“হ্যালো ম্যাডাম”, ভোর ভোর হুসেন সাহেবের গলার আওয়াজে চটকা ভাঙল, বাবার সাময়িক অসুস্থতার জন্য বিগত রজনী প্রায় বিনিদ্র কেটেছে, আমাদের। এই মুহূর্তে অবশ্য শিশুর মতই ঘুমাচ্ছে বাবা, তুত্তুরীকে জড়িয়ে। হুসেনের গলা শুনেই মনে পড়ে গেল,আরেঃ আজ তো ঈদ। কুরবানির ঈদ। চার্চ লেনের দিনগুলোতে হুসেন শোনাত কুরবানির কথা। এবারও ব্যতিক্রম নয়, কোচবিহার যেতেই হবে কোরবানির খাসি খেতে। তারপর হুসেন মিঞা আমাকে আর তুত্তুরীকে ঘুরতে নিয়ে যাবে কোচবিহারের বিখ্যাত রাসের মেলায়। ভিড় হয় খুব, তাতে কি, হুসেন মিঞা আছে না। কোথায় ঈদ আর কোথায় রাস- হুসেন ওসব বাহানা শুনতে রাজি নয়। যেতেই হবে, বেবিকে নিয়ে।
মেঘলা আকাশ, টিপটিপে বৃষ্টি। ছুটির দিনের ঘুমঘুম ভোর, জোলো হাওয়ার ফিসফিসানি, খুলে দাও বাতায়ন। কি যেন একটা ওষুধ, সবটা পাওয়া যায়নি। কিনতে যাবার কথা। ভেজা ভেজা পথঘাট, গলির মুখের জাহাজ বাড়ি, উল্টো দিকের সৎসঙ্গে কি এখনও প্রার্থনা সভা বসে? শ্রীনাথ বাবু স্যার ছিলেন ঋত্বিক। প্রতি বুধবারে বসত অধিবেশন। রাস্তায় পাতা হত কাঠের সারি সারি বেঞ্চ। গমগম করত শ্রীনাথ বাবুর গলা। তারপর সমবেত প্রার্থনা। এখন কি হয় কে জানে?
সামনে রাস্তা দুভাগ হয়ে গেছে। বাঁদিকে বুড়ো শিবের মন্দির, মনসাতলা, ক্ষীরের তলা মাঠ, পুরোনো রেশন দোকানের গলি। জনিদার দোকান।পঞ্চাশ টপকেই হঠাৎ করে চলে গেল একদিন জনিদা। পুঁচকে থলথলে অভিজিৎ চাল ওজন করত, মালপত্র গোছাত, কতবার মাসকাবারি দিয়ে গেছে আমাদের বাড়িতে। একবার আমি ভুল করে, পঞ্চাশ খোল আর পাঁচশ শুকনো লঙ্কা লিখেছিলাম। তখনও কলেজে উঠিনি। সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে অভিজিৎ এল মাসকাবারী নিয়ে। বাসন মাজার খোল আর খুঁজেই পায় না মা। সবে বাবা চটি গলিয়ে বেরোতে যাবে, হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির অভিজিৎ। হাতে ইয়া বড় পাঁচশ শুকনো লঙ্কার ঠোঙা। হাসতে হাসতে বাবা বলেছিল,“দুটোই ভজহরি। ” অভিজিৎ এখনও আছে। বয়স বেড়েছে, মুখে দোকানদার সুলভ গাম্ভীর্য ধরা পড়েছে, উচ্চতা যদিও তেমন বাড়েনি। আজকাল দেখলেও চিনতে পারে না। অথবা পারে, কথা বলার সাহস পায় না। ঘুচু একবার বলেছিল,“আমরা তোমায় ভয় পাই ঝুনুদি। হাসলে বা কথা বললে যদি তুমি মুখ ঘুরিয়ে নাও। ”
আর একটু এগিয়ে গেলেই কাশি মামুর মণিহারি দোকান। মারা গেছেন কাশি মামুও। এখন কাকিমা চালান। ওদের মেয়ে রেশমী আমাদের সাথে পড়ত। স্কুলেই রেশমীর মায়ের সাথে আলাপ, তাই কাকিমা। পরে যখন জানলাম, উনিই কাশি মামুর স্ত্রী, আর সংশোধন করা হয়ে ওঠেনি। বড় রূপসী ছিলেন কাকিমা। লম্বা, ছিপছিপে, শ্যামলা রঙ, ঘাড়ের কাছে এলো ঢলঢলে খোঁপা, লম্বাটে প্রসাধনহীন কাটাকাটা মুখ। সময় এতটুকু চিড় ধরাতে পারেনি ওণার সেই প্রশান্ত রূপে।
