Sunday 27 December 2020

অনির ডাইরি ২৫শে ডিসেম্বর, ২০২০



সাতসকালে ঢুলঢুলে মেয়েটার ঘুম ভাঙিয়ে, কোনমতে দুটো মেরি বিস্কুট খাইয়ে, হাওড়ায় রেখে অফিস যাওয়াটা তুত্তুরী এবং আমার কাছে যেন রূপকথা। সারাদিন ধরে একছত্র রাজত্ব চালায় তুত্তুরী। ঝিম মেরে থাকা দেড়শ বছরের বুড়ো বাড়িটা যেন জেগে ওঠে মন্ত্রবলে। আজব যত আব্দার করে তুত্তুরী। সাজতে বড় ভালোবাসে মেয়েটা। আর বড় মামি ভালোবাসে সাজাতে। কখনও লক্ষ্মীঠাকুর সাজে তুত্তুরী, তো কখনও সাজে পরী।  হাতের কাজ সেরে সাজাতে বসে চৈতি। আগামী কাল বড়দিন কি না, তাই বোধহয় নিজের সাদা সালোয়ার আর পাথর বসানো গয়নায় পরী সাজায় তুত্তুরীকে। তুত্তুরীর শহর জুড়ে নামে বুঝি রূপকথার মরশুম- 


দেবানন্দপুরের চাটুজ্জেদের বাড়ির আনাচেকানাচে নেচে বেড়ায় ফরিদপুরের ভট্টচার্য বাড়ির পরী। আজ তার সাতখুন মাপ। আজ যে আমি দিনান্তে ফিরব নিজের শহরে। শহরটা অবশ্যি বদলে গেছে অনেকটাই। বহিঃরঙ্গে লেগেছে প্রসাধনের প্রলেপ। দিদিমণি যেদিন থেকে গঙ্গা পেরিয়ে বাসা গড়েছেন এইপাড়ে, ল্যাদ খাওয়া চেনাছন্দ ভুলে, রীতিমত তন্বী হয়ে উঠছে পাঁচশ বছরের বুড়ি শহরটা। রাজপথ যেন আজকাল অনেক বেশী তকতকে। নিয়ন আলোয় উদ্ভাসিত। পাইকারি হারে স্যাঁৎসেতে ড্যাম্পধরা সাবেকী বাড়ি ধুলিসাৎ করে মাথা চাড়া দিচ্ছে ফ্যান্সি বহুতলের সারি। পথেঘাটে বাড়ছে অবাংলা ভাষীদের ভিড়। কে জানে হয়তো নিজ ভূমে ক্রমেই সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছি আমরা মুষ্টিমেয় আঞ্চলিক বাঙালী। 


 গলির ভেতর অবশ্য একই আছে শহরটা। ওঠে একই রকম শীতের আদুরে পশমী রোদ। আছে ড্রেন, আছে খানাখন্দ, আছে উপচে পড়া ভ্যাট,গোছা গোছা ফেতি কুতুয়া, আছে পাড়ার  মাঠে একই রকম ভাবে বল পেটানো ছন্নছাড়া ছেলেছোকরার দল। আছে চায়ের ঠেক, আছে জগতের ভবিষ্যৎ চিন্তায় উদ্বিগ্ন  জটলা পাকানো বয়ঃজ্যেষ্ঠদের দল। সব মিলিয়ে সময় যেন আজও থমকে আছে সহস্রাব্দের ওপারে- 


যেখানে আজও সারা দুপুর জেগে নারকেল কুরিয়ে রাখে মা। ঝোলা ভরে বুম্বার দোকান থেকে আখের গুড় নিয়ে আসে বুল্লুবাবু। পরীর সাজ খুলে, মস্ত স্টিলের গামলায় হাপুসহুপুস করে কুরানো নারকেল আর গুড় চটকায় তুত্তুরী। হাত লাগাতে গেলে ধমকে ওঠে মা, আঃ ও করতে চাইছে, ওকে বাধা দেওয়া কেন বাপু? সাধে শৌভিক বলে, “ওকে জিজ্ঞেস করে দেখ সাপের কটা পা। ও বলবে পাঁচটা। ” 


 কড়ায় অল্প ঘি মাখিয়ে নারকেল আর গুড়ের মিশ্রণ ঢেলে, গ্যাস কমিয়ে চায়ের গ্লাস হাতে সিরিয়াল দেখতে বসে মা। দাদার সাথে খেলতে চলে যায় তুত্তুরী। চায়ের কাপে ঠোঁট চুবিয়ে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে কড়ার দিকে তাকিয়ে থাকে বাবা। যদি ধরে যায়। তাড়ু না মারলে আবার নাড়ু হয় গা? তাড়ু মানে খুন্তি চালানো। খুন্তি চালানোর পারিশ্রমিক হল অঢেল অর্ধপক্ক গুড়-নারকেল। একটু সামলে খেতে হয় এই যা, নইলে যুগপৎ হাত এবং জিভ পুড়ে কাঠকয়লা।  



“এঁটো করে খাস না যেন-” টিভি দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক সুরে হাঁকে মা। ভুলে গিয়েছিলাম, এবাড়িতে এঁটোকাটার বাছবিচার বড় কঠিন। আমাদের মধ্য হাওড়ায় ভাতের এঁটোকে এককালে বলা হত 'সকড়ি'- এখনও বলে কি, কে জানে? 


বড়দিনের সকাল মানেই ঘরে তৈরি কেক। অন্তত আমার মেয়ের কাছে।  আবাসনের রাজা ঘরে তৈরি কেক বিক্রি করে, বড় দাম কিন্তু অসম্ভব ভালো খেতে।  এই পরবের সময় কয়েক দিনই বানায় ওরা। যা বানায় অর্ধেক স্বামীস্ত্রী নিজেরাই খেয়ে নেয়। বাকি অর্ধেক পড়তে পায় না। ঐ কেক কিনে আনলেই ল্যাটা চুকে যেত- তা না।  


বৃদ্ধ দাদুর ঘাড়ে চেপে গুচ্ছ খানেক কাজু, কিশমিস, ড্রাই ফ্রুট আর কুমড়ো মেঠাই কিনিয়ে আনে তুত্তুরী। ওগুলোকে একরাত রামে ভিজিয়ে রাখলে নাকি দুর্ধর্ষ স্বাদ হয়। কিন্তু তাঁকে কোথা পাই? মা যে রাম-লক্ষ্মণ- হনুমান জাতীয় যাবতীয় পানীয় ভজনার ঘোরতর বিরোধী। তাছাড়া রাম দিয়ে কেক বানালে তো সেটা তুত্তুরীর ভাষায় “অ্যাডাল্ট কেক” হয়ে যাবে না?


 ওভেন নেই। মস্তবড় প্রেশার কুকার বার করে দেয় মা। কুকারের তলায় নুন ছড়িয়ে, তারওপর বসাতে হবে সেপারেটর এর বাটি। বাটিতে ঢালতে হবে কেকের মিশ্রণ। ব্রাউন পেপার নেই, কুছ পরোয়া নেই, বাটির গায়ে হাল্কা করে মাখন মাখিয়ে, পাতা হয় বাবার মস্ত প্যাডের চারখানা পাতা। পাতা ছিঁড়তে ছিঁড়তে অভিযোগের সুরে নতুন প্যাডের ফরমাইশ করে বাবা। 


চিনি গুঁড়ো করে মেশাতে হয় ডিম আর ভ্যানিলা এসেন্সের সাথে। অর্জুন পিসের নিষেধ আছে, ফ্রিজের শীতল ডিম দেওয়া যাবে না। কেক তাহলে খুব নরম হয় না। ডিমকে কি করে গরম করা হবে,সেই নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে তুত্তুরী আর তুত্তুুরীর দাদু। তবে কি গরম জলে কয়েক মিনিট ভিজিয়ে রাখা হবে ডিমগুলোকে? বা হালকা করে একটু ফুটিয়ে নিলে- 



কেক বানাতে বানাতে গড়ায় বেলা। জন্মদিনের খাওয়াটা বাকি আছে বাবার। মাটন বিরিয়ানি খেতে বড় ভালোবাসে বৃদ্ধ এবং তাঁর স্ত্রীও। বেহরুজে কিলোদরে বিক্রি হয় বোনলেস মাটন বিরিয়ানি। সাথে পুদিনা গন্ধী রায়তা আর ঘিগন্ধী ক্ষীরের পান্তুয়া থুড়ি গুলাবজাম ফ্রি। মায়ের মত যারা শুকনো বিরিয়ানি খেতে নারে, তাদের জন্য খুব অল্প টাকায় দারুণ মির্চি কা সালান বানায় ওরা। 


ধনেপাতা ছড়ানো বাসমতী চাল আর বোনলেস মাটনে বিমোহিত হয়ে যাই তুত্তুরী আর আমি। পেট ভরে,মন জুড়ায় কই? "মন্দ কি" বলতে বলতে নিরাসক্ত হয়ে কাঠের চামচে দিয়ে আলু খোঁজে বাবা। বিরিয়ানিতে আলু নেই? হতভম্ব হয়ে পড়ে মা।  ডিমও নেই? নেই সুবাসী আতর? তাহলে এই মাংসের ঝোল মাখা ভাতের এত দাম কেন? বিষম খেয়ে অওধী বিরিয়ানি আর হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানির তফাৎ বোঝাই। ভাতের আবডালে লুকোচুরি খেলা বেরেস্তা খুঁজে এনে আত্মপক্ষ সমর্থন করার বৃথা চেষ্টা করি। “কেক বানালে আর বিরিয়ানি বানানো যায় না বুঝি?” গম্ভীর মুখে জানতে চায় মা? “তোর বানানো বিরিয়ানিটাই সবথেকে ভালো লাগে আমাদের-”। সমালোচনার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসায় দ্রবীভূত হয়ে যাই আমি। সত্যি এ শহরের সবটুকু জুড়ে আজ রূপকথার মরশুম- 


