Saturday 4 June 2016

সরিতা ভাবী (part-2)



এক সপ্তাহ স্কুল গেল না শম্পা। পরের রবিবার, সাজো সাজো রব পড়ে গেল, গোটা বাড়িতে। কারা যেন শম্পাকে দেখতে আসবে। বাইরের ঘরে, পেতে রাখা ফরাশে, নতুন ধপধপে চাদর পাতা হল। তেলচিটে তাকিয়া গুলোকে, ওয়াড় খুলে ভালো করে রোদ খাওয়ানো হল। কাকা রিণ্টি আর সিন্নিকে নিয়ে, উঠোনের শ্যাওলা সাফ করতে লাগল। কাকিমা তার কয়েক মাসের সদ্যজাত পুত্রকে কোলে নিয়ে, আলমারি থেকে বিয়েতে পাওয়া মূল্যবান কাঁচের প্লেট, গ্লাস, চামচ, বোন চায়নার কাপ-ডিস বার করতে লাগল। শম্পার হারমোনিয়ামটাকে ঝেরে-ঝুড়ে নামিয়ে এনে বাইরের ঘরের মাটিতে শতরঞ্চি পেতে বসানো হল। মূল্যবান চা পাতা, বিস্কুট, মিষ্টি আনা হল।বিকাল বেলায় তাঁরা এলেন, বেশ কয়েকজন সম্ভ্রান্তদর্শন পুরুষ এবং মহিলা, সঙ্গে একটি বাচ্ছা ছেলেও ছিল। রিণ্টির বাবা এবং কাকা খাতির করে এনে বসালেন পেতে রাখা ফরাশের ওপর। মেজদাদু এসে করজোড়ে নমস্কার জানিয়ে পাশে রাখা আরাম কেদারায় বসলেন, রিণ্টি এবং সিন্নি, যে যার মার রক্ত চক্ষু অগ্রাহ্য করে হারমোনিয়ামের দুপাশে গুটিগুটি গিয়ে বসল। বড়রা গল্পই করে যাচ্ছে, একি রে বাবা, রিন্টি আর সিন্নি যাত্রা দেখার উত্তেজনা নিয়ে জুলজুল করে তাকাচ্ছে, পাত্রপক্ষের সাথে আসা বাচ্ছা ছেলেটা পর্যায়ক্রমে একবার রিন্টি আর একবার সিন্নিকে মুখ ভ্যাঙাচ্ছে। বিরক্তি চরমে ওঠার ঠিক মুখোমুখি, কাকিমা শম্পাকে নিয়ে ঢুকলেন। পড়ন্ত সূর্যের কনে দেখা আলোয়, ড্যাম্প ধরা হাল্কা সব্জে রঙের চুনকাম করা ঘরটা যেন ঝলমলিয়ে উঠল। কাকিমাই সাজিয়ে দিয়েছে, একটা কাঁচা হলুদ রঙের তাঁতের শাড়ি, কানে দুটো ছোট সোনার ঝুমকো, দু হাতে দুই-দুই করে চারগাছা সোনার চুড়ি, চোখে হাল্কা কাজল, আর কপালে কুমকুমের ছোট্ট টিপ। পায়ের নুপুরে মৃদু রিনিরিনি আওয়াজ করে ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়াল শম্পা। দু-হাত জোড়া করে নীরবে নমস্কার জানিয়ে, মাটিতে পেতে রাখা শতরঞ্চিতে বসতে যাবে, ওনারা হাঁহাঁ করে উঠলেন, ওনাদের পাশে গিয়ে বসল শম্পা। মাথা নিচু করে সব প্রশ্নের জবাব দিল, প্রশ্নোত্তর পর্বের অন্তে মেজদাদুর ছদ্ম অনুরোধে গান ধরল শম্পা, “গোধূলি গগনে মেঘে, ঢেকেছিল তারা----।” রিন্টির বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে উঠল, ওঁরা নিয়ে চলে যাবে ওর দিদিকে? মনের গভীরে রিন্টি বারংবার প্রার্থনা করছিল, “হে মা দুর্গা, হে বাবা পঞ্চানন, হে নারায়ন, দোহাই, দিদিকে যেন ওঁরা নাপসন্দ- নাকচ করে দেয়।” যদিও বেশ ভালই বুঝেছিল, যে তা অসম্ভব।
