Monday 5 April 2021

ইতি তোমার মা-

 ইতি তোমার মা- ৫ই এপ্রিল, ২০২১


প্রিয় বুকু,

কি করছ? আজ ভীষণ ইচ্ছে করছে তোমায় একটা চিঠি লিখি। আমরা যত মেসেজে দড় হচ্ছি, ততোই ভূলে যাচ্ছি চিঠি লিখতে। আমরা কথা বলছি, সারাদিন কথা বলছি, তবুও ঠিক সম্পূর্ণ হচ্ছে না ভাবের আদানপ্রদান। অনেকদিন অভ্যেস নেই তো, জানি না কেমন লিখব, ভূলত্রুটি হলে মার্জনা করো। 


আজ তোমার জন্য একটু বেশীই মন খারাপ করছে কি না, তাই ভাবলাম তোমায় একটা চিঠিই লিখি। যেমন লিখে,সেঁটে রেখে যেতাম ফ্রিজের গায়ে। তুমি তখন আরও অনেক অনেকটা ছোট। সকালের স্কুলে পড়ো। ভোর ভোর তোমায় ঘুম থেকে তুলে, একরাশ মনোবেদনা সহ ছেড়ে আসতাম স্কুলের গেটে। ভারি ব্যাগটা পিঠে নিয়ে প্রবল অনিচ্ছা আর অপরিসীম ক্লান্তি নিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে একবার পিছন ফিরে তাকাতে তুমি, আমি হাত নেড়ে ইশারায় বলতাম এগিয়ে যাও। মাথা নীচু করে, মাটিতে পা ঘষতে, ঘষতে এগিয়ে যেতে তুমি। এরপর তোমার সাথে দেখা হতে-হতে সন্ধ্যা ঢলে পড়ত রাতের পথে।  


অধিকাংশ রাতেই তোমাতে পড়তে বসানো নিয়ে বাঁধত অশান্তি। দুচার ঘা উত্তমমধ্যম খেয়েই যেতে তুমি। সকাল হলে তোমায় স্কুলের গেটে ছেড়ে আসার সাথে-সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকত মনস্তাপ। প্রতিটি সকালে আমি নতুন নতুন করে উপলব্ধি করতাম,কতটা, ঠিক কতটা বদলে দিয়েছ তুমি আমায়। বদলে দিয়েছ জীবন তথা সম্পর্কের যাবতীয় সংজ্ঞা। বেশি শক্ত হয়ে গেল বুঝি, সহজ করে বলতে গেলে, বুঝতে পারতাম আমার জীবনের কতটা জুড়ে একচ্ছত্র রাজত্ব করো তুমি। অথচ রাতে ফিরে তোমায় পড়াতে বসালেই কিভাবে যেন কর্পূরের মত উবে যেত সারাদিন ধরে লালন করা যাবতীয় সুকুমার অনুভূতিগুলো। তাই আঁধার নামার আগেই লিখে রাখতাম চিঠিগুলো। 


মনে মনে ভাবতাম অনেককিছুই, লিখতে পারতাম থোড়াই। আর লিখে ফেললেই বা কি হত? না তুমি ভালো করে পড়তে পারতে বাংলা, না ইংরেজি। মনে আছে, বাবা তোমাকে ক্ষেপাতে বলত, ‘তুই অশিক্ষিত, তাই তোর আধারকার্ড হবে না। ’ একেবারে অশিক্ষিত না হলেও সদ্যস্বাক্ষর তো ছিলেই তুমি। তাই দুচারখানা মনের কথা লিখেই আঁকতে বসতাম ছবি। পড়তে না পারলেও ছবির ভাষা তুমি দিব্যি বুঝতে। হয়তো সব শিশুই বোঝে। ভালো তো আঁকতে পারি না,তবুও একটা যে কোন পশুর ছবি এঁকে, তার চোখ থেকে টপটপ করে ঝরে পড়া জলকণার ছবি আঁকলেই তুমি বুঝতে পারতে মায়ের মনে ঘনিয়েছে ঘোর কৃষ্ণ মেঘের ঘনঘটা। আপিস থেকে ফিরে হতভম্ব হয়ে দেখতাম, পাশে কচি কচি হাতে আঁকা ঐ পশুটিরই একটি শাবক। তারও মনে জমেছে মেঘ, তারও উছলে উঠেছে ছলোছলো আঁখি। মমির মন খারাপ, তাই বেবিটারও মন খারাপ বোঝাতে চাইতে তুমি। 


কখনও বা একটা বড় ফুল/পাখি বা বিড়ালের পাশে আরেকটা ছোট্ট ফুল/পাখি/বিড়াল এঁকে উভয়ের মাঝে একটা পুঁচকে পানপাতা এঁকে রেখে যেতাম। তুমি উভয়ের আসেপাশে এঁকে রাখতে আরো অনেক অনেক পানপাতা। বেবিটাও যে মাকে ভীষণ ভালোবাসে। কখনও কখনও তুমি খাতার পাতার কোণা ছিঁড়ে এঁকে রাখতে তিনটে বিভিন্ন মাপের পুঁচকে হাসিখুশি মুখ। তারপর উপহার দিতে আমাদের। উপহার পছন্দ হয়েছে কিনা জানার জন্য লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে আমাদের মুখের পানে।


জানিনা তোমার মনে আছে কিনা, কিন্তু এমন প্রতিটা চিরকূট, প্রতিটি চিঠি যত্ন করে গুছিয়ে রাখতে বলতাম আমি। কারণ এই সমস্ত চিঠির আঁকিবুকি, সমস্ত ছবির বাঁকে লুকিয়ে আছে তোমার অমূল্য শৈশব। পুতগন্ধময় e-জগতের বাইরে তোমার একেবারে নিজস্ব মোমরঙের দুনিয়া। 


এই দেখো লিখতে বসেছিলাম আমার কথা, আমার বর্তমান পরিস্থিতি, আমার ভালো লাগা না লাগার কথা, অথচ লিখে চলেছি তোমার,শুধু তোমার কথা। মা হবার এটাই সবথেকে বড় যাতনা। জীবনটাই যে আবর্তিত হয় তোমাকে ঘিরে। তুমি হলে আমার সূর্য, আর আমি তোমার বুড়ো পৃথিবী। 


ইতি

তোমার মা।

Saturday 6 March 2021

অনির ডাইরি মার্চ, ২০২১


অনির ডাইরি ৩০শে মার্চ, ২০২১


পাঁচশ বছরেরও বেশী পুরাণ শহরটায় যখন ঢুকলাম, তন্বী সন্ধ্যা ততোক্ষণে পা বাড়িয়েছে গভীর রাতের পানে। কাঁধে মাথা রেখে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন তুত্তুরী। দোলে ফিরে আসছি নিজের শহরে, প্রতিবারই শহরে প্রবেশের সাথে সাথে উদ্দাম আনন্দের পাশাপাশি এক অজানা আশঙ্কায় মৃদু কেঁপে ওঠে হৃদয়, কতদিন, আর ঠিক কতদিন বাঁধা থাকবে এই গাঁটছড়া? এমনি সজীব থাকবে সম্পর্কের শেকড়বাকড় গুলো? প্রতিটি পল অনুপলে কেমন যেন একটু একটু করে বুড়িয়ে যাচ্ছে, চেনা মানুষগুলো। একটু একটু করে মুছে যাচ্ছে সোনালী অতীত, আলগা হয়ে আসছে আশৈশব লালিত বাঁধন। 


কোণা এক্সপ্রেস ওয়ে বরাবর ছুটে আসা গাড়িটা আচমকা বেলেপোল থেকে ধরে নিল বাঁদিকের সরণি। তু্ত্তুরীর মুখ আর মাথা আবৃত পুরু আবিরে। গাড়ি ছোটে, পেরিয়ে যায় ৫২র চৌরাস্তা,পেরিয়ে যায় পুরাণ ইছাপুর রোড, ইছাপুর জলট্যাঙ্কের কাছে ক্ষুদিরামের মূর্তিকে ডানহাতে রেখে কদমতলা বাজারের দিকে বেঁকে যাই আমরা। পথে গমগমে ভিড় কিছুক্ষণ রেস্তোরাঁয়, এই অঞ্চলে কত যে রেস্তোরাঁ  খুলল আর বন্ধ হল, কিছুক্ষণের জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়েনি তিলমাত্র। খাবার যে অনবদ্য তা নয়, তবে সুস্বাদু এবং বেশ সস্তা। কতবার যে আমি,চৈ, সঞ্চিতা আর দেবারতি এখানে নৈশাহার সেরে, রাত এগারোটা নাগাদ হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরেছি। কি নিরাপদ ছিল আমাদের জনপদটা, হয়তো এখনও তাই আছে, তবে আমরা একটু বেশীই বেপরোয়া ছিলামও বটে। অন্তত মায়ের তাই অভিমত, হোটেলওয়ালারা, এবার ওঠ মামণি, তালা মারব মার্কা কিছু বলে ঠেলে না তুললে আমরা  উঠতাম থোড়াই? বকেই যেতাম, কি যে এত কথা জমে থাকত আমাদের। তবে মাঝেমধ্যেই এসে ঢুঁ মারতেন রবি ঠাকুর। দেবা থাকবে আর দাড়ি বুড়ো থাকবে না? 


পাওয়ার হাউসের মোড় থেকে ডানদিকে বেঁকে বাবাকে ফোন করলাম, একটু আসতে পারবে কি। টুকটুক করে জমেছে অনেকগুলো প্যাকেট। মাত্র চারবেলার জন্য পিত্রালয়ে আসাটাও যে কি ঝঞ্ঝাট, ব্যাগ ভর্তি করার আগে খালি করতে হয় ঠাণ্ডা আলমারি। এই করতে গিয়ে আবিষ্কৃত হয়, তিন টুকরো মাছ,বেশ খানিকটা ফুলকপি, শুঁটকো মটরশুঁটি, গুচ্ছ খানেক পটল, আধখানা ঢেপসা বেগুন, গুটি কয় উচ্ছে, একছড়া নিমপাতা, এক প্যাকেট বিনস্, গুটি চারেক পাতিলেবু, গাদাগাদা টমেটো আর শশা। এতকিছু থাকা সত্ত্বেও প্রতি সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখি মাসির চিন্তান্বিত বদন, ‘রাতে যে কি তরকারি করি? সব্জি তো কিছুই নেই।’ গোটা সব্জিপাতি শাশুড়ী মাকে গছিয়ে, আধকাটা  ফুলকপি আর শুঁটকো মটরশুঁটি দিয়ে খিচুড়ি আর পটলের বড়া করে খেয়ে এবং খাইয়ে তথা টিফিন দিয়ে বেরিয়েছি। আর এককৌটো ভর্তি খিচুড়ি ঠাণ্ডা আলমারিতে না তুলে ডাইনিং টেবিলে ফেলে রেখেই চলে এসেছি। অতখানি গোবিন্দভোগ চাল আর সোনামুগের ডালের খিচুড়ি, তারওপর ছড়ানো হয়েছে অপরিমিত গব্য ঘৃত, কেন যে তুলে এলাম না? গৃহকর্তা বাড়ি ফিরবেন রাত দশটা নাগাদ, এই পচা গরমে ততোক্ষণে কি আর তা অবশিষ্ট থাকবে? যত বলছি, বাড়ি ফিরে ফেলে দিও, শৌভিক ততোবারই ভয় দেখাচ্ছে, ওটাই খাবে। তবে আজ রাতে নয়, ইতিমধ্যেই দুবার খিচুড়ি খাওয়া হয়ে গেছে। ওটা কাল সকালে খেয়ে আপিস যাবেন বাবু। সাধে কি তুত্তুরী মাঝেমাঝেই, “ঠাম্মার ছেলে বাবা” বলে আদর করে? শৌভিক যথার্থই অতসী দেবীর পুত্র। না শাশুড়ি মা একদানা খাদ্য নষ্ট করেন, না তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র।  


গলির মুখে এসে থামল গাড়ি। দুহাতে চারটে ব্যাগ নিয়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, বাবার জন্য। বৃদ্ধ বলেছে, ‘বুড়ো হয়ে গেছি কিনা, অত তাড়াতাড়ি তো আর হাঁটতে পারি না, তোমরা কিন্তু দাঁড়াবে। চলে আসবে না। ’ আমার হাতে আর তুত্তুরীর পিঠের ব্যাগ ছাড়াও রয়েছে গোটা চারেক প্লাস্টিকের ব্যাগ। কাগজের ঠোঙার বদলে যখন সদ্য আসতে শুরু করল এই ব্যাগগুলো, আমরা বলতাম চিকচিকে। আজকাল আর কেউ বলে না বোধহয়। স্বকীয়তা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে শহরটার। আসল জেল্লা খুইয়ে, কেমনি যেন গিল্টিকরা ফ্যাশনদুরস্ত হয়ে উঠছে আমার শহর। 


বৃদ্ধের হাঁটুর যা অবস্থা, পাঁপড় ভাজার মত মচমচ করে, জোর কমেছে ফুসফুসেরও। আজকাল দু কিলো মালও বইতে পারে না বাবা। রিক্সায় বসে থেকে রিক্সাওয়ালাকে পাঠায় মাল সমেত বাড়ি, হয়তো কমেছে ক্ষয়েছে অনেককিছুই, তবে তিলমাত্র টসকায়নি মনের জোর আর বিক্রম। বুড়ো হলেও রীতিমত রয়াল বেঙ্গল হয়ে ঘুরে বেড়ায় বাবা। গলার শির ফুলিয়ে ঝগড়া করে মায়ের সাথে, সেই জন্যই ডেকে আনা, তুত্তুরীর যা অবস্থা, এইমেয়েকে শ্যাম্পু করাতেই হবে, আর এতরাতে মেয়েকে স্নান তথা শ্যাম্পু করাতে হবে বললেই পত্রপাঠ বিদায় করে দিতে পারে মা। ভুল বললাম, তুত্তুরীকে কেড়ে নিয়ে আমায় বিতাড়নই করবে মা। এই বৃদ্ধের সক্রিয় সমর্থন তাই আমার বড় প্রয়োজন। এত তাড়াতাড়ি তাড়িয়ে দিলে হবে? এখনও তো বাকি কতকিছু, দোলের আগের রাতে পোড়াতে হবে ন্যাড়া, রাত বারোটায় করতে হবে ফিস্টি, দোলের দিনের উদ্দাম রঙ খেলা আর রাতে আমাদের ভাঙ পার্টি। উৎসব থেকে উৎসবেই তো বেঁচে থাকি আমি, যতটা না ভালো থাকি আর তারথেকেও ভালো রাখি আসেপাশের মানুষগুলোকে। এবারেও হবে, সব হবে, আগে তো বৃদ্ধার প্রকোপ থেকে বাঁচি।



অনির ডাইরি ২৯শে মার্চ, ২০২১


মায়ের রান্নাঘরের জানলার বাইরে পূর্ণ মহিমায় বিকশিত দোল পূর্ণিমার চাঁদ। কি যেন বলেছিল চৈতালী, সবথেকে বড়,সবথেকে মাদক মাখানো চাঁদ ওঠে এই বসন্তপূর্ণিমার রাতে। সিদ্ধির নেশায় হাল্কা আচ্ছন্ন তখন আমাদের মন আর মাথা। নিঝুম বসন্তপূর্ণিমার রাতে চৈতালীদের বাড়ির গলি বেয়ে রাজপথের দিকে হাঁটছিলাম আমরা তিনজনা, চৈ, অন্তু আর আমি। গলির প্রতিটি বাঁকে ধাক্কা খাচ্ছিলাম পূর্ণ চন্দ্রের সাথে, পাল্লা দিয়ে চড়ছিল ঝিমঝিমানি। প্রতিটি পদক্ষেপে, মনে হচ্ছিল, কি অসম্ভব সুখী আমরা, এই পুতিগন্ধময় অবহেলার কুলি টাউনেও প্রকৃতি উজাড় করে দিয়েছে তার রূপের ডালি, শুধু, শুধু আমাদেরই জন্য। শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ছিল অসীম,অপরিসীম সুখ- 


এই তো গত পরশুই এসে হাজির হয়েছিলাম অর্ধ সহস্রাব্দী পেরোনো বুড়ো শহরটায়। প্রগাঢ় সন্ধ্যা তখন পা বাড়িয়েছে পূর্ণ রাতের দিকে।  নামানো কাঁচের বাইরে থেকে ছুটে আসা দামাল বাসন্তী হাওয়ায় মাখামাখি ফাগের সুবাস। কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে মৃদু কাঁসরঘন্টার ধ্বনি। কাঁধে মাথা রেখে অকাতরে ঘুমাচ্ছে তুত্তুরী। বড় পরিশ্রান্ত বেচারী,সেই কোন সকালে আপিস টাইমে দুটো নাকেমুখে গুঁজে আপিসে ছুটেছিল মেয়েটা। আপিসটা অবশ্য আমার, তবুও-। 


কি ভূতভূতে করে রঙ মেখেছে মেয়েটা। মাথা,গাল, গলা গাঢ় লাল গোলাপী বেগুনী আবিরে মাখামাখি। অবশ্য যত না মেখেছে, মাখিয়েছে তার পাঁচ গুণ। বলাগড়ের শ্যামলের কালো চুল আর সাদা পাঞ্জাবি লাল-সবুজ মাখামাখি, সৌজন্য আমার, ঝুমার এবং মাম্পির দুহিতা। আমাদের থেকে ঢের সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল ছেলেটা, দুধসাদা পাঞ্জাবি পরে, সাথে ব্যাগ ভর্তি করে এনেছিল ঘরে ভাজা মুড়ি, বাগানের নারকেল, ঝুরি ভাজা, চিনে বাদাম এমনকি একটা ছোট্ট প্লাস্টিকে মুড়ে খানিক ঘানি ভাঙা সর্ষের তেল। আপিসে এসে মুড়ি মাখবে বলে। এমনি করে ছেলেটা, শ্যামল আসা মানেই জম্পেশ করে মুড়ি মাখা। শুধু মুড়ি মাখার জন্যই একটা বড় স্টিলের গামলা কিনে আপিসে রেখে গেছে শ্যামল। পথে কোন দোকান থেকে কিনে এনেছিল রসগোল্লা আর পান্তুয়া। আর এনেছিল ফুল। পলাশের বায়না জুড়েছিল মেয়েরা। পলাশ পায়নি বলে, রাজ্যের হলুদ, লাল ফুল ব্যাগ ভর্তি করে এনেছিল ছেলেটা। যার মধ্যে খানিক হলুদ ফুল আর একখান শুঁটকো গোলাপ তুত্তুরীর মাথায় আটকে দিয়েছিল প্রিয়াঙ্কা। দশ কেজি লাল আবির আনবে বলেও ভয় দেখাচ্ছিল শ্যামল কয়েকদিন ধরে, সেটা যা হোক বলে কয়ে নিরস্ত করা গেছে।


 আমার সাতটা শ্রমিক কল্যাণ কেন্দ্রের প্রতিটি থেকে আসা এজেন্ট আর এসএলওদের বলা হয়েছিল একটা আলাদা রঙের আবির আনতে। যার যা মন চায়, নিয়ে আসুক সেই রঙ। বলাগড় বেছেছিল লাল, সেই হেতু লাল আবির। 


শুধু শ্যামল নয়, সবাইকেই কমবেশী রঙ মাখিয়েছে তুত্তুরী, মায়ের আপিস বলে,একটু বেশীই গুণ্ডামি করে মেয়েটা। আমার অসাক্ষাতে মৃদু শাসনও করে টুকটাক লোকজনকে। এবারের বসন্তোৎসবের জন্য রীতিমত দিন গুণছিল মেয়েটা।  এত আগ্রহের দুটি কারণ, প্রথমতঃ মায়ের নতুন ম্যাডামকে দেখবে আর দ্বিতীয় সিকনি আর লস্যি খাবে। নতুন ম্যাডামকে মা কেন যে, ‘দিদি,তুমি’ বলে সম্বোধন করে এটা নিয়ে অসীম কৌতুহল তুত্তুরীর। আগের উপরওয়ালাদের তুত্তুরী মামা এবং তুমি বললেও, মা তো,‘স্যার, আপনি’ বলেই সম্বোধন করত বরাবর। প্রশ্ন করলে মা বলে, ম্যাডামের সাথে পরিচিতি তো আজ নয়, প্রায় একযুগ আগে। উনিই বলেছেন, রাতারাতি সম্বোধন বদল করার কোন প্রয়োজন নেই।  