“মামমাম তোমার লিপস্টিক আছে, মা আনতে ভুলে গেছে?” চিৎকার করে ওঠে তুত্তুরী। হেসে উঠি, ভদ্রমহিলা জীবনে ওসব রঙ মাখেননি আর এখন তো-। হাসি দেখে রেগে যায় মা। তারপর বেতো হাঁটু নিয়ে, বাক্সপ্যাঁটরা ঘেঁটে বার করে আনে, এল এইট্টিনের কবেকার লালচে রঙা লিপস্টিক। শুকিয়ে গেছে ভিতরের জোজবা অয়েল। ভেঙে গেছে মাঝখান থেকে। তবুও বাকরহিত হয়ে পড়ি আমি। এতো আমার আইবুড়ো বেলায় কেনা ৬০/৮০টাকার লিপস্টিক। এত বছর ধরে এত যত্নে তুলে রেখেছে মা? বললে রেগে যায় মা। “কে বলেছে তোর? এটা আমি আনিয়েছিলাম তোর বাবাকে দিয়ে।” কথা বাড়াই না। সত্যিই তো বাবাকে দিয়ে কাশি মামুর দোকান থেকে কিনে আনিয়ে দিয়েছিল মা, কোন সে রূপকথার যুগে। যখন বুঝি আকাশে উড়ত পক্ষীরাজ আর গপ্প শোনাত ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী। নাঃ এ শহর জুড়ে আজ শুধুই গোলাপী রূপকথা- 


আজ বাড়ি ফেরার দিন। সকাল সকাল জলখাবারে লাল আটার গোলগোল পরোটা বানায় মা। সাথে খোসা সমেত আলুর তরকারী। “তোমরা কত ভালোমন্দ জায়গায় খেয়ে বেড়াও- গরীবের লাল আটার পরোটা কি আর তোমাদের মুখে রোচে?” অভিমানী সুরে শোনায় বাবা। প্রতিবার চলে আসার সময় এমন অভিমান করে বাবা। ফোলায় ঠোঁট। মান ভাঙাতে বেশী ক্ষণ লাগে না আমাদের। যাব বটে, আবার তো ফিরে আসব। আবার। আবার।বারে-বারে--। এ শহর ছেড়ে যাই কোথা? এ শহরের যে মজ্জায় মজ্জায় রূপকথা।


খুশি হয়ে অভিমান ভুলে সাদা আলুর তরকারীর রেসিপি শেখায় বাবা। খোসা সমেত আলুকে কেটে নুন জলে সিদ্ধ করে, বড় হাতায় পরিমাণ মত তেল, জিরে, অল্প হিং আর শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে ফুটিয়ে  সিদ্ধ আলুর ঝোলে মিশিয়ে দিতে হবে। হলুদ দিতে নেই। হলুদে নষ্ট করে দেয় খোসা সমেত সিদ্ধ আলুর সুবাস। উপর থেকে ধনেপাতা কুচি ছড়িয়ে দিলে তো পুরো অমৃত। যুগপৎ হাঁটুর ব্যথা অার ঠাণ্ডায় কাবু হয়েও অমৃতই তো বানায় মা। 


বেলা বাড়ে, ব্যাগ গোছাই আমি। তুত্তুরীকে বগলদাবা করে রেশন দোকান যায় বাবা। যেমনি যেতাম আমি। মস্ত বড় দাঁড়িপাল্লায় খালি তেলের টিনে মস্ত বড় হাতায় করে চাল, গম বা চিনি ঢেলে ওজন করা দেখে হতভম্ব হয়ে যায় তুত্তুরী। যেমনি যেতাম  আমি। গমকলে গিয়ে তাজা গমভাঙা গন্ধে নির্বাক হয়ে পড়ে তুত্তুরী। যেমনি যেতাম আমি। বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে, “হ্যাঁ গো তোমাদের দোকানে প্যাকেট করা মাল পাওয়া যায় না?”  বৃদ্ধ মালিকের পুত্র কিণ্ডারগার্টেনে আমার সহপাঠী ছিল, তাঁর গৃহেও বিরাজমান এমন একখানি নমুনা, তাই বুঝি হেসে ওঠেন তিনি। সবিনয়ে জানান, “না মা। এটা যে রেশন দোকান।”


বাড়ি ফিরে সহর্ষে রেশন দোকান আর গমকলের গল্প শোনায় তুত্তুরী। দোতলার দালানে সার সার ফেঞ্চ উয়িন্ডো দিয়ে চুঁইয়ে আসা সোনালী পশমী রোদ বাদামী রঙা মেঝেতে কাটে অচেনা আঁকিবুকি। সুযোগ বুঝে রান্নাঘরের জানলা গলে মুখ গলায় বুল্লুর আদরের বেড়ালিনী কালি- পেয়ারা গাছে উড়ে এসে বসে অচেনা এক জোড়া পাখি। খাঁচায় বসে ঢোলে মায়ের আদরের ককটেল- শহরটার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে গোলাপি রূপকথা।

Friday 25 December 2020

অনির মধ্যপ্রদেশের ডাইরি,১৪ই নভেম্বর, ২০২০

 


মাঝে মাঝে মনে হয় হাতটা বেঁকিয়ে নিজের নিজের পিঠটা চাপড়ে দি খানিক। বাপরেঃ জীবন যে এত ঘোল খাওয়াবে কোনদিন স্বপ্নে ভেবেছিলাম? সাতসকালে উঠে, স্নান আহ্নিক সেরে, ঝক্কাস সাজুগুজু করে, সুপ্তোত্থিত কন্যাকে বগল দাবা করে সোজা হাওড়া- বাবা-মায়ের ঘাড়ে মেয়ে চাপিয়ে সোজা চুঁচুড়া। সারাদিন ঝঞ্ঝাটের মিটিং সেরে, রঙ্গোলি আর প্রদীপ হাতে ছবি, গ্রুপ ছবি তুলে রাত আটটায় আবার হাওড়া। বাড়ি ঢুকে চা- জলখাবার খেয়ে আবার স্নান সেরে লক্ষ্মী ঠাকুর পাতা। পাততে পাততে মনে হচ্ছিল ঢুলেই পড়ে যাব বোধহয়। যদিও ঘুমোতে ঘুমোতে রাত বারোটা, আহাঃ পুজো শেষে জমজমাট পারিবারিক আড্ডাটাকে তো মিস্ করতে পারি না। 

পরদিন পুনরায় ঢুলঢুলে মেয়েকে টেনে হিঁচড়ে তুলে, ওলা ধরে বেলা দশটার মধ্যে বাড়ি। আজ কালিপুজো। কাল সকাল দশটা পঞ্চাশে আমাদের ফ্লাইট। ভেবেছিলাম, মানে শৌভিকের সাথে কথা হয়েছিল যে দিনের বেলা হাটারি থেকে খাবার আনিয়ে নেওয়া হবে, আহাঃ কতদিন ওদের ড্রামস্ অব হেভেন আর রাইজ নুডলস্ খাইনি। খাবার আনিয়ে নিলে আর রাঁধতে হয় না। গোছগাছ  তো সবই বাকি। 


ভাবি এক আর হয় এক। আটদিন থাকব না, ফ্রিজে যা জমে আছে শেষ তো করতে হবে রে বাবা। খাবার নষ্ট তো আর করতে পারি না। সত্যিই ঐ রোগেই বাঙালী মরেছে। শৌভিকের গতকালের অভুক্ত ভাতকে মাখন,পেঁয়াজ, টমেটো আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে টমেটো রাইজ বানিয়ে জলখাবার সারলাম আমরা মা মেয়েতে, তারপরও দেখি বাস্কেটের ভিতর থেকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে বেশ কিছু সব্জি। অগত্যা- থাকুক হাটারি এবেলা।  


পথশ্রমের ক্লান্তিতেই বোধহয় অথবা বাবামাকে নিভৃত দাম্পত্যালাপের সুযোগ করে দিতে কালিপুজোর দিন মাঝ সকালে নাক ডাকাতে লাগল তুত্তুরী। একটু বেলা করে রান্না বসালেও তো চলবে আজ- জমে আছে কত যে কথা- 


বেলা একটা নাগাদ রান্না করতে করতে হঠাৎ মনে হল, ফোনটা চার্জে বসানো দরকার এবং সেটা করতে গিয়ে দেখি চার্জার খানা রয়ে গেছে হাওড়াতেই। বাঃ! সাধে কি বললাম, কব্জি বেঁকিয়ে চাপড়াতে ইচ্ছে করে নিজেরই পিঠ। আপনারা কি ভাবলেন? এমন আপদ ফোন, যাতে লাগে না অন্যান্য ফোনের চার্জার। কি হবে এখন? কাছাকাছি ফোনের দোকান বলতে হাঁটা পথে মিনিট বিশেক। তার নম্বরও নেই আমার কাছে। একটু আগে দেখলেও নির্ঘাত এনে দিত শৌভিক। কিন্তু সদ্য একগাদা বিস্কুট আর কিছু ওষুধপত্র কিনে এনে স্নানে ঢুকেছেন তিনি। এখন বললে নির্ঘাত গালমন্দ-  