গলির মুখ থেকে টোটো ধরেও যাওয়া যায়, কিন্তু আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব। তাও পায়ে হেঁটে। তাই বুড়ো শিবের দিকে বাঁকলাম না। ডানদিকের রাস্তাটা ধরে সোজা হাঁটলে, একটা ভয়ানক সরু গলি পড়ে। নামই “মুতো গলি”। পাশাপাশি দুজন ছাড়ুন, একটু বেশী চওড়া হলে একজনই গলবেন না। তবুও ওটাই শটকাট।
গলির উল্টোদিকেই ছিল কেষ্ট কাকুর গম ভাঙানোর দোকান। এছাড়াও ভোর ভোর দুধ আর কাগজ বিলি করতেন কেষ্টকাকু। সোম থেকে শনি কেষ্টকাকু আর রবিবার মদনদার কাগজ। মদন বয়সে কেষ্টকাকুর থেকে অনেক বড় যদিও, গুমোরও খুব। খাঁটি সর্ষের তেলে ভাজা পেঁয়াজি আর ফুলুরি বিক্রি করতেন। পোড়া তেলটা ফেলে দিতেন। ভিড় হত খুব। সন্ধে নামলেই নরসিংহ দত্ত কলেজ থেকে গৃহাভিমুখী কপোতকপোতীরা ভিড় জমাত মদনদার দোকানে।হলদে বাল্বের আলোয়, মুখ পোড়ানো পেঁয়াজীর ভাপে জমে উঠত প্রেম। শেষ নব্বইয়ে আগুন লাগল পেঁয়াজের দরে, যে পাঁচিলের গায়ে গুমটি করে দোকান চালাত মদনদা, তারাই পার্টিকে ধরে তুলিয়ে দিল মদনদাকে। কেন কে জানে? হয়তো প্রমোটারের থাবা। মদনদা ছিল ঐ দলের একনিষ্ঠ সমর্থক। সব মিছিলে যেতেন মদনদা। লিফলেট, ভোটের স্লিপ বিলি করতেন। অথচ তারাই একদিন ভেঙে দিল দোকানটা। অভিমানে পেঁয়াজী ভাজাই ছেড়ে দিল মদনদা।
সেলুনটা অবশ্য এখনও আছে।সাবেকী বাঙালী সেলুন। দাড়ি কামানো সাবান আর পাওডারের গন্ধ মাখা, আয়না মোড়া দেওয়াল। সামনে কাঠের ভারি চেয়ার। একগাল সাবান মেখে বসে কাগজ পড়ে বয়স্করা। বাবাও যায়। দাড়িই কাটুক বা চুল,পাঁচ সাত টাকা এক্সট্রা দিলেই ম্যাসেজ করে দেয় ওরা। দমাদ্দুম কাটারি চালায় ঘাড়ে মাথায়। বুড়ো মালিক ইউপি চলে গেছে,চিরতরে। তার ছেলেরা চালায়। ওরা আজকাল ফেসিয়াল করাও শিখেছে । বাবাকে প্রায় গছায়। “মুখটা চকাচক করে দেব কাকু। ” বেশী না পচাশ টাকার ফেসিয়াল,বাবা কুড়িটাকা দিলেও চলবে।
এতটা পথ হেঁটে এলাম, কয়েক বছর আগে হলেও কেউ না কেউ ঠিক দেখতে পেত এবং চিৎকার জুড়ত, “তুই কেন? বাবা কোথায়?” আজ কেউই বলল না। বলার মত লোকগুলো সব চলে গেছে এক এক করে। কেষ্টকাকুও তো চলে গেলেন। সুপুরুষ, ঋজু মানুষটা। জরাও যাকে স্পর্শ করতে ডরাত-
মুতো গলিটা যদিও একই রকম আছে। পাশ দিয়ে এঁকে বেঁকে গেছে খোলা নর্দমা। যতই নির্মল হোক বাংলা,স্বচ্ছ হোক ভারত, এখনও অনেক বাচ্ছা নর্দমাতে ইয়ে ঝুলিয়ে ইয়ে করে এই গলিতে। ইয়ের লোভে জমায়েত হয় সারমেয়কুল। ঐগুলোকে বড় ভয়। এত সকালে যদিও তারাও ঘুমন্ত মনে হল। বড় গলিতে মেশার মুখে একটা বাড়িতে বাসন্তী পুজো হত। পুঁচকে দুর্গা আসত। অসময়ের ধুনোর মনকাড়া গন্ধ আর ঢাকঢোল, কাঁসর ঘন্টার আওয়াজে কেমন বদলে যেত গলিটা। এখন হয় কি না,কে জানে?
