#অনিরডাইরি #birthdaygift_birthdaytrip
জন্মদিন নিয়ে আমার আদিখ্যেতা বরাবরই। সমস্ত প্রিয়জনের শুভ জন্মদিনে ঠিক মধ্যরাত্রে ফোন করে উৎপাত করি আমি। আর নিজের জন্মদিনে বসে থাকি ‘উৎপাতিত’ হব বলে। ঘড়ির কাঁটা মধ্য রাত্রিকে স্পর্শ করার সাথে সাথে যদি কেউ শুভ জন্মদিন বলে আলিঙ্গন না করে, ফোন/মেসেজ না করে তো হেব্বি দুঃখু পাই, জানেন তো।
সত্যি কথা বলতে কি আমার আগে আমার পিতৃ বা মাতৃকুলে সেভাবে কোনদিন কোন মেয়ের জন্মদিন পালিত হয়নি। ছেলেদেরই বা হত কোথায়? মনে থাকলে মায়ের হাতের এক বাটি পায়েস, খুব জোর একখান নতুন জামা। ব্যাস্ ঐটুকুই।
ওরই মধ্যে অবশ্য ছোটদা আর আমার জন্মদিনটা পালিত হত বেশ জবরদস্ত ভাবে। আট বছর তফাতে হলেও একই দিনে জন্মেছিলাম যে মোরা। গুণু আর ঝুনু। সেই দিনটাও কোন যে-সে দিন নয়। খাস ২৩শে জানুয়ারী।
ঘুম ভাঙত প্রভাতফেরীর আওয়াজে। ঘুম ভাঙার সাথে সাথেই এক গাদা মিষ্টি আর পেস্ট্রি সাজিয়ে মুখের কাছে ধরত আমার জ্যাঠাইমা। ঠাকুমার নির্দেশ মত শীতলা তলায় আমার নামে পুজো দিয়ে প্রসাদ নিয়ে আসত পিসি। তারপরই সাইকেল নিয়ে চলে আসত বড়দা বা সেজদা। সাইকেলে চেপে পা দোলাতে দোলাতে সোজা বড়মাসির বাড়ি। বড়মাসির রান্নাঘরের ছাতে পতাকা তোলা হত, উফঃ সে কি উত্তেজনা। উপহার দিত ছোট আর সেজ মাসি। বেশির ভাগ বছরেই উপহার বলতে ওদের হাতে বোনা সোয়েটার। কদাচিৎ নতুন জামা। মেজদা দিত বই। আর সারা বছর চুলোচুলি করা ছোটদা, ওই দিন পকেটমানি বাঁচিয়ে ছোটবোনকে কিনে দিত চকলেট।
উপহার এবং জলখাবার পর্ব মিটলে, বড়দার হাত ধরে সোজা অবসরের মাঠে। জানি না আজও হয় কি না,সেই সময় ঠিক মধ্যাহ্নে নেতাজীর বয়স ধরে বোমা ফাটাত হাওড়া ইছাপুরের অবসর সম্মিলনী। মাঠের সীমানা জুড়ে ঝোলানো থাকত পাটের পেটো বোম। বাতি না লম্ফ জানি না কি দিয়ে যেন আগুন লাগানো হত বোমাগুলোয়, সে কি আওয়াজ, সাথে ‘জয় হিন্দ’ আর ‘বন্দেমাতরম’। শক্ত করে ধরে থাকতাম বড়দার হাত।
কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী আমার মা, ছুটি পেত না আমার জন্মদিনে। কাউন্টার ডিউটি সামলে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ঘনাত সন্ধ্যে। দুই ভাইবোনের জন্য জন্মদিনের পায়েস রাঁধত বড়মাসি। বোতলে করে আসা হরিণঘাটার দুধ দিয়ে, বেঁটে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে। মধ্যাহ্ন ভোজন বলতে চাকা চাকা বেগুন ভাজা, মুগের ডাল, ভাত আর খাসির মাংস। যার মেটেটা বড়মাসি প্রতিবারই তুলে রাখত শুধু আমার জন্য। ভাড়া বাড়ির ছোট্ট দালানে, বড়মাসিকে ঘিরে গোল করে খেতে বসতাম আমরা পাঁচভাইবোন আর বড়মেসোমশাই। সেই আনন্দ আর উত্তেজনার স্মৃতি আজও অমলিন।
বহু বছর চলেছিল আমাদের যুগ্ম জন্মদিন পালন। তারপর যা হয় আর কি। সবাই বড় হয়ে গেলাম। স্বাবলম্বী হলাম। একা থেকে হলাম দোকা। ইদানিং জন্মদিন মানেই ছিল গুরুজনদের আশির্বাদ সুলভ ফোন। উমার হাতের পায়েস। চৈতালীর ‘জয়তু অনিজী’ সম্ভাষণ। ফেসবুক, হোয়াট্সঅ্যাপ, ইন্সাগ্রাম,মেসেঞ্জারে আসা গুচ্ছ গুচ্ছ শুভকামনাপূর্ণ বার্তা। বেলা শেষে বাবা-মা আর পিসিকে প্রণাম করতে যাওয়া আর অবশ্যই পার্কস্ট্রিটে ভুঁড়ি ভোজ।
এবছর সব কিছুই কেমন যেন ঘেঁটে গেছে। কোথায় আমি আর কোথায় উমা। আমি বাড়ির সবার জন্মদিনে পায়েস রাঁধব, আর আমার জন্য রাঁধবে উমা এই প্রতিশ্রুতি দিয়েও রাখতে পারলাম কই আমরা। বরেদের কর্মসূত্রে একজন কাঁথি আর একজন দুর্গাপুরের বাসিন্দা। পার্কস্ট্রিট ও বহু বহু দূর, দেড়শ কিলোমিটারেরও একটু বেশী।
ডিনার করতে কোথায় যাওয়া যায় এই নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই মস্তিষ্ক প্রক্ষালণ করছিল শৌভিক। মাঝে মাঝে এসে জিজ্ঞাসা করছিল,‘মান্দারমণি যাবি কি?’ ঘরের পাশেই মান্দারমণি, বিগত দেড় বছরে বিশেষতঃ এখানে এসে অবধি অগুণতি বার গেছি। আর ওখানে মোটেই মোহিত বা সিজলার পাওয়া যায় না। ‘তাহলে দীঘা?’ জানতে চায় শৌভিক। ‘ভাব। ভাব। ভাবা প্রাকটিশ কর।’ জবাব দিই আমি। তোদের জন্মদিনে কি তোদের জিজ্ঞাসা করি আমি? যা কিছু ভাবনা-চিন্তা-কর্ম সবই তো থাকে আমার।
অনেক ভেবে চিন্তে একটা পরিকল্পনা বানায় আমার বর। এ বছর বার্থ ডে ট্রিট নয়, বার্থ ডে ট্রিপ দেবে আমায়। ‘ভেবে দেখ, এ বছরের জন্মদিনটা এমন কোথাও কাটাতে চাস কি না, যেখানে না ককটেল থাকবে না কন্টিনেন্টাল খাবার-দাবার। না থাকবে ফেসবুক না হোয়াটস্অ্যাপ। এমনকি হয়তো থাকবে না ফোনের টাওয়ারও। থাকবে কেবল জঙ্গল আর পাহাড়। যাবি কি?