নাঃ আমার বর কখনই বকে না। কখনই রেগে যায় না। হয়তো এককালে যেত, দীর্ঘ একযুগ ধরে গিন্নীর ন্যাদশপনা সহ্য করতে করতে আজকাল আর কিছুই বলে না। বরং পাশে থাকার চেষ্টা করে। সহমর্মিতা  দেখায়। যেমন আজ এগিয়ে দিল ফোনের দোকানের কার্ডটা। ঘড়িতে বেলা দুটো। তিনবার ফোন করেছি,ধরছে না লোকটা। ধর বাপ!প্লিজ ধর। আট-নদিন ফোন ছাড়া থাকা? উফঃ ভগবান।  


আড়াইটে নাগাদ ফোন ধরল লোকটা। জানাল চার্জার পাওয়া যাবে বটে তবে দোকান বন্ধ হয়ে যাবে তিনটের সময়। শৌভিক জামা গলাতে গলাতে বলল, “আমি এখুনি যাচ্ছি। কিন্তু তার আগে খেতে তো দে।”ওঃ হরি, রান্নাই তো শেষ হয়নি এখনও। সাধে কি বলি নিজের পিঠ চাপড়াতে ইচ্ছে করে। 


আবার ফোন করলাম লোকটাকে ভয়ে ভয়ে,  দাদা ওবেলা কি দোকান খুলবেন? জানতাম জবাব কি আসবে। আরেঃ আজ কালিপুজো। আজ কখনও কেউ সন্ধ্যেবেলা দোকান খোলে। ওপাশ থেকে হাসি ভেসে এল,“অবশ্যই খুলব। সন্ধ্যে ছটা থেকে দোকান খোলা। আরেঃ আমাদের বয়সে আবার কালিপুজো কি?” কাছাকাছি থাকলে নির্ঘাত হামি খেতাম লোকটাকে। 


দুপুরের খাওয়া মিটতে মিটতে বেলা তিনটে গড়িয়ে গেল। গড়িয়ে পড়ল শৌভিকও। ছোট্ট করে দিবানিদ্রা আর কি। গড়াবার তাল করছিল তুত্তুরীও। মামদো বাজি আর কি? সেই চুঁচুড়া থেকে কিনে এনেছি রঙ্গোলী বানানোর হরেক রঙ। কিনে এনেছি টিলাইট ক্যাণ্ডেল, মাটির প্রদীপ,ফ্লোটিং ক্যান্ডেল। বানাবে কে আর সাজাবে কে? 


মেয়ের সাথে খুনসুটি করতে করতে রঙ্গোলী যখন সেজে উঠল সন্ধ্যা নামছে কলকাতার বুকে। জ্বলে উঠেছে আবাসনের লাল-নীল-হলদে-সবুজ আলোর মালা। কফি বানিয়ে মুখের কাছে ধরল শৌভিক, এমন বর না থাকলে আমার যে কি হত? 


রঙ্গোলী প্রস্তুত। বাতি, প্রদীপ, সলতে,তৈল সাজানো শেষ,এবার সাজুগুজু করার পালা। তুত্তুরীর লাল কোল্ড শোল্ডার ড্রেস আর আমার টিয়াপাখি সবুজ খোলের কাঞ্জিভরম। যার লাল পেটা জরির পাড়ে ঝিলিক মারে আলো। একযুগ পূর্বে ফুল শয্যার তত্ত্বে সেজে এবাড়িতে এসেছিল শাড়িটা। সেই থেকে পরাই হয়নি। আজ পরবই। বাজার যাবার ফ্যাকাশে গেঞ্জি গলিয়ে চার্জার আনতে যাওয়া শৌভিক, হতবাক হয়ে প্রশ্ন করে, “কেন? কে দেখবে”। কেন তুমি দেখবা না? আহাঃ না হয় আমি পুরানো বউ, তাই বলে সাদা কালো নাকি। তোমায় অত ভাবতে হবে না,তুমি এগোও। আমার টিকলিটা কোথায় যে গেল- 


সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা। আতসবাজি বিহীন দীপাবলী। খসখসে শাড়ি সামলে বাতি জ্বালাতে গিয়ে গোলাপ গাছের কাঁটায় হাত ছড়ে গেল। পোড়েনি তাও ভালো। চার্জার নিয়ে শৌভিক ফিরে আসার পর খেয়াল হয়েছে, “হ্যাঁ গো, মাছ গুলোকে ওবাড়ি দিয়ে আইলে না?” মাছ আইজ্ঞা। তুত্তুরীর আদরের পপি আর টফি? তেনাদের তো এই সপ্তাহে ঠাম্মা আর দাদুর কাছে থাকার কথা। তবে যে তারা দিব্যি টিভির সামনের টেবিলে খেলে বেড়াচ্ছে? 


বিনা বাক্যে মাছ নিয়ে দৌড়ল শৌভিক, যাবার আগে হিমশীতল কণ্ঠে শুধু বলে গেল, প্যাকিংটা কিন্তু এবার করতে হবে। প্যাকিং? ও হ্যাঁ প্যাকিং। তাই তো। কাল যে সকাল পৌনে এগারোটায় ছাড়বে আমাদের বিমান। এখনও গোছগাছ হয়নি কিছুই। মাগোঃ সাধে কি চাপড়াতে ইচ্ছে করে নিজের পিঠ। 


রাত নটার মধ্যে ঝড়ের গতিতে সারা প্যাকিং। আটদিনের জন্য, প্রতি দুদিন পিছু একটা করে জামা ধরে চারটে সেট। শুধু তুত্তুরীর জন্য দুটো অতিরিক্ত, তেনার আবার গাড়িতে উঠলে ইয়ে করার অভ্যেস আছে না। যাঃ ভুল হয়ে গেছে কটা প্লাস্টিকের প্যাকেট নিতে হবে মনে করে। এতকিছু কি আর এই গোল মাথায় থাকে। যা গম্ভীর মুখে ম্যাগি বানাচ্ছে শৌভিক, চুপচাপ খেয়ে আজ রাতের মত ঘুমিয়ে পড়াই বোধহয় ভালো। কাল নটার মধ্যে বেরোতে হবে। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল কাল সকালে শ্যাম্পু করতে হবে। ঐটা করতে আমার আবার বড় সময় লাগে কিনা। আগে সালফেট ফ্রি শ্যাম্পু দিয়ে দুবার মাথা ধুয়ে, তারপর হেয়ারপ্যাক লাগিয়ে দশ মিনিট অপেক্ষা করা, ঝক্কি কি কম। এসব নিয়ে আপাততঃ নীরব থাকাই ভালো। শৌভিক আপাততঃ ভুরু কুঁচকে সুটকেসের লাগে লাগেজ ট্যাগ লাগাচ্ছে। ফেভিস্টিক দিয়ে যতবার আটকাচ্ছে হড়কে নেমে আসছে প্রিন্ট করা লাগেজ ট্যাগ। দুবার শূণ্যে হাত ছুড়ল শৌভিক, “এই বাড়িতে কি একটা ঢঙের আঠাও থাকে না?” ওসব কথায় কান দিতে নেই, আঠা তো আমি নষ্ট করি না, করে ওর মেয়ে। আপাততঃ ঘুমিয়ে পড়ি, কাল আবার শ্যাম্পু করতে হবে, তারপর পাড়ি দেব হিন্দুস্তানের দিল দেখতে- 

অনির মধ্যপ্রদেশের ডাইরি, ১৫ই নভেম্বর, ২০২০

আদতে প্লেনটার কলকাতা ছাড়ার কথা ছিল সকাল নটা পঞ্চাশে। সেই মত দিন-ঘন্টা-সেকেন্ড গুনছিলাম আমি, এটা আমার বরাবরের অভ্যেস। কোন বিশেষ ঘটনা ঘটার আগে প্রতিটা মুহূর্তের হিসেব রাখি আমি। প্রতিটা মুহূর্তে নিজেকে মনে করাই, আর তো ব্যাস এত ঘন্টা- এত মিনিট আর এত সেকেণ্ড। আর তারপর- 


সব হিসেব গুলিয়ে প্লেনটা পিছিয়ে গেল পাক্কা একটি ঘন্টা। অর্থাৎ গোয়ালিয়রে পৌঁছাতে বেলা একটা। পরবর্তী গন্তব্য শিবপুরী। গোয়ালিয়র থেকে সড়কপথে ঘন্টা আড়াই থেকে তিন। অর্থাৎ কিনা বিকাল চারটে নাগাদ পৌঁছাব শিবপুরী। মাঝ নভেম্বরের কলকাতায় চারটে মানে ধূপছায়া। সুদূর পশ্চিমে হয়তো আরেকটু বেশী থাকবে আলো।  তবুও- কিই বা দেখা যাবে তাতে? নষ্টই হল আজকের দিনটা। 


গেল বারও অবশ্য তাই হয়েছিল। বেলাবেলি নেমেছিলাম ইন্দোরে, আর ওঁঙ্কারেশ্বর পৌঁছেছিলাম সন্ধ্যা পেরিয়ে। বাকিটা অবশ্যি ছিল নিখাদ স্বপ্ন।  গেল বারের মতই মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের গাড়ি আর ড্রাইভার এবারেও থাকবে আমাদের প্রতীক্ষায়। এয়ারপোর্ট থেকে তুলে আটদিন বাদে আবার এয়ারপোর্টে নামিয়ে দেওয়ার চুক্তি ওদের সাথে। গেল বার তো সরকারী বোর্ড লাগানো গাড়ি দিয়েছিল ওরা, এবার অবশ্য একটা এজেন্সীর সাথে বন্দোবস্ত, সেই এজেন্সীর মালিক এবং গাড়ির ড্রাইভার ত্যাগীজী গত কাল থেকে বার তিনেক ফোন করেছে শৌভিককে। যতই বিমারু রাজ্য বলে তাচ্ছিল্য করি আমরা, ভীষণ ভদ্র এদিকের মানুষজন। 


