Monday, 28 March 2016

অনির ডাইরি ২১শে ফেব্রুয়ারি


সুপ্তোত্থিতা, ক্রন্দনরতা কন্যাকে স্কুলে পৌছান যে কি চাপ, তা কেবল ভুক্তোভোগীই বুঝবেন।  প্রত্যহই শব্দ প্রাবল্য ৬৫ডেসিবল অতিক্রম করে যায়। আমাদের ফ্ল্যাটের নীচেই থাকেন এক মালয়ালি আন্টি।  সাধারণত মালয়ালি আন্টি বললেই যা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, ইনি আদপেই তা নন অবশ্য। সত্তরোতীর্ণা কালো মেমসাহেব। অক্সিলিয়ামে পড়াতেন। এখনও মিডি ফ্রক পড়ে খটখট করে ঘুরে বেড়ান। ফড়ফড়  করে ইংরাজি বলেন, যার অধিকাংশই আমার বোধগম্যতার বাইরে।  তুত্তুরির চিৎকার  প্রায়শ ওণার প্রভাতী শান্তি বিঘ্ন করে। চটি  ফটফটিয়ে উঠে আসেন ওপরে, শান্তিবিনাশককে বিদেশী ভাষায় আদর করেন, চকলেট দেন, আর আমার কপালে জোটে খটমট ইংরেজী বকুনি।  মাঝে মাঝে আমার সন্দেহ হয়, তুত্তরী বোধহয় মাকে নাস্তানাবুদ করার জন্যই ঐ প্রবল কান্নাকাটির আবহ তৈরি করে।
যাই হোক আন্টির হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার একমাত্র উপায় যা আমি আবিষ্কার করতে পেরেছি, তা হল গল্প বলা।  গল্প শুরু করলেই তুত্তুরী চুপ। রোজ নতুন গল্প কোথা থেকে জোগাড় করি? উপেন্দ্রকিশোর বিগত দুই বছর ধরে আমার ত্রাতা।  কিন্তু ঐ গল্পে আর ভবি ভোলে না। গত সপ্তাহে শুরু করেছি বেতাল পঞ্চবিংশতি। সেই ছোট বেলায় দেখা বিক্রম অউর বেতাল অবলম্বনে। চরিত্রগুলির নাম মনে নেই, পড়ার অবকাশ কোথায় ? হাল্কা মনে আছে, অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ নারী চরিত্রে দীপিকা চিকলিয়া থাকত।  পরবর্তী  কালে যিনি রামানন্দ সাগরের রামায়নে সীতার চরিত্রচিত্রণ করেন।তাই এখনও অবধি বলা তিনটি গল্পেরই নায়িকার নাম দিয়েছি দীপিকা । তুত্তুরি অবশ্য ক্রমসন্দিহান হয়ে উঠছে, কিন্তু আমি নিরুপায় ।
যাই হোক প্রথম গল্পটি ছিল, এক নবোঢ়া তরুণীর গল্প, সদ্য বিবাহের পর শ্বশুরবাড়ি যাবার সময় পর্যায়ক্রমে তার স্বামী এবং ভ্রাতা দেবী দুর্গার সম্মুখে স্বহস্তে  শিরশ্ছেদ করে  আত্মঘাতী  হয়। অন্তে মা দুর্গার আশির্বাদে মেয়েটি তার স্বামী এবং উভয়কেই বাঁচিয়ে তোলে কিন্তু হড়বড়ানিতে এর ধড়ে ওর মুণ্ডু লাগিয়ে বসে।
রাত্রে ঘুমোনোর  আগে সকালে বলা গল্পটি আবার শোনাতে হয়, শুক্রবার রাতে যখন শোনাচ্ছিলাম, শৌভিক বলল, “ এই লেজেন্ডটি নিয়ে টমাস মানের একটি গল্প আছে,‘ চেঞ্জ অব হেড’ বলে। সেইটা অবলম্বনে গিরিশ কারনাডের একটি  বিখ্যাত  নাটক আছে,‘ হয়বদন’। ”
“ হয়? বদন?”
“ হুঁ।  হয়। হয় মানে ঘোড়া। শঙ্খ ঘোষ বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন।  বাবার আছে।  তুই পড়তে চাইলে, খুব খুশি হবে। ”
 বলাই বাহুল্য , শ্বশুর মশাই খুশি হয়ে একটি নয় দু দুটি নাটক পড়তে দিলেন।  পাতলা চটি বই। এক নিশ্বাসে পড়লাম। কোন এক কাল্পনিক  নগরে দুই অভিন্নহৃদয়  বন্ধু থাকত, দেবদত্ত ব্রাহ্মণ পুত্র, গৌর বর্ণ, দোহারা পেলব চেহারা, নামী কবি।  কপিল কামারের ছেলে, বিদ্যাদেবীর সঙ্গে চিরবিবাদ।  কপিল কুস্তিগীর। ভাগ্যবৈগুন্যে দুই বন্ধু  একই নারীর প্রেমে পড়ে। পদ্মিনী নামী শ্রেষ্ঠীতনয়া।  কালক্রমে দেবদত্তের ঘরনী হয়।  কপিল সব মেনে নিয়েও নিজের মুগ্ধতা গোপন করতে পারেনা।  দেবদত্ত অসন্তুষ্ট হয়, কিন্তু পদ্মিনী কপিলের নীরব প্রেম উপেক্ষা করতে পারে না।  এক জটিল ত্রিকোণ তৈরি হয়।
গল্প এগোয়।  মা কালীর কাছে কোন এক কালে করা মানত চরিতার্থ করতে দেবদত্ত আত্মবলি দেয়। অনুসরণ করে কপিলও।  যথারীতি  পদ্মিনী যখন স্ব শিরশ্ছেদ  করতে যায়, মা কালী তাকে নিরত করেন এবং সুযোগ দেন দেবদত্ত এবং কপিলকে পুনরুজ্জীবিত করার। পদ্মিনী কপিলের বলিষ্ঠ দেহে দেবদত্তের মাথা জুড়ে দেয়, সচেতন ভাবে নাকি অবচেতনে তা পদ্মিনী নিজেও বোঝে না।
প্রাণ ফিরে আসার পর, দুজনেই পদ্মিনীকে নিজ স্ত্রী হিসাবে তথা পদ্মিনীর গর্ভজাত পুত্রকে নিজ সন্তান দাবী করে।  পদ্মিনী যদিও নব সুঠাম দেহী দেবদত্তকেই নিজ স্বামী হিসাবে গ্রহণ করে।
দিন যায়, নবদেহে দেবদত্তর সাথে পরমসুখে দিন কাটে পদ্মিনীর।  কিন্তু ধীরে ধীরে নতুন দেহেও পুরাণ দেবদত্ত প্রকট হয়ে উঠতে থাকে।  ছটফটিয়ে উঠতে থাকে পদ্মিনী, কপিলের জন্য।  অবশেষে একদিন শিশু পুত্রকে কোলে নিয়ে কুলত্যাগী হয় পদ্মিনী কপিলের জন্য।  কিন্তু কপিল কোথায় ? সেদিনের পর থেকে কেউ দেখেনি তাকে।
শেষটা বরং উহ্যই থাক।
htttp:amianindita.blogspot.in
#aninditasblog #anirdiary

No comments:

Post a Comment