ঠিক এক পায়ে লাফিয়ে না উঠলেও রাজি হয়ে যাই। টিকিট কাটে শৌভিক। জঙ্গলের মধ্যে নেচারক্যাম্প বুক করে শৌভিক। দিন যায়। বিশে জানুয়ারী রাত দশটা কুড়িতে আমাদের ট্রেন। উনিশ তারিখ রাত অবধি কিছুই গোছাই না আমরা। কি হবে গোছগাছ করে। শেষে যদি অনুমতি না পেলে। শেষে সেই মান্দারমণিতেই যেতে হবে হয়তো।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য অনুমতি মিলেই যায়। শুক্রবার রাতের ট্রেন, শনি-রবি-সোম তো এমনিই ছুটি। মঙ্গলবার কাক না ডাকা ভোরেই ফিরে আসছি আমরা।এই অবসরে আর কিই বা সমস্যা হতে পারে। বিশে জানুয়ারী ভোরে স্কুল যায় তুত্তুরী। অফিস যায় শৌভিকও। ব্যাগ পত্তর গোছানোর দায়িত্ব পড়ে এই অধমের ওপর। কি আর করা, জন্মদিনটাও আমার যে।
ব্যাগ পত্র সহ রাতের খাবার গুছিয়ে নিয়ে কাঁথি থেকে ত্রয়ী যখন বেরোলাম ঘড়িতে তখন সন্ধ্যে ছটা। শুক্রবার অঙ্কুরহাটি আর সাঁতরাগাছির জ্যাম কাটিয়ে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই ঘোষিকার মধু ঢালা কণ্ঠ জানিয়ে দিল, কুড়ি নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসতে চলেছে আমাদের ট্রেন। ট্রেনের নাম সম্বলেশ্বরী এক্সপ্রেস। চটজলদি কয়েক বোতল জল কিনে, ব্যাগপত্র এবং শ্রীমতী তুত্তুরীকে টানতে টানতে আমরা যখন ট্রেনে উঠলাম ঘড়িতে দশটা দশ। বাঙ্কের নীচে সুটকেসটা ঢুকিয়ে সবে যে যার বাড়িতে ফোন করতে যাব, মাননীয় মহকুমা শাসকের মুঠো ফোনটি সজোরে চিৎকার করে উঠল। এত রাতে আবার এ অত্যাচার কেন রে বাবা। উল্টোদিক থেকে ভেসে এল সংবাদ, কেন্দ্রীয় দল আসছে, তাঁরা পর্যবেক্ষণ করতে আসবে কাঁথির বিভিন্ন ব্লক। সেখানে হাজিরা দিতে হবে মহকুমা শাসককেও। যে গাড়িতে হাওড়া এসেছি, তার ড্রাইভার বোধহয় বেশী দূর যায়নি। তাহলে কি নেমেই পড়তে হবে ট্রেন থেকে।
অনির (জন্মদিনের) ডাইরি ২১শে জানুয়ারি, ২০২৩
পর্ব -২
#অনিরডাইরি #birthdaygift_birthdaytrip
যদিও ট্রেনের নাম সম্বলেশ্বরী এক্সপ্রেস, যাবে বহুদূর। সেই জগদলপুর। পথে অবশ্য আমাদের নামিয়ে দিয়ে যাবে যথাস্থানে। নটা নাগাদ সম্বলপুর পৌঁছানোর কথা,বেশি না মাত্র আধ ঘন্টা লেটে নামাল ট্রেন। তখনও কুয়াশার চাদরে মোড়া চরাচর। ভালো করে রোদ ওঠেনি। কুয়াশার জন্যই সামান্য লেট করেছে ট্রেনটা।
সম্বলপুর বেশ বড় স্টেশন। জংশন। খুব পরিচ্ছন্ন। মিনিট পনেরো দাঁড়ায় ট্রেনটা, ফলে আড়ামোড়া ভেঙে ধীরে সুস্থে নামা যায়। সম্বলপুরেও থাকা যায়, হোটেল এমনকি পান্থ নিবাসও আছে। আমাদের গন্তব্য অবশ্য ডেবরিগড়।
জঙ্গলের মধ্যে নেচার ক্যাম্পে থাকব আমরা। সম্বলপুর স্টেশন থেকে নেচার ক্যাম্প এর দূরত্ব গোটা চল্লিশেক কিলোমিটার। স্টেশনের বাইরেই ট্যাক্সি মেলে। আমরা যদিও নেচার ক্যাম্পেই বলে রেখেছিলাম গাড়ি পাঠাতে। পরিকল্পনা ছিল গাড়িতে মালপত্র তুলে প্রাতরাশ সেরে নেব আমরা। তারপর রওণা দেব ডেবরিগড়ের পথে।
সেই মত ড্রাইভারকে নির্দেশ দেবার আগেই বেজে উঠল মহকুমা শাসকের মুঠো ফোন। ওপারে মাননীয় জেলাশাসক স্বয়ং। সাময়িক ভাবে স্তব্ধ হয়ে এল আমাদের হৃদস্পন্দন। এই রে, ফিরে যেতে হবে নাকি? গতরাত্রে কেন্দ্রীয় দলের আসার সংবাদ দিয়ে যিনি ফোন করেছিলেন, তাঁকে তো, ‘আমি তো বেরিয়ে পড়েছি। ট্রেনে উঠে পড়েছি। ডিএম সাহেব ছেড়ে দিয়েছেন' ইত্যাদি প্রভৃতি বলে কোন মতে নিরস্ত করা গেছে। কোনটাই মিথ্যে নয়। কিন্তু তবুও একটা চাপা ভয় কাজ করে। ডিএম সাহেবের যদি মনে না থাকে।
