Tuesday 6 August 2019

অনির ডাইরি ৬ই অগস্ট,২০১৯

সব চরিত্র কাল্পনিক-
দৃশ্য-১
“ম্যাডাম,একজন আপনার সাথে দেখা করবে বলে সকাল থেকে দাঁড়িয়ে আছে। ”
“দাঁড়িয়ে আছে কেন? আমি তো সকাল থেকেই এখানে। ”
“মিটিং চলছিল তো। তাই আসেনি। একা কথা বলতে চায়। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন। পাঠাব?”
দৃশ্য-২
-বলুন।
-নমস্কার ম্যাডাম। খুব বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি।
-ব্যাপার কি?
-আমি অমুক কোম্পানীতে কাজ করতাম। মানে নৌকরি। হঠাৎ একদিন বলে দিল আর আসতে হবে না।
-কেন? নোটিশ দিয়েছিল?
-না ম্যাডাম। হামি সুপারভাইজার ছিলাম। লেবারদের মধ্যে ঝামেলা সামলাতাম। হামি বাঘ আর গরুকে একসাথে এক মেশিনে কাম করবাতাম। একদিন হল কি,একদল লেবার আমায় যাচ্ছেতাই ভাষায় অপমান করল। জাত-ধরম-ভাষা সবকিছু নিয়ে যাতা বলল ম্যাডাম। এতো গালি এ কোম্পানীতে কুনদিন খাইনি ম্যাডাম। শরীল খারাপ হয়ে গেল। প্রায় পচ্চিশ বছরের চাকরী জীবন হামার ম্যাডাম, এ ভাষায় কেউ আমার সাথে কথা বলার হিম্মত পায়নি এতদিন। দুদিন পর যখন জয়েন করলাম অমুক বাবু পুছলেন তুমি তো ছুট্টি নাও না, তাহলে অ্যাবসেন্ট হলে কেনো? আমি উনাকে বলছিলাম ম্যাডাম,মা কসম। সেই সময় প্রোডাকশন ম্যানজার সাহেব আমাদের পিছন দিয়ে যাচ্ছিলেন। হামি জানতামই না,যে উনি সব শুনছেন। উনার কি মনে হল, যে হামি বোধহয় উনাকে গাল দিয়েছি। হামাকে ডেকে বললেন, কাল থেকে তোকে চৌহদ্দির মধ্যে না দেখি। একটা কথাও শুনলেন না ম্যাডাম-

