Tuesday, 19 May 2020

#চেনা_ইতিহাস_অচেনা_সুর উইলিয়াম ড্যালরিম্পলের দা অ্যানার্কি থেকে


"অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌল্লা ( ১৭৩২-৭৪)

মুঘল উজির সফদর জঙ্গ এর পুত্র এবং উত্তরসূরী সুজাউদ্ধোল্লা ছিলেন এক দৈত্য। উচ্চতায় প্রায় সাত ফুট, ওষ্ঠাধরের ওপরে উড়ন্ত ঈগল পাখির ডানার মত সুবিশাল তৈলচর্চিত গোঁফ। তেমনি ছিল গায়ের জোর। প্রায় কিংবদন্তী।  যৌবনের উপান্তে এসেও এক কোপে একটা মোষের মাথা উড়িয়ে দিতে পারতেন, দুহাতে ঘাড় ধরে শূণ্যে তুলে ধরতে পারতেন দুইজন সেপাইকে। অসম্ভব আত্মবিশ্বাসী আর আত্মম্ভরী ছিল লোকটা। তেমনি উচ্চাকাঙ্ক্ষী। নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে বড় বেশী উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন, এই কারণেই হয়তো তৎকালীন শহুরে শিক্ষিত সম্প্রদায় খুব একটা পছন্দ করত না ওণাকে। গুলাম হুসেন খাঁ ওণার সম্পর্কে লিখে গেছেন, যে ‘লোকটা যতটা বলশালী প্রায় ততোটাই নির্বোধ। বেশ গবেট’। ”


অ্যানার্কি
#চেনা_ইতিহাস_অচেনা_সুর #2
"The collecting of Mughal Taxes was henceforth subcontracted to a powerful multinational corporation- whose revenue-collecting operations were protected by its own private army." William Dalrymple about the East India Company, in The Anarchy. Why am I having this ominous feeling of repeating history.

অ্যানার্কি
#চেনা_ইতিহাস_অচেনা_সুর #3
“ভারতে বৃটিশ আধিপত্য বিস্তার, এই শব্দবন্ধের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক অশুভ সত্য। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে সমগ্র ভারত বর্ষ জুড়ে যে লুটপাট শুরু হয়েছিল, তার পিছনে বৃটিশ সরকারের কোন ভূমিকা ছিল না। এর জন্য দায়ী ছিল, এক নিয়ন্ত্রণহীন প্রাইভেট কোম্পানী। যার সদর দপ্তর বলতে ছিল পাঁচখানা জানালা পাশাপাশি জুড়লে যতটা চওড়া হয়, লণ্ডনের বুকে সেই মাপের একটা ছোট্ট আপিস। আর ভারতবর্ষে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে এক চরম নিষ্ঠুর,হিংস্র, অবস্থা বিশেষে মানসিক ভারসাম্যহীন কর্পোরেট জন্তু, যার নাম- ক্লাইভ।”
অ্যানার্কি
#চেনা_ইতিহাস_অচেনা_সুর #4
“এমনিতেই যুদ্ধবিগ্রহে বিপর্যস্ত ছিল বঙ্গদেশ, গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত দেখা দিল ১৭৬৯ এর মন্বন্তর। ঐ অবস্থাতেও খাজনার হার ছিল বেশ চড়া। খাজনা আদায়ের জন্য কোম্পানীর ট্যাক্স কালেক্টররা যথেচ্ছ নির্যাতন চালাত, পদে পদে লঙ্ঘিত হত মানবাধিকার। খুব দ্রুত খালি হয়ে আসছিল বঙ্গদেশের ধনভাণ্ডার। এখানকার সমৃদ্ধশালী তাঁতি আর কারিগররা নির্যাতিত নিঃস্ব হয়ে পরিণত হচ্ছিল ক্রীতদাসে।

