ইউটিউবে শর্ট ফিল্ম দেখাটা নেশার মত পেয়ে বসেছে। আড়াই মিনিট থেকে বড় জোর আধ ঘন্টার ব্যাপার। দৈনন্দিন ব্যস্ততার ফাঁকে এটুকু সময় তো নিজেকে দেওয়াই যায়। নানা বিচিত্র গল্প, অধিকাংশই অপেক্ষাকৃত সস্তা ক্যামেরায় তোলা, অপ্রয়োজনীয় সঙ্গীত অর্থাৎ ঝিনচ্যাক গান বা চটুল নৃত্য নেই। বেশির ভাগই অনামী শিল্পি কচিৎ নামী শিল্পিদের একঝলক। আর হ্যাঁ সেন্সর বোর্ডের রক্তচক্ষু ও সম্ভবত নেই।
অজস্র শর্ট ফিল্মের মধ্যে একটির কথা অনেকদিন ধরেই বলব ভাবছি, নাম সম্ভবত ,“ ওহ মেহরুনী সোয়েটার”।
শৌভিক তখন ব্লক অর্থাৎ উস্তিতে থাকত। ঐ লিঙ্কটা পাঠিয়েছিল। দৈর্ঘ্য ছ-সাত মিনিট হবে। গোটা ফিল্ম জুড়ে উর্দু মিশ্রিত হিন্দিতে অদ্ভুত মাদকতা মিশিয়ে একজন ধারাভাষ্য দিয়ে চলে, বিষয় প্রেম। “প্রেম” কোথায়? চূড়ান্ত ব্যস্ততার মধ্যে ফেসবুক বা হোয়াটস্ অ্যাপে সামান্য বার্তালাপ। রেস্তোরাঁ বা মাল্টিপ্লেক্সে দেখা, কিয়ৎক্ষণের নিভৃত আলাপচারিতা - ব্যাস আবার ব্যস্ত হয়ে পড়া রোজকার ইঁদুর দৌড়ে। প্রেমের সেই মাধুর্য, সেই রহস্যময়তা, অপার্থিবতা যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। এই কনক্রীটের জঞ্জালে ভরা শহরে প্রেম আজ বড়ই যান্ত্রিক, বড়ই বিবর্ণ।
কিন্তু এই সাদাকালো রুক্ষ খরাগ্রস্ত শহরে বক্তা আচমকা একদিন সাচ্চা প্রেম অনুভব করতে পারলেন। টাটকা গোলাপের মত রক্তিম সুগন্ধী প্রেম। অফিস টাইমের চরম ব্যস্ত রেলস্টেশনে তিনি দেখতে পেলেন তাঁদের। এক পুরুষ ও এক নারী। রোজ ওঁরা একই সময়ে স্টেশনে আসেন। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকেন যতক্ষণ না ট্রেন আসে। ট্রেনেও ওঁরা পাশাপাশি বসেন। ভদ্রলোক খবরের কাগজ খুলে বসেন, আর মহিলা সোয়েটার বুনতে থাকেন। কখনও অল্প ক্লান্ত হয়ে মাথা রাখেন ভদ্রলোকটির কাঁধে। কখনও অনুচ্চ স্বরে দাম্পত্যালাপ করতে থাকেন। নিতান্তই মামুলী থোড়বড়িখাড়া মার্কা কথা সব। নির্দিষ্ট স্টেশনে দুজনে নামেন, বক্তার অপলক মুগ্ধ দৃষ্টির সামনে হাত ধরাধরি করে মিশে যান ভিড়ের মধ্যে।
বক্তা ওদের নাম দেন মিঃ এবং মিসেস শর্মা। প্রতিনিয়ত ওঁদের দেখার জন্যই উনি ঐ ট্রেনে সওয়ারি করেন।
মাঝে কি হল, কিছুদিন মিঃ এবং মিসেস শর্মা এলেন না। বক্তা বিমর্ষ হয়ে পড়লেন, তবে কি ওরা পথ পাল্টালেন? রোজ চরম আশা নিয়ে বক্তা স্টেশনে পৌছন, রোজ ব্যর্থ হন। তবে কি হারিয়েই গেল, রাক্ষুসে শহর হজম করে ফেলল প্রেমকে?
সপ্তাহ দুই বাদে হঠাৎ একদিন মিঃ শর্মাকে দেখতে পেলেন। আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠলেন বক্তা, কিন্তু শ্রীমতী শর্মা কই? দুদিন-চারদিন-এক সপ্তাহ কেটে গেল। মিঃ শর্মা একাই আসেন। ট্রেনে ওঠেন। কাগজ পড়েন। একাই নির্দিষ্ট স্টেশনে নেমে যান। মিশে যান ভিড়ে।
সপ্তম দিনে বক্তা আর থাকতে না পেরে মিঃ শর্মা কে জিজ্ঞাসা করেই ফেলে, “ শুনছেন? একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?”
মিঃ শর্মা বিরক্তি নিয়ে বললেন “ তুমি সেই না? যে হাঁ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে?”
বক্তা সলজ্জ ভাবে বলেন,“ আজ্ঞে হ্যাঁ। আচ্ছা উনি কোথায়? ওণাকে আজকাল দেখি না। ”
মিঃ শর্মা ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন,“ দেখ আমি খুব যন্ত্রণার মধ্যে আছি। দয়া করে জ্বালিও না। ” কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে জানলা দিয়ে তাকিয়ে রইলেন, তারপর হড়বড় করে বললেন, “ ভীষণ জেদী ছিল। ওর ক্যান্সার ধরা পড়েছিল। ডঃ বলেই দিয়েছিলেন বড়জোর দুমাস। বলতাম আরাম কর, শুনতো কই? বলত যেকটা মুহূর্ত আছে, তা শুধুই আমার সাথে কাটাতে চায়। ঐ অসুস্থতা নিয়ে রোজ আমার সাথে যেত। আমি অফিসে ঢুকে গেলে ফিরে যেত। ”
হঠাৎ ধড়মড়িয়ে উঠে পড়লেন মিঃশর্মা। ট্রেন স্টেশনে ঢুকছে, মিঃশর্মা নেমে মিশে যাচ্ছেন জনস্রোতে, আচমকা বক্তা খেয়াল করলেন মিঃ শর্মার পরণে যে মেরুন সোয়েটারটা রয়েছে সেটা অর্ধসমাপ্ত। একটা হাত বোনা হয়ে ওঠেনি। সেই মেরুন সোয়েটারটা যেটা মিসেস শর্মা বুনছিলেন।
#anirdiary #aninditasblog
http:amianindita.blogspot.in
No comments:
Post a Comment