-কি যন্ত্রণা। আপনি কাঁদছেন কেন। আমার যা করার নিশ্চয়ই করব।
-পচাশ বছরের বুড়ো আদমি কুথায় কামধান্ধা পাবে ম্যাডাম। বালবাচ্ছাওয়ালা আদমি ম্যাডাম-
দৃশ্য-৩
-অমুক বাবু, আপনি না ঐ কোম্পানির  এইচ আর ম্যানেজার। আপনি থাকতে এক কথায় কারো চাকরি চলে যায়?
-(দীর্ঘশ্বাস ফেলে)সত্যি বলছি ম্যাডাম, আমি জানতাম না। আপনার চিঠি পেয়ে খোঁজ নিলাম। ও গালাগাল করেছে শুনলাম। ব্যাপারটা বাবু অবধি গেছে।
-বাবু কে? আপনাদের ব্লকের সভাপতি।
-না। না। ম্যাডাম। বাবু মানে মালিক।
-মালিককে আপনারা বাবু বলেন?
-(দীর্ঘশ্বাস চেপে টাক চুলকে)যস্মিন দেশে যদাচার ম্যাডাম।
-হুঁ। তা গালাগালির গপ্পটা একটু শুনি। কে কাকে গাল দিয়েছে?
-আপনার বাদী,শ্রীমান অমুকচন্দ্র। তার উর্ধ্বতন কতৃপক্ষকে অমুক তুসুক বলে গালি দিয়েছে। আপনার সামনে সেসব উচ্চারণও করতে পারব না।
-তা বেশ। কিন্তু দিল কেন?
-তা জানি না ম্যাডাম।
-সাক্ষী কে?
-আছে। তমুক বাবু।
-(বাদীর দিকে ফিরে) এই তমুক বাবুই না জানতে চেয়েছিল আপনি আসেননি কেন দুদিন।
-জী ম্যাডাম।
-বাঃ। তিনি তো দেখছি আপনার বিরোধী পক্ষে যোগ দিয়ে, তাঁদের সাক্ষী হচ্ছেন।
-(বাদী) কি করবে ম্যাডাম। সবাই ভয়ে আছে। যদি ওকেও তাড়িয়ে দেয়। (ম্যানেজারের দিকে ফিরে) স্যার আপনি হামাকে এতদিন ধরে চেনেন। হামি কি এটা করতে পারি? কখনও করেছি স্যার?
-(ম্যানেজারের দুই চোখে মায়ার ঘোর কৃষ্ণ মেঘ) তুই একটু বাইরে যাবি ভাই?ম্যাডামের সাথে দু মিনিট কথা বলি।
-(ঘর ফাঁকা হতে) কি আর বলবেন? কেউ কান শুনতে ধান শুনলেও আপনারা তার চাকরী খেয়ে নেন। কত ক্ষমতা মশাই আপনার।
-ম্যাডাম, আপনি আমাকে এত মাস ধরে চেনেন। কতবার কত কেসে এসেছি আপনার ঘরে, আমি হুকুমের চাকর,কিন্তু শ্রমিক অদরদী বলতে পারলেন? আমি কিচ্ছু জানতামই না ম্যাডাম। এইচ আর সেকশন্ জানে না,প্রোডাকশন কাকে তাড়াচ্ছে। এ মৎসন্যায় পূর্বে ছিল না ম্যাডাম। নতুন মালিক সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে নতুন চামচা বাহিনী। পুরাতন চাকর যারা ছিল,তাদেরও অনেকে তৈল মর্দনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে এদের সাথে। ঐ ম্যানেজারটা ম্যাডাম, এখানকার প্রাক্তন অমুক নেতার ভায়রা ভাই। এরা কি মনে করে নিজেদের কে জানে? এক কথায় লোকের চাকরী খেয়ে নেয়। আমি দেখছি ম্যাডাম কি করতে পারি।
দৃশ্য-৪
-বলুন ম্যানেজার সাহেব। কি বলবেন।
-ম্যাডাম ওর চাকরী আর ফেরৎ দেওয়া সম্ভব নয়। মালিক হেব্বি চটে গেছে ওর ওপর। অমুক নেতা বাবুকে ফোন করে বলেছে, ওর কেসটা দেখতে।
-হুঁ। ইগোয় নিয়ে নিয়েছেন?
-হ্যাঁ। ম্যাডাম। অমুক বাবু এটা কি করলেন। আমার ওপর ভরসা নেই। যাঃ বাবা কাঁদছেন কেন?
-ম্যাডাম। পোড়া কপাল আমার। বিকালে চায়ের দোকানে গিয়ে বসেছিলাম। দুচারজন বন্ধু যারা জানে, জানতে চাইল কি হচ্ছে। আমি আপনার গল্প করছিলাম। খেয়াল করিনি যে গাট্টু বাবু কখন এসে বসেছে।
-গাট্টু বাবু?ও হেরে যাওয়া সভাপতি।
-জী ম্যাডাম। উনি আমার কাঁধ চাপড়ে বললেন, নো চিন্তা। আমি ম্যাডামকে বলে দেব। বললেন আমি দেখছি কি করে তোমায় তাড়ায়।
-উফ্ অমুক বাবু, আপনি একটা রত্নধারণ করুন মাইরি। লোকের সাথে খোশ গপ্প করার সময় এবার থেকে চোখটা অনুগ্রহ করে খুলে রাখবেন। একবার এই কারণে আপনার চাকরী গেল। দ্বিতীয় বার সাজানো খেলা বিগড়ে গেল। গাট্টু বাবু,নিজের ছাড়া কোন জম্মে কার কাজে এসেছেন?আমায় ফোন করেছিল। আমি পাত্তা দিইনি। মালিককে খুঁচিয়ে দিয়েছেন। এবার কি হবে?
-(ম্যানেজার)ম্যাডাম, যদি আপনি চাপ দেন,ওকে নেবে হয়তো,কিন্তু দুদিন বাদে আবার-
-সে কি আর জানি না। এত রাগ হচ্ছে আপদ গাট্টুর ওপর। সাজানো বাগান শুকিয়ে দিল শালা। বলুন বাদী বাবু এবার কি করি?
-ম্যাডাম আমি একটা কথা বলি?
-আপনি আর কি বলবেন?বাবুর কথার ওপর আপনি যেতেই পারবেন না।
-ম্যাডাম, আমিও নিম্নমধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে ম্যাডাম। রবি ঠাকুর নজরুল পড়ে বড় হয়েছি। কোন বড় কোম্পানীতে এইচ আর ম্যানেজার হতে পারিনি। এই কোম্পানীতেও কোনদিন এক নম্বর হতে পারব না। কারণ শ্রমিকের মেরে মালিকের অস্থানে তৈলমর্দন করতে আমি অপারগ।
জানেন তো ম্যাডাম একবার চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে গেছি, আমার পরিচিত আর একজনও গেছে। সে ইন্টারভিউ দিয়ে বেরোবার পর জানতে চাইলাম,“কেমন দিলি?” বলল, দারুন। জানতে চাইলাম,“ওরা কি জানতে চাইল?” বলল,“আমার অ্যাচিভমেন্ট। আমি বললাম,এতজন শ্রমিকের এতটাকা গ্রাচুইটি মেরে দিয়েছি। ” আমি হতবাক। এটা অ্যাচিভমেন্ট-
-হ্যাঁ জানি। তারপর আপনি ইন্টারভিউ না দিয়েই কেটে পড়লেন। পঁচিশ বার শুনেছি। এই কেসে কি হবে?কি রিলিফ দিতে পারেন?
-ম্যাডাম ও সব টাকা পয়সা আগে তুলে নিক। না হলে ছুঁতোনাতায় ওর ন্যায্য প্রাপ্য আটকে দেবে।
