Sunday 11 September 2022

অনির ডাইরি ১৯ শে আগস্ট, ২০২২

 

#তুত্তুরী_আর_ফুলঝুরির_গপ্প - ৩

আমাদের বাড়ির ছিরি কেষ্ট (অন্য কারো মুখ কল্পনাপটে ভেসে উঠলে, লেখিকা দায়ী নহে)। কারাগারে অবশ্য জন্মাননি, নগর কলিকাতার সবথেকে মূল্যবান হাসপাতালেই ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন শ্রীমতী ফুলঝুরি। আজ্ঞে হ্যাঁ, উনি শ্রীমান নন, শ্রীমতী বটেক। তাতে কি?  শ্রীকৃষ্ণ তো অখণ্ড প্রেমের আধার, ইনিও তাই। হোক না মেয়ে, শ্রীরাধিকার মত পরপুরুষে মন মজিয়ে, বিরহানলে দগ্ধে মরার থেকে পার্থসারথি শ্রীকৃষ্ণ হওয়া ঢের ভালো। অসি আর বাঁশি দুইয়েতেই সমান পারদর্শী হোক।  রাজা হয়ে সিংহাসনে বসার দরকার কি, রাজা হলে মুকুট পরার যাতনাটাও যে ভুগতে হবে, তার থেকে ওর অঙ্গুলিহেলনে তৈরি হউক রাজা। 


তো, আমাদের কেষ্ট বাবু ভূমিষ্ঠ হবার দিন দুয়েক আগেও শ্রীমতী উমারাণী হুমকি দিয়েছিল, ‘হলে তোমাদের দিয়ে দেব। তুমি আর দাদা মানুষ করবে।’ বেজায় হেসেছিলাম মেসেজ খানা পড়ে, যেন সত্যিই প্রাণে ধরে দিয়ে দিতে পারবে! আমার আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে, শ্রীমতী উমারাণী আজকাল দিনরাত মেয়ের মুখের দিকেই তাকিয়ে থাকে। ফুলঝুরি কি রকম করে তাকাচ্ছে, ফুলঝুরি কিসে বিব্রত হচ্ছে, কি নিয়ে ফুলঝরি তীব্র আপত্তি জানাচ্ছে ইত্যাদি প্রভৃতি।  রোজ ঘুরে ফিরে মেসেজ করে উমা, ‘দিদিভাই, এমন সুন্দর সময়ের মধ্যে যাচ্ছি ওকে নিয়ে যে মনে হচ্ছে সময় বড় দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, বড় হয়ে যাচ্ছে আমার ছোট্ট মেয়েটা দেখতে দেখতে। মাঝে মাঝে মনে হয় এরকম ছোট্টটি থাকলে বেশ হত।’


পড়ি আর হাসি, হাসি নিজের নির্বুদ্ধিতার কথা ভেবে। ঠিক এমন চিন্তা আসত আমারও মাথায়। শ্রীমতী তুত্তুরী যখন মাত্র চার মাস বয়স, ওকে আমার মায়ের জিম্মায় রেখে যোগ দিতে হয়েছিল চাকরীতে। অফিস সেই খড়্গপুর। আবাস বলতে মাদপুর নামক অজ গাঁয়ের বিডিও কোয়ার্টর।ইচ্ছে থাকলেও শ্রীমতী তুত্তরীকে নিয়ে যাওয়ার উপায় ছিল না। আমাদের আপিস টাইমে মেয়েকে সামলাবে এমন বিশ্বস্ত তথা পরিচ্ছন্ন লোক পেলাম কোথায়। সবথেকে বড় কথা কেয়ার্টারটা ছিল চতুর্দিকে ধান জমি আর জলা জমি দিয়ে ঘেরা। আমরা যে নেহাৎ ভাড়াটে তা প্রতিপদে বুঝিয়ে দিত বাড়ির মালিক ওরফে টিকটিকি, আরশোলা, গুচ্ছ গুচ্ছ পোকা আর ধেড়ে ইঁদুরের দল। তাই সাহস করে মেয়েকে আর আনতে পারিনি।  বদলির আবেদন করে একাকি ফিরে গেলাম খড়্গপুর। কখনও যাতায়াত করে নিতাম, কখনও থাকতে বাধ্য হতাম। যাই করি না কেন প্রতি রাতে শৌভিকের বুকে মাথা রেখে ডাক ছেড়ে কাঁদতাম,আর বলতাম, ‘কি তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাচ্ছে ও, এইভাবে দেখতে দেখতে ওর ৩০বছর বয়স হয়ে যাবে, বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। আমার মেয়েকে আমি আর কাছে পাব না।’ 


সেটা ২০১১সাল, রাজনৈতিক পালাবদলের সময়, বিডিওদের ওপর উত্তাল চাপ, তারই মধ্যে আমার কান্নাকাটি গুলো ছিল আমার বরের একমাত্র বিনোদন। আমার আজগুবি কথাবার্তা আর হুহু করে কান্না দেখে হেসে অস্থির হত শৌভিক। বাবাদের যে ভেঙে পড়লে চলে না। 


একই পথের পথিক বলেই উমারাণীর মনের অবস্থা তাই আমার থেকে ভালো কে বোঝে! অতীত খুলে বসলেই উমারাণী বলে, ‘বিয়েই দেব না দুটোর। আমাদের কাছে থাকবে। ও দিদিভাই এদের বিয়ে হয়ে চলে গেলে আমরা বাঁচব কি নিয়ে গো?’ ওর ইনিংস সবে শুরু, এসব চিন্তা আসা খুব সাধারণ। এই পথে বেশ খানিকটা হেঁটে এসে আজ আমি জানি কি নিয়ে বাঁচব, বাঁচব এইসব অমূল্য মুহূর্তের স্মৃতিগুলো নিয়ে, বাঁচব ওদের গরবে গরবিনী হয়ে, ওদের প্রেমে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে, ওদের সাথে পড়ে, ওদের সাথে উঠে, ওদের গায়ের গন্ধ মেখে। ঠিক যেমন ভাবে শত সহস্র বছর আগে বেঁচেছিল দেবকী আর যশোদা মা, মায়েদের যে বেঁচে থাকতেই হয়।

শুভ জন্মাষ্টমী 🙏🏼🙏🏼


অনির ডাইরি ১২ই আগস্ট, ২০২২

 



#তাম্রলিপ্তকড়চা 


'ম্যাডাম যাবেননি?' তাগাদা দেয় উত্তমকুমার। এমন দিনে আপিস ছেড়ে যেতে একটুও ইচ্ছে করছে না। কিন্তু যেতেই হবে। লাটসাহেবকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি যে। লাটসহেব নামটা আমারই দেওয়া।  প্রতিদিন সবার শেষে হাঁপাতে হাঁপাতে আপিস ঢোকেন লাটসাহেব। এবং যতক্ষণ না তিনি এসে পৌঁছান, হাজিরা খাতাটি এসে পৌঁছায় না আমার কাছে। পাছে ছোকরাকে লাল দাগ দিই, কোন না কোন অছিলায় খাতাটা লুকিয়ে রাখেন আমাদের হক বাবু। 


