Sunday 2 June 2019

অনির ডাইরি ২রা জুন, ২০১৯

এরকম দম্পতি বাস্তবিকই দুর্লভ, যাদের সংস্পর্শে  আমরা দুজনেই স্বচ্ছন্দ। যেখানে কোন সাবটিম থাকবে না। যেখানে পুরুষ সদস্যরা শুধুমাত্র রাজনীতি নিয়ে গুঁতোগুঁতি করবে না।যেখানে আমার বর স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্য নিয়ে বড়দা মার্কা জ্ঞান বিতরণ করতে পারবে এবং অন্যপক্ষ মোটেই হাই তুলবে না বা কান বা নাক খুঁটবে না।  যেখানে উপস্থিত অন্য মহিলা সদস্যটি আমাকে ওজন কমানো বা মাতৃত্ব বা গুছিয়ে সংসার করা বা সন্তানের মুখ চেয়ে চাকরী ছাড়া নিয়ে সুচিন্তিত অথচ অযাচিত মতামত দেবে না। শাশুড়ী পুরাণ খুলে বসবে না বা সন্তানের বিদ্যার্জন বা কোষ্ঠকাঠিন্য বা ইয়ের বর্ণ বিশ্লেষণ করতে বসবে না।  কারণ এই নিয়ে গপ্পের হাঁড়ির ঢাকা খুললেই, কেন জানি না, আমার পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। উপরিউক্ত সমস্ত শর্তাবলী মেনে যাদের পাওয়া যায়, তারা সকলেই এত ভয়ানক ব্যস্ত এবং সর্বোপরি পে কমিশনের দৌলতে মাসের সাত তারিখ কাটলেই এমন হতদরিদ্র যে দেখা করবই বলে গোঁ ধরে বসে থাকলেও আর দেখা হয়ে ওঠে না। হয় শুধু পরিকল্পনা। তারিখ পে তারিখ, মি লর্ড। তারিখ পে তারিখ।
এষা আর অর্জুন হচ্ছে সেই দুর্লভতম দম্পতি তথা বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম। সবথেকে বড় কথা বয়স যেহেতু কম, তাই দেখা করার উদ্যোগও এষাই বেশী নয়। পর্যায়ক্রমে একবার শৌভিককে আর একবার আমায়,“ও দাদা/ও দিদি” করতে থাকে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর শৌভিকের নিদ্রাভঙ্গ হয়,“এষাটা খুব জ্বালাচ্ছে। দেখা করতেই হবে মনে হচ্ছে। ”আমি আর তুত্তুরী একপাক নেচেনি আনন্দে। কোথায় দেখা করবে, এই নিয়ে দড়ি টানাটানি শেষে শৌভিক শেষমেশ ঘোষণা করে,“এক কাজ কর,তোরা আমাদের বাড়িতেই চলে যায়।” অতঃপর বাতানুকূল আবহাওয়ায় গড়াগড়ি খেয়ে গপ্প। তুত্তুরীর বাঁধা জায়গা এষা পিসির কোল। আমাদের গপ্পের গতি বারবার বাধা পায় পিসি ভাইঝির গুপ্ত গল্পের ফিসফিসানিতে। অনেক রাতে যখন এষা অর্জুন বিদায় নিতে চায়, তুত্তুরী তখন গড়াগড়ি দিয়ে কান্না জোড়ে। “আজ রাতে আমি এষা পিসির বাড়ি গিয়ে এষা পিসির সাথে ঘুমাব।” চেনা ছক।

এবার অবিশ্যি, একটু অন্য পথে, কারণ বিগত নির্বাচন প্রায় নিকড়ে নিয়েছে শৌভিক আর এষার প্রাণশক্তি। রিফিল করার জন্য নিছক পানভোজন আর আড্ডাটা অনেকটা স্যালাইনের মত। কোথায় হবে, এই নিয়ে ব্রেন স্টর্মিং অপ্রয়োজনীয়, এষার আদুরে আব্দার মার্কোপোলো। শৌভিকের প্রিয় রেস্তরাঁ। আর মাসেরও সবে ইয়ে এক তারিখ আর কি-
তুত্তুরী যদিও এবার যেতে চাইল না। “নাঃ তোমরাই যাও। তোমরা খালি ইলেকশন- ডিএম-এডিএম করবে। ” আসল কারণটা যদিও বাইশ গজে নিউজিল্যাণ্ড-শ্রীলঙ্কা আর আফগানিস্তান- অস্ট্রেলিয়ার দ্বৈরথ।
শৌভিকের হুকুমনামা ছিল সাড়ে ছটার মধ্যে ঢোকার। এষা-অর্জুন বা আমি কেউই তেমন পাত্তা দিইনি যদিও। সাতটা নাগাদ যখন ঢুকলাম, দিব্যি ফাঁকা গড়ের মাঠ। ওয়েটারদের মধ্যেও ব্যাপক ল্যাদ। সাতটা থেকে ঘড়ির কাঁটা কখন যে নটার ঘরে পৌঁছল, কেউই খেয়াল করিনি বোধহয়।

