Saturday 11 February 2023

অনির ডাইরি ৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 


ছোট থেকে বাবা শিখিয়েছে,‘প্রত্যাশাতেই যন্ত্রণা’। এতদসত্ত্বেও কেন যে বারবার প্রত্যাশা করেই ফেলি। সিস্টেমের কাছে প্রত্যাশা করি সংবেদনশীলতা, সময়ের কাছে কখনও প্রত্যাশা করি দ্রুততা, তো কখনও বা ধীরতা। খেতে বসে প্রত্যাশা করি মুখরোচক কিছু। যা স্বাদে হবে অমৃতসম অথচ ক্যালরি থাকবে গ্রীন টি তুল্য। বাসের কাছে প্রত্যাশা করি সিট। রাতের কাছে প্রত্যাশা করি নিশ্ছিদ্র ঘুম। কিন্তু তার কি যো আছে।


 ভগবান জানে রোজ রাতে কার কার মনে পড়ে আমার বরের কথা। গতরাতেই তো পৌনে বারোটা নাগাদ  ফোন করেছিলেন জনৈক উকিল বাবু। কি অসাধারণ জাঁকিয়ে এসেছিল ঘুমটা। ধড়মড় করে উঠে বসে ভাবলাম নির্ঘাত কোন মাতাল। অচেনা নম্বর দেখে শৌভিকও বলল,‘তাই হবে।’ ধরার পর দেখা গেল ভদ্রলোক শৌভিকের পূর্ব পরিচিত। তমলুকে থাকতে নিত্য যোগাযোগ ছিল। ফোন ধরা থেকে ছাড়ার মধ্যে সময় কাটল পাক্কা দশ মিনিট। পুরোটাই চলল আমার কানের গোড়ায়। কি নাকি সাংঘাতিক কেস ঠুকেছে কে, বিবাদী পক্ষের অগ্রগণ্য মহকুমা শাসক কাঁথি। ফোন রেখে শুতে শুতে আমার বর বলল,‘লোকটা ভালো। বুঝলি তো।’ 


এরকম হাড় জ্বালান ভালো লোকেই ভর্তি আমার বরের জীবন। আমার জন্য সময় কোথা। যেটুকু সময় পায়, সেটাও কাটে আমার খুঁত ধরে, যেমন ধরুন -'বিছানায় ভিজে তোয়ালে রাখলি কেন?' 'সেই আমার চশমার ওপর ব্যাগটা রাখলি!' যেমন ধরুন 'তুই তো বসিস না, তোর পতন হয়। তাই বলে আমার ফোনের ওপর পড়বি?' ইত্যাদি প্রভৃতি। ঘুরিয়ে আমি যেই মুখ খুলি ওমনি শুনতে হয়,‘ তুই কিন্তু একটুও ঘ্যানঘ্যান করছিস না।’ ধুর ধুর। শাশুড়ী মা ঠিকই বলেন, বেঁচে থেকে কোন লাভ নেই। 


আমার বদমেজাজ, আমার ধমক, আমার বকবক শোনে একমাত্র উত্তমকুমার। প্রতি তিনদিনে একবার যাকে আমি তাড়িয়ে দিই পাঁচমিনিটের জন্য। পাঁচ মিনিট পর অবশ্য আবার ডেকে আনি এবং রসগোল্লার পায়েস খাওয়াই। আজ বাস থেকে নেমে গাড়িতে উঠতেই উত্তমকুমার বলল, ‘এই বেলা ফাঁকায় ফাঁকায় নিমতৌড়ির ঠাকুরটা দেখে আসবেন চলুন ম্যাডাম।’ অফিসের পাশেই বিশাল ভীম পুজো। সন্ধ্যে নামলে ভিড় করেন দর্শনার্থীরা। সকাল বেলা অবশ্য ফাঁকা ময়দান। তবে গাড়ি ঢুকল না। নেমে খানিক হেঁটে ঠাকুর দেখতে হল। দুপাশে অসংখ্য দোকান। সাজিয়ে বসেছে পসরা। ভাজা হচ্ছে গরম জিলিপি,বোঁদে, গুড় কটকটি আর খাজা। ফেরার পথে লোভ সংবরণ করতে না পেরে কিনেই ফেললাম এক কিলো। উত্তমকুমার যদিও আপত্তি করছিল,‘ কিনবেননি ম্যাডাম। আজ আবার ওবেলায় অমিয়দার বাড়ি নিমন্ত আছে।’ 