অবশ্য একথা অনস্বীকার্য যে ছেলেটা লেট লতিফ হলেও ফাঁকিবাজ নয়। বরং কাজের ক্ষেত্রে এক্কেবারে যাকে বলে রত্ন বিশেষ। কাজে কোন আপত্তি নেই ছেলেটার, উৎসাহ এবং উদ্দীপনাও প্রচুর।  প্রয়োজনে গভীর রাত পর্যন্ত জেগেও কাজD তুলে দেয়। লাটসাহেব বলেন তাতেই নাকি তাঁর সুবিধা।  কম্পুটার, প্রোগ্রামিং ইত্যাদি নিয়ে গভীর জ্ঞান ছেলেটার। আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর তাম্রলিপ্তর জন্য  একখানা নিজস্ব ওয়েবসাইটই বানিয়ে ফেলেছে ছেলেটা। আমাদের লাটসাহেবের কল্যাণে আপিসের প্রয়োজনীয় তথ্যাদি, হিসেবনিকেশের ফর্মূলা কেবল একটা মাউস ক্লিকের দূরত্বে। 


 এহেন লাটসাহেবকে আমি একদিন প্রশ্ন করেছিলাম, রোজ এত দেরী কেন করিস বাবা? জবাবে জানতে পারি, সকাল সকাল কোন কোচিংR সেন্টারে পড়াতে যায় ছেলেটা। সেখান থেকে ফিরে চটজলদি স্নানাহার সেরে আপিস ঢুকতে একটু বিলম্ব হয় আর কি। ওদের ক্যাডারের বেতনের যা হাল, আর মূল্যবৃদ্ধি যে হারে উর্দ্ধগামী , আমার আপিসের কাজ গুছিয়ে কেউ যদি আপিসটাইমের আগে পরে দুটি ছাত্র পড়ায়, আমার তাতে কোন আপত্তি নেই। 


 ছেলেটির মুখে বিশদে শুনেছিলাম ওদের কোচিং সেন্টারের গল্প। মূলতঃ কম্পিউটার পড়ায় এবং শেখায় ওরা। নবম থেকে দ্বাদশের ছাত্রছাত্রীই বেশি। কিছু অষ্টম শ্রেণীর পুঁচকেও অবশ্য আছে। যেমন আছে কিছু কলেজের ছাত্রছাত্রী। পড়ানোটা যে ছেলেটার কাছে নিছক জীবিকা-নির্বাহ নয়, তা ওর কথা শুনেই বোঝা যায়। পড়াতে ভালোবাসেK ছেলেটা, শেখাতেও।  এমনকি মাঝে মধ্যেই সুযোগ পেলে উপযাচক হয়ে আমাকে নানা জ্ঞান দেয় লাটসহেব । নেহাৎ আমি ছাত্রী হিসেবে একেবারেই অগাকান্ত অকর্মণ্য।  


তো এহেন লাটসাহেব কিছুদিন আগে ভীতু ভীতু স্বরে অনুরোধ করে ,‘ম্যাডাম আমাদের কোচিং সেন্টারে বাৎসরিক রাখিবন্ধন অনুষ্ঠান হবে। আপনি যাবেন?’ লাটসাহেব তো আর সত্যি সত্যি অনুরোধ করেন না, আব্দার করেন। তা তিনি যে দিন এবং যে ক্ষণের উল্লেখ করেছিলেন, আপিসের ডাইরি অনুযায়ী তখনও পর্যন্ত তা ঢাকা পড়েনি কোন মিটিংমিছিলে। ফলতঃ মৌখিক সম্মতি দিয়েছিলাম। শুধু যে লাটসাহেব আমন্ত্রণ জানিয়েছিল তা নয়, উক্ত কোচিং সেন্টারের মুখ্য আহ্বায়ক স্বয়ং এসে জানিয়ে গিয়েছিলেন, অন্যান্য মান্যগণ্য  অতিথি সমাবেশের মাঝে মুখ্য অতিথি হিসেবে ওণারা আমাকেই যাচ্ঞা করেন। 


 আহ্বায়ক মহোদয় পরে আবার একবার এসেছিলেন, এবার একাকী নয় একঝাঁক “নূতন যৌবনের দূত” এবং দূতীসহ। ‘ওরা আপনাকে নিমন্ত্রণ জানাতে এসেছে ম্যাডাম।’ লাজুক অথচ গর্বিত স্বরে জানিয়ে ছিল লাটসাহেব। এই তো সেদিনের কথা, সবাই মিলে কার্ড দিয়ে গেল, ছবি তুলে গেল। এত কিছুর পর যাওয়াটাই তো শিষ্টাচার। বাধ্যতামূলক ও বটে।  


মুস্কিল হল প্রতিশ্রুতি দেবার সময় খেয়াল করিনি, দিনটা যে স্বাধীনতা দিবসের আগের শেষ কর্মদিবস। স্বাধীন ভারতের জন্মদিন উপলক্ষে এখানে কিছু হবে না? আপিস সাজাব না আমরা? তৎকালীন চুঁচুড়া আপিসটার তো ভোলই পাল্টে যেত এইদিনগুলোতে।  তেরঙা বেলুন আর কাগজের ত্রিকোণ তেরঙা পতাকায় মুড়ে দেওয়া হত বুড়ো কালেক্টরেটের ছোট্ট লেবার অফিস আর তার সামনের বারন্দাটাকে। চন্দননগরের বড়সাহেব থেকে শুরু করে এসএলওরা পর্যন্ত সকলের বুকে আটকানো হত তেরঙা ব্যাজ।  সম্মিলিত ভাবে গাওয়া হত জাতীয় সঙ্গীত। উদাত্ত গলায় দেশাত্মবোধক গান ধরত ধনিয়াখালির ইন্সপেক্টর চঞ্চল। গলা মেলাত আরএলও ইন্সপেক্টর কৌশিক। সবার শেষে গান ধরত ধনিয়াখালির SLO অমৃতা। মুহূর্তগুলো হারিয়ে গেছে বটে, রয়ে গেছে স্মৃতিগুলো। কে যেন সেদিন কটূক্তি করেছে শুনলাম, ’আগের চুঁচুড়া আপিসটা নাকি কেবল ছবি তোলার আপিস ছিল’ বলে। ভাগ্যে তাই ছিল, তাই না ফেসবুক জুড়ে জ্বলজ্বল করে সেইসব সোনালী মুহূর্ত গুলো। 


কেবল মাত্র জহরবাবু ছাড়া এখানে গানবাজনায় কারো তেমন উৎসাহ না থাকলেও, আপিস সাজানোয় দেখলাম সবার তীব্র উৎসাহ। পুরসভার ইন্সপেক্টর বেদজ্যোতি তো অত্যুৎসাহী হয়ে তেরঙা বেলুনের গেট বানানোর আব্দার জুড়ে ছিল। অতি কষ্টে নিরস্ত করা হল তাকে। 


 আমার ফরমাইশ মত বেলুন আর পতাকা কিনে আনল অরূপ। জসুয়ার ফরমাইশ মত তাদের সাথে যুক্ত হল তেরঙা রিবন। 