বঙ্গদেশের ধনভাণ্ডারের একটা বৃহৎ অংশ গিয়েছিল ক্লাইভের পকেটে। ক্লাইভ যখন বৃটেনে ফিরে যায়, তার ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ২,৩৪,০০০ পাউণ্ড। সেই সময় সমগ্র ইউরোপে ক্লাইভের থেকে ধনাঢ্য ব্যক্তি কেউ ছিল না। বিশ্বাসঘাতকতা, জাল জোচ্চুরি আর ঘুষের বিনিময়ে ১৭৫৭এর পলাশীর যুদ্ধে জেতার পর ক্লাইভ, পরাস্ত নবাবের কোষাগার লুণ্ঠন করে  প্রায় ২৫লক্ষ পাউণ্ড পাঠিয়েছিল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ভাঁড়ারে। এত টাকা এর আগে কেউ কখনও চোখে দেখেনি। বঙ্গদেশের ভাঁড়ার বা ট্রেজারি খালি করে একশ খানা নৌকা গঙ্গাপথে পাড়ি দিয়েছিল মুর্শিদাবাদ থেকে, গন্তব্য সুদূর কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম।”

অ্যানার্কি
#চেনা_ইতিহাস_অচেনা_সুর  #5
“পোওইজ দুর্গে রাখা বাদশা শাহ আলম আর রবার্ট ক্লাইভের ছবিটা মোটেই যথার্থ নয়, বরং অনেক ভুল তথ্যে ভরা। চিত্রকর বেঞ্জামিন ওয়েস্ট কোনদিন  ভারতের মাটিতে পা রাখেননি। ছবিতে প্রথমেই যেটা চোখে লাগে, তা হল পটভূমিকায় আঁকা মসজিদের সাথে আমাদের সেন্ট পল ক্যাথিড্রালোর অদ্ভূত আকৃতিগত সাদৃশ্য।
বাস্তবে কোন আনুষ্ঠানিক জমায়েত হয়নি, ক্ষমতার হস্তান্তর হয়েছিল নিরালায়, নিভৃতে, লোকচক্ষুর অন্তরালে। এলাহাবাদে সদ্য বিজিত মুঘল দুর্গের এক প্রান্তে, ক্লাইভের তাঁবুতে মুখোমুখি বসেছিলেন পরাভূত সম্রাট আর বিজেতা ক্লাইভ। ছবিতে বাদশা শাহ আলমের জমকালো মখমলী সিংহাসন, আসলে ডাইনিং টেবলের সামনে টেনে আনা, ক্লাইভের হাতলওয়ালা চেয়ারের ওপর সামান্য সুতির ছিট চাদর।
ক্লাইভ নির্দেশ দিয়েছিল আর পরাস্ত,ভীত বাদশা শাহ আলম নীরবে মেনে নিয়েছিল সমস্ত শর্তাবলী- পরবর্তীকালে বৃটিশরা যার গালভরা নাম দিয়েছিল, এলাহাবাদের চুক্তি (১৭৬৫)। তৎকালীন মুঘল ঐতিহাসিক গুলাম হুসেন খাঁ লিখে গেছেন, “এত বড় একটা চুক্তির জন্য কতদিন আগে থেকে উত্তাল হয় মন্ত্রীসভা, দুপক্ষের মতামত আর সন্দেশ বয়ে দৌড়ায় বিচক্ষণ আর পরিপক্ক রাষ্ট্রদূতের দল, চলে দীর্ঘমেয়াদী দর কষাকষি- চাপানউতোর, তবে স্থির হয় প্রতিটি শর্ত। অথচ এই ক্ষেত্রে এত বড় চুক্তি হতে যা সময় লেগেছিল, তার থেকে বেশী সময় বোধহয় গরু-ছাগল কেনাবেচাতে ব্যয় হয়। ”