অমিয় বাবু আমাদের গাড়ির মালিক। গত সপ্তাহে একদিন কাঁচুমাচু মুখে এসে নিমন্ত্রণ করে গেছেন বটে। ওণার বাড়িতে প্রভুপাদ আসবেন। নামগানের আসর বসবে। তার সাথে সাথে ওণার মেয়েরও জন্মদিন। যদি লেবার দপ্তরের লোকজন একটু পদধূলি দেয়। আমি ভেবেছিলাম বিলের কথা বলতে এসেছেন বুঝি। গরীব শ্রম দপ্তর। ধারবাকিতে অফিস চলে। সব সময়ই পাওনাদারদের ভয়ে শঙ্কিত থাকি। তাগাদার পরিবর্তে নিমন্ত্রণ পেয়ে রীতিমত গলে গেলাম। শুধু নামগান হলে যেতাম না হয়তো, মেয়ের জন্মদিনের নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করি কেমনে। 


চাঁদা তোলা এবং উপহার কেনার দায়িত্ব সামলান মূলতঃ আমাদের হক বাবু। কিছুদিন ধরে সুগারে প্রেসারে কিঞ্চিৎ কাবু লোকটা। মাঝে দিন দুয়েকের ছুটি নিয়ে ভুবনেশ্বর গিয়েছিলেন, এইমস্ এ দেখাতে। এদিকের লোকজন স্থানীয় ডাক্তার বা কলকাতার হাসপাতাল- ডাক্তারদের থেকে অনেক বেশী ভরসা করে এই এইমস্ কে। অফিসে ঢুকে হক বাবুকে জিজ্ঞাসা করলাম  ভুবনেশ্বরের এইমস্ কি ওণাকে মেলার খাজা খাবার অনুমতি দিয়েছে।


আহাঃ, যেমন গরম তেমনি মোলায়েম খাজাগুলো। মুখে দিতেই যেন মিলিয়ে যায়। দোকানদারের কাছে প্রত্যাশা ছিল দুটো ফাউ দেবে। যথারীতি প্রত্যাশাতেই যাতনা। তিনি বললেন, ‘কুড়ি হাজার টাকা দিয়ে দোকান দিইছি দিদিমনি। ফাউ দি কেমনে?’ বাপরেঃ। জিজ্ঞাসা করলাম এত টাকার আদৌ বিক্রি হয় কি না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,‘ সেই তো।’ উত্তমকুমার যদিও বলল,‘এই বুড়া গুলোর কথায় একদম বিশ্বাস করবেননি ম্যাডাম। অবশ্যই লাভ হয়। নইলৈ কেউ ঘরের টাকা দিয়ে দোকান দেয়-’।


দুপুরে খাবার নিমন্ত্রণ। পূব মেদিনীপুরে এই সময় বিভিন্ন অঞ্চলে এই ধরণের অনুষ্ঠান হয়। কোথাও কৃষ্ণ তো কোথাও কালির নামে। সারা গ্রামের নিমন্ত্রণ থাকে। উত্তম বলে এই সময় নিমন্ত্রণ কর্তা ছাড়া অন্য কারো বাড়ি হাঁড়ি চড়ে না। কুটুম এলেও তাকে নিয়ে চলে আসে নিমন্ত্রিত বর্গ। নিমন্ত্রণ কর্তা যা খাওয়ান, তাই সবাই মাটিতে বসে তৃপ্তি করে খায়। গ্রামের ছেলে পিলেরাই পরিবেশন করে দেয়। উত্তম যেমন সকাল থেকেই বলছে,‘আজ যদি আমি থাকতাম নি ম্যাডাম, অমিয়দার বাড়ি, সব পরিবেশন আমিই করে দিতাম। হুহু করে পরিবেশন করতাম, হুহু করে পাতা গুড়াতাম।’ পাতা গুড়ানো মানে এঁটো পাতা তোলা। 


