ছাতের প্রিয় কোণাটায় আজকাল আর দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না। সব একই আছে, তারা জ্বলজ্বল রাতের আকাশী চঁদোয়া, নিয়ন আলোয় ধোয়া রাজপথ, সারি সারি উদ্ধত বহুতল, ফুটপাত জুড়ে ঝাঁকড়া মাথা দোলানো মহীরুহের সারি, ঝপাং করে নেমে আসা ফ্লাইওভার,নেই শুধু প্রাণ। লকডাউনের প্রথম দিকে শহরের ব্যস্ততম রাজপথের এই অচেনা ঝিমানো রূপ বেশ প্রশান্তি জাগাত। আজকাল ভয় ধরে, কোন অদৃশ্য যাদুকরের যাদুকাঠির ছোঁয়ায় বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছে প্রিয় শহরটা-
আজকাল একটা নতুন খেলা আবিষ্কার করেছি, বাসন মাজার আগে গুনেনি কটা বাসন আছে, তারপর কল্পনা করি প্রতিটা থালা-বাটি-গ্লাস-চামচ আসলে একএকটা দশক বা শতক। যেমন ধরুন রাতে বাসন একটু কম পড়ে, রাতের গুলো শতক। আর দিনের গুলো দশক। এবার মনে করার চেষ্টা করি ঐ দশক বা শতকে কি ঘটেছিল। আশির দশকে বিশ্বকাপ জিতেছিল ভারত। গ্লাসনস্ত আর পেরেস্ত্রৈকা। আগুনে সত্তর আর দেশজোড়া জরুরী অবস্থা। চল্লিশের বিশ্বযুদ্ধ আর হলোকাস্ট এই ভাবে পিছিয়ে যেতে যেতে হারিয়ে যাওয়া সময়ের অলিন্দে কখনও মোলাকাৎ হয়ে যায় কানা বাদশা শাহ আলমের সাথে তো কখনও সাক্ষৎ হয় পূষ্যভূতির বংশীয় সম্রাট হর্ষবর্ধনের সাথে। এভাবেই কখন যেন মাজা হয়ে যায় বাসনগুলো। কাজের মাসিদের বোধহয় আর এজন্মে প্রবেশাধিকার দেবে না এই আবাসন!
অতিমারীর হাত থেকে বাঁচা অসম্ভব, বেশ বুঝতে পারি। অল্পক্ষণ মাস্ক পরলেই, বন্ধ হয়ে আসে দম, ইলাস্টিক স্ট্রাপে কানের পিছনে উঠে যায় ছাল। প্রতি আড়াই মিনিটে একবার করে ঠিক করতে হয় মাস্ক। এদিকে পাড়াতেই ধরা পড়েছে করোনা রোগী। জনৈক পাড়াতুতো পিসি, কি ভাবে ধরালো রোগটা কে জানে? ফোনের ওপার থেকে সাবধান বাণী আওড়ে চলে বাবা,“এখন একদম এ পাড়ায় আসবি না।” শুনলাম ওণাদের বাড়ির সকলে আপাততঃ গৃহবন্দী, মাঠে আড্ডা মারতে বসা ছেলেছোকরার দলকেও হঠিয়ে দিয়েছে পুলিশ। আপিস যাবার পথে একবার ঢুঁ মারা বিশেষ দরকার। হপ্তা ঘুরে গেল মাসকাবারীর লিস্টে পাঠিয়েছে বাবা, সুখের দিনের বন্ধু বিগ বাস্কেট, যার জন্য পরিত্যাগ করেছিলাম পাড়ার মুদির দোকান,পাত্তাই দিল না। যখনই খুলি, একই বুলি ফাঁকা স্লট নাই। কারা যে এত স্লট বুক করেছে কে জানে? অগত্যা মাথা নীচু করে পাড়ার দোকানেই লাইন দেওয়া-। যা ডানপিঠে বুড়ো, নাহলে নির্ঘাত নিজেই বেরিয়ে পড়বে ঝোলা নিয়ে। আপিস যাবার পথে পলকের