মঠ ফুটকড়াইয়ের পাশাপাশি সিকনি অর্থাৎ সিন্নির প্রস্তাবটা ছিল আদতে আমারই, পরে লস্যিটা জুড়েছে ঝুমার আব্দারে। বর্মন সাহেব খানিক ঘেঁটে গিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘সিন্নি হবে মানে? আপিসে সত্যনারায়ণ করবেন?’ না না, পুজো আচ্ছা নয়, শুধু সিকনি থুড়ি সিন্নি মাখা। কে মাখবে সিকনি, ইয়ে মানে সিন্নি? কেন মগরার প্রিয়াঙ্কা আছে না। সবেতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রিয়াঙ্কা। রমেশ আর প্রিয়াঙ্কাকে নিয়ে মোটামুটি যুদ্ধ জেতা যায়, এদের অপরিসীম উৎসাহ আর উদ্দীপনা মাঝে মাঝে আমাকেও লজ্জায় ফেলে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য লস্যি বানিয়েই ক্ষান্ত হল প্রিয়াঙ্কা। সিন্নি মাখা মোটেই সেদিনের ছুকরির কাম না। তারজন্য দরকার পাকা গৃহিণী। 


লস্যিটা অবশ্য বড় দরদ দিয়ে বানিয়েছিল মেয়েটা। বাড়ি থেকে বয়ে আনা স্টিলের হাঁড়িতে কোন খাটাল থেকে কিনে আনা মোষের দুধের দইয়ের সাথে মাদার ডেয়ারির দই মিশিয়ে সামান্য চিনি আর নুন দিয়ে ডাল ঘুটনি দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ঘটঘট করে যে বস্তটি তৈরী হল,সেটা এক্কেরে অমৃত। প্রিয়াঙ্কা অবশ্য তাতে লেবুর রস, বিট লবণ আর জলজিরা মেশাবে বলে উঠে পড়ে লেগেছিল, শেষ পর্যন্ত বড় ম্যাডামের হস্তক্ষেপে তাকে নিরস্ত করা গেল। 


সিকনি থুড়ি সিন্নি মাখল আমাদের বাঁশবেড়িয়ায় এজেন্ট নূপুরদি। পেশায় নূপুরদি অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী।   আরও দুই অঙ্গওয়াড়ি দিদি, আমাদের পোলবার দেবী দি আর মিঠুদির সক্রিয় সহযোগিতায় সিন্নিটা দাঁড়ালো পুরো অমৃত। ওপর থেকে পাকা গৃহিণীরা আলতো হাতে ছড়িয়ে দিল কুচানো আপেল, বেদানার দানা আর ভাঙা কাজু। কাগজের বাটিতে ঘন ক্ষীরের মত সিন্নি মাখা, হাতে তুলে দেবার সময়, মিঠুদি লাজুক হেসে বললেন, ‘আপনি আমাদের মনে রেখেছেন ম্যাডাম, এতেই আমরা খুশি। ’ 


 আবিরে মাখামাখি আমারও মুখ আর মাখা। হাল্কা ঝেড়েছি বটে, তবুও টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে রঙীন ফাগ, রাঙিয়ে দিয়ে যাচ্ছে সাধের কাঁচা হলুদ রঙা তাঁত। ওণার বিগলিত মিষ্টি হাসিটা দেখতে দেখতে সামান্য ব্যথা করে উঠল গলার কাছটা, চুঁচুড়ায় এটা আমার এবং তুত্তুরীর শেষ বসন্তোৎসব। পেশাগত ভাবে পরিযায়ী পাখি আমরা, কবেই ঘোষিত হয়েছে বদলীর হুকুমনামা। কার্যকর হয়নি শুধুমাত্র নির্বাচনী নির্ঘন্ট হেতু। সময় হয়ে আসছে, অনেকদিন তো হল এবার গুটাতে হবে পাততাড়ি। না হয় চলেই যাব, রেখে যাব অগুনতি সুখস্মৃতি আর নিয়ে যাব অনেক অনেকটা ভালোবাসা।


অনির ডাইরি ১৪ই মার্চ,২০২১


অচেনা কলরবে চমকে উঠলাম আমরা। সচকিত হয়ে তাকিয়ে দেখি গটগট করে হেঁটে যাচ্ছেন এক প্রৌঢ়, পরণে গোলাপী টি শার্ট আর নীল ট্রাউজার। পিছন পিছন রীতিমত ভিখারিনীর মত দৌড়াচ্ছেন প্রৌঢ়া, কণ্ঠে কাতর কাকুতি মিনতি, ‘ওগো যেও না। ওগো যেও না। ওগো একটু দাঁড়াও-’। হতভম্বের মত তাকিয়ে ছিলাম শ্বশুরমশাই আর আমি। সময় সকাল নটা। আজকের আবহাওয়াটা বেশ মনোরম, নরম সোনালী আদুরে একটা রোদ ক্রমেই ছায়া মেলছে ধুলিমলিন মহানগরের ওপর। গরম তেমন নেই, বরং একটা বেশ মনোরম ঠাণ্ডা হাওয়ার ঘুর্ণি মাঝে মাঝেই পাক দিয়ে উঠছে শহরটার বুক জুড়ে। ‘এমন বসন্ত দিনে, বাড়ি ফিরি মাংস কিনে’ না করে লং ড্রাইভে যেতে পারলে সবথেকে ভালো হত। ড্রাইভেই অবশ্য বেরিয়েছি আমরা, গন্তব্য শহরের এক প্রসিদ্ধ নার্সিংহোম।  


কি যেন একটা স্ক্যান করতে বলেছে ডাক্তার। তাতে সময় লাগবে ঘন্টা পাঁচেক। ভোর ভোরই বেরিয়ে এসেছি আমরা, রাস্তা পেরিয়ে কোণাকুণি দুচার পা হাঁটলেই হাসপাতাল থুড়ি নার্সিংহোম, কিন্তু ঐ টুকু পথও হেঁটে অতিক্রম করা দুঃসাধ্য শ্বশুরমশাইয়ের পক্ষে। বিগত কয়েকদিনের ঘুষঘুষে জ্বর,শ্বাসকষ্ট আর হাই ডোজের অ্যান্টিবায়োটিকের সম্মিলিত দৌরাত্ম্যে বেশ কাহিল বৃদ্ধ। গাড়ি থেকে নেমে, হাসপাতালের সামনের কেয়ারি করা বাঁধানো বাগানে বসে আছি দুজনে। শ্বশুরমশাইয়ের হাতে ফ্রুট জুসের বোতল, তাতে মেশানো আছে ওষুধ। একঘন্টা ধরে ঢুকঢুক করে খেতে হবে সবটা। তারপরও বসে থাকতে হবে পাক্কা একটি ঘন্টা, তারপর নিয়ে যাওয়া হবে স্ক্যান করতে। হাতকাটা সোয়েটার,মাথায় উলের টুপি পরে এসেছিলেন বাবা, এখন আবার গায়ে জড়িয়েছেন একটা খাদির মোটা চাদর। বাগান থেকে উঠে আসা বাসন্তী হাওয়ায় কিঞ্চিৎ  নাজেহাল বৃদ্ধ, আমি খুলে বসেছি একখান বই, সবকিছুই চলছিল বেশ জম্পেশ আচমকা এই হট্টোগোল। 


গোলাপী টি শার্ট এখন মুখের মাস্ক খুলে প্রবল চিৎকার করছেন প্রৌঢ়ার ওপর। রাস্তার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে জমে উঠেছে রীতিমত নাটক। ফুটপাথের লাগোয়া স্বল্প উঁচু পাঁচিলের এপাশে, সুদৃশ্য বাগানে বসে বই বন্ধ করে হাঁ করে তাকিয়ে আছি আমি। কি ব্যাপার জানি না, তবে বাজে লাগছে খুব। এমন কি ব্যাপার হল যে এইভাবে নিজের স্ত্রীকে জনসমক্ষে অপমান করছে লোকটা। পাশ থেকে শ্বশুরমশাইও বললেন, ‘ছিঃ। কি সব মানুষ। ’ ভিড় জমে গেছে দম্পতিকে ঘিরে। ফুটপাথ বরাবর একটু এগিয়ে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছেন ওণারা,কিন্তু কানে এখনও আসছে উত্তপ্ত বাদানুবাদ। আর কতক্ষণ ঝগড়া করবে এরা? একটা লোকের মাথা ঠাণ্ডা হতে কত সময় লাগে? 

ভদ্রমহিলার জন্য মনের মধ্যে পাক খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক অদ্ভূত খারাপ লাগা। কেমন ভিখারিনীর মত কাকুতি-মিনতি করছিলেন উনি। হয়তো ডাক্তার দেখাতে এনেছিলেন স্বামীকে, এই হাসপাতালটা এমনি মন্দ না, তবে মাঝেমাঝে বড় ঝোলায়। শৌভিকের মত ঠাণ্ডা মাথার ছেলে বা উমার মত শান্ত মেয়েও একাধিকবার রেগে গেছে এদের ওপর। বাড়ির কাছে আর সবরকম টেস্ট হয় এই যা সুবিধা। 


হট্টোগোল ক্রমশঃ বাড়ছে। যারা ভিড় জমিয়েছিল দম্পতিকে ঘিরে, বুঝলাম সবাই একই পরিবারের সদস্য। এখন এক প্রৌঢ়া প্রচুর চিৎকার করছেন, বাগানের গেটের সামনে এসে। এক সিকিওরিটি আর একমহিলা গ্রুপ ডি স্টাফকে হাতপা নেড়ে ভয় দেখাচ্ছেন, ‘তোমাদের আমি দেখে নেবো। দেখ আমি কি করি-’। ট্রেনড স্টাফ এদের,রোজই চারটে লোক অমন ভয় দেখায়, তাই বোধহয় ভাবলেশহীন মুখে নিজের কাজ করে যাচ্ছে দুজনে। খুব ইচ্ছে করছে মহিলা স্টাফটাকে জিজ্ঞাসা করি, ‘ব্যাপারখানা কি?’ পারছি না শুধু পাশে বসে থাকা চাদর জড়ানো বৃদ্ধের জন্য। এমনিতে থিরথির করে কাঁপছেন, তবুও যা বিক্রম, যদি ধমকে দেন-


শৌচাগারে যেতে নিষেধ করছিল ওরা, শরীরে ফ্লুইডটা থাকলে নাকি রিডিং ভালো আসে। হেসে ফেললাম, সত্তরোর্ধ্বো কোন পুরুষকে এতটা জল খাইয়ে ওমন চেপে বসে থাকতে বলছে- এদের বুকের পাটা আছে বলতে হবে। অবশেষে রাজি হয়েছে ওরা, ‘একবার যাবেন কেমন-’। একবারই গেছেন শ্বশুরমশাই, শৌচাগার অদূরেই। দৃষ্টির অগোচর হতেই মহিলা স্টাফটাকে পাকড়াও করলাম, জানতে চাইলাম কেসটা কি? গোলাপী টিশার্টকে দেখা যাচ্ছে না বটে, তবে উত্তেজিত কথা বার্তা এখনও চলছে। বেশ অস্থির লাগছে এদের ঝগড়াঝাটির চোটে। এমন দিনে এত কলহ কেউ করে? 

আচমকা আবার বিরাট হট্টগোল লেগে গেল। উত্তর না দিয়েই দৌড়ল মহিলা স্টাফটি। হাসপাতালের মূল গেট থেকেও ছুটে গেল অনেকে। টেনে অানল চাকা লাগানো বিছানা। কি ব্যাপার হল, ব্যাগপত্র সামলে উঁকিঝুঁকি মারতে পাঁচিলের কাছে গিয়ে দেখি কাকুতি-মিনতি করা প্রৌঢ়া অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন ফুটপাথে। আজব ব্যাপার হাতদুটো তখনও খাড়া হয়ে উঠে আছে ওপরে- ।  


‘কোলাপস্ করে গেছে-’ অসহায় কিঞ্চিৎ  ভীত কণ্ঠে এইকথা গুলো শুনে দেখি কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন বাবা। মুখেচোখে অপরিচিতার প্রতি টলটলে সহানুভূতি। প্রৌঢ়ার আত্মীয়স্বজন যা ঝগড়ুটে, কি আবার বলে বসে, তাই মুখ ঘুরিয়ে জানতে চাইলাম, ‘আপনার হয়েছে?’ জবাব পেলাম টয়লেটটাই খুঁজে পাননি বৃদ্ধ। 


সিকিউরিটি এক কথায় নিয়ে যেতে রাজি হল, তার সাথে শৌচাগারে যেতে যেতে বাবা বললেন ,‘এদের ব্যাপারখানা কি? কিছু জানতে পারলে-’। আর কোন চিন্তা নেই। পুরাণ মেয়েটিও আবার ফিরে এসেছে তার স্টেশনে, তাকে পাকড়াও করলাম, ব্যাপারখানা কি? মেয়েটি কেজো বিরক্তি উগরে বলল, ‘আরে ঐ যে ভদ্রমহিলা সেন্সলেস হয়ে পড়লেন না, ওণার স্বামীর একটা অপারেশন হয়েছে আজ সকালে। অপারেশনের পর বেডেও দেওয়া হয়েছে। দুজনকে দেখতে যেতে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তাতেই এদের রাগ। এরা  সবাই দেখতে যাবে-। নিষেধ করা হয়েছে বলে এত কাণ্ড। ঐ যে মহিলা আমাকে শাসাচ্ছিল ওটা পিসি। অর্থাৎ ঐ বউটার ননদ। কি লাভ হল বলুন তো? একজন এমনিতেই অসুস্থ ছিল, এখন আরেকজনও বেঁহুশ- ’ 


তাজ্জব হয়ে গেলাম শুনে। এত সামান্য ব্যাপার নিয়ে এত অসভ্যতা? আরে কেউ হাসপাতালে ভর্তি হলে দল বেঁধে দেখতে যাওয়াটা চাটুজ্জে আর ঘোষ বাড়ি অর্থাৎ আমার বাপের বাড়ি আর দিদার বাড়ির ট্রাডিশন। তুত্তুরী জন্মের সময় হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে শৌভিক ছাড়াও উপস্থিত ছিল আরো এগারোজন। শ্বশুরবাড়ির দিকেও যখনই শ্বশুরমশাইয়ের কোন অপারেশন হয়েছে ছুটে এসেছেন সেজো জেঠু,মণিকাকা, ছোট পিসেমশাই এমনকি নীচের ফ্ল্যাটের পট্টনায়ক কাকুও। আজই তো বাবা বলছিলেন, ‘ছুটির দিন। তুমি বাড়ি থাকো। আমি বরং পট্টনায়ককে নিয়ে চলে যাব-’।  মোদ্দা কথা, এতজন জমায়েত হন বটে, তবে হাসপাতালের নিয়ম তো কেউ ভাঙেন না। আর ও কেন দেখতে গেল, আমি কেন সুযোগ পেলাম না এই নিয়ে এমন অসভ্যতাও কাউকে কোনদিন করতে দেখিনি। এই কোভিডের বাজারে সর্বত্র ১জন করে ভিজিটর অ্যালাও করে, এরা তো তাও দুজন করেছে। 


বেলা বাড়ছে, শ্বশুরমশাইকে ভিতরে নিয়ে গেল ওরা। দরজার কাছ থেকে সোয়েটার, টুপি আর চশমাটা নিয়ে আবার বাগানে ফিরে এসেছি আমি। অজ্ঞান হয়ে পড়া মহিলার বাড়ির ঝগড়ুটে লোকজন এখন এসে জমায়েত হয়েছে বাইরের বাগানে। পিসি এখনও চেঁচিয়ে যাচ্ছে। ফোনে কাকে যেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লাগাচ্ছে সব। পাশের অল্প বয়সী মেয়েটি বলতে গেল ‘একটু আস্তে’। তাকে কুৎসিত ভাবে ধমকালেন-।  


কানে হেড ফোন গুঁজলাম, স্টারট্রেকই বাঁচাতে পারে এই তিক্ত পারিবারিক দ্বৈরথ থেকে। কপাল মন্দ, স্কান ঘরের পুরুষ নার্সটি বেরিয়ে এসে জানতে চাইল, ২০১৪ সালে বাবার যে কোলনে অপারেশন হয়েছিল তার কাগজপত্র কিছু এনেছি কিনা। দস্তাবেজ তো সব বৃদ্ধ গুছিয়ে এনেছেন, কি কি আনতে হয় ভালো জানিও না। উমাই এগুলো ভালো পারে,  ভালো জানে। তবুও সব ঘেঁটে দেখতে লাগলাম। যদি এনে থাকা হয়- । কানের গোড়ায় এবার হল্লা জুড়েছে সকালের গোলাপী টি শার্ট পরা লোকটি। যার পিছনে ভিখারীর মত দৌড়েছিলেন সেন্স হারানো মহিলা। লোকটি পাকড়াও করেছে অজ্ঞান হয়ে পড়া মহিলার মেয়েকে, তারস্বরে প্রশ্ন করছেন, ‘আমার কি আসার কথা ছিল? না না আগে বলো আমার কি আসার কথা ছিল? তবুও আমি এসেছি-’। এমন দাক্ষিণ্য করার ঢঙে বললেন যে মনে হচ্ছিল উঠে ঘুরে দুটো জবাব দিই, এসে তো ধন্য করে দিয়েছেন মশাই। আপনি এসেছেন বলেই ভদ্রমহিলা এখন হাসপাতালে শুয়ে ধুঁকছেন। সবকথা তো আর বলা যায় না। আর এণার যা বিক্রম-।  


নার্স ভাইকে জানালাম, অপারেশনের কাগজপত্তর কিছু আনা হয়নি। কি হবে এখন? লোকটি দেখছি বলে উধাও হয়ে গেল-। পাশের নাটক এখন পুরোদমে চলছে, জনৈক চামচামত লোক গোলাপী টিশার্টকে তৈলমর্দন করে বলছে, ‘ঠিকই তো। তোমার তো আসার কথাই না। আমি তো অবাক হয়ে গেছি।’ অজ্ঞান মহিলার ভোম্বলমার্কা ছেলেটি কিছু বলতে গেল সবিনয়ে, গোলাপী টি শার্ট তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল,তারপর মেয়েটিকে বলল, ‘শুনে রাখো, তোমার মা আর তোমার এই ভাই তোমার বাবাকে মৃত্যুর শেষ সীমায় নিয়ে চলে এসেছে-’। মেয়েটি হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে করজোড়ে কিছু বলল,ছেলেটি গিয়ে লোকটির পায়ে পড়ল, ‘ অন্যায় হয়ে গেলে মাপ করে দাও। কিন্তু তুমি যেও না। বিশ্বাস করো আমি মাকেও দেখতে নিয়ে যাইনি। জানতাম মা বাবাকে ঐ অবস্থায় দেখলেই কাঁদবে-’। বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল গোলাপী টি শার্ট, তাহলে ঐ লোকটা দেখতে গেল কি করে? আমি দেখতে পেলাম না, ও গেল কেন-’। জবাবে কি বলল ছেলেটি জানি না, দেহবিভঙ্গে বুঝতেই পারলাম বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছে-। মেয়েটি কাঁদছে, যাদের বাবা মা দুজনেই আপাততঃ হাসপাতালে ভর্তি তাদের সাথে চরম খারাপ ব্যবহার করেও গোলাপী টিশার্টের মধ্যে ছিটেফোঁটা অনুতাপের চিহ্ন নেই।ক্ষ্যামা দিয়ে পুনরায় স্টারট্রেকে ডুব দিলাম।  এত অসভ্যতা বরদাস্ত হয় নাকি? ছেলেমেয়ে দুটি কাকুতি-মিনতি করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে বেশ বুঝলাম। এই নাটকের শীঘ্রই যবনিকা পাত হবে হয়তো। তবে আর দেখার ইচ্ছা আমার নেই।  মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালাম, বাপরেঃ ভাগ্যিস এমন আত্মীয়স্বজন আমাদের কেউ নেই। ঐ যে রাষ্ট্রভাষায় বলে না, এমন বন্ধু থাকলে আর শত্রুর কি প্রয়োজন-।


 

অনির ডাইরি ৯ই মার্চ, ২০২১


সিনেমা দেখার ভয়ানক নেশা ছিল পিসির। দোসর ছিল জ্যাঠাইমা। জ্যাঠাইমার বাপের বাড়িও যেহেতু একই মহল্লায়, পাড়ার ছেলেদের দিয়ে গোপনে খবর আনাত জ্যাঠাইমা, কোথায় কি সিনেমা এল। নবরূপমে কি এলো? আর শ্রীরূপায়? শ্যামাশ্রীতে বুঝি বাংলা বই চলছে, পার্বতীতে বাবা তারকনাথ। পুষ্পশ্রী সিনেমা হলের পাশেই গোরস্তান, নাইট শোয় নাকি আম দর্শকের পাশে বসে সিনেমা দেখেন তাঁরাও। বঙ্গবাসীতে আবার অবাঙালী লোকজন বেশী যায়, 'ভদ্দর ঘর কি লেড়কি'রা গেলে আর আস্ত রাখবে ঠাকুমা? তবুও যেত জ্যাঠাইমা আর পিসি। অনিল ধাওয়ানের কি ভয়ানক ভক্ত ছিল দুজনে। ছোট থেকে শুনে আসছি অনিল ধাওয়ান আর রাধা সালুজার সিনেমা মানেই নীল না হলেও আকাশী তো বটেই। আর জুলি? ছিঃ ছিঃ ওসব সিনেমা নিয়ে আমাদের সামনে কথাও বলা যায় না। আমার জন্মের পর, দেখাশোনার দায়িত্ব যখন স্বেচ্ছায় ঘাড় পেতে নিলো ঠাকুমা আর পিসি, সিনেমা দেখতে যাওয়ার ওপর লাগল প্রতিবন্ধ। 