-সে তো বেশ বুঝতে পারছি। আপনি একটু বাইরে যাবেন প্লিজ। বাদীর সাথে একান্তে একটু কথা বলি? দেখুন বাদীবাবু, আপনি ভেবে বলুন। আপনি কি চান। যদি চাকরী ফেরৎ চান, তাহলে আরও কটা দিন কেস গড়াবে। আমার ক্ষমতায় মিটবে না, হয়তো আমার বড় সাহেবের কাছে যেতে হবে। যা বুঝছি, ওণার সাথে কথা বলেও এটা মিটবে না।ফলে ফেলিওর রিপোর্ট পাঠাতে হবে সদর দপ্তরে। সেখান থেকে কোর্ট। কেস চলবে। মালিকের কোটি টাকা আছে,কেস চালাতে সমস্যা নেই। আপনি কি চান মনঃস্থির করুন। ব্যাপারটা আর আমার হাতে নেই। যদি আপনি লড়তে চান, আমি পাশে আছি। আমার রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই আদালত সিদ্ধান্ত নেবে। আমার রিপোর্ট পুরোপুরিভাবে আপনার পক্ষে থাকবে। বড় সাহেবের ঘরে ডেট ফেলি?
দৃশ্য -৫
-বলুন বাদী বাবু কি সিদ্ধান্ত নিলেন।
-লড়তে পারব না ম্যাডাম। ছেলের দিল্লী মে অ্যাডমিশনের জন্য কিছু টাকা লোন চেয়েছিলাম ওটা জলদি পাইয়ে দিতে পারেন?ছেলেটার বছর বরবাদ হোয়ে যাবে।
-বিবাদী বাবু শুনছেন?ওর চাকরী চাই না। টাকা পয়সা গুলো মিটিয়ে দিন।
-ম্যাডাম বাবু খুব খেপে আছে। বলছে কোর্টে গেছে যখন ওখানেই বুঝে নিক।
-বাঃ। তাহলে তো এবার আমাকে বুঝতে হয়।আপনি ভালো করে বোঝান, ওর প্রাপ্যগুলো যেন আমার সামনে মিটিয়ে দেওয়া হয়।
-(বাদী কাঁদতে কাঁদতে)ম্যাডাম কোয়ার্টার খালি করে দিতে বলছে। আমি বেকার বসে আছি। কিছু টাকা না দিলে বাড়ি কোথায় পাব? আর ছেলের অ্যাডমিশন?
দৃশ্য-৬
-নাও হে,বুঝে নাও। ম্যাডামের সামনে তোমায় ক্যাশ দিলাম ষাট হাজার টাকা। সই করে নাও।
-এই বিবাদী বাবু,এই না আপনি সেদিন বললেন, আপনার বাবু ক্ষেপে আছে। তাহলে টাকা দিলেন কি করে?
-(তোতলাতে তোতলাতে)ম্যাডাম এটা একটু লিবার্টি নিলাম। এটা ওর কোঅপারেটিভের টাকা। আমি সামলাই কোঅপারেটিভ। মালিক জানতে পারলে আর আমার গর্দান থাকবে না। ভুল টিমে খেলি বটে,তবে শিরদাঁড়া বাঁচিয়ে। বেকার মানুষের জ্বালা আমি বুঝি। একদিন অফিসে গেছি, আমার মেন্টর বলল,“তুমি রিজাইন করো। আজই। ”সন্দেহ করত যে আমি ওর পাওয়ারে ভাগ বসাতে চাই, তাই। আমির বউ সরকারী বাড়ির মেয়ে। শ্বশুর,শালারা সবাই সরকারী চাকুরে। ভাবতেই পারত না, সকালে ভাত খেয়ে অফিস বেরোলাম আর বিকালে আমি বেকার। নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে গেল বউয়ের। ছেলেকে সবে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। কি করি? (ধরা গলা ঝেড়ে) তো যাই হোক, আপনি ম্যাডাম আসলে আপনাদের প্রজন্ম বড় অধৈর্য । জীবন কি এখানে শেষ নাকি। বড় মানুষদের রাগ এই আছে,দুসপ্তাহ বাদে আর নেই। আমি রইলাম, বাবুর মাথা ঠাণ্ডা হলে জানাব। ও যেন তখন গিয়ে আবার চাকরী চায়।
-এই আমি ওসবে ভুলছি না। ওর প্রাপ্য টাকা-
-দেব ম্যাডাম দেব। আপনার সামনে সব দেব। ও শুধু মালিকের দাবী মত বাড়িটা খালি করে দিক।
দৃশ্য-৭
- আরে ম্যানেজার বাবু? আজ কি কোন কেস আছে নাকি?
-না ম্যাডাম। এমনি এলাম দেখা করতে। কতদিন আপনার বকাঝকা  খাইনি।
-কেন আপনার বাবু বকছে না বুঝি।
-এঃ কার নাম করলেন? ও ভালো কথা সেই বাদী বাবুর কথা মনে আছে?সেই যে কথায় কথায় কাঁদত।
-হুঁ। তার তো সব পাওনাগণ্ডা  আপনারা মিটিয়ে দিয়েছেন। ফাইলও বন্ধ। বছর ঘুরে গেল। আজ হঠাৎ  তাঁর কথা কেন?
- (দরজা খুলে) আয় হতভাগা। আয়। ম্যাডামকে প্রণাম কর।
-এই এসব কি?
-ম্যাডাম হামার ছেলে কম্বাইনড্ ডিফেন্স পেয়েছে।
-বাঃ। অভিনন্দন।
-ম্যাডাম আমিও চাকরী ফিরে পেয়েছি।
-সেকি? কনগ্রাচুলেশনস্। ওখানেই? কি করে?
-(ম্যানেজার বাবু)বলেছিলাম না আপনাদের প্রজন্ম বড় অধৈর্য। ঘা শুকোতে সময় দিতে হয়। আমার গল্পটা বলতে গেলাম, শুনলেন না তো। চাকরী হারিয়ে কি কষ্টে যে কাটিয়েছি। এক জায়গায় ইন্টারভিউ দিলাম, মালিক বলল, “আপনার আগের মালিক আপনার খুব তারিফ করছিল। তবে উনি ক্যাটেগোরিক্যালি বললেন, যে আপনি যে স্যালারি পেতেন বলে জানিয়েছেন, তার থেকে অনেক কম দিতেন আপনাকে। ” লজ্জায় ব্রিফকেস নিয়ে বেরিয়ে এলাম। আমায় মিথ্যাবাদী বলল?তবে বউ বটে একটা আমার। সব স্যালারি স্লিপ গুছিয়ে রেখেছিল। নিয়ে গিয়ে দেখালাম,বললাম,“আমি চাকরী ছাড়তে বাধ্য হয়েছি বটে, তবে আমার মালিককে নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নেই। আর হ্যাঁ উনি আমি তো দূরের কথা আমার বসের বস্ কত বেতন পান তাও বলতে পারবেন না। ” শালা -অ্যাল্ মাপ করবেন ম্যাডাম। তো যা বলছিলাম, আমি ধৈর্য ধরেছি, চেষ্টা করে গেছি। তারপর পেলাম এখানে চাকরী। প্রাক্তন মেন্টর, যে আমায় খেদিয়েছিল, একদিন ফোন করে বলল,“অমুক ফরগিভ এন্ড ফরগেট?” বলল, “তোমার কোয়ার্টারে যাব”। বললাম আসুন। উনি এলেন। এখনও আসেন। আমার বউ ওণাকে দেখে ঘেন্নায়  মুখ ফিরিয়ে নেয়। আমি কিন্তু সদাহাস্যময়। আপনি উঁচু চেয়ারে বসে আছেন তো কি, কন্যাসমা। বড় ভালোবাসি আপনাকে। তাই বলি ধৈর্য ধরে খেলুন, জীবন বড় মধুর। দেখবেন প্রতিপক্ষেও কোন না কোন বন্ধু পেয়েই যাবেন।  আর এই ব্যাটা প্রাক্তন বাদী, মিষ্টি কে খাওয়াবে?
©Anindita's blog