শুক্রবার দিন আপিসে বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধি আর পরিবহন শ্রমিকদের ভিড় লেগে থাকে। আরএলও ইন্সপেক্টর সৌরভ আর শহীদ মাতঙ্গিনী ব্লকের সিকেসিও নন্দন অন্যদিন দম ফেলার ফুরসৎ পায় না। আজও ওদের ব্যস্ততা চরম, তারই মাঝে আজ অপরাহ্নে শুরু হয়েছে বেলুন ফোলানো,পতাকা টাঙানোর কাজ। কাজ মিটে গেলেও ফিরে যাচ্ছে না আগত  অতিথিদের দল। সবাই সমবেত হয়ে বেলুন ফোলানো, পতাকা ঝোলানো, রিবন লাগানো দেখছেন। বিশেষজ্ঞ মতামত দিচ্ছেন। 


এমন দিনে, এমন আপিস ছেড়ে যেতে কার মন চায়? পাছে আমি আপিস ছেড়ে না নড়ি, তাই শুধু উত্তমকুমারের ভরসায় না থেকে ফোন করে নিজেই তাগাদা দেয় লাটসাহেব, ‘বেশীক্ষণ আটকাবনি ম্যাডাম। আপনি আসবেন, ছেলেমেয়েগুলোকে উৎসাহব্যঞ্জক দু-চারটে কথা বলবেন, ব্যাস।’ উৎসাহের মোড়কে জ্ঞান দিতে অবশ্যি আমার বরাবরই দারুণ লাগে। 


 নির্দিষ্ট সময়ের মিনিট পনেরো পরে পৌঁছে দেখি ব্যস্ত রাজপথের এক প্রান্তে ছোট্ট ম্যারাপ বেঁধে সাজানো হয়েছে মঞ্চ। পাতা হয়েছে আসন। গলায় মোটা পুষ্পহার নিয়ে পাশাপাশি বসেছেন রবীন্দ্র-নজরুল। পাশে বিনম্র ভাবে দাঁড়িয়ে টলটলে তেল ভর্তি লম্বা পিতলের পঞ্চপ্রদীপ। শতরঙী প্রজাপতির মত উড়ে বেড়াচ্ছে শাড়ি পরা পুঁচকি সুন্দরীদের দল। পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান ম্যাডাম এসে গেছেন আমার আগেই। এসে গেছেন স্থানীয় মহাবিদ্যালয়ের মহাধ্যক্ষ  মহোদয়, স্থানীয় কাউন্সিলর, এসপি সাহেবের প্রতিনিধি। পুরসভার চেয়ারম্যান সাহেব এসে পৌছাবেন যে কোন মুহূর্তে। 


অতঃপর এত সাড়ম্বর রাখি উৎসবে যা হয় আর কি,  'মাত্র পনেরো মিনিটে ছেড়ে দুব ম্যাডাম' বলে জনে জনে প্রতিশ্রুতি দিলেও ছাড় পেতে পেতে প্রায় ঘন্টার কাঁটা গড়িয়ে যায়। 


কপালে চন্দনের টপ্পা, হাতে ভারী ফুলের রাখি, গলায় উত্তরীয় নিয়ে যখন উত্তমকুমারের গাড়িতে উঠলাম, বেলা গড়িয়ে গেছে। দূরের লোকজনের ঘরে ফেরার সময় সমাগত। সামনে তিনদিনের লম্বা সপ্তাহান্ত। একে তো ফুরফুরে ছুটির মেজাজ তার ওপর আমি নেই, আর থোড়াই কেউ আপিসে বসে থাকবে আজ। অবশ্য যাবার আগে বলে যায় সবকটা। মুঠোফোন খুলে দেখি বাস্তবিকই দুটি মিসড্ কল। প্রথমজনকে ফোন করতেই, লাজুক আব্দার, ‘বাড়ি যাব ম্যাডাম?’ বেপোট গরম পরেছে আজ, ঘন্টাখানেকের রাখি উৎসবে প্রায় তিন লিটার ঘেমে ক্লান্ত হয়ে নিজেরই বাড়ি ফেরার ইচ্ছা দুর্দম, আমি আবার অন্যকে আটকাব! বললাম জলদি পালাও। আমিও ভাবছি আর আপিসে ঢুকব না। গাড়ি চালাতে চালাতে উত্তমকুমার বলে,‘হায় ম্যাডাম, অফিসে ঢুকবেননি? ওরা যে এত কষ্ট করে অফিস সাজালো গো?’ 


বলতে না বলতেই সঞ্জয়ের ফোন,সঞ্জয় আপাততঃ  আমার সবথেক সিনিয়র ইন্সপেক্টর। আগেও একবার করেছিল দেখলাম সঞ্জয়,  ‘ম্যাডাম, আমাদের অফিস সাজানো তো কমপ্লিট। আপনি কতদূর?’ ঘড়ি বলছে আপিসের সময় প্রায় শেষ। বলতে গেলাম, বাড়ি যাও, স্বাধীনতা দিবসের আগাম শুভেচ্ছা, উল্টে সঞ্জয় বলল,‘আমরা বসে আছি। ছবি টবি তোলা হবে তো নাকি?’ এরপর আর বাড়ি ফিরি কি করে? উত্তমকুমারকে বললাম,‘চালাও পানসি’। ঘাড় ঘুরিয়ে উত্তমকুমার বলল,‘ আজ্ঞে!’ বললাম, আরেঃ আপিসে চল রে ভাই লোকজন বসে আছে। 


আপিসে ঢুকে দেখি, সৌরভ-সন্দীপ আর নন্দন তখনও পেনশনের কেসের গোছা নিয়ে লড়ে গেলেও বাকি সবাই মুখ-টুক মুছে,চুল-টুল আঁচড়ে প্রস্তুত। জহর বাবু তিনছড়া তেরঙা রিবনের হার পরে বসে আছেন ছবি তোলা হবে বলে। অরূপ, আশিস, জসুয়া, সৌমেন, চঞ্চল বাদানুবাদে মত্ত কোথায় তুললে বেশী বেলুন চোখে পড়বে, কোথায় আলো বেশী। কি ভাবে তোলা হবে,সবাই দাঁড়িয়ে নাকি কিছু দাঁড়িয়ে কিছু বসে, তাহলে কারা দাঁড়াবে, কারাই বা বসবে ইত্যাদি প্রভৃতি। ঘামে ভেজা, তেলতেলে পাঁপড় ভাজার মত মুখের ওপর আঁচল ঘষতে ঘষতে  বিড়বিড় করে বললাম, তোমাদের কপালেও বদনাম নাচছে বাপু। আমায় যেতে দাও, ঠিক কেউ না কেউ বলবে, 'এটা তো ছবি তোলার আপিস ছিল।' সে বলুক, আপাততঃ আমরা ছবিগুলো তো তুলি। ভাগ্যে মুঠো ফোন এসেছিল, ছবি তোলা এত সুলভ হয়েছিল। নাহলে এমন কত মুহূর্ত যে নিছক হারিয়েই যেত সময়ের অভিঘাতে, স্মৃতির যাদুঘরে-

Sunday 4 September 2022

তুত্তুরী উবাচ ১৩ই আগস্ট, ২০২২

 


👩🏻- হোমওয়ার্ক গুলো শেষ হল?


👧🏻-(ক্লান্ত স্বরে)নাঃ। দুধ খেয়ে যাচ্ছি। 


👩🏻-(বিরক্ত হয়ে) এখনও দুধ খাওনি?


