Monday 9 March 2020

অনির ডাইরি ৯ই মার্চ, ২০২০


“সখী ভালোবাসা কারে কয়-”
কি যেন বলেছিলি চৈ, সবথেকে ফুটফেটে চাঁদ ওঠে দোল পূর্ণিমায়? রাত বেশ গভীর, শুনশান তোদের গলি, দিনভর রঙ খেলে ক্লান্ত শহরটা বুঝি ঝিমোচ্ছে। ভ্যানিশ রাস্তার সারমেয় কুলও।  সিদ্ধি মেশানো ঠাণ্ডাইয়ের হিমেল পরশ মিহি জোছনার মত ছড়িয়ে পড়ছিল চিন্তা ও চেতনায়। তুই আর অন্তু এগিয়ে দিতে এলি বড় রাস্তা অবধি, পথে ঝপ্ করে নিভে গেল ইলেকট্রিক বাতি, চাঁদের সুষমায়  পলকে রূপালী পাঁচশ বছর পার করা শহরটা।

“ চাঁদ উঠেছিল গগনে-”

দেড়শ বছরের বুড়ো বাড়িটা  চাঁদের আলোয় যেন চুনকাম করা।গ্রীল, বন্ধ কাঁচপাল্লার ভিতর দিয়ে জবরদস্তি ঢুকে আসছে চাঁদনি। ঠাকুমার বিয়ের বার্মাটিকের নকশি পালঙ্কের ওপর খবরের কাগজ বিছিয়ে বসেছে আসর। অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচি ভরা এলাচ গন্ধী ঘণ দুধ, ঠাণ্ডাই, কালাকাঁদ, সিদ্ধি, চিপস্, চানাচুর, ক্যাডবেরি, কোল্ড ড্রিঙ্কস্। একতলায় উদ্বিগ্ন  মা, সিদ্ধি অবধি ঠিক ছিল-চিপস্-কোল্ড ড্রিঙ্কস্ আবার কেন? দুধ সয় না অন্তুর। সিদ্ধিও না। নেশা করার বিলাসিতা ওর পোষাবে না। বাড়ি গিয়ে রান্না বসাতে হবে। আজ কত মাস কেটে গেল, শয্যাশায়ী ওর মা। পিঠে গভীর শয্যা ক্ষত। সেরে গিয়েছিল। গজিয়েছিল নতুন চামড়া, আয়া দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় ঘষে উঠে গেছে কচি চামড়া। কাকিমা চিৎকার করে ওঠেননি? চোখ দিয়ে জল বেরোয়নি? প্রশ্ন করলে, জলে ভরে ওঠে দুই চোখ, মাথা নাড়ে অন্তু। “না রে। মা কিছু বলে না-”।
কি সিদ্ধি আনলি চৈতালী? নেশাই তো ধরে না। মাথা চুলকেই যায় চৈতালী, “বললাম, শ্লা-। ভালো সিদ্ধি দেবেন-। চাটুতে বেশ করে নেড়ে আনলাম-”। উপুড় করা জোছনায়, গান ধরে সঞ্চিতা। “ এখন আমার বেলা নাহি আর, বহিব একাকী বিরহের ভার--. ”। কান খাড়া করে শুনি আমরা, এরপর কি? রবি না রোদ্দুর?অঙ্গে অঙ্গে হাল্কা ঝিমঝিমানি, হৃদয়ে মথিত প্রেম- নাকে ভেসে আসে ধুনোর মিষ্টি সুবাস। অস্মি আকাশের দিকে তাকিয়ে ব্যগ্র হয়ে খোঁজে, মাথার ফুটফুটে চাঁদ-

“যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভোলে না মোরে-”