অ্যানার্কি
#চেনা_ইতিহাস_অচেনা_সুর #৬

“ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি একদিকে পূবে চীনকে সরবরাহ করত আফিম, আবার চীনের চা নিয়ে গিয়ে বিক্রি করত সুদূর পশ্চিমে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস্ এ। বস্টন বন্দরে এই চা নামানোকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছিল আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ। আমেরিকান স্বদেশ প্রেমীদের মনে ভয় ছিল, যুদ্ধের সময়, আমেরিকানদের জব্দ করার জন্য, বৃটিশ সরকার বকলেস খুলে ছেড়ে দেবে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীকে। আর একবার যদি কোম্পানী জমিয়ে বসতে পারে, নির্বিচারে লুটতরাজ চালাবে ওদেশেও। বাংলার মতই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে আমেরিকাকে।

১৭৭৩এর নভেম্বরে, আমেরিকান নেতা জন ডিকচিনসন, বলেছিলেন, কোম্পানীর চা, “অভিশপ্ত আবর্জনা” বিশেষ, কোম্পানী যদি আমেরিকায় টিকে যায়, তাহলে এমন দুর্দিন ডেকে আনবে, কেউ বাঁচবে না। যত্রতত্র পচাগলা দেহ ইঁদুরে খুবলে খাবে। তিনি আরও বলেছিলেন, “শয়তানের প্রতিভূ এই দেউলিয়া কোম্পানী। নিপীড়ন আর অত্যাচারে বাংলাকে ছারখার করে এবার এদের লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে আমেরিকার ওপর।"
অ্যানার্কি
#চেনা_ইতিহাস_অচেনা_সুর #৭

“ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী, বৃটিশ সরকার প্রদত্ত প্রাতিষ্ঠানিক অনুমতি বা চার্টার পাবার দুমাসের মাথায়, ১৩ই ফেব্রুয়ারি, ১৬০১, উলউইচ থেকে যাত্রা শুরু করল নবরূপে সজ্জিত পোত “রেড ড্রাগন”। দোসর বলতে তিনটি অপেক্ষাকৃত ছোট জাহাজ- হেক্টর, সুজান আর অ্যাসেনশন। ফেব্রুয়ারির শীতে, কুয়াশাচ্ছন্ন টেমস নদীর বুকে পাল তুলে ভেসে তো পড়ল - কিন্তু ডেনভারের অদূরে টেমসের মোহনায় গিয়ে আটকে পড়ল নৌবহর। হঠাৎ করে স্তব্ধ হয়ে গেল বাতাস। অতঃপর বাতাসের মুখাপেক্ষী হয়ে, বসে থাকা ছাড়া কোন গতি রইল না।আর এই সুবাতাসের জন্য, এই নৌবহরকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল পাক্কা দুমাস-।  , -”

অ্যানার্কি
#চেনা_ইতিহাস_অচেনা_সুর #৮

“ইস্টইণ্ডিয়া কোম্পানী প্রথম দিকে যাদের নিয়োগ করত, তাদের কথা যত কম বলা যায় ততোই ভালো। অধিকাংশই ছিল নিউগেট জেল থেকে ছাড়িয়ে আনা দাগী আসামী। কোম্পানীর প্রথম দিকের একটি চিঠিতে অনুযোগ করা হয়েছে, ‘এদের যাও বা আমরা কিছুটা বশে আনতে পেরেছি, কিন্তু এবার তো বেডলামের পাগলা গারদ থেকে লোক পাঠানো শুরু হয়েছে দেখছি- ।’ কোম্পিনীর এই কর্মচারীদের নামে নিত্য নালিশ আসত, ‘ভয়ঙ্কর দাঙ্গাবাজ, পাঁড় মাতাল আর তেমনি বেশ্যাসক্ত’।  এমনি একটি চিঠিতে তৎকালীন ডাইরেক্টরদের করুণ ভাবে অধুরোধ করা হয়েছে,‘অনুগ্রহ করে যদি কিছু ঠিকঠাক লোক পাঠান খুব ভালো হয়।  দায়িত্বজ্ঞানহীন, মাতাল আর লম্পটদের নিয়োগ না করাই ভালো।’"