👧🏻- (হাত উল্টে) খাব কি করে? সবে তো গরু কিনতে গেছে মাসি। তারপর দুধ দোয়া হবে, তারপর গরম হবে, তারপর না- 


👩🏻-(হাসি চেপে) উফঃ। মাসির পিছনে লাগা বন্ধ করো। 


👧🏻-(তেতো স্বরে) হ্যাঁ। সবাই তো আমারই পিছনে পড়ে থাকে। ইংলিশ লিটারেচারে একটা প্রশ্ন বুঝতে পারি নি, তাই অ্যানসারে লিখেছিলাম, ‘আই কান্ট আন্ডারস্টান্ড। প্লিজ হেল্প।’ বাবা, যে তার নীচে লিখেছে, “বুঝবি কি করে, প্রশ্নটাই মিনিংলেস আর তোর মাথায় আরো কম বুদ্ধি।” কই বাবাকে তো কিছু বলো না।

অনির ডাইরি ৮ই আগস্ট, ২০২২

 


“ডাক্তার কি না দেখালেই নয়?” ফোনের ওপার থেকে তিতকুটে স্বরে জানতে চায় বাবা। মাস খানেক আগে ভাইরাল জ্বরে একেবারে কাবু হয়ে পড়েছিল বাবা। জ্বর তো ছিল মাত্র দিন দেড়েক, কিন্তু তার জের আর কাটতেই চাইছে না।  


যাবতীয় সমস্যা ঢেকে রাখা, চেপে রাখা,পারলে উহ্য বা লুপ্ত রাখাটা আমার বাবার প্রিয় অভ্যাস। বেচারী আমার মা, সমস্যার মুখোমুখি হয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে যদিও বা আমাকে জানাতে চায়, রক্ত চক্ষু প্রদর্শন করে বাবা। “ওদের একদম বিব্রত করবে না। ওরা প্রাণ ভরে বাঁচুক। নিজেদের তুচ্ছ সমস্যা আমরা দিব্যি সামলে নিতে পারব।”  মুস্কিল হল সমস্যা তুচ্ছ বা শিশু অবস্থায় জানালে তাকে প্রতিরোধ করাটা আমার পক্ষে যতটা সহজ হয়, তিনি যৌবনে পদার্পণ করলে তার মোকাবিলা করাটা হয়ে পড়ে ততোটাই দুঃসাধ্য। এ কথা বারংবার বলা সত্ত্বেও কেন যে বোঝে না আমার বাপ। 


 এবারেই ধরুন না, আমাকে শুধু বলা হয়েছিল বাবার একটু জ্বরজ্বর ভাব, সামান্য গা ছ্যাঁকছ্যাঁক, অল্প একটু মাথা ধরা, ব্যাস ঐ টুকুই। ক্যালপল খেয়ে, অক্সিমিটারে অক্সিজেন মেপে সেরে উঠেছে বাবা। ফোনে শুনে তাই বিশ্বাস করেছিলাম আমি, ভেবেছিলাম হয়তো নিছক মরশুম বদলের পরিণাম। ভয়ানক অবাধ্য যে লোকটা,যখন তখন স্নান করে, গরম লাগলেই স্নান করে। চান ঘরে পাখা চালিয়েও স্নান করে চোরাগোপ্তা। এমন তো হবারই কথা। বাবাও বলল, ‘ হ্যাঁ। হ্যাঁ একদম ঠিক আছি আমি।’ ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল আমারও। তারপর নিত্য কথা হয়, সকালে আমার সাথে রাতে তুত্তুরীর সাথে। ‘ইলেকট্রিক বিলটা দিয়ে দাও’, ‘মায়ের ফোনে রিচার্জ করে দাও’, ‘টাটা স্কাইয়ের বিলটা কবে ডিউ দেখে সময়মত দিয়ে দাও’ ইত্যাদি প্রভৃতি হাজার খানেক ফরমাইশ করে ফোন করে বাবা। প্রতিটা বিল দেবার পর পাঠাতে হয় স্ক্রিনশট। সেই টাকাটা যত্ন করে খামে ভরে লাল-গোলাপী-সবুজ কালিতে লিখে রাখে বাবা। বেশি টাকা জমে গেলেই তাড়া দেয়,গিয়ে নিয়ে নেবার জন্য। তেমনি তাড়া খেয়ে কোন এক সপ্তাহান্তে গিয়ে দেখি পুরো ধুঁকছে আমার বাপ। অপরিসীম দুর্বলতা, কোন মতে পায়ের আগে পা ফেলে হাঁটছে, রাস্তায় বেরোনো তো বন্ধ করেই দিয়েছে, বেশী ক্ষণ দাঁড়িয়েও থাকতে পারছে না। খাবার দাবারে ঘোর অরুচি। প্রোটিন জাতীয় কোন কিছুই খাচ্ছে না। মাংসে গন্ধ, ডিমে কোন স্বাদ নেই। খুব ছোট্ট মাছের টুকরো মুচমুচে করে ভেজে দিলে খাচ্ছে বটে, সেও আলে কালে। এতকিছুর পরও ডাক্তারের কাছে যেতে রাজি হল না বাবা। ‘কেন যাব?’ দুর্বলতার জন্য কি কেউ ডাক্তার দেখায়? পারিবারিক ডাক্তারের কাছে রুটিন চেক আপে যাবার সময় এখনও আসেনি। তাছাড়া তার আগে তো তার দেওয়া গুচ্ছ খানেক টেস্ট করাতে হবে। টেস্টের নামে যত ভয় বাবার। কারণ টেস্ট করলেই যে ধরা পড়বে কড়া নিষেধ সত্ত্বেও অপরিমিত ধুমপান এবং শর্করা সেবন। 


বাপরে কি ডানপিটে বুড়ো। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতেই পারলাম না। সে যাত্রা শৌভিকের পরামর্শ মত খাবারে নানা রদবদল করে, প্রোটিন বিস্কুট, প্রোটিন ড্রিঙ্ক খাইয়ে কোন মতে খাড়া করা হল বৃদ্ধকে। সম্প্রতি দেখা দিয়েছে নতুন উপসর্গ, কানে তালা ধরা। কখনও ধরছে, কখনও ছাড়ছে। বুঝতে পারছি চৃড়ান্ত অস্বস্তির মধ্যে আছে বৃদ্ধ তাও ডাক্তার দেখাতে যাবে না। ওসব নাকি এমনিই সেরে যাবে। বাধ্য হয়ে পাড়ারই এক শুভাকাঙ্ক্ষীকে ফোন করে অ্যাপো বুক করিয়েছি আমি। সেটাও তেমন পছন্দ হয়নি বৃদ্ধের। 


‘আর কত দৌড়বি আমাদের জন্য? এই তো গত শনিবার তুত্তুরীকে নিয়ে এলি,রবিবার আবার তমলুক ফিরে গেলি, সোমবার আবার কলকাতা এলি শ্বশুরকে ডাক্তার দেখাতে, আবার ফিরে গেলি। বুধবার বিকালে আবার আসবি, আবার বৃহস্পতিবার ফিরে যাবি। কত পরিশ্রম করবি আর আমাদের জন্য? বুড়ো বাপ মায়ের জন্য আর কত দৌড়বি?’ মনের খেয়ালে বলে চলে বৃদ্ধ। 