দোলের সকাল, ধপধপে সাদা পাঞ্জাবি পরে প্রস্তুত বুল্লু। তুত্তুরীর লাল রঙ চটা গেঞ্জি আর নীল তারা ছাপ বিবর্ণ ফুল প্যান্ট না পসন্দ। পিতলের রেকাবিতে চুড়ো চুড়ো করে সাজানো ছয় সাত রঙের আবির। চাটুজ্জে বাড়ির দস্তুর, প্রথম আবির পড়বে কুলদেবীর পায়ে। তাঁকে তো সরস্বতী নদীতে বিসজর্ন দিয়ে এসেছিলেন প্রপিতামহের বিধবা জননী। মড়ক লেগেছিল দেবানন্দপুরে। বাড়ির সমর্থ পুরুষগুলো ঝরে গেল অকালে। বিধবা গোলাপসুন্দরী তীব্র অর্থাভাবে কয়েকমাস থোড় সিদ্ধ দিয়ে উপাসনা করেছিলেন অষ্টভূজা কুলদেবীর। তারপর-।
মায়ের কুলুঙ্গী, যাকে বাবা বলে, “ঠাকুরের কাছারি বাড়ি” তথা বাড়ি জোড়া ঝুলন্ত ক্যালেণ্ডারে আসীন গুচ্ছ গুচ্ছ ঈশ্বরের চরণযুগল আবিররঞ্জিত করার পর, আবির পড়ে বয়সানুপাতে গুরুজনদের পাদপদ্মে। “দিদি কই?” সম্পর্কে তো বাবার দিদি, তবে তিন প্রজন্ম ধরে সবাই ডাকি দিদি। তিন প্রজন্মের লালন-পালন যে তাঁরই হাতে।চাটুজ্জে বাড়ি যে অন্ধকার তাঁকে ছাড়া।
পূবের ঘরে বন্দী দিদি। জানুয়ারীর শুরু থেকে অসাড় শরীরের ডান দিকে সবে জাগছে সাড়া। নিজে নিজেই উঠে বসতে পারে আজকাল। খানিকটা হলেও বাড়িয়ে দিতে পারে ডান হাত। হাত ধরলে পায়ের পর পা ফেলে পারে হাঁটতেও, যদিও ভাইদের প্রবল ধমকানির পর। আজও যেমন বড় ভাই বলল, “দাঁড়া দিদি নামবে। আমরা উঠব না। ”
কই গো দিদি নামো। বেলা মধ্যাহ্ন গড়িয়ে যায় অপরাহ্নের পথে। তুত্তুরী আর বুল্লুর মাথায় মুখে খেলা করে রঙবেরঙের আবির। কোথা থেকে এক আবির পিচকারি জোগাড় করে ভসভস্ করে আবির ছিটোয় ডাম্পি। পলকে ময়দান সাফ। এক বালতি জলে ভেসে বেড়ায় শুকনো পলাশ। জলের রঙ গড়ায় হলুদ থেকে লালের দিকে। অন্য বালতিতে গোলা হয় সবুজ রঙ। “মাখাবি না। মাখাবি না” করে অনর্থক চিৎকার করে মা। লাল-নীল-কমলা-হলুদে ভরে ওঠে মায়ের মুখ। গোলাপী শাড়িতে ফোটে লাল সবুজের ফোঁটা। বিনা আপত্তিতে রঙ মাখে বাবা।
দূর ছাই বলে দৌড়ই পূব-দখিন মুখো ঘরের দিকে। বিছানায় পরিপাটি করে শাড়ি পরে বসে আছে দিদি। অনেকদিন বাদে পরল। সৌজন্য আয়া মাসি। বাড়িয়ে দেওয়া গাঢ় সবুজ হাত ধরে পা ফেলে দিদি। পিছনে চিৎকার করে ডাম্পি, “ছেড়ে দাও ঝুনুদি। দিদি একা নামো। ” ডাম্পির চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার করতে করতে কখন যেন নেমে আসে দিদি। কুচো দুটো প্রস্তুত ছিল রঙের ডালি নিয়ে। পলকে খুনখারাবি। হাঁপাতে হাঁপাতে সোফায় বসে দিদি। বাবা শুরু করে, না জানি কোন মান্ধাতা আমলের বস্তাপচা গল্প। আপত্তি জানাতে যাওয়া মুখের ওপর হাত চাপা দেয় চৈতি, “ছেড়ে দাও দিভাই। দিদি এই গল্প গুলোকে খুব মিস করে। ” অতীত আঁকড়ে বেঁচে থাকা পঁচাশি বছরের পিসির সাথে পর্যায়ক্রমে ছবি তোলার হুজুক পড়ে যায়। এবার আমার পালা, মা বলে ওঠে, “যত বয়স বাড়ছে, ধিঙ্গিপনাও বাড়ছে মেয়েটার। ” কাঁপা কাঁপা হাতে সবুজ হাতটা চেপে ধরে পিসি, আদরের ছলে ফিসফিস করে বলে ওঠে “আমায় যেন ভুলিস না ঝুনু ”। আর ধিঙ্গি মেয়েটা? মনে মনে বলে, “কভি নেহি। কভি ভি নেহি। ” শুধু অসভ্য চোখটা কেন যে বারে বারে করকর করে ওঠে-

