Friday, 10 April 2020

✍শ্রী শরৎচন্দ্র দাশের, “জার্নি টু লাসা,ডাইরি অব আ স্পাই” বইটি থেকে কিঞ্চিৎ বঙ্গানুবাদ।

“আজ, ৭ই নভেম্বর, ১৮৮১। দার্জিলিং এর মাথার ওপর জাজ্বল্যমান পূর্ণচন্দ্রের সুষমায় আচ্ছন্ন চরাচর। বুকের ভিতর এক অদ্ভুত দোটানা নিয়ে রওনা দিলাম নিজের জন্মভূমি ছেড়ে। কি হবে? ফিরে আসতে পারব তো স্বদেশে? ইতিউতি ঘুরে বেড়ানো দু চারটে কালো মেঘের পুঞ্জ, অকালবর্ষণের সঙ্কেতবাহী। বারবার চোখ ঘুরে যাচ্ছে, দূরে পূবের পর্বতমালার দিকে। এখানে বর্ষণ মানে, ওখানে তুষারপাত। একদিকে বরফ চাপা পড়ে মরার ভয়, আর অপরদিকে অজানা অচেনা প্রকৃতিকে জয় করার চ্যালেঞ্জ-

নীরবে চলেছি আমি, সকলের নজর এড়িয়ে। উল্টো দিক আসা দু চারজন ভুটিয়া ছাড়া জনশূণ্য পথ। নিস্তব্ধ রাতের বুক চিরে, বহুদূর থেকে ভেসে আসছে কুলিকামিনদের গান, মাদল আর বাঁশির সুর।
নদীর ধারে, লামা উগেন গ্যাৎসো আমার জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন। এই সময়, নদী বেশ চওড়া। নদীর বুকের ওপর আলগা ভাবে ফেলে রাখা গোটা চারেক বাঁশই হল সেতু। আমার ভুটিয়া কুলি ফুরচুং বেশ বুদ্ধিমান, ও যদি সাহায্য না করত, এই পিচ্ছিল সেতু এত সহজে পেরোতে পারতাম না।
গোক গ্রামে পৌঁছলাম রাত দেড়টা নাগাদ। অন্য সময় গমগম করে এই গাঁ, বড় হাট বসে, কত দোকানপাট। একটা বৌদ্ধ স্তুপও আছে। দার্জিলিং থেকে ব্যবসায়ীরা আসে ভুট্টা আর ছোট এলাচ কিনতে। আপাততঃ জনমানবশূন্য। কেবল ফাঁকা খাটালে শুয়ে নাক ডাকাচ্ছে এক নেপালী। ঐ খাটালের মেঝেতেই কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম আমরা। একটু জিরিয়ে নেওয়া আবশ্যক। কাল আবার কাকডাকা ভোরে শুরু হবে আমাদের যাত্রা।
শোয়াই সার, ঘুম আর এলো না। মাটি বড় অসমান এখানে। বড় এবড়োখেবড়ো। পাতলা কম্বল ভেদ করে ফুটতে লাগল শুকনো ঘাস আর আগাছা। গায়ের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে বেড়াতে লাগল একপাল পোকামাকড়, সর্বোপরি আচমকা বৃষ্টি এসে একেবারে কাকভেজা করে দিয়ে গেল।

ভোর চারটেতে আবার শুরু পথচলা। পায়েচলা সরু পথ, মেরেকেটে একফুট চওড়া হবে হয়তো। বড় বড় ঘাস আর আগাছায় ঢাকা।সদ্য বৃষ্টিতে পিচ্ছিল।  লণ্ঠন হাতে আমি ফুরচুং কে অনুসরণ করে চললাম। ফুরচুংএর পিঠে ভারী মোট, মোটের সাথে শক্ত করে বাঁধা আমার শটগান। হড়কাতে-হড়কাতে,সামলাতে-সামলাতে আমরা যখন রাম্মামে এসে পৌঁছলাম, সদ্য উদয় হচ্ছেন দিনমণি।

৮ই নভেম্বর-রাম্মাম হল রঙ্গীতের অন্যতম প্রধান উপনদী। সিংলী পর্বতমালা থেকে উৎপন্ন এই নদী রচনা করেছে বৃটিশ ভারত আর স্বাধীন সিকিমের সীমানা। এই সময় রীতিমত খরস্রোতা এই নদী। পারাপারের জন্য ছোট একটি বাঁশের সেতু ভরসা। ব্রীজের কাছাকাছি উল্টো দিক থেকে আসা একটা বড় দলের প্রায় মুখোমুখি পড়ে যাচ্ছিলাম আমরা। অন্তত জনা কুড়ি তো হবেই। দার্জিলিং বাজারে কমলালেবু বিক্রি করতে যাচ্ছিল।  কোন মতে ওদের দৃষ্টি এড়াই আমরা।

এদিকে প্রচুর শাল গাছ চোখে পড়ে। পাহাড়ের মাথায় ছোটএলাচ আর তুলো গাছে ফসল পেকেছে। বাঁদর আর ভাল্লুকের হাত থেকে ফসল বাঁচানোর জন্য, উঁচু করে বাঁধা বাঁশের মাচায় বসে আছে সদা সতর্ক প্রহরীর দল। শুনলাম এখানে এক ধরণের বীর হনুমানের বড় উৎপাত। সাধারণ বাঁদর বা হনুমানের থেকে আয়তনে বেশ বড়, ফসলের দুশমন। চাষীরা এদের যমের মত ভয় পায়। একলা মহিলা দেখলেই আক্রমণ করে এরা। এদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে করমচা (ডগস্ বেন) এবং অন্যান্য বিষাক্ত গাছের শিকড় ভাত বা অন্য খাবারের সাথে মিশিয়ে ছড়িয়ে রাখে লেপচারা।
রাম্মামের তীরে প্রাতরাশ সেরে, ভারতীয় পোশাক পাল্টে পরে নিলাম তিব্বতী পরিধান। মিতশাং রোডকে ডানদিকে রেখে, শুরু হল চড়াই ভাঙা। এদিকে প্রচুর কৃষ্ণসার হরিণ (অ্যান্টিলোপ) আর জংলী ছাগল দেখতে পাওয়া যায়। গ্রামবাসীরা টুকটাক শিকার করে বটে, তবে বড় দরিদ্র এরা। মেরে কেটে এক ডজন বন্দুক হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে। এদিকে নেপালীই বেশী। কয়েকঘর ব্রাহ্মণ আর ছেত্রীও দেখলাম। মূলতঃ দুধ আর মাখন বিক্রি করাই এদের পেশা। বেশ কয়েক জায়গায় দেখলাম পাহাড়ের ঢালে ধাপী কেটে ধান চাষ করা হয়েছে। লাঙল টানছে বলদে। ভুটিয়ারা ধাপ চাষ করে না।ওরা লাঙলও ব্যবহার করে না। মান্ধাতার আমলের কিছু যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে বটে, ফলে ফসল মোটেই ভালো হয় না। লিম্বুরা আবার পর পর তিনবছর চাষ করে, তারপর তিনবছর আবাদ না করে ফেলে রাখে জমি। তারপর আবার আগাছা উপড়ে, শুরু করে চাষবাষ- ।
অনেকটা চড়াই একটানা ভেঙে অবশেষে যেখানে পৌঁছলাম, সেখান থেকে দূরে ধূরমদিয়েং উপত্যকা পটে আঁকা ছবির মত দেখতে পাওয়া যায়। এখানে অনেক গুলি ছোট বৌদ্ধ স্তুপ আছে, পাহাড়িয়ারা এটাকে বলে মনি-দারা। আর ভুটিয়ারা বলে চোটেং-গ্যাং। যেনামেই ডাকা হোক না কেন, অর্থ একই, “পবিত্র স্তুপের পাহাড়”।
স্থানীয় লিম্বুদের থেকে দু বোতল মুরুয়া( বীয়র) আর কিছু আনাজপাতি কেনা হল, এই পবিত্র পাহাড়ে, এক ছোট্ট ঝোরার ধারে আজ রাত্রিবাস করব আমরা।”

