Thursday, 21 May 2020

অনির ডাইরি ২১শে মে ,২০২০



ঝড় আসছে। ঝড় আসছে। রব উঠেছে কদিন ধরেই, মোবাইলের পর্দায় নীল সায়রে দাপিয়ে ওঠা কমলা ঘূর্নি। ও ঝড়, তুই যাবি কুথা? বাংলাদেশ আছে না, প্রতিবারই তো ওরা টেনে নেয় সব ঝঞ্ঝা, আমাদের ভাগে জোটে মনউদাসী কালো আকাশ,অল্পস্বল্প ঝোড়ো বাতাস আর কয়েক পশলা বৃষ্টি।

নাঃ। এবার শুনি গন্তব্য আমাদের বাংলা। দীঘার কাছে নাকি আছড়ে পড়বে ঝড়। গুচ্ছ গুচ্ছ সতর্ক বার্তা, ঝড়ের আগে কি করবেন-ঝড় উঠলে কি- আর ঝড় চলে গেলে কি করবেন দেখিয়ে-শুনিয়ে ঝালাপালা করে দিল কান আর মাথা। কোথায় ঝড়?দিব্যি পরিষ্কার আকাশ, দমচাপা গরম, নড়ছে না গাছের পাতা-

আজ ঝড়ের দিন, গত সন্ধ্যা থেকে কোথা থেকে যেন পঙ্গপালের মত ছুটে আসছে কালচে মেঘের পাল। বেলা দশটা- সাড়ে দশটায় নেমে আসল সন্ধ্যার আঁধার। মহানগরীর ন্যুভোরিশ এলাকায় রাজপথের লাগোয়া ঘন সবুজ সুসজ্জিত আবাসনের হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপে তখনও আসছে আশ্বাসবাণী, আমরা সর্বত প্রস্তুত। বিদ্যুৎবাতি নিভে গেলেও ভয় নেই, চলবে জেনারেটর- হ্যাঁ চলবে না বটে গিজার বা বাতানুকূল যন্ত্র।
বন্ধ জানলার ওপাড়ে ধীরে ধীরে মাথা দোলাতে লাগল সুসজ্জিত বনস্পতির দল। এক পায়ে দাঁড়ানো ফ্যান্সি সুপারি গাছগগুলো শিকড়সুদ্ধ আছড়ে পড়ল মাটিতে-ঝনঝনিয়ে ভাঙতে লাগল কাদের বাড়ির কাঁচ। শৌচাগারের স্বল্প খোলা জানলা দিয়ে কামানের গোলার মত ছুটে আসতে লাগল হাওয়া, আছাড় খেল ভারি কাঠের দরজা। তালেগোলে ঝপ করে চলে গেল বিদ্যুৎ। সম্ভবতঃ নিরাপত্তার স্বার্থে।

শুরু হল তুত্তুরীর হাউমাউ কান্না,  নাঃ ভয়ে নয়, মনোকষ্টে।  শৌখিন বারন্দায় সাজিয়ে রাখা টব গুলিতে উপছে পড়ছে জল, গলা জলে ডুবতে বসেছে তুত্তুরীর হাতে বসানো সদ্য অঙ্কুরিত কুমড়ো আর লঙ্কা গাছের সারি। পলকের জন্য বারন্দার দরজা খোলা মাত্রই, হুড়মুড়িয়ে ঢুকতে লাগল জলকণা।
 চানঘরের শাওয়ার খোলার মত তোড়ে ঝরছে জল, আবাসনের মেন গেটের মাথার ওপর সাজানো ঝুমকো লতা, ঝড়ের দাপটে উড়ে এসে বন্ধ করে দিয়েছে বারন্দার নালী। বারন্দা উপছে জল ঢুকছে ঘরে, জল তো নয় যেন নাদির শাহের ভারত আক্রমণ। অওয়ধ আর নিজামের  ইগোর লড়াই আর আয়েসী অবিমৃষ্যকারী রঙ্গিলা সুলতানের অদূরদর্শিতা যেমন ডুবিয়েছিল সেদিনের ভারতকে, অনেকটা তেমনি ভাবে ভেসে গেল আমাদের শৌখিন বাসাখানি।  শৌভিক অওয়ধের নবাব সফদর জং এর মত পুরোনো জামাকাপড় দিয়ে সাময়িক ভাবে ঠেকানোর চেষ্টা চালাল, হায়দ্রাবাদের নিজাম-উল-মুল্কের মত গোঁয়ার্তুমি দেখিয়ে ঝড়ের মধ্যেই বারন্দার নালী খোঁচাতে গিয়ে নাকখৎ দিলাম আমি, আর  সুলতান মহম্মদ শাহ রঙ্গীলার মত ক্রন্দসী তুত্তুরী নাকেকেঁদেই গেল-।