ভোর ভোর উঠে স্নান সেরে, হেভি ব্রেকফাস্ট করে বেরোতে বেরোতে বেলা গড়াল সাড়ে নয়। রাগে থমথম করছে শৌভিকের মুখ। সবকিছুর জন্য নাকি আমি দায়ী। বেড়াতে যাবার দিন কেউ শ্যাম্পু করে? নেহাৎ আমাদের বাড়ি থেকে বিমানবন্দর ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে নইলে নির্ঘাত ভস্ম হয়ে যেতাম। প্লেনে ওঠা নিয়ে কিঞ্চিৎ আতঙ্কে ছিলাম আমরা, নতুন কোভিড বিধি কি চালু হয়েছে ভালো জানতাম না। কার্যত দেখা গেল, ব্যবস্থাপনায় বিশেষ কোন পরিবর্তন আসেনি। শুধু বিমানবন্দরে প্রবেশের পূর্বে ব্যাগপত্তর গুলিকে ভালো করে স্যানিটাইজ করে দেওয়া হচ্ছে। স্যানিটাইজারের দাপটে স্যুটকেস ভিজে জবজবে। শৌভিকের সাধের লাগেজ ট্যাগ খসে পড়ল টুপটাপ- 


ফাঁকায় ফাঁকায় সিকিউরিটি চেকিং সেরে, এয়ারলাইন্স কতৃপক্ষের প্রদত্ত মাস্ক এবং ফেসশিল্ড পরে বাসে চেপে যখন প্লেনের সামনে গিয়ে নামলাম, হাসি পেল। এমন একখান এরোপ্লেন তো তোলা আছে, আমাদের আলমারির মাথায়। তুত্তুরীর অন্নপ্রাশনের উপহার।  পুঁচকে প্লেনে সওয়ার হতে পারে মেরেকেটে জনা পঞ্চাশ যাত্রী। ওঠার জন্য লাগানো সিঁড়িটিও ছোট্ট।  ধাপ বড়জোর গোটা চার। 


বেলা পৌনে একটা নাগাদ গোয়ালিয়রের রাজমাতা বিজয়া রাজে সিন্ধিয়া এয়ার টার্মিনালে নামার কথা। কিন্তু কেন জানি না প্লেন আর নামেই না। প্রায় পৌনে একঘন্টা গোয়ালিয়রের আকাশে চক্কর কেটে প্লেন যখন নামাল তখন বাজে বেলা পৌনে দুটো।


 ছোট্ট প্লেনের মতই ছোট্ট এয়ারপোর্ট। প্লেনে থাকাকালীন একাধিকবার উচ্চারিত হয়েছে সতর্কতা বার্তা- এটি মিলিটারি এয়ারপোর্ট। এখানে সারাদিনে নামে কেবল হাতে গোণা কয়েকটি প্লেন। ছবি/ভিডিও তোলা ঘোরতর ভাবে নিষিদ্ধ। 


ছোট্ট উঠোনের মত রানওয়ে। পেরিয়ে যাওয়া যায় একদৌড়ে, তবুও প্লেন থেকে নামার পর লাইন দিয়ে দাঁড়াতে হল মিনিট খানেক, কারণ সামনে দাঁড়ানো প্লেনটি ব্যাক করছিল যে। 


ভিতরে একটিই কনভেয়ার বেল্ট। আমি আর তুত্তুরী দাঁড়ালাম লাগেজ নেবার জন্য আর শৌভিককে লেখাতে হল আমাদের বিশদ পরিচয়, কোথায় যাব, কেন এসেছি ইত্যাদি। আর্মির এয়িরপোর্ট যে। অন্যান্য এয়ারপোর্টের মত করপোরেট লুক নেই, তবে সাফসুতরো। বাইরের বাগানগুলিও অনেকটা আমাদের সরকারী অাপিসের বাগানের মত। যত্ন আছে, তবে আরেকটু যত্ন নিলে মন্দ কি?


ত্যাগীজীর গাড়িতে চেপে প্রবেশ গোয়ালিয়র শহরে। রাজাদের শহর। সব কিছুই বড় জমকালো এথা।   বড় বড় স্কুল, কলেজ, ইনস্টিটিউশন সবকিছুই সিন্ধিয়াদের নামে। দীপাবলীর পরদিন বলেই হয়তো বন্ধ অধিকাংশ দোকানপাট, রাস্তায় বিরল মানুষজন।  ত্যাগীজী জানালেন, এদিকে করোনা সচেতনতার হার প্রায় শূণ্য। আদালতের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে গতকাল ভোর রাত অবধি দেদার বাজি পুড়িয়েছে গোয়ালিয়রবাসী। সেই ক্লান্তিতেই আপাততঃ গৃহবন্দী নগরবাসী। 


কোন সকালে খেয়ে আসা পাউরুটি, দুধ আর ডিম হজম হয়ে গেছে কখন। কিছু খেতে হবে। নেমে খেতে গেলেই নষ্ট হবে সময়। স্যান্ডউইচ জাতীয় কিছু কিনে নিতে পারলে ভালো হয়। এদিকে বন্ধ সব দোকানপাট। ভারী আকাশের মুখ। অচীরেই শুরু হল টিপটাপ বর্ষণ। বর্ষা আমার প্রিয়তম ঋতু। তাই বলে এই হেমন্তের শেষে বেড়াতে এসে আলাপ করতে আগ্রহী অকালবর্ষণ, অসহ্য।  ভিজতে ভিজতে স্টেশন লাগোয়া আধ খোলা বাজারের কফি হাউস থেকে চটজলদি কেনা ডিম স্যান্ডউইচ থুড়ি সিদ্ধ ডিম আর পাঁউরুটি খেতে খেতে ভিজে রাজপথ দিয়ে ছুটল গাড়ি শিবপুরীর দিকে। ত্যাগীজী জানালেন এদিকে কমার্সিয়াল গাড়ির গতিসীমা বাঁধা আশি কিমি/ঘন্টায়। ফলে উনি চাইলেও বাড়াতে পারবেন না গতি। পৌঁছাতে পৌঁছাতে নামবে বিকেল। তেমন কিছুই দেখা হবে না আজ। তবে পথেই পড়বে সিন্ধিয়াদের ছত্রী ওটা দেখে নিতে পারি আমরা। আর দেখতে পারি ভদাইয়া কুণ্ড।  


বিকাল চারটে নাগাদ গাড়ি গিয়ে থামল সিন্ধিয়াদের ছত্রীতে। ছত্রী বলতে সমাধি সৌধ। মুখোমুখি দুটি অনুপম সৌধ- একটি রাজমাতা শাক্য রাজে সিন্ধিয়ার স্মরণে নির্মাণ করেছিলেন তাঁর পুত্র মহারাজ মাধো রাও সিন্ধিয়া। অপরটি রাজা মাধো রাও সিন্ধিয়ার স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মাণ করেছিলেন তাঁর পুত্র তথা উত্তরাধিকারী রাজা জিভাজী রাও সিন্ধিয়া। দুটি ছত্রীর মাঝে খনন করা এক অনুপম পুষ্করিণী। সমগ্র আঙিনাটি শ্বেত পাথরে মোড়া। আছে ঘন সবুজ কেয়ারি করা বাগিচা। মাত্র ৪৮ বছর বয়সে প্যারিতে মারা যান রাজা মাধোরাও সিন্ধিয়া। তাঁর সমাধিতে আছে আটখানা সলিড রূপার দরওয়াজা। ছাত থেকে ঝুলছে ভারি ভারি রূপার ঝাড়লণ্ঠন। ইতালীয়  মার্বেলের দেওয়ালে নানা সেমি প্রেশিয়াস স্টোনের অনুপম নক্সা কাটা। পাতি মোবাইল ক্যামেরায় একখান ভিডিও তুলেছিলাম- যদি দেখতে চান- https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10222306300273599&id=1449214651

রাজমাতা শাক্য রাজে সিন্ধিয়ার ছত্রী- বাইরে থেকে

রাজমাতা শাক্য রাজে সিন্ধিয়ার ছত্রী- অভ্যন্তর ভাগ

রাজা মাধো রাও সিন্ধিয়ার ছত্রী- বাইরে থেকে

রাজা মাধো রাও সিন্ধিয়ার ছত্রী- অভ্যন্তর ভাগ

রাজা মাধো রাও সিন্ধিয়ার মূর্তি -

ভদাইয়া কুন্ড

গুগলে শিবপুরী লিখলেই প্রথমে যে ছবি ফুটে ওঠে, তা হল একতলা এক মন্দির যার মাথার ওপর থেকে আছড়ে পড়ছে প্রবল জলধারা। বড় মনোরম দৃশ্য। এই ভদাইয়া কুণ্ডের পাশেই ট্যুরিস্ট ভিলেজে আজ রাত কাটাব আমরা। খুব অল্প টাকার টিকিট কেটে বেশ খানিকটা নীচে নেমে ভদাইয়া কুণ্ডের সামনে দাঁড়িয়ে রীতিমত হতাশ হলাম। এবার বর্ষা ভালো হয়নি। ফলে তিরতির করে ক্ষীণ জলধারা ঝরে তো পড়ছে ভদাইয়া কুণ্ডের মাথা থেকে। তাতে খুলছে না রূপ। ভিতরের মন্দিরে ঢোকাও আপাততঃ নিষিদ্ধ। শ্যাওলায় আছাড় খেয়ে নাকি বড় আহত হয় পর্যটকরা। তাই বন্ধ ভিতরের কুঠুরি। 