✍শ্রী শরৎচন্দ্র দাশের, “জার্নি টু লাসা,ডাইরি অব আ স্পাই” বইটি থেকে কিঞ্চিৎ  বঙ্গানুবাদ।

৯ই নভেম্বর, ১৮৮১- পাহাড় থেকে নেমে, এই মুহূর্তে আমরা যে উপত্যকার উপর দিয়ে চলেছি, তা তুলনামূলকভাবে বেশ ঘনবসতিপূর্ণ। তাপমাত্রাও বেশ বেশী। আমরা হেঁটে চলেছি লিম্বু বসতির ভিতর দিয়ে। বিগত দুইদিনে যে উচ্চাবচ পেরিয়ে এসেছি, সে তুলনায় পথ সুগম। লিম্বুদের বাড়ির সামনে ভেড়া অথবা শুয়োরের খোঁয়াড় থাকে।  ছাগল আর গরুও বাঁধা আছে দেখলাম।
ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সমস্ত লিম্বু বাড়িতে অন্তত তিন থেকে চারটি ঢোল থাকবেই। সমস্ত পরবে, উৎসবে ওরা ঢোল বাজায়। এমনকি গৃহকর্তা যখন কোন কাজে বেরোয়, তার স্ত্রী আর সন্তানরা তার জন্য সম্মিলিত ভাবে ঢোল বাজায়, আবার বউবাচ্ছারা যখন বেরোয়, তখন গৃহকর্তা বসে ঢোল বাজাতে । 

১০ই নভেম্বর, ১৮৮১- আজ সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন চরাচর। আমরা রওনা দিলাম। এক ছোট্ট ঝোরার ধার দিয়ে এঁকে বেঁকে চলেছি আমরা। চতুর্দিকে উঁচু উঁচু পাইন আর রাক্ষুসে ফার্নের জঙ্গল। জঙ্গল আরো ঘন হয়ে উঠল, পাহাড়ের ওপর থেকে মাঝে মাঝেই ঝাঁপিয়ে নামছে খলবলে জলরাশি। বয়ে যাচ্ছে নদীর মত।  নদীর ধারে ধারে বেত ধরণের গাছের ঘন ঝোপ। জঙ্গল এখানে এতটাই ঘন হয়ে উঠেছে যে, সুউচ্চ ফাইন, ওক আর ম্যাগনোলিয়া গাছের মাথা ডিঙিয়ে দেখা যায় না আকাশ।
অনেকগুলো ছোট ঝোরা পেরিয়ে, বেলা একটা নাগাদ আমরা হি লা পাহাড় চূড়ায় উঠলাম। একটা ফাঁকা খাটাল দেখে বিশ্রাম নিতে ভীষণ ইচ্ছে করছিল, কিন্তু বড় জোঁকের উপদ্রব। শয়ে শয়ে জোঁক ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক। রীতিমত আতঙ্কিত হয়ে, যত তাড়াতাড়ি পারলাম , পাতাতাড়ি গুটোলাম।
উৎরাই পথে নামতে নামতে বেলা চারটের সময় আমরা যেখানে পৌঁছালাম, বেঁটে বেঁটে বাঁশের জঙ্গল। মাঝে মাঝেই বাঁশঝাড়ের মাথায় লাল কাপড় বাঁধা। ফুরচুং প্রতিটা লাল কাপড়ের কাছে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় প্রার্থনা(লা সল) করতে করতে নামছিল। সন্ধ্যে নামছে, জঙ্গলের মধ্যে এক বুড়ো ওক গাছের তলায় মোটামুটি সাফ করে আজকের মত রাত্রিযাপন করার সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা। চতুর্দিকে বিছুটি জাতীয় বড় বড় লতার জঙ্গল। মহীরুহগুলিকে জড়িয়ে উঠে গেছে। প্রায় একশ ফুট লম্বা লতাও দেখতে পেলাম। পাতি বিছুটি গাছও ছিল। বিছুটি গাছের কচি পাতা দিয়ে দারুণ স্যুপ বানায় কুলিরা । বেশ ভালো খেতে।

১১ই নভেম্বর, ১৮৮১- আজও আকাশের মুখ ভার। কুয়াশা। উপর্যুপরি রোদ আর বৃষ্টির লুকোচুরি। ভুটিয়ারা একে বলে, “মেটগ চারপা” বা পুষ্পবৃষ্টি। আমরা হি গাঁয়ে পৌছলাম। সিংলি পাহাড় থেকে উৎপন্ন কালাই নদী প্রায় কুড়ি মাইল পথ পরিক্রমা করে, তাশিডিং পাহাড়ের পাদদেশে রঙ্গীতের সাথে মিশেছে। কালাই নদীর দুই ধারে, পাহাড়ের ঢালে গড়ে উঠেছে অনেকগুলি ঘনবসতিপূর্ণ গ্রাম। অনেকটা বক্ষপিঞ্জরের মত। কালাই নদী যদি মেরুদণ্ড হয়, গাঁ গুলো পাঁজরা।

