Tuesday, 7 June 2016

সরিতা ভাবী (part-3)


শম্পার বিয়েতে বড়মার দুই মেয়েই এসেছিল, বেশ কিছুদিন ছিলও, যাবার সময়, দুই পিসিমাই বড়মাকে নিজের বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলেও বড়মা গেল না। হেসেই উড়িয়ে দিল, “আমি তো দিব্যি আছি রে।আমার রিন্টি- সিন্নি আমায় ছাড়া থাকতে পারবে না। পুজোর সময় ওরা যখন মামার বাড়ি যাবে, তখন দু একদিনের জন্য নিয়ে যাস বরং।” বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বড়মার বড় জামাই, রিন্টি দের বালির পিসিমার বর মারা গেলেন। মেয়ের ঐ ঘোর দুর্দিনে কাঁদতে কাঁদতে বড়মাকে যেতেই হল, যাবার সময়, রিন্টিকে কথা দিয়ে গেল, কাজকর্ম মিটলেই চলে আসবে। শ্রাদ্ধশান্তি মিটলেও বালির পিসিমা ছাড়ল না বড়মাকে। সদ্য বিধবা কন্যাকে ফেলে বড়মাও আসতে পারল না। বালির পিসিমা অত্যন্ত ধনী, বাড়ির লাগোয়া নিজস্ব গঙ্গার ঘাট, ঘাটের লাগোয়া শিবমন্দির, বাড়ি ভর্তি পরিচারক- পরিচারিকা, খিদমৎ খাটার লোক। পিসিমা বোধহয় ভেবেছিলেন বড়মা শেষ জীবনটা গঙ্গাস্নান আর পুজোআচ্চা করে আরামে কাটবে। কিন্তু কাজের মানুষ তো, ও ভাবে শুয়ে বসে থাকতে বোধহয় একদম ভালো লাগত না। কাউকে না বলে, ভোর বেলায়, লুকিয়ে চা করতে গিয়েছিলেন, উনুনে নয় স্টোভে। ৭০% পোড়া অবস্থায় যখন পিজি হসপিটালে আনা হল, ডাক্তার বলেই দিলেন, জরুরীভিত্তিতে চিকিৎসা ওনারা করছেন বটে, তবে বড়মার বয়সে ঐ তীব্র দহনের জ্বালা সহ্য করা প্রায় অসম্ভব। সেদিন সকাল থেকেই মেঘলা ছিল, টিপিটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল, রিন্টির বাবা-মা, কাকা, জেঠু সবাই গিয়েছিল পিজি তে। মেজদাদু মাঝে মাঝে চোখ মুছছিল আর বলছিল, “ ও থাকতে চায়নি। কেন যে জোর করে আটকে দিল।” নিমতলা ঘাটে দাহ করে বাবাদের ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়েছিল সেদিন। বাড়ি ফিরেও মা গুনগুন করে কাঁদছিল, “আমরা যখন গেলাম, তখনও প্রাণ ছিল। কাঁচের বাইরে থেকে ঠিক আমায় চিনতে পারল। হাতের ইশারায় জিজ্ঞেস করল রিন্টি- সিন্নি কি করছে।” রিন্টি তখন আট, শুকনো চোখে অবাক হয়ে ভাবছিল, পিসেমশাই এর শ্রাদ্ধের দিনও বড়মা বলছিল, “একদম ভালো লাগছে না এখানে। দাঁড়া না কটা দিন যাক, এরা একটু সামলে নিলেই আমি চলে যাব।”
বড়মার মৃত্যুর কিছুদিন পর একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল, কাকা-কাকিমা আলাদা হয়ে গেল। তলায় তলায় দ্বন্দ্ব চলছিলই। এত বড় পরিবারে, কিছুটা খাদ্য কৃচ্ছতা থাকেই, রেশ্নের চালের ভাত, রেশ্নের গম ভাঙানো আটার রুটি, মাথা পিছু আধখানা ডিম, এক পিস মাছ তাও সপ্তাহে দুদিন, ছোট ছোট করে কাটা খাসির মাংস, জলজলে পায়েস ইত্যাদি। এই নিয়েই অশান্তি দানা বাঁধছিল। কাকা-কাকিমা দুজনেই কলেজে পড়ান, বেশ ভালো মাইনে পত্র পান, কেন তাদের সন্তানসন্ততি রোজ মাছ খাবে না? বিশেষ করে কাকিমার আপত্তি ছিল নন্তুকে র্যা শন দোকানের চালের ভাত খাওয়াতে। সিন্নির বেলায় কাকিমা আলাদা করে ভাত করে নিত, এবার আর পারবে না। হাঁড়ি আলাদা হয়ে গেল, একদিকে রিন্টির ঠাকুমা, মেজদাদু-মেজঠাম্মা, জেঠু- জেঠিমা, বাবা-মা আর রিন্টি। অন্যদিকে কাকা-কাকিমা-সিন্নি আর নন্তু। কাকাদের খাবার ঘরও আলাদা হয়ে গেল। ছুটির দিন হলে কাকারা কি খেল রিন্টিরা জানতেও পারত না। কিন্তু মুস্কিল হত, যেদিন কাকা-কাকিমা দুজনেই থাকত না। এক সাথে বড় দালানে খেতে বসত রিন্টি আর সিন্নি। রিন্টি দাল-পোস্ত ভাত আর সিন্নি মাছের ঝল-ভাত। তাতে সমস্যাটা কি হত সেটা রিন্টি বুঝত না। মা