শুনতে শুনতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে কোন এক রবিবারের দুপুর। একটা চাকরীর পরীক্ষা দিয়ে গোলপার্ক থেকে ভিড়ে ঠাসা পাঁচ নম্বর নাকি ছয় নম্বর স্টেট বাসে উঠেছি। বসার জায়গা তো সবই ভর্তি, ভদ্র ভাবে দাঁড়ানোটাও মুস্কিল। কোন ভাবে গোঁতাগুঁতি করে লেডিজ সিটের সামনে একটু জায়গা পেয়ে সিটের ওপরের রডটাকে চেপে ধরেছি ব্যালান্সের জন্য। ধরতে গিয়ে সামনে বসা মেয়েটির কয়েকটি চুলও ধরে ফেলেছি অজান্তে। মেয়েটি একবার চোখ তুলে তাকালো, তারপর চুলটা সরিয়ে নিয়ে তাকিয়ে রইল জানলার বাইরে দিকে। এক পলকের একটু দেখাতেই দিব্য চিনতে পারলাম মেয়েটিকে, জনৈক সুন্দরী সহপাঠিনী। বিদ্যালয় জীবন শেষ হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগেই তবে তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি যে একে অপরকে চিনতে অপারগ হব আমরা। তাও সে চিনল না। 


গায়ে পড়ে পরিচয় দেবার মত আত্মবিশ্বাসটাও কেন জানি না খুঁজে পেলাম না সেদিন। মহাবিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয় টপকে সকলেই ততোদিনে কোন না কোন পেশায় জমিয়ে বসেছে, যারা পেশা নিয়ে ভাবিত ছিল না তারা হয় পাড়ি দিয়েছে নয়তো পাড়ি দিতে চলেছে সংসার নামক সমুদ্রে। পড়ে রয়েছে আমার মত গুটি কয়েক হতভাগ্য যাদের না হয়েছে ঝিনচ্যাক্ কেরিয়ার না জুটেছে বর বা বয়ফ্রেন্ড। কয়েকদিন আগেই তেমন এক পরিচিতার মন্তব্য কানে এসেছে ঘুর পথে, 'আমাদের মধ্যে অনিন্দিতাটারই কেবল কিছু হল না।’ বাবা অবসর নিয়েছে, মায়ের অবসর নিতে বছর পাঁচ কি ছয় বাকি, এমতবস্থায় আমার কিছু হচ্ছে না বা হবে না এই চিন্তায় আমি নিজেই যথেষ্ট পঙ্গু, তারওপর এই অযাচিত খাঁড়ার ঘা যে কতখানি ঝাঁঝরা করে দেয় নিছক "সাধারণ মেয়ে"দের আত্মবিশ্বাস তা কেন যে এরা বোঝে না-। 


এমনিই ঝাঁঝরা জর্জরিত আত্মবিশ্বাসের ওপর যেন অ্যাসিড প্রলেপ দিল হঠাৎ বাসে দেখা হয়ে যাওয়া সহপাঠিনী। প্রায় চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে মিশে যেতাম বাসের ভিড়ে ঠাসা মাটিতে, যদি না আচমকা নাকে আসত চেনা সিগারেটের গন্ধটা। আমি যত ব্যর্থ, যত অপদার্থই হই না কেন, আমার বাপের জন্য যে আমিই তার সূর্য। ভিড় কাটিয়ে সেই সূর্যেরই গায়ের কাছে সরে সরে এসেছে আমার বাপ। বয়স্কদের জন্য সংরক্ষিত সিটের মায়া ত্যাগ করে সরে এসে দাঁড়িয়েছে লেডিজ সিটের গা ঘেঁষে। শুধু আমারই জন্য। 


গোটা রাস্তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বকবক করতে করতে বাড়ি ফিরেছিলাম বাপ আর মেয়েতে। পরীক্ষা কেমন হয়েছে একটিবারও জানতে চায়নি বাবা। ভালো হয়ও নি। রেলের পরীক্ষা ছিল আজও মনে আছে। পাইও নি। তা নিয়ে বিন্দুমাত্র দুঃখ পায়নি বাবা, বুক বাজিয়ে বলে গেছে, ‘তুই চাসনি,তাই পাসনি। তুই যা চাইবি, সব পাবি। সঅঅব পাবি। সেদিন হয়তো আমি থাকব না, কিন্তু তুই পাবি, পাবিইইই।’ পেয়েছি তো। শেষ পর্যন্ত লেবার সার্ভিসকে বেছে নিয়েছি বটে,তবে মাইরি বলছি পেয়েছিলাম আরো এক ডজন সরকারী চাকরী। ভট্টাচার্য বাড়ির সীমাহীন ভালোবাসা পেয়েছি, শৌভিক, তুত্তুরী, উমাকে পেয়েছি। আরোও কত কিই যে পেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। পাবার পথটা দুর্গম ছিল, সহায় সম্বলও ছিল না তেমন, তাই বলে হাতটা তো ছেড়ে দেয়নি বৃদ্ধ আমার। তাহলে আজ যখন আমার হাত ধরার পালা এত মাতব্বরী করে কেন বৃদ্ধ কে জানে? এত কথা আর বললাম না, কারণ বাবা শুনবে না। কারণ বাবা শুনতে ভালোবাসে না, শুধু বলতে ভালোবাসে। 


তাই জব্বর ধমকটমক দিয়ে হাওড়ায় তো পৌঁছালাম, পৌঁছে শুনি ডাক্তারবাবুর বাড়িতে কি যেন একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে,তিনি এই সপ্তাহটা বসতে অপারগ। পাড়াতুতো ভাইটি বলল,‘দিদি আমি অন্য ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করে দিচ্ছি খন, আপনি ছুটি নিয়ে এসেছেনই যখন-’। আবার বেঁকে বসল বৃদ্ধ, তিনি দেখালে ঐ ডাক্তারকেই দেখাবেন। অন্য ডাক্তারের কাছে কিছুতেই যাবেন না। হোক না এক হপ্তা দেরী। 


হার মেনে ফিরে এলাম তমলুক। শুধু শুধু আর অফিস ছুটি নিয়ে কি করব? গোঁজ হয়ে বসেছিল বাবা। বেরোচ্ছি যখন, উদাস স্বরে বলল, ‘চলে যাচ্ছ? হ্যাঁ যাও। তুত্তুরী না হলে একা থাকবে। তবে তুমি চলে যাবে ভাবলেই কেন যে মনটা এত খারাপ হয়ে যায়।  আজও-’। একটু বেশিই ডানপিটে বটে বৃদ্ধ, তবে আজও আমিই এই লোকটার সূর্য।


Tuesday 9 August 2022

অনির ডাইরি ৫ই আগস্ট, ২০২২

 


