#কাঁথিরকিস্যা #অনিরডাইরি
যাঁর জন্য এত কিছু।
গত বছর পুজোর পর বিসর্জন দেওয়া হয়নি ঠাকুরটাকে। আহা কেমন মিষ্টি দেখ মুখটা। বৃষ্টি মাথায় ছোট বাচ্ছার মত কোলে করে নিয়ে এসেছিল তমলুকের মহকুমা শাসকের ড্রাইভার পলাশ। ঝুপ করে যখন এল বদলির অর্ডার, অন্যান্য ব্যক্তিগত জিনিসপত্রের মত স্থানান্তরের প্রয়োজন হল এনারও। আমরা পড়লাম মহা আতান্তরে। কি করি এই ভদ্রমহিলাকে নিয়ে। শেষ পর্যন্ত কি রূপনারায়ণ এর জলেই ভাসিয়ে দিতে হবে তুত্তুরীর সাধের প্রতিমাকে। বাধ সাধল পলাশ। " আমি নিজে পৌঁছে দিয়ে আসব স্যার।"
কথা দিল বটে, কথা রাখতে পারল কই! অফিসার বদলে যাবার সাথে সাথে যে হাত বদল হয় গাড়িরও। নতুন মহকুমা শাসকের ডিউটি সামলে ঠাকুর নিয়ে কাঁথি আসা কি অত সোজা। দূরত্ব ও তো কম কিছু নয়। হরেগড়ে প্রায় সত্তর কিলোমিটার। নিরূপায় হয়ে ভাসিয়েই দিতাম হয়ত,যদি না কাঁথি মহকুমা শাসকের ড্রাইভার নূপুর বাবু আর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষী মান্ডি বাবু বাধা না দিতেন। " অসময়ে বিসর্জন দিবেন কেন ম্যাডাম। আমরা আছি তো। আমরা নিয়ে যাব।"
আজ ২৬ শে জানুয়ারি, ঠিক সকাল সাড়ে আটটা থেকে বন্ধ গলা পরে, পতাকা তুলবে আমার বর। পতাকা উড়বে বাংলোয়, অফিসে, হেথায়-হোথায়, না জানে কোথায় কোথায়। পাইলট কার এসে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে অরবিন্দ স্টেডিয়াম। ফুল আর বেলুন দিয়ে সাজানো জিপে চেপে সেথা অভিবাদন নেবে আমার বর। পাবে ২১ টা gun salute। হবে কুচকাওয়াজ। হবে নাচ,গান, বাজনা, আবৃত্তি। ঘুরবে বিভিন্ন দপ্তরের রঙচঙে ট্যবলো। সবার ব্যস্ততা চরম। তাই বলে, এতদূর থেকে এত কষ্ট করেও যিনি আমাদের ছাড়েননি, বছর ভর নীরবে বসে থেকেছেন ঘরের কোণায়। তার অর্চনা না করলে কি চলে? আসুক না পুরুত ঠাকুর ভোর ছটায়। পড়ুক না মায়ের মুখে প্রথম আলো - ভয়ভক্তি না, ভালোবাসায় হোক মায়ের আবাহন।
অনির সরস্বতী পুজোর ডাইরি, ২৬শে জানুয়ারি, ২০২৩
(পর্ব - ২)
#কাঁথিরকিস্যা #অনিরডাইরি
বিয়ের পর মাঝেমধ্যে আমার বরকে রামচন্দর বলে খেপাতাম। শ্রীরাম যেমনি পিতৃসত্য পালনে স্বেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগ করে বনবাসী হয়েছিলেন, ঠিক অতটা না হলেও বাবাই ছিল শৌভিকের পরম গুরু। জীবনের আদর্শ। এই চাকরিতে আসাও তো বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই। অথচ ভাগ্যের এমনি পরিহাস