Sunday 10 May 2020

অনির ডাইরি, ১০ই মে, ২০২০

#Happy_Mothers_Day
মেয়েটি মুখচেনা। এমনিতে মুখ চোরা, তবে শুনতে পাই, রাজনৈতিক ভাবে বেশ সক্রিয়। ঝাণ্ডা নিয়ে মিছিলে হাঁটা পাবলিক। মাঝে মাঝে কাজ নিয়ে আসে আমাদের আপিসে, লোক নিয়ে আসে আমাদের মেলায়। ঝকমকে একটা গোলাপী শাড়ি পরে এসেছিল এবারের মেলায়- থিমই তো ছিল গোলাপী।
দিন কয়েক আগে হঠাৎ ফোন, “ম্যাডাম, বড় আশা নিয়ে আপনাকে ফোন করেছি, নিরাশ করবেন না। ” কথাটা এই কদিনে অগণিত বার শুনেছি, বহু বহু যোজন দূর থেকে ফোন করে চলেছে মানুষজন, “বাড়ি ফিরতে চাই, একটু সাহায্য করুন। ” যে কোন সরকারী ওয়েবসাইট থেকে যারই নম্বর পাচ্ছে ফোন করছে ওরা। অন্য জেলা হলে, সেই জেলার শ্রম কমিশনারদের নম্বর বিলিয়ে দি অকাতরে। মনে মনে মার্জনা চেয়েনি, বিনা অনুমতিতে নম্বর দিয়েছি বলে-।   আর আমার জেলা হলে, চেয়েনি বিশদ বিবরণ, কতজন আছেন, কোথায় আছেন, কোথায় যাবেন-। অতঃপর অতিরিক্ত জেলাশাসকের হাত ঘুরে, জেলাশাসক হয়ে তা চলে যায় নবান্ন।
বুঝলাম মেয়েটিরও ওমনি সহায়তা প্রয়োজন। ঠিকই বুঝেছি, মেয়েটি জানাল ওর স্বামী সহ বারো জন আটকে আছে সুদূর দাক্ষিণাত্যের কোন বড় শহরে। যেখানে থেকে ভেসে আসে বিরিয়ানির সৌরভ আর মুক্তার দ্যুতি। এ আর এমন কি ব্যাপার, গড়গড় করে বলেদিলাম, কি কি তথ্য পাঠাতে হবে আমায়। মেয়েটি সলাজে জানাল, না ঠিক এই সহায়তা ও চায় না। সরকারী ব্যবস্থা কবে কার্যকর হবে,কবে পৌঁছাবে ট্রেন (মনে রাখবেন বেশ কয়েকদিন আগের গল্প, তখনও দৌড়য়নি পরিযায়ী ট্রেন) ওরা আর ধৈর্য্য রাখতে অপারগ। রমজান মাস, সামনেই বাঙালীর মুসলিমদের সবথেকে বড় উৎসব, তার আগেই ঘরের লোক ফিরে আসুক ঘরে,এটাই মনপ্রাণে চায় মেয়েটি। তাই ওরা ঠিক করেছে একটা গাড়ি। বারো সিটের গাড়ি, মূল্য ধার্য হয়েছে আশি হাজার টাকা। বিষম খেলাম, বলতে গেলাম, এত টাকা? কিন্তু কেন? এতদিন ধৈর্য্য ধরলে আর কটা দিন সবুর করো না বাপু। বলতে পারলাম না। খালি মনে হল, দুর্গা পুজোর সময় যদি আমার ঘরের মানুষ আটকে থাকত এমন করে, কি করতাম আমি? মেয়েটি তো অনেক শক্ত আমার থেকে-।  একটা পাশ চায় মেয়েটা। ওদিক থেকে বেরিয়ে গেছে পাশ, এদিকেরটা পেলেই ছেড়ে যাবে গাড়ি।
বলার সময় বললাম, এ আর এমন কি কথা, কার্যক্ষেত্রে দেখলাম ব্যাপারখানা বেশ দুরূহ। কে দেবে পাশ, এটা নিয়েই লেগে গেল গোটা তিনেক ফোন। যে বড় সাহেবকে রাত তিনটেতেও মেসেজ করে বিপর্যস্ত শ্রমিকদের বিবরণ পাঠিয়েছি আমি, উনি এটা দেখেন না। যিনি দেখেন, উনি অত্যন্ত দায়সারা ভাবে জানালেন, ওসব পাশটাস দেওয়া যাবে না। “স্নেহের পরশ”এ আবেদন করুক ওরা। স্নেহের পরশ নামটার সাথে হয়তো অনেকেই পরিচিত, বিদেশে আটকে পড়া শ্রমিকদের ন্যূনতম হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা- এটা ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছে ওরা। বলতে গিয়ে দেখি, কেটে গেছে ফোন।
তুলনায় সংবেদনশীল অন্য এক কর্তাব্যক্তি জানালেন, এভাবে আন্তঃরাজ্য পাশ দেওয়াতে নানা প্রশাসনিক জটিলতা আছে, বরং পোর্টালে আবেদন করুক ওরা, সময় হলে সরকারী ট্রেনে জায়গা পেয়ে যাবে, আর যদি সবুর করতে না পারে তাহলে, যদি ওদিক থেকে কোন গাড়ি যোগাড় করে আসে, তাহলে কোন সমস্যা থাকে না। সেক্ষেত্রে দায়িত্ব ঐ রাজ্যের-। প্রয়োজনীয় লিঙ্ক, হেল্পলাইন নম্বরও পাঠিয়ে দিলেন উনি।