সীমিত সামর্থেও মাসি রাখতে চেয়েছিল মা। রেখেও ছিল কাকে যেন। ঘুমন্ত আমায় ফেলে সে পাঁচিল ধার গিয়ে পাড়ার মাঠে ছেলেদের বল পেটানো দেখছিল নাকি। পরিণতি সহজেই অনুমেয়। মায়ের আপিসে নিয়ে যাবার চেষ্টাও করেছিল মা, ঠাকুমা তখন ঘুরিয়ে দিয়েছিল , তাঁর শাশুড়ীর ডায়লগ,‘সারাদিন বাচ্ছা আপিসে পড়ে থাকবে? বাচ্ছা কি বাপের বাড়ি থেকে এনেছো? ও বাচ্ছা আমার-’। আজও ঠাকুমার সম্বন্ধে বলতে গিয়ে কপালে হাত ঠেকায় মা। ঐ ভাবে বলেছিল হয়তো, তবে ক্ষণিকের তরেও কোনদিন দায়িত্ব এড়িয়ে যায়নি ঠাকুমা। 


ঠাকুমার নির্দেশ মত, প্রায় বুকে করে মানুষ করেছে পিসি। যৌথ সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব,রান্না ইত্যাদি সামলেও খেয়াল রেখেছে আমার। আমার জন্য বেশ কিছুদিন বন্ধ হয়ে যায় পিসির সিনেমা দেখা। তারপর যখন হাঁটতে শিখলাম, ঠাকুমার অসাক্ষাতে আমাকে ট্যাঁকে নিয়েই নবরূপমে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল পিসি। একটা পুঁটলিতে সামান্য ন্যাকড়া চোপড়া আর খিদে পেলে খাবার জন্য কাঁচের বোতলে দুধ এই নিয়ে পিসি গেল সিনেমা দেখতে। গিয়ে দেখে সুপার ফ্লপ সিনেমা। দুপুরের শো পুরো ফাঁকা। একা পিসি আর দোসর আমি আর অদূরে হলের ঝাড়ুদারনি। তাই সই, কোল থেকে নামিয়ে দিল পিসি- হাতে ধরিয়ে দিল দুধের বোতল আর গোটা সিনেমাটা নাকি আমি অন্ধকারে প্রতিটা সিটে হাত বুলিয়েই কাটিয়ে দিলাম। সমস্যা হল ক্লাইম্যাক্সে, হিরো যেই ঘুঁষি চালাল ঢিস্যুম,অমনি আমি ঘুমিয়ে কাদা।ঈশ্বরের দয়ায় চিরকালই হৃষ্টপুষ্ট, পুঁটলি সমেত, ঘুমন্ত ভারী আমাকে কি ভাবে যে পিসি সেদিন বাড়ি এনেছিল এ গল্প প্রতিবার গিয়েই শুনতে হয়। যেমন শুনতে হয়, সরগম দেখতে গিয়ে সোনার দুল হারিয়ে এসেছিল পিসি। সৌজন্য সেদিনের আমি। শুনতে হয় কি যেন এ মার্কা হিন্দি সিনেমা দেখতে গিয়ে, দিদিভাই থাকায় জ্যাঠাইমা আর পিসিকে আটকে দিয়েছিল পুলিশ। দিদিভাইয়ের বয়স তখন তুত্তুরীর বয়সী, ছিলও তুত্তুরীর মত বোকচন্দর। পুলিশকে বলেছিল,‘না গো পুলিশ কাকু, আমার অনেক বয়স-১৭/১৮/১৯/২০ বছর।’ জবাবে পুলিশ  কাকু বলেছিল নাকি, ‘চুপ কর ডেঁপো মেয়ে-’। ডেঁপো মেয়েটার অবশ্যি তাতে কিচ্ছু যেতো আসত না, তিন চার বছর বয়স থেকে বাবা আর ছোটকাকুর সাথে নকশালদের মিটিংএ গিয়ে বসত দিদিভাই। মিটিং শেষে, উঠোনে জমায়েত বাড়ির লোকেদের অবিকল বয়ঃজ্যেষ্ঠ বক্তাদের নকল করে শোনাত মিটিং এর গল্প- ‘তারপর সন্তোষ দা বলল----। জবাবে বনবেহারী দা বলল----। তখন মেজোকাকু বলল----’। সন্তোষ দা আর বনবেহারী দা ছিলেন ডাকসাইটে নকশাল নেতা আর মেজোকাকু আমার বাবা। বাড়িতে যেবার পুলিশের রেড হল, খালি গায়ে একটা চাড্ডি পরে, বাঁশের কঞ্চির ডগায় একটা লাল জাঙিয়া টাঙিয়ে পুলিশের নাকের ডগায় ঘুরছিল দিদিভাই- তবে সে তো অন্য গল্প। 


বয়স বাড়ার প্রধান লক্ষণই বোধহয় স্মৃতিমেদুরতা। কোথা থেকে কোথায় চলে যায় মানসিক তরঙ্গ। বয়স বাড়ে, সময় টপকে নামে এক প্রজন্ম থেকে অন্যে। বদলে যায় কতকিছুই, সমাজ, দেশ, পরিপ্রেক্ষিত, মানসিকতা- বদলায় না শুধু ভালোবাসা। বয়স আর ওজন যতই বাড়ুক, পিসির ভালোবাসা আজও অবিকৃত, নির্ভেজাল,১০০শতাংশ খাঁটি এবং ভয়ানক ভয়ানক দুর্লভ।


অনির ডাইরি ৪ঠা মার্চ, ২০২১

'আমি তোমার কথা বলব কাকে'-


এটা তিলীদের বাড়ি, ওটা সদগোপদের, কড়ুরীদের বাড়ি, সোনার বেনেদের বাড়ি, গয়লাদের বাড়ি, এটা গোপালে বস্তি আর ঐটা বনমালী বস্তি- এই ভাবেই পরিচিত ছিল বাড়িগুলো। পুরোনো পাড়া আমাদের, সববাড়িই নিদেন পক্ষে শতেক বছরের বুড়ো। পাড়া জুড়ে ঘুরে বেড়াত নরম গরম হাওয়া। নকী পিসির বাবা, লাঠি ঠুকঠুক করে হেঁটে বেড়ানো বুড়ো বনমালী ঢ্যাংকে বলা হত বস্তির রাজা। আমরা জানতাম সোনার বেনেদের বাড়ির মেয়েরা অপরূপ সুন্দর হয়, কাঁচা হলুদ রঙা ত্বক, মা দুর্গার মত মুখশ্রী আর গোলগাল গড়ন। ওদের বাড়িতে সোনা নাকি কিলো দরে থাকে- আমরা অবশ্য বাড়ি গুলোকে চিনতাম অন্য নামে, এটা রক্ষেদার বাড়ি, ওটা মৌরি আর তন্দ্রাদিদের। কড়ুরীদের ছিল যমজ বাড়ি, জোড়া বাড়ির উঠোনে ঘুরে বেড়াত বিশাল হোঁৎকা ডোবারম্যান। হাল্কা বিস্কুট রঙা কুকুরটা দৈর্ঘ্যে প্রস্থে ছিল একখানা বাছুরের সমান, শুধু ল্যাজের জায়গায় ছিল ছোট্ট একটা কুণ্ডুলী। বিশাল গেটের ফাঁক দিয়ে নাকটা গলিয়ে যমদূতের মত রাস্তা দেখত সে, পাড়ার নেড়িরা দল বেঁধে যেত ঝাড়ি মারতে। এতজন তপ্ত অনুরাগিনীর রঙ ঢঙ নখরায় বিন্দুমাত্র প্রভাবিত হত বলে মনে হয় না। কেমন যেন তাচ্ছিল্য ভরা উদাস চোখে তাকিয়ে তাকত - 


সেসব দিনকাল ছিল সন্ধ্যে নামলেই আমতেল দিয়ে মুড়িমাখার, দিনকাল হলুদ বাল্বের আলো আর সাদাকালো টেলেরামা টিভির। বুধবারে চিত্রহার আর বৃহস্পতিবারে চিত্রমালার। দিনকাল ছিল জ্যাঠাইমার উনুনের ধোঁয়া আর ভোর ভোর আকাশবাণীর অমৃত সুরের। দিনকাল ছিল গরম কালে কালবোশেখী আর তার ছিঁড়ে যাবার-। সদ্যস্বাক্ষর আমায় পড়াতে এলেন তিলিদের বাড়ির বউ, আমার দিদিমণি। বনেদী বাড়ির বউ, শুনেছি ওণার শ্বশুরমশাইয়ের ছিল বিশাল মুদিখানার দোকান। শ্বশুরের উপার্জন দেখেই বিয়ে দেওয়া হয়েছিল দিদিমণির। ব্যাঁটরা পাবলিক লাইব্রেরির গণ্ডি ছাড়িয়ে, একরাশ বন্ধু হারিয়ে, কান্নাকাটি করে জ্বর বাঁধিয়ে সদ্য ভর্তি হয়েছি তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবনে।  এতদিন মা’ই পড়াত। আপিস ফেরৎ উত্তমমধ্যম সহকারে খানিক পড়ানোর পর মিলত ছুটি। তখন সামান্য সময়ের জন্য অনুমতি মিলত মাকে পড়ানোর। সেই যে সেদিন, ঈশ্বরচন্দ্রের চিত্রখচিত চটি বর্ণপরিচয়ের উ শেষ করিয়েছে মা। এবার মায়ের পালা ঊ পড়ার। মা পড়ল, ‘ভ য়ে ঊ ত, ভূত’। বাবা গো! সটান মায়ের কোলে আমি। পশ্চিমের জানালার ওপারে অন্ধকার ঝাঁকড়া পেয়ারাগাছে পা দুলিয়ে ছিলিম টানা বেহ্মদত্যির সে কি হাসি- 


দিদিমণি কোনদিন গায়ে হাত তোলেননি। অথচ তখন ছাত্র ঠ্যাঙানো ছিল শিক্ষক শিক্ষিকাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। বাবামায়েরাই বলত, ‘বেশটি করে ঠ্যাঙাবেন তো মাস্টারমশাই/দিদিমণি। জলবিছুটি দিয়ে দেবেন এক্কেবারে।’ দিদিমণির ওসব ছিল না, বকতেন প্রচুর, পড়াতে পড়াতে মায়ের সাথে জুড়ে দিতেন সুখদুঃখের গল্প। বাল্বের আলো ঠিকরে আসত ওণার হাতের তুবড়ে যাওয়া সোনার আংটি থেকে, যার ওপরে মিনাকারিতে লেখা ছিল ,‘পুষ্পরাণী’। হাজার অভাবেও গয়না বেচেননি দিদিমণি। এটাই নাকি তিলী বাড়ির বৈশিষ্ঠ্য। অভুক্ত থাকলেও বাস্তু আর সোনা বেচেন না ওণারা। এতো বুঝতাম না,তবে প্রত্যেক সপ্তাহে একবার জানতে চাইতাম কি কি গয়না আছে ওণার- 


শরৎচন্দ্রের লেখার অসম্ভব অনুরক্ত ছিলেন। ওণার মুখে শুনে শুনে অর্ধেক গল্প, চরিত্রের নাম মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল ক্লাশ থ্রি ফোরেই। মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল সাদাকালো যুগের অগণিত বাংলা সিনেমার ডায়লগ আর ঘটনাবলী। সে সব ছবির বোধহয় আর প্রিন্টও অবশিষ্ট নেই আজ। 


বয়স বাড়ার প্রধান লক্ষণই বোধহয় স্মৃতিমেদুরতা। বর্তমান চরম সুখে জবজবে থাকলেও মন ঘুড়ি হয়ে যায় অতীতের চিলেকোঠার জানলা গলে, উড়ে যায় ‘চৈত্রের রৌদ্রের উদ্দাম উল্লাসে’। মেয়েকে দেখাতে বসা ঝাপসা যমালয়ে জীবন্ত মানুষের ডিজিটাল প্রিন্টের আড়াল থেকে বকে যায় কবেই মুছে যাওয়া জীবনের সাদাকালো কোন অধ্যায়। চন্দনগন্ধী ধূপের সুবাসে গুলে যায় কয়েকদশক আগে সদ্য বনেদী বাড়ির চৌকাঠ ডিঙানো এক অভাবী অথচ আত্মাভিমানী গৃহবধূর কাতর অনুরোধ, ওণার বর ধূপকাঠি বাঁধতেন, যদি দু এক প্যাকেট কেনে কেউ।  ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত ঈষৎ নুব্জ দাদামণি স্বয়ং আসতেন ধূপের গোছা নিয়ে- একটু বেশী করে জ্বালানো ধূপের সুবাসে ম ম করত বাড়িটা সকাল- বিকেল।


নাঃ তুত্তুরীর এখনও কোন দিদিমণি নেই, এখনও মায়ের কোলে বসে ‘ভ য়ে ঊ ত’ পড়ার স্তরেই আছে তুত্তুরী। অগোছালো আপিস- সংসার, কিছুই ঠিকমত সামলে উঠতে পারি না, পারি না ভালো পড়াতে, তবে ভালো লাগে ভীষণ। মেয়ের সাথে নতুন করে শিখতে- নতুন করে পা ফেলতে- কবে শিখেছিলাম সব, মনে হয় যেন বিগতজন্মের কথা। নাম বদলে ফেললেও দিব্যি চিনতে পারি, সেই মান্ধাতার যুগে শেখা লসাগু আর গসাগু। নতুন করে শিখি বায়ুতে তিনভাগ নাইট্রোজেন আর একভাগ অক্সিজেন। সেই যে সেবার বড়দার সঙ্গে হাতেকলমে পরীক্ষা করতে গিয়ে ফাটিয়ে ছিলাম মায়ের কাঁচের গ্লাস। আবার ভাঙি নতুন করে, সঙ্গে এবার নতুন দোসর। মা হবার এটাই তো সুবিধে- নতুন করে ফিরে পাওয়া যায় ফেলে আসা সাদাকালো জীবনটাকে। প্রিয় অতীত, তোমায় আমি হারাইনি, আমার ভবিষ্যেতর মধ্যেই লুকিয়ে থাকো তুমি, ফিরে ফিরে আসো প্রতিটা বাঁকে, আরোও অনেক অনেক ভালোবাসা নিয়ে-  জুগিয়ে যাও বেঁচে থাকার রশদ।

Saturday 20 February 2021

অনির ডাইরি ফেব্রুয়ারি, ২০২১

 

অনির ডাইরি ২৫শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১


রিক্সামামা আর রিক্সা চালায় না। প্রথম প্রথম যখন মেয়ে নিয়ে একা থাকতে শুরু করেছিলাম তখন এমনি অনেক সম্পর্ক গড়েছিলাম আমি আর তুত্তুরী। জানতে পারলে হুলো বেড়ালের মত এখুনি ঘ্যাঁও করে উঠবে শৌভিক, ‘একা কেন? আমি কি আসতাম না?’ আসত বৈকি। ব্লক সামলে সুযোগ পেলেই পালিয়ে আসত। যখন আসত মুটে মজুরের মত দোকান বাজার করে দিয়ে যেত। বাকি দিনগুলোয় আপনি অার কপনি ভরসা। 


তাতে যে খুব একটা অসুবিধে হত তেমন নয়,সমস্যা হত তুত্তুরী সর্দিজ্বর বাঁধালে। কেমন যেন ডিনায়ালে ভুগতাম আমি, হয়তো আজও ভুগি। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে ভাবলেই নার্ভাস ব্রেকডাউন হত। এতো আর আমাদের হাওড়া নয় যে, গৌতম কাকুর চেম্বারে গিয়ে বলব ,‘কাকু মেয়েটা ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করছে। দু পুরিয়া ওষুধ দিন তো। ’ ঠাকুমা থেকে তুত্তুরী, চার প্রজন্মের যাবতীয় ছোটবড় অসুখে ডাঃ গৌতম সিংহরায় ছিলেন সাক্ষাৎ  ধন্বন্তরী।  পেশায় ছিলেন হোমিওপ্যাথ ডাক্তার। বাড়ির গ্যারেজের ওপরে ওণার ছোট্ট ডিসপেনসারি, সবসময় গমগম করত রুগীদের ভিড়ে।  রোগ নির্ণয়ের কেমন যেন সহজাত প্রতিভা ছিল ভদ্রলোকের, এমনকি যেসব ব্যধির চিকিৎসা ওণার আয়ত্বের বাইরেও, তাও কেমন একপলকে নাড়ি টিপে ধরে ফেলতেন গৌতম কাকু। 


 রিক্সার ঝাঁকানিতে সম্বিত ফিরে পেয়ে কিঞ্চিৎ  লজ্জিত লাগল। বয়স বাড়ার প্রধান লক্ষণই বোধহয় এই স্মৃতিমেদুরতা। লকডাউনে রিক্সা বেচে জোগাড়ের কাজ নিয়েছে রিক্সামামা। তবে স্বীকার করে না। ফোন করলেই বলে ‘আচ্ছা বওদি। আমিই থাকব। ’ থাকেও। অন্য রিক্সায় তুলে দিয়ে আবার কাজে ফিরে যায়। এদিকে আজকাল ই-রিক্সাই বেশী। চাপলেই দৌড়য়, ভর দুপুরে মেয়ের ইস্কুলে যেতে জাস্ট কান্না পাচ্ছে। কিন্তু নিরুপায়। মেয়ের ইস্কুলের ফরমান ওপরওয়ালীর ফরমানের থেকেও ভয়ঙ্কর। কি সব অলিম্পিয়াডের সার্টিফিকেট এবং মেডেল দেবে নাকি। 


অমন অলিম্পিয়াডে ফি বছর বসে তুত্তুরী। কোনবারই বলার মত কিছু হয় না। না হলেই বেশী খুশি হই আমি। যেটাতে উত্তীর্ণ হয়, সেটার পরের ধাপের জন্য আবার নিয়ে যেতে হয় অন্য ইস্কুলে। যে মহা যাতনার। প্রতিটি পরীক্ষার জন্য মোটা ফি দিতে পাঁজর টনটন করে, কিন্তু না দিলেও নয়। কি যেন একটা পরীক্ষায় জেদ করে ফি দিইনি একবার, রবার্ট ব্রুস একজন সম্মানীয় ব্যক্তি বটে, তবে ওণার মত সপ্তবার্ষিকী ফেল করার পরিকল্পনা না করাই শ্রেয়। সেদিন অফিস থেকে ফেরার পর করুণ মুখে বলেছিল তুত্তুরী, ‘জানো মা, আজ আমি একা বসেছিলাম ক্লাশে। সবাই পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল। ’ সেই থেকে নাক কান মুলেছি, যা বাবা ফেলই করে আয়। মনটা তো খুশি খুশি থাকুক।  


ইস্কুলে বিরাট লাইন। কিসের মেডেল কি বৃত্তান্ত কিছুই না জানা বাবামায়েরা রীতিমত ভোম্বল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অ্যাসেম্বলী হল থেকে কেউ বেরিয়ে এলেই ছেঁকে ধরছে তাকে, ‘মেডেল পেলে?’ যা বুঝলাম মেডেলের সংখ্যা সীমিত। ফলে উত্তর প্রত্যাশিত। ওদিকে বাড়িতে তুত্তুরী রূপার মেডেল পাবে ভেবে নেচেই চলেছে। রূপা নাকি সোনার থেকেও বেশী ঝলমলে। 


অবস্থা দেখে মায়াই লাগল, আহাঃ বড় আশা করেছিল গো। আজ অবধি একটাও মেডেল পায়নি মেয়েটা। বন্ধুরা অনেকেই পেয়েছে, প্রতিবার গল্প শোনায় মেয়েটা। ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল , আরেঃ আমি তো জীবনে কোন মেডেল পাইনি। থুড়ি পেয়েছি প্রচুর, অর্জন করিনি একটাও। 


মেডেল কিছু পেত বটে আমার ছোটদা। কি ভালো যে আঁকত ছোটদা। যবে থেকে পেন্সিল ধরতে শিখেছে, কোন প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়নি। এখনও আঁকে বটে, তবে আজকালকার ছবিগুলো বড় বেশী আঁতেল-আঁতেল মার্কা হয়,কিচ্ছু বুঝি না। ভিন্ন বছর হলেও, একই দিনে জন্ম তাই ছন্দ মিলিয়ে নাম-‘গুনু আর ঝুনু।’ শ্রীমাণ গুনু সত্যিই ভয়ানক গুণের আকর ছিলেন। ততোধিক নির্গুণ ছিলাম আমি। 

তবে ভাইফোঁটার দিনটা এলেই পাল্টে যেত সব হিসেব। সেদিন সম্বৎসরের মেডেল গুলো পরম যত্নে আমার হাতে তুলে দিত ছোটদা।  

ভাইফোঁটায় ছোটদার দেওয়া উপহারের জন্য মুখিয়ে বসে থাকতাম আমি। পুরানো পিচবোর্ডের বাক্সকে সুন্দর করে রঙ করে, রাংতা দিয়ে মুড়ে তার মধ্যে যত্ন করে রাখা মেডেলের পাশে থরে থরে সাজানো থাকত চকলেট। ক্যাডবেরীর যতরকম চকলেট পাওয়া যেত সব দুএকটা করে  সাজিয়ে বাকিটা আমুল,নেসলে আর কফি বাইট দিয়ে ঠাসা থাকত। উফঃ সেই সোনালী বাক্স খোলার উন্মাদনা জীবনে ভুলব? ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ল, এত চকলেট কেনার পয়সা কোথা থেকে পেত ছোটদা? কি আশ্চর্য! এতদিন এই চিন্তাটা কেন মাথায় আসেনি? ছাপোষা মধ্যবিত্ত আরএমএসের কর্মী বড় মেসোমশাইয়ের টানাটানির সংসারে কেউ হাতখরচ পেত বলে কখনও শুনিনি। অনেক কষ্টে তিন পিতৃহীন শ্যালিকা আর চার পুত্রকে মানুষ করেছিলেন স্বর্গীয় বড় মেসোমশাই। পেরেছিলেন শুধু অদম্য জেদ আর অপরিসীম দুঃসাহসে। তাহলে? অত চকলেট কেনার টাকা তুমি পেতে কোথায় ছোটদা?


