সরিতা ভাবীর সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার দিনটা রিন্টি আজো ভোলেনি। তখনও অবশ্য সরিতা ‘ভাবী’ হয়নি। সবাই ওকে পানওয়ালার মেয়ে বা পাঁড়েজীর কন্যা বলেই চিনত। সেটা আশির দশকের প্রথমার্ধ। রিন্টির জীবনের সবথেকে সুন্দর সময়। আজ বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে দাঁড়িয়ে মনে হয় সেই সময়টা যেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা কোন গল্প ছিল। মধ্য হাওড়ায় নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি বা ফ্ল্যাটবাড়ি তখন নেহাতই দুর্লভ। রিন্টিদের ছিল বিশাল যৌথ পরিবার। ঠাকুমা, তাঁর তিন ছেলে, তিন পুত্রবধূ, তিন নাতনী এছাড়াও নিঃসন্তান মেজ দাদু আর মেজ ঠাম্মা, আর ছিল বিধবা বড়মা অর্থাৎ রিন্টির বাবার বড় পিসিমা। এছাড়াও ছিল দুজন পরিচারিকা, স্বামী পরিত্যক্তা জ্যোতিদি আর অনাথা টেঁপিদি।
তখন রবিবার মানেই জল খাবারে আটার লুচি, আলু চচ্চড়ি আর আখের গুড়। রবিবার মানেই দুপুরে খাসির মাংস, অবশ্য মাসের শেষ রবিবার বাদে। মুরগী ঢুকতই না অধিকাংশ হেঁসেলেই। রেডিও মানেই কলকাতা ‘ক’ আর বিবিধভারতী। গোটা মহল্লায় কারো বাড়িতে টেলিফোন ছিল না। রিন্টির বাবা-কাকারা অফিস কামাই করলে সেই বড় রাস্তা টপকে পাশের পাড়ার পুনু পিসিমার বাড়ি যেত একটা ফোন করে অফিসে খবর দিতে। একটা কল করতে কত টাকা লাগে কোন ধারণা ছিল না রিন্টির, তবে , না কোনদিন বাবা-কাকা টাকা দিয়েছে, না কোনদিন পুনু পিসি তাদের ফোন ব্যবহার করা নিয়ে কোন ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। বরং কেউ এলে তাঁর সাথে গল্প করতে পেলে বেঁচে যেত পুনু পিসি। ফোন শেষ হতে না হতেই দু কাপ চা আর মেরি বিস্কুট নিয়ে হাজির হয়ে যেত পুনু পিসি। আর রিন্টির জন্য বরাদ্দ ছিল দুটো মোড়ের মাথার গুপ্তর দোকানের রসগোল্লা। তখনও বাচ্চারা চা খেত না। কম করে আধঘণ্টা বকবক করে তারপর ছাড়ত। কাকা প্রত্যেক বার পুনু পিসির বাড়ি থেকে বেরিয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলত, “উফঃ। এই শেষ আর আসছি না এই গপ্পে বুড়ির কাছে। বছর ঘুরে গেল অ্যাপ্লাই করেছি, আজও আমাদের টেলিফোন এল না।”
