Saturday 25 January 2020

অনির ডাইরি ২৩শে জানুয়ারী, ২০২০


আপন আপন ব্যস্ত জীবনের গোলকধাঁধা থেকে কয়েক মুহূর্ত চুরি করে, যাঁরা কাল ভরিয়ে দিয়েছেন আমার ফেবুর দেওয়াল বা মেসেঞ্জারের ইনবক্স বা হোয়াটস্অ্যাপ,তাঁদের সকলকে অশেষ ধন্যবাদ।  অনেকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন একসাথে একাধিক মাধ্যমে, আর মাম্পির মত গুটি কয়েক পাগলি সবকিছুর পর আবার ফোন করেও--। কুর্নিশ আপনাদের সকলকে। আপনাদের শুভেচ্ছার জন্য বড় বেশী ভালো কেটেছে গতকাল দিনটা।
আর পাঁচটা বাঙালী মায়ের মত নাহলে হয়তো আমারও মনে হত, মায়ের আবার জন্মদিন! ভূতের আবার জম্মতিথি!প্রণম্য মহামানবের সাথে জন্মদিন ভাগ করে নেবার অন্যতম সুবিধে হল ছুটি। একটু বেলা করে ঘুম থেকে ওঠার অপরিসীম আনন্দ-।  অতঃপর? অন্যদিনের মতই, গাছেদের সাথে কথোপকথন-। শীত শেষ হয়ে আসতে চলল, এখনও বন্ধ্যা আমার পেটুনিয়া ওরফে পেটু। গায়ে গতরে বেড়েছে খুব, শুধু ফুল ফোটানোতেই এত অনীহা কেন বাপু? বেড়েছে গোলাপ ওরফে গোলাপীও-। জামাকাপড় শুকাতে দিতে গেলেই আমার বরকে তিনি সোহাগ করে কাঁটা ফুটিয়ে দাম্পত্যকলহ বাঁধান- এখনও নিষ্ফুল। বাড়ছে আদরের ক্রোটন যার ডাক নাম ক্রোটু, ছাঁটা সত্ত্বেও বাড়ছে এদিকওদিক দিয়ে পয়সাপাতা, এমনকি ক্যাকটাসও, বাড়ছে না কেবল সাধের ঘৃতকুমারী। আজ তো মায়ের জন্মদিন, আজ তো ফুল ফোটাও পেটু বা গোলাপী। 

জন্মদিন মানেই স্মৃতিমেদুরতা, দেশবরেণ্য নেতার সাথে জন্মদিন ভাগ করে নেবার সুফল হল, প্রাক ফেবু যুগেও চট করে কেউ ভুলত না শুভেচ্ছা জানাতে। আর ভুলে গেলে? উথলে উঠত অভিমান। সাক্ষী সঞ্চিতা। কি রেগেই না গিয়েছিলাম সেবার প্রিয় বন্ধুর ওপর। বাড়তে থাকা বয়স আর চড়তে থাকা আত্মবিশ্বাস অবশ্য বহুকাল হল মুছে দিয়েছে ঐসব ছেলেমানুষী আবেগ। তবু আজও বসে থাকি কয়েকটা ফোনের অপেক্ষায়। তাদের ফোন, যারা তখন ছিল আসেপাশে, যখন দিগশূন্যপুরের মাঠে হারিয়েছিলাম খেই। 
সাদাকালো আশি-নব্বইয়ের দশক। হাওড়া ইছাপুরের সিংহ বাড়িতে ২৩শে জানুয়ারী দিনটা ছিল নিছক উৎসব। উৎসবের হাওয়া বইত গোটা মধ্যহাওড়া জুড়েই। সকাল থেকে বেরোত প্রভাত ফেরি। ছাতে ছাতে উড়ত ত্রিরঙা। অবসর সম্মিলনীর মাঠে, ঠিক মধ্যাহ্নে ফাটত বোমা। জীবিত থাকলে  তাঁর যত বছর বয়স হত, ততোগুলি বোমার সেলাম জানাত অবসর। বড়দার হাত ধরে দেখতে যেত সেদিনের ঝুনু। নেতাজীর সাথে সাথে ঐদিন গুনু আর ঝুনুরও জন্মতিথি ছিল যে। দিদা আদর করে ডাকত ঝুমি। ১৯৯৮এ দিদা চলে যাবার পর, আর কেউ ডাকেনি ঐ নামটা ধরে। চাইও না কেউ ডাকে- আবার যখন দেখা হবে, সেই তামুক পাতা চিবানো বৃদ্ধার সাথে, অন্য কোন দুনিয়ায়- আবার ডাকবে সে। শুধুই সে।