জানলার বাইরে ডুবিছে দিনমণি। দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল সপ্তাহটা। এই তো মনে হয় একটু আগেই বলছিলেন শ্বশুরমশাই, ‘বুঝলে, আমাদের দুই পুত্রবধূই খুব চটপটে।’ ঠিক সেই মুহূর্তেই গভীর মনোযোগ দিয়ে দইবড়া ভাগ করছিলেন শাশুড়ী মাতা, সেই দইবড়া যা আনানো হয়েছে শুধুই আমার তরে। আগাম সতর্ক করে রেখেছিলেন শ্বশুরমশাই, ‘যখন থেকে শুনেছে তুমি আসছ, একটাই কথা বলে গেছে, মেয়েটা অতদূর থেকে আসবে, ভাতও খাবে না, তাহলে ওকে যে কি খেতে দিই। তোমার জন্যই বিল্ডিং এর  সিকিউরিটি গার্ডকে দিয়ে আনিয়েছে। প্লিজ খেয়ে নিও। না বলো না। যা অভিমানী তোমার শাশুড়ী মাতা।’ শাশুড়ী মাতা আর তাঁর দুর্জয় অভিমান উভয়কেই বড় ভয় পাই আমরা দুই বউ, ভয় পায় আমাদের প্রিয় শ্বশুরটাও। শাশুড়ী মাতার মন এবং মান রাখতে ভাত খাবার অনুরোধ এবং আব্দার বেশ কয়েকবার করেছিলেন শ্বশুরমশাইও, শুনতে এবং রাখতে পারিনি। ভাগ্যে পারিনি, নাহলে এই সাড়ে চারটের সময় ভাত খেতে হত বাপ মেয়ে থুড়ি শ্বশুর পুত্রবধূকে। 


শ্রীমতী তুত্তুরীর সঙ্গে ভাত খেয়ে, তাঁকে ইস্কুলে পাঠিয়ে বেলা দশটা নাগাদ বেরিয়েছিলাম তাম্রলিপ্ত নগরী থেকে।  মধ্যাহ্নে মহানগরে পৌঁছে, শ্বশুরমশাইকে বগল দাবা করে রওণা দিয়েছিলাম নিউ টাউনের টাটা মেডিকেল ক্যান্সার হাসপাতালে। বেশ কিছুকাল যাবৎ পারিবারিক ডাক্তার বাবু সন্দেহ করছিলেন, যে পুনরায় বুঝি কর্কট রোগ বাসা বেঁধেছে বৃদ্ধের উদরে। কর্কট ব্যধি আর আমাদের শ্বশুরমশাইয়ের সম্পর্ক অবশ্য নবীন নয়, ইতিমধ্যেই দু বার সোজা ব্যাটে খেলে তাকে মাঠের বাইরে পাঠিয়েছেন ভদ্রলোক। প্রথমবার আমাদের বিয়ের অব্যবহিত পূর্বে, পাকস্থলীতে নন হজকিন্স লিম্ফোমা নামক ব্যামো ধরা পড়ে। কেটে বাদ দেওয়া হয় বেশ খানিকটা পাকস্থলী। নিতে হয় গোটা ছয়েক কেমো। তার জেরে আমাদের বিয়ের দিনই অনুপস্থিত ছিলেন বৃদ্ধ। সেজ জেঠু, ফুল কাকা, মণিকাকার আশির্বাদ আর ভালোবাসায় ভিজতে ভিজতেও নতুন কনে আমার দুই চোখ খুঁজছিল এক রুগ্ন ক্ষীণজীবী বৃদ্ধকে। হাতে হাত রেখে মন্ত্র পড়ার ফাঁকে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম শৌভিককে, ‘বাবা আসেনি?’ 


এর ঠিক সাত বছর বাদে, আবার কর্কটের কামড় পড়ে বৃদ্ধের উদরে। এবার আক্রান্ত হয় কোলন। সে যাত্রা অবশ্যি কেমো নেবার দরকার পড়েনি। তারপর আবার ঠিক বছর সাতেক বাদে পুনরায় কর্কটের পদধ্বনি। বাড়ির ডাক্তার তো হাত গুটিয়ে নিলেন, পাঠিয়ে দিলেন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের কাছে। তিনি দেখলেন বেশ ভালো করে টিপেটুপে। প্রেসক্রিপশনে লিখলেনও NAD অর্থাৎ নাথিং অ্যাডভার্স ডিটেক্টেড। আরও একটা কি যেন লিখলেন যার অর্থ নো লিম্ফ নোড ডিটেক্টেড। তাহলে কি তিনি আসেননি এবার? এটা কি নিছক নিশির ডাক। পুঁচকে ডাক্তারবাবু গম্ভীর হয়ে বলেন, ‘সেটা এখনই বলা যাবে না। আমরা এথিক্যালি পারি না।’ দিলেন গুচ্ছের রক্তপরীক্ষা। প্রত্যেকটা পরীক্ষায় ফুল মার্ক পেয়ে পাশ করেও গেল মাইরি শ্বশুরটা। তাও কেউ বলল না, বাড়ি যান মশাই। আপনি, বিলকুল সুস্থ আছেন। বরং বলা হল, পেট সিটি স্ক্যান করতে হবে। 


ছুটি নিয়ে গিয়ে স্ক্যানটাও করিয়ে আনল শৌভিক। এবার রিপোর্ট নেওয়া আর ডাক্তারবাবুকে দেখানোর পালা। ছুটির দিন বা সপ্তাহান্তে বসেন না ডাক্তারবাবু, শ্বশুরমশাইয়ের দুই পুত্রের পক্ষেই আপাততঃ আরোও একটা কর্মব্যস্ত দিনে ছুটি চাওয়া বা পাওয়াটা বেশ জটিল। উমারাণী তো নড়তেই পারছে না আমাদের দুমাসের প্রাণপুতলী শ্রীমতী ফুলঝুরিকে ছেড়ে। অবশিষ্ট রইলাম আমি। এসব ব্যাপারে আমাকে যে এবাড়ির কেউ ভরসা করে না, অপ্রাপ্তবয়স্ক গোবলু গোবিন্দ বলে মনে করে, তা আমি বেশ বুঝি। তাও নিরূপায় হয়ে আমার সাথেই যেতে হয় বৃদ্ধকে।


রিপোর্টে অবশ্য তেমন কিছু মেলেনি। ডাক্তারবাবু থুতনি চুলকে বললেন, ‘পেট সিটিতে ছোট কিছু তো ধরা পড়ে না। কিছু অ্যানোম্যালি আছে বটে আপনার ফুসফুস গহ্বরে। একটু বুক আর পেটের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখিয়ে নিন বরং। তারপর যদি কিছু পান, আসবেন-’। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে হাঁপানিতে ভুগছেন শ্বশুরমশাই। ওণার ফুসফুস জোড়া এমনিতেই ভয়ানক ঘায়েল। মোদ্দা কথা ইনি কিছু পেলেন না।


 রীতিমত কাল্পনিক ব্যাণ্ডপার্টি বাজাতে বাজাতে বাড়ি ফিরলাম আমরা শ্বশুর আর পুত্রবধূ। মনের খুশিতে আমাকে লুকিয়ে একখান সিঙ্গল মল্টই কিনে ফেললেন বৃদ্ধ। কোন বন্ধুর সাথে কি সব যেন সিনেমা দেখতে যাবেনও ঠিক করে ফেললেন।


