। আরও নানা খারাপ খারাপ কথা বলি আমরা, সে তো বলবই, আমরা হলাম খাস হাওড়ার মেয়ে, তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবনের ছাত্রী, একে অপরের সন্দর্শনে ভদ্র ,পরিশীলিত, সুচারু ভাষায় বার্তালাপ করলে, কান দিয়ে রক্তক্ষরণের সমূহ সম্ভবনা থাকে।
কিন্তু এবারে বিলম্বিত লয়ের যাবতীয় রেকর্ড চূর্ণবিচূর্ণ করে মাত্র দুই মাসের মধ্যে খেলনা ক্যামেরার ঝুলি থেকে আত্মপ্রকাশ করেছে চৈতালীর চিত্রসমূহ। সেই গুলিই হল বিলাই বা মেকুর বা বিল্লিদাস যা বলেন আপনারা।
আর পাঁচটা প্রতিভাধর উন্নাসিক চিত্রগ্রাহকদের মতোই, নিজের কাজের কঠোরতম সমালোচক চৈতালী। কোন ছবিই তার তেমন মনঃপূত হয়নি।নিজের কাজের সমালোচনা করার পূর্ণ অধিকার চৈতালীর আছে, তবে দীর্ঘ অদর্শনের খরার পর একসাথে জমায়েত হওয়া এক ডজন উদ্বেল বাল্যবন্ধু আর তাদের এক ডজন দুষ্টুমিষ্টি বাচ্ছাকে নিয়ে সরগরম আমাদের হাওড়ার বুড়ো বাড়িতে, সকলকে সুসংবদ্ধ ভাবে দাঁড় করিয়ে, ছবি তোলা যে কতখানি দুষ্কর, তা ছবি গুলো পরপর দেখতে থাকলেই বোঝা যায়-
যেমন ধরুন, দলবদ্ধ প্রথম ছবিটিতে প্রথমা ওরফে শ্রীমতী অনিন ওরফে অনিন্দিতা রায় মুখার্জী একগাল হেসে লাস্যময়ী চারুলতা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও, দ্বিতীয়া অর্থাৎ আমাদের রাখি ঘুরে গেছে ১৮০ডিগ্রী। হাত নেড়ে পিছনে দাঁড়ানো সঞ্চিতাকে ঠিক কি যে বলছে রাখি, তা শোনা না গেলেও, মনে পাপ থাকলে একনজরে মনেই হতে পারে, যেন বলছে, ‘আমার গ্লাস থেকে এক চুমুক খেয়ে দেখবি নাকি-’। জবাবে বুঝি বিগলিত হেসে তৃতীয়া সঞ্চিতা বলছে, ‘দে তাহলে এক চুমুক-’। তার পিছনে সাদাকালো বাঙলা সিনেমার নায়িকাদের মত বঙ্কিম হেসে অপাঙ্গে অনুশ্রী কি বলছে ‘টুকি’? তার পাশে যথারীতি অর্ধনিমিলিত চক্ষে ঢুলন্ত আমি, আমার মাথায় দিব্য গাল রেখে ক্লান্ত চোখ মেলেছে দেবীকা। যেন ছবি তোলা হলেই ঢুলতে বসব দোঁহে, দেবীর পিছনে সপ্তমী এ্যাঞ্জুলা পরিপাটি,নিভাঁজ, নিখুঁত বটে তবে অষ্টমা দেবযানী খিলখিল করে হাসছে,‘ওরে আমার মাথায় গামছা কেন রে?’ পুরাণ বাড়িতে গেট্টু করবে, আর হাওড়া স্পেশাল গামছা শুকাবে না এটা আশা করা বাপু এট্টু বাড়াবাড়ি না। দেবুর পাশে নবমী-দশমীকে দেখে মনেই হতে পারে বৈশাখীর হাত ধরে টানছে অন্তরা, ‘সামনে চল, না হলে ভালো ছবি উঠবে না। ’ সবশেষে একাদশী অস্মিতার শুধু মুণ্ড খানি দৃশ্যমান। দু চোখে করুণ দৃষ্টি, ‘ওরে তাড়াতাড়ি কর রে মেয়েগুলো- ।বাড়ি ফিরতে দেরী হলে, মা আর আস্ত রাখবে ভেবেছিস? ’ ঠিক যেভাবে, স্কুলে বলতাম আমরা- ।