খাকি ব্যাগে, জোড়া বোতলে করে ভোর-ভোর আসত হরিণঘাটার দুধ। পায়েস রাঁধত বড়মাসি। ঘণ দুধের  পায়েসের মাঝে এক আধখানা কাজু। জন্মদিনে ভোর ভোর উঠে গুরুজনদের প্রণাম করা ছিল প্রাথমিক কর্তব্য।  মাঝে মাঝে বায়না জুড়তাম।  শাড়ি পরিয়ে দাও মা। পিসির হাত দিয়ে কাছেই শীতলাতলায় পুজো পাঠাত ঠাকুমা। প্রসাদ বলতে ছোট্ট গুজিয়া অথবা প্যাঁড়া। আগের রাতেই জ্যাঠাইমা এনে রাখত নলেন গুড়ের নরম পাকের সন্দেশ,কালোজাম আর পেস্ট্রি। সুগার এন স্পাইজ বা ক্যাথলিনের মত নামি দোকান তখনও হাওড়ায় বিস্তার করেনি শাখা? স্থানীয় বাজারেরে দাবার ছকের মত দেখতে পেস্ট্রি। তাই মনে হত অমৃত। জন্মদিনের একমাত্র দুঃখ ছিল মায়ের অফিস। কেন্দ্র সরকারী কর্মচারী, তাও পোস্ট আপিসে কাউন্টার ডিউটি।  কোন দিন ছুটি পায়নি মা। শুধু সে বছর বাদে, যে বছর শতবর্ষে উপনীত হন তিনি।
বড় মাসির বাড়ি যেতে দেরী হলে সাইকেল নিয়ে সটান হাজির হত বড়দা বা মেজদা। রডে বসে পা দোলাতে দোলাতে ইছাপুর। সোনা-মিন্টুদের বাড়িতে তখন ভাড়া থাকত বড়মাসিরা। একতলার অপরিসর দালানে মাসিদের হাতে তৈরি লাল-নীল উলের আসন পেতে বড় মাসিকে ঘিরে আয়তাকারে খেতে বসতাম আমরা পাঁচ ভাইবোন। রাজার মত বসতেন বড় মেসোমশাই।  টুক টুক করে কত কি যে রাঁধত বড়মাসি। খেতে খেতেও ঝগড়া করত “গুণু আর ঝুনু”। কি বোকাই না বানাতে ছোটদা তুমি আমায়! তখন ইমরান খাঁ-ওয়াসিম আক্রমের ইন্দ্রজাল আচ্ছন্ন ক্রিকেট জগৎ। মনে আছে, তুমি দাবী করতে তুমি পাকিস্তানের সমর্থক?  কম কিলিয়েছি রেগে গিয়ে? আর নাহলে বলত, ঝুনুকে নয়, গুণুকে সবাই বেশী ভালোবাসে। “জিজ্ঞেস করে দেখ-”। কি বোকাই না ছিলাম। সত্যিই জনে জনে প্রশ্ন করে বেড়াতাম। হ্যাঁ গো, তুমি কাকে বেশী ভালোবাসো? ছোটদাকে? না আমায়?
প্রতি জন্মদিনে বাঁধা উপহার ছোট বা সেজ মাসির হাতে বোনা সোয়েটার। নাক টানলে আজও পাই হাতে বোনা নতুন সোয়েটারের সুঘ্রাণ। একটাও বাতিল করেনি মা। যত্নে রাখা সেই সব সোয়েটার পরে আজও ঘোরে আমার কন্যা। আর মেজদা দিতে বই। হাওড়ার বাড়ির আলমারি ভর্তি যত বই, তার শতকরা ৭০ শতাংশই তো তুমি দিয়েছিলে মেজদা। শেক্সপীয়রই বলো বা শার্লক হোমস্ অথবা দেশী নিহাররঞ্জন বা হেমেন্দ্রকুমার রায়- তুমি না থাকলে জমতই না পরিচয়।
১৫ই জানুয়ারী ১৯৯৯, বড়দার বিয়ে, তারপর কেমন যেন গুরুত্ব হারাল ২৩তারিখটা। নবোঢ়া তন্বী শ্যামা বড় বৌদির চলনে-ঠমকে-গমকে মুগ্ধ সিংহ-ঘোষ তথা চাটুজ্জে বাড়ি। বৌদির নিঁখুত পরা শাড়ি, কাজলটানা চোখ, চুড়ির রিনিঝিনি, ২৩শে জানুয়ারীকে একডজন গোল দিল ১৫ই। বছর তিনেক বাদে ২৮শে ফেব্রুয়ারি এল মেজবৌদি। গুরুগম্ভীর মেজদা এত ফাজিল বউ কি করে জুটিয়েছিল কে জানে? বৌদি নয়তো ইয়ার। দাদাদের থেকে বৌদিরা কবে যেন অনেক বেশী কাছের লোক হয়ে উঠল। সেজদা-ছোটদা যখন টোপর পরছে, তখন পুরোদস্তুর জীবন সংগ্রামে ব্যাপৃত আমি। জন্মদিন পালনের সময় কোথায়? তবুও আসত ফোন। ঠিক এসে পৌঁছে যেত স্নেহোপহার। দূরাভাষের ওপাড় হতে কাতর অনুরোধ- আসিস একবার। পায়েস করেছি দুই ভাইবোনের জন্য-।
কবে যেন চাকরী পেলাম-কবে যেন তার সাথে আলাপ হল। বিয়ে হল। সেসব মনে হয় স্মরণাতীত কালের কথা। এখন তো শালকিয়ার ভট্টাচার্য পরিবারের মেজ বউ। জিতেন বাবুর আদরের বড় বৌমা- টুকলুর বউদি আর উমার স্নেহশীলা দিদিভাই। সবার ওপর- তুত্তুরীর মা। যে বোঝেই না,কেক ছাড়া আবার জন্মদিন কি করে হয়? দাদু,ছোটেদাদু,  ছোটো-মুষ্টু বা মামা-মামিদের সামান্য ফোনে কেন ছলছলিয়ে ওঠে মায়ের চোখ। কিন্তু ওঠে তো। কি করি? যতই কঠিন হোক আত্মবিশ্বাসের খোলস, সেদিনের ঝুনু যে আজও বেঁচে আছে আজকের অনির ভিতর। আর সে যে বড় ভালোবাসার কাঙাল- মাথার ওপর থেকে যে হারে সরছে গুরুজনদের স্নেহছায়া, বড় ভয় পায় সে, তাই তো জন্মদিনের শুভক্ষণে তার একটাই প্রার্থনা, তোমাদের সুস্থ থাকাটাই আমার সবথেকে বড় উপহার। আজকে শুধু আজকের দিনে আঁকড়ে ধরতে চাই আমার প্রতিটি প্রিয়জন, প্রতিটি প্রিয়বন্ধুকে, আর বলতে চাই- যাই হোক না কেন, আমায় ছেড়ে যেও না। সময় যত জোরেই দৌড়ক না কেন,বিশ্বাস করো, আমি বদলাইনি। তোমরাও যেন বদলে যেও না-।