 তারপর আর কি, বৃদ্ধকে তাঁর বৃদ্ধার জিম্মায় পৌঁছিয়ে, তাঁর আদরের কনিষ্ঠ পুত্রবধূ থুড়ি কন্যাকে খবর দিয়ে বাড়ি ফিরলাম আমি। আসার আগে অবশ্য খেতে হল দইবড়াটা। মাইরি বলছি, এতটুকুও আপত্তি করিনি আমি। শাশুড়ী মায়ের নিজের হাতে বেড়ে দেওয়া দই বড়া, যা বৃদ্ধা আনিয়েছে শুধুই আমার তরে,এ জিনিস কি সহজে ছাড়া যায়। ভাবলাম ছবি তুলে উমারাণীকে পাঠাই, ‘এই দ্যাখ।আমার জন্য এনেছে, আমায় খাইয়েছে। তোকে দেয়নি, দুয়ো দুয়ো।’ তারপর মনে হল বয়স বাড়ছে, এতটা ছ্যাবলামো করাটা বোধহয় যুক্তিযক্ত হবে না। এইসব করি বলেই এরা আমায় প্রাপ্তবয়স্ক গণ্য করে না মাইরি। তারওপর ওসব দেখে উমারাণী যা হাত পা ছুঁড়বে। নির্ঘাত কথা বলাই বন্ধ করে দেবে কিছুদিনের জন্য।  তাই দইবড়ার ছবি আর তুললাম না, বৃদ্ধের সঙ্গেই একটা ছবি তুললাম। সেটা অবশ্যি উমা রাণীকে পাঠালাম, ওতে তেমন দোষ নেই, বোধহয়। ছবিটা যদিও তেমন ভালো হয়নি,সারাদিনের ক্লান্তি ফুটে উঠেছে দুজনেরই মুখে চোখে তাও বেশ পছন্দ হল উমারাণীর। প্রচুর ভালোবাসা পেলাম হোয়াটস্অ্যাপ মারফৎ। দইবড়ার গল্পটা অবশ্য চেপে গেলাম চুপচাপ-। প্রাপ্তবয়স্ক হতে গেলে ওটুকু তো করতেই হয়

তুত্তুরী আর ফুলঝুরির গপ্প - ২ তাং - ২ রা আগস্ট, ২০২২

 


"একটি আছে দুষ্টু মেয়ে, একটি ভারি শান্ত,/

একটি আছে দখিন হওয়া, আরেকটি দুর্দান্ত।          

আসল কথা, দুটি তো নয় একটি মেয়েই মোটে,

হটাৎ ভালো হটাৎ সেটি দস্যি হয়ে ওঠে।" 

                

 এই তো সেদিনের কথা, ঘোরতর আপিস টাইমে মেসেজ করেছিল উমা, “সোনাইটাকে (ওরফে শ্রীমতী তুত্তুরী) দাও বাপু আমায়, এটাকে(অর্থাৎ শ্রীমতী ফুলঝুরি) নিয়ে যাও। এ মেয়ে শান্ত হবে না গো। দিন দিন এমন পাজি হচ্ছে, সারা রাত তো জেগে কাটাচ্ছেই,যতক্ষণ জেগে থাকছে, সারাক্ষণ ছটফট, ছটফট করছে। একটু এদিক ওদিক হলেই কেমন ক্যাঁক ক্যাঁক করে ধমকাচ্ছে। মাঝে মাঝে বেশ রাগ হচ্ছে কিন্তু আমার। মনে হচ্ছে তোমার ইচ্ছে পূরণ করবে এ মেয়ে, এক নম্বরের গেছো ছানা হবে।”


হ্যাঁ আমি বলেছিলাম বটে গেছো মেয়ে হবে। জন্মেই এমন গালে হাত দিয়ে ঘুমাচ্ছিল শৌভিক তো দেখেই ভবিষ্যৎ বাণী করেছিল, মস্ত ভাবুক হবে এই মেয়ে। ঠিক ওর বাবার মত। গুরুগম্ভীর অধ্যাপক হবে। জটিল আমার মত অধমের অবোধগম্য কবিতা লিখবে। আপত্তি করেছিলাম আমি। মোটেই না, ও আমাদের উমার মত হবে। গেছো মেয়ে হবে একটা। তুত্তুরী বাপু বড় ভালো, ঠাণ্ডা,লক্ষ্মী লক্ষ্মী। মিষ্টি মিষ্টি।  ফুলঝুরি একটু ঝাল ঝাল হোক না। গুণ্ডা হোক বেশ। দু চারজনকে একটু ঠেঙিয়ে টাঙিয়ে আসুক বেশ। 


ফুলঝুরি তার বাপের মত হবে, না মায়ের মত হবে এই নিয়ে এই সেদিনই এত তর্ক করলাম আমরা, আর আজকেই দেখুন কেমন বেমালুম ভোল পাল্টে ফেললেন তিনি। বেটি এমন ভাবুক হয়ে পড়েছে, যেন ভুবনের ভার বাস্তবিকই তাঁর কচি স্কন্ধে। ধন্যি মেয়ে এক্কেরে 😊🙏🏼

অনির ডাইরি ৩১শে জুলাই, ২০২২

 



রাত একটা। চাটুজ্জে বাড়ির বুড়ো দেওয়াল ঘড়িটা যদিও চিৎকার করছে, ‘হুঁশিয়ার! পৌনে দুটো বেজে গেছে কিন্তু।’ ওটা অমনিই করে। সবসময় এক ঘন্টা এগিয়ে দৌড়য়। তাতেই নাকি সবার সুবিধা। 


সামান্য উসখুস করতে শুরু করেছে আমার বাবা। আমাদের আড্ডা শুরু হওয়া ইস্তক গোটা দুই সিগারেট ইতিমধ্যেই ফুঁকে ফেলেছে। আরেকটা ফোঁকার সময় সমাগত। আশি পেরিয়েছে কয়েক বছর হল, সিগারেট ছাড়ার কথা বলে বলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে পারিবারিক ডাক্তার বাবু। দুদিন বন্ধ রাখে বাবা। তৃতীয় দিন থেকে আবার পুনঃমুষিক ভব। মৃদু তাড়া দেয় মা, রাত অনেক হল এবার ঘুমাতে হবে তো নাকি? যাদের উদ্দেশ্য করে তাড়া দিল মা, তাদের একদল, ‘সাইকেলের দুদিক চাকা,মধ্যে ফাঁকা’ গানে উদ্দাম হাত পা ছুঁড়ছে। অপর দল তাদের দেখে হেসে উল্টে যাচ্ছে। আজ দুপুরে হাওড়া থুড়ি বাপের বাড়ি এসেছি আমি আর আমার দ্বাদশী কন্যা তুত্তুরী, কর্মসূত্রে বর্তমানে আমরা তাম্রলিপ্ত নগরীর বাসিন্দা। কাল বিকেলে আবার ফিরে যাব নিজ নিকেতন। আবার শুরু হবে ইঁদুর দৌড়। হাতে অবকাশ বলতে এই রাতটকুই। আমি আর তুত্তুরী হাওড়া এলেই জম্পেশ আড্ডা বসে ব্যাঁটরার চাটুজ্জে বাড়িতে, বাবা আর পিসি দুই ভাইবোন, আমরা তিন খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন, তুত্তুরী আর বুল্লুবাবু দুই মামাতো- পিসতুতো ভাইবোন, আমার মা আর আমাদের আদরের ভাতৃবধূ চৈতি সব মিলিয়ে আড্ডাবাজদের সংখ্যা  কি কম?  আর এটা তো শ্রীমতী তুত্তুরীর জন্মদিন স্পেশাল আড্ডা। শুধু আজকের জন্য শ্রীমতী তুত্তুরীকে নিজে হাতে সাজিয়ে দিয়েছে তার প্রাণাধিক প্রিয় বড় মামী। জন্মদিন উপলক্ষে জম্পেশ দেখে একটা গল্পের বই উপহার দিয়েছে বড়মামা। 