আমি আজ অবধি ঐ কাজটায় স্বচ্ছন্দ নই। প্লেট যাও বা তুলে নিতে পারব,উচ্ছিষ্ট ফেলতে বমি এবং কান্না পায়। ‘না না বিয়ে শাদি ঐসবের পাতা গুড়াতে হলে আমারও বমি পায় ম্যাডাম। ওসব করি না। পুজো- নামগানের সময় গুড়াই। পূণ্যি হয় কি না।’ গাড়ি চালাতে চালাতে বলে উত্তমকুমার। বেরোতে একটু দেরী হয়েছে। সূর্য মধ্য আকাশ থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে পশ্চিমের দিকে হাঁটা লাগিয়েছেন। শুধু আমার জন্যই সবার লেট হল। ভুলে গিয়েছিলাম মিটিং ডাকা ছিল। কি ভাগ্যি বেরোবার একটু আগেই এসে হাজির হয়েছিল দুই পার্টি। 


বিগত দশ না পনেরো বছর ধরে অমিয় বাবুর গাড়ি খাটছে এই অফিসে। ফি বছর নিমন্ত্রণ করেন, কিন্তু এর আগে কোন সাহেব/মেম নাকি ওনার গৃহে পদার্পণ করেনি। আমরা সদলবলে খেতে যাব, বলে ওণার আনন্দের সীমা নাই। আমাদের ছোট গাড়িতে সবাই ধরবে না বলে ওনার বড় গাড়িটাও পাঠিয়ে দিয়েছেন।  উত্তমকুমারের গাড়িতে চারজন, বাকিরা পিছনের বড় গাড়িতে। তাও স্থান সংকুলান হয় না।  উপহারের বড় পুতুলটা কোলে নিয়ে বসেছি আমি। বড় মিষ্টি পুতুলটা। উত্তম সমানে বলছে, ‘অমিয়দার মেয়েকে দেখবেন চলুন না, একেবারে অমনি দেখতে। ওর নামও মিষ্টু।’ 


ঘুরে ফিরে আবার পাতা গুড়ানোর গল্পে ঢোকে উত্তমকুমার।‘ আজকাল তো লোকে অনেক ভালো করে খায় ম্যাডাম। ছিবড়া গুলো পাতের এক পাশে রাখে। পাতায় জল ঢেলে হাত ধোয় না। ওসব করলে দেখতেন। পাতা গুড়াতে সব থেকে সমস্যা কোথায় হয় জানেন? মাঠে যখন খাওয়ায়। এবড়ো-খেবড়ো মাটির ওপর পাতা পেতে খায় তো মানুষ-’।  কি হয়? জল পড়ে কাদা হয়ে যায়? জানতে চাই আমি। ‘ হ্যাঁ কাদা তো হয়ই। তারপরে ভাত যেগুলো পড়ে, মাটির সাথে মিশে যায়। একটা একটা করে গুড়ানো, ওরে বাবারে বাবা। কি চাপের কাজ ম্যাডাম।’ 


শহর ছাড়িয়ে শহরতলী থেকে আরো একটু ভিতরে ঢুকি আমরা। বড় গাড়িটা দাঁড়িয়ে যায় খোলা মাঠে। বাকি পথ টুকু সওয়ারিদের পায়ে হেঁটে যেতে হবে। উত্তম বলে,‘বেশী নয়। পাঁচশ মিটার মাত্র। আমার গাড়ির পিছন পিছন হাঁটতে থাকো সবাই।’ আমাদের গাড়িটা যাবে? প্রশ্ন করি আমি। জবাব পাই, ‘আগে তো গাড়িটা এখেনেই রেখে যেতাম ম্যাডাম। এখন বাড়ি লিয়ে যাই।’ উত্তমের বাড়ি কাছেই। ওদেরও সপরিবারে নিমন্ত্রণ। কাল রাতেও ছিল। উত্তমের মা, বউ, ছেলে সবাই নামগান শুনতে এসেছিল। আজও এসেছে। তবে আমাদের যা বেলা হল, নির্ঘাত এতক্ষণে বাড়ি ফিরে গেছে। 


সরু ঢালাই রাস্তা ধরে টলমল করতে করতে এগোয় গাড়ি। দুদিকে পুকুর। একটু বেসামাল হলেই কেলো। উত্তম বলে,‘এ কি দেখছেন ম্যাডাম। এক পশলা বৃষ্টি হতে দেন। এই রাস্তা এক ফুট জলের তলায় চলে যাবে।’ এখনই পুকুরগুলো যা টলটল করছে, তা হওয়া বিচিত্র নয়। শীতের শেষ দুপুরে মাটির উঠোনে, কমলা-সোনালী রোদের ওমে চুল খুলে গল্প করছে পল্লীবালার দল। যেন পটে আঁকা ছবি। তাদের পাশ কাটিয়ে অমিয় বাবুদের বাড়ি যখন পৌঁছালাম শেষ ব্যাচ খেয়ে উঠছে।


