Friday 25 December 2020

অনির ডাইরি, ২৫শে ডিসেম্বর, ২০২০

 

কেস মিটে যাবার পরও লোক গুলো কেন যে আসে? বারবার আসে, শুকনো মুখে ঘুরে বেড়ায়, চেম্বারের বাইরে থেকে উঁকিঝুঁকি মারে, তারপর একফাঁকে সাহস জুটিয়ে গলিয়ে দেয় মুণ্ডু,“ম্যাডাম আসব?”


তা মশাই কেন আসবেন না? আসতেই পারেন, আপনাদের জন্যই বসে আছি, তবে অনুগ্রহ করে এটা ভেবে নেবেন না যে আমি আপনাকে দত্তক নেব বা নিয়েছি। একবার আপনার কর্মসিদ্ধি হয়েছে বলে কর্মক্ষেত্রের তুচ্ছাতিতুচ্ছ সমস্যা নিয়ে আমাকে জেরবার করতে করাটা কিন্তু মোটেই বাঞ্ছনীয়  নয়। নাঃ বলি না এই কথাগুলি, তবে ভাবি বটে। 


বিশেষতঃ অমুক বাবুকে দেখলেই এটা ভাবি, বহুযাতনায় ওণার কাজটা ফেরৎ দিতে পেরেছিলাম। তারজন্য উচ্চ আদালতের জনৈক অ্যাডভোকেটের প্রচুর আইনি গালি খেতে হয়েছিল বই কি, তবে ভদ্রলোকের কার্যোদ্ধার হয়েছিল। আগেও লিখেছিলাম বোধহয় ওণার গল্পটা, ছোট কোন আধা সরকারী দপ্তরে অ্যাসিস্টান্ট ম্যানেজার পদাসীন ছিলেন ভদ্রলোক। তহবিল তছরুপের অভিযোগে রাতারাতি ওণাকে বরখাস্ত করা হয়। 


তখন আনলক ডাউনের প্রথম অধ্যায়, আপিস প্রায় জনশূণ্য। বাজারের থলে ভর্তি কাগজপত্র নিয়ে উনি এসেছিলেন আমার দপ্তরে। পদের সাথে ম্যানেজার শব্দটি জুড়ে দিলেই তিনি আর শ্রম আইনের অাওতায় পড়েন না। সম্ভবতঃ আইন প্রণেতারা ধরেই নিয়েছিলেন যে ম্যানেজার বা অ্যাডমিনিস্ট্রেটর’রা মোটেই শ্রমিক ক্যাটেগরিতে পড়েন না, তাই শ্রম আইনের নিরাপত্তা তাদের জন্য নয়। একই কথা প্রযোজ্য বেসরকারী কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্যও। চোখের সামনে তাদের শোষিত হতে দেখলেও হাত-পা বাঁধা আমাদের। 


ফিরে যাই অমুক বাবুর গল্পে, ওণার পদের সাথে ম্যানেজার লেজুড় থাকলেও,বেতন যে কোন সিকিউরিটি গার্ডের সমান। যুগপৎ ওণার কাগজের দিস্তা ঘেঁটে বার করা নথি ঘেঁটে যা দেখলাম, ওণার দপ্তর ওণাকে লিখিত নির্দেশনামা দিয়েছিল, ই ব্যাঙ্কিং ইত্যাদির জন্য ওণার ব্যক্তিগত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টটি ব্যবহার করা যাবে। লকডাউন ঘোষণার দিন উনি লাখ দশ-পনেরোর একটি দপ্তরী চেক নিয়ে গিয়ে ব্যাঙ্কে জমা করেন, চেকটার ফটোকপিতে স্পষ্ট যে উচ্চ পদাধিকারীদের সই থাকলেও, ক্রশ করা ছিল না।  


সেইসময় ব্যাঙ্কের ওপর যে অসীম চাপ ছিল হয়তো সেই কারণে অথবা জানি না কেন চেকটি দপ্তরের অ্যাকাউন্টে না ক্রেডিট হয়ে অমুকবাবুর ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে ক্রেডিটেড হয়। তারপর করোণার দাপটে ঘুমিয়ে পড়ে সমগ্র বিশ্ব। টানটান লকডাউনের আড়ামোড়া ভাঙা মাত্রই আপিসে গিয়ে সমগ্র ব্যাপারটা বুঝতে পারেন অমুক বাবু। সেইদিনই সমগ্র টাকাটা আবার দপ্তরী অ্যাকাউন্টে ঢুকিয়ে দেন এবং সততার পরাকাষ্ঠা হয়ে ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট তুলে সমগ্র ব্যাপারটা দপ্তরের গোচরে আনেন। তার পরের দিনই ওণার চাকরী যায় এবং শুরু হয় আমার দপ্তরে আনাগোণা।  


নাই পড়ুক ব্যাপারটা শ্রমআইনে, কোন কর্মচারী যদি কাজ হারিয়ে আমার দ্বারস্থ হন, তাঁকে দেখা আমার কর্তব্য। সেই মোতাবেক ওণার চিঠির কপি ওণার দপ্তরে পাঠিয়ে জানতে চাইলাম, কেসটা কি? বাঁধাগতে জবাব পেলাম তহবিল তছরূপের অভিযোগে ওণার চাকরী গেছে ইত্যাদি।  


পরের ধাপে ডেকে পাঠানো হল ঐ সংস্থার সচীব এবং সভাপতিকে। সচীব এলেন না বটে, সভাপতি এসে হাজির হলেন। ভদ্রলোক সত্তরোর্দ্ধ, এককালে সরকারী কর্মচারী ছিলেন। একবাক্যে মেনে নিলেন, ছাঁটাই সম্পূর্ণ বেআইনি। আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ফলেই কাজ হারিয়েছেন অমুক বাবু। নাঃ লাল-নীল-কমলার দ্বন্দ্ব নয়, সবাই একই রঙের অনুগামী নিছক গ্রাম্য দলাদলী রাজনীতির বলি অমুক বাবু।  


বললাম, লিখে দিতে পারেন, যে কাজটা অনৈতিক হয়েছে? আধঘন্টার মধ্যে কাঁপা কাঁপা হস্তাক্ষরে চিঠি লিখে আনলেন বৃদ্ধ। ভাবলাম কেল্লা ফতে! সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ার আগেই এল মোটকা চিঠির বাণ্ডিল, যাতে সংস্থার বর্তমান ম্যানেজার জানালেন যে, ঐ সভাপতি বা সচীবের কথার কোন গুরুত্ব আজ আর নেই, কারণ বোর্ড ভেঙে গেছে। নতুন বোর্ড না আসা পর্যন্ত সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার প্রশ্ন নেই। 


খোঁজ পত্তর করে দেখা গেল জনৈক জেলাস্তরীয় অফিসার আপাততঃ ঐ সংস্থার দায়িত্বে। তাঁকেই চিঠি লিখে জানানো হল, ব্যাপারটা একটু দেখুন। এইভাবে রাতারাতি মুখের কথায় কাউকে বিতারণ করা যায় নাকি? আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ তো দিতে হত? যথোপযুক্ত এনকোয়ারি করতে হত। চুরির অভিযোগ হলে পুলিশে জানাতে হত, তারপর না হয় আপনাদের নিজস্ব আইনানুসারে ওণার বিচার হত। 


