Monday, 12 August 2019

অনির ডাইরি ৯ইআগস্ট ২০১৯


যদিও আগস্ট মাস, তবুও বেশ বোঝা যায় পুজো আসছে। লোকাল ট্রেন জুড়ে ঝুটো গয়নাগাটি, রঙ বেরঙের মাথার ক্লিপ, হেয়ারব্যাণ্ডের ফেরিওয়ালাদের ভিড়। সুর করে হাঁকছে মহিলা হকার,“কুর্তি আছে-ল্যাগিংস আছে-প্লাজও”। পাশাপাশি বিক্রি হচ্ছে “সুতির রুমাল- তোয়ালে রুমাল- শান্তিনিকেতনের রুমাল”। সুসজ্জিতা রূপসী দিদিমণিদের মুখে কলেজ স্ট্রীট আর গড়িয়াহাট, “এই দোকানের ঢাকাই ভালো, ঐ দোকানের সিল্ক”। ট্রেনটা যে নড়ছেই না, কারো হুঁশ নেই।
জগদ্দল-কাঁকিনাড়া ছাড়ালে ট্রেনটা একটু ফাঁকা হয়। রোদে হাল্কা সোনা রঙ লাগলেও, দুপাশের নয়ানজুলিতে কাশেরা এখনও মেলেনি ডানা। স্টেশন থেকে লঞ্চঘাট যাবার ৭০০ মিটার পথ জুড়ে শুধু রকমারি দোকানের পসরা। থরে থরে ঝোলে শাড়ি, বিভিন্ন ডিজাইনের ব্লাউজ,নাইটি, ফ্রক, অনামী ব্যান্ডের জিন্স, শার্ট। এই বাজার আমার মুস্কিল আসান। কালি পুজোর আগে, বাবার জন্য মাটির নক্সা বাড়ি, সরস্বতী পুজোর আগে তুত্তুরীর বাসন্তী রঙা শাড়ি, উটকো বিয়ে বাড়ির রঙমিলান্তি ব্লাউজ, ম্যাচিং টিপ বিকিকিনি চলে বছর জুড়ে। হুদা বিউটির লিপস্টিক- আইশ্যাডোও বিক্রি হয়, দোকানদার নাছোড়বান্দা কিনতেই হবে, “ইমপোটেনট(বিলাইতি) জিনিস”। কত দাম গো? বেশী না, চল্লিশ থেকে একশো কুড়ি টাকা। সত্যি? তবে যে নাইকা হাজার দেড় থেকে সাড়ে তিনের কম দেখায় না? বলিনি অবশ্য। হুদা কাট্টানকেও বলিনি, বললে হয়তো এক আধটা ফ্রি স্যাম্পল জুটে যেত-। এইসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে  লঞ্চে উঠি।
চার কিলোমিটার পথ, সময় মেরেকেটে পাঁচ মিনিট। তাই বসার জায়গা পাওয়াটা গৌণ। গলুইয়ের দিকটায় দাঁড়াতে পারলে নিরবিচ্ছিন্ন গঙ্গা দেখা যায়। দূরে জুবিলি ব্রীজের রূপালী ঔদ্ধত্য। ঘোলাটে গঙ্গায় ভেসে যায় পাঁজা পাঁজা পানা। ভরা বর্ষায় অমন হয়। কে জানে কোন গাঁয়ের পানা, কেমন মানুষ তারা-।  কি তাদের গল্প, কি তাদের কাহিনী।
পাশ থেকে কে যেন বলে উঠল,“দিদি একটু-”। চোখ ফিরিয়ে দেখি, যিনি বললেন, তিনি তাঁর জায়গাটা ছেড়ে সরে গেছেন, লঞ্চে মাঝ বরাবর। যাবার আগে আমায় সরে যেতে বলে গেলেন, আমার জায়গায় উবু হয়ে বসলেন এক মাসিমা। সাদাসিধে করে পরা লাল সাদা তাঁতের শাড়ি। কাঁচাপাকা চুল ছোট্ট খোঁপায় জড়ানো। গঙ্গার দামাল হাওয়ায় বেশ এলোমেলো। মাসিমার হাতে একটা সিন্থেটিক বাজার ব্যাগ। ব্যাগ থেকে উঁকি মারছে টু ফোল্ড কালো ছাতার বাঁকা মাথা। মাসি বসে ব্যাগ থেকে বার করলেন একটা দলা পাকানো কাগজের মণ্ড, মণ্ডের ভিতর গোটা দুই তিনেক ভাঁজ করা রুটি। তারপর খেতে লাগলেন। ঠিক আমার সামনেই বসে খাচ্ছেন,চোখ চলেই যাচ্ছে, মাসি ভাঁজ খুলছেন আর রুটি খাচ্ছেন, কিন্তু খাচ্ছেন কি দিয়ে? কিছুই তো নেই। রুটির খাঁজের গভীরে কি কিছু আছে? অফিস টাইমে রান্নাবান্না করে, আমাদের খেতে দিয়ে, বাসন তুলে, রান্নাঘর সাফ করে, আমাদের টিফিন গুছিয়ে প্রায়শঃ নিজের টিফিনটা আর বানাত না মা। তড়িঘড়ি কটা রুটি আর চিনি নিয়ে দৌড়ত। সবাই বেরিয়ে গেলে সারা বাড়ির কাজ গুছিয়ে, বেলা বারোটা নাগাদ জলখাবার খেতে বসত ঠাকুমা। কি জলখাবার, একটা বা দুটো হাতে গড়া রুটি আর একহাতা ডাল। কখনও সখনও ডালও খেত না। একচামচ চিনি আর জল দিয়েই হত জলখাবার। বড় সরল ছিল জীবন। মাটির কাছাকাছি।লোডশেডিং আর কালবৈশাখীর।  মাসিমার রুটি খাওয়া শেষ। একদানা চিনিও ছিল না ভেতরে। এক ঢোঁক জল খেয়ে উঠে দাঁড়ালেন, এগিয়ে গেলেন মুখে এক ফোঁটা  মালিন্য নেই, হতাশা নেই। অভিযোগও বোধহয় নেই।

মুখের মধ্যে শুকনো রুটি চিবানোর স্বাদ নিয়ে পৌঁছলাম অফিসে। আজ আমার ইন্সপেক্টরদের মারামারির দিন। আজ ক্লেম ডে। সপ্তাহজুড়ে বাছাধনেরা যা মে বি অ্যাপ্রুভড করেছে, আজ তার পরীক্ষা। সবার আগে লাইন দেয় দর্প আর সঞ্চিতা। এদের ক্লেমের সংখ্যা ভদ্রসভ্য। ধনিয়াখালির চঞ্চলকে সবাই ভয় পায়। চঞ্চল ঢুকলেই ট্রাফিক জ্যাম। জবরদস্ত পাল্লা দিচ্ছে পোলবার নির্মল আর তার দলবল। মগরা এবার ফেল।

বর্মন সাহেব হেব্বি কড়া হেড মাস্টার। কেউ ভয়ে ওপথ  মাড়ায় না। রীতিমত পাকড়াও করে পাঠাতে হয়, যাও আগে শ্রী সুখেন বর্মনের কাছে পাশ করে এসো।

 প্রতিটা শুক্রবারই শুক্তির মত, পরতে পরতে লুকিয়ে রাখে জীবন। প্রতিটা ক্লেমই যেন একএকখানা ছোট গল্প। সাদাকালো বাংলা সিনেমা। মুক্তার মত হস্তাক্ষরে লেখা শংসাপত্রের তলায় সাপ ব্যাঙ করে লেখা স্কুল থেকে অন্য কোন অনুদান পায় না। এটা কে লিখেছে রে ভাই? রিসিভ্ড্ বানান ভুল। ইংরেজি বাক্য গঠনটা না হয় ছেড়েই দিলাম। ঠিক করিয়ে আনতে ফেরৎ পাঠাচ্ছি, ইন্সপেক্টর মৃয়মান সুরে বলল,“মেয়েটাকে চিনি ম্যাডাম। ভালো মেয়ে। মামার বাড়িতে থাকে। বাবা নেই। মা টা লজেন্স তৈরি করে।”
“ম্যাডাম এই কেসটা কি হবে একটু দেখুন না। এই ছেলেটার মা টা রোজই আসে আর কান্নাকাটি করে। জোয়ান ছেলে হঠাৎ করে পঙ্গু হয়ে পড়েছে। বিছানা থেকে উঠতেই পারে না। বুড়ো মা একা হাতে দেখাশোনা করে।কোন রোজগার পাতি নেই তেমন।” আবেদন পত্রে সাঁটানো রঙীন পাশপোর্ট সাইজের ছবিতে হাসিমুখ এক সদ্য যুবা। দুচোখে টলটলে স্বপ্ন। সঙ্গে আটকানো সরকারী হাসপাতালের শংসা পত্র শোনায় অন্য গল্প। ছেলেটা পঙ্গু, তবে মানসিক ভাবে। বেঁকে বসা মন প্রভাব ফেলছে শরীরে। সব কাগজ ঘেঁটেও বার করা গেল না, কোন অনুচ্ছেদটা প্রযোজ্য।

ডেথ কেসের আবেদন করেছেন স্ত্রী। স্ত্রীকে এসএসসি পরীক্ষা দিতে নিয়ে যাবার পথে বাইক অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন ভদ্রলোক। মহিলা টুকটাক বাড়ি বসে শায়া-ব্লাউজ বানাতেন। অ্যাক্সিডেন্টে আহত হয়ে সেসবও বন্ধ। চাকরীর পরীক্ষাটাও দিতে পারেননি।বাড়িতে ছোট ছোট বাচ্ছা।  টাকাটা বড় দরকার।  অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়া কেস। প্রাপ্য দুলক্ষ। কিন্তু বইটা তো ভদ্রমহিলার নামে। “আমি মরলে, ও বোধহয় পেত, তাই না স্যার?”
দিনান্তে ভারাক্রান্ত মনে কম্প্যুটর শাটডাউন করতে করতে, প্রতি শুক্রবার বড় গর্ব হয় জানেন, গর্ব হয় মানুষ হিসেবে। প্রতিনিয়ত  প্রতিকূল স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে কেমন লড়াই করে যায় মানুষ। আকালেও কেমন স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন দেখতে শেখায় মানুষ। আর সবটুকুই শুধু এ জীবনকে ভালোবেসে।

No comments:

Post a Comment