তার পরের ছবিতে অবশ্য সম্পূর্ণ গায়েব অস্মিতা। ওখানেই তো ছিল, ছবিতে উঠল না কেন, বুঝ যে জন। নিখুঁত মুহূর্তটিকে ক্যামেরা বন্দি করার তালে দশমী অন্তরার মুখেচোখে, মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে যাওয়ার মৃদু উদ্বেগ। কিঞ্চিৎ গোলপানা হয়েছে প্রথমা অনিনের বদন। ঘর্মাক্ত ত্বকে পিছলে যায় বাবার সাবেকী টিউবলাইটের সাদা আলো। স্বভাবসিদ্ধ ফাটাফাটি পোজ দিয়েছে দ্বিতীয়া রাখি। পেশায় শিক্ষিকা, তৃতীয়া সঞ্চিতা কে জানে, কাকে আঙুল দেখিয়ে বলছে, ‘ কান ধরে ক্লাসের বাইরে বের করে দেব! দেখবি?’ সঞ্চিতার হাতে আবৃত চতুর্থী অনুশ্রীর বদন, ফলে তার বিভঙ্গ এক্ষেত্রে কিঞ্চিৎ রহস্যাবৃত বটে, তবে আমি ঠিক কি করছি বুঝতে পারলাম না। সম্ভবতঃ হাত পা নেড়ে সঞ্চিতাকেই সমর্থন করছি আমি। দে সব কটাকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে 😊😊। পিসার হেলানো টাওয়ার থেকে ঘরের পাশের অক্টারলোনি মনুমেন্টের মত খাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে বটে দেবিকা, তবে তিনিও পেশায় শিক্ষিকা কি না, মুখে মাখামাখি পেশাসুলভ গাম্ভীর্য। সপ্তমী এ্যাঞ্জুলা যে পেশায় খাদ্য বিশেষজ্ঞ, তা তার ঋজু অপরূপ বিভঙ্গে সুস্পষ্ট প্রতীয়মান। রীতিমত টেক্কা দিচ্ছে প্রথমা এবং দ্বিতীয়ার সাথে। অষ্টমী দেবুর মাথার পিছনে পূর্ণবিক্রমে দ্রষ্টব্য নীলচে গামছা খানি। দেবুর খিলখিলে হাসি সীমানা ছাড়িয়ে বাংলাদেশ অবধি প্রসারিত।
তৃতীয় ছবিতেও একেক রকম কর্মকাণ্ডে ব্যাপৃত একেক জন। দেখতে দেখতে, একে অপরের মনের ভাব, দৈহিক বিভঙ্গ বিশ্লেষণ করতে করতে উছলে ওঠে খুশির নদী। পলকে বিস্মৃত হয় অসুস্থ পৃথিবী, পেশাগত চাপ, গৃহবন্দি সন্তানদের জন্য সযতনে লালিত দুঃশ্চিন্তা সমূহ। বিস্মৃত হয় জীবনের যাবতীয় জটিলতা। সময়ের চাকা বুঝি নিয়ম ভেঙে আজ রওণা দেয় পিছন পানে। চিত্রগ্রাহিকা হিসেবে চৈ যতই খুঁত খুঁজে বার করুক না কেন, মন বলে,
‘ - ফিরে এসো, ফিরে এসো, চাকা,
রথ হয়ে, জয় হয়ে, চিরন্তন কাব্য হয়ে এসো ।
আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো, প্রেম হবো, অবয়বহীন সুর হয়ে লিপ্ত হবো পৃথীবীর সব আকাশে ।’
No comments:
Post a Comment