Wednesday 4 March 2020

অনির ডাইরি ৪ঠা মার্চ, ২০২০


মুখ লাল করে ঢুকেছিল নির্মল। সঙ্গী জনৈক প্রৌঢ় আর একটি চ্যাংড়া। প্রৌঢ়র বয়স বছর পঞ্চাশ, দোহারা খেটে খাওয়া চেহারা, হাতে একটি বাজার ব্যাগ, পরম সঙ্কোচে পিছনে লুকানো। চ্যাংড়ার গায়ে বর্ণময় পাঞ্জাবি।  ভাবহাব পুরো উঠতি নেতা মাফিক। ছোকরা মুখ খোলার আগেই, নির্মল পরিচয় করিয়ে দিল, “ইনি ইমদাদ হোসেন (সব নাম বদলে দিলাম)।  সেই যে ইসমত বিবির কেসটা-”।
কেস। মানে বেনিফিট। পেলে কারো পদধূলি ছাড়ুন, ছায়াও পরে না, এই তুচ্ছ শ্রম দপ্তরে। না পেলেই বাড়ে গোল। ইসমত বিবির কি কেস, প্রশ্ন করতে গিয়েও করলাম না। মনে পড়ে গেল ঝপ করে। আরে ইনি তো আগেও এসেছিলেন। ওণার বিবিজানের অকাল প্রয়াণের পর, প্রাপ্য অনুদানের তদ্বির করতে। নামের গড়বড়ের জন্য, আমাদের পূর্ণ সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পোর্টাল কিছুতেই অনুমোদন দেবার অনুমতি দিচ্ছে না। নির্মলই নিয়ে এসেছিল আগেরবার। ইমদাদ বাবু করজোড়ে অনুরোধ করেছিলেন, “টাকাটা পেলে বড় উবগার হয় দিদি। মেয়ের বিয়ে দিতাম-”।  সেদিন কত্ত কথা হয়েছিল, “কেন বিয়ে দেবেন? পড়ান।” উনি কপাল চাপড়ে বারবার বলছিলেন, “কাকে পড়াব দিদি? সে তো কলেজে ভর্তি হয়েও গেল না। মাটাও মরে গেল-।  বাড়িতে দেখাশোনার কেউ নেই। কেউ নেই দিদি আমার। বড়ছেলেটার চোখে যে কি হয়েছে, ভালো দেখতে পায় না। কত ডাগতার দেখালাম। কলকাতাও নিয়ে গেলাম। কিচ্ছু হল না। মেয়েটারও দেখছি, চোখটা কেমন যেন করছে-।  ভয় লাগে দিদি। ” খুব বকেছিলাম সেদিন। মেয়েটার চোখ খারাপ হবার আগেই পরের ঘরে পাঠাতে চাও? যাক শত্রু পরের ঘরে? তারপর? তাদের যদি না পসন্দ হয়? মন উঠে যায়? তখন ও কি করবে সারা জীবন। তারথেকে, নিজের পায়ে দাঁড়াক। নিজের শর্তে বাঁচুক। যাই বলি,একটি কথাই বারবার ঘুরে ফিরে বলছিলেন উনি, “আমার কেউ নেই দিদি। কেউ নেই। বিবিজান নেই, আমার ঘর ফাঁকা-। ”
তারপর অবশ্য কেটে গেছে বেশ কয়েকটা দিন। গতকালও অনুমোদন দেবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। তাই কি নেতা ধরে এনেছেন? কে যে কাকে ধরেছে জানি না। ছোকরার বক্তব্য খুব পরিষ্কার, বিশেষ সম্প্রদায়ভুক্ত বেনিফিশিয়ারি বলেই গা নেই সরকারী দপ্তরের। অমুক কমিশনের গুঁতো না খেলে, হবেও না চাচার কাজটা-।
চাচার কাজ এমনিও হচ্ছে না। হবে কি করে? হোসেন বানান তিন জায়গায় লেখা তিন রকম। পর্যায়ক্রমে Hossain, Hussain এবং Hosen। এই জট কাটাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি কদিন ধরে। পর্যায়ক্রমে হেড অফিস- সফ্টওয়ার ডেভেলাপার আর আমাদের অফিস। দিন দুয়েক আগেও ডেভেলাপার টিম বলেছে, আপনি দায়িত্ব নিয়ে লিখে দিন, হোসেন এবং হুসেন একই ব্যক্তি। ইনিই মরহুম বিবিজানের খসম। লিখে দিতে সর্বদা প্রস্তুত। লিখব কিসের উপর ভিত্তি করে? অগত্যা প্রৌঢ়ের কি কি কাগজ আছে, সব দেখতে চেয়েছিলাম আমরা। ক্যাক্যা ছিছি মার্কা কাগজ নয়। মামুলী ভোটার-আধার-ব্যাঙ্কের কাগজ। কাগজ চাওয়ার পরিণামেই এই চাপানউতোর।
এসব ক্ষেত্রে যা করি, যার জন্য আমি রীতিমত সুপ্রসিদ্ধ। নেতামশাইকে সেই অভ্যর্থনাই দিলাম। আমার অফিসে এসে হিঁদু-মোছলমান করা? আজ সকালেই এই কারণে এক সবজান্তা জ্ঞানবৃদ্ধকে  দূর দূর করে তাড়িয়েছি। অনবধানতা বশতঃ টাকা সমেত একটি পুরোনো ব্যাগ সেলাই করতে পাঠিয়েছিলাম, অফিস পাড়ার বুড়ো চর্মকারের কাছে। দিন তিনেক ব্যাগটা পড়েছিল সেকশনে। তারপর ধীমান তাকে বগলদাবা করে নিয়ে গিয়ে দিয়ে এসেছে চাচার কাছে। পরের দিন আনতে গিয়ে, চাচার ধমক খেয়েছে। “ক্যা রে? তোদের ম্যাডাম কুছু দেখে না? আপিস চালায় কেমন করে? অ্যাঁ?” ব্যাগের মধ্যে ছেঁড়া খামে মোড়া এক তাড়া একশ টাকার নোট। আর দুটি সাবেকী পাঁচশ আর হাজার টাকার বাতিল নোট। প্রথম মুখদর্শনের পর পেয়েছিল তুত্তুরী। যাঁরা দিয়েছিলেন অনেকেই আজ নেই এই পৃথিবীতে। নোট বন্দীর সময় বুড়ো দাদু আর মামমাম ছোটাছুটি করে জমা করেছিল সব বাতিল নোট। পরম যত্নে তুলে রাখা, তুত্তুরীর পাওয়া টাকার মধ্যেও যে লুকিয়ে ছিল দুইটি নোট, খেয়াল করেনি কেউ। যেদিন জানা গেল, প্রবল দাম্পত্য অশান্তি হল দাদু আর মামমামের।  অতঃপর টাকার প্যাকেটটা গছানো হল মামমামের মেয়েকে। তুই যত্ন করে রাখিস।