Friday 2 August 2019

অনির ডাইরি, ২রা আগস্ট, ২০১৯


ধনিয়াখালির শ্যামল আহেরী ছিলেন পেশায় রঙ মিস্ত্রী।বেশ কিছুদিন আগের কথা, হরিপাল থেকে কাজ সেরে বাড়ি ফিরছিলেন, বসেছিলেন জানলার ধারে। ভাবতেও পারেননি, দিনের শেষে দুটি বাসের রেষারেষি রাতারাতি বদলে দেবে ওণার জীবন। স্বচক্ষে  প্রত্যক্ষ করেছিলেন, কিভাবে ওণার ডান হাতটা কেটে  পড়ে মাটিতে। খবরটা তৎকালীন স্থানীয় সংবাদ পত্রেও ফলাও করে ছাপা হয়েছিল। বাসওয়ালারা তাই বলে শিক্ষা নিয়েছে, বা রেষারেষি বন্ধ করেছে,এমন ভেবে বসবেন না কিন্তু।

হ্যাঁ, বন্ধ হয়েছে বটে, তবে সেটা হল শ্যামল বাবুর উপার্জন। সেই থেকে বেরোজগার হয়ে বাড়িতে বসে। কি ভাগ্যি আমাদের নির্মানকর্মী প্রকল্পে নাম নথিভুক্ত করিয়ে রেখেছিলেন। স্থানীয় পঞ্চায়েতে বসা এসএলও দিদির মুখে শোনেন, অঙ্গহানি, বিশেষ করে একটা হাত কাটা গেলে এক লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়।

সেই থেকে আমাদের ধনিয়াখালি শ্রমিক কল্যাণ কেন্দ্রে ওণার আনাগোনা। ফর্ম দিয়ে সব বুঝিয়ে দেন ইন্সপেক্টর বাবু। সেই মত জমা ও করে দেন শ্যামল বাবু। ইতি মধ্যে বদলে গেছে বেশ কিছু নিয়মকানুন। সেই মোতাবেক নতুন ওয়েবসাইটে ওণার ডিটেলস্ তোলা হয়, নতুন পোর্টালটি আবার আধার নম্বর ধরে মেলায়, এই আধারনম্বরের মালিকের অন্য কোথাও বই নেই তো। অন্য কোথাও থেকেও অনুরূপ সুবিধা পাচ্ছেন না তো? সারা পশ্চিমবঙ্গের এক দেড় কোটি নথিভুক্ত মানুষের অগুনতি ডেটার সাথে তুল্যমূল্য বিচার করতে লেগে যায় বেশ কিছুদিন। যতদিন না পোর্টাল বলছে ইউনিক কেস, ওণার সামাজিক মুক্তি কার্ড জেনারেট করতে পারে না ইন্সপেক্টর। কার্ড যখন জেনারেট হল,ততোদিনে বেজে উঠেছে নির্বাচনের দামামা। ফলে আরও বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয় শ্যামল বাবুকে। ক্রমশই অসহিষ্ণু হয়ে উঠতে থাকেন উনি। প্রায়ই চলে আসতেন ইন্সপেক্টর সাহেবের কাছে, সাহেব বলতেন,“ধৈর্য ধরুন। ” কতদিন ধৈর্য ধরে থাকা যায়? মাথা গরম করে দু চার কথা শুনিয়ে বসতেন শ্যামল বাবু। বেচারা ইন্সপেক্টর আমার কপাল বৈগুণ্যে ঝাড় খেত।

 যাই হোক, সবুরে মেওয়া ফলেছে। সম্প্রতি সামাজিক সুরক্ষা যোজনায়  অঙ্গহানির জন্য ১লক্ষ টাকা পেয়েছেন শ্যামল বাবু।  আপাততঃ মধুরেন সমাপয়েৎ। ধনিয়াখালি শ্রমিক কল্যাণ সহায়তা কেন্দ্রে এসেছিলেন,ইন্সপেক্টর শ্রী চঞ্চল মণ্ডলকে ধন্যবাদ জানাতে। বার বার বলে গেছেন শ্যামলবাবুর চোখে “ইঞ্চপেক্টর বাবু” সাক্ষাৎ ভগবান।

চঞ্চল ঝাড়টা বেমালুম হজম করে গেলেও এত প্রশংসা বোধহয় হজম হয়নি, পেটরোগা ভালোমানুষ ইন্সপেক্টর আমার। ম্যাডামের বড়ই অনুগত। শ্যামল বাবুকে ধরে এনেছিল আমার কাছে। “অনেকটা দেখ আমি বাড়ছি মামি” সুলভ ভঙ্গীতে। খুব খুশি হলাম শ্যামল বাবুর সাথে প্রত্যক্ষ আলাপে। শ্যামল বাবু কি বললেন জানেন? ওণার জবানীতেই লিখি,“খুব উপকার হল স্যার/ম্যাডাম।বড় হতাশ হয়ে পড়েছিলাম গো। এখন আবার বেঁচে থাকার একটা কারণ খুঁজে পাচ্ছি। ” আমরা এএলসি ইন্সপেক্টর যদিও পইপই করে বললাম, টাকাটা বুঝে খরচ করতে। শ্যামল বাবু জানালেন, উনি একটা দোকান দিতে চান। অনেক শুভেচ্ছা রইল আপনার জন্য শ্যামল বাবু। ভালো থাকুন।
আর হ্যাঁ, দিনের শেষে আমাদের(এএলসি-ইন্সপেক্টর-সিকেসিও-এসএলও) সান্ত্বনা এই যে, আমরা অন্তত একজন বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পেরেছি।

Wednesday 31 July 2019

অনির ডাইরি ৩০শে জুলাই, ২০১৯

প্রতিটা দিন, শুরু হয়, ঠিক একই রকম ভাবে। সেই ঘুম জড়ানো ভারি চোখ, মনের মধ্যে সুপ্ত ইচ্ছা, আজ বেশ রবিবার। আর তারপর? ট্রেনে বিক্রি হওয়া মুচমুচে কচুভাজার মত ঝাল-নুন ছিটোতে থাকে জীবন।
সকাল ১১টা- “ম্যাডাম, কাল তারা এসেছিল। ঠিক আপনার অসাক্ষাতে। পাক্কা দেড় ঘন্টা ধরে, কি চিৎকার। বলেছে, এবার বেনিফিশিয়ারিদের এনে, আপনার চেম্বারে বসিয়ে বিক্ষোভ দেখাবে?”