Wednesday 22 January 2020

অনির ডাইরি, ২২শে জানুয়ারী ২০২০




কুয়াশা ঘেরা আলসে শীতের ভোরে ঘুম ভাঙলে প্রথমেই যেটা মনে হয় , “জীবন জঞ্জাল হয়ে গেল মাইরি-”। মসৃণ কম্বলের মায়ামাখা ওম ফেলে নিজেকে তোলা, তারপর তুত্তুরীর সঙ্গে শুম্ভ-নিশুম্ভের যুদ্ধ।বার্ষিক পরীক্ষায় একজন রসোগেল্লা-পান্তুয়া পেতে বদ্ধপরিকর, অপরজন সেগুলোকে ল্যাংচা-চমচম বানাতে দৃঢ়মনস্ক।অতঃপর নাকেমুখে গুঁজে ট্রামে-বাসে বাদুড়ঝোলা। ট্রেনটা পাইয়ে দাও, হে ঠাকুর। যাঃ দুই নম্বর প্ল্যাটফর্মে দিল- সাড়ে দশটার লঞ্চটা পাইয়ে দাও ঠাকুর। ও রিক্সাওয়ালা থোড়া অউর জোর সে টানো বাপ-। রিক্সাদাদার মুখে ভুরভুরে দেশী ইয়ের সৌরভ- রাস্তা পেরোতে গিয়ে এই বুঝি মারল বাসে ধাক্কা-।
সরকারী দপ্তর, তাও আবার লেবার, পিলপিল করে আসে মানুষ। কারো আছে প্রশ্ন তো কারো অভিযোগ। সেদিন এক মহিলা এসে বেপোট চ্যাঁচালেন, সামাজিক মুক্তি কার্ডে নামের বানান ভুল। বেচারী সঞ্চিতা আর সোমনাথ যত বোঝায়, অ্যাপ্লিকেশন যিনি টাইপ করেছেন, ওটা তাঁর ভুল, চিন্তা নেই সংশোধন করা যাবে। পাল্লা দিয়ে বাড়ে মহিলার গলার স্বর। উনি বাড়ি বসে শায়া ব্লাউজ বানান, ওণার  মেয়ে ফেলেছে অ্যাপ্লিকেশন। মেয়ে “গ্যাজুয়েট”। সে কি ভুল করতে পারে? ভুল আমাদেরই-। 
গত পরশু যেমন, রমেশ আর প্রদীপ আমার সাধের প্রিন্টারটা নিয়ে খোঁচাখুচি করছে, এক অটো ড্রাইভার শুরু করলেন লাফাতে- তাঁর সময়ের দাম নেই? শ্রমদপ্তরে এমন মানুষ আসবে না তো কি শ্যুটেড বুটেড মানুষজন আসবে? তাঁরাও আসেন অবশ্যি মাঝেমধ্যে। অটোচালক বা কাজের মাসিদের সাথে বসেন একই ভিজিটরস্ চেয়ারে। মিলেমিশে একদর হয়ে যায় মুড়ি আর মিছরি-
 এত কিছুর মধ্যেও আজকের দিনটা ছিল সামান্য ব্যতিক্রম। আজ আমরা গণেশ বাবুর টাকাটা দিতে পারলাম। তাহলে একটু খুলেই বলি- চুঁচুড়া কামারপাড়া তালতলা গলির গণেশ মাল পেশায় একজন নির্মাণকর্মী।উনি দীর্ঘদিন ধরে আমাদের তৎকালীন নির্মাণকর্মী কল্যাণ প্রকল্পের এক নথিভুক্ত শ্রমিক। নিয়মিত জমা করে আসছেন ত্রৈমাসিক বা বার্ষিক চাঁদা। 
 ২০১৫ সালে জুলাই মাসে ওণার স্ত্রী শ্রীমতী শান্তি মাল, আচমকা আক্রান্ত হন হৃদরোগে।  দীর্ঘ চিকিৎসার পর বসে পেসমেকার। খরচ হয় অনেক টাকা। ঐ বছরই সেপ্টেম্বর মাসে আবেদন করেন উনি। সাথে জমা করেন ৬১৪০০ টাকার বিল।
দিন আনা দিন খাটা মানুষের পক্ষে রোজ রোজ সরকারী অফিসের চক্কর কাটা অসম্ভব। তবু বেশ কয়েকবার উনি এসেছিলেন, হয়নি। উনিও আর আসেননি খবর নিতে।