ভদাইয়া কুণ্ডের উল্টো দিকে অবশ্য নয়ন জুড়ানো শাক্যসাগর লেক। টলটলে তার জল। পাড়ের কাছে ফুটে আছে সহস্র শতদল। অদূরে শাখা বিস্তার করেছে মাধো ন্যাশানাল পার্ক। কাল ভোর-ভোর দেখতে যাব আমরা। আপাততঃ দুদণ্ড জিরিয়ে নিই এই অনুপম লেকের ধারে। ফুসফুসে ভরেনি টাটকা জলো বাতাস। কানের পর্দায় সুড়সুড়ি দিক অখণ্ড নীরবতা, মাঝে মাঝে জলের ছলাৎ ছলাৎ আর সন্ধ্যে নামার মুখে কুলায় ফেরা পাখিদের কূজন। 

(ক্রমশঃ)

(ক্রমশঃ) 


অনির ডাইরি, ২৫শে ডিসেম্বর, ২০২০

 

কেস মিটে যাবার পরও লোক গুলো কেন যে আসে? বারবার আসে, শুকনো মুখে ঘুরে বেড়ায়, চেম্বারের বাইরে থেকে উঁকিঝুঁকি মারে, তারপর একফাঁকে সাহস জুটিয়ে গলিয়ে দেয় মুণ্ডু,“ম্যাডাম আসব?”


তা মশাই কেন আসবেন না? আসতেই পারেন, আপনাদের জন্যই বসে আছি, তবে অনুগ্রহ করে এটা ভেবে নেবেন না যে আমি আপনাকে দত্তক নেব বা নিয়েছি। একবার আপনার কর্মসিদ্ধি হয়েছে বলে কর্মক্ষেত্রের তুচ্ছাতিতুচ্ছ সমস্যা নিয়ে আমাকে জেরবার করতে করাটা কিন্তু মোটেই বাঞ্ছনীয়  নয়। নাঃ বলি না এই কথাগুলি, তবে ভাবি বটে। 


বিশেষতঃ অমুক বাবুকে দেখলেই এটা ভাবি, বহুযাতনায় ওণার কাজটা ফেরৎ দিতে পেরেছিলাম। তারজন্য উচ্চ আদালতের জনৈক অ্যাডভোকেটের প্রচুর আইনি গালি খেতে হয়েছিল বই কি, তবে ভদ্রলোকের কার্যোদ্ধার হয়েছিল। আগেও লিখেছিলাম বোধহয় ওণার গল্পটা, ছোট কোন আধা সরকারী দপ্তরে অ্যাসিস্টান্ট ম্যানেজার পদাসীন ছিলেন ভদ্রলোক। তহবিল তছরুপের অভিযোগে রাতারাতি ওণাকে বরখাস্ত করা হয়। 


তখন আনলক ডাউনের প্রথম অধ্যায়, আপিস প্রায় জনশূণ্য। বাজারের থলে ভর্তি কাগজপত্র নিয়ে উনি এসেছিলেন আমার দপ্তরে। পদের সাথে ম্যানেজার শব্দটি জুড়ে দিলেই তিনি আর শ্রম আইনের অাওতায় পড়েন না। সম্ভবতঃ আইন প্রণেতারা ধরেই নিয়েছিলেন যে ম্যানেজার বা অ্যাডমিনিস্ট্রেটর’রা মোটেই শ্রমিক ক্যাটেগরিতে পড়েন না, তাই শ্রম আইনের নিরাপত্তা তাদের জন্য নয়। একই কথা প্রযোজ্য বেসরকারী কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্যও। চোখের সামনে তাদের শোষিত হতে দেখলেও হাত-পা বাঁধা আমাদের। 


ফিরে যাই অমুক বাবুর গল্পে, ওণার পদের সাথে ম্যানেজার লেজুড় থাকলেও,বেতন যে কোন সিকিউরিটি গার্ডের সমান। যুগপৎ ওণার কাগজের দিস্তা ঘেঁটে বার করা নথি ঘেঁটে যা দেখলাম, ওণার দপ্তর ওণাকে লিখিত নির্দেশনামা দিয়েছিল, ই ব্যাঙ্কিং ইত্যাদির জন্য ওণার ব্যক্তিগত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টটি ব্যবহার করা যাবে। লকডাউন ঘোষণার দিন উনি লাখ দশ-পনেরোর একটি দপ্তরী চেক নিয়ে গিয়ে ব্যাঙ্কে জমা করেন, চেকটার ফটোকপিতে স্পষ্ট যে উচ্চ পদাধিকারীদের সই থাকলেও, ক্রশ করা ছিল না।  


সেইসময় ব্যাঙ্কের ওপর যে অসীম চাপ ছিল হয়তো সেই কারণে অথবা জানি না কেন চেকটি দপ্তরের অ্যাকাউন্টে না ক্রেডিট হয়ে অমুকবাবুর ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে ক্রেডিটেড হয়। তারপর করোণার দাপটে ঘুমিয়ে পড়ে সমগ্র বিশ্ব। টানটান লকডাউনের আড়ামোড়া ভাঙা মাত্রই আপিসে গিয়ে সমগ্র ব্যাপারটা বুঝতে পারেন অমুক বাবু। সেইদিনই সমগ্র টাকাটা আবার দপ্তরী অ্যাকাউন্টে ঢুকিয়ে দেন এবং সততার পরাকাষ্ঠা হয়ে ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট তুলে সমগ্র ব্যাপারটা দপ্তরের গোচরে আনেন। তার পরের দিনই ওণার চাকরী যায় এবং শুরু হয় আমার দপ্তরে আনাগোণা।  


নাই পড়ুক ব্যাপারটা শ্রমআইনে, কোন কর্মচারী যদি কাজ হারিয়ে আমার দ্বারস্থ হন, তাঁকে দেখা আমার কর্তব্য। সেই মোতাবেক ওণার চিঠির কপি ওণার দপ্তরে পাঠিয়ে জানতে চাইলাম, কেসটা কি? বাঁধাগতে জবাব পেলাম তহবিল তছরূপের অভিযোগে ওণার চাকরী গেছে ইত্যাদি।  


পরের ধাপে ডেকে পাঠানো হল ঐ সংস্থার সচীব এবং সভাপতিকে। সচীব এলেন না বটে, সভাপতি এসে হাজির হলেন। ভদ্রলোক সত্তরোর্দ্ধ, এককালে সরকারী কর্মচারী ছিলেন। একবাক্যে মেনে নিলেন, ছাঁটাই সম্পূর্ণ বেআইনি। আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ফলেই কাজ হারিয়েছেন অমুক বাবু। নাঃ লাল-নীল-কমলার দ্বন্দ্ব নয়, সবাই একই রঙের অনুগামী নিছক গ্রাম্য দলাদলী রাজনীতির বলি অমুক বাবু।  


বললাম, লিখে দিতে পারেন, যে কাজটা অনৈতিক হয়েছে? আধঘন্টার মধ্যে কাঁপা কাঁপা হস্তাক্ষরে চিঠি লিখে আনলেন বৃদ্ধ। ভাবলাম কেল্লা ফতে! সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ার আগেই এল মোটকা চিঠির বাণ্ডিল, যাতে সংস্থার বর্তমান ম্যানেজার জানালেন যে, ঐ সভাপতি বা সচীবের কথার কোন গুরুত্ব আজ আর নেই, কারণ বোর্ড ভেঙে গেছে। নতুন বোর্ড না আসা পর্যন্ত সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার প্রশ্ন নেই। 


খোঁজ পত্তর করে দেখা গেল জনৈক জেলাস্তরীয় অফিসার আপাততঃ ঐ সংস্থার দায়িত্বে। তাঁকেই চিঠি লিখে জানানো হল, ব্যাপারটা একটু দেখুন। এইভাবে রাতারাতি মুখের কথায় কাউকে বিতারণ করা যায় নাকি? আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ তো দিতে হত? যথোপযুক্ত এনকোয়ারি করতে হত। চুরির অভিযোগ হলে পুলিশে জানাতে হত, তারপর না হয় আপনাদের নিজস্ব আইনানুসারে ওণার বিচার হত। 


আমার চিঠিটাই ঐ সংস্থায় পাঠান জেলার অফিসার, সাথে সাথে নির্দেশ দেন অমুক বাবুর চাকরী যাওয়া বেআইনি, অবিলম্বে ওণাকে পুনর্বহাল করতে হবে। ভাবলাম মধুরেন সমাপয়েৎ। তারপরই উচ্চ আদালতের অ্যাডভোকেট মহাশয়ের শাসানি চিঠি। “একদম আপনার এক্তিয়ার বহির্ভূত ব্যাপারে নাক গলাবেন না। ফের যদি নাক গলিয়েছেন ভালো হবে না কিন্তু। ”পত্রপাঠান্তে জনৈক ব্যাচমেটের কথা মনে পড়ছিল, যে কোন এককালে অমন শাসানি চিঠি সম্পর্কে বলেছিল,“ওগুলো তো ট্রফি রে-।”  


আমি ট্রফি পেলাম,উনি কাজ ফেরৎ পেলেন। আবার কি চাই? জীবন এগিয়ে চলছিল নিজের মত। তারপরও দুবার তিনবার এসেছিলেন অমুক বাবু, নালিশ করছিলেন না না সমস্যা নিয়ে। উনি পুলিশকে জানিয়েই কাজে যোগ দিতে যান, তাও ওণার নামে পুলিশে নালিশ করতে যায় ওণার দপ্তর। ওণাকে কোন কাজ দেওয়া হচ্ছে না, সই করা নিয়ে নিত্য অশান্তি চলছে ইত্যাদি।  


প্রতিবারই এক কথা বলতাম, এগুলো সত্যিই আমার এক্তিয়ার বহির্ভূত। আপনি জেলার অফিসারের সাথে যোগাযোগ করুন। প্রতিবারই উনি বলতেন, “গিয়েছিলাম তো ম্যাডাম। উনি প্রতিবারই এককথা বলেন,  ‘আমি কি করব? আপনি বরং ম্যাডামের কাছেই যান। যা করার উনিই করতে পারবেন-’। ” এতো মহাজ্বালা!