অ্যানার্কি
#চেনা_ইতিহাস_অচেনা_সুর #৯
“২৮শে অগষ্ট, ১৬০৮, সুরাট বন্দরে এসে থামল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর জাহাজ হেক্টর, ভারতের মাটিতে পা রাখলেন কোম্পানীর প্রথম কম্যান্ডার উইলিয়াম হকিন্স। সেই সময় ভারতবর্ষের জনসংখ্যা ছিল ১৫ কোটি। সমগ্র পৃথিবীর জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশ মানুষ বসবাস করত এই দেশে। আর পৃথিবীর যাবতীয় উৎপাদনের এক চতুর্থাংশই উৎপাদিত হত এই দেশে।ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র ছিল ভারতবর্ষ। বিশেষতঃ বস্ত্রশিল্পে ভারত ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ইংরাজি ভাষায় চিন্টজ্,শল, ক্যালিকো, পাজামা, খাকি, ডাংগ্রী, কমরবন্ধ, টাফেট্টার মত শব্দগুলি আজও তার সাক্ষ্য বহন করে।”

“তুলনায় ইংলণ্ডের জনসংখ্যা ছিল ভারতের পাঁচ শতাংশ মাত্র। বিশ্বের উৎপাদনের মাত্র তিন শতাংশ উৎপাদিত হত ইংলণ্ডে। ভারতীয় ব্যবসা বাণিজ্যের মুনাফার একটা বড় অংশ গিয়ে জমা হত মুঘলদের তোষাখানায়। যা থেকে বাদশাহের আয় হত প্রায় দশ কোটি পাউণ্ড। নিঃসন্দেহে ভারতসম্রাট ছিলেন বিশ্বের ধনীতম ব্যক্তি। বৈভবে-ঐশ্বর্যে মুঘলদের রাজধানী ছিল অতুলনীয়। জেস্যুইট পাদ্রী ফাদার অ্যান্টনিও মনট্সেরা লিখে গেছেন, ‘আয়তন, জনসংখ্যা আর ঐশ্বর্যের নিরিখে এশিয়া বা ইউরোপের কোন শহর এদের ধারেকাছে আসে না’। 

সপ্তদশ শতকের শুরু থেকে ইউরোপীয়রা অন্যান্য জনজাতিগুলিকে খুব সহজেই যুদ্ধে পরাস্ত করে আসছে। ১৫২০তে মাত্র এক মাসের মধ্যে অ্যাজটেক সম্রাটের বিশাল সৈন্যদলকে ছত্রভঙ্গ করে দেয় স্পেনীয়রা। মলাক্কা প্রণালীতেও, স্থানীয় শাসকদের দিকে কামান তাক করে ডাচরা। এতদিন যাদের সাথে ছিল ব্যবসায়িক সম্পর্ক, নির্বিবেক ভাবে তাদেরই আক্রমণ এবং হত্যা করে ডাচরা। ৪৭জন দলপতিকে নির্যাতন পূর্বক হত্যা করা হয়। কিছুদিন আগেও যে স্থানীয় অধিবাসীরা ক্যানো চড়ে হাসি মুখে এসে অভ্যর্থনা জানাত ভিনদেশী অতিথিদের, তাদেরই বন্দর জবরদখল করে, আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় তাদের বসতিতে। নির্বিচারে চালানো হয় গণহত্যা।”