আমার চিঠিটাই ঐ সংস্থায় পাঠান জেলার অফিসার, সাথে সাথে নির্দেশ দেন অমুক বাবুর চাকরী যাওয়া বেআইনি, অবিলম্বে ওণাকে পুনর্বহাল করতে হবে। ভাবলাম মধুরেন সমাপয়েৎ। তারপরই উচ্চ আদালতের অ্যাডভোকেট মহাশয়ের শাসানি চিঠি। “একদম আপনার এক্তিয়ার বহির্ভূত ব্যাপারে নাক গলাবেন না। ফের যদি নাক গলিয়েছেন ভালো হবে না কিন্তু। ”পত্রপাঠান্তে জনৈক ব্যাচমেটের কথা মনে পড়ছিল, যে কোন এককালে অমন শাসানি চিঠি সম্পর্কে বলেছিল,“ওগুলো তো ট্রফি রে-।”  


আমি ট্রফি পেলাম,উনি কাজ ফেরৎ পেলেন। আবার কি চাই? জীবন এগিয়ে চলছিল নিজের মত। তারপরও দুবার তিনবার এসেছিলেন অমুক বাবু, নালিশ করছিলেন না না সমস্যা নিয়ে। উনি পুলিশকে জানিয়েই কাজে যোগ দিতে যান, তাও ওণার নামে পুলিশে নালিশ করতে যায় ওণার দপ্তর। ওণাকে কোন কাজ দেওয়া হচ্ছে না, সই করা নিয়ে নিত্য অশান্তি চলছে ইত্যাদি।  


প্রতিবারই এক কথা বলতাম, এগুলো সত্যিই আমার এক্তিয়ার বহির্ভূত। আপনি জেলার অফিসারের সাথে যোগাযোগ করুন। প্রতিবারই উনি বলতেন, “গিয়েছিলাম তো ম্যাডাম। উনি প্রতিবারই এককথা বলেন,  ‘আমি কি করব? আপনি বরং ম্যাডামের কাছেই যান। যা করার উনিই করতে পারবেন-’। ” এতো মহাজ্বালা!


সম্প্রতি আবার  এসেছিলেন ভদ্রলোক, আরো অনেকটা কৃশ হয়েছেন। গাল ভর্তি দাড়ি। উদ্ভ্রান্ত চোখমুখ। সেই থেকে বেতন পাননি। আপিসে নিত্য অশান্তি। হতাশ হয়ে বললেন, “আমাকে ওরা নেবে না ম্যাডাম। জলে বাস করে আর কতদিন কুমীরের সাথে লড়ব? ভাবছি ছেড়েই দেব কাজটা। ” শুনলাম সেই থেকে বেতন পাননি ভদ্রলোক। 


আমার সমস্ত মেহনত, মস্তানি, খিস্তি খাওয়া সব ব্যর্থ হয়ে গেল হয়তো, তবে কাজ করবেন কি ছেড়ে দেবেন ওণার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবুও বললাম, খোদ রাজ কর্মচারীর ফরমান ওণার পক্ষে, আরেকবার তাঁকে গিয়েই বলুন না হয়। জবাব পেলাম, উনি হয় বলেন সবুরে মেওয়া ফলবে নয়তো আমায় দেখান। ভালো জ্বালায় পড়েছি তো। সাধে দত্তক নেবার কথাটা মাথায় আসে। তাহলে তো একটাই রাস্তা খোলা, ন্যায়ালয়ের শরণাপন্ন হয়ে দেখুন। এক্ষেত্রে সবাই একই কথা বলেন, আদালতের চক্করে পড়ার মত সময় বা অর্থবল থাকে না এদের। জেলা আইনি সহায়তা কেন্দ্রের আইনজীবি বিনা মূল্যে কেস লড়েন বটে, তবে যদি বাদী মহিলা হন। সংরক্ষিত জনজাতি বা পিছড়ে বর্গের জন্যও বোধহয় নানা আইনি সুযোগ আছে। হয়তো সাধারণ শ্রেণীর জন্যও কিছু থাকতে পারে, ওদের কাছে গিয়েই দেখুন না। তাও যাবেন না অমুক বাবু। 


“আমায় চোর বদনাম দিয়ে তাড়িয়ে দিল, কেউ পাশে থাকেনি। আপনি কেবল আমার কথা শুনেছেন। আপনার চেষ্টায় কাজ ফেরৎ পেয়েছি। বেতন না পেয়েও আপনার কাছেই ছুটে এয়েছি। যা করার আপনিই করুন। দয়া করে ফিরিয়ে দিয়েন না ম্যাডাম। ” এতো মহাজ্বালা! যে রাজনৈতিক ঘুর্ণির মধ্যে পড়তে চাই না, তাতেই টেনে নিয়ে যাবে লোকটা। 


বেতন না পাওয়াটা অবশ্য সত্যিই আমি দেখতে পারি। “বেতন পাচ্ছি না ম্যাডাম” আমাকে উদ্দেশ্য করে বাংলা হরফে লেখা চিঠিটা পাঠিয়ে জেলার সংশ্লিষ্ট দপ্তরের গোচরে আনার চিঠি করে বললাম, এতে কিছু হবে বলে মনে হয় না। আমার দৌড় এখানেই শেষ। এবার কিন্তু আদালতই ভরসা- 


গতকাল মেলার তাড়া তাড়া চিঠিপত্র নিয়ে ব্যস্ত, ছুটে এল ধীমান,“ম্যাডাম, অমুক বাবুর এই চিঠিটা কি নেবো?” আবার কি চিঠি দেয় রে বাবা লোকটা। এদের চিঠির দাপটে পাগল হয়ে যাব যে, চোখ বোলাতে গিয়ে দেখি, এটা উনি লেখেননি, লিখেছেন জেলার অফিসার। লিখেছেন অমুক বাবুর দপ্তরকে, আমায় কপি দিয়েছেন কেবল। চিঠিতে আমার পুরানো চিঠির অংশবিশেষ তুলে ধরে গোটা গোটা মোটা মোটা কালিতে অফিসার মশাই লিখেছেন,“ উনি বলার পর, আমি নির্দেশ দিয়েছিলাম অমুক বাবুকে চাকরীতে পুনর্বহাল করার। করেননি কেন? ওণাকে বেতন দেননি কেন? অবিলম্বে অমুকবাবুর সমস্ত বেতন প্রদান করে আমাকে জানান। ”   


বুঝতে পারলাম না, এতে আমার সমস্যা মিটবে না বাড়বে। হয়তো আবার শমন পাঠাবেন কোন উকিল মহোদয়, এক্তিয়ারের লক্ষণরেখা পার করার অনুযোগ তুলে। হয়তো আসবে কোন ভারী রাজনৈতিক ফোনও। অথবা ফোন যাবে আমার অনেক ওপরতলায়- যা হবার হবে, হোক। অত ভাবলে কি আর লেবারগিরি করা যায়! মুখে যাই বলি, কলম যাই বলুক, আবার যদি এমন কেউ এসে আমার দ্বারস্থ হন, আমার সর্বশক্তি নিয়ে আমি আবার তার পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করব- অতঃপর যা হবে, দেখা যাবে। দত্তক নেবার কথাটা বোধহয় তাই মাথায় আসে। যাই হোক শুভ বড়দিন। অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইল। খুব ভালো থাকুন সকলে।

Tuesday 22 December 2020

অনির ডাইরি ২২শে ডিসেম্বর ২০২০

 