রোজ রাতে বাবাকে ফিসফিস করে শোনাত আজ কাকাদের কি রান্না হয়েছে, অথচ রিন্টির জন্য একটুও দেয়নি। কেন যে কাকিমা রিন্টির জন্য রাখবে, সেটাই তো রিন্টি বুঝে উঠতে পারত না। কাকিমা কোনদিনই রিন্টিকে পছন্দ করেনি। সিন্নি-নন্তুর জন্য আনা খেলনা তো দূরের কথা, সামান্য গল্পের বইটাও রিন্টিকে পড়তে দিত না। রিন্টি হ্যাংলার মত চাইত, তাও না। সিন্নির জন্য আনা আনন্দমেলা, চাঁদমামা গুলো একটু স্পর্শ করার জন্য রিন্টি হাঁকপাঁক করত, কিন্তু তাও হাত দেবার অনুমতি পেত না। কাকিমার সাফ বুলি, “বই আমি কাউকে দি না। কেউ বই ফেরত দেয় না।” আরে একই তো বাড়ি, একটা বই এ ঘর থেকে ও ঘর গেলে কি হারিয়ে যায়, কিন্তু কাকিমাকে কে বোঝাবে? রিন্টির চোখের সামনে পুরানো বই বেচে দেওয়া হত, তাও ওকে পড়তে দিত না কাকিমা। তবে জেঠুকে দিত। জেঠুর ঘরে লুকিয়ে বই পড়ত রিন্টি। একবার মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “মা, কাকিমা জেঠুকে শারদীয়া আনন্দমেলাটা পড়তে দিল, আমায় কেন দিল না মা? আমি ছিঁড়ে ফেলব বলে?” মা খুব স্বাভাবিক ভাবে জবাব দিয়েছিল, “না। আমরা গরীব বলে।” গরীব মানে কি? বাবার কারখানাটা অবশ্য বেশ কিছুদিন ধরে বন্ধ।বাড়িতে দিনরাত অশান্তি। বাবা-মায়ের ঝগড়া না কোনদিন হাতাহাতির রূপ নেয় রিন্টি সেই ভয়েই আছে।বাবা পাগলের মত টিউশনি খুঁজছে আর মা, গলার বার মাস পড়ার হারটা বেচে একটা সেলাই মেশিন কিনেছে, অবসর সময়ে মেজ ঠাকুমার কাছে শায়া-ব্লাউস, জামা বানানো শিখছে।
বিয়ের পর শম্পাও যেন কেমন বদলে গেছে। ইতিমধ্যে বরের সাথে কিছুদিনের জন্য দামস্কাস আর ডোহায় কাটিয়ে এসে যেন বড়ই উন্নাসিক হয়ে উঠেছে। ওদের পুরানো শহরটাকে আর সহ্যই করতে পারে না শম্পা। হাওড়ার থেকে খারাপ আর নোংরা শহর বুঝি আর পৃথিবীতে হয় না। এ বাড়ির রান্নাও আর শম্পার মুখে রোচে না। এ বাড়ির চা নাকি অখাদ্য, গয়লার দুধে নাকি নর্দমার জল মেশানো, এ বাড়ির আজন্ম ব্যবহৃত স্নানঘর, পায়খানা নাকি ব্যবহারের অযোগ্য। এ শম্পা রিন্টির পরিচিত নয়। রিন্টি বরাবরই দিদির গায়ে ঠেস দিয়ে বসতে ভালবাসত, শম্পা আগে বিরক্ত হত, ঠেলে সরিয়ে দিত। এ শম্পা বিরক্তি প্রকাশ করে না, ঠেলে সরিয়ে দেয় না, বরং এক অদ্ভুত শীতলতার সাথে নীরবে বিচ্ছিন্ন করে নেয়, মৃদু সরে বসে। রিন্টি গায়ে হাত বোলালে, হাসি মুখে তাকায়, কিন্তু অজান্তে শক্ত হয়ে যায় পেশী। রিন্টি গায়ে পড়ে কথা বলে, না বললে, শম্পা সে ভাবে কোন কথাই বলে না। রিন্টি একদিন মাকে বলেই ফেলল, “মা, দিদি যেন কেমন বদলে গেছে না? আজকাল আসেই না। এলেও ভালো করে কথা বলে না।” মা আনমনে সেলাইকল চালাতে চালাতে বলল, “ হ্যাঁ বদলে গেছেই তো। কথায় কথায় শ্বশুর বাড়ির বৈভবের গল্প করে, ও বাড়িতে নাকি মাসের শুরু- শেষ বোঝা যায় না। সারা মাসই মাছ আসে, এত বড় বর পিস। যার যটা ইচ্ছা খাও- এই সব বলছিল আর কি।” কথা বলতে বলতে হঠাৎ মা সোজা হয়ে বসল, “তোকে আজকাল পাত্তা দেয় না, না? দেবেই বা কেন? জানে তোর বাবার কারখানা বন্ধ। গরীব কাকা টিউশনি করে সংসার চালায়। আর তোকে দেখতেও তো তেমন সুন্দর নয়।” দেখতে ভাল নয়, তা রিন্টি জানে, ছোট থেকেই ঠাকুমা বলত, “ভাগ্যে রঙটা কালো হয়নি। নাহলে এর বিয়ে দেওয়া মুস্কিল হত। তবে সর্ব দোষ হরে গোরা।” তবে কি নিষ্কলুষ ভালোবাসার প্রতিদানে কি ভালোবাসা পাওয়া যায় না? প্রিয়জনেদের ভালোবাসাও অর্থ বা রূপের ওপর নির্ভরশীল?
(to be continued)
#AninditasBlog
https://www.facebook.com/amianindita.blogspt.in/

No comments:

Post a Comment