ইতিমধ্যে বদলে যায় তৎকালীন সমস্ত পদাধিকারী। ঠিকানা বদলায় অফিসও। আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর চুঁচুড়া উঠে আসে মিউনিসিপ্যালিটি থেকে জেলা কালেক্টরেটে। নির্মাণকর্মী কল্যাণ প্রকল্প মিশে যায় সামাজিক সুরক্ষা যোজনার সাথে। বদলে যায় নিয়ম- ফর্ম-দস্তাবেজ। হয়তো গণেশ বাবু ভেবেছিলেন পরিসমাপ্তি ঘটেছে সকল আশার, কিন্তু ঐ যে বাদশা খান বলে গেছেন না,“ চলচ্চিত্র এখনও বাকি, বন্ধু-”।
ওণার সুপুত্র তাপস মাল, পেশায় মুদি দোকানের কর্মচারী। তিনি সম্প্রতি নথিভুক্ত  হয়েছেন সামাজিক সুরক্ষা যোজনায়। কি যেন কাজে তিনি এসেছিলেন আমাদের দপ্তরে। নতুন প্রকল্পের সুযোগসুবিধা সম্পর্কে জানতে পেরে দুঃখ করে বলেছিলেন,“কিন্তু আমার মায়ের চিকিৎসার টাকাটা তো পায়নি আমার বাবা। ধার কর্জ করে মায়ের প্রাণ বাঁচানো হয়েছিল। টাকাটা পেলে খুব উপকার হত”।
আমাদের একজন নথিভুক্ত শ্রমিকের বেদনা, হজম হয়নি আমাদের। শুরু হয় তত্ত্বতলাশ।আমাদের সোমনাথ ঘাঁটতে বসল পুরানো দস্তাবেজ।বিস্তর ধুলো ঘেঁটে দেখা গেল , আগের আধিকারিকগণ তৎকালীন নিয়মানুসারে তাকে পাঠিয়েছিল কলকাতায়। ইতিমধ্যে কেটে গেছে প্রায় চার বছর। এতদিন তো পড়ে থাকার কথা নয় কলকাতায়। কবেই পাশ হয়ে গেছে সমসাময়িক অন্যান্য কেস। তবে কি রিজেক্ট হয়েছিল? আমাদের হয়তো জানানো হয়েছিল আমরা খেয়াল করিনি। অথবা হয়তো টাকাও পাঠিয়েছিল, আমরা খেয়াল করিনি। এমন কি হতে পারে? যদি হয়? বর্মণ সাহেবের তত্ত্বাবধানে তোলা হল চার বছরের ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট- কলকাতায় দৌড়ল হুগলী চুঁচুড়া মিউনিসিপ্যালিটির ইন্সপেক্টর সঞ্চিতা। উৎসাহিত হয়ে দৌড়লেন তাপস বাবুও। যদি পাওয়া যায়-
সহযোগীতার হাত বাড়ায় কলকাতা অফিসও।কিছু ভাবে হয়তো হারিয়ে গিয়েছিল গণেশ বাবুর আবেদন পত্র। দীর্ঘ অন্বেষণের পর তাকে খুঁজে বার করে, অনুমোদন দিল বোর্ড। এতদিন বাদে একসাথে ৬০০০০টাকার অনুদান পেয়ে বেশ খুশি গণেশ বাবু। আর তাপস বাবুর উৎসাহ আর ধরে না, স্বয়ং এসেছিলেন ধন্যবাদ জানাতে। সঙ্গে ধরে এনেছিলেন পিতা গণেশ বাবুকেও- খুশি আমরাও। আমাদের সময়ের নয় বলে দায় এড়ায়নি আমার টিম। আর কেউ না জানুক দলপতি হিসেবে আমি জানি খেটেছে খুব।এই খাটা নিছক বেতনভূক সরকারী কর্মচারীর খাটা নয়, এই খাটা একদল মানুষের আরেকজন মানুষের জন্য- ঐ যে ভূপেন হাজারিকা মশাই বলে গেছেন না,“মানুষ যদি না হয় মানুষ-” ইত্যাদি ইত্যাদি- 