ঈশ্বরপ্রীতি অবশ্য আমারও ঐ বয়সে ভয়ানক রকমের ছিল। আহাঃ বেঁচে থাকুক বাঙালীর বারো মাসে তের পার্বণ, আরো উপোস তিরেস করুক মা- ঠাকুমা-পিসি, দিনান্তে আরো সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়া হোক উপাদেয় নানা পদ। যেমন জয় মঙ্গলবারের ফলার- উঃ ভাবতেই জিভে জল আসে। চিঁড়ে, দুধ, চিনি, আম আর কলা একসাথে মেখে যে কি অমৃত তৈরি হয়, তা যারা ঠাকুমার হাতের ফলার খায়নি জানতেও পারবে না।


 অথবা জ্যাঠাইমার হাতের সাবু মাখা। রাত ভর ভিজিয়ে রাখা উড়ের দোকানের সাবুতে চটকানো হত কড়ে আঙুলের মাপে কাঁঠালি কলা, নারকেল কোরা আর বাতাসা। সাবু নিয়ে অবশ্য রীতিমত অবসেসড্ ছিল জ্যাঠাইমা। পার্বণে হয় সাবু মাখা নয়তো সাবুর খিচুড়ি তো হতই, এর বাইরেও কারো হাঁচি কাশি পেটগরম হলেই বড় কাঁসার গ্লাস ভর্তি দুধ সাবু নিয়ে হাজির হয়ে যেত জ্যাঠাইমা। সাবু খেলে নাকি পেট ঠান্ডা হয়, তাই বেহারী গোয়ালার জল ঢালা ট্যালটালে দুধকে একটু বেশী ফুটিয়ে ঘন করে, তাতে এলাচ আর তেজপাতা দিয়ে প্রস্তুত হত মিষ্টি মিষ্টি দুধসাবু। আজ লিখতে লিখতে জিভে জল এলেও সেদিন ছুঁয়েও দেখতাম না। 


জ্যাঠাইমার সাবু আর ঠাকুমার বার্লি দুটোকেই সমান ভয় পেতাম আমরা। আর ভয় পেতাম পিসির দশহরার দিন ঘুম ভাঙিয়ে কাঁচা দুধ আর কাঁচা উচ্ছে খাওয়ানো। বাপরেঃ সে যে কি অসীম যাতনা। না খেলে নাকি মনসা দেবী চটে যাবেন- সাংঘাতিক ভিড় হত সেদিন গলির মনসা তলায়। কবেকার বুড়ো ফণিমনসা গাছের নাতির নাতির চরণে জমা হত পুজোর নানা উপাচার। কথিত আছে বড় জাগ্রত এই মনসাতলা। নিঃসন্তান দম্পতিরা পুত্রার্থে (সন্তানার্থেই হয়তো) মানত করত ক্ষীরের পুতুল। মনসাতলায় ক্ষীরের পুতুল থেকেই আমাদের গলির নাম ক্ষীরেরতলা। বুড়ি মনসা এখনও আছেন বটে, তবে উল্টোদিকে কোথা থেকে যেন উড়ে এসে জুড়ে বসেছে এক বুড়ো শিব, তাঁর গ্ল্যামার অার ঐশ্বর্যের কাছে ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছে সাবেকী বাংলার ছাপোষা লোকদেবী।  


মোটকথা আমার মেয়েবেলায় ঈশ্বর আর সুখাদ্যের মধ্যে ছিল নিবিড় সম্পর্ক।  ঈশ্বরচেতনার অনেকটা জুড়েই বিরাজ করত আটা বা ময়দার সিন্নি, লাল আটার ফুলকো লুচি, ফলার, খিচুড়ি, গলির মুখের ঘোষ ব্রাদার্সের নারকেল ছাপা, চন্দ্রপুলি, দানাদার। তাছাড়া পায়েস, মালপো, পিঠেপাটালি ছিল তো ছিলই।  


নিছক নিম্ন মধ্যবিত্তের হেঁসেল থেকে আসা এইসব অমৃত আজ নিজে বানালে কেমন যেন পানসে লাগে, তাও বানাই মেয়ের সাথে নিজের মেয়েবেলার কিছুটা আস্বাদ ভাগ করে নিতে। আর মেয়ে কি করে? স্বকর্ণে শুনুন না মশাই। দিবারাত্র বাড়িতে গুঞ্জরিত হয় দুর্গাস্তোত্র। আপিস থেকে ফিরে জুতো খুলে মুখ হাতপা ধুতে যাবার আগেই একবার শুনতে হয় দশ মহাবিদ্যা উপাখ্যান। তারপর চায়ে চুমুক দিতে দিতে আরও বিশদে শুনতে হয়- তারপর আরো বিশদে- আরো- আরোও। 


দশভূজার গুঁতোয় অতিষ্ঠ হয়ে  যদি প্রকাশ পায় সামান্যতম উষ্মা, ছলছল আঁখি আর ধরা অভিমানী ফোন যায় অদূর হাওড়ায়। ফোনের ওপার থেকে ভেসে আসে আক্রমণাত্মক বৃদ্ধা আর আহত বৃদ্ধের স্বর, “বড় নিঃসঙ্গ ও।” বুঝতে পারি, শুধু তুত্তুরী নয়, নিঃসঙ্গ ওরা তিনজনাই। আমার জীবনে যা ভয়ানক দুর্লভ, ওদের জীবনে তারই প্রাচুর্য। সময় অঢেল নেই শুধু যোগাযোগের সুযোগ। দূরভাষই রচনা করে  একমাত্র সেতু। আর সেই দূরভাষ আর অনেকটা সময়জুড়ে বিরাজ করেন এই কাল্পনিক রমণী। আমার চোখে যিনি উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট বা নারী স্বশক্তিকরণের প্রতিভূ।  তবে সে গল্প অন্য কখনও হবে না হয়। আপাততঃ যাই সবার মান ভাঙাই।

Monday 21 December 2020

তুত্তুরী উবাচ ২১শে ডিসেম্বর, ২০২০

 

👧🏻- আচ্ছা সঞ্চিতা মাসি, তোমার নাকে ওটা কি?

👩🏻‍🏫-(নাকের ডগায় হাত বুলিয়ে হেসে উঠে) এটা? এটা তিল রে তুত্তুরী। 

👧🏻- (ভিডিও কলের এপারে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকে) তিল না আঁচিল?

👩🏻‍🏫-( আদুরে মস্করার সুরে) না রে তুত্তুরী। এটা তিল।  আমি খুঁটে দেখেছি- 

👵🏻-(সঞ্চিতার মাসির মা পাশ থেকে মুখ বাড়িয়ে) যেদিন সঞ্চিতা মাসির সাথে তোর দেখা হবে, খুঁটে দেখে নিস, তিল না আঁচিল। 

👧🏻-(গম্ভীর মুখে) নাঃ। আমি শুধু নিজেরটা খুঁটি, অন্যের নাক খুঁটি না।

Saturday 19 December 2020

অনির ডাইরি ১০ই ডিসেম্বর, ২০২০

 


অনেকক্ষণ ধরে ভাবছি কাঁদব। খুব জোরে বিলাপ করে যদি নাও হয়, অন্তত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে তো কাঁদতেই পারি? কত কিছুতেই তো আমি কেঁদে ভাসাই- অথচ আজ যখন এক পলকে শেষ হয়ে গেল জীবনের এতবড় অধ্যায়- 


অধ্যায়ই তো, ডাকনামটাই তো তাঁর দেওয়া। বংশের উত্তরাধিকারীর জন্ম দিতে অপারগ বাবা- মা যখন কোলে করে আমায় নিয়ে প্রথম প্রবেশ করে ব্যাঁটরার চাটুজ্জে বাড়িতে, সবথেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা দিয়েছিল সে। দিদিভাইয়ের ডাক নাম ছিল রুনু, ছন্দ মিলিয়ে নাম রেখেছিল ঝুনু। 


আঠারো মাস বয়স অবধি না কথা বলতে পারতাম, না দাঁড়াতে পারতাম। কোথাও বোধহয় হাল ছেড়ে দিয়েছিল ঈশ্বর স্বয়ং। আশা ছাড়েনি সে। ভোর ভোর ঘুম থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে জোর করে দাঁড় করিয়ে দিত টিনের মিটসেফটার গায়ে ঠেস দিয়ে। মিটসেফের মাথার ওপর বেজে চলত সন্তোষ রেডিওর বিবিধ ভারতী। টলটল করতে করতে পড়ে যাবার উপক্রম হলেই পুনরায় ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিত সে। তারপর শুরু করত বকবক। বোবা বাচ্ছার সাথে এত কি বকবক করতে তুমি জ্যাঠাইমা? আমার মুখের ভাঁজে ভাঁজে ফুটে ওঠা হাসির অর্থ কি ভাবে ধরতে তুমি জ্যাঠাইমা? 