জন্য থামা, বাপি বলে, “আপনাদের এই গলিতে কি আদৌ কেউ লকডাউন মানছে ম্যাডাম?” স্থানীয় দোকানগুলিতে বেশ ভিড়। সৎসঙ্গের সামনে সব্জি নিয়ে বসেছে চেনা ছেলেপিলের দল। ছোট্টবেলার খেলার সঙ্গী সব, মাস্ক পরা সত্ত্বেও দিব্যি চিনতে পারে। একসাথেই বলে উঠি উভয়ে,“কি রে? কেমন আছিস? সাবধানে থাকিস। ” চৌকাঠ ডিঙিয়ে মাটিতে মালপত্র ঢেলে, ঘন্টা দুয়েকের আগে হাত দিতে নিষেধ করি। আনারসের জ্যাম চেয়েছিল বাবা, মেলেনি দোকানে। মেলেনি ব্লিচিং পাউডারও। জনৈক বয়স্ক কাকু এসেছিলেন পিটা ব্রেড কিনতে, পিৎজা বানাবেন গিন্নি আর কন্যার আব্দার বিশেষ ব্রাণ্ডের শাওয়ার জেল - নাঃ মেলেনি সেসবও।
আগের তুলনায় আজকাল রাস্তায় ভিড় একটু বেশী।আপিস টাইমেও দিল্লী রোডে সার দিয়ে যাতয়াত করে মালবোঝাই ট্রাকের দল। রোদের তেজ বড়ই বেশী। তবুও গাড়ির কাঁচগুলো নামিয়ে দিতে বলি, আঁতকে ওঠে বাপি, “আপনাদের এখানে গিজগিজ করছে করোণা। কাঁচ নামালেই ঢুকে পড়বে। ” আমাকে নিতে আসার আগে, গাড়িটা স্যানিটাইজার দিয়ে মুছে আনে বাপি। শুধু স্যারের ভয়ে চাবিটা বোধহয় মোছে না।
লকডাউনের বাজারেও সুজয় বাবুর চায়ের দোকান বন্ধ হয়নি। দোকান থোড়াই, কালেক্টরের কোন অচেনা বারান্দায় জনতা স্টোভে জল ফুটিয়ে চা বানায় সুজয়। সাথে বাদাম দেওয়া বিস্কুট। জিরে-কালো জিরে দেওয়া বিস্কুটও থাকে, তবে ওগুলো দেখলে আমার মটকা গরম হয়ে যায় বলে আমার ঘরে আনে না। এগারোটা নাগাদ একবার দুধ কফি দিয়ে যায়। তারপর ঘন্টায় ঘন্টায় কালো চা। এলেই গপ্প শোনায়, আমাদের গাছ গুলোতে নাকি ও রোজ জল দেয়। প্রত্যেকের নামে একটা করে গাছ লাগিয়েছিলাম আমরা। নিজেরাই জল দিতাম। যত্ন করতাম। লকডাউনের বাজারেও দিব্যি আছে গাছগুলো। বিদ্যুতের জবা গাছে এত বড় কমলা জবা ধরেছে। প্রীতির হাজারি গোলাপ গাছে কুচি কুচি গোলাপী ফুল। ভালো আছে কৌশিকের পাম আর নির্মলের পাতাবাহারও। কি যেন একটা বেগুনী গাছ, এক চুপড়ি এনে রেখে গেছে রমেশ। ওটা ফাঁকা বাতিল র্্যাকে লাগাবে। গাছগুলো ভালো আছে, তবে মোটেই সুজয় বাবুর জন্য নয়। আমি জানি কে যত্ন নেয় আমাদের গাছগুলোর-
সম্পর্কে তিনি আমাদের কেউ না, জেলাশাসকের প্রাক্তণ সাফাইকর্মী। সাফাই করার সূত্রেই আমাদের সাথে আলাপ। শুধু সাফাই না, রোজ সকালে আপিস খোলেন তিনি, সন্ধ্যা গাঢ় হলে তালাও মারেন তিনি। অবসর নেবার পর ঘুরে গেছে বছর, না তিনি আমাদের ছাড়তে পারেন না আমরা তাঁকে। তিনি আমাদের সর্বজনপ্রিয় অজিত দা।