রেখেছিল তুত্তুরীর মা। ছেঁড়া ব্যাগে। রেখে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। ফেলে যে দেয়নি ব্যাগটাকে, এই তুত্তুরীর সৌভাগ্য। দরজার পিছনে অ-ন-এ-এ-ক দিন কালি ঝুলি মেখে ঝুলত ব্যাগটা। বাড়ির সামনেই বসে চর্মকার, তবুও সারিয়ে উঠতে পারেনি মা। শেষ পর্যন্ত ধীমান মামার ঘাড়ে চেপে চাচার কাছে যাওয়া এবং নোটগুলির পুনরাবিষ্কার। ধীমান যখন শোনাচ্ছিল চাচার গল্প, ঘরে উপস্থিত ছিলেন লোকটি। এসেছিলেন শ্রম আইন সম্পর্কে কয়েকটি প্রশ্ন করতে, টাকা পাবার উত্তেজনায় নাকি চাচার ধমকের উত্তাপে,  মিটিংএর মাঝেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে এসেছিল ধীমান।  বিনা আমন্ত্রণে নাক গলিয়ে বলে উঠেছিলেন, “লোকটা মুসলমান তো। কিন্তু কি ভালো।” সকাল থেকেই গরম ছিল তুত্তুরীর মায়ের মটকা। টুইটার জুড়ে “দেশ কে গদ্দারো কো-” দেখতে দেখতে জন্মেছিল ধিৎকার- তাহলে কি এমন কেউ নেই, যারা আমাদের মতে বিশ্বাসী? নাকি তারা টুইটারে নেই।  পলকে ফেটে পড়েছিলাম লোকটার ওপর। আমার আপিসে হিঁদু মোছলমান করতে এলে কপালে দুঃখ আছে।  একই কথা বললাম উঠতি ছাগল দাড়িকে। নেতাগিরি নিজের মহল্লায় দেখাবে। এখানে মস্তানি করতে এসো না বাছাধন।পরের মস্তানি বরদাস্ত হয় না তেমন। ফোটো।