দুখানি পার্টিসিপেশন সার্টিফিকেট বগলে রিক্সায় উঠেই ফোন করলাম ছোটদাকে, ‘কি ভাবে দিতে ছোটদা?নিজের কি কি প্রয়োজন না মিটিয়ে জমাতে পয়সা? শুধু আমার জন্য?’ প্রশ্ন করতে গিয়ে চিকচিকিয়ে উঠল চোখের কোণা, এত ভালোবাসা দিয়ে গেছে জীবন, অথচ আমি বুঝিনি?ফোনের ওপাড়ে ছোটদার উদাত্ত হাসি, ‘যা যা বাড়ি যা। তুত্তুরীকে যেন ঠ্যাঙাস না। যা ঠ্যাঙাড়ে তুই।’ কি প্রশ্নের কি জবাব। মনে পড়ে গেল, এই কারণে, শুধু কারণেই উদোম হাতাহাতি হত এই ভদ্রলোকের সঙ্গে। সবসময় লুকোচুরি মাইরি। মহা বাজে লোক।

অনির ডাইরি ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১

#শুভভাষাদিবস

সাত সকালে চৈতালী বলল, ‘শোন অাজ ভাষা দিবস, জম্পেশ করে একটা লেখা নামিয়ে ফেল-’। রসাল আলাপচারিতার ফাঁকে এমন বিদঘুটে আব্দার শুনে শঙ্কর শেঠের কথা মনে পড়ে গেল। তাঁর আদরের নন্দন কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগত এবং শতানুরোধেও সক্কাল সক্কাল প্রাতকৃত্য করতে রাজি হত না, তাই শঙ্কর বাবু করেছিলেন কি, পরপর দিন সাত আটেক ভোরভোর শিশু পুত্রকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে শৌচাগারে ভরে দিতেন এবং লাঠি নিয়ে দরজায় বসে থাকতেন। পাক্কা গব্বর ইস্টাইলে,‘ হয় ইয়ে কর, নয় লাঠি খা’। আরে লেখাপত্তর হল ইয়ে মার্কা ব্যাপার স্যাপার, অমন হুকুম দিলেই হয়? প্রসঙ্গতঃ দ্বিতীয় ইয়েটা কিন্তু প্রথম ইয়ে নয়। বুইলেন কি না- একটা সত্যিই ইয়ে আর দ্বিতীয়টা আঁতেল মার্কা আর কি- 


তো যা বলছিলাম, আমি মনে, প্রাণে এবং ধনে ঘোরতর বাঙালী। বঙ্গের রাণী দয়া করে বেতন দেন, তাই মোর সংসার চলে। তবে আমার থেকেও কড়া বাঙালী হল মোর বাপ। যার কাছে আমার বাঙালিয়ানার হাতে খড়ি। রাত নটা নাগাদ, টিভির সামনে বসে, আধ কি সিকিখানা হিন্দি সিনেমা দেখতে দেখতে, চামচে করে চাট্টি শুকনো মুড়ি আর কড়াইশুঁটি খেতে খেতে, মায়ের কাছে এক কাপ চায়ের উষ্ণ প্রেম প্রার্থনা করতে করতেও বাবা হিসেব করে যায়, ‘একটা ষোল আনা বাঙালী(রাণী মুখার্জী), একটা আট আনা বাঙালী (অভিষেক বচ্চন), একটা চার আনা বাঙালী (ঋত্বিক রোশন। ওণার পিতামহী বঙ্গনারী ছিলেন কিনা) আর একটা সাড়ে বারো পয়সার বাঙালী (করিনা কাপুর। তাঁর প্রপিতামহ কোন কালে কলকাতাবাসী ছিলেন-)।’ উফঃ কত্ত বাঙালী। 


নাঃ অধম এখনও ঐ স্তরীয় বাঙালী হয়ে উঠতে পারেনি, তবে ঐ পথেই এগোচ্ছি। দিনদিন আরো আরো বেশী করে বাঙালী হয়ে উঠছি। উল্টো দিকের লোকটা খুব বেশী ইংরেজিতে পটরপটর না করলে বাঙলাতেই কথা বলি। উল্টোদিকের ব্যক্তিটি যদি আমার মাতৃভাষা শুনে , ‘কেয়া’ বলে তো আমিও গোবেচারার মত হাত পা নেড়ে বোঝাই, ‘হিন্দি ভালো নেহি বুঝতা। বাংলায় বোলিয়ে নয়তো ইংরেজি ভি চলেগা।’  চিঠিপত্রে দস্তখৎ তো বাংলা হরফেই করি। ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষকে লিখতে কিঞ্চিৎ সঙ্কোচ নয়, কিন্তু নিম্নতন কর্মীবন্ধুদের যখন চিঠি করি, বাঙলা ভাষাতেই করি। নোটিশ দিলেও বাংলায় দেবার জন্য পীড়াপীড়ি করি, ফলতঃ দশ মিনিটের চিঠি লিখতে ঘন্টা আধেক দাঁত কিড়মিড় করতে হয় এবং নিজের চিঠি নিজেকেই টাইপ করতে হয়। সর্বোপরি নির্ভেজাল বাংলায় গালাগালি দিই। 


এতদসত্ত্বেও খুঁৎ তো থেকেই যায়। আমি হইচই দেখি না। তিলোত্তমা বা তসলিমা ছাড়া সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্য পড়ি না। গানও বেশীর ভাগ সময় অবাংলা ভাষাতেই শুনি।মাসটা ধরতে পারলেও বাংলা তারিখের হিসেব রাখি না। খাবারদাবারের বেলাতেও আমার বিজাতীয় ভিনদেশীয় খাবারে বড় লোভ-।  উপরিউক্ত সবকটি কারণের জন্যই আমি যৎপরনাস্তি লজ্জিত। একুশে ফেবুর ফেবুসমাজ কি আমায় মেনে নেবে Chaitali? 


শেষবিচারে আমি বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের এক অতি নগন্য কিন্তু অতি গর্বিত সদস্যা। দেশস্বাধীন- ভাষাও স্বাধীন। যা খুশি বলুন না মশাই, ভাষা তো শুধু মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম মাত্র। কানে বন্দুক ঠেকিয়ে আপনাকে না বাঙালি করা যাবে, না অবাঙালি। এতই যদি সহজ হত ব্যাপারটা, তাহলে দেশভাগের এত বছর পরেও পদ্মা পেরিয়ে আসা মানুষগুলো আজও সুযোগ পেলেই নিজেদের হারিয়ে যাওয়া পরগণার কথ্য ভাষায় বাক্যালাপ করত না। ভাষার প্রতি প্রেম থাকুক, তবে ভাষা নিয়ে একদিনের গুণ্ডামি না হয় নাই করলাম। ভাষা তো স্থবির নয়, ভয়ানক জঙ্গম। ভিন্ন ভাষা বা আঙ্গিকের দৌরাত্ম্যে থোড়াই হারিয়ে যেতে পারে এমন ভাষা? বিজ্ঞজন যাই ভবিষ্যৎ বাণী করুন না কেন, ভালো করে কান পেতে শুনুন কি কয় আপনার হৃদয়? 


 বেঁচে থাক মোদের ভাষা শতায়ু- সহস্রায়ু হয়ে- বাহুল্যর খোলস ঝেড়ে ফেলে- আবেগে ভালোবাসায় পুষ্ট হোক দিনে দিনে। চলুন, শুভ ভাষাদিবস। ভালো থাকুন, ভালোবাসুন আর প্রাণের ভাষায় কথা বলুন। মাতৃভাষা জিন্দাবাদ, আমরাও, আপনারও, সবার ভাষা জিন্দাবাদ।

অনির ডাইরি ১৯শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১



‘আজ পারলে একটু তাড়াতাড়ি ফিরো মা-’। গ্রীলের ওপাশে কন্যার করুণ মুখ ঘোরতর ব্যস্ত আপিসটাইমকেও থামিয়ে দেয় এক লহমায়। পলকে পিছিয়ে নিয়ে যায় কোন সে সাদাকালো দশকে। সময়ের দর্পণে যেখানে ফুটে ওঠে তুত্তুরীর সমবয়সী চেনাঅচেনা কোন বালিকার সিপিয়া প্রতিবিম্ব। দেড়শো বছরের পলেস্তারা খসে পড়া বুড়ো বাড়িটার দক্ষিণ পশ্চিমের বারন্দা থেকে এমনি করেই কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত, যে। বিশাল বার্মাটিকের সদর দরজা ঠেলে অাপিস বেরিযে যাওয়া লোকটার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলত, ‘একটু তাড়াতাড়ি ফিরো বাবা। এখনও বাকি কত্ত কাজ-’। সোচ্চারে বলতে ভয় পেত, পিছু ডাকতে ভয় পেত সে। 


দুই যুগের দুই কন্যার যাবতীয় উদ্বেগ তথা উৎকণ্ঠার মধ্যমণি একজনই, সপ্তাহের গাড়ি বাঁক নিলেই যে এসে পড়বেন তিনি। এমন অগোছালো ধূলিমাখা আবহে কি ভাবে বরণ করা হবে তাঁকে? শুধুই তাঁর জন্য যুদ্ধকালীন ব্যস্ততায় গোছাতে হবে, সাফাই করতে হবে ঘরদুয়ার। কিনে আনতে হবে ষোড়শ উপাচার, তারপর সাজাতে হবে মনের মত করে। পাততে হবে মঙ্গলঘট, আঁকতে হবে স্বস্তিকা, দুয়ারে বসাতে হবে কলাগাছ আর সবশেষে কাঁপা কাঁপা হাতে বাইরের দরজার সামনে আঁকতে হবে তাঁর পদচিহ্ন, ঠিক যে ভাবে মা লক্ষ্মীর পদচিহ্ন আঁকত ঠাকুমা, ঢুকবে কিন্তু বের হবে না। অদূরে মিলনী মাঠে বসন্তবিলাপী সুর ধরতেন আরতি মুখোপাধ্যায় ‘ধরেছি আর তোমায় ছাড়ব না-’।  


ঘরসাফাই দিয়ে শুরু হয় বাগদেবীর আগমন পর্ব। মা নিষেধ করা সত্ত্বেও নিঝুম দুপুরে স্কচব্রাইট আর বাসনমাজা সাবান দিয়ে দেওয়াল ঘষে তুত্তুরী। মুছে ফেলার চেষ্টা করে দেওয়াল জোড়া অগুনতি ছবি, হাতের ছাপ, ‘মাসি খুব বাজে’ বা ‘আই লাভু মা’ মার্কা ছুটকো বার্তা। কোথাও কোথাও ভুলভাল অঙ্কও কষে রেখেছে তুত্তুরী, দেখতে পেলেই কান ধরে ওঠবোস করায় বাবা, দেওয়াল নষ্ট করার জন্য নয় যোগ/ বিয়োগ বা গুণে ভুল করার জন্য।  


কন্যার ঘর সাফাই করার মরিয়া প্রচেষ্টা দেখেও রাগতে পারে না তুত্তুরীর মা। মনে পড়ে যায় পলেস্তারা খসা, সাবেকী ঠাকুরঘরের কথা। ভিটের মূল কাঠামোর বাইরে টালির চালের ঠাকুরঘরটা বিশেষ রূপে বানানো হয়েছিল প্রপিতামহের জননী স্বর্গীয়া গোলাপসুন্দরী দেবীর জন্য। ঘরের লাগোয়া চকচকে কালো রোয়াকটা ছিল তাঁর গোঁসা ঘর বুঝি। গোঁসা হলেই আঁচল বিছিয়ে শয্যা নিতেন তিনি। কলকাতা তখনও ভারতের রাজধানী। অনুশীলন সমিতির উৎপাতে বঙ্গভঙ্গের চিন্তা সদ্য ঢুকছে গোরাদের গোবরভরা মস্তিষ্কে। 


ঠাকুরঘরের লাগোয়া আমগাছটি অবশ্য নবীন। পাঁচ সাত রকম আমের আঁঠি থেকে গজানো একগুচ্ছ চারা মিলে তৈরী করা মহীরুহের এক একটা আমের সোয়াদ ছিল এক একরকম। সবই চিনি গোলা যদিও। গ্রীষ্মকালে টুপটাপ ঝরে পড়া আমে ফি বছর ভাঙত টালি। আম- কাঁঠাল আর পেয়ারার লোভে হামলা চালানো হনুমানের দলও ভাঙত কিছু টালি। বর্ষাকালে চুঁইয়ে নামত সজলধারা। দেওয়ালগুলোও ছিল ড্যাম্প ধরা। আয়নার মত চকচকে কৃষ্ণবর্ণ মেঝের মুখে শতেক বলিরেখা।


 এহেন ঠাকুরঘরকেও কেমন যেন রাজপ্রাসাদ বানিয়ে ফেলত বাবা রাতারাতি। মায়ের বাতিল ঝলমলে ব্যাঙ্গালোর সিল্ক দিয়ে রচিত হত পিছনের চালচিত্র। অমনি কোন শাড়ি দিয়েই মাথায় টাঙানো হত চাঁদোয়া। দীর্ঘ দুই তিন মাস ধরে জমানো সিগারেটের খোলের পাহাড় থেকে রাংতা বার করতে বসতাম আমরা তিন খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন। আপিস ফেরতা ক্লান্ত হাতে নিটোল ফুল কাটত বাবা। টিভি সিরিয়াল দেখার ফাঁকেফোকরে অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে ময়দা গুলে স্টোভে ফুটিয়ে আঠা বানিয়ে দিত জ্যাঠাইমা। অতঃপর ঠাকুর ঘর জুড়ে টুপটাপ ফুটে উঠত সোনালী রূপালী ফুলের দল। বিরাট উঠোনের কোণায় কোণায় ঝুলত লাল-নীল-সবুজ শিকলি। 


ফেলে আসা সময়টাকে আঁকড়ে ধরতে আপিস ফেরতা পাঁচরঙা মার্বেল পেপার কিনে আনে তুত্তুরীর মা। রান্নাঘরের ভোঁতা ছুরি দিয়ে কাগজ কেটে ফেভিস্টিক দিয়ে মেয়েকে শিকলি বানানো শেখানোর সময়, কেন জানি না গলার কাছটা ব্যথা ব্যথা করে তুত্তুরীর মায়ের। কাগজের খসখস শব্দের আবডালে ফিসফিসিয়ে কাকে যেন বলে তুত্তুরীর মা, 'দেখো বাবা, আমি আজ তোমার ভূমিকায়-'। 


নামভূমিকায় অভিনয় হয়তো করা যায়, কিন্তু আসলকে বোধহয় কোনদিনই ছুঁতে পারে না নকলনবীশের দল। গাঁদাফুলের মালা, আম্রপল্লব, পঞ্চগুঁড়ি, পঞ্চশস্য, পঞ্চরত্ন, চাঁদমালা কিনতে গিয়ে তাই বোধহয় হাত বাড়িয়ে সেই চেনা, চির নির্ভরশীল হাতটাই খোঁজে তুত্তুরীর মা। জ্বলে যাওয়া ফর্সা রঙা হাতটায় বারো মাস থাকে সস্তা সিগারেটের গন্ধ।  কত বছর পেরিয়ে যায় এই গন্ধ আর এই স্মৃতি গুলো কেন যে যুগান্তরেও থেকে যায় অবিকৃত?


পাঁচালি খুলে ভুলভাল উচ্চারণে মন্ত্র উচ্চারণে, দেবনাগরী অলিগলিতে হোঁচট খেতে খেতে, করজোড়ে বসে থাকা ভক্তিমতী কন্যার বিনম্র আঁখিপল্লবে, সন্ধ্যাপ্রদীপের কম্পমান শিখায় কি যে খোঁজে তুত্তুরীর মা। চোখ বন্ধ করে বসে থাকা ভক্তিমতী তুত্তুরীর মধ্যে হয়তো সেই সিপিয়া রঙা মেয়েটা আর সাদাকালো সময়টাকেই খোঁজার চেষ্টা করে তুত্তরীর মা। সময় বড় নির্মম, পট ঠিক রাখলেও কেমন বদলে বদলে যায় কুশীলবরা। আজ বাবার জুতোয় পা রেখেছি আমি, কাল হয়তো  অন্য কেউ থাকবে আমার ভূমিকায়। পড়ে থাকবে শুধু একমুঠো স্মৃতিমেদুরতা।


অনির ডাইরি১১ই ফেব্রুয়ারি ২০২১

অতসী দেবী জিন্দাবাদ- 


ভদ্রমহিলা আপাততঃ বেশ ভালো আছেন। অবশ্যি থাকারই কথা, প্রাকবিবাহ যুগ থেকে শুনে আসছি ওণার অতিমানবিক শক্তি তথা কর্মদক্ষতার উপাখ্যান। বয়স কালে ভদ্রমহিলা শুধু যে অসীম শক্তিশালিনী ছিলেন তাই নয়, যে কোন গৃহকর্মে ওণার পারিপাট্য তথা নৈপুণ্য প্রবাদপ্রতিম। এ হেন ভদ্রমহিলা খোদ যখন আমায় বধূ হিসেবে বরণ করে এনেছিলেন তখনই আমার গর্ভধারিণী বলেছিলেন, ‘আমার মেয়েটা ন্যাদোশ। ঢ্যাঁড়শ এবং হদ্দ কুঁড়ে। সবথেকে বড় কথা ভয়ানক নিদ্রাকাতর।’ অর্থাৎ বহির্রঙ্গ দেখে বিমোহিত হবেন না। জবাবে উনি বলেছিলেন, ‘আমার ছেলেটা আবার ভয়ানক কর্মঠ। একজন যদি গৃহকর্মে ব্যাপৃত থাকে, আরেকজনকেও তখন উঠতেই হবে। আর অপ্রয়োজনে ওঠার দরকারটাই বা কি?’ 