আরো এগোলে, রাস্তাটা বেশ চওড়া। একটা বাড়ি পড়ত, দুই ধারে আর্চওয়ালা দুটো বিশাল দরজা, দরজার মাথায় মাধবীলতার মুকুট, ভিতরে প্রশস্ত খোলা উঠোন, উঠোন টপকে গাড়ি বারন্দা, দোতলায় গোল গোল ঝুল বারন্দা। উঠোনের এককোণে দাঁড় করানো থাকত একটা সাবেকী বড় কালো রাগী গাড়ি। সীমানা বরাবর কত যে গাছ ছিল। উঠোনে খেলে বেড়াত কয়েকটা বাচ্ছা। স্কুল জীবনে বইখাতা-পেন্সিল যাই কিনতে যেতাম, হাঁ করে দেখতে দেখতে যেতাম ইঁট বার করা বাড়িটাকে।মনে হত দেশলাই বাক্সের শহরে এক ঝলক টাটকা বাতাস। বাড়িটা বোধহয় স্মৃতির পাতায় হারিয়েই গেছে। ফ্ল্যাট উঠেছে দেখলাম। দাঁড়িয়ে পড়ে গুনলাম, পাঁচতলা। গোলাপী সাদা ওয়েদার কোট পরা। স্টিলের গ্রীল দেওয়া ব্যালকনি। ব্যালকনিতে বাহারী ইনডোর প্ল্যান্ট।
বড় দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে শহরটা। সামনে একটা বাইক আর একটা সাইকেল গল্প করতে করতে যাচ্ছে। দুজনের হ্যান্ডেলে ঝুলছে বাজার ব্যাগ। কি নিয়ে গল্প এত ওদের? কি বাজার করল, তাই শোনাচ্ছে কি একে অপরকে। শোনাচ্ছে কি বাজারে লেগেছে আগুন। ঠিক যেমন বাজার করে ফেরার পথে, বাবা বা ছোটকাকু গল্প জুড়ত, পরিচিত মুখচেনা সকলের সাথে। কুড়ি টাকার বাজার নিয়ে রিক্সা করে ফিরত এককালে বাবা। কাদের বাড়ি থেকে যেন ভেসে আসছে বাঙলা গান, “আমায় গুণ করেছে, খুন করেছে ও বাঁশি। ” ওপাশের জানলা গলে বেরিয়ে এলেন শাম্মি কাপুর,“বারবার দেখো, হাজার দেখো”। কি হল? আজ কি রবিবার? রঙ্গোলী শুরু হল নাকি? সামনেই বাস রাস্তা। রাস্তার ওপারে থরে থরে বসেছে শাকসব্জী, মেছো বাজারে মাছ। রাস্তায় গেঁড়ি গুগলী নিয়ে বসেছে মাসিরা। রাজকীয় ছাল ছাড়ানো পাঁঠা ঝুলছে সারি সারি। পাশেই মুরগির দোকান থেকে বদ গন্ধ আর চিৎকার ভেসে আসছে আগের মতই। ফলের বাজারে লেগেছে আগুন। নামী বাজারুদের দরদস্তুর তাদের দৈহিক বিভঙ্গে সুস্পষ্ট।পোড়া পেট্রোল, পচা সব্জি, পাঁঠা-মুরগি-মাছের সাথে চারমিনারের গন্ধ ভাসছে বাতাসে। নব্বইয়ের দশক আবার ফিরে এল নাকি? ইশ ফিরে এলে বেশ হয়! পৃথিবীটা যদি স্বপ্নের দেশ হয়? ঝাঁপ ফেলা ওষুধের দোকান আর মুঠো ফোন ভেদ করা খুড়তুতো ভাইয়ের তেড়ে চিৎকার,“আমি এনে দেবো বললাম, বিশ্বাস হল না? তুই গেছিস কি করতে?” ঝপাং করে ফিরিয়ে আনল বাস্তবের রুখা মাটি। নাঃ দিবাস্বপ্ন মোটেই ভালো না। ফেরার পথে টোটো ধরাই ভালো। তার আগে একবার সিঙারা জিলিপির দোকানে ঢুঁ মেরে নিলে মন্দ হয় না, কি বলেন?
No comments:
Post a Comment