তখন কেবল রিন্টিদের বাড়িতেই টিভি ছিল। বিরাট বড় শাটার টানা টেলেরামা টিভি, একটাই চ্যানেল আসত, “দূরদর্শন”। আজো মনে পড়ে বুধবার হিন্দি গানের চিত্রহার, বৃহস্পতি বার বাংলা গানের চিত্রমালা, শনিবার সন্ধ্যায় বাংলা, রবিবার দুপুরে আঞ্চলিক ভাষার চলচিত্র আর রাতে হিন্দি ছায়াছবি। পাড়ার কুচোকাঁচা আর মেয়ে বউদের ভিড় লেগে যেত।আর খেলা থাকলে ছেলেবুড়ো দের। সেটা ছিল টেস্টের যুগ। যদি ইন্ডিয়া-পাক বা ইন্ডিয়া-ওয়েস্টইন্ডিজ এর টেস্ট থাকত, তো রিন্টির বড় জেঠু অফিসে ডুব মেরে সারাদিন টিভি চালিয়ে বসে থাকত। আর মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ থাকলে তো কথাই নেই। গোটা মহল্লায় অঘোষিত কার্ফু কেবল রিন্টিদের টিভির ঘর ছাড়া। মোহনবাগান গোল দিলেই সেদিনের পুঁচকে ছেলে গুলো নাচতে শুরু করে দিত। “গো—ও-ও-ল” বলে চিৎকার বোধহয় শোনা যেত এক মাইল দূর থেকেও । মাঝে মাঝেই এত শোরগোল হত, যে ঠাকুমা রেগে গিয়ে গৃহত্যাগের হুমকি দিত। তবে সব উত্তেজনায় জল ঢেলে দিত, “রুকাবট কে লিয়ে খেদ হ্যাঁয়” বা “অনুষ্ঠান প্রচারে বিঘ্ন ঘটায় আমরা দুঃখিত।” সবার ওপরে ছিল কাকের উৎপাত বা বেমক্কা ঝড়ে অ্যান্টেনা ঘুরে যাওয়া। কাকা বাড়িতে থাকলে কাকাই দৌড়ত নাহলে পাশের বাড়ির বুকাই দাদা একটা পুরানো ঝুলঝাড়া নিয়ে দৌড়ত। আর ছিল লোড শেডিং। কি লোড শেডিং হত বাপরে বাপ। কখনও কখনও সারা রাত কারেন্ট আসত না। গোটা মহল্লায় শুধু একটা বাড়িতে এসি কারেন্ট ছিল, বাকি সকলেরই ডিসি। সামান্য ঝড় হত আর তার ছিঁড়ে যেত। আলো চলে গেলেই রিন্টি আর ওর জেঠতুতো দিদি শম্পা দৌড়ত, দোতলার বারন্দা থেকে উকি মেরে দেখার জন্য যে কার কার বাড়িতে কারেন্ট গেল। যদি কারো না থাকে তাহলে শান্তি, নাহলে রিন্টির বাবা এত বড় পাঁচ সেলের টর্চ নিয়ে দেখতে যেত, মিটার বক্সের ফিউজ উড়ে গেল কিনা। এসি কারেন্ট ওলা বাড়িতে লোডশেডিং প্রায় হতই না। রিন্টির জেঠিমা তাই রেগে গজগজ করত, “এসি টা হল বড়লোকের কারেন্ট। তাই ওদের আলো যায় না।”
তখনও পাড়ার ছেলে ছোকরারা গুরুজনের সামনে সিগারেট খেত না। পাড়াতেই ছিল পাঁড়েজির পান বিড়ী সিগারেটের দোকান, কিন্তু কাকা সিগারেট কিনতে যেত, বড় রাস্তা পেরিয়ে পাশের পাড়ার ভোলার দোকানে। লুকিয়ে ক্লাব ঘরে বা ছাতে গিয়ে ফুঁকত। জেঠু আর মেজদাদুর সামনে দিয়ে একা একা সিগারেট কিনতে যেতে সাহস হত না, তাই খুব প্রয়োজন হলে রিন্টি আর ওর খুড়তুতো বোন সিন্নিকে বেড়াতে নিয়ে যাবার ছুতো করে বেরত। সেদিনও তাই হয়েছিল। রিন্টি তখন তিন আর সিন্নি এক বছরের। এক হাতে রিন্টির হাত ধরে আর কোলে সিন্নিকে নিয়ে কাকা গিয়েছিল সিগারেট কিনতে। মোড়ের মাথায় পৌঁছে দেখে একটা বছর এগার-বারোর মেয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে হাপুস নয়নে কাঁদছে। কাকা