তাই জানালাম মেয়েটাকে। ওদিকে থেকে ভেসে আসা জবাব বুঝিয়ে দিল যতটা ঘেঁটে আছি আমি,ততোটাই ঘেঁটে আছে মেয়েটা। পরদিন ভোরবেলা ফোন, “সারা দিন- রাত চেষ্টা করেছি ম্যাডাম। চারজন, চার জয়গা থেকে চেষ্টা করেছি, পারিনি ম্যাডাম”। শয়ে-শয়ে, হাজারে-হাজারে মানুষ আবেদন করে চলেছে পোর্টালে, সুযোগ পাওয়া এত সহজ না। তাহলে কি হবে? ওদিক থেকে গাড়ি করবে কি? সেখানেও সমস্যা, তিন থেকে চারজনের জন্য গাড়ির অনুমোদন পাওয়া যেতে পারে, তাতে অবশ্যই খরচটা আর বহনযোগ্য থাকছে না। কি করা যায়? আপাত অসহায়তা লুকিয়ে মেয়েটাকে বললাম, ভেঙে না পড়ে, পোর্টালে চেষ্টা চালিয়ে যেতে, আর ওদিকে ওর বরও যেন চেষ্টা চালিয়ে যায়- সে দিন বুদ্ধপূর্ণিমা।