হাঁটতে শিখলাম, মুখে খই ফুটল। বাবা-মা নিয়ে গিয়ে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এল ব্যাঁটরা পাবলিক লাইব্রেরীর নার্সারিতে। ভোর ভোর ইস্কুল। ঘুম থেকে তুলে জামা পরিয়ে কোলে করে ঘর থেকে বের হত মা। তারপর কোলে তুলে নিত পিসি। গোটা দোতলার দালান আর সিঁড়ি পিসির কোলে চেপে নামার সাথেসাথেই, খপ করে কোলে তুলে নিত জ্যাঠাইমা। একতলার দালান থেকে বেরিয়ে, রোয়াক টপকে, চারটে সিঁড়ি ভেঙে, বিশাল উঠোনকে কোণাকুণি পার করে, দেড়শ বছরের সদর দরজাটার সামনে এসে তুলে দিত বাবার কোলে। 


ছোটবেলায় মা বলেই তো ডাকতাম, আর জন্মদাত্রীকে বলতাম মানা। কবে থেকে যে বদলে ফেললাম সম্বোধন, তা আর আজ মনে পড়ে না। দিদিভাইয়ের বিয়ের পর আরও বেশী আঁকড়ে ধরেছিল জ্যাঠাইমা- 


ভোরবেলা ঘুম ভাঙত জ্যাঠাইমার উনুনের ধোঁয়ার গন্ধে, আর সন্তোষ রেডিওর “ইয়ে আকাশবাণী হ্যায়” শুনে। যে টিনের মিটসেফের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াতে শিখেছিলাম, ডিঙ্গি মেরে তার মাথায় উঁকিঝুঁকি মারতাম বেলা নটায় বিবিধ ভারতীর রঙ্গারঙ্গ কার্যক্রম শোনার লোভে। ভারত বিস্কুটের সেই বিজ্ঞাপনটা আজও মনে আছে, “কি গো নাতনী, আমায় বিয়ে করবে নাকি? ইশ্ তুমি বুড়ো। ” শেষে ভারত বিস্কুট প্রাপ্তির লোভে যেখানে শিশুকন্যাটি রাজি হয়ে যেত বুড়োকে নিকে করতে। অথবা চেশমি গ্লিসারিন সাবানের বিজ্ঞাপন। আর হাতুড়ি মার্কা ফিনাইল এক্স? শনিবারের বারবেলা শুনতে শুনতে আরো তলিয়ে যেতাম জ্যাঠাইমার ভুঁড়ির তলায়। 


বাবামায়ের রক্তচক্ষুর আড়ালে প্রথম চায়ের কাপ তো জ্যাঠাইমাই ধরিয়েছিল। বড় বেশী ন্যাওটা ছিলাম যে, যখন যাই করত পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম আমি। বিকালের চায়ের কাপটা কবে যে টুকুস করে তুলে নিলাম আর বিদায় জানালাম দুধের কাপকে আজ আর মনেও নেই।  


কানে খোল জমেছে কিনা, আর মাথায় উকুন হয়েছে কিনা, দেখা ছিল জ্যাঠাইমার নেশা। ধরতে পারলেই কোলে ফেলে কানে ফোঁটা ফোঁটা সর্ষের তেল ঢেলে, হেয়ারপিন নিয়ে লেগে পড়ত কান সাফ করতে। জীবনের প্রথম শাড়ি, উপহার পেয়েছিলাম জ্যাঠাইমার থেকে। চুনেহলুদ রঙের খোলে জরির বুটি আর সবুজ পাড়। দ্বিতীয় বছর কমলা খোলের ওপর বেগুনী রঙা সুতোর কাজ। আজও চোখে ভাসে শাড়ি দুটো।  

জ্যাঠাইমার হারমোনিয়ামটা ছিল সত্যি সত্যি পদী পিসির বর্মী বাক্স। সন্ধ্যে নামলেই গলা সাধতে বসত জ্যাঠাইমা। যেদিন অনুগ্রহ করে স্পর্শ করতে দিত,সেদিন যে কি ফূর্তি-। 


শালকিয়ায় স্বর্গীয় অনল চট্টোপাধ্যায়ের কাছে গান শিখতে যেত জ্যাঠাইমা। শিখে আসা গান, দোতলায় রেওয়াজ করতে বসলেই, একতলার উঠোনে ভ্যাঙাত বাবা। বাবার ভয়ে “পিলে পিলে হরিনাম কা প্যায়ালা” তোলেনি জ্যাঠাইমা। অনলদাকে বলেছিল, “এই গানটা ধরলে আমার মেজো দেওর আর আস্ত রাখবে না আমায়। দিনরাত ঐ গান গেয়ে  ঘুরবে আমার পিছু পিছু। ” এই গল্পটা বাড়ি এসে বলাটাই কাল হল। কতদিন যে বাবা জ্যাঠাইমাকে দেখলেই প্যারডিটা গাইত তার ইয়ত্তা নেই। বঙ্গীয় সঙ্গীত পরিষদ থেকে পাওয়া জ্যাঠাইমার সার্টিফিকেট গুলো সযতনে বাঁধিয়ে রেখেছিল জেঠু। আর ছিল একটা সাদাকালো ছবি, জেঠু-জ্যাঠাইমা আর নেতাজীর মত পোশাকপরা ছোট্ট দিদিভাই। দোতলায় উঠলেই চোখে পড়ত- বহুদিন বন্ধ ঐ তরফের অংশটা। উই ধরে গেছে নির্ঘাত। 


সিনেমা দেখার কি নেশা ছিল জ্যাঠাইমার। প্রতি শুক্রবার স্কুল থেকে ফেরার পর, জিজ্ঞাসা করত জ্যাঠাইমা- নবরূপমে কি সিনেমা চলছে রে? আর শ্রীরূপায়? সিনেমা দেখার তাড়নায় কতবার যে দুপায়ে দুরকম চপ্পল পরে চলে গেছে জ্যাঠাইমা। সেসব ইতিহাস আজও গুমরে গুমরে ঘোরে চাটুজ্জে বাড়ির বন্ধ অংশটায়।  