সম্প্রতি আবার  এসেছিলেন ভদ্রলোক, আরো অনেকটা কৃশ হয়েছেন। গাল ভর্তি দাড়ি। উদ্ভ্রান্ত চোখমুখ। সেই থেকে বেতন পাননি। আপিসে নিত্য অশান্তি। হতাশ হয়ে বললেন, “আমাকে ওরা নেবে না ম্যাডাম। জলে বাস করে আর কতদিন কুমীরের সাথে লড়ব? ভাবছি ছেড়েই দেব কাজটা। ” শুনলাম সেই থেকে বেতন পাননি ভদ্রলোক। 


আমার সমস্ত মেহনত, মস্তানি, খিস্তি খাওয়া সব ব্যর্থ হয়ে গেল হয়তো, তবে কাজ করবেন কি ছেড়ে দেবেন ওণার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবুও বললাম, খোদ রাজ কর্মচারীর ফরমান ওণার পক্ষে, আরেকবার তাঁকে গিয়েই বলুন না হয়। জবাব পেলাম, উনি হয় বলেন সবুরে মেওয়া ফলবে নয়তো আমায় দেখান। ভালো জ্বালায় পড়েছি তো। সাধে দত্তক নেবার কথাটা মাথায় আসে। তাহলে তো একটাই রাস্তা খোলা, ন্যায়ালয়ের শরণাপন্ন হয়ে দেখুন। এক্ষেত্রে সবাই একই কথা বলেন, আদালতের চক্করে পড়ার মত সময় বা অর্থবল থাকে না এদের। জেলা আইনি সহায়তা কেন্দ্রের আইনজীবি বিনা মূল্যে কেস লড়েন বটে, তবে যদি বাদী মহিলা হন। সংরক্ষিত জনজাতি বা পিছড়ে বর্গের জন্যও বোধহয় নানা আইনি সুযোগ আছে। হয়তো সাধারণ শ্রেণীর জন্যও কিছু থাকতে পারে, ওদের কাছে গিয়েই দেখুন না। তাও যাবেন না অমুক বাবু। 


“আমায় চোর বদনাম দিয়ে তাড়িয়ে দিল, কেউ পাশে থাকেনি। আপনি কেবল আমার কথা শুনেছেন। আপনার চেষ্টায় কাজ ফেরৎ পেয়েছি। বেতন না পেয়েও আপনার কাছেই ছুটে এয়েছি। যা করার আপনিই করুন। দয়া করে ফিরিয়ে দিয়েন না ম্যাডাম। ” এতো মহাজ্বালা! যে রাজনৈতিক ঘুর্ণির মধ্যে পড়তে চাই না, তাতেই টেনে নিয়ে যাবে লোকটা। 


বেতন না পাওয়াটা অবশ্য সত্যিই আমি দেখতে পারি। “বেতন পাচ্ছি না ম্যাডাম” আমাকে উদ্দেশ্য করে বাংলা হরফে লেখা চিঠিটা পাঠিয়ে জেলার সংশ্লিষ্ট দপ্তরের গোচরে আনার চিঠি করে বললাম, এতে কিছু হবে বলে মনে হয় না। আমার দৌড় এখানেই শেষ। এবার কিন্তু আদালতই ভরসা- 


গতকাল মেলার তাড়া তাড়া চিঠিপত্র নিয়ে ব্যস্ত, ছুটে এল ধীমান,“ম্যাডাম, অমুক বাবুর এই চিঠিটা কি নেবো?” আবার কি চিঠি দেয় রে বাবা লোকটা। এদের চিঠির দাপটে পাগল হয়ে যাব যে, চোখ বোলাতে গিয়ে দেখি, এটা উনি লেখেননি, লিখেছেন জেলার অফিসার। লিখেছেন অমুক বাবুর দপ্তরকে, আমায় কপি দিয়েছেন কেবল। চিঠিতে আমার পুরানো চিঠির অংশবিশেষ তুলে ধরে গোটা গোটা মোটা মোটা কালিতে অফিসার মশাই লিখেছেন,“ উনি বলার পর, আমি নির্দেশ দিয়েছিলাম অমুক বাবুকে চাকরীতে পুনর্বহাল করার। করেননি কেন? ওণাকে বেতন দেননি কেন? অবিলম্বে অমুকবাবুর সমস্ত বেতন প্রদান করে আমাকে জানান। ”   


বুঝতে পারলাম না, এতে আমার সমস্যা মিটবে না বাড়বে। হয়তো আবার শমন পাঠাবেন কোন উকিল মহোদয়, এক্তিয়ারের লক্ষণরেখা পার করার অনুযোগ তুলে। হয়তো আসবে কোন ভারী রাজনৈতিক ফোনও। অথবা ফোন যাবে আমার অনেক ওপরতলায়- যা হবার হবে, হোক। অত ভাবলে কি আর লেবারগিরি করা যায়! মুখে যাই বলি, কলম যাই বলুক, আবার যদি এমন কেউ এসে আমার দ্বারস্থ হন, আমার সর্বশক্তি নিয়ে আমি আবার তার পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করব- অতঃপর যা হবে, দেখা যাবে। দত্তক নেবার কথাটা বোধহয় তাই মাথায় আসে। যাই হোক শুভ বড়দিন। অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইল। খুব ভালো থাকুন সকলে।

Tuesday 22 December 2020

অনির ডাইরি ২২শে ডিসেম্বর ২০২০

 


ঈশ্বরপ্রীতি অবশ্য আমারও ঐ বয়সে ভয়ানক রকমের ছিল। আহাঃ বেঁচে থাকুক বাঙালীর বারো মাসে তের পার্বণ, আরো উপোস তিরেস করুক মা- ঠাকুমা-পিসি, দিনান্তে আরো সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়া হোক উপাদেয় নানা পদ। যেমন জয় মঙ্গলবারের ফলার- উঃ ভাবতেই জিভে জল আসে। চিঁড়ে, দুধ, চিনি, আম আর কলা একসাথে মেখে যে কি অমৃত তৈরি হয়, তা যারা ঠাকুমার হাতের ফলার খায়নি জানতেও পারবে না।


 অথবা জ্যাঠাইমার হাতের সাবু মাখা। রাত ভর ভিজিয়ে রাখা উড়ের দোকানের সাবুতে চটকানো হত কড়ে আঙুলের মাপে কাঁঠালি কলা, নারকেল কোরা আর বাতাসা। সাবু নিয়ে অবশ্য রীতিমত অবসেসড্ ছিল জ্যাঠাইমা। পার্বণে হয় সাবু মাখা নয়তো সাবুর খিচুড়ি তো হতই, এর বাইরেও কারো হাঁচি কাশি পেটগরম হলেই বড় কাঁসার গ্লাস ভর্তি দুধ সাবু নিয়ে হাজির হয়ে যেত জ্যাঠাইমা। সাবু খেলে নাকি পেট ঠান্ডা হয়, তাই বেহারী গোয়ালার জল ঢালা ট্যালটালে দুধকে একটু বেশী ফুটিয়ে ঘন করে, তাতে এলাচ আর তেজপাতা দিয়ে প্রস্তুত হত মিষ্টি মিষ্টি দুধসাবু। আজ লিখতে লিখতে জিভে জল এলেও সেদিন ছুঁয়েও দেখতাম না। 


জ্যাঠাইমার সাবু আর ঠাকুমার বার্লি দুটোকেই সমান ভয় পেতাম আমরা। আর ভয় পেতাম পিসির দশহরার দিন ঘুম ভাঙিয়ে কাঁচা দুধ আর কাঁচা উচ্ছে খাওয়ানো। বাপরেঃ সে যে কি অসীম যাতনা। না খেলে নাকি মনসা দেবী চটে যাবেন- সাংঘাতিক ভিড় হত সেদিন গলির মনসা তলায়। কবেকার বুড়ো ফণিমনসা গাছের নাতির নাতির চরণে জমা হত পুজোর নানা উপাচার। কথিত আছে বড় জাগ্রত এই মনসাতলা। নিঃসন্তান দম্পতিরা পুত্রার্থে (সন্তানার্থেই হয়তো) মানত করত ক্ষীরের পুতুল। মনসাতলায় ক্ষীরের পুতুল থেকেই আমাদের গলির নাম ক্ষীরেরতলা। বুড়ি মনসা এখনও আছেন বটে, তবে উল্টোদিকে কোথা থেকে যেন উড়ে এসে জুড়ে বসেছে এক বুড়ো শিব, তাঁর গ্ল্যামার অার ঐশ্বর্যের কাছে ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছে সাবেকী বাংলার ছাপোষা লোকদেবী।  


মোটকথা আমার মেয়েবেলায় ঈশ্বর আর সুখাদ্যের মধ্যে ছিল নিবিড় সম্পর্ক।  ঈশ্বরচেতনার অনেকটা জুড়েই বিরাজ করত আটা বা ময়দার সিন্নি, লাল আটার ফুলকো লুচি, ফলার, খিচুড়ি, গলির মুখের ঘোষ ব্রাদার্সের নারকেল ছাপা, চন্দ্রপুলি, দানাদার। তাছাড়া পায়েস, মালপো, পিঠেপাটালি ছিল তো ছিলই।  