আগে ঠাকুর দেখতে নিয়ে গেলেন অমিয় বাবু। রাধাকৃষ্ণ ততোক্ষণে নিদ্রা গিয়েছেন। কাপড়ের মশারি দিয়ে ঘেরা তাঁদের চারিধার। দোতলায় নিয়ে গেলেন অমিয় বাবু। জুতো খুলতে গেলাম, সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিষেধ করলে। অমিয় বাবুর গিন্নী ভয়ানক রূপসী, মিষ্টি হেসে বললে,‘আজকে সব চলে। এমনিতেই বাড়ির যা অবস্থা। জুতো পরেই আসুন।’ দোতলাটা ভারি সুন্দর, লাল টুকটুকে দালানের একদিকে দু-তিনটে ঘর আর অন্যদিকটা খোলা বারন্দা। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। 


আমাদের আর নীচে বসে খেতে হল না। আমাদের জন্য দোতলায় চেয়ারটেবিল সেট করা হল। অমিয় বাবু নিজে দাঁড়িয়ে থেকে খাওয়ালেন। ফুলকপি, মটরসুটি,কাজু বাদাম আর চেরি দেওয়া ফ্রায়েড রাইজ, ফুলুরির মত ভেজ পকৌড়া, আলু পটলের দারুণ সুস্বাদু তরকারি, পনীর, সাদা ভাত, ডাল, ইঁচড়ের তরকারি, চাটনি, পাঁপড়, রসগোল্লা আর নবদ্বীপের দই। প্রভুপাদের ঠিক করে দেওয়া মেন্যু। ঠাকুর, এরা বলে পূজারিও কোন বড় আশ্রম থেকে আনা। যোগাড় যন্ত্র অবশ্য প্রতিবেশিনীরাই করে দিয়েছে। জীবনে প্রথম বার নবদ্বীপের দই খেলাম। দারুণ লাগল। সবথেকে ভালো লাগল ওণাদের আতিথেয়তা। বাইরে অবধি ছাড়তে এলেন সপরিবারে। অমিয় বাবুর স্ত্রী আর মা বোধহয় সাড়ে সতেরো বার বললেন, ‘আবার এসো কেমন।’ 


ফেরার পথে আবার সেই একদল গাড়িতে, একদল পদব্রজে। সেই উত্তমকুমারের বকবকম। " আমাদের পাড়ার ভীমটা দেখবেন চলুন।" গতবারও বুরারীর ভীমের দর্শন পেয়েছিলাম, এবার অবশ্য দেখা পেলাম না। সামনেই কি যেন কালি পুজো হবে বলে, উত্তমের ভাষায়, " হায়, ঠাকুরটাকে ফেলে দিইছে?" বার দুয়েক সংশোধন করে দিলাম, বলো বিসর্জন দিয়েছে বা জলে ফেলে দিয়েছে। কে কার কথা শোনে। উত্তমকুমার ব্যস্ত হয়ে পড়ল এবার কালি পুজোর বিশেষত্ব বর্ণনে। সাতদিন ধরে পুজো হবে, গোটা গাঁয়ের লোক খাবে ইত্যাদি, প্রভৃতি।  ফাঁক পেয়ে ফোন করলাম তুত্তুরীর বাপকে, " হ্যাঁ গো, আজ জেলায় আসবে নাকি?" প্রশ্নের জবাবে ওদিক থেকে ভেসে এল প্রশ্ন, "কেন?" নাহ তাহলে এক পেট খেয়ে আর বাসে করে ফিরতে হয় না। তোমার সাথেই -।" ভেসে এল মৃদু ধমক, " খামোখা তোকে আনতে আমি জেলায় যাব কেন? আমার কাজ নেই? অত খায় না। বাসে ওঠ, রূপসীতে নাম। ওখান থেকে বরং তোকে নিয়ে আসব।" রূপসী বাইপাস থেকে আমাদের নীড়, হেঁটে ১০/১৫ মিনিট, গাড়িতে ৫। ঐটুকু কষ্টই বা কেন করবে আমার বর। আহা গো,তাঁর কি কাজ নেই? করুক,করুক, দেশোদ্ধার করুক মন দিয়ে। শাশুড়ি মা কি সাধে বলেন, কোনই লাভ নেই বুঝলেন কি না।



No comments:

Post a Comment