একবারই পুরী নিয়ে গিয়েছিল জেঠু। বাড়ি থেকে রওণা দেবার সময় ঠ্যাং ছড়িয়ে কেঁদেছিলাম আমি, “ও জ্যাঠাইমা, তুমি যেও না গো। ” আর হাওড়া স্টেশনে কেঁদেছিল মুনাই, আমার একমাত্র বোনঝি তথা জ্যাঠাইমার প্রাণাধিক নাতনী। পরিণতি কি হয়েছিল বলুন তো? জবরদস্তি বেড়াতে নিয়ে আসার অপরাধে গোটা পুরী ট্রিপে জেঠুর গুষ্টি উদ্ধার করে দিয়েছিল জ্যাঠাইমা। কোথাও নামেনি, কোথাও যায়নি। শুধু একগাদা উপহার কিনে এনেছিল সবার জন্য। বাড়ি ফিরে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল জেঠু, “এই মহিলাকে নিয়ে? আর কোত্থাও নয় বাবা। ” 


তখন বোধহয় ষষ্ঠ শ্রেণী, মস্ত অপারেশন হয়েছিল জ্যাঠাইমার। বেডে যখন দিল, তখনও তন্দ্রাচ্ছন্ন। মাঝে মাঝে অস্ফুটে ডেকে চলেছে দিদিভাইকে। হাত ভর্তি কাঁচের সোনালী সবুজ চুড়িতে ঝিলিক মারছিল নার্সিং হোমের টিউবলাইটের আলো। আজও চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই দৃশ্যটা। দিন তিনচার পর দেখতে গেছি জেঠু আর আমি, ও হরিঃ, বেড ফাঁকা।  আয়া মেয়েটিকে পটিয়ে পাটিয়ে রিক্সা ডাকিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে জ্যাঠাইমা। "নার্সিংহোমে আবার কেউ থাকে? ম্যাগো।" বাপরেঃ কি ডানপিঠে মহিলা- 


কি যে অসম্ভব ভালো পিঠে পায়েস বানাত জ্যাঠাইমা। আর নবান্ন? সে তো অতুলনীয়। আমার হাতের যে লাল পায়েস খেয়ে মোহিত হয়ে পড়ে আমার শ্বশুর থেকে বর,মায় মেয়েটাও, তাতো জ্যাঠাইমার কাছেই শেখা। নিজে হাতে আমার বিয়ের শ্রী গড়েছিল জ্যাঠাইমা। ভেজেছিল আনন্দনাড়ু। বরণ করেছিল শৌভিককে। আর বিয়ের আগের রাতে যখন আলোকমালায় সজ্জিত চাটুজ্জে বাড়ি, শাঁখাপলা পরিয়ে নিয়ে এল দিদিভাই, সেই দৃশ্য দেখে সে কি কান্না জ্যাঠাইমার। “রুণা চলে যাবার পর, তোকে বুকে নিয়ে সামলেছিলাম এতদিন, এবার তুইও-”। 


আমি তো কোথাও যাইনি জ্যাঠাইমা, সরকারী ভাবে আমার ঠিকানা যাই হোক না কেন, হৃদয়ের আস্তানা আজও ব্যাঁটরার চাটুজ্জে বাড়ি। নাকে আজও তোমার, দিদির আর মায়ের আঁচলের গন্ধ। আজও তোমার হাতে বানানো পায়েস পিঠে মালপো নাড়ুর কথা ভাবলে জিভে জল আসে। আজও প্রাণ চায় তোমার সন্তোষ রেডিওতে বিবিধ ভারতী শুনতে। জানি হবেই দেখা আবার। হয়তো অন্য কোন খানে, অন্য কোন সময়। মাঝে শুধু কয়েকটা বছরের প্রতীক্ষা মাত্র। 


পুনশ্চঃ আজ দুপুর দুটো নাগাদ যখন দিদিভাইয়ের ফোনটা এল, একেবারেই সিরিয়াসলি নিইনি। ও মাঝেমাঝেই অমন ফোন করে, যখনই জানতে পারে নতুন কোন তথ্য বা টোটকা, ফোন করে জানায়। ভেবেছিলাম তেমনি- চমক ভাঙল, বুকফাটা হাহাকার শুনে, “মা অার নেই রে বোন। টিভি দেখতে দেখতে, তিনটে হেঁচকির মত- ব্যাস সব শেষ হয়ে গেল। কিছুই করতে পারলাম না আমি। ” এর থেকে বড় মিথ্যে হতে পারে না দিদিভাই, তুমি যে সেবা করেছ নিজের বাবা-মায়ের, চাটুজ্জে বাড়ির কোন মেয়ে আজ অবধি করতে পারেনি। অবশ্যই দিদি থুড়ি পিসিকে ছাড়া।  তবে সেই সময়টাও তো ছিল অন্য। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যদি বিচার করতে হয়, তো আমি জোর গলায় বলতে পারি,তুমি অনন্যা। সত্যি আমি তোমার ছোটবোন। তোমার শিক্ষার্থী।  ছবিতে পড়ন্ত বিকেলে আমাদের বাড়ির রোয়াকে, পেতে রাখা চেয়ারে তিনজন-জ্যাঠাইমা,বুুল্লু বাবু আর পুঁচকেটা আমার তুত্তুরী।  এদৃ্শ্য আর কখনই দেখা যাবে না। এই গল্পের এখানেই যবনিকা পাত।


চিত্র সৌজন্য- শ্রীঅয়ন কুমার চট্টোপাধ্যায়

তুত্তুরী উবাচ ১৯শে ডিসেম্বর, ২০২০

 

👧🏻- হ্যালো! মামমাম, কি করছ?

👵🏽- এই একটু সকালের কাগজটা দেখছি মা। 

👧🏻-আচ্ছা। দাদু কোথায়? দাদু দাও। 

👵🏽- দাদু তো একটু বাজারে বেরিয়েছে মা। 

👧🏻-ওঃ এত সকাল সকাল বাজার যায় কেন? আর এতবারই বা বাজার যায় কেন? এলে আমায় একটু ফোন করতে বোলো তো!

( মিনিট পাঁচ ছয় পর) হ্যালো মামমাম! দাদু ফিরেছে?

👵🏽- না মা। এখনও তো ফেরেনি। ফিরলেই তোমায় ফোন করবে। 

👧🏻-(বিষণ্ণ সুরে) আচ্ছা। ঠিক আছে। 

( আরও মিনিট পাঁচ ছয় পর) হ্যালো মামমাম,দাদু ফিরেছে?  উঃ এখনও ফেরেনি? কাল রাতে বলে রাখলাম আজ দশ মহাবিদ্যা নিয়ে আলোচনা করব। আচ্ছা মামমাম, তুমি বলো তো আমি ঠিক বলছি কি না? অষ্টম বিদ্যা বগলামুখী,নবম ধূমাবতী আর দশম বিদ্যা কমলা?

👵🏽-(ক্লান্ত স্বরে) সকাল সকাল এইসব কেন মা? একটু পড়তে বসো না। 

👧🏻-(ক্ষিপ্ত হয়ে) পড়তে বসব কেন? আমার তো পরীক্ষা কালই শেষ হয়ে গেছে। 

👵🏽-(প্রমাদ গুণে) আচ্ছা। আচ্ছা। তাও নাহয় মায়ের কাছে একটু বসলে। 

👧🏻-(বিরক্ত, নিম পাতা চিবানো স্বরে) কারো ঠাকুমা-দিদা যে পড়তে বসতে বলে, এ আমি জীবনেও শুনিনি। 

👵🏽-(হাসি চেপে) তাই? জীবনেও শোননি? কত বড় হয়েছে তোমার জীবন মা? 