ভদ্রমহিলা ওমনি। চেনা শাশুড়ির ছকে ফেলা বেশ মুস্কিল।আর পাঁচটা পুত্রবধূর মতোই আমি আর উমা বেশ সমীহ করে চলি আমাদের শাশুড়ি মাতাকে। সমীহ ছাড়ুন, পাতি বাংলায় বেশ ভয় পাই এণাকে। শ্বশুরমশাই অবসর প্রাপ্ত জাঁদরেল আমলা হলেও তাঁর সঙ্গে তর্ক করা যায়, ভুলো স্বভাব নিয়ে খিল্লি করা যায়, ফোকটে দেওয়া যায় খানিক জ্ঞানও,এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে ধমকানোও যায়। কিন্তু এই ভদ্রমহিলার ভয়ে রীতিমত কম্পমান আমরা। 


যাই হোক ফিরে যাই ভদ্রমহিলার ভালো থাকার গপ্পে, গত পরশুই ওণার উদরে তিনখানি ফুটো করেছেন ডাক্তারবাবু, জনৈক সুপার স্পেশিয়ালিটি হাসপাতালের লবিতে একাকী সেদিন বসে বসে ভাবছিলাম, প্রতিদিন কত মানুষই না অসুস্থ হন। ঘোরতর কর্মব্যস্ত দিনেও কি মারাত্মক ভিড়ের দৌরাত্ম্য। পৌনে একঘন্টারর মধ্যেই জনা সতেরো বয়ঃজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি এবং বেতো মহিলাকে আসন ছাড়লাম। আপদ করোণার জন্য চেয়ারের সংখ্যা অসম্ভব সীমিত। এদের নিয়ম রুগী পিছু মাত্র একজন সঙ্গী কেবল হাসপাতালে ঢুকতে পারে। আর ডাক্তারের কাছে বা বিলিং সেকশনে অনুমোদন পায় কেবল একজন। একটু আগেই জনৈক বৃদ্ধ চিৎকার করছিলেন, ‘এখানে কত রুগীর সঙ্গে চারজন করে লোক ঢুকছে দেখতে পারছেন না আপনারা?’ বৃদ্ধকে তাঁর বৃ্দ্ধার থেকে আলাদা করার চেষ্টা করছিল মহিলা নিরাপত্তা রক্ষী। তাই এই ক্ষোভ। পাশ থেকে উমা ফিসফিস করে বলল, “কাল এই  নিয়ে এই এক বৃদ্ধ দম্পতি কি ঝগড়া করছিল দিদিভাই। বৃদ্ধ বলছিল ‘আমি যাব’ আর বৃদ্ধা বলছিল, ‘তুমি ঢ্যাঁড়শ। কিচ্ছু মনে করে বলতে পারো না। আমি যাব।’“ অন্য সময় হলে হয়তো হাসতাম, কিন্তু সেদিন তো বেআইনি কাজ করেছি আমরা দুজনেও। একজন ঢুকেছে শাশুড়ি মায়ের সাথে আর আমি বলেছি, আমিও রুগী, আমারও পেটে ব্যথা। 


পেটে ব্যথা অবশ্য কারোর নয়। শাশুড়ী মায়ের পেটে পাথর জমেছে বটে, তবে ব্যথা বেদনা কিচ্ছু নেই। ওণার বমি করার অভ্যাস বরাবরের। বারো বছর ধরে দেখছি, মাঝে মাঝেই অমন গা কাঁপিয়ে বমি হয়, উনি একবেলা নিঝুম হয়ে পড়ে থাকেন, বারো ঘন্টা কাটতে না কাটতেই আবির্ভূত হন পুনর্বিক্রমে। আবাসনের দত্ত ডাক্তার বলতেন এর নাম ভার্টিগো। আমরাও জানতাম, মাঝে মাঝে ওণার ভার্টিগোর অ্যাটাক হয়। 


হঠাৎ করে বছর দুয়েক আগে জানা গেল ওণার পাথুরী হয়েছে। ফিরিঙ্গি ভাষায় গল ব্লাডারে জমেছে পাথর কুচি। কে জানে হয়তো সেই কারণেই এত বমির দমক। গল ব্লাডারে অপারেশন তো মামুলী ব্যাপার। পেটে তিনটে ফুটো,ব্যাস-। জনৈক সার্ভিসতুতো দাদার মুখে শুনেছিলাম, তেনার অপারেশনের সময় পাশাপাশি পর্দা দেওয়া বেডে শোওয়ানো হয়েছিল আরো অনেকজন রুগীকে। অতঃপর ঘচাঘচ ফুটো করা, আর টপাটপ পাথর পড়া। ভদ্রলোক মহা ফাজিল, মস্করা করেছিলেন কি না জানি না, তবে আমার মায়ের ক্ষেত্রে দেখেছিলাম সাকুল্যে আধাঘন্টার ব্যাপার। আধঘন্টা কেটে গেছে অনেকক্ষণ হল। খিদে পাচ্ছে। সেই কোন সকালে দুটো বাসি রুটি খেয়ে বেরিয়ে এসেছি উমা আর আমি। শাশুড়ী মাতা তো তাও খাননি। শুধু জল আর ওষুধ। বেচারা বৃদ্ধ শ্বশুরমশাই পত্নীগত প্রাণ,আসতে চেয়েছিলেন হাসপাতালে। আসতে চেয়েছিল দুই পুত্রও। বেজায় ধমকে তাদের নিরস্ত করা গেছে। শ্বশুরমশাই ফুসফুসের সমস্যায় ভোগেন নিত্য। রাস্তায় বেরোন এমনি নিষেধ তাঁর। শৌভিকের আছে ইলেকশন আর অভীক থুড়ি টুকলুর আছে কলেজের ইন্টারনাল এক্সজাম। ফলে আমরা দুই পুত্রবধূই আপাততঃ শাশুড়ি মায়ের একমাত্র সঙ্গী। তাই নিয়ে শুরুর দিকে ভদ্রমহিলার গর্বের অন্ত ছিল না, তিনবার বললেনও সে কথা। 

উনি অবশ্য অমন কথা প্রায়ই বলেন। উমা এবং আমি উভয়ই মনে করি এমন আলোকপ্রাপ্ত মহিলা খুব কম আছে। নারী স্বাধীনতার সংজ্ঞা হয়তো পড়েননি তবে এত বেশী নারীবাদী মহিলা, বিশেষতঃ ঐ বয়সে আমরা আজ অবধি দেখিনি। যেখানে সব শাশুড়িরা বিয়ে হতে না হতেই নাতিনাতনীর মুখ দেখার আব্দার করে, আমাদের শাশুড়ী জরায়ুর ওপর মেয়েদের অধিকার দাবী করেন। বিশ্বাস করেন এবং আমাদের বলেনও যে সন্তান আসবে কি আসবে না, সেই সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার শুধু মায়েদের থাকা উচিত। উনি ঘোরতর নারীবাদী বলেই হয়তো ছেলেদের শিখিয়েছেন খাবার টেবিলে বউদের জন্য অপেক্ষা করতে। শিখিয়েছেন প্রয়োজনে বউদের খাবার বেড়ে দিতে। শিখিয়েছেন ঘরের কোন কাজ নিছক মেয়েলি নয়, সব কাজই সবার শেখা এবং করা উচিত। তা রান্না করাই হোক বা বাসন মাজা, বা জামাকাপড় কাচা বা হোক না নিছক শৌচাগার সাফাই। কখনও মাছের পেটি বা বড় পিসটা আলাদা করে ছেলেদের পাতে তুলে দেননি। রান্না করে সাজিয়ে দিয়েছেন টেবিলে,এবার যার ভাগ্যে যা ওঠে। যখনই বলেছি কোন কাজ ঠিক জানি না বা ভালো পারি না, ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন ভদ্রমহিলা, ‘অত জানার দরকারটাই বা কি?নিজের মত চালিয়ে নিও’। 


যাই হোক বছর দুয়েক আগে আবিষ্কার তো হল যে ওণার উদরে জমছে পাথর, যা সরাতে লাগার কথা মাত্র ঘন্টা আধেক,  কিন্তু সেই আধাঘন্টার ব্যাপার সামলাতে যে কত ঘাটের জল খেতে হল, কি আর বলি। সবাই মিলে ছুটতে হল এই হাসপাতাল থেকে ঐ হাসপাতাল। নামকাওয়াস্তে গল স্টোন তার জন্য বারবার একে অপরের কোর্টে বল ঠেললেন কত যে বিশেষজ্ঞ। প্রত্যেকেরই দাবী ঝুড়ি ঝুড়ি পরীক্ষা। যত রকম পরীক্ষা, ততো রকম জটিলতা। যত রকম জটিলতা ততো নতুন রকম বিশেষজ্ঞ। 


এদিকে শাশুড়ী মায়ের ঐ বমি ছাড়া যে অন্য কোন উপসর্গ ছিল তাও না। বয়স সুলভ হাঁটুর ব্যথা, সামান্য উচ্চ রক্তচাপ আর বেতো হাঁটু। সর্বশেষ বিশেষজ্ঞ বললেন বৃদ্ধার ফুসফুস বেশ ভালোই জখম। যদিও সাদা চোখে ধরা পড়ে না। শ্বাসকষ্টও  তেমন হয় না। অথবা হয়, উনি বুঝতেও পারেন না। দু দুবার ক্যান্সারকে নক আউট করে যাবতীয় মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু শ্বশুরমশাই একাই। শাশুড়ি মাতাকে নিয়ে তেমন ভাবিত থাকি না আমরা। উনি তো অ্যাটলাস, ঝিম মেরে সোফায় বসে, বেতো হাঁটুতে হাত বোলাতে বোলাতে কেবল্ টিভিতে বাংলা সিনেমার চ্যানেল সার্ফ করতে করতেও ধরে রাখেন পুরো বাড়ির ভার। হেঁপো রুগী তো শ্বশুরমশাই। গান্ধারীর মত শাশুড়ি মা যে কবে আপন করে নিয়েছেন বরের ব্যামো, তা জানতেও পারিনি আমরা। জানলাম তখন, যখন ডাক্তার বললেন, অপারেশন করালে নাও ফিরতে পারে জ্ঞান- 


মুলতুবি হয়ে যাওয়া অপারেশন আর পেট ভর্তি পাথর নিয়ে দিব্যি ঘুরতে লাগলেন শাশুড়ি মা। ধাড়সার আহমেদ ডাক্তারের হোমিওপ্যাথি ওষুধ খেয়ে খানিক গলিয়েও ফেললেন পাথর, করোণার মাঝেও রিপোর্টে বেশ কম কম এল সবকিছু। নতুন বছর পড়তেই রাতারাতি গেল বেড়ে সবকিছু। অতঃপর আমার আদরের ছোট দেওর ওরফে অধ্যাপক ডাঃ টুকলুর প্রবল ধমকচমকের পর ভদ্রমহিলা রাজি হলেন অপারেশন করাতে। 

আধাঘন্টার অপারেশনের সময়সীমা কখন যে বেড়ে গেল ঘন্টা সাড়ে তিন কে জানে। নিষেধ সত্ত্বেও গুটি গুটি এসে হাজির হল টুকলু বাবু। উমা বিরক্ত হয়ে বলেই ফেলল, ‘আমাদের ওপর এদের কোন ভরসাই নেই দিদিভাই। দেখছ তো?’ দেখছিলাম তো। দেখছিলাম এমন জাঁদরেল গুরুগম্ভীর অধ্যাপক টুকলুরও মুখটা কেমন শুকনো। দেখছিলাম বাইরের জটিল কঠিন আবরণের ভিতর একটা বছর সাত আটেকের ভীতু ছানা, যার সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে রয়েছেন ছবির ভদ্রমহিলা।


অপারেশন শেষ হতে বেরোল প্রায় সাতখানা জব্বর পাথর। একনজরে দেখলে মনে হবে বুঝি ডুমো ডুমো করে কাটা সুপারি বা চৌকো করে কাটা পেস্তা। এত পাথর নিয়ে ভদ্রমহিলা এতদিন টিকে ছিলেন কি করে ভগবান জানেন। ডাক্তার জানালেন, সমস্ত জটিলতার মুখে ছাই দিয়ে দিব্যি আছেন ভদ্রমহিলা। জানালেন কালকেই ছুটি-। 


উমার সাথে খোদ শ্বশুরমশাই গিয়েছিলেন প্রিয়তমা স্ত্রীকে বাড়ি আনতে। ছবিতে যতই গোবেচারা নির্বিরোধী মনে হোক না কেন, বাড়ি আসার সাথে সাথেই নিজ মূর্তি ধরেছেন ইনি। উড়িয়ে দিয়েছেন আয়া মাসি রাখার প্রস্তাব। কাজের দিদিকে কটা দিন একটু বেশী থাকতে বলে বেজায় ধমক খেয়েছেন শ্বশুরমশাই। দুদিন তাও একটু জবুথবু ছিলেন, আজ সকাল থেকে পূর্ণোদ্যমে যাবতীয় সাংসারিক কাজে ব্যাপৃত হয়েছেন ভদ্রমহিলা। হতাশ শ্বশুরমশাই অসহায় ভাবে  বিড়বিড় করে বললেন, ‘কি করি বলো তো?’ কিচ্ছু করার নেই, সবই অতসী দেবীর মহিমা। মোদ্দা কথা শাশুড়িমা জিন্দাবাদ। এমন ভাবেই চলুক না জীবন ছন্দবিহীন ছন্দবদ্ধ হয়ে- কখনও টক আর অনেকটা মিষ্টি নিয়ে।

Friday 29 January 2021

মেলার ডাইরি ২০২১

 মেলার ডাইরি, ১৫ই জানুয়ারী, ২০২১

পর্ব ৯ক


জনৈকা আত্মীয়া একবার বলেছিলেন,‘তোর চাকরীটা বেশ ভালো। খালি সাজুগুজু আর ছবি তোলা“।  


১২ই জানুয়ারী বেলা দুটো- স্যারকে মেসেজ করতে গিয়েও বুঝতে পারলাম না কি লিখি। এমন জটিল পরিস্থিতিতে বাপের জন্মে পড়িনি। প্রতিবছরই মেলার আগের দিন গোলমাল বাঁধে। গত বছর যেমন গেটের সামনে লাগানো শোলার হাতি নিয়ে চূড়ান্ত রাজনৈতিক নোংরামো করেছিল এক স্থানীয় ব্যক্তি। একটা মাতাল আর পলকে জমে যাওয়া ভিড়ের সামনে ভয়ে জড়সড় আমার টিমের ছবি দীর্ঘদিন দুঃস্বপ্ন দেখেছি আমি। পেঁচো মস্তানের সাথে মস্তানি করে তাকে পুলিশের জিপে তোলাটা আজ অবধি নিজের বিশের বছরের অন্যতম কৃতিত্ব বলে মনে করি। তবে সেটা তো বিগত বছরের কথা। এ বারের সমস্যা যে তার থেকে শতগুণ জটিল। 


১২ই জানুয়ারী বেলা ২টো দশ-স্যারের ফোনটা বেজে গেল। ওণার অনুমতি ছাড়াই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যুযুধান দুপক্ষের একজনকে পত্রপাঠ বাড়ি পাঠাব বলে ঠিক করলাম। আমরা যতই নিজেদের অপরিহার্য বলে মনে করি না কেন- আদতে সবাইকে ছাড়াই সব হতে পারে। যেমন আমার অন্যতম নির্ভরশীল ইন্সপেক্টর নির্মলকে ছাড়াই এবছর মেলা করার দিকে এগোচ্ছি আমরা। নিরূপায়। সদ্য প্রিয়জন হারানো নির্মল আপাততঃ কাছা পরেই অসুস্থ মাকে নিয়ে বসে আছে কলকাতার এক নামী হাসপাতালে।


বেলা তিনটে- সমস্যাটা কোন মতে মেটানো গেল। আমি কঠোর পদক্ষেপ নেবারই পক্ষপাতী ছিলাম। বর্মন সাহেব মিটমাট করার পক্ষে। শেষ পর্যন্ত রণং দেহির ওপর বিজয় প্রাপ্ত হলেন শান্তিরূপিনী। এখনও বাকি প্রচুর কাজ। সবাই ফিরে এসো মেলা মোডে। 

শ্যামল মুড়ি কই? 


বেলা সাড়ে তিনটে- এখনও অর্ধসমাপ্ত স্টেজ। মাঠে টানা হয়নি ছাউনি। লাগেনি কোন আলো। সমীর দৌড়ে এল, মাঠের বাইরে পোস্টার মেরেছে ওরা। মুড়ি খাওয়া হাতেই রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালাম সবাই। মাঠের উল্টো দিকের বাড়ির দেওয়ালে হাতে লেখা মেলা তথা সরকার বিরোধী না না শ্লোগান। যার কিছুকিছু বেশ আক্রমণাত্মক। শুধু তাই নয়, মাঠের সামনের রাজপথ বরাবর যতদূর নজর যায়- দুপাশের ল্যাম্পপোস্টে কারা যেন রাতারাতি লাগিয়ে গেছে বিশেষ রাজনৈতিক দলের ঝাণ্ডা। গণ্ডগোলের পূর্বাভাষ ছিলই। এসপি থেকে জেলা প্রশাসন হয়ে থানা সবজায়গায় চিঠি করে যথোপযুক্ত  ফোর্স পাঠানোর অনুরোধ করেই রেখেছি। গোপন সূত্র থেকে মুহূর্তে মুহূর্তে খবর আসছে, আজ ওণাদের মিটিং চলছে। আমাদের চন্দ্রাকেও ডেকেছিল ঐ মিটিং এ। মেলা থেকে বিশ মিনিট দূরত্বে জমায়েত হবে ওণাদের। সেখান থেকে ট্যাবলো এবং মিছিল নিয়ে এসে হাজির হবে আমাদের মেলায়। ইতিপূর্বে যথেষ্ট দুর্ঘটনা ঘটে গেছে অন্যান্য জেলায়। প্রচারিত হয়েছে কুৎসামূলক খবর। আর সর্বক্ষেত্রে আসামীর কাঠগোড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে বেচারা আধিকারিককে। 


বেলা চারটে- নির্মলই সাধারণতঃ থানার সাথে কথা বলে, সে এখনও এসে পৌঁছায়নি কলকাতা থেকে।  নির্মল এলে সাথে চঞ্চল বা কৌশিককে থানায় পাঠানো হবে। আপাততঃ আরেকবার ঝালিয়েনি নিজেদের প্ল্যান। সামনের গেটে থাকবে দুজন জাঁদরেল মহিলা। বলাগড়ের প্রীতি শীল আর বাঁশবেড়িয়ার মহুয়া নাথ। শ্যামল আপত্তি করে, ‘মেয়েরা শুধু পারবে না। আমরা কজনও থাকি। ’ একসাথে মুখ ঝামটা দি আমরা। আমরাই পারি। ইন্সপেক্টর মৃণালের রিশেপসন টিম থাকবে প্রীতি দি আর মহুয়াদির পিছনে। দূরদূরান্ত থেকে আমাদের যে এসএলও বা কালেক্টিং এজেন্টরা লোক নিয়ে আসবেন, তাঁদের গেটের পাশে দাঁড় করিয়ে, এক একজন করে স্যানিটাইজার গেটের ভিতর দিয়ে ভিতরে ঢুকবে। মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। মাস্ক পরে না এলে মাস্ক সরবরাহ করব আমরাই। সার্জিক্যাল মাস্কের বাণ্ডিল রাখা থাকবে মহুয়াদির কাছে। স্লোগান হবে, ‘মাস্ক পরুন, মেলা দেখুন’। 


আর যদি স্থানীয় মানুষ মেলা দেখতে আসেন। তাঁরা অবশ্যই স্বাগত। তাদের ছাড়পত্র দেবে বাঁশবেরিয়ার মহুয়াদি। অচেনা কেউ না। আর হ্যাঁ একবার ঢুকে পড়লে, উদ্বোধন শেষ না হওয়া পর্যন্ত বেরোতে দেওয়া হবে না। বাহির গেটে ডিউটি দেবে বাঁশবেড়িয়ারই নূপুরদি আর তরুণী মধুমিতা। 


যদি এদের চোখে ধুলো দিয়ে কোন বিক্ষোভকারী ঢুকেও পড়েন, তাঁকে সামলাবে মাঠ কমিটি। মাঠ কমিটির মাথায় থাকবে আমাদের ইন্সরেক্টর দর্প। আর তার সাথে থাকবে প্রদীপ, সমীর, প্রিয়াঙ্কা, শান্তনু আর আশিস। দূরত্ববিধি মেনে পাতা চেয়ারগুলির ফাঁক দিয়ে সমানে পায়চারি করবে এরা। যদি দেখা যায় কেউ ব্যাগ থেকে কোন ফেস্টুন বার করছে, তাকে বুঝিয়ে শান্ত করার দায়িত্ব এদের। 

এত উৎসাহী এই ছেলেমেয়েগুলো যে এদের সামলানো বেশ চাপ। বিশেষতঃ প্রিয়াঙ্কা তো একাই লড়তে চায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে। এ মেয়েকে সামলাতে আরও গুটি কতক মেয়েকে বলা হল, ওকে সামলে রেখো বাপ।   


বিকেল পাঁচটা- নির্মল এসে পৌঁছালো। ওর মাকে কালই ভর্তি করতে হবে  হাসপাতালে। এবারে আর নির্মল মেলা হবে না আমাদের। থাকতে পারবে না মেলার মূখ্য উদ্যোক্তা শ্রী নির্মল কুমার শেঠ। বাকি দুই ইন্সপেক্টর চঞ্চল আর কৌশিক আশ্বাস দিল, ‘আমরা সামলে নেবো ম্যাডাম’। বেশ। 


রাত পৌনে আটটা- থানা থেকে ফোন করল চঞ্চল। 'দুটো মেল আইডি পাঠাচ্ছি ম্যাডাম। বড় বাবু বলছেন একটা চিঠি করতে হবে। তবে ফোর্স চাইবেন ওণারা।’ সে আবার কি? এত রাতে আমি গাড়ি থেকে কি করে চিঠি করব? মেমো নম্বর পাব কোথা থেকে? আর এত যে চিঠি করলাম? সেগুলো কি অর্থহীন? অসহায় গলায় জবাব এল, 'সেই সব চিঠি এখনও ওণাদের কাছে নামেনি।'

অনির মেলার ডাইরি ১৫ই জানুয়ারী, ২০২১

পর্ব-৯ খ

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10222728040936852&id=1449214651  এর পর 


১২ই জানুয়ারী রাত আটটা- স্যারকে ফোন করলাম। মিটিং সেরে ফুলের লোক আর ফুল গাড়িতে তুলে মাঠে যাচ্ছেন স্যার। উনি আসছেন বলেই বাড়ির দিকে রওণা দিয়েছি আমি। ঠিক বাড়ি নয়। মেলার আগের রাতে হেয়ার স্পা করানোটা আমার বার্ষিক রিচুয়্যাল বলতে পারেন। একটা তুক থাকে না সকলেরই। 

স্যার আশ্বস্ত করলেন, ‘তুমি যাও। দরকার হলে মাঠে পৌঁছে হাতে চিঠি করে দেবো আমি। ’ এত চিঠি, ধাপে ধাপে ধাপে চিঠি করার পরও কেন চিঠি করব আমরা? ফোন করলাম অতিরিক্ত জেলা শাসক, সাধারণ মহাশয়কে। উনি স্বয়ং ফরোয়ার্ডিং চিঠি সমেত আমার চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন পুলিশের কাছে। তার আর পর থাকতে পারে নাকি? 