বৃদ্ধকে বসিয়ে জানতে চাইলাম, “হ্যাঁ গো, আপনি একেক জায়গায় একেক নামের বানান লিখেছেন কেন? মুসলিম বেনিফিশিয়ারি হলে, এই সমস্যাটা কিছুটা হয়, কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে তো মাত্রাছাড়া। সবাইকে ঘোল খাইয়ে আবার ছাগল দাড়ি ধরে আনা। সসঙ্কোচে জানালেন, “আমি তো ইংরেজি জানি না দিদি। যা নামের বানান, তাই বলি, ওণারা ইংরেজিতে কি লিখে দেয়-”।  হোসেন-হুসেনের জাল কাটিয়ে বাড়ি ফিরলাম সেদিন। বারবার অনুরোধ করলাম সফ্টওয়ার টিমকে, প্লিজ করে দিন। নেতামশাই নেতা হয়ত চান- উত্তপ্ত পরিস্থিতির ফায়দা তুলতে। তবে বৃদ্ধের প্রয়োজনটা নিখাদ সত্য। এদিনও চোখ মুছতে মুছতে বললেন, “মেয়েটা কেমনি হয়ে যাচ্ছে দিদি। বিয়ে পাগল এক্কেবারে। ওর খালুর পরিচিত একটি ছেলে, সুরাতে থাকে, পাথর বসানোর কাজ শিখছে, তার সাথে বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। তাকে বিয়ে করার জন্য পাগল পুরো। আমি বড় একা দিদি। সারাদিন মাঠেঘাটে কাজ করি। বাড়িতে আমার কেউ নেই। ছেলেটা চোখে দেখে না ভালো। তাও কলকাতায় একটা কাজ পেয়েছে। মেয়েটাকে দুটো রান্না করে দিতে বলি- তাও করে না। বলে আপনার সংসার আপনি বোঝেন। আমি পারব না। ” বিয়েটাই যেন জীবনের মোক্ষ। ”
গতকাল আবার এসেছিলেন ইমদাদ চাচা। টাকা ঢুকে গেছে। সামনেই মেয়ের বিয়ের দাওয়াত। বিয়ে নাকি এর মধ্যে হয়ে গেছে। মেয়েটা ব্যাণ্ডেলে চাকরিও  পেয়েছে একটা ছোটখাট। হাজার দশ মাহিনা দেবে বলছে। বর সুরাত নিয়ে যেতে চায়। পাগলি মেয়ে এখন আর যেতে রাজি নয়। জানতে চাইলাম দেনমোহর কত? জবাব পেলাম ৪০০০/-। মাত্র চার হাজার? উনি অমায়িক হেসে বললেন, “চার হাজার টাকা, আমাদের ধর্মে অনেক দিদি। ” ধর্ম নিয়ে জ্ঞান সীমিত বটে, তবে বাজারদর নিয়ে তো নয়। চার হাজার আবার অনেক টাকা কেমনে হয় অ্যাঁ? আপনার দেনমোহর কত ছিল চাচা? চাচার দুই গালে লাগল আলতার ছোপ, “আজ থেকে সাতাশ বছর আগের কথা দিদি। হাজার টাকা দেনমোহর ছিল-”। বলতে গেলাম তবে? বলতে গেলাম অনেক কিছুই, পারলাম কই?ছলছলিয়ে উঠল প্রৌঢ়ের দুই আঁখি। ধরা গলায় প্রৌঢ় আবার বলে উঠল,“ আমার বাড়ি ফাঁকা করে চলে গেছে দিদি। বিবিজান নেই, আমারও আর কেউ নেই-”। 