“কিন্তু মুঘল শাসনাধীন ভারত বর্ষে এই গোস্তাকি করার সাহস হয়নি কোন ইউরোপীয় শক্তির। ক্যাপ্টেন হকিন্স নেমেই বুঝতে পারেন, এখানে বেচাল হবার প্রশ্নই ওঠে না। মুঘল সম্রাটের ছিল ৪০লক্ষ সশস্ত্র সুপ্রশিক্ষিত সৈন্য। ১৬৩২এ যখন সুলতানের গোচরে আসে যে হুগলীতে পতুর্গীজরা বিনানুমতিতে দুর্গ বানাচ্ছে এবং বাদশাহের সুস্পষ্ট নিষেধ সত্ত্বেও তাঁর প্রজাদের জবরদস্তি খ্রীষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত করছে, তিনি তৎক্ষণাৎ পর্তুগীজদের গড় ধ্বংস করে, তাদের সদলবলে উচ্ছেদ করার নির্দেশ দেন। কয়েকদিন নামমাত্র প্রতিরোধ করার পরই আত্মসমর্থন করতে বাধ্য হয় পর্তুগীজরা। যারা নদীপথে পালাবার চেষ্টা করে, নিঁখুত ভাবে তাদের নৌকা লক্ষ্য করে গর্জে ওঠে ভারতীয় কামান।ডুবে মারা যায় অনেকে। আর যারা বেঁচে যায়, তাদের বন্দী করে, সুলতানের করুণা ভিক্ষার জন্য পাঠানো হয় আগ্রা। এই প্রসঙ্গে পাদশাহনামায় লেখা আছে যে, “প্রায় ৪০০পর্তুগীজ কয়েদী, বিধর্মী মূর্তি সহ ধরা পড়ে। যারা ক্ষমা চাইতে অস্বীকার করে, তাদের ক্রীতদাস হিসেবে ভাগবাটোয়ারা করে দেওয়া হয় আমির-ওমরাহদের মধ্যে। অথবা দেওয়া হয় কারাদণ্ড, যেখানে নির্যাতন সইতে না পেরে অনেকেই পচে মরে।” গোয়ার পর্তুগীজ গভর্নর সমস্ত ঘটনাবলী নীরবে প্রত্যক্ষ করা ছাড়া কিছুই করতে পারেননি। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী প্রথম থেকেই বুঝেছিল,যে এদেশে টিকে থাকতে হলে সম্রাটের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন একান্ত জরুরী।”