জানেন কি, দীর্ঘ ৩৪-৩৫বছরের কর্মজীবনে মাত্র চারদিন ছুটি নিয়েছিলেন অজিত দা। দুদিন নিজের বিয়ের জন্য আর বাকি দুই দিন দুই মেয়ের বিয়েতে। এখনও এই বৃদ্ধের কর্মতৎপরতা তথা সক্ষমতা লজ্জা দেয় আমাদের। আপিসে মালপত্র এলে একাই নীচে থেকে তুলে আনেন অজিতদা। মেলার আগে যখন আপিস গুটিয়ে মাঠে যাবার সময় আসে, কাগজপত্র, ফাইল-দস্তাবেজ, ট্রফি-স্মারক, উত্তরীয়-ব্যাজ থেকে কম্পুটর দুহাতে আর মাথায় করে মালপত্র বয়ে গাড়িতে তোলে অজিত দা। শুভজিৎ, সোমনাথ, রমেশ আর বিদ্যুতের একটা বাক্স নিয়ে যেতে যেতে তিনবার ওপরনীচ করে ফেলে অজিতদা। আমাদের সর্বঘটে কাঁঠালি কলা অজিত দা। সেদিন থার্মাল গান কেনার কথা হচ্ছিল, নির্মল প্রশ্ন তুলল চালাবে কে? রমেশ আর আমার মুখ থেকে একসাথে বের হল কেন অজিত দা? স্যার শুনে আঁতকে উঠেছিলেন, আরেঃ ওণারই তো আক্রান্ত হবার সম্ভবনা সবথেকে বেশী।
সেদিন নালিশ জানাতে এসেছিলেন অজিত দা, ম্যাডামের কাছে মাঝেমধ্যেই না না নালিশ তথা আব্দার জানায় অজিতদা। সেদিন অনুযোগ করছিলেন, “একটা টিপিনও দিল না ম্যাডাম। প্রচেষ্টার ফর্ম জমা নিচ্ছিলুম আমরা। কত লোক। কি বিশাল লাইন। বেলা তিনটে অবধি আমরা পাঁচজন রইলুম, ওরা প্রচেষ্টার নাম করেই টিপিন আনল আমাদের দিল না। আমি চাইতে গেলুম। তাও দিল না।” ওরা মানে পাশেই জেলা প্রশাসনের জনৈক হোমরাচোমরা আধিকারিকের দপ্তর। আধিকারিক অত্যন্ত বিনয়ী, সহৃদয় এবং ভালোমানুষ। কিন্তু তাঁর দপ্তরে যারা আছেন, তাঁরা রীতিমত নমস্য। স্পষ্ট মনে আছে, বিগত সংসদীয় নির্বাচনের পরদিন রণিত বলেছিল, “সারা দিন খেতে পাইনি ম্যাডাম। সব দোকানপাট বন্ধ। ঐ আপিসে গাদা গাদা প্যাকেট এল বটে। একটাও -”। রণিত, শুভজিৎ আর বর্মন সাহেব তো লজ্জার মাথা খেয়ে চাইতে পারেনি সেদিন, কিন্তু অজিত দা চেয়েছিল। তাও পায়নি। তাই ম্যাডামকে পেয়েই উগরে দিয়েছে মনের দুঃখ। ভালোবাসে বলেই তো আব্দার জানায়। ম্যাডামও ভালোবাসে অজিতদাকে। কিন্তু আপাততঃ বড়ই অসহায়। চেনা দোকাপাট সব বন্ধ। তবে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন অজিত দা, উঠুক লকডাউনট। খুলুক দোকানপাট। সুদ সমেত খাওয়াতে হবে পাঁচজনকে-। আপাততঃ চলুন দেখি, কেমনি পোজ দিতে পারেন, গাছগুলোর সঙ্গে আপনার একখান ছবি তুলি, ওরা বেঁচে আছে তো শুধু আপনারই জন্য। আপনার মত মানুষজন এখনও আছে বলেই বোধহয় কোথাও বোধহয় বজায় আছে ভারসাম্য।
No comments:
Post a Comment