সব শুনে জানালেন, ‘তুমি সিম্পলি আমার চিঠিটার একটা হার্ড কপি থানায় পাঠিয়ে কি ফিড ব্যাক পাও আমায় জানাও।’


রাত সাড়ে আটটা-  মাঠে প্রিন্টার কোথায়? চিঠিটা থানার মেলে আর নির্মলকে হোয়াটস্অ্যাপে পাঠালাম। সামাজিক মুক্তি কার্ড আর পিপিও প্রিন্ট ল্যামিনেট করাতে গেছে রমেশ। তাকেই বলা হল, ওটার একটা প্রিন্ট এনে দে বাবা। শুনলাম সময় লাগবে। সব প্রিন্ট নিয়ে চুঁচুড়া থেকে বাঁশবেড়িয়া আসতেও লাগবে অন্তত আধঘন্টা। রাস্তা ভয়ানক খারাপ। আচ্ছা সামলে আয়। 


রাত সাড়ে নটা- রমেশের ফোন বন্ধ। বুঝলাম চার্জ শেষ। গোপন সূত্রে কিছু খবর পেলাম। সংবাদ প্রদানকারী আশ্বাস দিলেন, ‘মেলা বয়কট করবেন বটে,বানচাল করবেন না ওণারা। বিক্ষোভ দেখাবেনই। ’ বললাম দেখুন বিক্ষোভ দেখানো আপনাদের অধিকার। তাতে হস্তক্ষেপ করতে চাই না। তবে চার বছর এই জেলায় কাটিয়ে দেওয়ার পরও যদি ‘শ্রমিকবিহীন শ্রমিকমেলায় চলছে বিরিয়ানি উৎসব’ বা ‘সরকারী মেলায় চলছে চটুল অশ্লীল নাচগান’ মার্কা খবর পড়তে হয়, তার থেকে বেদনাদায়ক কিছু হতে পারে না। 


রাত দশটা- থানা থেকে ফোন করল চঞ্চল,‘ম্যাডাম আপনাকে খবরটা কে দিয়েছে? এণাদের কাছে কিন্তু খবর আছে বিরাট গণ্ডগোল হবে। সারাদিনের উত্তেজনা আর ক্লান্তি ঘুম হয়ে নেমে আসে ফোনের এপ্রান্তে। সোর্স কেউ জানায়? আমার যা করার আমি করেছি। এরপর যদি কিছু হয়, হবে। তুমি ফিরে এসো। কাল ভোর থেকে প্রচুর চাপ।  


রাত এগারোটা- মাঠ থেকে ফোন করল ডেকরেটর। ম্যাডাম গুটি তিন চ্যাঙড়া ছেলে এসে হুমকি দিচ্ছে কাল সব ভাঙচুর করবে। ক্লান্তি জড়ানো গলায় জানালাম, করুক। যার যা প্রাণ চায় করুক। শুধু যখন ভাঙচুর করতে আসবে, আপনি আপনার মূল্যবান জিনিসগুলি সরিয়ে রাখবেন। 


১৩ই জানুয়ারী ভোর ছটা- অ্যালার্মটাকে ঘুম জড়ানো হাতে বন্ধ করে জড়িয়ে ধরলাম ঘুমন্ত বরকে। আমি বেশ যাব না আজ। যার যা খুশি মারামারি  করে নিক। আধঘুমন্ত আলিঙ্গন সহ, ফিসফিস করে ভেসে এল সোহাগী বাণী,‘ সেই ভালো যাস না। বড় সাহেব আছেন তো। আর বর্মনও আছে।’


সকাল পৌনে আটটা- সাড়ে সাতটায় বেরোব ভেবেও দেরী হয়ে গেল। বের হবার আগে শৌভিককে দিয়ে একটা ছবি তোলানোটাও তুক বলে মনে করি আমি। কাজের সময় এমন বেয়াড়া আব্দারে ভয়ানক বিরক্ত হয় শৌভিক। তাকে পটাতে গিয়েই দেরী আর কি। 

 জলদি চালান সুবীরবাবু। এইসব দিনগুলোতে ভীষণ মৃত্যুচিন্তা নিয়ে খেলা করতে মন চায় আমার। কি হয়,যদি আজ রাস্তায় উল্টে যায় গাড়ি? ওরা অপেক্ষা করবে আমার জন্য। ফোন করবে বারে বারে। তারপর সামলে নেবে ধীরে ধীরে। টেনশন চেপেও চালিয়ে যাবে নিজ- নিজ দায়িত্ব। ঐ যে শেক্সপিয়র সাহেব বলে গেছেন না, কুশীলব বদলে গেলেও-‘দা শো মাস্ট গো অন’। দেখা যাক আজ কি শো থাকে কপালে- 

(চলবে)

অনির ডাইরি জানুয়ারী, ২০২১

 অনির ডাইরি ২৭শে জানুয়ারী, ২০২১


ঘোরতর আপিস টাইমে ফোন করেন তিনি,‘মা আমি একটা অপাট করেছি’। বিগত দশ বছরের অভিজ্ঞতা যাবতীয় অপাট সম্পর্কে মোরে করেছে অনেকটাই সহিষ্ণু। আজকাল আর আঁতকে উঠি না। কেজো গলায় জানতে চাই, কি ঘটিয়েছেন শ্রীমতী অঘটনঘটনপটিয়সী? উত্তর আসে, বাড়িতে পরার হাওয়াই চপ্পলখানি দেহ রেখেছেন। এতদিন কেন যে রাখেননি, তা পরমেশ্বরই জানেন। সারাদিন মোটামুটি খালি পায়েই তো ঘোরে তুত্তুরী। পায়ের তলায় মাখা থাকে দুনিয়ার কালিঝুলি। আর চপ্পল জোড়া বিমর্ষ হৃদয়ে পড়ে থাকে কখনও খাটের কোণায় তো কখনও খাবার টেবিলের নীচে। 


আজ তাঁরা দেহ রাখায় বড়ই বিমর্ষ কন্যা আমার, বারংবার আশ্বস্ত করে, ‘একটা ফেভিকুইক কিনে এনো তো। জোড়া যাবে মনে হয়। ’ দাঁত থাকতে যেমন বোঝা যায় না দাঁতের মর্ম, তেমনি হয়তো চপ্পল থাকতেও কেউ কেউ বোঝেন না-। তাঁরা মারা গেলে হঠাৎ বড় দীন, বড় শীতকাতুরে হয়ে ওঠেন কেউ কেউ। আপন মনে করুণ সুরে বিড়বিড় করে তুত্তুরী, ‘দাদু(মাতামহ) থাকলে ঠিক জুড়ে দিত।’ হয়তো দিতো। এসব ব্যাপারে দাদু সাক্ষাৎ বিশ্বকর্মা। যুগটাই যে অমন ছিল। প্রাচুর্য শব্দটাই বোধহয় ছিল সবথেকে দুষ্প্রাপ্য।   


তুত্তুরী জন্মের পর শ্বশুরমশাই একবার বলেছিলেন, ‘যা চাইবে সঙ্গে সঙ্গে দিও না। অভাববোধ যেন তৈরী হয়। ’ যিনি এই অমূল্য জ্ঞান দিয়েছিলেন, তুত্তুরী তাঁর প্রাণ। তিনি নিজে এই জ্ঞান ভুলে গেছেন কবেই। তবে তিনি না মানতে পারলেও, আমি থুড়ি আমরা দোঁহে মেনে চলি। থাক না একটু অভাব। তৈরী হোক না সামান্যতম মূল্যবোধ। 


 বাবামায়ের পেশাদারী ব্যস্ততার ফাঁকে মায়ের চপ্পল জোড়াই দখল করে তুত্তুরী। মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য, তারপরই ফেরৎ দিয়ে যায়, আহাঃ মায়ের পায়ে ঠাণ্ডা লাগবে কি না। ছেঁড়া চপ্পল পরেই বাড়িময় ঘুরতে থাকেন তিনি, কর্মব্যস্ত মাকে অফিস বেরোনোর সময় আশ্বস্ত করেন তিনি,‘ মা এটা তো দিব্যি পরা যাচ্ছে। তোমায় চিন্তা করতে হবে না।’ কড়া আধিকারিক, বিস্তর (অ)জ্ঞানবতী মায়ের চোখের কোণা কেন যে ভিজে ওঠে অকারণে- 


শ্রীরামপুর শ্রমিকমেলার দপ্তরী দায়িত্ব সেরে, তড়িঘড়ি চপ্পলের দোকান খোঁজে মা। বাড়ি ফিরলেই প্রশ্ন করেন তিনি, ‘কি এনেছো মা?’ কোন মিটিং এর ঠাণ্ডা টিফিন প্যাকেটই হোক বা কোন উৎসবের শুঁটকে মার্কা স্টিক বুকে বা ছাপোষা আপদ উত্তরীয়, যেগুলি না পারা যায় বয়ে আনতে না পারি ফেরৎ দিতে, সব ঝেঁটিয়ে বাড়ি আনি আমি। তিনি খুশি হন যে।  আজ অবশ্য যথারীতি ফেলে এসেছি শ্রীরামপুর শ্রমিকমেলার উত্তরীয়টা। বৈদ্যবাটির ইন্সপেক্টর দেবারতির ইন্সপেক্টরগিরির হাতেখড়ি আমাদের চুঁচুড়ায়। আজ আর তার ওপর আমাদের কোন দপ্তরী অধিকার নেই বটে, তবে দপ্তরীয় সম্পর্কের বাইরেও রয়ে গেছে বেশ খানিকটা উষ্ণতা। শ্রীরামপুরের কোন অনুষ্ঠানে গেলেই আমি দেবারতিকে খুঁজি, আর ও আমায়। দেবারতিই পরিয়ে দিয়েছিল সাধ করে। দিব্যি গলায় পরে বসেও ছিলাম, শান্তশিষ্ট নক্ষ্মী অতিথি হিসেবে। তারপর যা হয় আর কি। কখন যে পাট করে পাশে রেখেছি আর মনে নেই।  


যথারীতি, মায়ের জলদি বাড়ি ফেরা তথা নতুন চপ্পল জোড়া উপহার পাওয়ার পরও তাঁর দুঃখ হল ফেলে আসা নীল সাদা উত্তরীয় খানার জন্য। অন্তত একটা নীলসাদা ওড়ণাও যদি মায়ের থাকত, গলায় পরে মান্যগণ্য অতিথি হয়ে ঘুরতেন তিনি। ধুত্তেরি! 

অতিথিবরণের ঝকমকে সোনালী জরি দেওয়া ব্যাজটা অবশ্য দিব্য পছন্দ হল তাঁর। যতো ঝকমকে ততো বেশী পছন্দ, বেশ বুঝলাম রাতে ঘুমাতে যাবার আগে ঐ ব্যাজটি খুলছেন না মাননীয় অতিথি। ব্যাজ পরিয়ে, হাতে পিটুনিয়ার টব ধরিয়ে বরণ করার পর মাননীয় অতিথির সাথে তুলতে হল খানকতক ছবিও। এবার মাননীয় অতিথির ভাষণ দেবার পালা- তবে সে তো অবশ্যি অন্য গল্প। এইভাবেই গড়াক না জীবন, অলসছন্দ প্রতি মুহূর্তে তৈরী করুক না নতুন নতুন গপ্প। ছড়িয়ে পড়ুক ভালোলাগা আর ভালোবাসার রঙ জীবনের প্রতিটি পল থেকে অনুপলে। দর্পনে নিজের প্রতিচ্ছবির মুখোমুখি হয়ে যাতে বলতে পারি,‘ এই বেশ ভালো আছি।’

অনির ডাইরি ২১শে জানুয়ারী, ২০২১


বেলা এগারোটার অ্যালার্ম বাজার সাথে সাথেই দিতে হয় হাজিরা। এগারোটা দশে আসবে লিঙ্ক। সেই লিঙ্ক পাঠাতে হবে অন্য একটা নম্বরে। বাড়িতে ল্যাপটপ খুলে বসে থাকবে একজন। তার নিজের তো ফোন নেই। মাসির ফোনে যায় লিঙ্ক। সেই লিঙ্ক দেখে নিজেই খোলে গুগল মিট। বসায় কোড। তারপর বসে ক্লাস করতে। এই ভাবেই গড়ায় দিন। 

প্রতিটা দিনই নিজের সাথে বয়ে আনে নানা জটিলতা। কোনদিন আচমকা কিবোর্ডে হাত পড়ে গিয়ে উড়ে যায় দরকারী ফাইলপত্র। পাগলের মত তলাশ করে সে। মায়ের আপিসের ল্যাপটপ। মায়ের দরকারী ফাইলপত্র। হারিয়ে গেলে কি হবে? মা যে পড়ে যাবে ভয়ানক বিপদে। হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ফোন করে সে। মা ব্যস্ত জরুরী মিটিং এ। কেজো সুরে ‘পরে করছি’ বলে রাখতে রাখতে হাত কাঁপে মায়ের। গুগল ক্রোমটাও বোধহয় খুঁজে পাচ্ছে না সে। ক্লাশ করবে কি করে। চটজলদি মেটেও না আপদ মিটিংগুলি। 


মিটিং শেষে মা যখন ফোন করে, সে বলে, ‘তুমি চিন্তা করো না মা। আমি ক্রোম খুঁজে বার করেছি। শুধু তোমার ফাইলগুলো খুঁজে পাচ্ছি না।’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মা শেখায়, যা হবার তা হবেই। সমস্যায় পড়লে মোকাবিলা করবে। অবলার মত কাঁদতে বসবে না। তবেই না শক্তপোক্ত হবে। 


কখনও বা হ্যাং হয়ে যায় বুড়ো কম্পুটার। কখনও অকারণে নিতেই থাকে আপডেট। আজকাল আর কাঁদে না কেউ। শুধু নার্ভাস গলায় ফোন করে জানতে চায়, ‘ক্লাস যে শুরু হয়ে গেল মা। সবে ৩৫ শতাংশ-’। ঠিক তখনিই দরজা ফাঁক করে মুখ গলায় কোন পরিচিত মুখ, তাড়া তাড়া বিল এসে জমে টেবিলের ওপর। পারে না মা সমস্যা মেটাতে। অসহায় অবলার মত বলে, একটু অপেক্ষা কর। আর ঠাকুর ডাক। সারাদিন এত যে ‘মুণ্ডমালা শোভিনী ভয়ংকরী ত্রিনয়নী’ গেয়ে বেড়াস। বিপদে পড়লে তাকে ডাকিস না কেন? বলতে বলতে বাড়তে থাকে মায়ের হীনমন্যতার মাত্রা। দপ্তরী কাজ করতে করতে মোবাইলের স্ক্রীনের দিকেই তাকিয়ে থাকে মা- কত শতাংশ হল?কিছু বলে না কেন? টুং করে নেচে ওঠে মুঠোফোন- কোন ভারিক্কি দপ্তরী গ্রুপে ভেসে উঠতে থাকে কাজের খতিয়ান। তারই ফাঁকে আসে প্রাণের বাণী, ‘৮৫ শতাংশ মা। তুমি চিন্তা করো না। এই তো খুলে গেল। ওয়াইফাইও লাগিয়ে নিলাম। এবার ক্লাশ করি। ’ কন্যার ক্ষুদ্রতম জয়েও ঝরে পড়তে চায় কড়া আধিকারিকের আনন্দাশ্রু। ঘর ফাঁকা হলে কাঁপা কাঁপা হাতে মেসেজ করে মা, ‘তোমার পাশে না থাকতে পারার বেদনা আমায় কুড়ে কুড়ে খায়। বড় ভালোবাসি যে তোমায়। বাবার থেকেও বেশী। ’ ক্লাস থামিয়ে ধমকে ওঠে মেয়ে, ‘কাজে মন দাও মা। আমি তো রইলামই।’  তাজ্জব মায়ের হৃদয় ভরে ওঠে কানায় কানায়, এমন গতিতে কি আদৌ ছোটার কথা ছিল জীবনের? এত উত্তেজনা- সাফল্য, এত উষ্ণতা, বিষণ্ণতা, হঠাৎ ব্যর্থতা, এত নির্ভরশীলতা,এত ভালোবাসা কি সত্যিই প্রাপ্য ছিল? প্রাপ্য ছিল চূড়ান্ত ঋণাত্মক পরিস্থিতির মধ্যেও এত আনন্দ? কিছুই তো পারতাম না আমি। আজও পারি না। পারি শুধু ভালবাসতে, ভাগ্যিস জীবন সমুদ্রসম, যত ভালোবাসি, ফিরে ফিরে আসে শতগুণ হয়ে।





Saturday 16 January 2021

তুত্তুরী উবাচ, ২০২১


তুত্তুরী উবাচ ৩০শে এপ্রিল, ২০২১


(মাসির সাথে দাবাখেলা নিয়ে সক্কাল সক্কাল তুমুল বিবাদ, বেশ কিছুক্ষণ বাক্যালাপ বন্ধ এবং অবশেষে মায়ের পীড়নে ক্ষমা চেয়ে মিটমাট করার পর)  


👩🏻-দেখছ তো, ক্ষমা চাইলে আর শাস্তি পেতে হয় না। 

👧🏻-(হাসি চেপে) তাই বলে খুন করে ক্ষমা চাইলে কি আর মার্জনা করা হয়?

👩🏻-(জ্ঞান দেবার সুরে) নাঃ তা হ-য়-না। তবে ফাঁসিও হয় না। যাবজ্জীবন  কারাদণ্ড হয় হয়তো, অথবা সাত আট বছরের জেল।  

👧🏻-(খানিক চিন্তা করে) আচ্ছা মা কেউ যদি আমার ছুরির ওপর পেট নিয়ে আসে, তাহলেও কি আমার শাস্তি হবে?

👩🏻-(প্রবল হাসির দমকে, কাশতে কাশতে) এ আবার কেমন প্রশ্ন। কেউ খামোকা তোর ছুরির ওপর পেট নিয়ে আসতে যাবে কেন? 

👧🏻-(বোঝানোর ঢঙে) নাঃ ধর, আমি রাস্তা দিয়ে ছুরি নিয়ে যাচ্ছি, কেউ পেট নিয়ে আমার ছুরির ওপর পড়ল-

👩🏻- (হাসতে হাসতে) তুই খামোকা রাস্তা দিয়ে ছুরি নিয়ে যাবিই বা কেন? আর যদি যাস ও তাহলে এমন ভাবে মুড়ে নিয়ে যাবি,যাতে হোঃ হোঃ হোঃ কেউ তোর ছুরির ওপর পেট না নিয়ে আসতে পারে।  

👧🏻-(খানিক ভাবনা চিন্তা, খানিক পায়চারি যাকে ঠাম্মা বলে ‘হুমহাম’ করে পুনরায় রান্নাঘরের দরজায় আবির্ভূত  হয়ে) আচ্ছা মা, তুমি দৌড় বোম্বাই আম খেয়েছ?