শৌভিকের জীবনের কোন গুরুত্বপূর্ণ দিনেই আজ অবধি হাজিরা দিতে পারেননি শ্বশুরমশাই। এমনকি আমাদের বিয়ের দিনও ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে অনুপস্থিত ছিলেন। আজকের এই বিশেষ লগ্নে, যখন বন্ধগলা পরে অভিবাদন নিতে যাবে আমার বর, হয়তো আজও গরহাজিরই থাকতেন বৃদ্ধ, যদি না আচমকা শ্বাসকষ্টে কাবু হয়ে পড়তেন।
কর্কট রোগকে দু-দুবার হাঁকিয়ে মাঠের বাইরে পাঠাতে পারলেও শ্বাসকষ্টটাকে কিছুতেই ম্যানেজ করতে পারেন না শ্বশুরমশাই। ডাক্তার বলেই দিয়েছে, ফুসফুসের অবস্থা সুবিধের নয়। নিষেধ করেছে রাস্তায় বেরোতে। বেরোতেনও না ভদ্রলোক, কিন্তু কাছের জন যদি হাসপাতালবাসী হয়ে পড়ে,রাস্তায় না বেরিয়ে উপায় কি। যতদূর সম্ভব রূঢ় ভাষায় নিষেধ করেছিলাম আমি। ‘বাবা আপনি প্লিজ হাসপাতালে যাবেন না। আপনি কিন্তু মোটেই সুস্থ নন। ভগবান জানে কি ব্যধি বয়ে আনবেন। আগে তমলুকে ছিলাম, যখনই কিছু হয়েছে শৌভিক বা আমি ছুটে আসতে পেরেছি। কাঁথি কিন্তু অনেক দূর।’
বৃদ্ধ যে শোনার চেষ্টা করেননি তা নয়। কিন্তু অভিমানী কণ্ঠে স্নেহের পাত্র যখন অনুযোগ করে, ‘আমায় তোমরা দেখতে আসছ না কেন?-’ বৃদ্ধকে যেতেই হয়। পরিণাম যা হওয়ার তাই হয়েছে। তীব্র শ্বাসকষ্ট। বাড়িতে অক্সিজেন সিলিণ্ডার এনে, স্টেরয়েড নিয়েও কোন লাভ হয়নি। অফিস কাছারি সামলে সপ্তাহের মাঝে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার মত অবস্থায়ও ছিলাম না দুজনের কেউই। সপ্তাহান্তের জন্য অপেক্ষা করতে পারেনি বৃদ্ধ। অনুজ ফুলকাকাকে নিয়ে হাজির হয় ডাক্তারের কাছে। সোজা হাসপাতালে ভর্তি হবার নিদান দিয়ে দায় ঝেড়ে ফেলে ডাক্তার। এবার হাসপাতালে ভর্তি করবে কে? করলেও শাশুড়ী মার কি হবে? বৃদ্ধার কানের অবস্থা তো কহতব্য নয়। আর দুটো হাঁটুই মচমচ করে। তিনি যতই বলুন না কেন, ‘আমি একা দিব্যি থাকতে পারব।’ আমরা পারব কি? আর কাঁথি থেকে কলকাতা রোজ ভিজিটিং আওয়ারে গিয়ে হাজিরা দেওয়াও অসম্ভব। ইশ্ একটু যদি আমার কথাটা শুনত বৃদ্ধ।
এসব বলতে, বলতে, ভাবতে, ভাবতেই মনে হল, আমরা যদি না যেতে পারি, বৃদ্ধ তো আসতে পারে। আসতে পারে নয়, আসতেই হবে। এসব ক্ষেত্রে মহানগরের বিলাসবহুল হাসপাতালে দৈনিক লাখ টাকা খরচা করে যে চিকিৎসা হবে, মহকুমা হাসপাতালে তার থেকে খুব খারাপ কিছু হবে না। তড়িঘড়ি স্থানীয় হাসপাতালের ডাক্তারবাবুর সাথে কথা বলল শৌভিক। তারপর বৃদ্ধকে জানানো হল,‘কোন রকম ওজর আপত্তি চলবে না। দরকার হলে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে যাচ্ছি আমরা। আসতে তোমাদের হবেই।’ শাশুড়ী মা যথারীতি সেই একই গান ধরেছিলেন, ‘নারে আমি পারব না। এতটা রাস্তা। তোরা বাবাকে নিয়ে যা। আমি দিব্য-’।
পঁচিশে জানুয়ারী রাতে সোজা দুজনকে তুলে এনেছে শৌভিক। দিব্যি এসেছে দোঁহে। হাসপাতালের ডাক্তারবাবু দেখেও নিয়েছেন। ছেড়েও দিয়েছেন। বলেছেন ‘বাড়িতেই থাকুন। ওষুধ চলুক। সেরে উঠবেন জলদি। অক্সিজেন চলুক যদি দরকার পড়ে। ’ আজ সকাল থেকে বৃদ্ধ বলছেন,‘আমি তো ঠিকই আছি। শ্বাসকষ্টও নেই।’ শ্বাসকষ্টকে ঠিক বিশ্বাস নেই আমার। ব্যাটা কখন যে আবার এসে উদয় হবে ভগবান জানে। তবে আপাততঃ এই শ্বাসকষ্টের জন্যই ছেলের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিনে হাজিরা তো দিতে পারলেন বৃদ্ধ। অতীতেও অনেকে পরেছেন বন্ধগলা, ভবিষ্যতেও অনেকে পরবেন। কিন্তু ভট্টচার্য এবং চাটুজ্জে বাড়ির ইতিহাসে প্রথম কেউ পরল এই পোশাক। তাই নিয়ে শৌভিক এর তেমন তাপ উত্তাপ না থাকলেও বৃদ্ধ এবং তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূর গর্বের সীমা নেই। ভাগ্যে আমার অবাধ্য হয়েছিল বৃদ্ধ।
অনির সরস্বতী পুজোর ডাইরি, ২৬ শে জানুয়ারি, ২০২৩
(পর্ব -৩)
#কাঁথিরকিস্যা #অনিরডাইরি
মহকুমা শাসকের বাংলো চেম্বারটা সন্ধ্যে থেকে পরিণত হয় শ্রীমতী তুত্তুরীর পড়ার ঘরে। টেবিল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে বই, খাতা,পেন, জ্যামিতি বক্স আরও না জানি কি কি। সন্ধ্যের পর হঠাৎ করে কোন জরুরী ভিসি ডাকা হলে বা ফাইলপত্র বগলে কেউ যদি বাংলোয় এসে হাজির হয়, তবেই ঐ ঘর ছেড়ে নড়ি আমরা।
দিন দুয়েক আগে তেমনি কোন কারণে চটজলদি বইপত্র গুছাতে গিয়ে দেখি টেবিলের একপাশে দুপাতার কিসের যেন প্রিন্ট আউট পড়ে আছে। জলদি পাতাতাড়ি গুটানোর জন্য তাড়া দিতে শিয়রেই দাঁড়িয়ে ছিল শৌভিক। জিজ্ঞাসা করলাম এটা কি? জবাব এল,‘আমার স্পিচ। সাধারণতন্ত্র দিবসের জন্য লিখে দিয়েছে।’ বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘বাবা রে, তোকে স্পিচ লিখে দেবারও লোক থাকে!’ ব্যস্ত হাতে কম্পুটর অন করতে করতে শৌভিক বলল,‘ ওটা বলব না। কিছু একটা ভেবে বলে দেব।’
তারপর যতবারই জিজ্ঞাসা করেছি, কি রে ভাবলি? একটাই জবাব পেয়েছি, ' আরে ভাববো। ভাববো। অনেক সময় আছে তো।' দেখতে দেখতে এসে পড়ে ২৬ তারিখ। সূর্যোদয়ের আগে থেকে ব্যস্ততার শেষ থাকে না আমাদের। তুত্তুরী আর আমি উভয়েই সেই ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠেছি। ছটায় পুজো করতে আসবেন ঠাকুরমশাই। আমাদের স্নান করা, সাজগোজ, পুজোর যোগাড় সব হয়ে গেল। ঘড়ির কাঁটাও ছটার ঘর ছাড়িয়ে সাড়ে ছটার দিকে গড়িয়ে এল। না এল ঠাকুরমশাই, না উঠল শৌভিক। যত তাড়া দিই,‘ওরে ওঠ রে।আর কত ঘুমাবি?’ ততোবারই লাল চোখ খুলে, মাথাটা বালিশ থেকে আধ ইঞ্চি তুলে, ঘুম জড়ানো স্বরে শৌভিক বলে,‘ আমার শ্বশুরটা ঘুমোচ্ছে। আমি তো জেগেই আছি। স্পিচ ভাবছি।’ সব কথায় আমার বাপকে না টানলে পোষায় না আপদটার।
সময় গড়ায়। একঘন্টা লেটে আসেন ঠাকুর মশাই। পুজো শুরু ও হয়ে যায়। ঘড়ি বলে সাড়ে সাত। শাঁখ বাজাতে বাজাতে আর ধুনুচিকে বাতাস করতে করতে পলকের অবসরে ফোন করি,‘ওঠ রে বাবা। প্যারেডে কি আমার বাবা যাবে? স্পিচটাও তো লিখলি না।’ কি যে হবে। পুরাণ প্রিন্টআউটটা পেলেও হত। কিন্তু শ্রীমতী তুত্তুরী গত পরশু ওটাতেই ফুসফুস আর হৃদপিণ্ড আঁকা প্রাকটিশ করছিলেন। তারপর তাকে কোথায় রেখেছেন, কেউ জানে না।
আটটা পনেরোয় ধপধপে সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরে ফুলবাবু সেজে শৌভিক এসে হাজির। ‘রেডি হয়ে গেছি। শ্বশুরটাকে আর প্যারেডে যেতে হবে না।’ সেই আমার বাপকে ধরে টানাটানি করা। উদয়াস্ত আমার বাপের পিছনে পড়ে থাকে আপদটা।
পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে তড়িঘড়ি লুচি তরকারি খেয়ে, নটা বাজতে দশে মাঠে চলে যাই আমরা। ঠিক নটায় এসে হাজির হয় শৌভিক। সর্বপ্রথমে পতাকা উত্তোলন হয়। অতঃপর জাতীয় সংগীত। তারপর ফুল আর বেলুন দিয়ে সাজানো জিপে চেপে প্লাটুন পরিদর্শন। জিপ ফিরে আসে। এবার ভাষণ দেবার পালা। উদ্বিগ্ন হই, কি বলবে কে জানে। মাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় শৌভিক, গলা ঝেড়ে, ‘সুপ্রভাত। সকলকে নমস্কার’ দিয়ে যে বক্তব্য শুরু করে, পাক্কা ন মিনিট কয়েক সেকেণ্ড পরে যখন শেষ হয়, করতালিতে ভেসে যায় মাঠ। তুত্তুরী শুদ্ধ বলে ওঠে, “কিচ্ছু না দেখে কি সুন্দর বলল বাবা।” আমিও বললাম, কি ভালো বললি রে। স্টেজ থেকে নেমে, দর্শকাসনে বসে, টুপি খুলে, মাথার ঘাম মুছে শৌভিক বলল,‘হ্যাঁ, তবে আমার শ্বশুরটার মত তো নয়।’ এই জন্যই এই লোকটার প্রশংসা করি না। উদয়াস্ত আমার বাপের পিছনে পড়ে
থাকে মাইরি।
No comments:
Post a Comment