অদূরাতীতে, মার্কোপোলোতেই জীবনের প্রথম ককটেলটির আস্বাদ গ্রহণ করেছিলাম, নাম ছিল,“ইলেকট্রিক জ্যাম। ” ভডকা-টেকিলা আর ব্লু কিউরাশাও এর অনুপম সংমিশ্রন।অর্ধেকটা নীল আর বাকি অর্ধেকটা ঘোলাটে সাদা।  বাইরে থেকে মনে হয়েছিল এক চুমুক সমুদ্র বুঝি ভরে দেওয়া হয়েছে টলটলে কাঁচের গ্লাসে। তলায় হয়তো পড়ে আছে একখণ্ড রোদ পোয়ানো সোনালী সৈকত। হোমিওপ্যাথি ওষুদ ব্যতিরেকে জীবনে প্রথম অ্যালকোহলের আস্বাদ গ্রহণের দৌলতেই হয়তো, অদ্ভুত ফুরফুরে অনুভূতিতে ভরে উঠেছিল মন আর মাথা।
বহুবছর বাদে আবার ইলেকট্রিক জ্যাম চেখে দেখলাম। এবার বড় বেশী মিষ্টি লাগল খেতে। পরেরটা আর মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করছিল না, ওরাই সাজেস্ট করল,“ব্ল্যাক রাশিয়ান” খেয়ে দেখুন না। একে রাশিয়ান তায় কালো? শুনেই কেমন যেন “মিস জেলী, জ্যামে আটকে গেছে” মার্কা মারকাটারি অনুভূতি হল। মার্টিনি গ্লাসের মত সুন্দর গ্লাসে কৃষ্ণকায় যে বস্তুটি দিল তা মূলতঃ কালো কফি আর ভডকার সংমিশ্রণ,খেতে খেতে বারবার অর্জুন আর আমি একই কথা বলছিলাম,“কেমন যেন। কাশির ওষুধ মার্কা খেতে। ” আর হ্যাঁ, বেশ মিষ্টি বাপু।

খাবার নিয়ে অবশ্য বলার মত কোন বিশেষণই খুঁজে পাচ্ছি না।মার্কোপোলো অনবদ্য। গোটা ঐ চত্বরে, এই অধমের চেখে বেড়ানো, সীমিত সংখ্যক রেস্তোরাঁর মধ্যে নিঃসন্দেহে সেরা।ওদের চেলো কাবাব, অনায়াসে পিটার ক্যাটের চেলোকে সাড়ে বত্রিশ খানা গোল দিতে পারে। পিটার ক্যাটের চেলো আলো করে থাকে যে দুটি শাম্মি কাবাব,বিশ্বাস করুন, তাই দিয়ে তুত্তুরীকে ঠ্যাঙানো যায়। কেমন শক্ত, তেমনি শুকনো। মার্কোপোলোতে ঐটি মুখে দিলেই ফক্কা- অনেকটা বুড়ির মাথার পাকা চুলের মত। একই অনুভূতি তথা অভিজ্ঞতা এবার ওদের গলৌটি কাবাবকে নিয়ে হল।   যখন অর্ডার করা হল, তখনও অওধ- ১৫৯০এ চেখে দেখা গলৌটি কাবাবেরর স্মৃতি মনে করে বেশ বিরক্ত হয়েছিলাম বটে, কিন্তু মুখে দিতেই কেমন যেন গলে গেলাম,হারিয়ে গেলাম কাবাব এবং আমি দুজনেই। ওজনের ঘোড়া এমনিতেই অত্যন্ত অভদ্র বেবাগা, জানি এই সুযোগে দৌড়ে গেল অনেকটাই, তবে কবে যেন তাকে শেষ পাত্তা দিয়েছিলাম? বোধহয় কোনদিনই না। প্রিয়জনেদের সংস্পর্শে এমন একখান নির্ভেজাল আনন্দময় সন্ধ্যার পাশে ওজন যন্ত্র কেয়া চিজ হ্যায়? আর বুধ বা শুক্র গ্রহে যদি যাই, তাহলে তো এই অধমও রীতিমত তন্বী বলেই বিবেচিত হব, নাকি।

No comments:

Post a Comment