হি ও এমনি একটি গ্রাম। এই গাঁয়ে কয়েকঘর ভুটিয়া, লেপচা আর লিম্বুদের বাস। লিম্বুরা এদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত সচ্ছল। চাষবাসই এদের মূল জীবিকা। এরা মোষ দিয়ে লাঙল টানায়। লিম্বুদের সম্পর্কে আরও অনেক কথা জানলাম। যেমন, লিম্বুদের সমাজে পাঁচ ধরনের পুরোহিত দেখা যায়। প্রথম শ্রেণীকে বলে “ফেডংবা”, এরা মামুলী পুরুত। পুজো আচ্ছা নিয়েই থাকে। টুকটাক হাত দেখা, ভবিষ্যৎবাণী করা অবধি এদের দৌড়। দ্বিতীয় শ্রেণীকে এরা বলে “বিজুবা”। ওঝা বলতে পারেন। টুকটাক তুকতাক করে। এদের আচারবিধির অন্যতম অঙ্গ হল নাচ। রীতিমত দর্শনীয়, সে নাচ ।
তৃতীয় শ্রেণী হল, “দামী”। এরা অশুভ আত্মা তাড়ায়। যাদুবিদ্যা বা ডাকিনীবিদ্যার সাহায্যে ভূত তাড়ায়। লিম্বুরা মনে করে, দামীর প্রভাবে,ঘাড় থেকে নেমে প্রেতাত্মা বেরিয়ে আসে মানুষের মুখ দিয়ে।
চতুর্থ শ্রেণীকে বলে “বইদাং”। এরা বৈদ্য। সম্ভবতঃ বইদাং নামটাও সংস্কৃত বৈদ্য শব্দের অপভ্রংশ।  পঞ্চম তথা অন্তিম শ্রেণীটি হল, “শ্রীজাংগা”। এরা পুরোহিত শ্রেষ্ঠ। ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন তথা ব্যাখ্যা করার অধিকার শুধু এদেরই আছে। যাঁর থেকে আমি লিম্বুদের সম্পর্কে এত তথ্য জানতে পেরেছিলাম তিনিও শ্রীজাংগা। শুধু তাই নয়, তিনি বাকি পুরোহিতদের বিদ্যাতেও সমপারদর্শী। বলাইবাহুল্য লিম্বুদের মধ্যে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি।
কালাই নদীর অববাহিকাকে নীচে ফেলে আমরা আরও ওপরে উঠতে শুরু করলাম। বড় বড় ঘাস আর কাশফুলের মত গাছের ঘন ঝোপে ভর্তি পথ। এদিকে বড় জংলী শুয়োর আর শজারুর উৎপাত। বিশেষতঃ শজারু নিয়ে স্থানীয় অধিবাসীরা রীতিমত আতঙ্কে ভোগে। সামান্য ডালকলাই, মূলো আর রাঙালু চাষ করে এরা।তাতেই চলে সম্বৎসর। তাও বরবাদ করে দেয় শজারু।
দিনের শেষে কালাই নদী থেকে প্রায় ৩০০০ফুট উপরে উঠে এলাম আমরা। বহু নীচে এঁকেবেকে বয়ে যাওয়া কালাইয়আর রাটাং নদী আর তার দুধারে ঢালে গড়ে ওঠা ছোট ছোট গ্রামগুলি যেন পটে আঁকা ছবি। আমাদের ডানদিকে লিংচ্যাম গ্রাম। কমলালেবুর বাগান। মুরুয়ার ক্ষেত। আজ রাতটা এক লিম্বু গৃহে আশ্রয় নেবো আমরা। কুলিরা আসার পথে, পাহাড়ের ফাঁক ফোকর থেকে প্রচুর বুনো পেঁয়াজ (লাগগ) তুলে এনেছে। তরকারি বানাবে।  লাগগের গন্ধ অনেকটা আমাদের রসুনের মত। যদিও ঝাঁঝ অনেক কম। মাংসেও দেয়। মাংসে দিলে অদ্ভূত একটা গন্ধ হয়। বলে, খেলে নাকি কাশি হয়।
১২ই নভেম্বর- যাত্রা শুরু। আজ আবার চড়াই ভাঙা। সরু পায়ে চলা পথ, পথের ধারে ধারে ভুট্টা ক্ষেত। দু চারটে হতদরিদ্র  লিম্বু কুটির। মাঝে মাঝে দু-এক মহিলাকে দেখলাম জঙ্গল থেকে ঝুড়ি করে জংলী এপ্রিকট তুলে আনতে। এই পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চ্যাংগাচেলিং মঠে যখন পৌঁছালাম বেলা দুটো বাজছে। খাদের ধারে মসে ঢাকা এক চোর্টেন স্তুপ।
দুদণ্ড জিরিয়ে এগিয়ে চললাম আমরা।  এবার পথ ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে।  আকাশ ছোঁয়া ওক আর পাইন গাছের জঙ্গল। নীচে দুর্ভেদ্য বিছুটি বা নেটল জাতীয় লতার ঝোপ। ঝোপ কেটে সরিয়ে আমরা এগোতে থাকলাম। প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর পৌঁছানো গেল টেল গাঁয়ে। এখানেই আপাততঃ নিশিযাপন করব আমরা। ছোট্ট গ্রাম টেল। বড়জোর গোটা কুড়ি পরিবার বাস করে। গৃহপালিত পশু বলতে ঘোটকী, মোষ, শুয়োর বেশ কিছু গরু চোখে পড়ল। এখানে লবণের বড় অভাব। ইয়ুংপুং  লবণ ব্যবসায়ীরা অক্টোবরের তুষারপাতের পর আসা বন্ধ করে দেয়।এই সময় তাই কোন অভিযাত্রী দল এ পথে এলেই ভিড় জমায় গ্রামবাসীরা। চ্যাং বা দিশি মদের বিনিময়ে লবণ বেচার জন্য পিড়াপিড়ি করে। আমাদেরও ঘিরে ধরল গ্রামবাসীরা। কিন্তু আমরা নিরুপায়। আমাদের রসদ যে অত্যন্ত সীমিত-। প্রয়োজনের বেশী এককণাও অতিরিক্ত আনতে পারিনি আমরা।