রোদ ওঠার সাথে সাথে যেমন কুয়াশা কাটে, তেমনি সমস্ত শঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে আশ্বস্ত করলেন ডিএম স্যার। ওণার দিব্যি মনে আছে, প্রয়োজনীয় কিছু নির্দেশ দিয়ে দিলেন কেবল। আর বললেন,‘ দেখে নিও। ফোনে থেকো।’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জানলার বাইরে যখন তাকালাম, সম্বলপুর ছাড়িয়ে এসেছি আমরা। শুরু হয়ে গেছে পাহাড় আর মহানদীর খাত। গতকাল রাতে একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে গলদ্ধকরণ করা স্যাণ্ডউয়িচ হজম হয়ে গেছে কখন। যেহেতু আজ থেকে বুকিং তাই আজকের প্রাতরাশটা মিলবে না নেচার ক্যাম্পে। পথে আর কোন খাবারের দোকান ও নেই। বয়ে আনা বিস্কুট আর কাজুই ভরসা।
আচমকা বাঁক ঘুরতেই সামনে হীরাকুদ ড্যাম। সম্বলপুর থেকে এই ড্যামের দূরত্ব মোটামুটি ষোল- সতেরো কিমির মত। হীরাকুদ হল পৃথিবীর দীর্ঘতম মাটির বাঁধ। দৈর্ঘ্য ১৫ কিলোমিটার। বাঁধের একদিকে যতদূর চোখ যায় কেবল জল আর জল। প্রায় পঞ্চান্ন কিলোমিটার দীর্ঘ এই জলাধার প্রায় সমুদ্র সম। জলের রঙ গাঢ় নীল। অগুনতি পাখপাখালি আর জলজ প্রাণীর নিবাস। শোনা যায়, এই জলাধারের নীচে নাকি ডুবে রয়েছে প্রায় দুই শতাধিক মন্দির। এমনকি ঐতিহাসিক শীলালিপিও। উন্নয়নের কাছে পিছু হটেছে ইতিহাস। মে জুন মাসে যখন জল কমে আসে, মাথা চাড়া দেয় অনেকে। বর্ষা নামার সাথে সাথেই মুখ লুকোন তাঁরা। স্কুবা ড্রাইভিং এর জন্য তাই অত্যন্ত উত্তম এই জলধার। জলাধারের উল্টোদিকে আর পাঁচটা ড্যামের মতই চোখে পড়ে উষর জমি, এঁকেবেঁকে চলা রাস্তা, অবিন্যস্ত জঙ্গল।
হীরাকুদের বুকের ওপর দিয়ে এঁকে বেঁকে আমরা গিয়ে হাজির হলাম ডেবরিগড় অভয়ারণ্যের চেক পোস্টে। এখান থেকে ছাড়পত্র মিললে তবে প্রবেশ করা যাবে জঙ্গলে। নেচার ক্যাম্প এখান থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূর। ঘড়িতে সোয়া দশটা সবে। অফিস থেকে জানাল সাড়ে এগারোটার আগে জঙ্গলৈ প্রবেশ করতে পারব না আমরা। তেমনি নাকি নির্দেশ আছে ওদের ওপর। একটা চায়ের দোকান আর একটা স্যুভোনির শপ ছাড়া আর কিছুই নেই। এক প্রচণ্ড গম্ভীর দিদিমণি বসে আছেন সেই শপে। গুটি কয়েক টি শার্ট আর টুপি ছাড়া তেমন কিছু নেই।
চায়ের দোকানে বয়াম ভর্তি সুজির বিস্কুট, দিলখুশের মত মিষ্টি আর কেক রাখা। চা আর ঐ কেক দিয়েই প্রাতরাশ সারলাম আমরা। হলুদ কেকগুলি যে সাম্প্রতিক কালে তৈরি নয় বেশ বোঝা যায়। পেট খারাপ না হলেই বাঁচি। চাটা যদিও অতি উত্তম ছিল।
একটা পায়ে চলা লালচে পথ ঢুকে গেছে জঙ্গলের মধ্যে। সময় কাটাতে ঐ পথ ধরে বেশ খানিকটা ঘুরে এলাম আমরা। যারা শিমলিপাল গেছেন এই জঙ্গল তাদের ভয়ানক চেনা লাগবে। একই ধরণের গাছপালা। একই রহস্যময় আবহ। এককালে এই জঙ্গল ছিল সম্বলপুরের সিংহ বীর সুরেন্দ্রসাইয়ের চারণ ভূমি। সম্বলপুরের রাজা নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী কে হবেন তাই নিয়ে বৃটিশদের সাথে সুরেন্দ্র সাই এবং তাঁর পরিবারের সংঘর্ষ লাগে। এই জঙ্গলের ভিতর ঘাঁটি গড়ে বৃটিশদের সাথে তুমুল লড়াই করেন সুরেন্দ্র সাই। ঔপনিবেশিক বৃটিশ শক্তির বিরুদ্ধে তীরধনুক, তরবারি নিয়ে লড়াই করলে যা হবার তাই হয়েছিল শেষ পর্যন্ত। কাকতালীয় ভাবে তাঁরও জন্মদিন ছিল ২৩শে জানুয়ারী।