👧🏻-(বিজ্ঞ সুরে) যত বড়ই হোক না কেন? তুমি তো দিদা। দিদারা কখনও আবার পড়তে বলে? তার জন্য তো তোমার মেয়েই যথেষ্ট।

অনির ডাইরি ১৫ই ডিসেম্বর, ২০২০

 


তখনও আকাশের মুখ কালো, পশ্চিম আকাশে ঢুলু ঢুলু সন্ধ্যাতারা। দিব্যি মশারি টাঙিয়ে ঘুমাচ্ছিলাম আমরা, মা আর আমি খাটে, আর বাবা মেজেতে। খুব গরম পড়লে অবশ্য তিনজনই গড়িয়ে যেতাম মাটিতে। সেই রাত গুলো বোধহয় আমার মেয়েবেলার সবথেকে মূল্যবান রাতের মধ্যে পড়ে। শোবার আগে জলের ছিটে দেওয়া হত প্রপিতামহের আমলের লাল ফুটিফাটা মেঝের বুকে। তার ওপর পাতা হত না কোন গদি-তোষক বা চাদর। শুধু মাথার আর পাশ বালিশের ওপর আলগা করে টাঙিয়ে দেওয়া হত মশারি।  গুচ্ছ খানেক কাঁচের টোল খাওয়া পেপার ওয়েট দিয়ে মাটিতে আটকে রাখা হত মশারির তলার কাপড়টাকে। মাথার ওপর ঘড়ঘড় করে ঘুরত ডিসি পাখা।  মাঝে মাঝে বন্ধ হয়ে গেলে, বাবা খাটের ওপর দাঁড়িয়ে টেনে বার করত দুটো স্প্রিং লাগানো কার্বনের লাঠি। আমাদের মানে আমি বা আমার খুড়তুতো ভাই অয়ন আর অনিন্দ্যর কাজ ছিল খড়খড়ে মেঝেতে ঐ কার্বন গুলো ঘষে সমান করা। তারপর আবার লাগিয়ে দিলেই- ভয়লা থুড়ি কেল্লা ফতে।  আবার ঘড়ঘড় করে ঘুরত ডিসি পাখা।


যা বলছিলাম, সেদিন অবশ্য শোয়া হয়নি মাটিতে, ঠাকুমার বিয়ের সাবেকী খাটেই ঘুমিয়েছিলাম মায়ের পাশে, দুদ্দাড় করে ঢুকে এল দিদিভাই, হাতড়ে খটাস করে আলো জ্বালিয়ে চিৎকার করে উঠল, “রাজীব গান্ধী মারা গেছেন। পরিস্থিতি খুব খারাপ। আজ যেন কেউ রাস্তায় বেরিও না তোমরা। ” দিদিভাই অর্থাৎ আমার একমাত্র জেঠতুতো দিদি শ্রীমতী রুণা ব্যানার্জীর দুঃসাহস সীমাহীন। ইন্টারনেট বিহীন সেই যুগে কি ভাবে অত রাতে খবরটা পেয়েছিল কে জানে? তখন তো ঘুমিয়ে থাকত আকাশবাণী তথা দূরদর্শন।  তাহলে ও জানল কি করে সেটা আজও রহস্য আমার কাছে। দূরভাষ তো তখন আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে দূরের স্বপ্ন- শুধু মাত্র বাপ-কাকাদের প্রতি অসীম টানে, জানা মাত্রই কিভাবে যেন এক প্রৌঢ় বিহারী রিক্সাওয়ালাকে পটিয়ে নিশুতি হাওড়া শহরের বুক চিরে দৌড়ে এসেছে বাপের বাড়ি। আরও চার ঘন্টা লেগেছিল দূরদর্শনের খবর পেতে। 

 

সেই তো শুরু। খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছিল আশির দশকের নিখাদ বাঙালী জীবন। কয়লা ভাঙা, গুল দেবার জায়গাটা দখল করে নিচ্ছিল এলপিজি গ্যাস, নিদেন পক্ষে কেরোসিনের জনতা স্টোভ। চলে যাচ্ছিলেন  বাঙালীর যাবতীয় অহংকার তুফান মেল কানন দেবী থেকে সত্যজিৎ রায়।


  আমাদের প্রজন্মের চোখের সামনে ভেঙে পড়ল প্রায় অর্ধ সহস্রাব্দ প্রাচীন মসজিদ। দূরদর্শনে স্মিত হাসি মুখে বয়ান দিলেন বৃদ্ধ বিসমিল্লা খাঁ, “আমার ঈশ্বর তো সর্বত্র বিরাজমান। যেখানে যখন এক চিলতে জায়গা পাব, আমি বসে যাব আমার ঈশ্বরের ইবাদৎ করতে। ” ঠিক তর্জমা করলাম কি? জানি না। তবে ওণার হৃদয়ের অনুভূতিটা আজও বন্দী হয়ে আছে আমার মনের মণিকোঠায়।  ঈশ্বরকে ডাকতে আমারও লাগে না জাঁকজমক ওয়ালা কোন স্থান, আমার ঈশ্বর তো বাস করেন আমার হৃদয়ে- 


আমাদের প্রজন্ম সাক্ষী হল রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার। কি জানি কেন ধারণা ছিল ওসব দাঙ্গাহাঙ্গামা তো মিটে গেছে স্বাধীনতার সাথে সাথেই। সাদাকালো টিভিতে দেখা গান্ধী সিনেমা- যাতে ছিটেফোঁটাও অস্তিত্ব নেই আমাদের ঘরের ছেলে সুভাষ থুড়ি নেতাজীর। তাহলে আবার কেন? আবার কেন তিলজলা? আবার কেন কার্ফু? কেন সামান্য সময়ের কার্ফু শিথিল হওয়া আর আটার দোকানে  লম্বা লাইন? 


আমাদের প্রজন্মকে সাক্ষী রেখে পরপর বিস্ফোরণ ঘটে গেল বম্বেতে। গোটা চাটুজ্জে বাড়িতে সেদিন যেন শ্মশানের স্তব্ধতা। কোথায়? হোটেল- আপিস-পেট্রোল পাম্প-বাজার কোথায় নয়? কত? সরকারই বলছে আড়াইশ, আহত দেড় হাজার। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল দাউদের গন্ধ। শারজার গ্যালারিতে বসা, কালো রোদ চশমা পরা জনৈক ব্যক্তিই নাকি মূল খলনায়ক। আনন্দলোকের পাতা জুড়ে শুধু বড় বড় অভিনেতা অভিনেত্রীর পাশে তাঁর ছবি। গোছা গোছা সাফাই গাওন, “আরেঃ কোন পার্টিতে কে আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলল, তার মানে থোড়াই যে সে আমার ইয়ার?”


মাঝে কবে যেন টুক করে ভেঙে গেল সাবেকী সোভিয়েত রাশিয়া। স্বপ্নভঙ্গের যাতনায় সেরাত অভুক্ত রয়ে গেল বাবা আর জেঠু। বাঙালী উচ্চমণ্যতার অবসান ঘোষণা করে কবে যেন চলে গেলেন উৎপল দত্ত। দা ওয়ার্ল্ড দিজ উইকের পর্দায়  দাড়িওয়ালা প্রণয় রায়ের ভাষণে বসনিয়ার যুদ্ধ। এত বেশী মহিলা বিদ্বেষী যুদ্ধ আগে কখনও দেখেনি আমাদের প্রজন্ম। সম্মুখ সমরের পৌরুষ নয়, ধর্ষণই যেখানে মূল মন্ত্র। সারি সারি ধর্ষিতা প্রৌঢ়া, বৃদ্ধা রমণী- যৌন পরিতৃপ্তি নয়, রণকৌশল মাত্র। একে অপরের মনোবল ভঙ্গই যার একমাত্র উদ্দেশ্য।  