আয়লায় আমাদের বিয়ে, ঝড়-জল দুর্বিপাককে  খুব একটা ডরাই না আমরা, তবে ঘন্টাখানেক ধরে পর্যায়ক্রমে রাবার পুলার, মুড়ো ঝ্যাঁটা আর চারখানা পুরানো তোয়ালে দিয়ে চারহাত পায়ে গোটা বাড়ি নিংড়ে চার বালতি জল বার করার পরও যখন গড়িয়ে আসে জলস্রোত,তখন সত্যিই কান্না পায়। প্রতি মুহূর্তে মন বলছিল, এত শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই করা মানুষের সাধ্যাতীত। সবার ওপর মাননীয় মূখ্যমন্ত্রীর বাণী, ওণাকে এমন অসহায় কখনও দেখিনি, ভেঙে পড়া গলায়, ক্লান্ত দৈহিক বিভঙ্গে, বিজিত দলপতির মত উনি বলে চলেছেন, “সব শেষ। আমরা বিপর্যস্ত”। দলপতির এই হেরে যাওয়া রূপটা কেন জানি না আরো গাঢ় করে দিচ্ছিল ঝড়ের রাতের অন্ধকার।
তবু থেমে থাকে না সময়। সকাল যখন হল,ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়েছে জেনারেটর। মোবাইলে টিমটিম করছে চার্জ।ঘরের বাইরে দিব্যি নিরীহ মুখের আকাশ- কে বলবে কালকের রাতটা অমন ভয়ঙ্কর কেটেছে। আসেনি খবরের কাগজ, আসেনি পৌরসভার ময়লাওয়ালা। খোলা জানলার ওপারে অভূতপূর্ব নৃশংসতা, পড়শী ধনী ব্যবসায়ীর চালের ওপর উড়ে এসে পড়েছে কার যেন বাঁশ আর টিন দিয়ে বাঁধা একখান ছাপোষা গুমটি, আবাসনের রাস্তায় ওপাশ-ওপাশ করে শুয়ে আছে এখনও তরতাজা গাছের দল। পাখিগুলো কোথায় গেল কে জানে? ভোরবেলা যে কোকিলটার ডাকে ঘুম ভাঙে, মুখে আজ কুলুপ এঁটেছে সেটা। রাজপথের ধারে ধারে  পাকিয়ে মণ্ড হয়ে গেছে নানা ঝুলন্ত তার, ছেঁড়া তারে দোল খাচ্ছে শিকড় উপড়ে পড়া বনস্পতির দল। অধিকাংশ প্রিয়জনের কাছে যাচ্ছে না ফোন, আর যেখানে ঢুকছে,চূড়ান্ত অবসাদমাখা একটাই কথা ভেসে আসছে ইথারে, প্রকৃতির এই রূপ আগে কখনও দেখিনি। মোবাইলে একের পর এক মনখারাপ করা ছবি, উড়ে যাওয়া ছাতের নীচে অসহায় বৃদ্ধা, তছনছ হয়ে যাওয়া গরীবের কুটির, মধ্যবিত্তের বাড়ি ধ্বসিয়ে হেলে পড়া মহীরুহ, আধাআধি তুবড়ে যাওয়া বাস, তছনছ হয়ে যাওয়া বিমানবন্দর, ডুবো গলি- আর সবার ওপর অভিমান। এমন দিনেও রাজনীতি বড়দা? একটা ট্যুইট পর্যন্ত করতে পারলেন না? ঘোষণা করলেন না তো জাতীয় বিপর্যয় বলে? আর আপনার ঐ হিন্দি মিডিয়া কেন খামোশ? কেন জনপ্রিয় হচ্ছে না কোন হ্যাশট্যাগ? কেন উত্তাল হচ্ছে না দেশ আমাদের ক্ষততে? আপনিও যদি সেই দলে পড়েন, তো অনুগ্রহ করে গুজবে কান দেবেন না,বড়দার ব্যাপারে মন্তব্য করতে অপারগ তবে টুইটারাটিদের মনোযোগ বা হ্যাশট্যাগই যদি আপনার কাম্য হয়, তবে আরেকবার চেক করে দেখুন #PrayforBengal এবং #PrayforWestBengal দুটোই খুঁজে পাবেন। সমবেদনা জানিয়েছেন অনেক ছোট-বড়-মাঝারি মাপের যশস্বী ব্যক্তি। সমবেদনা থাকবে-রাজনীতিও থাকবে- আর থাকবে লড়াই, মধ্য-নিম্নমধ্য আর নিম্নবিত্তের চিরসাথী। আমাদেরই আগের প্রজন্ম বলেছিল না,“লড়াই করে বাঁচতে চাই”। কোমর বাঁধুন মশাই, সামনে লড়াইটা বেশ কঠিন-

No comments:

Post a Comment