জিজ্ঞেস করল, “এই তুই পান- ইয়ে মানে পাঁড়েজির মেয়ে না? কি যেন নাম?” মেয়েটা ফোঁপাতে ফোঁপাতে মাথা নাড়ল, “সরিতা”। পরনে সাদা ফ্রক, লাল বেল্ট, মাথার চুল লাল ফিতে দিয়ে কলা বিনুনি করা, পিঠে হলুদ রঙের স্কুল ব্যাগ। বেশ লম্বা এবং ততোধিক মোটা। ব্যাঙের মত মুখ আর অস্বাভাবিক মোটা এক জোড়া ঠোঁট। বেশ কুদর্শন, ক্রন্দনরতা বলে আরও কদাকার লাগছিল। কাকা আবার জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন? আজ পরীক্ষা বুঝি? আর তুই নির্ঘাত কিছু পড়িসনি?” মেয়ে সজল চোখে বলল, “না। রোজ মা স্কুলে দিতে যায়। আজ বাড়িতে কুটুম এসেছে তাই আমায় একা ছেড়ে দিয়েছে।” কাকা ভ্যাবলার মত বলল, “তো কি হয়েছে? স্কুল চিনিস না? কোন স্কুল?” মেয়েটি ফোঁপাতে ফোঁপাতে জানাল, “তারাসুন্দরী। আমি চিনি তবে রাস্তা পেরোতে পারছি না।” কাকা সস্নেহে হেসে বলল, “ অঃ। এই ব্যাপার। কি ভন্দু মেয়ে রে। রাস্তা পেরোতে পারছে না বলে কাঁদছিস? আয় আমাদের সাথে। তুই রিন্টির হাত ধর।”
এর পরে মাঝে মাঝেই দেখা হত রাস্তায় ঘাটে, হাটে-বাজারে, দোকান-পাটে, পাড়ার পুজোর প্যান্ডেলে, ছুটির সময় স্কুলের গেটে চেনা-অচেনা মানুষের ভিড়ে, কোন টাই মনে রাখার মত নয়। মুঠোয় ধরে রাখা বালির মত দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছিল আশির দশক। পাল্টে যাচ্ছিল চেনা শহর। একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, বড় বড় কলকারখানা। মেটাল বক্স, কেশোরাম কটন মিলস, বেঙ্গল ল্যাম্প, সুলেখা ওয়ার্কস, গেস্কিন উইলিয়ামসের মত বড় বড় কলকারখানার সাথে সাথে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল অজস্র ছোট ছোট কারখানা। উচ্চ-মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত থেকে রাতারাতি খুব গরীব হয়ে পড়ছিল লোকজন। যেমন ওদের পাড়ারই হাসু কাকু বা তপন জেঠু, কিছুদিন আগেও চকচকে জামাপ্যান্ট পরে জার্মান সিলভারের টিফিন বক্স আর পানের ডিবে নিয়ে অফিস করতে যেত, এখন গলির মোড়ে বসে পেয়াজি ভাজে হাসু কাকু। আর তপন জেঠু, ডাঁটি ভাঙা চশমা সুতো দিয়ে বেঁধে বাড়ি বাড়ি কাগজ বিলি করে। রিন্টির বাবার অফিসেও কি সব যেন চলছে, মাইনে কমে গেছে বাবার। আগের মত বাবা আজকাল আর অত হাসিখুশি থাকে না। ঘরের দরজা বন্ধ করে দিনরাত ঝগড়া করে ওর বাবা-মা। স্বপ্নময় জীবনটা যেন কি রকম কষাটে হয়ে যাচ্ছিল।