Thursday, 9 April 2020

Journey to Lhasa, The Diary of a Spy by Sarat Chandra Das

"He was a spy, who had fallen in love with the land of his mission and remained its lifelong lover.-  তিব্বত চিরকালই বহিরাগতদের সন্দেহের চোখে দেখে এসেছে। দুর্গম প্রাকৃতিক অবস্থান, সীমান্ত রক্ষায় সদাজাগ্রত দুর্দম, নৃশংস,শত্রুপরায়ন জনজাতি সভ্য জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন, অগম্য করে রেখেছিল তিব্বতকে। অগম্য বলেই হয়ত চরম রহস্যময়। উনবিংশ শতকের শুরু থেকেই সমগ্র এশিয়া জুড়ে ক্ষমতা বিস্তারে ব্যাপৃত হয় দুই মহাশক্তিধর  রাষ্ট্র বৃটেন আর রাশিয়া।  পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আরও আতঙ্কিত তথা সন্দেহপরায়ন হয়ে ওঠে তিব্বত। কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ করা হয় বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ। শ্বেতাঙ্গ ছাড়ুন, সমতলবাসী ভারতীয়দেরও প্রবেশানুমতি  দিতে অস্বীকার করে তিব্বত।
যদিও, দুই দেশের মধ্যে স্মরণাতীত কাল থেকে চলে আসা ব্যবসাবাণিজে পড়েনি কোন প্রভাব। এই বাণিজ্য একতরফা ভাবে নিয়ন্ত্রণ করত তিব্বতীয় আর সীমান্তে বসবাসকারী কিছু পাহাড়ি উপজাতি। এরা ছাড়া প্রবেশাধিকার ছিল কেবল মাত্র বৌদ্ধ শ্রমণদের।  কয়েক শ বছর ধরে, অগণিত বৌদ্ধ শ্রমণের পদধূলি ধন্য এই পথ, বৃটিশদের জন্য এটাই ছিল লোহার বাসর ঘরের একমাত্র ছিদ্র। এই পথেই, গোপনে পাঠানো হত শ্রমণের ভেকধারী গুপ্তচরদের।  এদের বলা হত “পণ্ডিত।” মধ্য এশিয়ায় ব্যাপৃত বৃটেন আর রাশিয়ার ক্ষমতার দ্বন্দ্বে এরা ছিল  পাতি ক্রীড়ানক। অধিকাংশই দরিদ্র অশিক্ষিত পাহাড়ি জনজাতির মানুষ। জমিজরিপ সম্পর্কিত সামান্য প্রাথমিক শিক্ষানবিশী করেই এদের ঠেলে দেওয়া হত, সাংঘাতিক বিপজ্জনক মিশনে।হাতিয়ার বলতে থাকত বিশেষ ভাবে তৈরি কিছু যন্ত্রপাতি, যা ঝোলার মধ্যে লুকিয়ে, সীমান্তরক্ষীদের চোখে ধুলো দিয়ে ওপারে নিয়ে যেত এই গুপ্তচরের দল। সেক্সট্যান্ট, থিওডোলাইটের মত মাপন যন্ত্র লুকোনো থাকত বাক্সের কোন গোপন কক্ষে, ছড়ির ভেতর লুকানো থাকত কম্পাস, ফাঁকা জপযন্ত্রের মধ্যে লুকানো থাকত পাকানো কাগজ আর উচ্চতা মাপার হিপসোমিটার। জপমালায় ১০৮ এর পরিবর্তে থাকত ১০০খানা পুঁতি। পা গুনে গুনে দূরত্ব মাপত এরা, পরিমাপ-জরিপ করত তিব্বতের বিভিন্ন অঞ্চল। কয়েকজন পণ্ডিত যেমন অসাধারণ দক্ষতা তথা সাহসের পরিচয় দিয়েছিল, তেমনি পরাভূত, নির্যাতিত, নিহত পণ্ডিতের সংখ্যাও কিছু কম ছিল না। এমনি এক পণ্ডিত নয়ন সিং রাওয়াতকে, পরবর্তীকালে তাঁর অবিস্মরণীয় তথা দুঃসাহসিক কাজের জন্য স্বর্ণপদক দিয়ে সংবর্ধনা জানায় দা রয়াল জিওগ্রাফিক সোসাইটি।
তবে এদের মধ্যে প্রথাগত শিক্ষার অভাব থাকার জন্য, এরা কখনই তিব্বতের ভূপ্রকৃতি, জনজীবন বা সংস্কৃতি সম্বন্ধে বিশদ তথ্য যোগাড় করে উঠতে পারেননি। এই নিয়ে বৃটিশ সরকারের খেদ ছিল বরাবরই। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত, বাস্তু প্রযুক্তিবিদ্ শরৎচন্দ্র দাস, তাই সরকার বাহাদুরের চোখে ছিলেন এই কাজের জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি। তিব্বতের প্রতি তাঁরও ছিল অদম্য প্রেম।" 
“ঁশরৎচন্দ্র দাশের জন্ম, অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত চট্টগ্রাম জিলায়। প্রেসিডেন্সী কলেজে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া কালীনই, তাঁর বুদ্ধিমত্তা আর অধ্যাবসায়, গোরা শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ডিগ্রী লাভের পূর্বেই তাঁকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পাঠানো হয়,সুদূর দার্জিলিং জেলার ভুটিয়া বোর্ডিং স্কুলে।

পাণ্ডববর্জিত জায়গায় পাহাড়ি ছেলেদের বোর্ডিং স্কুল, আর তার প্রধান শিক্ষক হিসেবে এক তরুণ বাঙালী ইঞ্জিনিয়ারের নিয়োগ আসলে ছিল বৃটিশ সরকারের এক গভীর চক্রান্তের সূচনা।

সিকিমের রিনচেনপং বৌদ্ধ বিহার থেকে আগত লামা উগেন গ্যাৎসো ছিলেন এই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। রিনচেনপং বিহারের সাথে, তিব্বতের শিগাটযের তাসিলহুনপো বিহারের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত গভীর। মূলতঃ উগেনের উদ্যোগেই তাসিলহুনপো থেকে পাওয়া যায়, শরৎচন্দ্রের তিব্বতে প্রবেশের ছাড়পত্র। শুধু তাই নয়, শরৎচন্দ্রের তিব্বত যাত্রার অন্যতম সহযাত্রীও ছিলেন লামা উগেন গ্যাৎসো।

গোপন মিশনে যাবার প্রাক্কালে শরৎচন্দ্রের মাসিক বেতন এক ধাক্কায় ১৫০টাকা থেকে বেড়ে হয় ৩০০ টাকা। রওনা হবার পূর্বে, শরৎচন্দ্র তাঁর স্ত্রীকে শুধু জানিয়েছিলেন, যে তিনি আপিসের জরুরী  কাজে দিন কয়েকের জন্য শিগাটযে যাচ্ছেন। তাঁর স্ত্রী জানতেনও না, এই শিগাটযে কোথায়, বা কি তাঁর এই জরুরী কাজ। তিনি জানতেনও না যে, শরৎচন্দ্রের অকালমৃত্যু হলে তাঁর জন্য মাসিক ১০০টাকা পেনশন ধার্য করেছেন সরকার বাহাদুর।