অফিস থেকে আমাদের জঙ্গলের বেশী ভিতরে ঢুকতে নিষেধ করল। ডেবরিগড় বন্য বরাহদের নিবাস স্থল। ব্যাটারা যখন তখন, যেখানে-সেখানে দল বেঁধে আবির্ভূত হয়। হয়তো আমাদের ছটফটে স্বভাবের জন্যই, সাড়ে এগারোটার বদলে এগারোটা নাগাদ জঙ্গলে প্রবেশের অনুমতি মিলে গেল। জঙ্গলে প্রবেশের সাথে সাথেই অভ্যর্থনা জানাল গুটি কয়েক ময়ূর। খানিক এগিয়ে আবার থমকে দাঁড়াল গাড়ি, পথ জুড়ে আসর বসিয়েছে এক দঙ্গল হনুমান। জঙ্গলে হর্ন বাজানো নিষেধ। ওরাই এখানকার ভূমিপুত্র, আমরা নিছক বহিরাগত। ফলে তাড়া দেওয়াও অসঙ্গত। বেশ খানিকক্ষণ চলল মিটিং। তারপর কি মনে হল, আড়মোড়া ভেঙে একে একে সরে গেলেন তেনারা রাস্তা ছেড়ে।
সোজা ডেবরিগড় নেচার ক্যাম্পে গিয়ে থামল গাড়ি। নেচার ক্যাম্পের একদিকে জঙ্গল আর অন্যদিকে হীরাকুদ জলাধার। জঙ্গলের দিকটা জাল দিয়ে ঘেরা। বিশাল এলাকা নিয়ে গঠিত এই নেচারক্যাম্পে কটেজ আছে বেশ কয়েকটা। কটেজগুলোর নাম খুব সুন্দর জল, অগ্নি, বায়ু ইত্যাদি। আর ডাইনিং কটেজটার নাম পঞ্চতত্ত্ব। দলবল নিয়ে এলে কটেজে থাকতেই পারেন, অন্যথা বড় নিরিবিলি। আমরা থাকব বাইসন ব্লকে। বাইসন ব্লক একটা দোতলা বাংলো। যার দুই তলা মিলিয়ে সাত- আটটা সুইট আছে। প্রতিটা সুইটের সামনে এবং পিছনে আছে বারন্দা। প্রতিটি সুইটের প্রতিটি বারন্দায় রাখা বেতের সোটা এবং সেটি। কাচের টেবিল। সামনের বারন্দাটা কমন এবং খোলা। পিছনেরটা আপনার নিজস্ব এবং জাল দিয়ে ঘেরা যাতে পাখি বা বাঁদর না ঢুকে আসে। সামনেরটা খোলে জঙ্গলের দিকে আর পিছনেরটা জলাধারের দিকে।
ঘরগুলি বিশাল বড়। বিছানাটাও সাফ সুতরো, কিং সাইজ। ঘরেও দুটি বেতের কেদারা টেবিল রাখা। আছে ওয়ার্ডরোব এবং ড্রেসিং টেবিল। বাথরুমটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। তবে ঝাঁ চকচকে নয় অবশ্যই। জঙ্গলের ভিতরে এর থেকে বেশী আশা করাও অন্যায়। শিমলিপালের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা ধরেই নিয়েছিলাম যে ফোনের টাওয়ার থাকবে না। সেই মত অন্তত বার দুশো যে যার বাপ-মাকে বলেছি সাবধানে থাকতে। নিজেদের খেয়াল রাখতে। ২৩তারিখ জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে টাওয়ার পেলেই আমরা ফোন করব। তাতে কতখানি আশ্বস্ত হয়েছে ওরা ভগবান জানে। আমার বাবা তো বলেই দিল,‘তোমার টাওয়ার থাকুক না থাকুক, নির্দিষ্ট সময় অন্তর আমি ফোন করতেই থাকব।যদি কানেক্টেড হয় ভালো, নাহলে আর কি (দীর্ঘশ্বাস)। ’
পুরো নেচার ক্যাম্পে কোথাও টাওয়ার না পেলেও পিছনের বারন্দায় গিয়ে দেখি টিমটিম করছে দুটি টাওয়ার। যাক বাবা। শান্তি। ঝপাঝপ যে যার বাড়িতে ফোন করতে লাগলাম শৌভিক আর আমি। রীতিমত ভিডিও কল করে ঘর- জঙ্গল- জলাধার দেখাতে লাগলাম বাবাকে। আচমকা তুত্তুরী চেঁচিয়ে উঠল,‘মা দেখো এক পাল বন্য বরাহ।’ তাকিয়ে দেখি, সত্যিই আমাদের ঝুল বারন্দার অদূরে একটা গুল্মের নীচে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করছে সত্যিই একপাল শুয়োর। আমিও চিৎকার করে উঠলাম,‘সত্যিই ওয়াইল্ড বোরস্ তো রে।’ যুগপৎ বাংলা এবং ইংরাজিতে উল্লাসের দাপটে বোর থুড়ি বরাহরা তো ঝুপঝুপ করে লুকিয়ে পড়লেন গাছের পিছনে। ওদিকে বাবার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে আব্দার জুড়ল আমার জননী,‘শুয়োর দেখা।’
প্রসঙ্গতঃ - ডেবরিগড় নেচার ক্যাম্পের ভিডিও লিঙ্কটা নীচে দিলাম। যদি মনে করেন দেখে আসতে পারেন।
https://youtu.be/yFmTLi1TJ_U
অনির (জন্মদিনের) ডাইরি, ২১শে জানুয়ারি, ২০২৩
(পর্ব-৩)
#অনিরডাইরি #birthdaygift_birthdaytrip