নিছক নিম্ন মধ্যবিত্তের হেঁসেল থেকে আসা এইসব অমৃত আজ নিজে বানালে কেমন যেন পানসে লাগে, তাও বানাই মেয়ের সাথে নিজের মেয়েবেলার কিছুটা আস্বাদ ভাগ করে নিতে। আর মেয়ে কি করে? স্বকর্ণে শুনুন না মশাই। দিবারাত্র বাড়িতে গুঞ্জরিত হয় দুর্গাস্তোত্র। আপিস থেকে ফিরে জুতো খুলে মুখ হাতপা ধুতে যাবার আগেই একবার শুনতে হয় দশ মহাবিদ্যা উপাখ্যান। তারপর চায়ে চুমুক দিতে দিতে আরও বিশদে শুনতে হয়- তারপর আরো বিশদে- আরো- আরোও। 


দশভূজার গুঁতোয় অতিষ্ঠ হয়ে  যদি প্রকাশ পায় সামান্যতম উষ্মা, ছলছল আঁখি আর ধরা অভিমানী ফোন যায় অদূর হাওড়ায়। ফোনের ওপার থেকে ভেসে আসে আক্রমণাত্মক বৃদ্ধা আর আহত বৃদ্ধের স্বর, “বড় নিঃসঙ্গ ও।” বুঝতে পারি, শুধু তুত্তুরী নয়, নিঃসঙ্গ ওরা তিনজনাই। আমার জীবনে যা ভয়ানক দুর্লভ, ওদের জীবনে তারই প্রাচুর্য। সময় অঢেল নেই শুধু যোগাযোগের সুযোগ। দূরভাষই রচনা করে  একমাত্র সেতু। আর সেই দূরভাষ আর অনেকটা সময়জুড়ে বিরাজ করেন এই কাল্পনিক রমণী। আমার চোখে যিনি উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট বা নারী স্বশক্তিকরণের প্রতিভূ।  তবে সে গল্প অন্য কখনও হবে না হয়। আপাততঃ যাই সবার মান ভাঙাই।

Monday 21 December 2020

তুত্তুরী উবাচ ২১শে ডিসেম্বর, ২০২০

 

👧🏻- আচ্ছা সঞ্চিতা মাসি, তোমার নাকে ওটা কি?

👩🏻‍🏫-(নাকের ডগায় হাত বুলিয়ে হেসে উঠে) এটা? এটা তিল রে তুত্তুরী। 

👧🏻- (ভিডিও কলের এপারে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকে) তিল না আঁচিল?

👩🏻‍🏫-( আদুরে মস্করার সুরে) না রে তুত্তুরী। এটা তিল।  আমি খুঁটে দেখেছি- 

👵🏻-(সঞ্চিতার মাসির মা পাশ থেকে মুখ বাড়িয়ে) যেদিন সঞ্চিতা মাসির সাথে তোর দেখা হবে, খুঁটে দেখে নিস, তিল না আঁচিল। 

👧🏻-(গম্ভীর মুখে) নাঃ। আমি শুধু নিজেরটা খুঁটি, অন্যের নাক খুঁটি না।

Saturday 19 December 2020

অনির ডাইরি ১০ই ডিসেম্বর, ২০২০

 


অনেকক্ষণ ধরে ভাবছি কাঁদব। খুব জোরে বিলাপ করে যদি নাও হয়, অন্তত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে তো কাঁদতেই পারি? কত কিছুতেই তো আমি কেঁদে ভাসাই- অথচ আজ যখন এক পলকে শেষ হয়ে গেল জীবনের এতবড় অধ্যায়- 


অধ্যায়ই তো, ডাকনামটাই তো তাঁর দেওয়া। বংশের উত্তরাধিকারীর জন্ম দিতে অপারগ বাবা- মা যখন কোলে করে আমায় নিয়ে প্রথম প্রবেশ করে ব্যাঁটরার চাটুজ্জে বাড়িতে, সবথেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা দিয়েছিল সে। দিদিভাইয়ের ডাক নাম ছিল রুনু, ছন্দ মিলিয়ে নাম রেখেছিল ঝুনু। 


আঠারো মাস বয়স অবধি না কথা বলতে পারতাম, না দাঁড়াতে পারতাম। কোথাও বোধহয় হাল ছেড়ে দিয়েছিল ঈশ্বর স্বয়ং। আশা ছাড়েনি সে। ভোর ভোর ঘুম থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে জোর করে দাঁড় করিয়ে দিত টিনের মিটসেফটার গায়ে ঠেস দিয়ে। মিটসেফের মাথার ওপর বেজে চলত সন্তোষ রেডিওর বিবিধ ভারতী। টলটল করতে করতে পড়ে যাবার উপক্রম হলেই পুনরায় ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিত সে। তারপর শুরু করত বকবক। বোবা বাচ্ছার সাথে এত কি বকবক করতে তুমি জ্যাঠাইমা? আমার মুখের ভাঁজে ভাঁজে ফুটে ওঠা হাসির অর্থ কি ভাবে ধরতে তুমি জ্যাঠাইমা? 


হাঁটতে শিখলাম, মুখে খই ফুটল। বাবা-মা নিয়ে গিয়ে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এল ব্যাঁটরা পাবলিক লাইব্রেরীর নার্সারিতে। ভোর ভোর ইস্কুল। ঘুম থেকে তুলে জামা পরিয়ে কোলে করে ঘর থেকে বের হত মা। তারপর কোলে তুলে নিত পিসি। গোটা দোতলার দালান আর সিঁড়ি পিসির কোলে চেপে নামার সাথেসাথেই, খপ করে কোলে তুলে নিত জ্যাঠাইমা। একতলার দালান থেকে বেরিয়ে, রোয়াক টপকে, চারটে সিঁড়ি ভেঙে, বিশাল উঠোনকে কোণাকুণি পার করে, দেড়শ বছরের সদর দরজাটার সামনে এসে তুলে দিত বাবার কোলে। 


ছোটবেলায় মা বলেই তো ডাকতাম, আর জন্মদাত্রীকে বলতাম মানা। কবে থেকে যে বদলে ফেললাম সম্বোধন, তা আর আজ মনে পড়ে না। দিদিভাইয়ের বিয়ের পর আরও বেশী আঁকড়ে ধরেছিল জ্যাঠাইমা- 


ভোরবেলা ঘুম ভাঙত জ্যাঠাইমার উনুনের ধোঁয়ার গন্ধে, আর সন্তোষ রেডিওর “ইয়ে আকাশবাণী হ্যায়” শুনে। যে টিনের মিটসেফের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াতে শিখেছিলাম, ডিঙ্গি মেরে তার মাথায় উঁকিঝুঁকি মারতাম বেলা নটায় বিবিধ ভারতীর রঙ্গারঙ্গ কার্যক্রম শোনার লোভে। ভারত বিস্কুটের সেই বিজ্ঞাপনটা আজও মনে আছে, “কি গো নাতনী, আমায় বিয়ে করবে নাকি? ইশ্ তুমি বুড়ো। ” শেষে ভারত বিস্কুট প্রাপ্তির লোভে যেখানে শিশুকন্যাটি রাজি হয়ে যেত বুড়োকে নিকে করতে। অথবা চেশমি গ্লিসারিন সাবানের বিজ্ঞাপন। আর হাতুড়ি মার্কা ফিনাইল এক্স? শনিবারের বারবেলা শুনতে শুনতে আরো তলিয়ে যেতাম জ্যাঠাইমার ভুঁড়ির তলায়। 


বাবামায়ের রক্তচক্ষুর আড়ালে প্রথম চায়ের কাপ তো জ্যাঠাইমাই ধরিয়েছিল। বড় বেশী ন্যাওটা ছিলাম যে, যখন যাই করত পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম আমি। বিকালের চায়ের কাপটা কবে যে টুকুস করে তুলে নিলাম আর বিদায় জানালাম দুধের কাপকে আজ আর মনেও নেই।  


কানে খোল জমেছে কিনা, আর মাথায় উকুন হয়েছে কিনা, দেখা ছিল জ্যাঠাইমার নেশা। ধরতে পারলেই কোলে ফেলে কানে ফোঁটা ফোঁটা সর্ষের তেল ঢেলে, হেয়ারপিন নিয়ে লেগে পড়ত কান সাফ করতে। জীবনের প্রথম শাড়ি, উপহার পেয়েছিলাম জ্যাঠাইমার থেকে। চুনেহলুদ রঙের খোলে জরির বুটি আর সবুজ পাড়। দ্বিতীয় বছর কমলা খোলের ওপর বেগুনী রঙা সুতোর কাজ। আজও চোখে ভাসে শাড়ি দুটো।  

জ্যাঠাইমার হারমোনিয়ামটা ছিল সত্যি সত্যি পদী পিসির বর্মী বাক্স। সন্ধ্যে নামলেই গলা সাধতে বসত জ্যাঠাইমা। যেদিন অনুগ্রহ করে স্পর্শ করতে দিত,সেদিন যে কি ফূর্তি-। 