অনির ডাইরি, ২৭শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০


এমন রৌদ্রকরোজ্জ্বল ঝলমলে দিন, প্রভাতী বাতাসে বাসন্তী ফুলেল সুবাসের সাথে মিঠে  হিমেল শিরশিরানি, তবু মন ঘিরেছে প্রগাঢ় বিষাদ। আর পাঁচজন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মতই, রাজধানীর জন্য ভারাক্রান্ত এ হৃদয়।  গোদের ওপর বিষফোঁড়া, তারওপর দিন কতক আগে, শখ করে সদস্য হয়েছিলাম এক গাছপালার গ্রুপের। বারন্দায় বাগিচা আমার নতুন প্রেম- বাড়িওয়ালার ক্ষুদ্র ফ্ল্যাটের পুঁচকে বারন্দায় ঠাসাঠাসি করে আসর জমিয়েছে গোলাপ-গাঁদা-পিটুনিয়া-বেলি-গন্ধরাজ। ফাঁকে ফোকরে ক্যাকটাস-ঘৃতকুমারী আর পয়সাপাতা। সাধের পাতাবাহার দুটি আপাততঃ নির্বাসিত কমন প্যাসেজে। দিন রাত প্রাণ চায়, আরো-আরো- আরো সবুজ হোক এ ধরা। এদিকে বাড়িওয়ালা ভয় দেখিয়ে রেখেছে আর একটিও যদি গাছ কিনি, উনি সটান কিনে আনবেন একটি ছাগল। সেদিন বললাম, ঘৃতকুমারী গাছটাকে একটু রোদে দিতে, জবাব পেলাম, “বারন্দা গলিয়ে নীচে ফেলে দিলে আরও ভালো রোদ পেতে পারে। দেবো কি?”
অগত্যা, দেখি, পরের সাজানো বাগানই দেখি, আর ভাবি-“তুমি অন্য কারো সঙ্গে বাঁধো ঘর। ”তো এহেন ভার্চুয়াল সবুজ স্বর্গে, দেখি কে যেন পোস্টিয়েছেন, এক খ্যাতনামা রাজনৈতিক ব্যক্তির ছবি। সাথে জ্বালাময়ী আবেগময় বক্তব্য, “হে হিন্দুদের ত্রাতা,মহাহিন্দু, আপামর বিশ্ব, বাঁশঝাড় আর জলবিছুটি নিয়ে তোমার পিছনে পড়েছে বটে, তবে নো চিন্তা। আমরা, তোমার ভক্তবৃন্দ আছি তো। থাকব তব” ইয়ে মানে, পিছনে আর কি। প্রথম চোটে বেশ বিরক্ত লেগেছিল মাইরি, রাজনৈতিক স্তাবকতার জন্য তো গুচ্ছ গুচ্ছ গ্রুপ- পেজ আছে। আছে নিজের দেওয়ালও। তাহলে এই গ্রুপে কেন বাপু?দিনান্তে বা দিনপ্রভাতে এইটুকুই তো অম্লজান পাই, এই ভার্চুয়াল জগৎ থেকে।  লিখতে গিয়ে দেখি, ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজন লিখে ফেলেছেন, একই কথা। হয়তো আরো অনেক সুচারু ভাষায়- অনেকে ঘোষণা করেছেন গ্রুপ ছাড়ারও কথা। হয়েছে হাল্কা বাদানুবাদ- পরিণামে যে কদর্য ভাষায় আক্রান্ত হয়েছেন তাঁরা, তার কিছুটা প্রত্যক্ষ ভাবে গায়ে লাগে বৈকি। এত রোষ,দ্বেষ, অবিশ্বাস, ঘৃণা, প্রতিহিংসা  এসব কি গৃহযুদ্ধের অশনিসঙ্কেত?
অশক্ত অসুস্থ মন চায় বসে থাকি ঘরের কোণায়, আঁকড়ে থাকি আপনজনদের। বন্ধ রাখি, জানলা-দরজা, চোখ আর কান। বন্ধ রাখি  বেতার-দূরদর্শন আর মুঠো ফোন। কিন্তু পেট শুনলে তো? তার যে বড় ক্ষুধা। পেটের ধান্ধায় বেরোতেই হয় রাস্তায়। পথে ঠকঠক করে ঢোকে সুকন্যার মেসেজ-  সপুত্র ফিরে যাচ্ছে কর্মস্থলে। হাওড়া স্টেশনে হচ্ছে ঘোষণা, “কিপ আ ওয়াচ অন ইয়োর লাগেজ-”। শোনা মাত্রই উটো বাবু, যাঁর ভালো নাম অর্ক, বলছে, “মা, মা,শিগ্গির। তোমার ঘড়িটা খুলে ব্যাগের ওপর রাখো। ” দিনের প্রথম হাসিতে, হাল্কা করে, হাল্কা হয় মনখারাপের বাদল।
জুতো পরছি, ছুট্টে এসে জড়িয়ে ধরল তুত্তুরী। আসন্ন বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে গতরাত থেকে প্রবল নিম্নচাপের আবহ বাড়িতে। একজন পরীক্ষায় রসগোল্লা-পান্তুয়া পাবেই, আরেকজন পেতে দেবে না। এই নিয়েই কলহ অশান্তি আর কি। সকাল থেকেও স্বল্পই ছিল মা-মেয়ের বার্তালাপ। মা বেরিয়ে যাওয়ার আনন্দ, তাই বোধহয় আজ তুরীয়। হাসি হাসি মুখে গল্প শুরু, “জানো মা, কাল একটা কাণ্ড ঘটেছে। আমাদের যে রুমে ক্লাশ হয়, সকালে ঐ ঘরে নার্সারি বসে। ওদের একটা বিচ্ছু ছেলেকে কাল ওদের মিস বাড়ি যেতে দেয়নি। আমরা ক্লাশে গিয়ে দেখি,একটা কুতুপুতু বাচ্ছা ছেলে রঙীন জামা পরে বসে বসে ঢুলছে। ওর কাল জন্মদিনও ছিল কি না। মৌমিতা ম্যাম যেই ঢুকেছেন, কি ভয় যে পেল ছেলেটা। মনে হল মাটিতে মিশে যাবে। ম্যাম বললেন, ‘একটা ইকোয়শন যদি করতে পার, আই’ল লেট উ লিভ। ’ ঋতমের ওপর ভার পড়ল ইকোয়শন দেবার। ঋতম লিখল ৭০†৪০=? ম্যাম বললেন, ‘লুক এট হিম। হি ইজ আ বেইবি। গিভ হিম সামথিং সিম্পল।’ আমায় ডাকলেন, মানে আমি হাত তুলেছিলাম তাই-। আমি দিলাম, ৭†৭=? ও তো তাও পারছিল না। বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঢুলছিল। তারপর গেল চকটা খেতে। আমি তড়িঘড়ি আঙুল নেড়ে দেখালাম ১০ আর ৪। ও কি করল জানো? ও খানিক মাথা চুলকে, বোর্ডে কয়েকটা আঙুলের ছবি এঁকে দিল-”। আর ম্যাম কি করল জানো? ম্যাম বলল, “ইয়েস। ইয়েস। রাইট। রাইট।  গো হোম চাইল্ড-”।  প্রবল হাসছিল তুত্তুরী। গতরাতের বিরক্তি আর আজ সকালের বিষাদ ভুলে হাসছিলাম আমিও। নাঃ রক্তবীজের উত্তরপুরুষরা যেমন আছে, তেমনি উটো আর তুত্তুরীও তো আছে। আছে তাদের সাঙ্গোপাঙ্গোরা। এরাই তো আমার সবুজ। এত সোজা বোধহয় হবে না খেলা এবং জেতা। চলো দেখাই যাক না-
পুনশ্চঃ ভেবেছিলাম একটা স্ক্রিনশট দেবো। বেলা গড়ানোর সাথে সাথে মনে হল, একজন অবয়বহীন ফেক অ্যাকাউন্টওয়ালীর কলুষিত কথাবার্তা, অনির দেওয়ালে থাকার যোগ্যতা নেই। কাজেই থাক।