এরই মাঝে হঠাৎ একদিন বিয়ে হয়ে শ্বশুর বাড়ি চলে গেল শম্পা। দুই জেঠতুতো খুড়তুতো বোনের মধ্যে বয়সের এতটাই তফাৎ ছিল যে ওরা কখনই একে অপরের বন্ধু হতে পারেনি। রিন্টি ছিল শম্পার মুগ্ধ অনুরাগিণী। সৌন্দর্য নিয়ে গোটা রায়চৌধুরী বাড়ি দুভাগে বিভক্ত ছিল, একদলের চোখে হেমা মালিনী ছিলেন দুনিয়ার সেরা রূপসী, অপর দল ছিল সায়রা বানুর অন্ধ ভক্ত। শ্রীদেবী তখনও জাতে ওঠেনি। কাকা বলত, “এই তোদের শ্রীদেবী? নাকি বিশ্রীদেবী?” যাই হোক কিন্তু রিন্টির চোখে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রূপসী ছিল শম্পা। শম্পা যখন স্কুল থেকে ফিরে, বিকালে গা ধুয়ে, এক ঢাল কালো চুল ফাঁপিয়ে একটা এলো খোঁপা বাঁধত, মুখে আলতো করে বুলিয়ে নিত পাউডারের পাফটা, চোখে দ্রুত ঘষে নিত কাজল, কপালে কুমকুমের টিপ, হাঁ করে তাকিয়ে থাকত রিন্টি। ডুবন্ত সূর্যের মায়াবী আলোয় কি যে অপরূপা দেখাত শম্পাকে, তা ভাষায় অপ্রকাশ্য। না গৌরী ছিল শম্পা, নাই কৃষ্ণ বর্ণা। ঠাকুমা বলত কাঁচ কাঁচ রঙ। লক্ষ্মী প্রতিমার ধাঁচে গোল মুখ, তাতে ঘন কৃষ্ণ এক জোড়া ভ্রুর নীচে, আঁখি পল্লবের ভারে অবনত টানাটানা দুটো চোখ, পাতলা সুউচ্চ নাক, নাকে এক কুচি হিরে সব সময় যেন জ্বলজ্বল করত। ভিজে ভিজে এক জোড়া ঠোঁট, ওপরের ঠোঁটটা যত পাতলা ছিল, নীচেরটা ততটাই মোটা ছিল, ঠিক যেন এক কোয়া কমলা লেবু। বিয়ে বাড়ি বা কোন অনুষ্ঠানে যখন লিপস্টিক লাগাত শম্পা, রিন্টির মনে হত, শম্পার রূপের বাহার যেন অনেকটাই কমে যেত। কি অপরূপ হাত-পায়ের গড়ন ছিল শম্পার, হাজার ধুলো ঘাঁটলেও কখনও মলিন হত না। শীতের সকালে যখন ফ্রকের ওপর পুরানো শাল জড়িয়ে পড়তে বসত শম্পা, নিজের পড়া ভুলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত রিন্টি। ছুটির দুপুর বেলা লুকিয়ে পুরানো সিনে অ্যাডভান্সের পাতা ওলটাতে ওলটাতে, বা টিভিতে চিত্রহার বা চিত্রমালা দেখতে দেখতে, শম্পা মাঝেমাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আয়নার দিকে তাকিয়ে বলত, “এরাও নাকি নায়িকা! হুঃ। তুই বল বোন, এদের থেকে আমায় ভাল দেখতে না?” শম্পা কি সত্যি ওর জবাবের প্রত্যাশা করত? পরে রিন্টির মনে হয়েছিল, ও গুলো আসলে ছিল স্বগতোক্তি। কিন্তু সাগ্রহে শম্পাকে সমর্থন জানাতে পেরে যেন বিগলিত হয়ে যেত রিন্টি। জেঠিমা বাড়িতে না থাকলে, মাঝে মাঝে লুকিয়ে সীমন্তে সিঁদুর ছোঁয়াত শম্পা, তারপর চোখ মটকে জিজ্ঞেস করত, “ আমায় কেমন দেখাচ্ছে রে?” কোন এক অলস মুহূর্তে আনমনে শম্পার গাওয়া, এক কলি, “নাম গুম জায়েগা-” সেই সব মুহূর্ত গুলো ছিল রিন্টির শৈশবের মণিমুক্তো।