শালকিয়ায় স্বর্গীয় অনল চট্টোপাধ্যায়ের কাছে গান শিখতে যেত জ্যাঠাইমা। শিখে আসা গান, দোতলায় রেওয়াজ করতে বসলেই, একতলার উঠোনে ভ্যাঙাত বাবা। বাবার ভয়ে “পিলে পিলে হরিনাম কা প্যায়ালা” তোলেনি জ্যাঠাইমা। অনলদাকে বলেছিল, “এই গানটা ধরলে আমার মেজো দেওর আর আস্ত রাখবে না আমায়। দিনরাত ঐ গান গেয়ে  ঘুরবে আমার পিছু পিছু। ” এই গল্পটা বাড়ি এসে বলাটাই কাল হল। কতদিন যে বাবা জ্যাঠাইমাকে দেখলেই প্যারডিটা গাইত তার ইয়ত্তা নেই। বঙ্গীয় সঙ্গীত পরিষদ থেকে পাওয়া জ্যাঠাইমার সার্টিফিকেট গুলো সযতনে বাঁধিয়ে রেখেছিল জেঠু। আর ছিল একটা সাদাকালো ছবি, জেঠু-জ্যাঠাইমা আর নেতাজীর মত পোশাকপরা ছোট্ট দিদিভাই। দোতলায় উঠলেই চোখে পড়ত- বহুদিন বন্ধ ঐ তরফের অংশটা। উই ধরে গেছে নির্ঘাত। 


সিনেমা দেখার কি নেশা ছিল জ্যাঠাইমার। প্রতি শুক্রবার স্কুল থেকে ফেরার পর, জিজ্ঞাসা করত জ্যাঠাইমা- নবরূপমে কি সিনেমা চলছে রে? আর শ্রীরূপায়? সিনেমা দেখার তাড়নায় কতবার যে দুপায়ে দুরকম চপ্পল পরে চলে গেছে জ্যাঠাইমা। সেসব ইতিহাস আজও গুমরে গুমরে ঘোরে চাটুজ্জে বাড়ির বন্ধ অংশটায়।  


একবারই পুরী নিয়ে গিয়েছিল জেঠু। বাড়ি থেকে রওণা দেবার সময় ঠ্যাং ছড়িয়ে কেঁদেছিলাম আমি, “ও জ্যাঠাইমা, তুমি যেও না গো। ” আর হাওড়া স্টেশনে কেঁদেছিল মুনাই, আমার একমাত্র বোনঝি তথা জ্যাঠাইমার প্রাণাধিক নাতনী। পরিণতি কি হয়েছিল বলুন তো? জবরদস্তি বেড়াতে নিয়ে আসার অপরাধে গোটা পুরী ট্রিপে জেঠুর গুষ্টি উদ্ধার করে দিয়েছিল জ্যাঠাইমা। কোথাও নামেনি, কোথাও যায়নি। শুধু একগাদা উপহার কিনে এনেছিল সবার জন্য। বাড়ি ফিরে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল জেঠু, “এই মহিলাকে নিয়ে? আর কোত্থাও নয় বাবা। ” 


তখন বোধহয় ষষ্ঠ শ্রেণী, মস্ত অপারেশন হয়েছিল জ্যাঠাইমার। বেডে যখন দিল, তখনও তন্দ্রাচ্ছন্ন। মাঝে মাঝে অস্ফুটে ডেকে চলেছে দিদিভাইকে। হাত ভর্তি কাঁচের সোনালী সবুজ চুড়িতে ঝিলিক মারছিল নার্সিং হোমের টিউবলাইটের আলো। আজও চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই দৃশ্যটা। দিন তিনচার পর দেখতে গেছি জেঠু আর আমি, ও হরিঃ, বেড ফাঁকা।  আয়া মেয়েটিকে পটিয়ে পাটিয়ে রিক্সা ডাকিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে জ্যাঠাইমা। "নার্সিংহোমে আবার কেউ থাকে? ম্যাগো।" বাপরেঃ কি ডানপিঠে মহিলা- 


কি যে অসম্ভব ভালো পিঠে পায়েস বানাত জ্যাঠাইমা। আর নবান্ন? সে তো অতুলনীয়। আমার হাতের যে লাল পায়েস খেয়ে মোহিত হয়ে পড়ে আমার শ্বশুর থেকে বর,মায় মেয়েটাও, তাতো জ্যাঠাইমার কাছেই শেখা। নিজে হাতে আমার বিয়ের শ্রী গড়েছিল জ্যাঠাইমা। ভেজেছিল আনন্দনাড়ু। বরণ করেছিল শৌভিককে। আর বিয়ের আগের রাতে যখন আলোকমালায় সজ্জিত চাটুজ্জে বাড়ি, শাঁখাপলা পরিয়ে নিয়ে এল দিদিভাই, সেই দৃশ্য দেখে সে কি কান্না জ্যাঠাইমার। “রুণা চলে যাবার পর, তোকে বুকে নিয়ে সামলেছিলাম এতদিন, এবার তুইও-”। 


আমি তো কোথাও যাইনি জ্যাঠাইমা, সরকারী ভাবে আমার ঠিকানা যাই হোক না কেন, হৃদয়ের আস্তানা আজও ব্যাঁটরার চাটুজ্জে বাড়ি। নাকে আজও তোমার, দিদির আর মায়ের আঁচলের গন্ধ। আজও তোমার হাতে বানানো পায়েস পিঠে মালপো নাড়ুর কথা ভাবলে জিভে জল আসে। আজও প্রাণ চায় তোমার সন্তোষ রেডিওতে বিবিধ ভারতী শুনতে। জানি হবেই দেখা আবার। হয়তো অন্য কোন খানে, অন্য কোন সময়। মাঝে শুধু কয়েকটা বছরের প্রতীক্ষা মাত্র। 


পুনশ্চঃ আজ দুপুর দুটো নাগাদ যখন দিদিভাইয়ের ফোনটা এল, একেবারেই সিরিয়াসলি নিইনি। ও মাঝেমাঝেই অমন ফোন করে, যখনই জানতে পারে নতুন কোন তথ্য বা টোটকা, ফোন করে জানায়। ভেবেছিলাম তেমনি- চমক ভাঙল, বুকফাটা হাহাকার শুনে, “মা অার নেই রে বোন। টিভি দেখতে দেখতে, তিনটে হেঁচকির মত- ব্যাস সব শেষ হয়ে গেল। কিছুই করতে পারলাম না আমি। ” এর থেকে বড় মিথ্যে হতে পারে না দিদিভাই, তুমি যে সেবা করেছ নিজের বাবা-মায়ের, চাটুজ্জে বাড়ির কোন মেয়ে আজ অবধি করতে পারেনি। অবশ্যই দিদি থুড়ি পিসিকে ছাড়া।  তবে সেই সময়টাও তো ছিল অন্য। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যদি বিচার করতে হয়, তো আমি জোর গলায় বলতে পারি,তুমি অনন্যা। সত্যি আমি তোমার ছোটবোন। তোমার শিক্ষার্থী।  ছবিতে পড়ন্ত বিকেলে আমাদের বাড়ির রোয়াকে, পেতে রাখা চেয়ারে তিনজন-জ্যাঠাইমা,বুুল্লু বাবু আর পুঁচকেটা আমার তুত্তুরী।  এদৃ্শ্য আর কখনই দেখা যাবে না। এই গল্পের এখানেই যবনিকা পাত।


চিত্র সৌজন্য- শ্রীঅয়ন কুমার চট্টোপাধ্যায়

তুত্তুরী উবাচ ১৯শে ডিসেম্বর, ২০২০

 

👧🏻- হ্যালো! মামমাম, কি করছ?

👵🏽- এই একটু সকালের কাগজটা দেখছি মা। 

👧🏻-আচ্ছা। দাদু কোথায়? দাদু দাও। 

👵🏽- দাদু তো একটু বাজারে বেরিয়েছে মা। 

👧🏻-ওঃ এত সকাল সকাল বাজার যায় কেন? আর এতবারই বা বাজার যায় কেন? এলে আমায় একটু ফোন করতে বোলো তো!

( মিনিট পাঁচ ছয় পর) হ্যালো মামমাম! দাদু ফিরেছে?

👵🏽- না মা। এখনও তো ফেরেনি। ফিরলেই তোমায় ফোন করবে। 

👧🏻-(বিষণ্ণ সুরে) আচ্ছা। ঠিক আছে। 

( আরও মিনিট পাঁচ ছয় পর) হ্যালো মামমাম,দাদু ফিরেছে?  উঃ এখনও ফেরেনি? কাল রাতে বলে রাখলাম আজ দশ মহাবিদ্যা নিয়ে আলোচনা করব। আচ্ছা মামমাম, তুমি বলো তো আমি ঠিক বলছি কি না? অষ্টম বিদ্যা বগলামুখী,নবম ধূমাবতী আর দশম বিদ্যা কমলা?

👵🏽-(ক্লান্ত স্বরে) সকাল সকাল এইসব কেন মা? একটু পড়তে বসো না। 

👧🏻-(ক্ষিপ্ত হয়ে) পড়তে বসব কেন? আমার তো পরীক্ষা কালই শেষ হয়ে গেছে। 

👵🏽-(প্রমাদ গুণে) আচ্ছা। আচ্ছা। তাও নাহয় মায়ের কাছে একটু বসলে। 

👧🏻-(বিরক্ত, নিম পাতা চিবানো স্বরে) কারো ঠাকুমা-দিদা যে পড়তে বসতে বলে, এ আমি জীবনেও শুনিনি। 

👵🏽-(হাসি চেপে) তাই? জীবনেও শোননি? কত বড় হয়েছে তোমার জীবন মা? 

👧🏻-(বিজ্ঞ সুরে) যত বড়ই হোক না কেন? তুমি তো দিদা। দিদারা কখনও আবার পড়তে বলে? তার জন্য তো তোমার মেয়েই যথেষ্ট।