আর এই সব কিছু থেকে অনেক দূরে, স্বপ্নের জগতে বিচরণ রত আমরা- বাবা-মায়ের চিরপরিচিত নিরাপত্তা বলয়ের বাইরেও ঠাকুমা-পিসি এবং জেঠাইমা। ছবিতে জেঠাইমার সাথে আমি আর মুনাই। মুনাই ওরফে সহেলী আমার একমাত্র বোনঝি। দিদিভাইয়ের প্রাণাধিকা তনয়া। ছবিটা ওর দেওয়াল থেকেই ধার করা। চিত্রসৌজন্য নির্ঘাত জেঠু।  ভাবতেই পারি না, মাঝের ভদ্রমহিলা আজ শুধু স্মৃতি মাত্র। আগামী রবিবারের মধ্যে সম্পন্ন হয়ে যাবে তাঁর যাবতীয় পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম।  আজও তো চোখ বুঝলেই দেখতে পাই, জেঠাইমার ঘরের জার্মান বাফ রঙা দেওয়াল, উত্তরদিকে তিনটে প্রমাণ সাইজ খড়খড়ি ওয়ালা সবুজ রঙা জানালা আর দক্ষিণে দরজার দুপাশে দুটো। মেঝের রঙ ছিল চকচকে লাল। আসবাব সামান্য, একটি প্রমাণ সাইজের দেরাজ, যার মাথার ওপর ঠাকুরদার মৃত ছোটবোনের নাম খোদাই করা-“পিকোরাণী। ” কি যেন ব্যামো অকালেই কেড়ে নিয়েছিল কিশোরী  পিকোরাণীর জীবন। তারপাশে কাঠের টেবিলে রাখা একটি বিশাল আয়না, যার সামনে থরে থরে সাজানো প্রসাধন দ্রব্য। বড় শৌখিন ছিল জেঠু। ওসব তারই। জ্যাঠাইমা জীবনেও স্পর্শ করেনি ওসব। সামান্য ট্যালকম পাউডার আর ধ্যাবড়া টিপই ছিল সম্বৎসরের  সঙ্গী। আর শীতে মামুলী বসন্ত মালতি। কতবার যে ৫০১বার দিয়ে জামাকাপড় কাচার ফাঁকে ঐ সাবান দিয়েই মুখ ধুতে দেখেছি জ্যাঠাইমাকে তার ইয়ত্তা নেই।  এতদসত্ত্বেও ছিটেফোঁটাও টসকায়নি তাঁর রূপ। জীবনের শেষ মূহূর্তেও গায়ের রঙ ছিল পাকা আমূল মাখনের মত। অথচ এই ভদ্রমহিলা দাবী করতেন ওণার গাত্রবর্ণ নাকি,“শ্যাম-শ্যাম”। কত যে গলার শিরা ফুলিয়ে ঝগড়া করেছি ওণার সাথে, আজ প্রতিমূহূর্তে বারবার মনে হচ্ছে একটাই কথা- আরেকবার ফিরে এস জ্যাঠাইমা। যা খুশি হোক তোমার গায়ের রঙ, কোন প্রতিবাদ করব না দেখো-


https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10222475603186066&id=1449214651

অনির ডাইরি, ১৮ই ডিসেম্বর, ২০২০

 


“বাবা একটা পেন্সিল এনো তো” ডাইনিং টেবিল থেকে গলা উঁচু করে বলছে তুত্তুরী। একটা মানে এক বাক্স। ও এমনি বলে। মামমাম- দাদুর রূপকথার জগৎ থেকে যখন উপড়ে নিয়ে এসেছিলাম আমাদের লাল নীল সংসারে, প্রথম সপ্তাহেই চারতলার বারন্দা থেকে এক পাটি হাওয়াই চপ্পল নীচে ফেলে দিয়েছিল বছর সাড়ে তিনের তুত্তুরী। নাঃ এক্কেবারে মাটিতে পড়েনি, পড়েছিল একতলার অধিবাসীর সান শেডের মাথায়। দোতলার বারন্দা থেকে লাঠি গলিয়ে তাকে দিব্যি তুলে আনা যেত, কিন্তু দোতলার ঐ ফ্ল্যাটের অধিবাসী ভিনদেশে পরবাসী। ফলতঃ অতীব বিরক্ত হয়ে যখন কিনে আনলাম নতুন হাওয়াই চপ্পল, তুত্তুরী অবাক হয়ে বলেছিল,“দুটো আনলি কেন মা? একটা তো আছে-”।  তখন তুইতোকারি করত তুত্তুরী ওর বাবাকে আর আমাকে। শৌভিক বড় ভালোবাসত ঐ সম্বোধন, কিন্তু সমাজের ভয়ে পাল্টাতে বাধ্য করেছিলাম মেয়েকে। আজ খুব আফশোস হয় সেই দিনগুলো, সেই ছোট্ট তুত্তুরীর কথা ভাবলে। 


একবার ডেট পেরিয়ে যাওয়া জনসন শ্যাম্পু খেয়ে নিয়েছিল তুত্তুরী। সে কি কাণ্ড। বাপরেঃ। তখনও চার বছর পুরো হয়নি। সন্ধ্যা বেলা। সদ্য আপিস থেকে ফিরেই দেখি লোড শেডিং। তখনও জেনারেটর বসেনি আমাদের আবাসনে, মোমবাতিই ভরসা এবং মোমবাতি বাড়ন্ত। একখান মোমবাতি জ্বালিয়ে ডাইনিং রুমে বসে দরদর করে ঘামছি, মাঝে মাঝে মাসি ঐ মোমবাতিটাই নিয়ে যাচ্ছে রান্নাঘরে চা বানাতে। উল্টো দিকের চেয়ারে বসে ঠ্যাং দোলাচ্ছিল তুত্তুরী, আচমকা কখন অন্ধকারে পেঁচো মাতালের মত ঠাকুর ঘরে ঢুকে টুক করে এক ছিপি পচা বেবি শ্যাম্পু খেয়ে এসেছে কে জানে? দুম করে যখন আলো এল, ধাঁধিয়ে যাওয়া চোখ সামলে দেখি কন্যা মুখ দিয়ে ফুঃ ফুঃ করে বড় বড় বুদবুদ বানাচ্ছে এবং ওড়াচ্ছে। প্রাথমিক ভাবে মাথাতেই আসেনি কি করব এই হাড় বজ্জাত মেয়েটাকে নিয়ে। খাবার মত আর কিছুই কি পেলি না বাপ তুই? শৌভিক তখনও বিডিও, আবাস সুদূর দক্ষিণ ২৪পরগণার উস্তি। বাড়ির কর্তাগিন্নী সবই আমি। ফোন করলাম, বেজে গেল। অগতির গতি সেই আমার বাপ। প্রাথমিক হাউমাউ থামিয়ে সব শুনে তিনি ফরমান দিলেন গলায় আঙুল দিয়ে বমি করা। সদ্য খেয়েছে বোঝাই যায়। কাকে বমি করাব? তিনি তো মুখ খুলতেই চাননা। জবরদস্তি হাঁ করিয়ে, তিনবার কামড় খেয়ে বমি করাতে গিয়ে নখে হাল্কা চিরে গিয়েছিল তুত্তুরীর গলা। আমি কাঁদছিলাম মেয়ে বাঁচবে কি না এই আতঙ্কে, আর মেয়ে কাঁদছিল চিরে যাওয়া গলা আর মুখ দিয়ে আর বুদবুদ না বার করতে পারার দুঃখে- 