বড় সাহেব ফোন করেছিলেন অন্য কোন কাজের দরকারে, জানালাম, কাজে একদম মন নেই, খুব মন খারাপ মেয়েটার জন্য। স্যার বললেন, “মন্ত্রীমশাইকে ফোন করেছ?” নাঃ মন্ত্রীমশাইকে ফোন করার কথা মাথাতে আসেনি। হুগলী সদরের মাননীয় পূর্ণমন্ত্রী, অত্যন্ত অমায়িক ব্যবহার। এবছর মেলার আগের রাতে, জনৈক মস্তান যে হুজ্জতি বাঁধিয়েছিল, মন্ত্রীমশাইয়ের প্রত্যক্ষ সহায়তা ছাড়া তাকে জব্দ করতে পারতাম না। ফোন করা মাত্র সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিলেন উনি, জানালেন এখুনি নিজের প্যাডে চিঠি করে দেবেন-। লোকগুলির ঠিকুজি পাঠাতে পাঠাতে মেয়েটিকে বললাম, এখুনি দৌড়ও। প্রখর রোদে সাইকেল নিয়ে দৌড়ে গেল মেয়েটা।
মন্ত্রীমশাই চিঠি করে পাঠিয়েও দিলেন জেলাশাসককে, তিনি পাঠাবেন নবান্ন। ট্রেন চালু হলেই সর্বাগ্রে ফেরার ব্যবস্থা হবে ওদের।
তাহলে ব্যাপারটা হল ঘুরে ফিরে আবার প্যাভিলিয়নে ফিরে এলাম আমরা। মেয়েটিও বলল, “তাহলে তাই হোক ম্যাডাম। কটা দিন পরেই ফিরুক। ” আমারও মনে হল, আর কিই বা করা যেত, অন্তত নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের এতগুলো টাকা তো বেঁচে যাবে।
বিকালে ফোন করল মেয়েটা, “ম্যাডাম ওরা ওখান থেকে পাশ পেয়ে গেছে। তবে গাড়ি না, বাসে আসতে হবে। খরচটা একটু বেশীই পড়ছে। কি আর করা যাবে। সীমান্তে না কোন ঝঞ্ঝাট হয়, একটু দেখবেন ম্যাডাম। ” জানালাম পাশটার ছবি তুলে পাঠাতে, আর জানতে চাইলাম কত পড়ছে, উত্তর এল, “এক লাখ টাকা। ” প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম, এত টাকা! বাসে তো কম হবার কথা? জবাব পেল, “সব সঞ্চয় শেষ ম্যাডাম। ঘরের লোকটা ঘরে ফিরে আসুক। আর এটা এমনি বাস নয়কো, স্পেশাল বাস-দূরত্ব রেখে বসে আসতে হবে তো”। কিছু বলার নেই, মেয়েটির জায়গায় আমি থাকলেও এটাই করতাম। উৎসবের দিন ঘরের মানুষ ঘরে ফিরে আসুক।
পরশু গভীর রাতে ছাড়ল বাস। জেলা প্রশাসনের বড় কর্তাকে সব তথ্য পাঠিয়ে রাখলাম, উনিও আশ্বস্ত করলেন কোন সমস্যা হবে না। গতকাল আবার ফোন মেয়েটির, “ম্যাডাম তিনজনের পাশ বেরিয়ে গেছে, পোর্টাল থেকে। কি হবে ম্যাডাম?” মন্ত্রীজী কথা রেখেছেন। এক ধাক্কায় বারো জনের না হলেও খেপে-  খেপে বেরোতে শুরু করেছে। এই রেঃ, ওরা যে বাসে করে বেরিয়ে পড়েছে এটা তো ওণাকে জানানো হয়নি।“ কি হবে ম্যাডাম?” কাঁদোকাঁদো সুরে জানতে চাইল মেয়েটা। গলায় ছদ্ম সাহস এনে বললাম, কি আবার হবে? শ্রমিকরা অপেক্ষা করে থাকতে পারেনি, ধারধোর করে ঘটিবাটি বেচে রওণা দিয়েছে। এতে দোষের কি অ্যাঁ? চুপচাপ থাকো।
তখনকার মত ঝামেলা মিটল বটে, বিকালে সবে জুড়ে এসেছে চোখের পাতা, মন্ত্রীমশাইয়ের ফোন। “রবিউলের বউকে ফোনটা দিন।” সর্বনাশ যেখানে বাঘের ভয়-। কাঁপতে কাঁপতে জানালাম, আমি চুঁচুড়ায় নেই। মেয়েটিকে বলছি, ওণাকে ফোন করতে এখুনি। মেয়েটিকে বললাম, আবার দৌড়ে যা বাবা। গিয়ে মার্জনা চেয়ে নে। তারপর আমি সামলাচ্ছি। পাঁচ মিনিট বাদেই মেয়েটার ফোন, “ম্যাডাম, ইয়ে আমার বরের নাম রবিউল নয়তো। ঐ বার জনের মধ্যে কোন রবিউল নেই। ” যাক স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল। মন্ত্রীমহোদয়কে ফোন করে জানালাম, রবিউলের হয়ে কোন তদ্বির আমি করিনি। যাদের হয়ে করেছিলাম, তারা বাড়ি ফেরার জন্য কাতর হয়ে পড়েছিল এবং বাস ভাড়া করে ফিরে আসছে। উনি অত্যন্ত সহৃদয় ভাবে জানালেন, ঠিক আছে। ভবিষ্যতেও এমন সমস্যা হলে যেন ওণাকে জানাতে দ্বিধা না করি।
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। রাত এগারোটার সময় মেয়েটা জানালো উড়িষ্যা ছাড়িয়েছে ওরা। প্রার্থনা করে ঘুমোতে গেলাম, মানে মানে ঘরের ছেলেগুলো ঘরে ফিরুক। ভোর সাতটায় মেয়েটার মেসেজ, এবং তার সাত মিনিটের মধ্যে ফোন, ওদের বাস চুঁচুড়ায় ঢুকেছে। সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে ওদের পরীক্ষার জন্য। মধ্যাহ্নে খবর এল, ছেড়ে দিয়েছে ছেলেগুলোকে। আপাততঃ একজনের ফাঁকা বাড়িতে আইসোলেশনে থাকবে ওরা। নিজেরাই রান্নাবান্না করে খাবে- জানালাম, “সে ভালো। তবে এখনি জড়িয়ে ধরে হামিটামি খেতে যেও না। আর কটা দিন সবুর করো। ” সলাজ হেসে প্রভূত কৃতজ্ঞতা জানাতে জানাতে কেঁদেই ফেলল মেয়েটা। জানতাম। আমি হলেও কেঁদেই ভাসাতাম। অনেকবার বাংলা ইংরাজিতে থ্যাঙ্কু জানাল মেয়েটা, জানালো গোটা পরিবার আমার মঙ্গলাকাঙ্খায় দোয়া চাইবে ওপরওয়ালার কাছে- অনেকবার বোঝালাম, নিছক সহমর্মিতা দেখানো ছাড়া কিছুই করিনি আমি। তারপর মনে হল, থাক আর বিনয় দেখাব না। দুহাতে লুটে নি এই ভালোবাসা আর শুভকামনা। তারপর উপহার স্বরূপ পাঠিয়ে দেব সবটুকু, আমার মাকে, আজ মাদার্স ডে কি না। খুব ভালো থেকো মা। যতদিন যাচ্ছে ততোবেশী তোমার মত হয়ে উঠছি আমি। আর জীবনের থেকে সেটাই আমার সবথেকে বড় পাওনা।

No comments:

Post a Comment