Monday 24 February 2020

অনির ডাইরি, ২৪শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০

“মেঘ পিওনের ব্যাগের ভিতর মন খারাপের বস্তা”- সকালটাই কেমন যেন ভিজে ভিজে। টলটলিয়ে উঠছে আকাশের আঁখি, বড় অগছাল ঘরদুয়ার,থরে থরে পাট করে রাখা, সদ্য কাচা পশমী বস্ত্র, আলমারি খুললেই ওডোনীল আর ন্যাপথলিনের চেনা চেনা গন্ধে উঁকি মারে শৈশব, আলমারির লুকানো কোণা থেকে উঁকি মারা, লালচে জাব্দা পিচবোর্ডের বাক্স থেকে ভেসে আসে মনকেমনিয়া জুঁই ফুলের সুবাস। লাল ভেলভেটের অ্যালবামের পাতার পর পাতা জুড়ে, শুধুই সুখস্মৃতি। নতুন শাড়িতে আড়ষ্ঠ সদ্য শাঁখাপলা পরা নতুন বউ, টোপর পরা ছোকরা বরের কান এঁটো করা একগাল হাসি, কপাট বক্ষে লেপটে থাকা গায়ে হলুদের রঙ- তত্ত্বের ট্রেতে শোওয়ানো ঘোমটা দেওয়া এত্ত বড় কাতলার নাকে নথ- আঙুলের ফাঁক গলে ঝরে পড়া জলের মতই হারিয়ে যাচ্ছে সময়- রেখে যাচ্ছে শুধু একরাশ মনখারাপ।
“হেলো, আপনি সিএমও তে ফোন করেছিলেন-?” “কি? ছিএমো? কোথা থেকে বলছেন?” জিভ কেটে আবার বলি, “দিদিকে বলো’তে ফোন করেছিলেন?” ইতি তৃতীয় ব্যক্তি, বড় সাহেব লিস্ট পাঠিয়েছেন নব্বই জনের, ভাগ করে ফোন করছি আমরা, জানতে চাইছি কি সমস্যা, শ্রমদপ্তরের বিরুদ্ধে কি অভিযোগ। এর আগের দুই জন মোটেই খুশি হননি, আমাকে পেয়ে। ওনারা “দিদি”কে চান, কোন দিদি বলে দিতে হবে না আশা করি, সমস্যা অবশ্য তেমন গুরুতর ছিল না, একটি ছিল নিছক মা-মেয়ের চুলোচুলি, তাতে শ্রম দপ্তর কি করবে বুঝতে পারলাম না যদিও। দ্বিতীয় ব্যক্তি জানেনই না, কে নালিশ করেছে দিদির কাছে। ওনার কোন অভিযোগ নেই। তিন নম্বরকে ধরতে যাবার আগেই বাইরে থেকে আমাদের সঞ্চিতার প্রবল চিৎকার। জানতাম এটাই হবে।আমি নিজেও যথেষ্ট ভয়ে ভয়ে ফোন করছি,  মোবাইলে অচেনা মহিলার গলা পেলেই বাঙালী (অবাঙালী ও) পুরুষের হৃদয়ে প্রেমের সুড়সুড়ি লাগে। দৌড়ে এসে ফোনটা কেড়ে নিয়ে পিতৃসুল্ভ স্নেহে বোঝাতে লাগলেন আমাদের বর্মণ সাহেব। “এমন কি করতে আছে বাবা?” ডান হাতে- বাঁ হাতে ব্যাট করে চলেছেন ভদ্রলোক, একাই ৫৭ জনকে ফোন করে ফেলেছেন দিনের শেষে, তবে সে তো অনেক পরের কথা।
বেড়ে যায় বেলা, কাজের ফাঁকে ফোকরে আমি যাদের ফোন করি, হয় ফোন বন্ধ। নয় ধরে না। দম নিতে বারন্দায় যাই, ওল্ড কালেক্টরেটের সুবিশাল ঝুল বারন্দা, হাজি মহম্মদ মহসিন সাহেবের আস্তাবল ছিল নাকি, কেউ বা বলে গোরাদের সৈন্য ব্যারাক। আপিসের সামনের চেয়ার দখল করেছে যেন কারা, এক কোঁচর মুড়ি কোলে এক বয়স্ক মানুষ, সামনে দাঁড়িয়ে দুটো ছোট ছোট বাচ্ছা, সামান্য আবডালের প্রচেষ্টা মাত্র, খোসা সমেত শসা আর মুড়ি চিবোচ্ছে তিনজনায়। অপরিসীম সারল্য মাখামাখি বাচ্ছা দুটোর মুখ। ছোটটা হঠাৎ বাড়িয়ে দেয়, আধ খাওয়া কচি শসাটা। “এই” বলে ধমকে ওঠে, দেবু, পিছনের বার কামরায় বসেন বার জন অফিসার, দেবু তাদের সবেধন নীলমণি একটিই মাত্র পিওন। সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “এরা কোর্টে এসেছে ম্যাডাম। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে, বাচ্ছা দুটোকে নিয়ে, তাই আপনাদের চেয়ারে বসতে বলেছি।“
সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে বৃদ্ধ, উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করেন, আশ্বস্ত করতে জানতে চাই, “কোর্টে কেন গো? আর এই বাচ্ছা দুটোকে এনেছেন কেন?” ছোটটা সামান্য প্রশ্রয় পেয়ে এগিয়ে আসে আধ খাওয়া শসা নিয়ে, মাথা নেড়ে জানাই খাব না বাবা, তুই খা। বৃদ্ধের চোখটা বোধহয় সামান্য চকচকিয়ে ওঠে, “এই টুকুন বাচ্ছা, কতদিন হয়ে গেল মাকে ছেড়ে আছে। আজ ওর মাকে কাঠগড়ায় তুলবে, তাই নিয়ে এয়েছি—“ দীর্ঘ অস্বস্তিকর নীরবতার পর, “বাড়িতে তো আর তেমন কেউ নেই--।“ বাচ্ছা দুটোর নিষ্পাপ চোখের দিকের তাকিয়ে প্রশ্ন করতে পারলাম না, কি এমন করেছে ওদের মা। শুনলাম, খুনের দায়ে জেল খাটছে মেয়েটি। মাছ কাটা বটি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে খুন করেছে সোয়ামীকে। “বাড়ির অমতে, পালিয়ে গিয়ে  ভাবের বিয়ে। বিয়ের পর জানতে পারে, আগের পক্ষের এক খানি জ্বলজ্যান্ত বউ আর চার-চারটে বাচ্ছা আছে লোকটার। ভাত দেবার ভাতার নয় কিল মারবার গোঁসাই ছিল গো বরটা, দুদুটো ছোট বাচ্ছার পেট ভরানোর জন্য বাজারে মাছ বিক্রি করত মেয়েটা, সেই পয়সার ভাগ নিয়ে মারধর খাওয়া ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। বাচ্ছাদের মাছ-ভাতের পয়সায় দোজবরে বরের মদ গেলা যেদিন আর সয়নি, আঁশ বটির বাড়ি বসিয়ে দিয়েছে কয়েক ঘা। তারপর সটান রক্তাক্ত বটি নিয়ে হাজির হয়েছে থানায়।“ বৃদ্ধেরই মেয়ে। কোন উকিল বাবু নাকি আশ্বাস দিয়েছে, বেকসুর খালাস করিয়ে আনবে মেয়েটিকে। সেই অনাগত শুভদিনের তাকিয়েই দিন গুনছে বৃদ্ধ বাপ আর দুটি আপাতঃ অনাথ শিশু।
পরের মিটিং এর লোকজন এসে হাজির, ফাঁকা বয়লার সাফ করতে গিয়ে, বের হওয়া গ্যাসে মারা গেছে এক শ্রমিক, তিনজন ধুঁকছে হাসপাতালে। বাইপাসের ধারের অভিজাত হাসপাতাল, প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বিল। ভয়ে কারখানা খুলতে পারছে না মালিক, গুদামে পচছে মাল, ঠিক সময়ে ডেলিভারি দিতে না পারলে, সমূহ লোকসান। মজুরী না পেয়ে ধুঁকছে শ্রমিকরাও—সবার আশা, যদি ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে বের হয় কোন সমাধান সূত্র- তৃতীয় পক্ষ আমি। চেম্বারে ঢোকার আগে, বাচ্ছা দুটোকে একটু আদর করে যাই। মেয়েটা বড়, বলি, “মন দিয়ে পড়াশোনা কর।” ছোটটার অক্ষরজ্ঞান হয়নি বোধহয়, আবার বাড়িয়ে দেয় তখন থেকে কামড়ানো শশার টুকরোটা, মনে মনে বলি, “ভালো থাকিস বাবা। মায়ের বাছা, ফিরে পাক মায়ের কোল-“। জীবন বড়ই রুক্ষ। দুদণ্ডের দুঃখবিলাসটুকুই যা সম্বল- তারপর আবার শুরু ইঁদুরদৌড়- সূক্ষ্ম ভূলই যে কখন অজান্তে ছুঁড়ে ফেলে দেয় কয়েক আলোকবর্ষ পিছনে- ভাবতে বসলে অবাক লাগে বৈকি-