যাঁরা নেচার ক্যাম্পে এর আগে থেকেছেন তাঁরা জানেন, অন্যদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে, যখন আপনি নেচার ক্যাম্পে রুম,কটেজ বা সুইট বুক করবেন, ঘর ভাড়ার সাথে সাথেই আপনার প্রাতরাশ, মধ্যাহ্নভোজ, সান্ধ্যকালীন জলখাবার এবং নৈশভোজের মূল্য ওরা আপনার থেকে নিয়ে নেবে।
তাছাড়া আর উপায়ই বা কি? গভীর জঙ্গলের মধ্যে অন্য কোন হোটেল বা রেস্তোরাঁ তো আর পাবেন না। খাবারদাবার খুব সাধারণ মানের এবং সবার জন্য এক। চাইলেও কালিয়া- কোপ্তা পাবেন না। শুধু তাই নয়, খাবার সময় এবং স্থানও নির্দিষ্ট। বড়জোর সকাল-বিকেলের চা ছাড়া রুম সার্ভিস পাবেন না।
ডাইনিং হল বা কটেজে গিয়েই আপনাকে খেতে হবে। আজকের মেন্যুতে ছিল মোটা চালের ভাত, অরহড় ডাল, চাটমশলা ছড়ানো ভয়ানক মুচমুচে করলা ভাজা। একেবারে প্যাকেটের চিপসের মত সুস্বাদু। সাথে মোটা মোটা আলুভাজা, মিক্সড ভেজ মার্কা একটা পাঁচমিশালী তরকারি এবং মাছ। মাছ না খেলে পনীর পাবেন।
শিমলিপালের বড়েইপানি নেচারক্যাম্পে যা খেয়েছিলাম সে তুলনায় রীতিমত অমৃত বলতে পারেন। ডাইনিং হলটা নেচার ক্যাম্পের এক কোণে। শালের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে লাল মেঠো পথ ধরে হেঁটে যেতে হয় অনেকটা। নামটাও ভারি সুন্দর পঞ্চতত্ত্ব। ডাইনিং হলটার তিনদিকই খোলা এবং জাল দিয়ে ঘেরা। বর্ষাকালে কি হয় ভগবান জানে। জাল দিয়ে ঘেরা খোলা জানলা/ বারন্দার ধার ঘেঁষে পরপর বেশ কতকগুলি টেবিল পাতা। সাথে বাঁশের চেয়ার। বেশ মজাদার দেখতে চেয়ারগুলো।
খেতে খেতে আপনি স্বচ্ছন্দে হীরাকুদ জলাধারের শোভা দেখতে পারেন। হু হু করে ছুটে আসবে জঙ্গলেয় গন্ধ মাখা জোলো হাওয়া। জলের কাছে যাবার পায়ে চলা লালচে পথটাও চোখে পড়বে। চোখে পড়বে জলে ভাসমান জেটিটাও। ঐ জেটি থেকেই আজ দুপুর সাড়ে তিনটে নাগাদ নৌবিহারে রওণা দেব আমরা। আর চোখে পড়বে এক দঙ্গল রাজহাঁস। আমরা যখন খেতে আসছিলাম, বেজায় গম্ভীর মুখে বসে/দাঁড়িয়ে ছিল ব্যাটারা। মনে হয়েছিল মূর্তি বুঝি। শ্রীমতী তুত্তুরী অবশ্য গোড়া থেকেই দাবী করেছিলেন উহারা জ্যান্ত বটেক। ডাইনিং হল ( https://youtu.be/yFmTLi1TJ_U ) আর রাজহাঁসেদের ভিডিও ( https://youtu.be/3CgLaOJYKUg ) লিঙ্কটা দিলাম, যদি আগ্রহী হন দেখে আসতে পারেন।
দ্বিপ্রাহরিক গুরু ভোজ সেরে হাল্কা গড়িয়ে নিয়ে আমরা বেরোলাম নৌকা বিহার করতে। এটা নেচার ক্যাম্পের অতিথিদের জন্য বুক করাই থাকে। হীরাকুদের বিশাল জলাধারের মধ্যে মাথা উঁচু করে আজও দাঁড়িয়ে আছে তিনটি দ্বীপ। এই দ্বীপ গুলি আদতে ছিল অনুচ্ছ পাহাড়। জলাধারের জলে যখন প্লাবিত হল চরাচর, স্থানান্তরিত/পুনর্বাসিত হল স্থানীয় অধিবাসীবৃন্দ, ডুবন্ত পাহাড়ের মাথা গুলি জেগে রইল কেবল নিঃসঙ্গ দ্বীপ হয়ে। প্রতিটি দ্বীপই ঘন জঙ্গলে ঢাকা।
তিনটি দ্বীপের মধ্যে ব্যাট আইল্যাণ্ডেই কেবল নিয়ে যায় নেচার ক্যাম্পের স্পিড বোটটি। দিনে কেবল দুইবারই সওয়ারি করে বোট গুলো, একবার সকালে আর একবার বিকেলে। সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সময় পাক্কা দেড় ঘন্টা ধরে নৌযাত্রা করায় অতিথিদের। ব্যাট আইল্যান্ডে দ্রষ্টব্য বলতে প্রচুর বাদুড়। আর আছে গোটা সাতেক মৎসজীবী পরিবার। যারা এখনও মাটি আর বাঁশের কুঁড়ে ঘরে থাকে। ব্যাপারটার মধ্যে আদৌ কোন দ্রষ্টব্য আছে বলে আমার মনে হয়নি। খামোখা একদল মানুষের দুর্দশা দেখে যে কেন লোকজন এত আনন্দ পায়।