শম্পার যে এই রকম রাতারাতি বিয়ে হয়ে যাবে তা বোধহয় কেউ ভাবেনি। শম্পা তখন সবে দশম শ্রেণীতে উঠেছে। চারটে দশে ছুটি হত। খুব রক্ষণশীল পরিবার ওদের, উঠতি যৌবনা মেয়েকে একা রাস্তায় ছাড়া হত না। জেঠিমা স্বয়ং দিতে এবং আনতে যেত, সেদিনও সাড়ে চারটে নাগাদ জেঠিমা এবং শম্পা ফিরেছিল। রিন্টির আজো স্পষ্ট মনে আছে, ওদের বাড়ি সেদিন এক নাগা সন্ন্যাসী এসেছিলেন। আদপে হয়তো ভিক্ষা চাইতেই এসেছিলেন, মেজ ঠাকুমার এই সন্ন্যাসীদের প্রতি ছিল অগাধ ভক্তি। কাউকে পেলেই হত, তাদের খাতির করে বসিয়ে, চা-জলখাবার খাইয়ে তুষ্ট করে ভবিষ্যৎ জানতে চাইতেন। নিঃসন্তান ঐ বয়সী রমণীর ভবিষ্যতের কাছে কি জিজ্ঞাস্য ছিল, তা কোনদিনই রিন্টি বোঝেনি। তবে মনে আছে, প্রায় প্রত্যেকেকেই অন্তে একই প্রশ্ন করতেন মেজ ঠাকুমা, “বাবা কবে মরব বলতে পার? মরার আগে পরের গলগ্রহ হয়ে থাকব না তো? আমার বরের আগে মরব না তো? একটু দেখ বাবা। বড্ড অসহায় ও।” বলতে বলতে প্রতিবার গলা বুজে যেত মেজ ঠাকুমার। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুলভাল জবাব দিত সাধুবাবারা, কেউ কেউ অবশ্য দয়াদ্র কণ্ঠে বলত, “জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ কি বলা যায় মা?” আবার কেউ কেউ ভারি পুজো-আচ্চা, হোম যজ্ঞের বিধান দিত। ঠাকুর, দেবতার নাম করে টাকা, পয়সা নিয়ে যেত। মেজ দাদু তাই এই সব সাধু বাবাদের দুচক্ষে দেখতে পারত না। কিন্তু অসহায়া বৃদ্ধ স্ত্রীকে মুখের ওপর নিষেধ করতেও পারতেন না।
সেদিনও এ রকমই এক সাধু বাবা এসেছিল, পড়ন্ত বিকালে ভিক্ষা চাইতে। উঠোনে পেতে রাখা চৌকিতে বসে, মেজ ঠাকুমার নানা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন বাবাজী। মৃত্যুর প্রসঙ্গে, হাত তুলে বলেই দিলেন, যে কে কবে মরবে তা বলতে পারার মত জ্ঞান ওনার নেই। তবে মেজ ঠাকুমার হাত দেখে এটুকু আশ্বস্ত করলেন, যে ওনার কপালে বৈধব্য যোগ আছে। বারংবার বলা সত্ত্বেও মেজদাদু হাত দেখাতে চাইল না। রিন্টি তখনও শিশু শ্রেণীতে পড়ে, মেজ ঠাকুমার সনির্বন্ধ অনুরোধেও সাধু বাবা রিন্টির হাত দেখতে চাইল না। বলেই দিলেন, “পনেরো ষোল বছরের আগে ওদের হাতের রেখাই তৈরি হয় না। ওদের বাবা-মায়ের হস্তরেখাই আপাততঃ ওদের ভাগ্য নির্ধারণ করবে।” রিন্টির মা, বড়মা, ঠাকুমা সকলে সারি দিয়ে হাত দেখাতে বসেছিলেন। কাকার সেদিন কলেজে অফ ডে ছিল, তাই বাড়িতেই ছিল, বাড়ির মেয়েরা এরকম সারি বদ্ধ ভাবে একজন অপরিচিত পুরুষকে হাত দেখাতে বসায়, কাকা বোধহয় ক্ষুব্ধ হয়ে কিছু বলেছিল, সাধু বাবা তখন বড়মার হাতটা দেখছিল।