ওরা চলে গেলেন। জানিয়ে গেলেন, দু একদিনের মধ্যেই খবর পাঠাবেন। শম্পাও আবার স্কুল যাওয়া শুরু করল। ওঁরা সত্যিই খবর পাঠিয়েছিল, শম্পাকে ওদের খুব পছন্দ। কিন্তু বয়সটা বড়ই অল্প, তাই ওঁরা অপারগ। জেঠিমা যখন রিন্টির মাকে কথাটা বলছিল, ওর মা তখন রান্নাঘরে রুটি বেলছিল, আর জেঠিমা সেঁকছিল, ভাগ্যক্রমে সেই সময় রিন্টি ঘুম পেয়েছে বলে মায়ের কোলে মাথা দিয়ে শুয়েছিল । পরের রবিবার আবার একদল দেখতে এল, আগের বারের মত না হলেও এবারেও যথেষ্ট আয়োজন করা হল। এদের খুব পছন্দ হয়ে গেল শম্পাকে। ওনারা জানালেন, বিয়ে পাকা হয়ে যাক, কিন্তু শম্পা বড়ই ছোট। সবে দশম শ্রেণীতে উঠেছে, স্কুল ফাইনাল এবং উচ্চ মাধ্যমিকটা অন্তত পাশ করুক। কলেজে উঠলে বিয়েতে ওনাদের কোন আপত্তি নেই। এবারের সম্পর্কটা এরাই বাতিল করে দিল। অতদিন অপেক্ষা করতে নারাজ জেঠিমা। পরের পরের রবিবার আর একদল দেখতে এলেন। এঁরা অত্যন্ত ধনাঢ্য, দেখেই বোঝা গেল। নাকি শোভাবাজারের অত্যন্ত বনেদী পরিবার। ধপধপে সাদা কন্টেসা গাড়ি চেপে ওঁরা এলেন, অল্প দুচার কথায় সম্পর্ক পাকা হয়ে গেল, পাত্র সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। শম্পার থেকে বয়সে একটু বড়, তা হোক ঠাকুমা বলল, “সোনার আংটি আবার বেঁকা।” শম্পার হবু শাশুড়ি, জেঠিমার দুহাত জড়িয়ে বলে গেলেন, “কিচ্ছু চিন্তা করবেন না। ও আমাদের মেয়ের মত থাকবে। আমরাই পড়াব।” গিনির মালা দিয়ে আশীর্বাদ করে গেলেন শম্পার হবু শ্বশুর।
দেড় মাসের মাথায়, বিয়ে হয়ে গেল শম্পার। তড়িঘড়ি আয়োজন করতে গিয়ে অনেক গুলো ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙতে হল জেঠুকে। অনেক টাকার সুদ মারা গেল। সঞ্চয়িতা চিট ফান্ডে টাকা রেখে ইতিমধ্যেই একবার বিরাট লোকসান হয়েছিল ওনার, সেই চোট সারার আগেই এত গুলো টাকা হারিয়ে তথা ধনী বেয়াই বাড়ির সাথে সৌহার্দমূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে বেপোট প্রেশার- সুগার বাড়িয়ে ফেলল জেঠু। নির্বিঘ্নে বিয়ে করে হাসতে হাসতে শ্বশুর বাড়ি চলে গেল শম্পা, যাবার সময় এক ফোঁটা কাঁদলও না। সবাই হাউ হাউ করে কাঁদছিল, মেজদাদু, বড়মা, ঠাকুমা, মেজ ঠাম্মা, জেঠু, জেঠিমা, রিন্টির মা, রিন্টি, সিন্নি সবাই। কাকা বা রিন্টির বাবার চোখও ছলছল করছিল। রিন্টির মা একবার বলেই ফেলল, “শম্পা তুই শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছিস। সেই শোভাবাজার। চাইলেও আর আমাদের দেখতে পাবি না। তোর কি কোন কষ্ট হচ্ছে না? একটু তো কাঁদ?” কি অসহায় বোকা বোকা ভাবে তাকাচ্ছিল শম্পা, রিন্টি বেশ বুঝতে পারছিল, হাজার চেষ্টা করেও কাঁদতে পারছে না শম্পা।নীরব বোবা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল, খাঁচায় বন্দী পাখির মত। শুধু বরের গাড়ি যখন ছেড়ে যাচ্ছে, জেঠুর হাতটা জড়িয়ে একবার ডুকরে কেঁদে উঠল, জেঠু ওর মাথায় হাতটা রাখতে গেল, তার আগেই হুস করে বরের গাড়ি এগিয়ে গেছে অনেকটা। ফুল দিয়ে সাজানো সেই সাদা কন্টেসা--।