অপর একটি উল্লেখযোগ্য দ্বীপ হল ক্যাটল আইল্যাণ্ড। যেখানকার আদি অধিবাসীরা স্থানান্তরিত হবার সময় ছেড়ে গিয়েছিলেন তাদের গবাদি পশু গুলিকে। সময়ের সাথে সাথে শুধু যে তাদের সংখ্যাই বৃদ্ধি পেয়েছে তা নয়, ছেড়ে যাওয়া ভীরু গৃহপালিত পশুগুলির উত্তরসূরিরা হয়ে উঠেছে বন্য এবং দুর্দম। আকারেও নাকি বৃদ্ধি পেয়েছে বেশ অনেকটা। পরবর্তীকালে আসেপাশের গ্রামের মানুষ অনেক চেষ্টা করেছে ওদের কব্জা করার, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে বারেবারে। ক্যাটল আইল্যান্ড প্যাকেজে থাকে না। অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে ওরা নিয়ে যায় বটে, তবে বলেই দেয় নৌকা থেকে নামবেন না। বিপদ ঘটে যাবে।
ব্যাট আইল্যান্ডে মিনিট পনেরো দাঁড়িয়ে থেকে বোটটা আবার ফিরে যায় মূল জলাধারে। অতঃপর ভেসে থাকে আরো মিনিট পনেরো। ঠিক এই সময়ই একরাশ লালিমা জড়িয়ে পাহাড়ের পিছনে লুকিয়ে পড়েন দিনমণি।
সত্যি কথা বলতে কি যাঁরা আমাদের মত অ্যাডভেঞ্চার ভালোবাসেন বা যাঁরা ইতিপূর্বে রম্ভা বা চিল্কায় এই ধরণের নৌকায় চড়েছেন তাঁরা হয়তো একটু হতাশই হবেন। ঐ ধরণের রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা হেথায় দুর্লভ। মোচার খোলার মত স্পিড বোটের দুলুনিও তেমন ভাবে টের পাবেন না। হীরাকুদে নৌবিহার বড়ই রম্য, বড়ই মোলায়েম। আপনি যাবেন, আপনার সাথে সাথে, আপনার আসেপাশে ঘুরে বেড়াবে, উড়ে বেড়াবে,ছুটে বেড়াবে হরেকরকম পাখির দল। পলকে পলকে রঙ বদলাবে হীরাকুদের জল। সূর্য সাদা তো জল ঘোলাটে নীল। সূর্য সোনালী তো জল আরেকটু বেশী নীল। সূর্য কমলা তো জলও ঘোলাটে কমলা, সূর্যের রঙ লাল তো ঝুপ করে জলের রঙ হয়ে যায় কালো। জল থেকে উঠে আসতে থাকে থোকা থোকা কুয়াশা। ঘিরে ধরে বোটটাকে। হীরাকুদে নৌবিহারের ভিডিও লিঙ্কটা দিলাম যদি দেখতে চান- https://youtu.be/ltUg-OpmWwU
বোট থেকে যখন নামলাম একে একে জ্বলে উঠেছে নেচারক্যাম্পের আলো। হয়ে এসেছে চায়ের সময়। সঙ্গে টা বলতে জিভ পোড়ানো চিকেন পকোড়া। ডিনার টাইম রাত আটটা থেকে। দেরী করলেই ডাকতে চলে আসে ক্যান্টিনের ছেলেগুলো। যাদের প্রত্যেকের ব্যবহার অসম্ভব ভদ্র এবং মিষ্টি।
শালের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাতের বেলা খেতে যাওয়াটা রীতিমত গা ছমছমে অভিজ্ঞতা। নির্দিষ্ট দূরত্ব ছাড়াই জ্বলছে সাদা বাল্ব। তাও যেন ঘোঁচে না আঁধার। প্রতিটি ঘর ভর্তি, তাও যেন অখণ্ড নীরবতায় মোড়া চরাচর। আওয়াজ বলতে উৎকট স্বরে ঝিঁঝি পোকাদের কলতান আর পেঁচার ডাক। মাঝে মধ্যে ডিহি-ড্ডুহু করে ডেকে উঠছে কোন অচেনা পাখি।
জঙ্গল আর নেচার ক্যাম্পের মধ্যে লক্ষণরেখা বলতে কেবল কাঁটাতারের বেড়া। তার ওধারে কারা যেন ঘোরাফেরা করছে, অস্পষ্ট মচ্-মচ্, শর-শর আওয়াজ ভেসে আসছে অন্ধকার থেকে। শিমলিপালে আমাদের গাইড দাদা একবার বলেছিলেন, ‘স্যার আপনি জঙ্গলে এসে জীবজন্তু নাও দেখতে পেতে পারেন, কিন্তু জেনে রাখবেন ওরা ঠিক আপনাকে দেখছে। নজর রাখছে আপনার গতিবিধির ওপর।’ এই নিকষ আঁধারে সেই কথাগুলি মনে পড়ে কে জানে কেন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
অনির (জন্মদিনের) ডাইরি, ২২ শে জানুয়ারি, ২০২৩
পর্ব- ৪
#অনিরডাইরি #birthdaygift_birthdaytrip
মোবাইলের ঘড়ি বলছে, রাত সাড়ে তিনটে, ঘুমের ঘোরে গায়ের কম্বল খুলে ফেলেছে তুত্তুরী। ঠিক করে দিতে গেলাম তো, মায়ের মুখে সোহাগী হাত বুলিয়ে, তিনি বললেন, ‘ হ্যাপ্পি বাড্ডে মমি”। বাবার অগোচরে তিনি মাঝে মাঝে মা’কে ‘মমি’ বলে সম্বোধন করেন বটে, বিশেষতঃ যখন মায়ের ওপর সোহাগ উথলে ওঠে।