জমে উঠেছে আমাদের আড্ডা থুড়ি পার্টি। নাচ গানের ফাঁকে ফাঁকে চলছে যে যার স্কুলের গল্প। তুত্তুরী আর বুল্লুবাবু অর্থাৎ আমার কন্যা আর ভাইপোর গল্পগুলো আধুনিক যুগের, আমাদের তিন খুড়তুতো-জেঠতুতো ভাইবোন অর্থাৎ অয়ন, অনিন্দ্য আর অনিন্দিতার গুলো মধ্য যুগের, বাবা আর পিসির গুলো সেই আদি প্রস্তর যুগের। তা হোক, স্বাদে-গন্ধে-সৌরভে- দুষ্টুমি আর দুরভিসন্ধিতে সব সমান। উফ কি নচ্ছারই না ছিলাম আমরা। এমন অনেক গল্পই আজকাল আমরা খোলাখুলি বলতে পারি, যা এক দশক আগেও মা বা পিসির সামনে বললে পিঠের চামড়া তুলে ডুগডুগি বাজানো হত। বাবা অবশ্যি চিরকালীন বেস্ট ফ্রেণ্ড। 


স্বর্গীয় ছোটকাকুও তাই ছিলেন। তাঁর গল্পও ওঠে কোন না কোন প্রসঙ্গে। উঁচু টেবিলের ওপর দাঁড় করানো,নকল মুক্তোর মালা পরানো ছবিটায় কি কোন আলোড়ন ওঠে? খেয়াল করি না কেউ। হয়তো পাশের ছবিটা থেকে খেয়াল করেন ছোট কাকিমা। আজ যেমন অনিন্দ্য, ছোটকাকুর হাতে বিভিন্ন কারণে ঠ্যাঙানি খাবার গল্প বলছিল। রঞ্জিত মল্লিকের মত বেল্ট খোলার বদভ্যাস থাকলেও ছোটকাকুর হাতই ছিল যথেষ্ট। 


মারকুটে অবশ্য আমার মাও কম ছিল না। শৌভিক বিশ্বাস করে না, কিন্তু কাঠের লম্বা স্কেল থেকে, হাত পাখার হাতল, প্লাস্টিকের চিরুনি, সাঁই করে ছুটে আসা হাওয়াই চপ্পল কিসের দ্বারাই না আহত হয়েছি আমি। হাওয়াই চটির মহিমা আপামর রাজ্যবাসীর ঢেড় আগে থেকে টের পেয়েছি আমরা। অয়ন, অনিন্দ্যও কি ও রসে থুড়ি অভিজ্ঞতায় বঞ্চিত ভেবেছেন।


মা আবার মৃদু তাড়া দেয়। বুড়ো ঘড়িতে সোয়া দুটো। মানে রাত দেড়টা। চুনোপুঁটি দুটো তখনও হাত পা ছুঁড়ছে কি যেন ভয়ানক গানে। এইসব অনিন্দ্যর অপকীর্তি। কোথা থেকে বানায় এমন প্লে লিস্ট ভগবান জানে। ব্যাটারা একটা ভদ্রসভ্য গান চালা না। অয়ন বিরক্ত স্বরে বলে, ‘ওসব মুর্গি ডান্স বন্ধ কর। রাতে ঘুম আসবে না তোদের। দাঁড়া আমি একটা চালাই।’ ঘর ভেসে যায়, ‘পহেলা নেশা’র মূর্ছনায়। 


আবার তাড়া দেয় মা। সিগারেট ধরিয়ে উঠে পড়ে বাবা। সম্প্রতি ভাইরাল ফিভার থেকে উঠে বড্ড দুর্বল হয়ে গেছে বাবা। কানেও যে কি বাঁধিয়েছে। পিছন থেকে গাড়ির হর্ন শুনতে পাবে না এই ভয়ে বেশ কদিন আর রাস্তায় বেরোচ্ছে না বাবা। বিরাম নেই শুধু সিগারেট টানার। রাত দশটা থেকে এইটি তিন নম্বর সিগারেট। তাহলেই বুঝুন।


মায়ের তাড়া খেয়ে মনে পড়ে যায়, কেকটাই তো কাটা হয়নি এখনও। আজ আমাদের পার্টি শুরুই হয়েছে একটু বিলম্বে। প্রায় রাত দশটায় আপিসের কাজ মিটিয়ে বাড়ি ফিরেছে অনিন্দ্য। আসার সময় ভাগ্নির জন্য বয়ে এনেছে জব্বর একখান কেক। কেক কম, ক্রিম বেশি। ঠিক যেমনটি ভালোবাসেন শ্রীমতী তুত্তুরী। হাক্লান্ত অনিন্দ্যকে একটু ধাতস্থ হবার সময় দিতে গিয়ে আর কাটাই হয়নি কেকটা। ঠিক হয়েছিল, নৈশ ভোজন মিটলে, ওটা আমরা ডেজার্ট হিসেবে খাব সবাই মিলে। 


মায়ের গুঁতো খেয়ে অবশেষে চটজলদি সাজানো হয় কেকটা। গ্লাসে গ্লাসে ঢালা হয় জিরু। আমাদের আড্ডা বসবে আর জিরু বাবু থাকবে না, তাও কি হয়। কেককে ঘিরে সুন্দর করে সাজানো হয় জিরুর নটি গ্লাস। ছুরি নিয়ে প্রস্তুত হয়ে যান শ্রীমতী তুত্তুরী।  মামা-ভাগ্নি অর্থাৎ অনিন্দ্য এবং তুত্তুরীর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও কেকের ওপর থেকে রং মশালটা সরিয়ে দিই আমি। ওটা মহা আপদ। বড্ড বারুদ ছেটায়। আর এর আগেও তো দুবার রং মশাল জ্বালিয়ে কেক কেটে ফেলেছে তুত্তুরী। পরিবেশের আর কত ক্ষতি করবি বাপু তোরা। যুক্তিতে হেরে গিয়ে পিছিয়ে যায় মামা ভাগ্নির টিম। স্পিকারে বেজে ওঠে, "হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ" এর  ধুন। কেকের একটা পুঁচকে টুকরো কেটে সবার মুখে মুখে ধরে তুত্তুরী। কেক কামড়াতে গিয়ে তুত্তুরীর আঙ্গুল মৃদু কামড়ে ফেলে পিসি, হাসির হুল্লো়ড় ওঠে একচোট। কে যেন বলে আসছে বছর আবার হবে, হোক হোক বলে উল্লাস জাহির করে জিরুর গ্লাসে ঠোঁট ডোবাই আমরা। কে জানে কি হবে আসছে বছর, বাবা মা পিসির স্বাস্থ্য প্রতিদিন ভেঙে পড়ছে একটু একটু করে। ওরাই তো আমাদের শিকড়, যতদিন ওরা থাকবে ততোদিনই মূলের সঙ্গে যুক্ত থাকব আমরা, আর তারপর কি হবে- সে চিন্তা এই মুহূর্তে করে লাভ কি? আপাতত এই সুখের মুহূর্তটাকে তো পান করেনি এক নিঃশেষে। কাল যা হবে,দেখা যাবে।