👩🏻-(তাজ্জব হয়ে) অ্যাঁ? সে আবার কি? 

👧🏻-(বোঝানোর ঢঙে) হ্যাঁ গো মা। এক ধরণের আম আছে, যার নাম দৌড় বোম্বাই আম। মাম্মাম (দিদা)  মাঝেমাঝে কিনে আনত, অফিস ফেরত। দাদু বলেছে সেই আম এত টক যে বাঘের পিছনে দিলে বাঘ দৌড়ে পালাবে। 

👩🏻-(হাসতে হাসতে বিষম খেয়ে) কি শুরু করেছিস তোরা বলতো? খামোখা বাঘের পিছনে আম দিতে যাবি কেন?



 তুত্তুরী উবাচ, ৬ই এপ্রিল, ২০২১


👧🏻-(খেতে বসে উত্তেজিত হয়ে) মাসি তুমি আবার শুক্তোতে উচ্ছে দিয়েছ? 

👩🏽‍🍳-(তাজ্জব হয়ে) শুক্তো তো উচ্ছে করলা দিয়েই হয়। উচ্ছে না দিলে আবার শুক্তো হয় নাকি? 

👧🏻-(যুক্তি মেনে খানিক ভাত খেয়ে, পুলকিত স্বরে) মাসি জানো তো আমার মাথায় না সবসময় উল্টোপাল্টা চিন্তা ঘোরে। যেমন ধরো, রসগোল্লার শুক্তো আর উচ্ছের পায়েস রাঁধলে কেমন খেতে হবে? তুমি একদিন রাঁধবে?


(বিশেষ পাত্তা না খেয়ে খানিকবাদে দাদুকে ফোন করে) 


হ্যালো দাদু, জানো তো অামার মাথায় সবসময় নানা উদ্ভট চিন্তা আসে। আচ্ছা তুমি বলো তো, কলাগাছের চারা থেকেই তো কলা হয়, আবার সেই কলার বীজ থেকেই তো গাছ হয়, তাহলে প্রথম কলাগাছের চারাটা এসেছিল কোথা থেকে?


তুত্তুরী উবাচ ২রা এপ্রিল, ২০২১


👧🏻-(ঘুম চোখে, দুধের কাপে চুমুক দিয়ে) হ্যালো দাদু, একটা গল্প বলো না। 

👴🏻-  (প্রাতকালীন চিনি ছাড়া চায়ে চুমুক দিয়ে, ক্লান্ত সুরে) সকাল সকাল কি গল্প শোনাই বলো তো। বুড়ো হয়েছি, মাথা কি আর অত চলে। তুমিই বরং একটা গল্প শোনাও। 

👧🏻-(খুশি হয়ে,তরল গলায়) আচ্ছা দাদু, শ্রীকৃষ্ণের যে ১৬১০৮টা বউ ছিল তুমি জানতে?

👴🏻- বেশ।  শুনলাম। অত জন একসাথে থাকত?

👧🏻- আরে নাঃ। অষ্ট ভার্যার আটটা মহল ছিল-

👴🏻- অষ্ট ভার্যা?

👧🏻- হ্যাঁ, রুক্ষ্মিণী, জাম্ববতী, সত্যভামা, কালিন্দী,মিত্রাবিন্দা,নাগনাজীতি, ভদ্রা আর লক্ষ্মণা। 

👴🏻- (ক্লান্তি চেপে)অ। আর বাকি ১৬১০০?

👧🏻- তারা? তাদের গল্প আলাদা। তুমি শুনবে?

👴🏻-(আঁতকে উঠে) না। না। এতজনের কথা বলতে গিয়ে তোমার আমার চার-পাঁচদিন কেটে যাবে। 

👵🏼-(দিদা থুড়ি মামমাম পাশ থেকে মিনতির সুরে) সকাল থেকে কেন এসব কেষ্টবিষ্টু নিয়ে পড়েছ মা। একটু পড়তে বসো না মায়ের কাছে। 

👧🏻-(ঠক্ করে দুধের কাপ নামিয়ে ঝাঁঝালো সুরে) কারো ঠাকুমা-দিদিমা যে তাদের ঘুম থেকে উঠেই পড়তে বসতে বলে, এ আমি জীবনেও শুনিনি।  (অতঃপর কিঞ্চিৎ শান্ত হয়ে দাদুর উদ্দেশ্যে) শোননা, এক অসুর ছিল, তার নাম ছিল নকাসুর। 

👴🏻-( মধ্যস্থতার সুরে) নকাসুর! কি অদ্ভূত নাম। শুনে খুউব ভালো লাগল। 

👧🏻-(তুরীয় মেজাজে) নকাসুর ১৬১০০জন সুন্দরী মেয়েকে ধরে এনেছিল। সবাই অভিজাত বাড়ির মেয়ে। তাদের বাড়ির লোকেরা শ্রীকৃষ্ণের কাছে নালিশ করল, শুনে শ্রীকৃষ্ণ তো গেল ক্ষেপে,বলল, ‘এই নকা, আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।’ তারপর যুদ্ধ হল আর শ্রীকৃষ্ণ নকাসুরকে বধ করল। তারপর হল কি, শ্রীকৃষ্ণ ঐ ১৬১০০জন কন্যাকে তাদের বাবামায়ের কাছে ফেরৎ দিতে গেল-‘একে কি আপনারা নেবেন? তারা বলল,‘ না নেবো না। ’

👴🏻- (দুঃখী স্বরে) কি অবিচার!

👧🏻- হ্যাঁ তো। তখন  শ্রীকৃষ্ণ কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে তাদের বিয়েই করে নিল। 

👴🏻-(হতভম্ব স্বরে) একসাথে?

👧🏻-(মাথা চুলকে) হ্যাঁ তাই বোধহয়। একটা একটা করে বিয়ে করতে তো পাঁচ ছয় বছর কেটে যেত- 

👴🏻-(দুষ্টুমির সুরে) তাহলে একটা কাপড়ে এতগুলো গাঁটছড়া বাঁধা হল কি করে? শ্রীকৃষ্ণ কি মালায় ঢেকে গিয়েছিল? একদিনে এতজনকে মালাই বা পরাল কি করে? 

👧🏻-(চিন্তিত সুরে) তা জানি না। (বিজ্ঞ ভাবে) কিন্তু বিয়ের পর শ্রীকৃষ্ণ কখনও তাদের সাথে থাকেনি। বা কথা বলেনি,বা সম্পর্কও রাখেনি। 

👴🏻-তারা কোথায় থাকত?

👧🏻- দ্বারকামহলেই হবে।

👴🏻-অ।  অষ্ট ভার্যা ছাড়া তাহলে আর কারো সাথেই সম্পর্ক রাখেনি শ্রীকৃষ্ণ?

👧🏻- নাঃ। (আহ্লাদী সুরে) তোমার কেমন লাগল গল্পটা দাদু। 

👴🏻-(ক্ষ্যামা চাওয়ার সুরে) খুউব ভালো লেগেছে। সকাল সকাল এত বিয়ের গল্প শুনে তো আমারই আর একটা বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে।

তুত্তুরী উবাচ ১৯শে মার্চ, ২০২১


👧🏻-(সকাল সকাল দুধের কাপ হাতে গম্ভীর গলায়) হ্যালো, ইলেকশন কমিশন থেকে বলছি। সরমা চ্যাটার্জী বলছেন?

👴🏻-(হাসি চেপে)হ্যাঁ বলছি। 

👧🏻-(আরো গম্ভীর গলায়,ধমকের সুরে) না বলছেন না। তিনি তো মহিলা। 

👴🏻-(কৌতুকের সুরে) উনি আমার বউ। বেবিকটে শুয়ে শুয়ে এখন কাঁদছেন। 

👧🏻- (উত্তেজিত হয়ে) অ্যাঁ? ওণার এত বড় সাহস? উনি আবার জন্মেছেন? ওণার ভোটে নাম কেটে গেছে দ্বিতীয়বার জন্মানোর অপরাধে। (কিঞ্চিৎ ধাতস্থ হয়ে) আচ্ছা সরমা চ্যাটার্জিকে দিন। 

👵🏼-( স্নেহাদ্র কণ্ঠে) হ্যাঁ সন্তু বলো। (প্রসঙ্গতঃ তুত্তুরীকে তার দিদা আদর করে সন্তু বলেও ডাকেন। )

👧🏻-(পুনরায় ধমকে) কে সন্তু? আমি ইলেকশন কমিশন থেকে বলছি। ধ্যারঃ, আপনি দ্বিতীয়বার জন্মেছেন কোন সাহসে? এই অপরাধে ভোট থেকে আপনার নাম কেটে গেছে জানেন?

👵🏼-(আদর মাখা কণ্ঠে) ও আচ্ছা। এবার কি হবে?

👧🏻-(হাসি গোপন করে, উত্তেজক কণ্ঠে) কি আর হবে? আবার নাম তুলতে হবে। আপনি শীঘ্রই আপনার পাখি কার্ড, প্যান কার্ড, আধার কার্ড বানিয়ে নিয়ে আসুন। 

👵🏼- ও আচ্ছা। তা পাখিটাকেও কি ভোট দিতে নিয়ে যাব?

👧🏻-হ্যাঁ। আপনার পাড়ার সব লোককে বলুন, তাদের পোষা পশুপাখি নিয়ে যেন ভোট দিতে আসে। আপনারা ভোট দেবেন আর আমরা ওদের গায়ে দাগ কেটে দেব। 

👵🏼-(ক্ষ্যামা দেওয়া সুরে) আ-চ-ছা। 

👧🏻-(মজার সুরে) তা আপনি তো একটা ছোট বাচ্ছা,বেবি কটে শুয়ে কাঁদছেন, আপনার দুধ টুধ কম পড়েনি তো? 

👵🏼-না না কিচ্ছু কম পড়েনি। তুমি বরং এবার আমার পাকা চুলো বুড়ো বরটার সাথে কথা বলো।  

👴🏻-(দাদুর গলা পেয়ে, পুনরায় ধমকে) এই যে, আপনার বউ দ্বিতীয়বার জন্মেছে, এই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ আপনাকে একখানা কুকুর পুষতে হবে। 

👴🏻-কেন? আমাকে কি এবার কুকুরটাকেও বিয়ে করতে হবে?

👧🏻-(হেসে কুটোপুটি হয়ে) উফঃ আমি আর পারছি না। ইলেকশন কমিশন সেজে নতুন ডায়লগ বানানো আর সম্ভব নয়। দাদু আমি আবার তোমার সোনার তুত্তুরী হয়ে গেছি। একটা গল্প বলো-

তুত্তুরী উবাচ, ১৫ই মার্চ ২০২১


👧🏻-আচ্ছা বাবা, ইনস্যাশিয়েবল সেক্সুয়াল অ্যাপেটাইট মানে কি? ( অফিস টাইমের ভাত খেতে বসেছে শৌভিক, পাশেই বসে ইংলিশ লিটারেচর পরীক্ষা দিচ্ছে তুত্তুরী। এক পলক আমার দিকে অসহায ভাবে তাকিয়ে পুনরায় ভাত খাওয়ায় মন দিল। অগত্যা-)

👩🏻- (ভালো মানুষের মত মুখ করে) পরীক্ষায় এসেছে? কোন চ্যাপ্টার থেকে বল তো?

👧🏻- (লেখা থামিয়ে, চোখ তুলে) নাঃ পরীক্ষায় আসেনি। একজনের সম্বন্ধে পড়লাম। তাই জানতে চাইছি- 

👩🏻-পড়লি? আচ্ছা কোথায় পড়লি? কনটেক্সটটা একটু  বল, তবে না মানে বলতে পারব- 

👧🏻- দ্রৌপদীর সম্বন্ধে পড়লাম। গুগল বলল। আগের জন্মে দ্রৌপদী একজন ঋষির বউ ছিল। গুগল বলছে ইনস্যাশিয়েবল সেক্সুয়াল অ্যাপেটাইটের জন্য তার বর তাকে অভিশাপ দিয়েছিল, পরের জন্মে তোমার একটা নয়, দুটো নয়, পাঁচ পাঁচটা বর হবে। সবটা বুঝতে পারলাম, শুধু ঐটুকু বুঝিনি। তাই বাবার কাছে জানতে চাইছি-

👩🏻-(বেচারী বাবার করুণ মুখ দেখে হাসি গোপন করে) তার মানে হল একটা বরে সে সন্তুষ্ট ছিল না। 

👧🏻-মানে? বরের ওপর অসন্তুষ্ট কেন ছিল?

👩🏻- তার আরও চাহিদা ছিল (বলেই প্রমাদ গুণলাম)

👧🏻- কিসের চাহিদা ছিল মা? আরোও গয়নার- 

👩🏻-(স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে) হ্যাঁ আরো ভালো ভালো শাড়ি,  আরোও গয়না, খাওয়া, বেড়াতে যাওয়া এইসব আর কি।  

👧🏻-আচ্ছা। (তরল স্বরে) জান তো মা, দ্রৌপদীর ছেলেদের নামগুলো কি শক্ত, আমি তো উচ্চারণ করতেই পারলাম না। বেচারী দ্রৌপদী, দ্রৌপদী শুধু অর্জুনকেই ভালোবাসত। ( বিজ্ঞ স্বরে) অর্জুন কিন্তু দ্রৌপদীকে ভালোবাসত না। অর্জুন শুধু সুভদ্রা আর চিত্রাঙ্গদাকেই ভালোবাসত। 

👨🏻-(গম্ভীর মুখে)কথা হয়েছে? 

👧🏻-(থতমত খেয়ে) কার সাথে অর্জুনের সাথে? (হাসিতে ফেটে পড়ে) নাঃ অর্জুন পিসের সাথেও হয়নি। তবে গুগল কাকার সাথে হয়েছে।

তুত্তুরী উবাচ ১১ই মার্চ ২০২১

-আরেঃ।  কি করছিস? এই অন্ধকারে ছবি তুলছিস কেন? 

-(দৃঢ় স্বরে) আমি এই মশাটার ভিডিও তুলে ভাইরাল করে দেবো। তখন থেকে পোঁ পোঁ করে জ্বালাচ্ছে। মা

-(হাসি চেপে) মশার ভিডিও ভাইরাল করলে কি হবে?

-(দাঁতে দাঁত চেপে) তখন ওকে সবাই চিনে যাবে, আর পুলিশে ধরে নিয়ে গিয়ে জেলে পুরে দেবে। 

-কাকে?

-(তিক্ত স্বরে) মশাটাকে। আবার কাকে? (অতঃপর তরল স্বরে) মা জানো তো মশাদের জেল কেমন হয়? আমাদের জেলের মত হয় না। তাতে ছোট ছোট ফুটো থাকে। যাতে মশারা না পালাতে পারে। (আচমকা তেড়ে ফুঁড়ে উঠে) এই মশা জেলে যাবি? 


তুত্তুরী উবাচ ৮ই ফেব্রুয়ারি ২০২১

👧🏻-(বাড়ি ঢোকার সাথে সাথে অত্যুৎসাহী হয়ে) মা, আমি আজ মিসকে বলেছি, বাবা তো ইলেকশন নিয়ে ভীষন ব্যস্ত, আর মায়েরও খুব চাপ। সকালে আমায় একটু খানি পড়িয়েই মা অফিস বেরিয়ে যায়-

👩🏻-(ক্লান্ত স্বরে) মোদ্দা কথাটা বল। 

👧🏻- তাই বললাম আর কি, যদি আমি আর আমার মাসি যাই প্রজেক্ট জমা করতে? মিস বলল সরি চাইল্ড। আই কান্ট অ্যালাও। প্লিজ টক টু ইয়োর পেরেন্টস্। 

👩🏻-ঠিকই তো বলেছে। তোকে এত কথা বলতে কে বলেছে? প্রজেক্টটা ডেকরেট করতে হবে কি না শুধু এইটুকু জানতে বলেছিলাম। 

👧🏻-হ্যাঁ করতে হবে তো। ম্যাম বললেন ইয়েস চাইল্ড। ডেকরেট ইট উইথ স্টোন স্টিকারস্। 

👩🏻-(ভ্যেংচি কেটে)ডেকরেট উইথ স্টোন স্টিকার্স! যেই বড়মামা কিনে দিল, অমনি মিস বলল, ঐটা দিয়েই ডেকরেট করতে হবে?

👧🏻-(নিষ্পাপ মুখে) তা আমি কি জানি? জানো তো মা, সেদিন বড়মামা আমাকে আর দাদাকে নিয়ে কদমতলা বাজার গেল না, ওই যে গো স্টোন স্টিকার কিনতে, ফেরার পথে একটা বাজারওলার কাছ থেকে কি যেন একটা কিনল। বেশী না পাঁচশ গ্রাম মাত্র। কেনার সময় বড় মামা আমায় প্রশ্ন করল, ‘এটা কি বলতো?’ আমি বললাম বরবটি। শুনে বড় মামার কি হাসি। বলল,‘তুই নাকি তোর বাবার সাথে রোজ বাজার যাস? এই তুই বাজার চিনিস?’ তারপর দাদাকে প্রশ্ন করল, ‘তুই বলতো দেখি?’ দাদা বলল, ‘ঢ্যাঁড়শ’। ওটা আসলে কি ছিল জানো? ডাঁটা। 

বড়মামা তাই হাসতে হাসতে  কি বলল জানো? বলল,‘এরা সব এক গোয়ালের গরু।  একটা বোকা গরু আর একটা চালাক গরু। ’ 

👩🏻- (হাসি চেপে) বোকা গরুটা কে? 

👧🏻-( দুষ্টু  দুষ্টু মুখে) দাদা।


তুত্তুরী উবাচ ৩রা ফেব্রুয়ারি, ২০২১


👧🏻-হ্যালো এষা পিসি! (আদুরে গলায়) কি করছ?

👩🏻‍🎓-এই তো সবে বাড়ি ঢুকলাম। তুই কি করছিস?

👧🏻- তেমন কিছু না। এবার মাছেদের খেতে দেবো। 

👩🏻‍🎓- হ্যাঁ আমিও দেবো।

👧🏻- তোমাদের অ্যাকোরিয়ামে কটা মাছ আছে?

👩🏻‍🎓- আপাততঃ একটা। বাকি গুলো মরে গেছে। 

👧🏻-এ বাবা। মাত্র একটা? আরোও কয়েকটা কেনো না শিগ্গির। 

👩🏻‍🎓-(নালিশের সুরে) তোর পিসেকে বল। যখনই বলি, একই কথা-‘ওটা আগে মরুক। তখন কিনব’। 

👧🏻-(হতভম্ব হয়ে) ওটা কি চাল নাকি, যে শেষ হলে তবে কিনে আনবে?

তুত্তুরী উবাচ ১৬ই জানুয়ারী, ২০২১


👧🏻-(দরজা খোলার সাথে সাথে) মা জানো আজ কত বড় বিপদ হচ্ছিল? আমি তো ঠাম্মা দাদুর কাছে যাচ্ছি, পথে বড় মাঠটার কাছে দেখি কয়েকটা তুলোর বলের মত কুকুর ছানা গড়াগড়ি খাচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ ওদের খেলা দেখলাম। তারপর দেখি ওরা কোথায় যেন চলে গেল। আর ওদের মা’টা এতক্ষণ দূর থেকে আমায় দেখছিল, সে এসে আমায় শুঁকতে লাগল। তারপর আমার গায়ে দুধের গন্ধ পেয়ে সটান আমার বুকে পা তুলে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। 

👩🏻-সে কি রে বাবু। কি সর্বনাশ। তারপর?

👧🏻- তারপর আর কি? আমি তো প্রবল চিৎকার করতে লাগলাম, বাঁচান! বাঁচান! একটা লোক দৌড়ে এল, ‘কি হয়েছে?’ আমি বললাম, ‘এই যে কৌটোটা দেখছেন এতে গুড়ের পায়েস আছে। আমার মা দিয়েছে ঠাম্মা-দাদুর জন্য। এই পায়েসের লোভে কুতুয়াটা আমায় আক্রমণ করছে-। ঐ সামনেই তো দাদুর ফ্ল্যাট। আমাকে একটু ঐ বিল্ডিং অবধি এগিয়ে দিন না প্লিজ’। 

👩🏻-বাপরেঃ। তুই তো বীরাঙ্গনা রে। কি সুন্দর বিপদে থেকে নিজেকে উদ্ধার করেছিস। প্রাউড অব ইউ। 

👧🏻- হ্যাঁ জানো তো, দাদু বলল, ‘আমি তোমাকে আর একা ফিরতে দিচ্ছি না।’ শেষে কাকিমা সাইকেলে চাপিয়ে পৌঁছে দিল। 

👩🏻-বাঃ। খুব ভালো। 

👧🏻- জানো তো মা, লোকটা ঠাম্মা দাদুর বাড়ি অবধি এগিয়ে দিয়ে বলল,‘তুমি রোজ ফ্লাওয়ার শো দেখতে আসো না? ডালিয়ার কুঁড়িটা কি তুমি ছিঁড়েছ?’ আরেঃ আমি ছিঁড়ব কেন? তুই ব্যাটা অপদার্থ। অামাদের ডালিয়া গাছে কুঁড়ি এসে গেল আর তোদের এল না?  