অ্যানার্কি 
#চেনা_ইতিহাস_অচেনা_সুর #১০

"সুরাট থেকে ক্যাপ্টেন হকিন্সের আগ্রা পৌঁছতে লেগে যায় এক বছর। আফগান আমিরের ছদ্মবেশে আগ্রায় প্রবেশ করে, স্বল্প সময়ের জন্য সুলতানের দর্শন পান তিনি। সুলতানের সঙ্গে তুর্কী ভাষায় বাক্যালাপও করেন, তবে তাতে বিশেষ সুবিধা হয়নি। অর্ধশিক্ষিত ফিরিঙ্গী নাবিককে ছিটেফোঁটাও গুরুত্ব দেননি বাহশাহ জাহাঙ্গীর। খালি হাতে ফিরতে হয় ক্যাপ্টেন হকিন্সকে, এক আর্মেনিয়ান মহিলাকে ঘরণী করে ঘরে ফিরে যান তিনি। 
প্রথম অভিযানের ব্যর্থতায় হতোদ্যম না হয়ে, কোম্পানী স্যার হেনরি মিডলটনের নেতৃত্বে আরেকটি নৌবহর পাঠায় ভারতে। কিন্তু এই নৌবহরের যাত্রীদের আর ভারতের মাটিতে পা রাখার সৌভাগ্য হয়নি। সুরাট বন্দরে নোঙর করার আগেই, স্থানীয় পর্তুগীজ ব্যবসায়ীদের বিক্ষোভের চোটে, বন্দর কর্তৃপক্ষ সুভালি থেকে তাদের ফেরৎ পাঠান। 
পরপর দুটি অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর, তৃতীয় অভিযানের পূর্বে তৎকালীন ইংলন্ডেশ্বর রাজা জেমসের শরণাপন্ন  হয় কোম্পানী। কোম্পানীর অনুরোধে, রাজপরিষদের অন্যতম সদস্য, এমপি তথা দক্ষ কূটনীতিবিদ স্যার টমাস রো’কে রাজদূত হিসেবে ভারতে পাঠানো হয় দৌত্য করার জন্য। ইতিপূর্বে অ্যামাজন অভিযান ছাড়াও কিছুদিনের জন্য  কনস্ট্যান্টিনোপলে ইংলণ্ডের রাজদূত ছিলেন স্যার টমাস রো। 
১৬১৫খ্রীষ্টাব্দে আজমীরে পৌঁছান স্যার রো, সঙ্গে  উপঢৌকন হিসেবে নিয়ে আসেন ইংলিশ ম্যাস্টিফ এবং আইরিশ গ্রে হাউন্ডের মত শিকারী কুকুর, রাজকীয় ইংলিশ কোচ, বিলাতী বাদ্যযন্ত্র, কিছু বিখ্যাত ম্যানারিস্ট পেন্টিং আর অনেকগুলি ক্রেট ভর্তি রেড ওয়াইন। সুরার প্রতি জাহাঙ্গীরের দুর্বলতা তাঁর অজ্ঞাত ছিল না। 
ব্যক্তি হিসেবে বাদশাহ জাহাঙ্গীর ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ এবং সংবেদনশীল। বংশগরিমা সম্পর্কে অতিসচেতনতা সত্ত্বেও অন্যান্য দেশ এবং সেখানকার জীবনধারা সম্পর্কে তাঁর ছিল অপরিসীম ঔৎসুক্য। দেশবিদেশের মূল্যবান সম্পদ সংগ্রহ করার নেশা ছিল তাঁর। ভেনিশিয়ান সোর্ড থেকে পারস্যের স্যাফাভিড রেশম, জেড পাথরের নুড়ি থেকে নারওয়াল তিমির দাঁত কি না ছিল, তাঁর সংগ্রহে। জীবজন্তুর কৃত্রিম প্রজননএবং প্রতিপালনে বেশ উৎসাহী ছিলেন জাহাঙ্গীর। উৎসাহী ছিলেন চিকিৎসা শাস্ত্র এবং জ্যোতির্বিদ্যায়ও। উৎসাহ ছিল না কেবল ব্যবসাবাণিজ্যে। 
বেশ কয়েকমাস ধরে চলা আলাপচারিতার ফাঁকে ফাঁকে স্যার রো যতবার কথা ঘোরাবার চেষ্টা করতেন বাণিজ্য, কূটনীতি, ফরমান বা সুরাটে ইংলিশ ফ্যাক্টরী স্থাপনের অনুমতি বা ভারতে ইংলিশ বণিকদের সুরক্ষা তথা ইংলণ্ডের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ বাণিজ্যিক সম্পর্কের দিকে, ততোবারই ‘ওসব কেজো কথা পরে হবে’, বলে থামিয়ে দিতেন বাদশাহ। উল্টে বরং তিনি প্রশ্ন জুড়তেন ভারত থেকে ইংলণ্ডের দূরত্ব কত, জানতে চাইতেন সেই কুয়াশা ঢাকা ছোট্ট দ্বীপের কথা, যেখান থেকে এসেছেন স্যার রো। সেখানকার জীবনশৈলী, শিল্প-কৃষ্টি- সংস্কৃতি।”

“ক্ষেত্র বিশেষে বেশ কড়া সুরে মুঘল আমলের সমালোচনা করেছেন স্যার রো, লিখে গেছেন, ‘ধর্ম অনেক, কিন্তু আইনকানুন শূন্য।’ এতদসত্ত্বেও ভারতের ঐশ্বর্য আর বৈভবে বারংবার ধাঁধিয়ে গেছে তাঁর চোখ। ১৬১৬ সালে বাদশাহের জন্মদিনের উৎসবে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর, মাণ্ডু থেকে তৎকালীন যুবরাজ(পরবর্তী রাজা) প্রথম চার্লসকে লেখা পত্রের ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে ভারতের অবিশ্বাস্য বৈভবের ছবি।
জন্মদিনের মূল উৎসবটা হয়েছিল এক অপরূপ সুন্দর বাগিচায়। জলের মাঝে বিশাল চৌকনা বাগান। বাগানের চতুর্দিকে ঘন সবুজ গাছপালা, গাছে গাছে ফুটে আছে রঙবেরঙের ফুল। বাগানের মাঝখানে একটা উঁচু বেদীর ওপর রাখা সোনার তুলাযন্ত্র। যাতে রাখা হবে সম্রাটের সমান ওজনের মণিমুক্তা। ‘বেদীকে ঘিরে পেতে রাখা কার্পেটে বসে সম্রাটের প্রতীক্ষা করছিলেন সব আমির ওমরাহরা। অবশেষে এলেন সুলতান। সুলতান আদৌ পোশাক পরেছেন নাকি শুধুই হীরা-চুনি-পান্না আর মুক্তায় ঢেকে নিয়েছেন নিজেকে বুঝতে পারলাম না।অলংকারের দ্যুতিতে ধাঁধিয়ে গেল চোখ। ওণার মাথা, গলা,বুক, কনুই অবধি বাহু, কব্জি থেকে হাতের আঙুল সবই অলঙ্কারে ঢাকা। প্রতিটি আঙুলে কম করে দুই থেকে তিনটি রত্নাঙ্গুরীয়। এত বড় হীরে, চুনি বা মুক্তা সচরাচর দেখা যায় না। চুনীগুলি আকারে আখরোট বা তার থেকেও বড় আর মুক্তাগুলি প্রায় আমার চোখের সমান। সারা বিশ্বের সমস্ত মণিমুক্তা যেন এসে জমা হয়েছে ওণার রত্নভাণ্ডারে।’ 
মুঘলদের অন্যদিকে ইংলন্ড সম্পর্কে সামান্য কৌতুহল ছাড়া কোন মুগ্ধতা ছিল না। স্যার রো বুঝতে সময় লাগেনি যে ইংলন্ডের সাথে কোন রকম সম্পর্ক স্থাপনে ছিটেফোঁটাও উৎসাহ নেই মুঘলদের। রাজদূত হিসেবে মোটেই তেমন খাতিরযত্ন পাননি তিনি, সপার্ষদ রাজদূতকে থাকার জন্য কারবাঁ সরাইতে বরাদ্ধ হয় মাত্রই চারটে কামরা। স্যার রো তাঁর পত্রে লিখেছেন, ঘরগুলির আয়তন, ‘কোনমতেই আভেনের থেকে বড় নয়। ঘরের ছাতটা গোলাকার, দরজা না খুলে রাখলে কোন আলো ঢোকে না। মাত্র দুটো জুড়িগাড়ির মাল ঢোকাতেই সব ঘর ভর্তি হয়ে যায়।’” 

“তিন বছর সময় লাগে, শেষ পর্যন্ত অবশ্য বাদশাহের ফরমান নিয়েই দেশে ফিরে যান স্যার টমাস রো।”

অ্যানার্কি
#চেনা_ইতিহাস_অচেনা_সুর #১১
“ভারতে ইংরেজদের প্রথম ঔপনিবেশিক শহর, মাদ্রাজ। সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে গড়ে ওঠা এই শহরের জনসংখ্যা ছিল প্রায় চল্লিশ হাজার,ছিল নিজস্ব প্রশাসন ব্যবস্থা, পৌরসভা। এমনকি ছিল নিজস্ব স্বর্ণমুদ্রাও।”
“ভারতে কোম্পানীর দ্বিতীয় বড় উপনিবেশটি পর্তুগালের রাজপরিবারের তরফ থেকে বিবাহসূত্রে যৌতুক হিসেবে পাওয়া। ১৬৬১খ্রীঃ পর্তুগালের রাজকন্যা ক্যাথরিন ব্রাগাঞ্জা, ইংলণ্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের ঘরণী হিসেবে আসার সময় যৌতুক হিসেবে নিয়ে আসেন  মরক্কোর ট্যানজিয়ার বন্দর আর “Islands of Bumbye”। রাজকন্যার বিয়ের কনট্র্যাক্টের সাথে যে ম্যাপে এই Islands of Bumbye এর অবস্থান নির্দেশিত ছিল, তা পর্তুগাল থেকে লণ্ডন আসার পথে কোনভাবে হারিয়ে যায়, ফলে Bumbye কোথায়, এই নিয়ে ইংলণ্ডে তৈরী হয় ব্যাপক ধোঁয়াশা। অনেকের ধারণা হয়  Bumbye নির্ঘাত ব্রাজিলের কাছাকাছি কোন অজানা দ্বীপ। 
এই জট কাটতে লেগে যায় বেশ কিছুদিন, তারপরও দ্বীপের দখল পেতে লাগে আরো অনেকদিন। বম্বের পর্তুগীজ গর্ভনর দ্বীপ হস্তান্তরের কোন নির্দেশ পাননি, ফলে স্বাভাবিক ভাবেই দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে রাজি হননি। ১৬৬২খ্রীঃ যখন স্যার আব্রাহাম শিপম্যান সদলবলে গিয়ে উপস্থিত হন দ্বীপের দখল নিতে, বন্দুকের ডগায় তাদের হটিয়ে দেওয়া হয়। ৪৫০লোক নিয়ে স্যার শিপম্যান নোঙর করতে বাধ্য হন,সুদূর দক্ষিণের এক ঊষর দ্বীপে। দ্বীপের দখল পেতে ইংলণ্ডের লেগে যায় আরও তিনবছর, ততোদিনে অবশ্য তীব্র গরম আর হিটস্ট্রোকে মারা গেছেন স্যার শিপম্যান। কেবল একজন ছাড়া মারা গেছে তাঁর সমস্ত অফিসার। ১৬৬৫ খ্রীষ্টাব্দে, দ্বীপের দখল নেবার জন্য শিপম্যানের সেক্রেটারি যখন বম্বেতে পদার্পণ করে, তার সঙ্গী বলতে অবশিষ্ট ছিল কেবল ১জন পতাকাধারী, দুজন গোলান্দাজ সেপাই আর ১১১ জন অধঃস্তন কর্মচারী। 
শুরুটা গোলমেলে হলেও অবিশ্বাস্য দ্রুততায় দক্ষিণ এশিয়ার সেরা বন্দর হিসেবে গড়ে ওঠে বম্বে। অচীরেই সুরাটকে পিছনে ফেলে এশিয়ায় কোম্পানীর সবথেকে বড় ঘাঁটি হয়ে ওঠে বম্বে। সুরাটের জনগন অবশ্য ততোদিনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে উচ্ছৃঙ্খল ইংরেজদের অত্যাচারে। কোম্পানী জনৈক কর্মচারীর  লেখা থেকে জানা যায়, “সুরাটের মানুষ ইংরেজদের ওপর বীতশ্রদ্ধ। আমাদের দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয়, রাস্তাঘাটে আমাদের দেখলে গালিগালাজ করে। আর এর জন্য দায়ী, আমাদেরই অপরিসীম বেশ্যাপ্রীতি,মাতলামো আর দাঙ্গাবাজী।এরা পয়সা দিয়ে খাস বেশ্যা পোষে, তারপরও সময়-অসময়ে বেশ্যালয় আর সুঁড়িখানায় গিয়ে হল্লা আর ভাঙচুর করে বেড়ায়-। সুরাটের লোকজন রাস্তাঘাটে ইংরেজ দেখলেই Ban-chude- আর Betty-chude- বলে খিস্তি মারে।' ”

No comments:

Post a Comment