“মানে? আমার ঘরে লোক ঢোকাবে? কে ভাই, সেই মহাপুরুষ? ঘরে লোক ঢোকাতে চাওয়াটা দেখছি গাঙ্গেয় হুগলীর মুদ্রাদোষ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
সকাল ১১টা ১৫-  প্রবল ইচ্ছে করছিল বরকে ফোন করে নালিশ করতে,কিন্তু সক্কাল সক্কাল কাউকে ভুঁড়ি নাচিয়ে হাসাতে চাই না। তাই তীব্র ইচ্ছে দমন করে, তাঁকে ফোন লাগালাম, যাঁর ভয়ে আমার তিন তিনটে ইন্সপেক্টরের মুখ কালো হয়ে আছে। ব্যাটারা আবার বলছিল,আমায় নাকি ট্রেনিং করে রোগা এবং কালো লাগছে। ফোনটা বেজে গেল, যাই হোক।

১১টা ৩০- “ম্যাডাম, আঠারোটা ফাইল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হয় হারিয়ে গেছে।”
- মানে? কোথায় গেছে? বেড়াতে? ১৮জন একসঙ্গে বেড়াতে গেল? খুঁজেছো? “ম্যাডাম শুভজিৎ ধীমানকে দিয়েছিল।” “না ম্যাডাম আমায় দেয়নি। আমায় দিলে আমি কোনদিন হারাই? আমি সব গুছিয়ে রেখেদি কি না বলুন?  নির্ঘাত রমেশকে দিয়েছিল।” “বাঃ তা শুভজিৎ, রমেশ  এণারা সব কোথায়?” “শুভজিৎ পুজো করছে।” মানে? “ছুটি নিল যে, হোয়াটস্অ্যাপে।” বাঃ। তা ফাইলগুলো দিয়ে কি ধুনো দিচ্ছে?” “ম্যাডাম আমি কতবার বলেছি, আমায় দিতে, আমি সব গুছিয়ে রাখি।” ঝগড়া থামাবে তোমরা? আমি বলে সদ্য শিখে এলাম-নো ব্লেম গেম- নো স্কেপগোট। কোথায় কোথায় খুঁজেছো? চল আমার সামনে খুঁজবে চলো।

১২টা- “হ্যালো ম্যাডাম,আপনি ফোন করেছিলেন, সরি আমি ধরতে পারিনি, একটু ইয়ে করছিলুম। ”
“বেশ করছিলেন। আরে আয়াম সরি, আপনি আমার অসাক্ষাতে আমার অফিসে ডেপুটেশন দিয়ে গেলেন, আমি থাকতে পারলুম না। আপনি একাই আমার তিন তিনজন ইন্সপেক্টরকে আমার অসাক্ষাতে চমকে গেলেন, হ্যাঁ গো,তা আপনারা নোটিশ দিয়েছিলেন? কই দেখিনি তো? মারের আগে ধাক্কা তো দেবেন?”
- “কি যে বলেন ম্যাডাম। আপনাদের সঙ্গে আমার কত ভালো সম্পর্ক। আপনারা কত হেল্প করেন।” “তাই বলে ওসব ছেলেপিলে ঢোকানোর গল্প করে যাবেন? আমি না হয়, মজা পেয়েছি,তবে,আমি আর কদ্দিন বলুন তো। এবার ট্রেনিং এ পাঠাক, আমি আর ফিরব না। ”
“হেঃ হেঃম্যাডাম আপনাকে যেতে দিলে তো।রাগ করছেন কেন? ও তো কথার কথা।  ওসব একটু বলতে টলতে হয়। বুঝলেন কি না। আপনি ট্রেনিং এ ছিলেন, তাই দেখা হল না। আপনি মিষ্টি খেতে চেয়েছিলেন, এবার গেলে নিয়ে যাব। রাগটাগ করবেন না। ”
১২টা৩০- “সঞ্চিতা,চিন্তা নেই,অমুক বাবু মিষ্টি নিয়ে  আসছেন। ছেলেপিলে আনছেন না। এই, তুমি পাহাড়ে চড়ে কি করছ?” “ফাইল খুঁজছি ম্যাডাম। আপনি বললেন তো। ” তাই বলে ধুলোর পাহাড়ে কে চাপতে বলল। শেষে বস্তা চাপা পড়ে মরবে নাকি?” “না ম্যাডাম, এই দেখুন ছটা ফাইল পেয়েছি। বাঃ গুড গার্ল। ধীমান-কৌশিক কিছু শেখো মাইরি তোমরা। সঞ্চিতা আমার একাই দশ শ।” “ম্যাডাম, দাঁড়ান। কাল আমি ময়দানে নামব। সব বস্তামস্তা বিদেয় করে ছাড়ব। ধুলোর আখড়া যত। ”
১। ৩০- রমেশ তোমাকে যে ফাইলটার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, সেটা রেডি হয়েছে? “ শুনুন না ম্যাডাম, আমি সব গুছিয়ে সঞ্চিতা ম্যাডামকে দেখিয়ে ফাইলটা রাখলাম, আর খুঁজে পাচ্ছি না। ” বাঃ। উনিশ নম্বর। সাত দিন। মাত্র সাতদিনের জন্য ট্রেনিংএ গেছিলামরে বাপ, তোমরা তার মধ্যে আর কি কি হারিয়েছো? একটা লিস্ট করে দাও হ্যাঁ। বার বার আমি জানতে চাইব, তোমরা এক এক করে শোনাবে,~ কাঁহাতক সহ্য হয় বাপ?

২। ৩০- “হ্যালো ম্যাডাম, চিঠি পেয়েছেন?  “আবার? আর কত চিঠি লিখবেন অমুক বাবু? আমি চাপা পড়ে যাব যে।ডিসপিউট চলছে তো। একটু ভরসা রাখুন না। উল্টো পার্টিকেও একটু ভাবতে দিন। এভাবে পত্রাঘাত করলে খেপে যাবে না? ” “না ম্যাডাম। চিঠি আমারই। তবে আইনটা আলাদা।” “ওরে বাবা, আবার নতুন আইন পড়াবেন?”

৩। ৩০-“হ্যালো সুকন্যা। এই আইনে কাজ করেছো?” “হ্যাঁ। ” বাঃ। সাধে কি তোমায় ফোন করি। শালা সবজান্তা মাইরি। এবার বলো দেখি সোনামণি কি করতে হবে। ” “পড়ে দেখ। ” ছিঃ এমন করে দর বাড়াতে আছে? পড়েছি তো। বুঝতে পারলে আর তোমার কি প্রয়োজন। বলো না বাপ-।”

৪টে- “হ্যালো অমুক বাবু, শুনুন। আপনার এই পাঁচ গণ্ডা চিঠির ওপর আরো গুটি ছয়েক অ্যাপ্লিকেশন লাগবে। ফর্মটা এসে নিয়ে যাবেন।” “ আরো ছয় কপি? আমায় যে অমুক বলল-”। “ধুর বাবা। আপনাকে কে বলেছে জানি না, আমায় খোদ আইনের বই বলেছে। জ্যান্ত সরস্বতী বাবা। ভুল বলে না। এবার দয়া করে,আপনি আসুন। আর একদম চিঠি লিখবেন না। ”

৫টা৩০-“দিদি, কাল আসব।” “আচ্ছা। কেন বলো তো?” “সেই যে সেক্সুয়াল হ্যারাজমেন্টের কেসটা-”।  “অ্যাঁ? কোন কেস? কে কাকে হ্যারাজ করল। ধুর বাবা, মনে পড়ছে না কেন?” “না। না। দিদি, হ্যারাজমেন্ট অ্যাট ওয়ার্ক প্লেস অ্যাক্টটা নিয়ে বলতে বলেছিলাম না, রেকর্ড করে নেব। ” ওঃ। বাঁচলাম।

এইভাবেই অর্ধেকটা দিন কেটে গেল, এবার বোধহয় বাড়ি যাবার পালা। সেখানে আবার অঘটনঘটনপটিয়স তথা তাঁর কন্যা, কি পাকিয়ে রেখেছেন কে জানে? তবে সে তো অন্য গল্প। আপাততঃ অনেক হয়েছে বাপ। বাড়ি যাই।

Thursday 25 July 2019

অনির ডাইরি ২৪/০৭/১৮


দৃশ্য-১
"ম্যাডাম!" "বলুন?"
“ট্রেড ইউনিয়নের কি জেনারেল ম্যানেজার হয় ম্যাডাম?”
“কেন বলুন তো?কি হল আবার?এটা জানতে ফোন করেছেন সক্কাল সক্কাল?”
“আপনার পাঠানো চিঠির খামে ঠিকানা লেখা, প্রতি, জেনারেল ম্যানেজার, অমুক ট্রেড ইউনিয়ন-”
সর্বনাশ। কে লিখেছে? সোমনাথ? প্রীতি? রণিত? মান সম্মান আর রাখলে না দেখছি, জুট মিলেরটা জেনারেল ম্যানেজার আর ট্রেড ইউনিয়নেরটা জেনারেল সেক্রেটারি, তেলে আর জলে মিশিয়ে দিয়ে বসে আছো? আমার চিঠি দেখে টুকতে গিয়েও ভুল? কাজের সময় মন কোথায় থাকে?
দৃশ্য-২
“ম্যাডাম, আমি এত কম টাকা কেন পেলাম?”
“উ?”
“আমি জানতে চাই, আমায় এত কম টাকার অর্ডার করলেন কেন?”
“আরে বাবা, আপনি যা কাগজপত্র দিয়েছেন, তার ওপরেই তো ক্যালকুলেট করব? ফাইন্ডিংস্ টা পড়ে দেখুন, তাতে সিঁড়ি ভাঙা অঙ্কের মত সব বলে দেওয়া আছে, কিভাবে আমি নির্ধারণ করলাম, আপনি কত টাকা পেতে পারেন।“
“আপনি তো শুধু ম্যানেজমেন্টের আর্গুমেন্ট শুনলেন, গরিবকে তো সুযোগই দিলেন না। উনি আমাকে জেরা করলেন, অথচ আমি ওনাকে করতে পারলাম না।“
“আপনার উকিল করল তো? আপনার সামনে প্রশ্নোত্তর চলল, আপনি সই করলেন?”
“সে তো আমার উকিল করল। উনি তো আর আমার কথা জানেন না?” 
“উফ ভগবান!”
দৃশ্য-৩
“ম্যাডাম আসব?”
“বলুন এবার আপনার কি চাই?”
“ম্যাডাম আপনার লোক তো কই জানালো না? কটা মাল চাই। কিনে ছাপাতে হবে তো, আমার লোক মাল আনতে কলকাতায় গিয়ে বসে আছে।“
“কি যন্ত্রণা। রমেশ? শ্যামা বাবুকে জানাও নি? একটা কাজ কি কেউ সম্পূর্ণ কর না? সব আমার মাথায় চাপাতে হবে?”
“আচ্ছা। ম্যাডাম। সরি ম্যাডাম। আপনি রেগে যাবেন না ম্যাডাম এখুনি জানাচ্ছি।”
“সেটা ছাড়ো। এখনও জানানো হয়নি কেন? জবাব দাও?”
“কি করব ম্যাডাম, প্রমিত বাবু বললেন, ‘মেলে আছে দেখে নে।‘”
“বাঃ। কি আনন্দ। আমিই দেখি তাহলে? যত সব-”
দৃশ্য-৪
“ম্যাডাম, আপনার চা নিয়ে আসি?”
“হু।“
“সাদা না কালো?”
“যা খুশি। প্রচন্ড মাথা ধরেছে, একটু কড়া হয় যেন। আর পুঁচকে কাপে নয়।”
“বুঝতে পেরেছি। আমার খাবার গ্লাসটা মেজে আপনাকে দিচ্ছি দাঁড়ান।“
“আরে ধুর বাবা। অতো চা কি করব? স্নান?”
দৃশ্য-৫
“আসছি?ম্যাডাম।”
“বলুন?এই আপনারা এই সেদিনই ডেপুটেশন দিয়ে গেলেন না?”
“ হ্যাঁ। সেগুলো সব পেয়ে গেছি ম্যাডাম। আজ আরো কয়েকটা কেস দিলাম, একটু বলে দেবেন যেন ছেড়ে দেয়।“
“সে তো এমনি দেবে। সব কাগজ পত্র ঠিক থাকলে আর কি চাপ?”
“তবু ম্যাডাম, আপনি জানেন না কি করুণ অবস্থা ওদের, রাস্তা তৈরি করতে গিয়ে গরম পিচের ড্রাম উল্টে পড়েছিল, ছেলেটি গায়ে।বেঘোরে মারা গেছে। “
“ইশ।”
“আরো শুনবেন ম্যাডাম? ছয় বছরের বাচ্ছা মেয়ের মাথায় টিউমার, বাবা-মায়ের কি মানসিক অবস্থা ভাবুন। সর্বস্বান্ত  হতে বসেছে ম্যাডাম।লোকটি রিক্সা চালায়। বউটি সেলাই দিদিমণি। কোথায় পাবে? সাড়ে চার লাখ টাকা খরচা হয়ে গেছে, আবার ভেলোর যাবে-”।
দৃশ্য-৬
-ম্যাডাম, লাইফ সার্টিফিকেট সই করাব, এখন আসব? না কি টিফিন হয়ে গেলে?
-টিফিন তো আসেই নি। আপনিই আসুন। কি করতেন?
- বাস চালাতাম।
-এখন চালান না?
-উ হু।
-কেন? চোখ?
- চোখ নয় ম্যাডাম, আমি ৩৫ বছর অমুক রুটে বাস চালিয়েছি, কিন্তু তখন এতো ছোট গাড়ি ছিল না ম্যাডাম, আর ছেলেপুলেও এতো বিপজ্জনক ভাবে বাইক চালাতনি।
-হু। তা আপনি ৩৫ বছর বাস চালিয়েছেন, কটা লোককে টপকেছেন?
- হেঁহেঁ, না ম্যাডাম, মানুষ না, তবে বার কয়েক গরু-
দৃশ্য-৭
-“ম্যাডাম, টাকা ঢুকে গেছে, অসংখ্য ধন্যবাদ।“
“অ্যাঁ? টাকা? কিসের টাকা?”
“দুলাখ টাকা? অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথ।“
- “আরেঃ বাঃ। খুব ভালো? তা বেনিফিশিয়ারি কোথায়? তার তো একটা ছবি তুলে রাখতে হবে, নোটিশ বোর্ডে।“
- “সে তো স্বর্গে চলে গেছে ম্যাডাম। তার বউ চলবে?
দৃশ্য-৮
- ম্যাডাম আসছি?
- কি চাই?
- ম্যাডাম চিনতে পারছেন? সেই যে দেখা হয়েছিল? অমুক দপ্তর-
- অ। বলুন কি চাই?
- ম্যাডাম, শুনুন না, আগের বার আপনি অনেক হেল্প করেছিলেন, এবারো একটু করে দিন না। বেচারা বুড়ো মানুষ, কটা টাকার জন্য দরজায় দরজায় ঘুরছেন।
- কিসের টাকা?
- পি এফ।
- এই ভাগো। পি এফ আমার অফিসের দায়িত্ব নয়।
- জানি ম্যাডাম। আপনি তো আগের বার বলে দিলেন পিএফ কমিশনারের অফিসে যেতে। আমরা গিয়েছিলাম, ওনারা একটা ফর্ম দিয়েছেন, ইনি বুঝতে পারছেন না, কি করে ফিল আপ করে। একটু বলে দিন না-।”
দৃশ্য-৯
- আবার আপনারা? না। না। আমি আর কোন মানুষের দুঃখ দুর্দশার গপ্প শুনব না। প্রচুর কাজ।
- শোনেন না ম্যাডাম, একটা প্রতিকার তো চাই, একজনের বই হারিয়ে গেছে।
- ইন্সপেক্টরকে বলুন ও ডুপ্লিকেট বার করে দেবে। এই জন্য আমায় জ্বালানোর কি কোন দরকার আছে?
- জানি ম্যাডাম। আমি কি আর আজ থেকে ট্রেড ইউনিয়ন করছি? আপনি হয়তো তখনও জন্মাননি, তখন থেকে এই গরীব মানুষ গুলোর জন্য খাটছি। ডুপ্লিকেট বার করতে হলে তো বইটার নম্বর চাই।
- -ও। তাও নেই? ভালো। টাকা দেবার রসিদ? তাও নেই? অসাধারণ।যে বলবে কাক এ কান নিয়ে গেছে, অমনি আপনি এসে আমায় জ্বালাবেন?
- কি করব ম্যাডাম, এসব নিয়েই আছি। জানেন তো আদিতে আমরা পূর্ববঙ্গের অধিবাসী, বাবা সম্পত্তির মায়া ত্যাগ করে ১৯৪২এ এদেশে চলে এসে ডানলপে চাকরী নেন, তাই আমাদের ভাইবোনেরা আজ সবাই মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছি, মাঝে মাঝে ভাবি, জানেন, যদি বাবা, বাড়ি জমি আঁকড়ে পড়ে থাকত, কি হত? ৭২এ পালিয়ে আসতে হত এক কাপড়ে। তখন আমার মা হয়তো লোকের বাড়ি বাসন মাজত আর বাবাকে ভ্যান রিক্সা চালাতে হত-
এতরকম মানুষ আর এত ধরণের আবেগ অনুভূতিস্নাত হয়ে বাড়ি ফেরার পথে ভুলেই যাই, আজ ভোরে অ্যালার্মের কর্কশ শব্দে কাঁচা ঘুম চটকে যাবার হতাশায় মনে হয়েছিল কি সাংঘাতিক বর্ণহীন আমার।কাজের সাথে ভালোলাগা আর ভালোবাসার নিবিড় সম্পর্কের ফলে আপাতত পূর্ণ এ ঝুলি।  আপাততঃ বড় বেশী রঙীন এ জীবন।  কাল সকাল অবশ্য আবার অন্য বার্তা বহন করে আনবে- এই তো জীবন কালি দা।

Saturday 20 July 2019

অনির ডাইরি ১৯শে জুলাই, ২০১৯

অনির ডাইরি ১৯শে জুলাই, ২০১৯
মুণ্ডুখোলার নাম শুনেছেন? কি ভাবছেন কোন জায়গার নাম? আজ্ঞে না মশাই, মুণ্ডুখোলা হল একটি  ব্যাঙ্কের নাম। ব্রাঞ্চ নয় কিন্তু। নামটাই মুণ্ডুখোলা ব্যাঙ্ক। তো কথা হচ্ছে আহাম্মদপুর , জিরাট নিবাসী বারীণ বাবুর কি যে মতিগতি হয়েছিল, উনি অ্যাকাউন্ট খোলার আর কোন ব্যাঙ্ক খুঁজে না পেয়ে, অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন এই মুণ্ডুখোলা ব্যাঙ্ক। নিজের,স্ত্রীর তথা তৎকালীন অবিবাহিতা কন্যারও অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন এই ব্যাঙ্কে। কি মুণ্ডুখোলা প্রীতি মাইরি বারীণ বাবু আপনার।
উনি প্রাইভেটে সিকিউরিটির কাজ করতেন, স্ত্রী বাড়িতে বসে ব্লাউজ শায়া বানাত। সময়মত দিলেন মেয়ের বিয়ে দিয়ে। তারপর ঐ আর কি, “বুড়োবুড়ি দুজনাতে মনের সুখে থাকত, বুড়ি বসে তামাক সাজত, বুড়ো বসে কাশত। ” বারীণ বাবুর পেনশন,পি এফ আমাদের তৎকালীন সাসফাউ কিছুই ছিল না। তবে ওণার বউয়ের একখানি বই ছিল বটে।
এহেন শ্রীমতী জ্যোৎস্না পাল হঠাৎ করো আক্রান্ত হলেন কর্কট রোগে। ঘটি বাটি বেচে চিকিৎসা তো হল,শুধু প্রাণটাই যা  বাঁচল না। বেচারা বারীণবাবুর নুন আনতে পান্তা ফোরায়। সেই সময় গ্রামের কালেক্টিং এজেন্ট দিদি বললেন,“ তোমার বউয়ের একখানি বই ছেল না? জমা টাকা তো পাবেই, আরো পঞ্চাশ হাজার টাকা পাবে তো গো। ”
মুস্কিল হচ্ছে জ্যোৎস্নাদেবী নমিনি করে গেছেন তাঁর কন্যাকে। মেয়ে থাকে কলকাতায়।তার এত ঘোরার সময় বা প্রয়োজন কি? প্রয়োজন তো বারীণ বাবুর। মেয়েকে দিয়ে সই করিয়ে, উনি জমা করলেন সেই ক্লেম। সময় ২০১৬। তখনও আমাদের চুঁচুড়ায় আসতে বেশ কয়েকমাস দেরী। ২০১৭সালে সামাজিক সুরক্ষা যোজনা চালু হল। তার আগের সব ক্লেম আমরা অনুমতি সাপেক্ষে ঝেঁটিয়ে সাফ করলাম।
২০১৯এর গোড়ায় এসে হাজির বারীণ বাবু। আমি তো ট্যাকা পাইনি কো। বয়স্ক মানুষ কি যে বলেন বোঝাই যায় না। ভয় পেয়ে যান, নার্ভাস হয়ে যান। সর্বোপরি ওণার ব্যাঙ্ক- মুণ্ডুখোলা। ব্যাপারটা কেউই বুঝে বা বুঝিয়ে উঠতে পারি না। ইতিমধ্যে বদলে গেছে আমাদের অফিসের ঠিকানা। হয়ে গেছে অডিট। বদলে গেছে বলাগড়ের ইন্সপেক্টর। দু আড়াই বছর আগের কাগজ খোঁজা দুঃসাধ্য। সেই দুঃসাধ্যসাধন করেছে এই তিন মক্কেল। বাঁ দিক থেকে ধনিয়াখালির সিকেসিও সোমনাথ হাঁসদা, বলাগড়ের ইন্সপেক্টর দর্পনারায়ণ সাহা ওরফে আমাদের আদরের দর্প আর একদম ডানদিকে শ্রী কৌশিক মুখার্জী, আমার আরএলও ইন্সপেক্টর। পুরাণো কাগজ খুঁজে বার করে, ব্যাঙ্ককে চমকে টাকা ফেরৎ আনিয়ে। জবরদস্তি বারীণ বাবুর কন্যাকে দিয়ে সরকারী ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলিয়ে তারপর সেই টাকা পাঠানো হয়েছে মেয়ের অ্যাকাউন্টে। টাকা পেয়ে বারীণ বাবু এসেছিলেন কৃতজ্ঞতা জানাতে। আজও অন্যদিনের মতই হাঁউমাউ করছিলেন, তবে গলায় বাজছিল খুশির সুর। বারীণ বাবু কতটা বুঝেছেন জানি না, তবে আমি জানি বারীণ বাবুর গল্পের নায়ক এই তিনজন। হয়তো সবটুকুই কাজের অঙ্গ,তবু যে অপরিসীম ধৈর্য নিয়ে, দরদ দিয়ে এরা কাজটা করেছে, তার সাক্ষী স্বয়ং আমি । যে কোন ভালো কাজের লাইমলাইট সব সময় ওপর তলাই শুষে নেয়,আর যারা খেটেখুটে কাজটা করে তারা মিশে যায় জনস্রোতে।  বেতন হয়তো বাড়াতে পারব না, পদোন্নতি  বা চাকরির স্থায়ীকরণ ও করতে পারব না, কিন্তু দলপতি হিসেবে মাথার টুপিটাতো খুলতে পারি-। তাই বললাম, আয় বাপ তোদের একটা ছবি তুলেদি।