একটানে হাতটা সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বিশাল চেহারা, কোমর অবধি জটা নেমেচে, ভস্ম মাখা প্রায় উলঙ্গ শরীরে শুধু লজ্জা নিবারণের জন্য একটুকরো বিবর্ণ লালচে লেঙটি আর গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। রক্ত চক্ষু মেলে কাকার দিকে তাকিয়ে জলদগম্ভীর স্বরে ঠেঠ হিন্দিতে বলে উঠল, “ দুপাতা ইংরাজি পড়ে, বিরাট পণ্ডিত হয়ে গেছিস? প্রমাণ চাস, বেশ এই মেয়েটার পিঠে যে থলে আছে” বিশাল হাত বাড়িয়ে শম্পার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, “ ঐ থলে খুঁজলে একটা চিঠি পাবি।এক বিজাতীয় যুবকের লেখা প্রেম পত্র। আর এই আমি বলে যাচ্ছি, যদি আগামী তিনটে পূর্ণিমার মধ্যে এর বিয়ে না দিস, তো এই মেয়ে কুলত্যাগিনী হবে।”
মুহূর্তের বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠে, কাকা ব্যঙ্গ করে কিছু বলতে যাচ্ছিল, জেঠিমা তার আগেই ছিনিয়ে নিল, শম্পার ব্যাগ। পাগলের মত হাঁটকাতে লাগল, প্রতিটা বই, খাতা। কাকা উপহাস করে বারবার নিষেধ করছিল, পাত্তাও দিল না জেঠিমা। ঝাড়তে ঝাড়তে এক টুকরো কাগজ ঝরে পড়ল ওদের শান বাঁধান উঠোনে। শম্পা ঝুঁকে তুলতে যাবার আগেই বাঘের মত ছিনিয়ে নিল জেঠিমা। চিঠিতে কি লেখা ছিল, রিন্টি জানে না। চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে শম্পাকে টেনে নিয়ে গেল জেঠিমা। কি মার খেয়েছিল সেদিন শম্পা। শম্পা যতটা কেঁদেছিল প্রায় ততটাই কেঁদেছিল রিন্টি। ছোট ছোট হাতে গুমগুম করে কিল মারছিল জেঠিমাকে। কাকা পাগলের মত চ্যাঁচাচ্ছিল, ঠাকুমা, মেজ ঠাকুমা হাউমাউ জুড়ে দিয়েছিল। রিন্টির মা ওকে টানতে টানতে সরিয়ে নিয়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে রিন্টি শুধু শুনতে পাচ্ছিল শম্পার আর্ত চিৎকার, “বিশ্বাস কর মা, আমি চিনি না। আমিনা দিল। আমিনার দাদা হয়। আমি পড়িনি। আমিনা শুধু বলেছিল, চুপচাপ ব্যাগে রাখ। বাড়ি গিয়ে পড়ে, কাল জানাস।” আমিনা দি? আমিনা দি তো দিদির সাথে পড়ে, বহুবার ওদের বাড়ি এসেছে। দিদির সাথে রিন্টি, সিন্নিও গেছে ওদের বাড়ি। কাকা স্কুটারে চাপিয়ে দিয়ে আসত, আবার নিয়ে আসত। আমিনা দি এমন কি করল, যে জেঠিমা দিদিকে এত মারছে, তা সেদিন রিন্টির ছোট্ট মাথায় কিছুতেই ঢুকছিল না।
#AninditasBlog
Facebook Page - https://www.facebook.com/amianindita.blogspt.in/
(চলবে)
No comments:
Post a Comment