Monday 20 January 2020

অনির ডাইরি ২০শে জানুয়ারী, ২০২০

বসে বসে মেয়ের কথাই ভাবছিলাম। সকালে বলছিলাম, আজ সিটু ডেপুটেশন দিতে আসবে। প্রশ্ন করল, “সিটু কি মা? টু সির উল্টো?” হঠাৎ চমক ভাঙল, “এ দিদি, টাইম ক্যা হুয়া?” প্রশ্নকর্ত্রীর বয়স পঞ্চাশের কোঠায়, কৃশাঙ্গী। চিমসে বললে বোধহয় ভালো হয়। পরণে সবুজ চকটকে শিফন। মাথায় বেশ হৃষ্টপুষ্ট  হাত খোঁপা। কপালে কমলা সিঁদুর আর কাঁচপোকার টিপ। কানে সস্তা ইমিটেশনের দুল। হাতে শাঁখাপলার ওপর মেরুন কাঁচের চুড়ি। পায়ে রবারের চপ্পল।

ঐ যে বাংলায় বাঙালীর সাথে বাংলা ভাষায় কথা বলুন- তাই বাংলাতেই বলতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, ঘড়ি ঘর মে ভুল আয়া। কোণাকুণি উল্টো দিকের লেডিজ সিটে এক জীর্ণা বয়ষ্কা রমণী বসে বসে ঘাড় থেকে উকুন বার করছে আর সিটে পিষে মারছে। বাপরেঃ উড়ে না আসে, মাথা ঢাকতে ঢাকতে বাঙালী সুলভ ঘ্যাম নিয়ে বললাম, “৬টা ১০। ” পরের প্রশ্ন, ভাঙা  বাংলায়, “ ফেরার ট্রেন কখন পাবো দিদি?” জানি না বলাতেও রেহাই নেই। “এই দিদি দেখো না, আমার মেকআপটা ঠিকঠাক আছে?” যত পাগল আমার কপালেই জোটে, তাই মাথা নেড়ে বললাম,“ভালোই তো। ” কমপ্যাক্ট পাউডার যে মেখেছে দিব্যি বোঝা যাচ্ছে। ঐটুকুই।
অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, বিরাট অপরাধ করে ফেলেছি। মেয়ের প্রজেক্টের রঙীন ছবির প্রিন্ট আনতে ভুলে গেছি। মনে করাতে ফোনও করেছিল, এরপরও ভুলে যাওয়া, ফাঁসির যোগ্য অপরাধ। ভুলিনি, যদিও।  অফিসের একমাত্র রঙীন প্রিন্টারটি দেহ রেখেছে। আমাদের রমেশ আর প্রদীপ এসে বিস্তর খোঁচাখুঁচি করেছে, কালো কালির বোতল অর্ধেক খালি করেছে, তাও তাঁর মুখে বুলি ফোটেনি। দীপঙ্কর বাবু আর অনুতাপ পর্যন্ত ঘোল খেয়ে বাড়ি চলে গেল- এই সব ভাবছি, এমন সময়,“গোয়না পরিনি দিদি। সব সঙ্গে লিয়ে লিয়েছি। ” বলে যে ব্যাগটা দেখালেন, সেটা আমার পাশে অবহেলায় রাখা। বক্তা আমার সামনের সীটে। একগাল হেসে কইলেন, “বিয়ে বাড়ি যাচ্ছি তো। একেলা যাচ্ছি। ভয় লাগে দিদি। ” বললাম, ভয় লাগে তো ব্যাগটা সামলে রাখুন। নৈহাটি স্টেশনে চোর ছ্যাঁচড় কিছু কম নেই। ব্যাগটা কোলে নিয়ে আবার প্রশ্ন,“লাস টিরেন কটায় দিদি? একেলা ফিরব তো। ” বেশ। কোথায় নামবে জেনে অ্যাপ দেখে জানিয়ে দিলাম, “লাস্ টিরেন কটায়। ”
“ আমি কুথাও যাই না দিদি। আদমি খুব অসুস্থ। বহু বচ্ছর কোথাও যাই না। ভালো শাড়ি পরি না। ” বললাম, তাহলে আজ যাচ্ছ কেন? “কি করি, ওরা শুনল না। চাপাচাপি করতে লাগল- হামার একমাত্র ভাতিজা কি না। যাব কিন্তু খাব না। আজ আমার বাবার ব্রত। দ্বাদশ শিউ লিঙ্গের পূজা করি। নিরামিষ খাই। একটু চা পেলে খেতাম। কিন্তু পুইসা নেই-।”
বুঝলাম মাসির চা তেষ্টা পেয়েছে। মুস্কিল হল ট্রেনে এই সময় কোন চা ওয়ালা ওঠে না। অন্তত লেডিজে।
কোণাকুণি বসা উকুনঘাতিকার আতঙ্কে ঐসারির সব সিট খালি। যার অভিঘাত এসে পড়ছে আমাদের দিকে, চারজন বসার পরও কাউকে কোলে নিতে পারলে ভালো হয়। সবাই বলছে, উকুনেবুড়িকে নামিয়ে দাও। দেবে কে? দিতে গেলে যদি গায়ে দুটো ছেড়ে দেয়? বা তেনারা উড়ে আসে?
“ছোলা ওয়ালা উঠলে বলব পাঁচটাকার দাও।ইস্টিশনের ছোলাওয়ালাকে বললাম, ওদিলে না। বলল ১০টাকা দিতেই হোবে।  সকাল থেকে এক প্যাকেট বিস্কিট খেয়ে আছি। খিদে পায়নি যদিও। বাবার দয়ায় ভুখ পিয়াস রোগ বিমারি সব গায়েব-”। মনে পড়ল ব্যাগে একটা আপেল পড়ে আছে, ফেরৎ নিয়ে গেলে শৌভিক নির্ঘাত কান ধরে ওঠবস করাবে। “আমি কিনে আনি আর তুই নষ্ট করিস” অথবা “ হেলদি জিনিস কেন খাবি?” মনে পড়া মাত্র মাসির হাতে চালান করে দিলাম। ফল খাও। ফল তো খেতে পারো।
লাজুক হেসে মাসি বলল,“নাগো অ্যাসিড হয়ে যাবে না? কিছু খেয়ে খেলে হত-। ” ব্যাগে খানিক মুড়িও ছিল। তেল মশলা ছাড়া সাদা মুড়ি। বললাম খাও। তো জবাব পেলাম,“না গো। মুড়ি আমি চায়ের সঙ্গে খাই। ” অপশন শেষ। আবার ডুবে গেলাম নিজের মনের অলস বৃত্তে। মাঝে মাঝে মাসি হাতে হাত ঠেকিয়ে ডাকছে, টুকটাক কথা বলছে। একবার বলল,“ঐ পাঁপড়টা কেনো। তুমি অর্ধেক খাবে। আমি অর্ধেক। ” বললাম, আমি খাব না। তুমি খাও। কিনে দিচ্ছি। হেসে লুটিয়ে পড়ে বলে গেল,““তুমি না খেলে খাব না গো।” হ্যাঁ হ্যাঁ না না করতে করতে পাঁপড়ওয়ালা গায়েব-। ধুৎ মাসি তুমি না হোপলেস। “তুমি চিন্তা কোরো না গো। হামি গিয়ে এক কাপ চা খেয়ে লিব।ভাতিজার বউভাত বলে কথা-। চিকেন মাট্টন কত কি রান্না হবে-”।  মাসি নেমে গেছে কয়েকটা স্টেশন আগেই। না বন্ধ জানলার ফাঁক  গলে ছুটে আসছে হিমেল হাওয়া-। ছুটে চলা ট্রেনের বাইরে নিকষ আঁধার, আঁধারের ওপাড়ে আলোকজ্জ্বল সুখী সুখী ঘরবাড়ি- আবাসন-দোকানপাট- মল।  কেটে যাচ্ছে আরেকটা দিন। প্রতিটা দিনই যেন এক একটা না পড়া গল্প। কত অজস্র চরিত্র। কত আবেগ- বড় ভালোলাগে পড়তে এই বই। হে জীবন সত্যিই বড় রঙীন তুমি।

Monday 16 December 2019

এক যে দেশে-

(c)Anindita Bhattacharya
৭৯৬৯৩৬০২ এর আজ আনন্দের শেষ নেই। আনন্দের ঢেউ গোটা মহল্লা জুড়েই। অবশেষে সেই বহু কাঙ্ক্ষিত ক্ষণ সমাসন্ন, সময় ঠিক মধ্যাহ্ন।  ভেসে এল মাননীয় দেশনেতার জলদগম্ভীর  কণ্ঠস্বর, “প্রিয় মিত্রগণ,অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, আমাদের বহু শতকের মেহনত ফলপ্রসূ হয়েছে। জম্বুদ্বীপ আজ আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠাসনে আসীন। দেশ থেকে অবশেষে আমরা নির্মূল করতে পেরেছি, “ধর্ম” নামক বিষাক্ত নেশার গুষ্ঠি। ধর্মনিরপেক্ষ নয়,আজ থেকে আমরা নির্ধর্ম রাষ্ট্র। উল্লাস প্রিয় মিত্রগণ!“। দেশনেতার অমৃত বাণী  থামার সাথে সাথেই গর্জে উঠল দেশ, যার বিস্তার গিরিরাজের কপোল থেকে মহাসিন্ধুরD কিণারা অবধি। “উল্লাস”। নিছক উল্লাসে মেতে উঠল সমগ্র রাষ্ট্র।
ধর্ম নামক অসুখকে নির্মূল করতে অনেক যাতনা সয়েছে জম্বুদ্বীপ। ঝরেছে অনেক রক্ত। ৭৯৬৯৩৬০২ শুনেছে তার মায়ের মুখে,মায়ের প্রপিতামহের প্রপিতামহের সময় নাকি সমগ্র জম্বুদ্বীপে ছড়িয়ে পড়েছিল ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ R।নির্বিচারে মারা পড়ছিল ছাপোষা মানুষ।
ধর্মের নেশায় বুঁদ ছিল সমগ্র রাষ্ট্র। তারপর এলেন তিনি।ইতিহাস যাঁকে চেনে ১ হিসেবে। অতি সাধারণ দেখতে ওণাকে, নাতি দীর্ঘ উচ্চতা, পাতলা হয়ে আসা চুলের মাঝে মাঝে চাকাচাকা চকচকে টাক,চোখে গোল ফ্রেমের চশমা, যার একটি ডাঁটি আবার ভাঙা, গৃহযুদ্ধের অভিঘাতে ভেঙেছিল, উনি সারাননি। সুতো দিয়ে বেঁধে পড়তেন। উনিই প্রথম ডাক ছিলেন, পরিত্যাগ করুন ধর্ম নামক বিষাক্ত  নেশা। তখন নাকি ধর্মানুসারে নাম হত মানুষের। উনি ত্যাগ করেন ওণার নামK। নামের বদলে ধারণ করেন সংখ্যা।বংশানুক্রমিক  ধর্মস্থানে খোলেন দাতব্য চিকিৎসালয় আর বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র।
২ ওণার প্রথম অনুগামী। তারপর ৩-৪-৫-। নামের বদলে বাড়তে থাকে সংখ্যা। লুপ্ত হতে থাকে দেবস্থান আর ধর্মালয়।  আর আজ? আজ দেশ জোড়া শুধুই সংখ্যা। প্রায় এক শতাব্দীর অধিক পরিত্যক্ত পড়ে আছে সমস্ত উপাসনালয়। জ্বলেনি সাঁঝবাতি। ভেসে আসেনি প্রার্থনার মোহক সুর, যা রক্ত পিপাসু করে তুলত মানুষকে। দেবস্থানগুলির অনেক কটাই বর্তমানে সংগ্রহালয়। এমনই একটি সংগ্রহালয় দেখতে যাবে আজ ৭৯৬৯৩৬০২। মায়ের মুখে শুনেছে প্রায় এক শতাব্দী জুড়ে কয়েক লক্ষ মানুষের রক্ত খেয়েছে এই দেবালয়। গড়েছে এক পক্ষ,ভেঙেছে অপর। আবার তৈরি হয়েছে নতুন পক্ষ, আবার চলেছে ভাঙা-গড়ার খেলা। মাটির নীচে পরতে পরতে লুকিয়ে আছে এমন ভাঙা গড়ার গপ্প। আজ দেখবে ৭৯৬৯৩৬০২। আর ভাববে কতখানি নির্বোধ ছিল ওর পূর্বপুরুষ তথা পূর্বমহিলাগণ।

Saturday 14 December 2019

মধ্যমেধার মধ্যবিত্তের রোজনামচা-১৪ই ডিসেম্বর,২০১৯

আমার তেত্রিশ কোটি দেবতার মধ্যে, মহঃ রফি একজন। আজ্ঞে হ্যাঁঁ, “আভি না যাও ছোড়কর, কে দিল আভি ভরা নেহি-”। এই পেলব অমৃতস্বরূপ স্বর স্বয়ং ঈশ্বর ছাড়া আর কার হতে পারে বলুন দিকি? কিশোরের সাথে খুনসুটি চলতে পারে, জমতে পারে হাল্কা ফুল্কা প্রেমও। মুকেশজীর সাথে গভীর সম্পৃক্ত প্রেম। কিন্তু রফি সাব? উনি এই তুচ্ছ সাধারণ মেয়েটার ধরা ছোঁয়ার বাইরে। যাঁর পদতলে করজোড়ে বসে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকতে মন চায়। যাঁর আত্মভোলা হাসিতে নত হয়ে যায় মম গর্বিত শির।
পকেটহীন হলুদ পাঞ্জাবি পরা, খালিপা এক বাংলাদেশী যুবার হাত ধরে, নীল শাড়ি পরে মিশে যেতে চাই জনসমুদ্রে। কদমফুল যাঁর ভীষণ প্রিয়। হস্তচুম্বন করতে চাই তাঁর স্রষ্টার। শরদ্বিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের পর এত গভীর ভাবে কোন লেখকের অনুরাগিনী হইনি। আর সেই হেঁপো বুড়ো মিশির আলি, কি যে বলি তাঁকে নিয়ে? ভাগ করে নিয়েছি প্রিয় বান্ধবীদের সাথে। সবকটা তাঁর প্রেমে দিওয়ানা-
আর সেই সদ্য বিপত্নীক বৃদ্ধ, অবসর নেবার দিন যিনি বলেছিলেন, “ও আমার আরেকটা মেয়ে-”। আমার দুই বাপ ছাড়া এত ভালো আমায় কে বেসেছে? তিনিও তো ধর্মে মুসলমান। রোজা রাখতেন না বলে কত পিছনে লেগেছি, “আপনি ভুলভাল মুসলমান নজরুল সাহেব-”।  কান ধরে কবিতা পড়াতেন যিনি। কবিতার প্রতি যতটা ভালোবাসা,সবটুকুই তাঁর থেকে পাওয়া। আজও তাঁর তিরিশ সেকেণ্ডের হড়বড়ে ফোনে আদ্র হয়ে ওঠে উত্তেজিত শুষ্ক মন আর মাথা।

  সংবিধানের প্রস্তাবনা তো সেদিনের শিশু। ধর্মনিরপেক্ষতা আমার রক্তে। ক্রোমোজোমে। প্রপিতামহ ছিলেন চার্বাকপন্থী। ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।  লুকিয়ে অস্ত্র আনতে কালাপানি পেরিয়ে একঘরে হয়েছিলেন ঠাকুরদা। ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায় বলেছিলেন ছোটদাদু। জেলখাটা নকশাল আমার বাবা। উদারমনা শ্বশুর-শাশুড়ী। ঘোরতর আস্তিক বটে,তবে আমার মতই উদার আমার ঠাকুর। এক স্যালুটেই খুশি। অতি ভক্তিতে কুঁচকে যায় তাঁর/তাঁদের ভ্রু।
বিশ্বাস করুন, এসব কথা আপনাদের শোনাচ্ছি না। শোনাচ্ছি নিজেকে। এহেন আমারও আজন্মলালিত সংস্কার, বিশ্বাস তথা মূল্যবোধের গোড়া নড়ে গেছে কালকে তথা আজকের নোংরামিতে। “নোংরামি”। আজ্ঞে হ্যাঁ, কান্নিককে(Spade) কান্নিক বলাই শ্রেয়। এটা প্রতিবাদ বা পোতিবাদ নয়, এটা সহজ সরল নোংরামি। সুদূর মুর্শিদাবাদ থেকে কানের কাছের উলুবেড়িয়া অবধি কেঁপে উঠল যে নোংরামিতে, তাজ্জব ব্যাপার আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা গুলো ঘুণাক্ষরেও টের পেল না এতখানি সংঘবদ্ধ  প্রতিরোধের? আর আমাদের মূখ্য সংবাদপত্র কি লিখছেন, “- আইনের প্রতিবাদে সরব বাংলা”!  মাইরি সত্যি? শুধু সরব? তাহলে অরাজকতা তথা গুণ্ডামির সংজ্ঞাটা অনুগ্রহ করে জানাবেন দাদা/দিদি?
বাতানুকূল ঘরে, অনাগত শীতের অপেক্ষায় ওম্ পোহাতে পোহাতে ওমন কথা লেখা যায় বৈকি।ফেবুতে তপ্ত কুড়মুড়ে স্টেটাস্ লেখা যায়,“বেশ করেছে ভাঙচুর করেছে---। ওদের অস্তিত্ব বিপন্ন। এখন কি ভেবে ভেবে ডেমোক্রেটিক পথে ঝামেলা করবে---”।
আর আমার যে বন্ধু কাল সকালে চেন্নাই মেল ধরবে? সুস্থ ভাবে বাড়ি পৌঁছবে তো সে? বা যে লক্ষ্মীমন্ত বান্ধবীটির বর চাকরী করেন অশান্ত এলাকারই একটি স্কুলে? বিগত দাঙ্গায় বাইক ফেলে হামাগুড়ি দিয়ে ধানখেতের মধ্যে দিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন, তাও টলেনি যাঁর ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি আস্থা। আগামী পরশু থেকে নিয়মিত দপ্তরে যেতে পারবেন তো তিনি? ভগ্নীসমা যে আধিকারিককে কাল রাতে ধমকাচ্ছিলাম, “গুলি মারো বড় সাহেবকে।স্টেশন লিভের নিকুচি করেছে, আগে বাড়ি ফেরো-”, স্বাভাবিক ভাবে কোয়ার্টারে ফিরতে পারবে তো সে? আর ঐ আধিকারিকের স্ত্রী আর কন্যা, আজ থেকে বছর নয় দশ আগে ঐ জায়গাতে তো আমিই ছিলাম-।
নড়ে গেছে যাবতীয় বিশ্বাস আর সংহতির ভিত। ভুলে গেছি পিঁয়াজের দাম বা না পাওয়া ডিএর বেদনা। পড়েও দেখিনি বিহারে নিগৃহিত তথা নিহত বছর দশেকের শিশু কন্যার খবর, শুধু ঘিরে ধরেছে অপরিসীম আতঙ্ক।