ডেবরিগড় নেচার ক্যাম্পে আজই আমাদের শেষ রাত। এই সুইট গুলোর একটা দিক পুরো কাঁচের। শোবার আগে পর্দা সরিয়ে দিয়েছে শৌভিক, এক নজর দেখলে মনে হচ্ছে কাঁচের ওপারে নিকষ কালো যবনিকা টেনে দিয়েছে কেউ। একটু চোখ সয়ে গেলেই বোঝা যায়, যার অর্ধেকটা জুড়ে আকাশ। আকাশ ভরা ঝিকমিকে হীরের কুচির মত অগণিত তারা। কালো কালো পর্দার বাকি অর্ধেকটা জুড়ে জল আর জঙ্গল। শুক্ল পক্ষ পড়ে গেছে যদিও, আজ দ্বিতীয়া, তাই চাঁদের দেখা নাই। তারার আলোকে দিব্যি বোঝা যাচ্ছে জঙ্গল আর জলের সীমানা এমনকি বড় বা মাঝারি গাছ গুলোর আকৃতি।
গত কাল একটু তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়েছিলাম আমরা, সাড়ে নটার মধ্যে। সারাদিনের পথশ্রমে এত ক্লান্ত ছিলাম সকলে, যে ঘুম আসতে দেরী হয়নি। দিনের বেলা নৃসিংহনাথের মন্দির, গন্ধমর্দন পাহাড় আর কপিলধারা দেখতে গিয়েছিলাম আমরা। সব মিলিয়ে প্রায় তিনশ কুড়ি পঁচিশ কিলোমিটারের পথ যাত্রা। সত্যি কথা বলতে কি এটা আমাদের পরিকল্পনা বহির্ভূত ট্রিপ ছিল। উড়িষ্যা বনদপ্তরের ওয়েবসাইটে গিয়ে নেচার ক্যাম্প বুক করাতে গেলেই ওরা জানতে চাইবে, আপনি সাফারি করতে ইচ্ছুক কি না। সাফারি দুই ধরণের হয়, অর্ধ দিবস এবং পূর্ণ দিবস। বউয়ের জন্মদিনের উপহার বলে কথা, কোন কার্পণ্য রাখেনি আমার বর। বুক করিয়ে ছিল ছয় ঘণ্টার সাফারি। আমাদের ধারণা ছিল, সারাদিন জঙ্গলেই ঘোরাবে হয়তো। বাস্তবে দেখা গেল জঙ্গল সাফারি আলাদা করে বুক করাতে হয়। আমাদের ওরা জঙ্গলে ঘোরার থার জিপে করেই ঘোরাবে বটে, তবে ডেবরিগড়ের জঙ্গলে নয়।
উড়িষ্যার বলাঙ্গির আর বারগড় জেলার সীমানা বরাবর বিস্তৃত গন্ধমর্দন পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত নৃসিংহনাথের মন্দিরটির নির্মাণ কাল খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতক। নির্মাতা পাটনার রাজা বৈজল দেব। ছয়শ বছরের বুড়ো এই মন্দিরে শ্রীবিষ্ণু মার্জার কেশরী রূপে পুজিত হন। লোকগাথা অনুসারে গন্ধমর্দন পাহাড় সংলগ্ন এই অঞ্চলের অধিবাসীদের ওপর এককালে প্রবল অত্যাচার চালাত মূষিক দৈত্য। অত্যাচারিত, নিপীড়িত ভক্ত কুলের পরিত্রাণার্থে মার্জার রূপে প্রকট হন শ্রী বিষ্ণু। কথিত আছে যে, তাঁকে দেখেই ছুট্টে গর্তে ঢুকে পড়ে মূষিক দৈত্য। সেই যে ঢুকেছে, আজও বেরোয়নি। মার্জারকেশরী আজও তার জন্য সজাগ এবং প্রতীক্ষারত।
নৃসিংহনাথের মন্দির থেকে গন্ধমর্দন পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে প্রায় চার কিলোমিটার ট্রেক করে উঠতে হয় কপিলধারায়। বনদপ্তরের গাড়ি অবশ্য ওঠে। তবে কেবলমাত্র অনুমোদিত সরকারি গাড়ি ছাড়া অন্য গাড়ির প্রবেশ নিষেধ। বাইকের অবশ্য ছাড়পত্র আছে।
পাহাড়ি পথ বেয়ে হাঁটাটা বেশ মনোরম অভিজ্ঞতা। প্রায় জনবিহীন, একদিকে পাহাড় আর জঙ্গল আর অন্যদিকে খাদ। স্থানীয় লোক গাথা অনুসারে, গন্ধমর্দনই হল রামায়ণে বর্ণিত গন্ধমাদন পাহাড়। রামানুজের প্রাণ বাঁচাতে জাম্বুবানের নির্দেশ মত বিশল্যকরণী আনতে গিয়েছিলেন হনুমান। একদিকে বিশল্যকরণীকে শনাক্তকরণে অপারগতা অপরদিকে সময়ের স্বল্পতা, রিস্ক নেননি বজরংবলী, কাঁধে করে তুলে আনেন গোটা পাহাড়টাকেই। কার্যসমাধা হবার পর, পাহাড়টিকে আর যথাস্থানে রেখে আসেননি। এখানেই ফেলে যান উড়িষ্যার বলাঙ্গিরে।
মহাভারতের যুগে, এখানেই নাকি শিষ্যদের অস্ত্র শিক্ষা দিতে আনতেন পাণ্ডবগুরু দ্রোণাচার্য। কে জানে হয়তো আসেপাশের কোন গ্রামেই ছিল একলব্যের নিবাস। এমন কি হিউয়েন সাং এর লেখাতেও নাকি এই পর্বতের উল্লেখ আছে। ট্রেকিং এর ভিডিও লিঙ্কটা দিলাম, যদি মনে করেন দেখে আসতে পারেন- https://youtu.be/9ce8I6Dkj6k