শরৎচন্দ্র দুবার তিব্বত যান। প্রথম বার ১৮৭৯ সালে চার মাসের জন্য, আর দ্বিতীয়বার ১৮৮১ সালে চোদ্দ মাসের জন্য। মূলতঃ দ্বিতীয় অভিযানে তিনি যে বিশদ তথ্য যোগাড় করেছিলেন, তার উপর নির্ভর করে দুটি রিপোর্ট জমা করতে হয় তাঁকে, একটি রিপোর্ট গোয়েন্দা দপ্তরের জন্য আর দ্বিতীয়টি জমা করেন সার্ভে দপ্তরে। উনবিংশ শতকের অন্তিম ভাগেও এই দুইটি রিপোর্টই ছিল অত্যন্ত গোপনীয় এবং সংরক্ষিত। অবশেষে ১৯০২ সালে পুস্তকাকারে প্রকাশ পায়, “Journey to Lhasa, The Diary of a Spy”।  

তাঁর পূর্বসূরী ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের থেকে শরৎচন্দ্রের  অভিজ্ঞতা ছিল অনেকটাই আলাদা। বলাইবাহুল্য শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল অনেক বেশী। খুব সহজেই তিনি মিশে গেছেন স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে। শ্বেতাঙ্গ অভিযাত্রীদের তুলনায় ন্যূনতম বাজেটে,স্বল্প রশদ আর লোকবল নিয়ে যাত্রা করতে হয়েছে তাঁকে। কোথাও রাত্রিবাস করেছেন মেষপালকের কুটিরে,কোথাও বা পথের ধারে গ্রাম্য বিহারে। পথে সহযাত্রী ভৃত্য তথা কুলিদের সাথে গড়ে উঠেছে উষ্ণ সম্পর্ক। নভেম্বরের শীতে,সামান্যতম গরম পোশাকে, যন্ত্রপাতি বা আধুনিক উপকরণ ছাড়াই, যে ভাবে তাঁরা পার হয়েছেন একের পর এক দুর্গম গিরিখাত, তা রীতিমত বিস্ময়কর। তাজ্জব করে দেয় পেশাদার পর্বতারোহীদেরও।
যদিও দুর্গম পথের থেকেও বহুগুণ বিপজ্জনক ছিল, দুই দেশের সীমানা বরাবর বসবাসকারী উপজাতির দল। সর্বদাই অভিযাত্রীদের উপর যাদের ছিল তীক্ষ্ণ নজর। তিব্বতী ভাষায় তাঁর দক্ষতা আর বৌদ্ধ ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর প্রগাঢ় জ্ঞানের দৌলতে, এই প্রহরী উপজাতিদের হাত থেকেও সহজেই গলে বেরিয়ে যান শরৎচন্দ্র। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়া তথা একাত্ম হবার তাঁর ছিল এক অস্বাভাবিক সহজাত প্রবণতা।"   -শ্রী পরিমল ভট্টাচার্যের ভূমিকা থেকে খানিকটা বঙ্গানুবাদ।  Journey to Lhasa, The Diary of a Spy by Sarat Chandra Das

Wednesday, 8 April 2020

অনির ডাইরি, ৮ই এপ্রিল, ২০২০


#lockdown #lockeddown
কি যে সব হচ্ছে-। সারা দেশ করোণা আতঙ্কে গর্তে সেঁদিয়েছে, আর আমার বৃদ্ধ বেরোচ্ছেন দুধ আনতে। শুধু দুধ? চেপে ধরলে, ট্রেনের ওয়াগনের মত আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে আরো কত কি? দই(টক এবং মিষ্টি), বাতাসা--।  বাতাসা? ঘচাং করে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ে, সকালের ভিডিও কল। বাতাসা কি করতে অ্যাঁ? সুগারওলা লোকজনের বাড়িতে বাতাসা ঢোকে কেন? ধমকালে পাল্টা ধমকায় বৃদ্ধ। গলার জোর এবং বিক্রম দুইই বড় বেশী বৃদ্ধের।

মাঝপথে ফোন রাখতে বাধ্য হই, সদ্য কিনে আনা বাবার শেভিং ফোম, পাউডারের মত গালে মেখেছে আমার কন্যা। রীতিমত যুদ্ধ করে ফোম আর ক্ষুর কিনে এনেছে শৌভিক। ক্ষুর বললে, বড় রেগে যায় এরা শ্বশুর-জামাই। করোণার উৎপাতে মাথায় মুখে গজিয়েছে ঘণ জঙ্গল। বিগ বাস্কেটে নাপিত থুড়ি চুল-দাড়ি কাটার লোক পাবো কিনা জানতে চায় শৌভিক দুই বেলা। বাজারে গেলে করুণ চোখে তাকায়, বন্ধ সেলুনের দিকে। প্যাঁচ কষে, লক আউট উঠলেই, কাকডাকা ভোরে লাইন দেবে সেলুনের সামনে। কতবার বলেছি, আমিই পারব। ছোটবেলায় তো তুত্তুরীকে দিতাম কেটে খামচা কাট। তুত্তুরীর ঘণ আর কোঁকড়া চুল, কান কাটতাম, ধান হতো। মা অকারণ হাঁউমাউ জুড়ত। সে তুলনায় ছেলেদের চুল কাটা অনেক সহজ। এই তো সুকন্যা কি সুন্দর কেটে দিয়েছে উটোর চুল। দাড়িটাও কামিয়ে দেব, যদি আমার কাছে চুল কাটতে রাজি হয়- না হলেও দেব।  এদের বাপমেয়ে এত নাক উঁচু না, সেই দাড়ি কামালো, তাও আমাকে ক্ষুর চালাতে দিল না।  আবার বলে, করোণা যুদ্ধে প্রথম ক্যাজুয়ালিটি আমার দাড়ি।

দুপুর গুলো কাটে, রিপোর্ট আর তত্ত্বতলাশে। কোথায় কার বেতন হয়নি? কোথায় কে আটকে পড়েছে- সব মিটলে জেলা প্রশাসন থেকে আসে ফোন “যোগে ভুল আছে বুঝলেন তো। ১৭ জন কমবেশী আসছে। ” কি জ্বালা বাবা, করোণার সময় এক্সেলও যদি যোগে ভুল করে কি করি?

সব কেমন গড়বড় হয়ে যাচ্ছে। দুপুরে যারা ঘুমিয়েছিল, বিছানা তোলেনি কেউ। যত্ন করে, বালিশ চাদর বক্সে ভরে,সপাসপ ঝ্যাঁটালাম বিছানা। ভাবলাম,  বর খুশি হবে, সাবাশি দেবে। কচু। ঘেঁচু। কাঁচকলা। ষাঁড়ের মত চিৎকার করছে শৌভিক। রাতে শোবার জন্য বিছানা ঝেড়ে, সদ্য বালিশ-চাদর গুচিয়ে রেখেছিল- আমি নাকি কেঁচেগণ্ডুষ করেছি সব।

এবার ঘুমোতে যাব। এই লক ডাউনের বাজারেও এত ঘুম পায় কেন? তুত্তুরী রীতিমত ঈর্ষান্বিত। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও আপিসেরই স্বপ্ন দেখব, যেমন সেদিন দেখলাম, সারা দিন জুড়ে এজেন্ট-এসএলওদের ট্রেনিং। নব্যপ্রশাসনিক ভবনের গতিধারা হল কানায় কানায় ভর্তি। অথচ মূল ট্রেনার, ওরফে আমাদের এএলসি শ্রী সুখেন বর্মন, ট্রেনিং এর কথা বেমালুম ভুলে দার্জিলিং ঘুরতে চলে গেছেন। স্বপ্নে নিজের ধমকে নিজেই চমকে উঠি। সকালে বলাতে হেসে গড়াগড়ি যায় বর্মন। “ম্যাডাম আমি বলেছি, আমি ট্রেনিং হলের দরজার সামনে। আপনি ভুল শুনেছেন। ” সে তো গেল সেদিনের কথা। আজ আবার আমার দুই ইন্সপেক্টরকে স্বপ্ন দেখলাম- দেখলাম আমি দেখলাম সঞ্চিতা আর আমি গাছ কিনতে গেছি, কোন একটা নার্সারিতে। মালিকের সাথে কি নিয়ে যেন হাল্কা মতান্তর হল, ফলতঃ মালিক আমার গাছটা কেড়ে নিল। এই নিয়ে তুমুল ঝগড়া। তারপর নির্মলকে নিয়ে ইন্সপেকশন।  নির্মল যত বোঝাবার চেষ্টা করে,  ম্যাডাম, আপনার গাছটা কেড়ে নিয়েছে, এই অপরাধে মালিককে  কোর্টে তোলা যাবে না- ওর জেল-জরিমানাও হবে না।  ততো রেগে যাই আমি। স্বপ্নের মধ্যে বলেও দিলাম কি কি সব আইনে কেস দেওয়া যায়। মুস্কিল হচ্ছে যার একটাও নির্মলের পড়া নেই। “এ্যাইঃ  কাকে ধমকাচ্ছিস?” শৌভিকের গুঁতোয় যখন ঘুম ভাঙল, তখনও হেব্বি রাগ হচ্ছিল নির্মলের ওপর। হোক না স্বপ্ন। এত ফাঁকি কেউ মারে?

Monday, 6 April 2020

অনির ডাইরি ৬ই এপ্রিল, ২০২০


#লকডাউন #লকড_ডাউন
ঐ যাঃ। জামাটা আবার ভিজে গেল। রান্নাঘরের কলটা এত জল ছিটোয়, ঐ জন্যই সবিতা মাসি বাসন মাজার সময়, একটা পুরোনো  মোজা জড়াত কলের মুখে। আজ সকালে আবার ফোন করেছিলাম সবিতা মাসিকে। বেতন দিতে পারিনি এখনও। ফোন করলেই মাসির এক কথা, “ কি করে যাব বওদি? লকডাউন কবে উঠিবে কিসু জানো গো বওদি? কি খেয়ে থাকব বলো তো?” টাকা মাসের প্রথম দিন থেকেই তুলে আলাদা করে রেখেছি। বারবার জানতে চাই, চেনা পরিচিত কেউ যদি অাসে এদিকে, যার হাতে পাঠাতে পারি বেতনটুকু। অন্য কোন কাজের দিদি বা সিকিউরিটির লোক। সিকিরিটির গুমটিটাও কদিন ধরে খালিই পড়ে আছে। শৌভিক মানতে নারাজ,কিন্তু  আমি জানি গৃহবন্দি সিকিউরিটি গার্ডেরাও। মনের সুখে রাজত্ব করছে কেলে-লেলের দল। সকালে দোকান সেরে ফেরার পথে দেখি, ল্যাজ খাড়া করে চিৎকার করছে লেলোটা। জনমানবশূন্য আবাসনের পথ। দাঁড়িয়ে রইলাম প্রায় মিনিট পাঁচেক, যদি কোন সঙ্গী পাই। মাস্ক পরা এক কাকু মাছের থলি নিয়ে যেই ঢুকলেন, সুড়সুড় করে তাঁকে অনুসরণ করলাম। থেমে গিয়ে পিছন ফিরে তাকালেন ভদ্রলোক, অতঃপর আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইলেন, কি চাই? এইরে অনুপ্রবেশকারী ভাবল বোধহয়। চটজলদি বললাম, কুত্তায় আমার হেব্বি ভয়। আর যে ভাবে চিল্লাচ্ছে।পরিণাম এই হল, যে বাকি পথটা কাকু আমাকে কুকুরের ল্যাজ পুরাণ বোঝালেন।
আজকাল মাঝ রাতে উঠেও বাসন মাজি। খেয়ে উঠে আর ইচ্ছা করে না। ঘুমও তো আসে না ছাই। গতকাল রাত তিনটেয় ঘুমিয়েছি। রাতে ঘুম না এলেই বিকট খিদে পায়। পেট ভর্তি, তবু খিদে পায়। গতকাল সাড়ে বারোটার সময় উঠে, অবশিষ্ট রুটিটা মাখনচিনি দিয়ে খেয়ে ক্যাসারোলটা মেজে রাখলাম। ঠিক টের পায় শৌভিক। আমি ঘর থেকে বেরোলেই, পিছন থেকে জলদ গম্ভীর ধমক ভেসে আসে, “অ্যাই! কি খেতে যাচ্ছিস?” নিজের বাড়িতেও চোরের মত থাকতে হয় শা-
বাসন মেজে মেজে নখগুলোর অবস্থা খারাপ। মা দেখি নেলপালিশ পরেছে। আজ সকালে ভিডিওকল করতে গিয়ে দেখতে পেলাম। চীনের মুণ্ডপাত করছিল মা তখন, বিশেষতঃ চীনেদের খাদ্যাভাস নিয়ে মা দেখলাম বিশেষ বিব্রত এবং রাগাম্বিত। যে সব জিনিসপত্র চীনেরা খায় বলে মায়ের ধারণা দেখলাম, তা সোশাল মিডিয়ায় লিখলে চীন নির্ঘাত আমার নামে মানহানির মামলা ঠুকবে। কোন উৎসব, অনুষ্ঠানে তো পরে না, আজ হঠাৎ নেলপালিশ পরলে কেন? মা লাজুক হেসে জানাল, “ঐ তুই কিনে পাঠিয়ে দিয়েছিস। ” অনলাইন মাসকাবারির সাথে মাস কয়েক আগে মায়ের আবদারে একটা ল্যাকমের নেলপালিশ অর্ডার করেছিলাম বটে। সেটা শুকিয়ে যায়নি? ব্যাণ্ড এবং রঙটাও মা’ই ঠিক করে দিয়েছিল, লাল অথবা মেরুন। আজন্ম এই দুটি রঙই মায়ের পছন্দ। কেনে, কেনার পর আর রঙটা ভালো লাগে না, ফেলে রেখে শুকোয়। পরেছে দেখে আশ্বস্ত হলাম। রঙটা পছন্দ হয়েছে তাহলে? কপাল কুঁচকে মা জানাল, মোটেই না। কেমন যেন কেল্টে কেল্টে রঙটা। জানতে চাইলাম, তোমার কোন নেলপালিশ কোনদিন পছন্দ হয়? জবাব পেলাম, “তুই যেগুলো পরিস ঐ রঙগুলো পছন্দ হয়। তবে ওগুলো আমায় মানাবে না। ” আমি যেন কি পরি? বাঁ হাতের তর্জনী, মধ্যমা  আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে লেগে থাকা হাল্কা আভা আর পায়ের আঙুলে খাপছাড়া ভাবে লেগে থাকা রঙ মনে করায় সপ্তাহ দুয়েক আগেও বেশ শৌখিন ছিলাম আমি-

আজকাল রান্না করতে করতে যা পাই মুখে লাগিয়ে নি। সকালবেলা টক দইয়ের কৌটটা মাজার আগে অবশিষ্টাংশ লাগিয়েছিলাম মুখে। বিকালেও তুত্তুরী বলছিল, “মা তুমি চুরি করে মাখন খেয়েছ? তোমার গায়ে মাখন মাখন গন্ধ কেন?” সত্যিটা চেপে যাই। দুর্দিনে খাবার জিনিস গায়ে মাখলে খুব রেগে যায় শৌভিক। কদিন আগে একচামচ টক দইয়ে হলুদ গুঁড়ো মিশিয়ে গায়ে মেখেছিলাম বলে খুব অশান্তি হয়েছে বাড়িতে। ভালো করে ধোওয়া সত্ত্বেও তোয়ালে এবং কাচা জামায় লাগছিল হলুদ রঙ। জামাকাপড় কাচার ওপর শৌভিকের মনোপলি আছে। ওয়াশিং মেশিনে হাতও দেবার অধিকার নেই আমার। কুকমি না এভারেষ্ট কার যেন ছিল হলুদটা, ভুলে গেছি, এত পাকা রঙ, শৌভিক ঘষে ঘষেও তুলতে পারেনি তোয়ালে থেকে। তাই আজকাল আর হলুদ মাখি না। তবে অন্য অনেককিছু মাখি যা শৌভিক টের পায় না। যেমন সন্ধেবেলা তরকারিতে দেবার জন্য টমেটো ঘষে তার ছালটা ঘষে ছিলাম মুখে। প্রথম দিকে বেশ চিড়বিড় করছিল, তারপর কাজের চাপে যথারীতি ভুলেছি ধুতে। এখন মুখ ধুতে গিয়ে বেশ জ্বালা করছে।  নাঃ টমেটো নির্দোষ, দোষ আমার হাতের। লঙ্কা কুচিয়ে ভুলে গেলে যা হয়। নাঃ বেশ জ্বলছে, নাইটক্রীমের বোতলটা নিয়ে শৌভিককেই ধরি, যদি একটু মুখে লাগিয়ে দেয়-

Sunday, 5 April 2020

অরণ্যে আমরা- (c)Anindita Bhattacharya


জঙ্গলের ভিতরে একটা গ্রাম আছে। নির্ঘাত আছে, কাল দেখেছি, কয়েকজন আদিবাসী মহিলা মাথায় শুকনো কাঠের ঝাঁকা নিয়ে জঙ্গলে মিলিয়ে গেল।  পিছু ধাওয়া করতে গেলাম, সু হাতটা টেনে ধরল, “অনি, বেশী সাহস দেখিও না। এটা হাতি করিডর। বিপজ্জনক এলাকা।” জঙ্গলের রাণীর কথা কি আর, ফেলা যায়? সকাল সকাল হাতে গড়া রুটি আর পেঁপের তরকারি দিয়ে প্রাতঃরাশ সেরে হাঁটতে বেরিয়েছি সবাই। চতুর্দিকে ঘন সবুজ ঢেউ খেলানো পাহাড়, আর গভীর জঙ্গল। মাঝখান দিয়ে একফালি সরু পিচরাস্তা। চরাচর ব্যাপী অখণ্ড নিস্তব্ধতা, কেমন যেন চেপে বসছে কানের পর্দার ওপর।  ফুসফুসকে চেপে ধরছে অজানা এক রহস্যময়তা।  কি জানি কি হয় মার্কাD অদ্ভুত এক ভয়। বিদিশা দি আর দেবশ্রী দি হাঁটছে সবার আগে। দুজনের পিঠে পিট্টু টাইপ ব্যাগ। ব্যাগে ভরা জলের বোতল। আর বাদাম পাটালি। বাদামপাটালি গুলো আসার পথে এক ছোট্ট গুমটি থেকে কেনা। এক অনামী পাহাড়ি ঝর্ণা দেখতে সবকটাকে নামিয়েছিল অর্ণব দা। লাল কাঁকড়ে পাহাড়ের বুক চিরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পুঁচকে জলরাশি। নভেম্বরের শেষ।R ক্রমশঃ শুকিয়ে আসছে জলধারা। ধারাপথে জেগে উঠছে বড় বড় গোলাকার পাথর। অনেকটা চড়াই-উতরাই ভেঙে ওঠানামা করে হাঁপিয়ে পড়েছিলাম সবাই।চাঙ্গা করতে ত্রিদিবেশ দার দাওয়াই ছিল, শশা। একটাই মাত্র গুমটিতে বসেছিল একজন কৃশকায় ব্যক্তি। গুটি কয়েক পাকা শশা আর সাতটা বাদাম পাটালি নিয়ে। ঝাল নুন মাখানো শশার ফালি সত্যিই ফিরিয়ে দিয়েছিল প্রাণ। বাদাম পাটালি খেতে চাইছিল তুত্তুরী। আমি পয়সার ব্যাগ নিয়ে নামিনি। দরকারও নেই। ত্রিদিবেশ মামা আর অর্ণব কাকু থাকতে বাবা -মায়ের খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না তুত্তুরীর। ত্রিদিবেশ দা একটা বাদাম পাটালি কিনছিল, দেবশ্রীদি তুলে নিল সাতটাই। দেবশ্রীদির দূরদৃষ্টিK সীমাহীন। কি অসম্ভব ভালো খেতে পাটালি গুলো। চিবোতে চিবোতেই হাঁটছি আমরা। গতকাল রাতেও হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। সুকন্যা আর আমি। চুপিচুপি। বরগুলো জানতে পারলেই চিল্লাবে।বাচ্ছাগুলো গল্প শুনছিল দেবশ্রীদির কাছে।খোলা বারন্দায় আলো নিভিয়ে গল্প জুড়েছিল ছেলেরা। বিদিশাদি বসেছিল কি যেন একটা বই নিয়ে।    আমি আর সু কোন দলেই ঠিক ফিট হলাম না। তাই আর কি-
বেরিয়েছিলাম গল্প করব বলে, বাংলোর চৌহদ্দি ছাড়াতেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লাম। আকাশে  বিরাজমান পূর্ণচন্দ্র। শীতল বাতাসে জঙ্গলী ফুলের সুবাস, ভেসে আসা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। মনে হয়েছিল চতুর্দিকে কেউ যেন উল্টে দিয়েছে কালো কালির দোয়াত। আর সেই মসিকৃষ্ণ চরাচরের ওপর ছড়িয়ে পড়েছিল জোছনার রূপালী দোপাট্টা। মোহিত মন্ত্রমুগ্ধের মত হাঁটছিলাম আমরা। যেন ধ্বংস হয়ে যাওয়া পৃথিবীর অন্তিম দুই মানবী। খেয়াল করিনি, কারা যেন পিছু নিয়েছিল নিঃশব্দ চরণে। একটা বাঁকের মুখে পথ আটকাল তারা, “মেমসাহেব এবার ফিরে যান। এটা হাতি করিডর তো।ঐ দূরে দেখতে পাচ্ছেন ঐটা দলমা পাহাড়। ঐখান থেকে সটান নেমে আসেন তেনারা। মানুষ দেখলে খেপে যান আইজ্ঞা। ” কোন পাহাড়টা যে দেখালো বুঝলাম না, তবে মেমসাহেব অর্থাৎ সুকন্যার নিরাপত্তা নিয়ে ওরা যে বিশেষ উদ্বিগ্ন সেটা বুঝলাম। বিনা বিবাদে ফিরে গিয়ে ছিলাম আমরা। আজ তাই খোঁজার চেষ্টা করছি দলমা পাহাড় কোনটা। যেদিকে আঙুল দেখিয়েছিল সেদিকে ঢেউয়ের মত ছড়িয়ে পড়েছে সবুজ সবুজ পাহাড়। এদেরই কোনটা দলমা হবে-
পিছন ফিরে দেখলাম তিনটে বাচ্ছাকে গাছে চড়তে শেখাচ্ছে অর্ণব দা। উটো ফার্স্ট। প্রায় মগডালে উঠে বসে আছে শাখামৃগের মত। উজান অতি সাবধানী। অপেক্ষাকৃত নিরাপদ, মোটা দেখে ডালে বসেছে। তুত্তুরী এবার হাঁচোরপাঁচোর করে উঠছে। উটো কি যেন একটা বলল, রেগে গিয়ে হাওয়াতে হাত পা ছুঁড়ল তুত্তুরী। সবার পিছনে এত্ত বড় লেন্স নিয়ে ত্রিদিবেশ দা, ছবি তোলা নিয়ে কি যেন শেখাচ্ছে শৌভিককে। বাধ্য ছাত্রর মত ঘাড় ঘুরিয়ে শুনছে শৌভিক।
সুকন্যা কি যেন বলে উঠল, ওর দিকে ফিরে তাকালাম। অন্যমনস্ক ভাবে সুকন্যা বলছে,“আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে আমি এই পথ ধরে আগেও হেঁটেছি। সেটাও তোমার সঙ্গেই।” বলতে গেলাম ডেজা ভ্যু। বলতে পারলাম না। সত্যিই তো এই দৃশ্যগুলো বড় বেশী চেনা। যেন মনে হয় আদি অনন্তকাল ধরে হেঁটে চলেছি এই পথ ধরে। ভাবতে ভাবতে অজানা আতঙ্কে কাঁটা দিয়ে উঠল গায়ে।
“ওঠ রে। বেড়াতে এসে কেউ এত ঘুমোয় নাকি। ” বলে ধাক্কা মারল শৌভিক। স্বপ্ন দেখছিলাম তাহলে। চটজলদি তৈরি হয়ে নীচে নেমে দেখি, অর্ণবদা বাদে বাকি সবার স্নান সারা। ক্যাসারোলে করে প্রাতঃরাশ দিয়ে গেছে। হঠাৎ ভীষণ শীত করতে লাগল আমার। আমি জানি কি আছে,ঐ ক্যাসারোলে। রুটি আর পেঁপের তরকারী। কালও তাই ছিল। তার আগের দিনও। তার আগের দিনও। না জানি কত শত সহস্র বছর ধরে তাই থেকে আসছে। আমি জানি, কেন আসে না কোন খবরের কাগজ। কেন চলে না মোবাইল। কেন চলে না টিভি। আমি জানি খেয়ে উঠেই হাঁটতে বেরোব আমরা। বিদিশা দি আর দেবশ্রীদি পিঠে নেবে পিট্টু। তাতে থাকবে জল আর বাদাম পাটালি। তিনটে বাচ্ছাকে গাছে চড়াবে অর্ণবদা। শৌভিককে ফটোগ্রাফি শেখাবে ত্রিদিবেশ দা। আমি জানি দীর্ঘপথে আসবে না একটাও গাড়ি। চোখে পড়বে না অন্য কোন জনমানব। ঠিক একটা বাঁকের মুখে সুকন্যা আবার বলে উঠবে, “আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে আমি এই পথ ধরে আগেও হেঁটেছি।” আর তারপরই আবার ঘুম ভাঙাবে শৌভিকের ডাক। আবার প্রস্তুত হয়ে নামব আমি-। কাঁধে হাত রাখল সুকন্যা, “অত ভেবো না। এর থেকে ভালো আর কি হতে পারত-”।

পুনশ্চঃ সব চরিত্র কাল্পনিক। শুধু ধার নিয়েছি কিছু প্রিয়জনের নাম।