👩🏻- আচ্ছা এবার থাম। আর বড়দের অপদার্থ বলতে নেই । বিশেষতঃ উপকারীকে তো নয়ই। 

👧🏻-বড়রা ছোটোদের বলতে পারে?

👩🏻-হ্যাঁ। 

👧🏻- আজব নিয়ম তো? (মা নিরুত্তর দেখে, ফাজিল সুরে) মা হাতিদের টুথপিক লাগে?

👩🏻-(বিরক্ত সুরে) আমি জানি না। যত উৎকট কথাবার্তা। 

👧🏻-(আরো খানিকবাদে,রহস্যের সুরে) মা বলোতো কোন ভারতীয় মহিলা প্রথম বিদেশে গিয়েছিলেন?

👩🏻-(চিন্তার সুরে) মাদাম কামা? না না দাঁড়া। সম্রাট অশোকের কন্যা সংঘমিত্রা। 

👧🏻-(ফাজিল সুরে) হল না। প্রথম বিদেশ যাওয়া ভারতীয় মহিলা  হলেন সীতা। শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিল না? অার তার পিছন পিছন গিয়েছিল রাম। 

👩🏻-(তিক্ত সুরে) কোথা থেকে শিখিস এই পচাপাতকো জোকস্? হানিবানি থেকে?

👧🏻-(বিজ্ঞের সুরে)না না। আমি ইয়ে মানে ভেবে ভেবে বার করেছি। (খানিকপরে, আহ্লাদী সুরে) কি করছ বাবা? এপিক জেনারেট করছ? দাও না আমিও একটু করি?

👨🏻-(বিরক্ত সুরে) আর বাজে বকিস না তো। তুই করলে আমার চাকরী থাকবে?

👧🏻-(অবাক সুরে) আরে? এপিক জেনারেট হলেই তো হলো নাকি? শৌভিক ভট্টাচার্য করল না পুরোযা ভট্টাচার্য তাতে ওদের কি? 

(কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক থেকে) আচ্ছা বাবা,কেউ যদি কানের ফুটোতে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে চালায়, তাহলে কি সে খুব জোর আওয়াজ শুনবে?

👨🏻-(কম্পুটার চালাতে চালাতে প্রায় বিষম খেয়ে) সে কোন অাওয়াজই আর শুনতে পাবে না।

তুত্তুরী উবাচ ২৮শে জানুয়ারী, ২০২১


👧🏻-হ্যালো মামমাম। (আদুরে সুরে) হ্যাঁ মামমাম, চটি পরেছি। হ্যাঁ মা'ই তো এনে দিয়েছে কালকে। চটিটায় না কালকে দেখছিলাম সুগন্ধী তেল মাখানো ছিল। পরলেই পা হড়কে যাচ্ছিল। আজ ঠিক হয়ে গেছে মামমাম। কি নরম চটিটা। তুমি সেদিন বলছিলে না, তোমার ঐ আকুপ্রেশারওয়ালা চটিটা পরলে পায়ে লাগে, মাকে বলব তোমায়ও একটা কিনে দিতে। এই চটিটা পরলে পায়ের সব ময়লা উঠে যায়- পাটা ঝকঝক করে।

👩🏻-( পাশ থেকে ভেংচি কেটে) হ্যাঁ। কারণ পায়ের সব কালিঝুলি গিয়ে চটিতে লাগে। একদিনেই চটিটার হাল করেছে দেখো। 

👧🏻-উফ্। বড় বিরক্ত করো মা তুমি।(পুনরায় আবদারের সুরে) তোমার মেয়ে বড্ড জ্বালাতন করে মামমাম। সারাদিন শুধু (ভেঙিয়ে) 'পড়-পড়' করে পিছনেই পড়ে থাকে।(মায়ের থেকে একটু সরে গিয়ে,অভিমানী সুরে) জানো তো মামমাম, বাবাও আজ আমায় বকেছে। 

👵🏽- বাবা তো বকে না মা। কেন বকেছে? 

👧🏻- কেন আবার? আমি আঙুল চাটছিলাম তাই। 

👵🏽- খামোকা আঙুল চাটছিলে কেন? 

👧🏻- আরেঃ আমি মাছের ঝোলের সাথে লেবু মেখে ভাত খেয়েছিলাম। তারপর দই দিয়ে ভাত খাবার আগে ভাবলাম, লেবুর রসে যদি দুধ কেটে যায়, তাহলে দইটাও তো কেটে যাবে। তাই ভালো করে হাত চাটছিলাম। বাবা ধমকে বলল, ‘দুধ কেটেই তো দই হয়। দই খামোকা কাটতে যাবে কেন?’

(প্রসঙ্গ বদলে) দাদু আবার কবে রেশন আনতে যাবে? আমিও যাব তাহলে-। সেদিন খুব মজা হয়েছিল। দাদু তো আমায় রিক্সায় বসিয়ে আর কুড়িটাকার নোটটা দিয়ে রেশন তুলতে গেছে, বলে গেছে ,‘তুমি রিক্সাটাকে ধরে রেখো তুত্তুরী। ’ আমি তো রিক্সাটাকে চেপে ধরে বসেই আছি, বসেই আছি। রিক্সাওয়ালাটা বলে কিনা, ‘ বাবু একবার নামো তো।’ আমি ভাবলাম,পিছনের কাপড়টা ঠিক করবে বুঝি। যেই নামলাম, ওমনি অন্য একটা বুড়োকে বসিয়ে পোঁপাঁ দৌড়। আমি বোকার মত খানিক দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর গুটি গুটি দাদুর কাছে গিয়ে হাজির হলাম। দাদু তো হতবাক। ‘তোকে রিক্সাটাকে ধরে রাখতে বললাম যে-।’ ভাগ্যিস টাকাটা দিয়ে দিইনি।  তারপর রেশন নিয়ে রাস্তায় এসে আবার অন্য একটা রিক্সা ধরলাম আমরা। রিক্সায় ওঠার সময় দাদু বলল ,‘তুত্তুরী তুমি ঐ দিকটায় বসো। আমি একদিকে বসব। এদিকে রোদ আসছে,।  আমি রোদ পোহাতে পোহাতে যাব। ’শুনে তো আমি হেসে বাঁচি না। দাদু কি কুমীর নাকি? যে রোদ পোহাবে? 

যাই বলো। খুব মজা হয়েছিল সেদিন। জানো তো মামমাম, রেশন দোকানে প্যাকেটের মাল পাওয়া যায় না। সব গোটা গোটা। সব বিনা পয়সায় পাওয়া যায় রেশনে। 

👴🏼-(দাদু পাশ থেকে গলা তুলে) বিনা পয়সায়? ওটা কি আমার শ্বশুরমশাইয়ের দোকান নাকি রে?

Sunday 3 January 2021

অনির ডাইরি, ৩১শে ডিসেম্বর, ২০২০

 

“ঝটক কে গেঁসু যাঁহা চলে,তো সাথ মেঁ আশমাঁ চলে-”

সকাল আটটা। কিশোর কুমারের মধু ঢালা কণ্ঠ থামিয়ে বেজে ওঠা ফোনটা যখন ধরলাম, সিক্ত কেশ গুচ্ছ দিয়ে টপাটপ ঝরে পড়ছে মুক্তোকণা। গানটাকে গত রাতে কিছুতেই খুঁজে পাইনি। আজ সকালে অনুধাবন করলাম, “কেয়া সুরৎ হ্যায়” বলে অন্বেষণ করলে, “জরুরৎ হ্যায়”কে খুঁজে পাওয়া যায় না। 


ফোনের ওপারে জনৈক মস্ত বড় সাহেবের পিএ। ঘুম জড়ানো অসহায় কণ্ঠে জানান, অনিবার্য কারণ বশতঃ আজকের বৈঠক বাতিল। বসের নির্দেশ সবাইকে জানাতে হবে, অথচ ওণার গৃহে বা মোবাইলে কারো নম্বর নেই। লাজুক কণ্ঠে সবিনয় অনুরোধ, যদি বাকি আধিকারিকদের এট্টু জানিয়ে দিই- অত্যন্ত আনন্দের সাথে রাজি হয়ে যাই।  বর্ষবরণের প্রাক্কালে বৈঠক বাতিলের সংবাদ বহন অতীব পূণ্যকর্ম। 


আজ বছরের শেষ দিন। কোন এককালে এমন দিনে আপিস যেতে ডাক ছেড়ে কান্না পেত। উৎসব মুখর শহর আর খুশি খুশি নাগরিক বৃন্দ জাগাত ভয়ানক হীনমন্যতা।  জমানাই ছিল ভিন্ন, আর শৌভিকের ভাষায় আপিসটাও ছিল ‘জঘন্যের কাকাবাবু’।


এ হেন বালখিল্যচিত ছিঁচকাঁদুনে দুঃখবিলাস অবশ্যি আজকাল আর অনুভূত হয় না। জেলাটা ভালো, আপিসটা ভালো, লোকজন ভালো আর সবার ওপরে আপাততঃ মোদের শিরে সংক্রান্তি। 


আরে মশাই, বারো দিন বাদে আমাদের মেলা বুইলেন। সময় কম, লোক বল তলানিতে আর অর্থ বল? বাজেট কাটতেছাঁটতে যাকে বলে জেরবার আমরা। নির্দয় হাতে ছাঁটা হচ্ছে মেলার যাবতীয় সৌন্দর্যায়ন।  প্রতিপদে কেটারার আর ডেকরেটরের সাথে দরদাম করে চলেছে আমার অবশিষ্ট খঞ্জভঙ্গ টিম। শেষে গতকাল উনি হতাশ হয়ে বললেন, “বাজারদর সম্পর্কে আপনাদের কোন ধারণা আছে ম্যাডাম? আলু-পেঁয়াজের দাম জানেন? গ্যাসের দাম জানেন?” আলু-পেঁয়াজের সঠিক দাম না জানলেও, জানি বাজারে লেগেছে আগুন। আর সদ্য অনলাইন গ্যাসের বিল দিলাম, তাই এমাসে গ্যাসের দামটা ঠোঁটস্থ। উনি আমাদের সম্মিলিত অত্যাচারে এই ঠাণ্ডাতেও ঘেমে উঠেছিলেন। কপালের ঘাম মুছে হেসে বললেন, “ওটা তো ডোমেস্টিক ম্যাডাম। কমার্শিয়াল সিলিণ্ডার আরও অনেক বেশী মূল্যবান।” সে হোক। আমরা নিরূপায়। আপনার যা প্রাণ চায় করুন। যা খুশি বিল দিন। আমার এইটুকুই  সম্বল- 


সকাল নটা। গুড় নিয়ে ফিরল তুত্তুরী। গিয়েছিল আখের গুড় আনতে। কিনে এনেছে ভেলিগুড়। একখানা জাম্বো নারকেল দিয়েছে মা। বেহারী নারকেল। দেশ থেকে এনে দিয়েছে পৌরসভার ঝাড়ুদার। রোজ ময়লা নিতে এসে খোশগল্প করে বাবা আর মায়ের সাথে। যত এদের নিষেধ করি, অপরিচিত অর্ধপরিচিত মানুষের সাথে এত খোশ গপ্প করো না। জমানা খারাপ। তা শুনলে তো? কদিন আগে বোধহয় মা বলেছিল আমার জামাই আর নাতনী নারকেল নাড়ু খেতে বড় ভালোবাসে। বাজার গিয়ে বাবার পক্ষে নারকেল কিনে আনা প্রায় অসম্ভব। স্থানীয় যারা বাজার নিয়ে বসে তারা তো আর নারকেল বিক্রি করে না।  


মায়ের দুঃখে গলে গিয়ে, চারদিন কাজে ডুব মেরে, চার খানা খোক্ষস মার্কা নারকেল এনে দিয়েছে ঝাড়ুদার। দরাদরি অন্তে নগদ ৩৫০টাকায় কেনা চারখানা নারকেল, যার দুখানি নাড়ু রূপে আর একখানি গোটাগুটি এসে হাজির হয়েছেন আমার গৃহে। নারকেল তো পেলাম,ফাটাই কি দিয়ে? ছোট নারকেল হলে বাটনা বাটার নোড়া মেরে ঘায়েল করে লতা দি। এটা যা জাঁদরেল। 


রমেশকে বলেছিলাম একটা কাটারি কিনে দিবি বাবা? অত্যুৎসাহী জনগণ যত। নিজের বাড়ির ভারি কাটারিটাই গছিয়েছে দিন কয়েকের জন্য। তিনি এসেছেন তো এসেইছেন। কাজে আর লাগানো হচ্ছে না তাঁকে। মায়ের হাতের নাড়ু শেষ হলে তবে না নতুন নাড়ু পাকাব। 


গতকালই লতাদিকে বললাম,যা হয় হোক, এবার কাটারিটা ফেরৎ দিতে হবে। ভেবেছিলাম বছর শেষে আপিস ফেরতা চিনির নাড়ু পাকাব। বাপ-মেয়ের না পসন্দ। সাতসকালে তাই কৌটো নিয়ে দৌড়েছিল তুত্তুরী পাঁচশ আখের গুড় আনতে। মেয়েকে দোকানে পাঠাতে খুব একটা স্বচ্ছন্দ বোধ করে না শৌভিক। ভয় পায়। যা ট্যালা মেয়ে। তাই টাকাপয়সা ছাড়াই দোকান যায় তুত্তুরী। দোকানদার হোয়াটস্ অ্যাপে পাঠিয়ে দেয় বিল।  


আজ তিনি অনুপস্থিত। দোকানের পুঁচকে কর্মচারী আখের গুড় বোঝেনি। পাঁচশ ভেলি গুড় গছিয়েছে। তাই নিয়েই নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরেছে আমার কন্যা। 


আখের গুড়ের পরিবর্তে ভেলি গুড় এনেছে বটে, তবে পথে কোন বুড়ো রিক্সাওয়ালা নাকি মামণি বলে ডেকে বিনামূল্যে বাড়ি পৌঁছে দিতে চেয়েছে, তাকে দিব্য মায়ের ভয় দেখিয়ে পাশ কাটিয়ে ফিরে এসেছে ট্যালা মেয়েটা। বর্ষ শেষে এটাই কম পাওনা কি? রোমে টিকতে হলে রোমান হতে হয়, আর জঙ্গলে বাস করতে হলে- 


বেলা দশটা- “আজ কোথাও যাচ্ছ তোমরা?” ফোনের ওপার থেকে সংকুচিত ভাবে জানতে চাইল উমা।  তুত্তুরীর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও ভেলিগুড় বিদায় করে, ধার করা কাটারি বগলে আপিস বেরোতে একটু দেরীই হয়ে গেছে। হাসি চেপে জানালাম, যাচ্ছিই তো। যে যার আপিস। “তাহলে সোনাইকে নিয়ে একটু বেরোব?” আবার জানতে চায় উমা। উমা অর্থাৎ কাকিমা আর তার সোনাই অর্থাৎ তুত্তুরীর মধ্যে সাধারণত ঢুকি না আমি। যতক্ষণ  না দুটোতে ঝটাপটি করছে, যা খুশি কর না বাপু তোরা।   


বেলা এগারোটা- আপিসে ঢুকতেই সঞ্চিতা বলল, “ওরা কিন্তু আসবে ম্যাডাম। দল বেঁধে।” ওরা আসবেই, জানি। গতকাল মেলার সমস্ত দপ্তরী দায়িত্ব থেকে ওদের অব্যাহতি দিয়েছি যে। তারপর থেকেই উত্যক্ত করছে ওরা। 


বড় সাহেবই বলেছিলেন, ‘তোমার ছেলেমেয়েগুলো ভালো, তুমি বললে ওরা ফেলতে পারবে না। কিন্তু সাংগঠনিক ভাবে যদি ওরা মেলা বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আমাদের চাপ দেওয়া অনুচিত। দেখো কি করবে-।’  আমার ছেলেমেয়ে গুলো সত্যিই ভালো, মেলা নিয়ে আমাদের থেকে ওদের উত্তেজনা বেশী। শ্যামল তো রোজই লিখে চলেছে, ‘দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসবে আমাদের মেলা দেখতে। কত লোক চাই ম্যাডাম। আমি আনব।’ ধরে বেঁধে থামাতে হয় এদের। বাপঃ করোণা এখনও আছে কিন্তু। 


তবুও ভেসে আসে নানা অপ্রীতিকর বার্তা। অন্য মহকুমার লোকজনের তিক্ত ঝাঁঝালো উক্তি। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য ফোন করে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে কৌশিক। “জানেন না আমাদের কি অবস্থা?”  অবস্থা আমাদের থেকে ভালো কে জানে? তুচ্ছ ফিল্ড আপিসের ওপর গোঁসা হতেই পারে, কিন্তু ফিল্ড আপিসের অসহায়তা বুঝবি না তোরা? তাহলে কে বুঝবে? ক্ষোভ অভিমান তো আমাদেরও হয়- তাই লিখেছিলাম,  মেলা তো তোমাদেরই, অবশ্যই মেলায় এস, মেলার কাজে অংশগ্রহণ করো, কিন্তু স্বেচ্ছায়। এবার অফিশিয়ালি যাবতীয় দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হল সকলকে। ‘আপনি আর কপনি’ নিয়েই লড়ে যাব আমরা। 


বেলা একটা- তুত্তুরীর ফোন আর থামেই না। দারুণ কাটছে আজকের দিনটা। পিছনের কেরিয়ারে সোনাইকে বসিয়ে সারা আবাসন সাইকেলে চক্কর মেরেছে কাকিমা। জীবনে কখনও সাইকেলের কেরিয়ারে বসেনি তুত্তুরী। তারপর পাড়ার ছোট্ট পার্কে ঢুকে এক অবাঙালি শিশুর থেকে ধার করা ফুটবল নিয়ে হুল্লোড়বাজি, দোলনায় চড়া, ঢেঁকিতে চড়া আর তারপর মাঠে রোদ পোয়াতে আসা জনৈক দাদুর আদরের থলথলে ল্যাব্রাডর কুতুয়াকে ধার নিয়ে আশ মিটিয়ে চটকেছে দোঁহে। আদরের দাপটে নাজেহাল কুতুয়া মাঝে একবার পালিয়ে গিয়ে পাশের গাছে পা তুলে কিভাবে ইয়ে করেছে সেই গল্পও শোনায় তুত্তুরী। সারা বেলা টইটই করে ঘুরে, হাফ প্যাডেল শেখা তথা শেখানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টান্তে বাড়ি ফিরেছে দুজনে। উফঃ এমন দিন কেন যে রোজ আসে না, একসাথে চিৎকার করে দুটোতে, সাধে এদের মধ্যে ঢুকি না।  


বেলা তিনটে-কালো হয়ে আসা মুখগুলিতে মাখামাখি আব্দার আর আর্তি।  “ও ম্যাডাম, রাগ করবেন না।” “দুঃখ পাবেন না। মেলা থেকে প্লিজ আমাদের সরিয়ে দেবেন না। আমরা আসব হ্যাঁ।” ওদের মেলা থেকে ওদের বাদ দেবার ক্ষমতা কি আমার আছে? কত বড় শক্তিধর আমি? আর রাগ? রাগ হলেও তার স্থায়িত্ব কতক্ষণ এরা ভালোমতই জানে। মন কষাকষি, মান অভিমান, রাগ-অনুরাগ মিটতে মেটাতে গড়িয়ে যায় বেলা। বর্মন সাহেব গলা ঝেড়ে, হাত কচলে, জানান দেন, সব তো হল, এবার একটু কিছু খাওয়া দাওয়া হবে না? আজ যে বছর শেষ। বুঝতে বাকি থাকে না, বাইরে থেকে শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠিয়েছে সবাই মিলে। ছদ্ম গাম্ভীর্যের প্রসাধনের আড়ালে ফিক করে হেসে ওঠে হৃদয়,‘ এমনি ভাবেই কাটুক না বছর গুলো, কিছু নরমে, কিছু গরমে। কিছুটা লোহায় আর বাকিটা নিখাদ সোনায়।’