শম্পা চলে যাবার বছর দেড়েকের মাথায় বড়মাও চলে গেল। সেই কোন তরুণী বয়সে, অকাল বিধবা বড়মা তার দুই নাবালিকা কন্যার হাত ধরে বাপের বাড়ি এসে উঠেছিলেন তা আজ আর কারো মনে নেই। বড়মার দুই মেয়েই রিন্টির জেঠুর থেকে বড়, এ বাড়ি থেকেই তাদের বিয়ে হয়েছে, এবং উভয়ই অত্যন্ত ধনী তথা সমৃদ্ধশালী পরিবারের পুত্রবধূ। তা সত্ত্বেও বড়মা যে কেন তার বাপের ভিটেতে পড়ে থাকত, তা কেউ জানত না। মা, জেঠিমা আর কাকিমা সুযোগ পেলেই মৃদু অভিযোগ করত, যে বড়মার মেয়েরা মায়ের বিন্দুমাত্র খোঁজ খবর রাখে না। বড়মার অবশ্য বিন্দুমাত্র হেলদোল ছিল না। এ বাড়ির প্রতিটা শিশু বড়মার নিজের হাতে মানুষ, রিন্টি, সিন্নি মায় সিন্নির পুঁচকে ভাই নন্তু যখন হল, আঁতুড়ের সব কাজ একা হাতে বড়মা করেছে। সকাল থেকে বড়মা রান্না ঘরে গিয়ে ঢুকত, সবাই অফিস কাছারি বেরিয়ে গেলে ঠাকুমা-মেজ দাদু- মেজ ঠাম্মা আর বড়মা বেলা বারোটায় জল খাবার খেত। কি সাধারণ ছিল সেই জলখাবার, একটু ডাল, হাতে গড়া রুটি আর একটু চিনি না হলে ভেলি গুড়। সারাদিন যে যা বলত ছুটে ছুটে সেই ফরমায়েশ পালন করত বড়মা। বাবা বা কাকা চা করতে বললে কি খুশিই যে হত। বিকাল চারটের আগে ভাত খেত না। চারটের সময়, ভাত, ডাল, একটু নিরামিষ তরকারি আর অম্বল, এই ছিল নিত্যনৈমিত্তিক আহার। কত রকমের যে অম্বল রাঁধতে জানত বড়মা। কুমড়ো, ঢ্যাঁড়শ, বেগুন, বড়ি দিয়ে, কাঁচা তেঁতুল দিয়ে, শীত কালে মুলো দিয়ে, টমেটো দিয়ে কি অসাধারণ অম্বল রাঁধত বড়মা। কিছু না পেলে পাকা তেঁতুল গুলে চিনি দিয়ে টক। বিকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে, বড়মার পাতে অম্বল দিয়ে মাখানো এক গাল ভাতের স্বাদ বোধহয় জীবনেও রিন্টির মুখ থেকে যাবে না।
সন্ধ্যে বেলা, পড়ার জন্য যে যার মায়ের হাতে ঠ্যাঙানি খেয়ে, কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে বড়মার কোলে আশ্রয় নিত রিন্টি আর সিন্নি। গ্রীষ্ম কালে উঠোনে পেতে রাখা চৌকিতে, বড়মার দুপাশে দুই বোনে শুয়ে শুয়ে গল্প শুনত, আর শীত কালে, খাটে লেপের তলায় শুয়ে।রামায়ণ, মহাভারত থেকে রাজা-রাণী- রাজপুত্র-রাজকন্যা- রাক্ষস- খোক্কশ-ব্যাঙ্গমাব্যাঙ্গমীর সাথে পরিচয় তো বড়মার মাধ্যমেই। এমনকি ইতিহাসের সাথে প্রাথমিক পরিচয়ও বড়মার হাত ধরে। অ্যালেকজান্ডার- পুরু, চন্দ্রগুপ্ত- কৌটিল্য, চণ্ডাশোক- ধর্মাশোক হয়ে বাদশাহ আকবর, হতভাগ্য শাহ জাহান, নিষ্ঠুর ঔরংজেব, বর্গীদের আক্রমণ, সিপাহী বিদ্রোহ, হয়ে ভারত ছাড় আন্দোলন কিছুই বাদ দিত না বড়মা। গল্পের সাথে সাথে নাটকীয় ভাবে উঠত নামত বড়মার কণ্ঠস্বর, কখনও ভয়ে কুঁকড়ে যেত দুই বোন, কখনও আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠত। গল্প বলতে বলতে বড়মা যার দিকে ফিরে শুত, অন্যজন সঙ্গে সঙ্গে বড়মার মুখটা টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিত। এই নিয়ে প্রায়ই মারামারি লেগে যেত ওদের। সেই বড়মা যে এত তাড়াতাড়ি ওদের ছেড়ে চলে যাবে রিন্টি স্বপ্নেও ভাবেনি। কেন যে ভালবাসার মানুষ গুলো এত দ্রুত হারিয়ে যায়?
#AninditasBlog

https://www.facebook.com/amianindita.blogspt.in/
 

No comments:

Post a Comment