“বাবা ডমের পেন্সিল আনবে, ওগুলোর পিছনে রাবার থাকে, খুব সুবিধে হয়। ”পুনরায় চিৎকার করছে তুত্তুরী। এতক্ষণ গুণগুণ করছিল, দিবারাত্র দুর্গা স্তোত্র গায় তুত্তুরী। আমার অনবধানতার সুযোগে অথবা বাবাকে পটিয়ে মোবাইল পেলেই দুর্গা- কালী- ছিন্নমস্তার ভিডিও দেখে তুত্তুরী। তারপর তাই নিয়ে চলে দাদুর সাথে গোপন আলাপচারিতা। ঠাম্মা দাদু অর্থাৎ শ্বশুরমশাইকেও শোনাতে চায় তুত্তুরী, তবে ভদ্রলোক চিরকেলে অধার্মিক, ওসব ধর্ম কথা শোনাতে গেলেই উল্টে স্যামসন আর ডিলাইলার গল্প শোনান। অথবা শোনান স্পার্টাকাসের উপাখ্যান, পরিণাম? দিনান্তে নৈমিত্তিক দুর্গা-কালীচরিতের পাশাপাশি ঐ গল্পগুলোও শুনতে হয় আমার বুড়ো বাপটাকে। দাদু হওয়া কি মুখের কথা!


শৌভিকের দৃঢ় ধারণা, বাবা তুত্তুরীর সবকথা শোনে না। এত অত্যাচার আশি বছুরে হাড়ে সইবে না, বাবা নির্ঘাত ফোনটা টেবিলে রেখে ঘুরে বেড়ায় বা কাজকর্ম করে। এত সহজে যদি ছাড় পাওয়া যেত তাহলে তো মিটেই যেত, বাবা শোনে। ধৈর্য ধরেই শোনে, মাঝে মাঝে কিছু বলে, তুত্তুরী ভুল বললে সংশোধন করিয়ে দেয়। তাতে অনেক সময় হিতে বিপরীতও হয় বটে। মনের অমিল হলেই রেগে গিয়ে ঘ্যাঁচ করে ফোন কেটে দেয় তুত্তুরী। 


বেচারা মামমাম, তাঁর জগৎটাই তুত্তুরীকে ঘিরে অথচ তাঁর জন্য বরাদ্দ মিনিট দুয়েক কেবল। তুত্তুরীর প্রতি মামমামের স্নেহ প্রায় স্বর্গীয় বিদ্যাসাগর রচিত গোপালের মাসির তুল্য। সেই যে মাসির কান কামড়ে দিয়েছিল গোপাল, কবে যে তুত্তুরী অমন কামড়াবে সেই অপেক্ষায় বসে আছি। কামড়ানোই উচিৎ। ফোন করলেই খালি তুত্তুরীর খবর নেয় মা। তুত্তুরীর শতেক গলতিতেও কোনদিন দোষ দেখে না মা। ছুটির দুপুরে সাধের ভাতঘুম দিয়ে উঠে দেখি দপ্তরী মোবাইলটা ভাঙা -কে ভেঙেছে তাই নিয়ে তদন্ত কমিশন বসানো নিষ্প্রয়োজন কারণ হত্যাকারী ভাঙা মোবাইলে কাঁচে হাত কেটেছেন- অন্তত তিনি তাই দাবী করছেন বটে। সেই কাটা দেখতে অবশ্যি রীতিমত অণুবীক্ষণ যন্ত্র প্রয়োজন। এমন খবরেও কোন হেলদোল থাকে মায়ের? মনখারাপী সুরে নালিশ করার পর মায়ের প্রথম প্রতিক্রিয়া হল,“আহারেঃ ওর হাত কেটে গেছে? খেয়াল রাখবি তো?” অতঃপর,“ ওকে এত দামী মোবাইল দিসই বা কেন বাবা? সব দোষ তোর। পড়াশোনার জন্য যদি দিলি তো খাটে বসিয়ে দিবি তো?” ধেড়ে মেয়েকে আমি খাটে বসিয়ে মোবাইল ধরাব? তাও নিদ্রিত অবস্থায়? বিরক্তি প্রকাশ করলে উল্টো দিক থেকে ভেসে আসে ক্রুদ্ধ স্বর এবং ঘ্যাঁচ করে কাটা হয় ফোন। বেশ বুঝতে পারি, মতের অমিল হলেই ফোন কাটার বদভ্যাসটা আমার কন্যা কোথা থেকে পেয়েছে। 


আর একটা জিনিসও মায়ের থেকে পেয়েছে তুত্তুরী, হুট কথায় গঙ্গাযমুনা বইয়ে দেওয়া। আজই যেমন, “তুমি মামমামকে কেন বকলে, ওহো হো” করে হাপুস নয়নে কাঁদছিল তুত্তুরী। যত বলি বকিনি তো, বলেছি যা বলার জলদি বলো, আপিস বেরোতে দেরী হয়ে যাচ্ছে। একটু থিতু হয়েই আবার ফোন করব মামমাকে, শোনে কে? “তুমি সবাইকে বকো। বাড়িতে- মামমামকে- অফিসে ও হো হো”। বোঝ কাণ্ড আমার আপিসে আমি কাকে বকব আর কাকে হামি খাবো সেটাও কি আমার কন্যা ঠিক করে দেবে নাকি? দেরী ভুলে কিছু বোঝাতে গেলাম শৌভিকের মুচকি মুচকি হাসি দেখে থমকে গেলাম। বর বলল, “এই হাপুস নয়নে কাঁদাটা একদম তোর মত”। যেটা বলতে পারলাম না সেটা হল,মোটেই অমন করুণ সুরে কাঁদি না আমি। বা হয়তো কিছুটা কাঁদি, কারণ আমার শরীরেও তো সুদূর মুর্শিদাবাদের রামনগর গাঁয়ের ঘোষ বাড়ির রক্ত আছে। মায়ের থেকে আমি হয়ে তুত্তুরীর মধ্যেও সেই জিন, জিনদৈত্য হয়ে বেঁচে আছে। 


বেঁচে থাকুক জিনদৈত্য, এমনি আক্খুটে থাকুক তুত্তুরী,এমনি স্নেহে অন্ধ থাকুক মা, একটু গপ্পে বুড়ো হয়েই বেঁচে থাকুক বাবা আর এমনি নীতি শিক্ষা দিয়ে যান শ্বশুরমশাই।  আজকের প্রতিটা মুহূর্তই তো কাল নিখাদ ইতিহাস। আর ইতিহাস যত রঙীন হয়, ততোই তো ভালো।  আজ সকালেই বলছিল এক ফুলওয়ালী বন্ধু, হোয়াটস্অ্যাপে যার স্টেটাস দেখার জন্য মুখিয়ে থাকি আমি, যার একচিলতে বারন্দায় বিরাজ করে চিরবসন্ত। পিটুনিয়া, গেজেনিয়া, প্যানজি, ডায়ান্থাস নামগুলো তো ওর থেকেই শেখা। ফুল ছাড়া যেটা লাগায় ওর দুলালীর গুচ্ছ গুচ্ছ ছবি। এখনকার তন্বী,রূপসী কন্যা নয়, বরং শৈশবের গাল ফোলা, আলুভাতে মার্কা মেয়ের ছবি লাগায় ওর মা। সেই প্রসঙ্গেই বলছিল,  “ছোট্ট মেয়েটাকে ভীষণ মিস করি যে, ছেলেমেয়েগুলো বড় হঠাৎ করে বড় হয়ে যায়। ” আরো না হয় একটু এমনি থাকুক সবকিছু। ফুসফুসে ভরেনি আরেকটু ভালোবাসা।