Wednesday 11 December 2019

অনির ডাইরি ১০ডিসেম্বর ২০১৯


গতকাল মাসির জন্মদিন ছিল। মাসির আবার জন্মদিন। ভূতের আবার জন্মবার। আর পাঁচজন মাসির জীবনচরিতের মতই তুত্তুরীর মাসিরও জীবন পাক খেয়েছে একই পাকদণ্ডী বরাবর, যার গতিমুখ  বড়ই উচ্চাবচ।
শৈশবে উদ্দাম মজা, ঝপাং করে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডুব সাঁতারে জোড়া পুকুর এপাড়ওপাড়। মশারি দিয়ে বর্ষাকালে চুনো মাছ ধরা। জোড়া বিনুনী দুলিয়ে ইস্কুল যাওয়া। পথেই আলাপ তাঁর সাথে, যাঁকে কোন এককালে তুত্তুরী ডাকত মেসো। তারপর আর কি? গন্ধর্ব থুড়ি পালিয়ে গিয়ে বিয়ে। মাসির তখন সপ্তম শ্রেণী, মাসির সদ্য শাড়ি।
তারপর বড়দিদি,বড়দাদা এবং ছোটদিদি।সংসারের হামানদিস্তার বাড়ি খেয়ে ভালোবাসা পালাল জানলা গলে। শুরু হল সংগ্রাম। জীবন সংগ্রাম। বাড়ি বসে আচার-নাড়ু-পাটালি বানানো। ধূপ বানানো। চানাচুর বানানো।শায়া-ব্লাউজ বানানো।  চেষ্টা তো করেছে মাসি অনেকই। হয়তো করেছিলেন মেসোও। আমরা তো এক পক্ষের গপ্প শুনি কেবল।
কোথায় যেন চাকরী পেয়েছিল মেসো, ছোট চাকরী,তবে সরকারী তো বটে। শুধু যেতে হত বহু দূর। মেসোর মা ছাড়েননি তাঁর আদরের দুলালকে। কেঁদে কেটে কাটিয়ে দিয়েছিলেন নাম। জীবনে কখনই আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি মেসো। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল সংসার, বাধ সাধল মেসোর বাবার হঠাৎ অসুস্থতা। ঘটি বাটি বেচেও বাঁচানো গেল না তাঁকে।  কাজের ধান্ধায় স্থানীয় নার্সিংহোমে আয়ার কাজ সেই তখন থেকে-। আজও জনৈক স্বর্গীয় ডাক্তারের নাম করার সময় কপালে হাত ঠেকান মাসি। হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছিলেন যে ডাক্তারবাবু।

তুত্তুরী তখন ছ দিন বয়স। সোমবারে জন্মেছে বটে,রবিবারের আগে ছাড়েননি বুড়ো ডাক্তারবাবু। মা প্রচুর কান্নাকাটি  জুড়েছিল, বাড়ি যাবে বলে। ততোধিক ধমকেছিলেন ডাক্তারবাবু। অবশেষে রবিবার ভোরে বাড়ি ফেরা। উফ্ কি বৃষ্টি, ধুয়ে যাচ্ছে হাওড়া শহর। ঠাম্মাদাদুর কোলে চেপে হাওড়ার বাড়িতে ঢুকল তুত্তুরী। চকাস্(বড় মাসি), টুলটুল দাদা(বড় মেসো), বড় দাদু, আতুপাতু(বড় দিদা), দিদি(পিসি দিদা), দাদু,মামমাম(দিদা), ছোট দাদু, বড় মামা,বড় মামি সবাই মিলে সে কি টানাটানি। এ বলে আমায় দে। ও বলে আমায়। কত কি যে পেল তুত্তুরী, রূপোর টাকাই তো কতগুলো। আর বেশ কিছু পাঁচশ হাজারের নোট। যার দুটি এই সেদিন বের হল, মামমামের লক্ষ্মীর ঝাঁপি থেকে। দাদুর কি চিৎকার, কি বকল মামমামকে। ওগুলো নাকি পচা টাকা। টয়লেট পেপার সমতুল।
যাই হোক সবার আদরের মাঝে, ঐ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কে যেন এল। এসেই স্নান করে, ডেটল জলে কাচা জামাকাপড় পরে কোলে নিল তুত্তুরীকে। তাকিয়ে দেখল তুত্তুরী, ও মা!মাসি তো।

সেই থেকে বিগত নয় বছরে তু্ত্তুরীর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ মাসি। যখনই তুত্তুরী কোন দুষ্টুমি করে, কারো সাথে কথা বলে না বা মিশতে চায় না। লোকে তো দুটো কথাই বলে, “ইশ্ মা কোন শিক্ষা দেয়নি! ইশ্ আয়ার কাছে মানুষ!” তাতে তুত্তুরীর ঘন্টা। তোমাদের কাছে আয়া হতে পারে,তুত্তুরীর পরিবার তো অসম্পূর্ণ মাসি ছাড়া।
কে তু্ত্তুরীর অপরিসীম বকবক মন দিয়ে শোনে?কে পড়ে শোনায় উপেন্দ্রকিশোর বা অবন ঠাকুর? কে তুত্তুরী দুর্ব্যবহার করে ক্ষমা চাইলেই এক কথায় মার্জনা করে দেয়? কে মায়ের চোখ বাঁচিয়ে এখনও ইউনিফর্ম বা জুতো পরিয়ে দেয়? মাখতে দেয় পমেটম? বানিয়ে দেয় মনের মত টিফিন? স্কুলে কারো সাথে তু্ত্তুরী ঝগড়া করলে কে বাড়ি এসে তার গুষ্ঠির মুণ্ডপাত করে? মাসিই তো।

মেসো যখন ঝপ করে পাড়ি দিল অন্য জগতে, কে সাদা শাড়ি পরতে দেয়নি মাসিকে? মাসি নিরামিষ খেলে কে রাগ দেখায় আজও? কে ধ্বংস করবে বলে স্মার্ট ফোন কিনেছে মাসি? কার অনুরোধে, বাড়ির শাড়ি ছেড়ে সুন্দর শাড়ি এবং টুপি পরে তৈরী হয়ে গেল মাসি কেক কাটতে? তুত্তুরীই তো। এত জটিল সম্পর্কের মধ্যে ঢুকে আমাদের কাজ নেই ভাই, মোদ্দা কথা হ্যাপি বার্থ ডে মাসি। এমনই থাকুক তোমার সম্পর্ক, আদরে আর অধিকারে মাখা।