গন্ধমর্দন পাহাড় এখনও ওষধি গাছের জন্য বিখ্যাত। বোটানিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার মতে এই পাহাড়ে দুই শতাধিক ওষধি গাছ পাওয়া যায়। স্থানীয় অধিবাসীদের মতে অবশ্য এই সংখ্যাটা অন্তত পাঁচশ। গন্ধমর্দন পাহাড়ের দুই ঢালে গড়ে উঠেছে দুই খানি আয়ুর্বেদিক কলেজ হাসপাতাল। আশেপাশের প্রায় ৫০,০০০ আদিবাসীর চিকিৎসার হয় যেথায়। শুধু তাই নয় ডাবর, ঝান্ডুর মত কোম্পানি গুলি কাঁচামাল সংগ্রহ করে এই পাহাড় থেকে।
গন্ধমর্দন পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে যখন কপিলধারায় পৌঁছালাম, বেশ হতাশ লাগছিল। শীতের শেষ বলে জল বেশ কম। যেটুকু ধারাপাত হচ্ছে, তাকে ঘিরে স্থানীয় পুণ্যার্থীদের ভিড়। তেমনি নোংরা চারিধার। প্লাস্টিকের মোড়ক আর খালি জলের বোতলে ছয়লাপ। আমরা হেঁটে উঠলেও, নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে অনুসরণ করছিল বনদপ্তরের গাড়িটা। ড্রাইভার দাদা বলছিলেন, গন্ধমর্দনের ঢাল নাকি সাংঘাতিক। নিষেধ থাকা সত্ত্বেও মাঝে মাঝেই ঘুষ দিয়ে ঢুকে পড়ে ট্যুরিস্ট গাড়ি। তেমনি একটা গাড়ি নাকি কিছুকাল আগে খাদে পড়ে যায়। আজও তাকে তোলা যায়নি। গাড়িটাও দেখালেন। টাটা সুমো। ভিতরে শাখা মেলেছে বন্য গুল্ম।
আমাদের মধ্যাহ্ন ভোজের ব্যবস্থা ছিল নৃসিংহনাথের মন্দিরে। মন্দিরের বাইরে বেশ খানিকটা দূরে জুতো খুলে খালি পায়ে প্রবেশ করতে হয় মন্দিরে। ভিতরে থিকথিক করছে পুণ্যার্থীদের ভিড়। যত জন মানুষ, প্রায় ততোগুলি বাঁদর। রয়েছে গোটা কয়েক গরুও। ড্রাইভার গিয়ে কুপন কেটে আনল। জন প্রতি ৬০ টাকা। হাত ধুয়ে পংক্তি ভোজনে বসলাম আমরা। পাশাপাশি দুটি হল ঘর, মাঝের দেওয়ালে জাফরি কাটা। একদিকে পরিবেশন শুরু হচ্ছে, অন্য দিকে শেষ। মানুষ উঠে গেলে এঁটো পাতা গুলো শুধু ঝেঁটিয়ে বার করে দিচ্ছে একদল মহিলা। মোছার কোন বালাই নেই। বসার জায়গায় ডালের ফোঁটা, ভাতের কণা পড়ে আছে। ফেলে দেওয়া এঁটো পাতা চাটছে বাঁদরে, গরুতে। কিছু থেকে আবার পচা গন্ধ আসছে ভুরভুর করে।
ঠাকুরের কাছে এসেছি, কোন কিছুতে ঘৃণা করা মহাপাপ, তবুও গা গুলিয়ে উঠছিল। শৌভিক জন্ম নাস্তিক, ব্যাপারটা যে এমন হবে জানতও না। অপরাধী মুখে বার বার বলতে লাগল, ‘চল উঠে যাই।‘ তুত্তুরীও বাবার দলে। সাহসে কুলোচ্ছিল না কেবল আমার। যদি ঠাকুর পাপ দেন? নির্ঘাত দেবেন। আর দ্বিতীয়ত ড্রাইভার বা পঙক্তিভোজে বসা অন্যান্যরা যদি কিছু মনে করেন? মিনিট পনেরো ঐ যাতনা সহ্য করে আর পারলাম না। তখনও এই ঘরে পরিবেশন শুরুই হয়নি। ক্রমশ বাড়ছে ভিড়। মার্জার কেশরীর কাছে মার্জনা চেয়ে উঠেই পড়লাম। বয়স্ক ড্রাইভারটির কাছেও কর জোড়ে মার্জনা চাইলাম। স্থানীয় অধিবাসীদের ভাবাবেগে আঘাত হানার কোন অভিপ্রায়ই আমার নেই।
ড্রাইভার দাদা যদিও বললেন, বাঙালি ট্যুরিস্টরা এখানে কোন বারই খেতে চায় না, কে জানে কেন। মার্জার কেশরীর ভোগের অবমাননা করেছিলাম বলেই হয়তো, মধ্যাহ্ন ভোজন সারতে সারতে বেজে গিয়েছিল, বিকাল সাড়ে চারটে। একে তো দিনভরের ধকল, তারওপর কাল আবার উঠতে হবে খুব ভোরে। কাল সত্যিই জঙ্গলে যাব আমরা, সাফারি করতে। তবে আজকের দিনটা যা গেল, খুব বেশি আশা আর রাখিনি কালকের দিনটা নিয়ে। কাল আবার আমার জন্মদিন,কে জানে কেমন কাটবে কালকের দিনটা।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment